পাশ্চাত্য ইসলাম বিরোধী ষড়যন্ত্র (৮ম পর্ব) – শায়খ আব্দুল্লাহ আযযাম (রহঃ)

যুগ যুগ ধরে চলে আসা ষড়যন্ত্র

আল্লাহ তাআলা এ দ্বীনকে আমাদের জন্য পছন্দ করেছেন এবং আমাদের জন্য নবীকুল শিরোমণি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ করেছেন। আর এ দ্বীনের কিছু প্রতীক ও বিধান দান করেছেন এবং একটি সংরক্ষক ঠিক করেছেন। আর তা (সংরক্ষক) হচ্ছে ‘জ্বিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ’ । জ্বিহাদ এ দ্বীনকে রক্ষাকারী একটি দুর্জয় দুর্গ এবং ইসলাম বিশ্বময় তাঁর প্রচার, প্রভাব প্রতিষ্ঠা ও আন্তরিক ধারক প্রাপ্তির আশায় সব সময় এ দুর্গেই ফিরে আসে। যাতে এ দ্বীন কিতাবের পাতার কতিপয় বাক্য ও শব্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে বাস্তব ক্ষেত্রে তাঁর প্রয়োগ ঘটাতে পারে। ‘জ্বিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ’ এটি এমন একটি প্রতীক, যার চতুষ্পার্শ্বে এ দ্বীন রক্ষা করার আন্দোলনকারীরা সমবেত হয় এবং এ দ্বীনের প্রচার ও প্রসারের জন্য ডান হাতে কুরআন ও বাম হাতে তরবারী নিয়ে পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ায়। এ জ্বিহাদই হচ্ছে ইমাম ও খলীফার প্রতিচ্ছবি। তাই মদীনাতে ইসলামের কার্যকর প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বাতিল শক্তি ইসলামের মূলোৎপাটন করার জন্য সর্বশক্তি ব্যয় করেছে। এরপর থেকে তাঁরা ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে। বিশেষ করে ইসলামের খেলাফতকে ধবংস করার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে এসেছে।অতঃপর তাঁরা ইসলামের সর্বশেষ খলীফা সুলতান আবদুল হামীদ রহ.-এর পতন ঘটানোর মধ্য দিয়ে ইসলামের মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেয়। হ্যাঁ !  সুলতান আবদুল হামীদের পর তিনজন বা চারজন খলীফা এসেছে। তবে তাঁরা দুর্বল ছিল। খেলাফতের কার্যকর অস্তিত্ব সুলতান আবদুল হামীদের পতনের মধ্য দিয়ে ১৯০৯ সালেই লুপ্ত হয়ে যায়। আমরা সুলতান আবদুল হামীদ রহ.-এর সে দৃঢ় ভূমিকা সম্পর্কে অবগত আছি, যার কারণে বিশ্বের সমগ্র কুফরী শক্তি তাঁকে নির্মূল করার জন্য ধেয়ে এসেছে। ১৮৯৭ সালে ইয়াহুদীরা সুইজারল্যান্ডে একটি আন্তর্জাতিক ইয়াহুদী কনফারেন্সের আয়োজন করে। এ সম্মেলনে তাঁদের পরিকল্পনা প্রকাশিত হয়। এরপর ইয়াহুদী নেতা হার্টজল সম্মেলন কক্ষে দাঁড়িয়ে বলল, ‘সুধীবৃন্দ ! যদি আমি বলি যে, ইয়াহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, তাহলে বিস্ময়ের কিছু নেই। ইয়াহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হতে হয়তো দশ বছর সময় লাগতে পারে। আর বেশী লাগবে সর্বোচ্চ পঞ্চাশ বছর।’

বাস্তবেই ১৮৯৭ থেকে ১৯৪৭ তথা পঞ্চাশ বছর পর ইয়াহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইয়াহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা তাঁদের মানসিক সিদ্ধান্ত ছিল। এ সিদ্ধান্তকে বাস্তব রূপ দিতে তাঁদের অনেক বাঁধা অতিক্রম করতে হয়েছে। ১৭৮৯ সালে ফ্রান্সে বিপ্লব ঘটাতে সফলকাম হওয়ার পর তাঁরা ইউরোপে ক্যথলিকবাদের পতন ঘটায়। এরপর তাঁদের সামনে রাশিয়ার জার সাম্রাজ্য ও ইসলাম দ্বারা ফিলিস্তিনকে শাসনকারী উসমানী সাম্রাজ্য বাঁধা হিসেবে চিহ্নিত হয়। তাই তাঁরা উসমানী সাম্রাজ্যের পতন ও রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লব ঘটানোর পরিকল্পনা হাতে নেয়। ১৯০৪ সালে যখন রাশিয়া জার্মানে অবস্থিত ইয়াহুদীদের আন্তর্জাতিক হেড কোয়াটারে লোক পাঠিয়ে বন্দুকের জোরে ইয়াহুদীদের গোপনীয় কাগজপত্র ছিনতাই করে নিয়ে আসল, তখন তাদের পরিকল্পনার কথা ফাঁস হয়ে যায়। ঐ গুলোর অনুবাদ হওয়ার পর রুশ অধ্যাপক লিলিচ বলল, ‘শিগগিরই উসমানী সাম্রাজ্য ও রুশ সাম্রাজ্যের পতন ঘটবে’। এ লক্ষ্য অর্জন করার জন্য ইয়াহুদীরা সুলতান আবদুল হামীদকে প্ররোচিত করার চেষ্টায় আত্মনিয়োগ করে। এ উদ্দেশ্যে হার্টজল ১৯০১ সালে সুলতান আবদুল হামীদের কাছে গিয়ে কিছু দাবী দাওয়া পেশ করে। সুলতান তাঁর এ স্পর্ধা দেখে হতভম্ব হয়ে গেলেন এবং প্রহরীকে বললেন, তুমি জান না এ কাফের কোন উদ্দেশ্যে এসেছে ?অতঃপর তিনি চিৎকার দিয়ে বললেন, ওহে নীচু জাতের লোক ! তুমি আমার সামনে থেকে সর। তাঁর সাথে কনস্টান্টিনপলের লীফিমোসীও ছিল। সুলতানের এ তাড়া খাওয়ার পরও হার্টজল আশাহত হয়নি। অতঃপর তুরস্কের অভ্যন্তরে ফ্রীম্যাসন বা জাতিয়তাবাদী আন্দোলন পরিচালনাকারী ইয়াহুদী এক আইনজীবীর সাথে হার্টজল সুলতানের দরবারে ১৯০২ সালে আবারো প্রবেশ করে। তাঁরা  সুলতানের কাছে এক লম্বা দাবী ও আবেদননামা পেশ করে এবং সুলতানের হাতে দেড়শত মিলিয়ন স্বর্ণমুদ্রা তুলে দিয়ে বলে, এ অর্থগুলো (উসমানী) সাম্রাজ্যের ঋণ পরিশোধ, নৌবহর নির্মাণ ও আলকুদসে (যেরুজালেমে) উসমানী সাম্রাজ্যের একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার জন্য। সাথে সাথে এ আবেদনও জানায় যে, সুলতান যেন ইউরোপ ও আমেরিকায় নিজের কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেন। সত্যিই এসব লোভনীয় প্ররোচনা মানুষকে হতভম্ব করার জন্য যথেষ্ট ছিল। অনেক সম্পদ। সে সময় দেড়শত মিলিয়ন স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে একটি শহর বা দেশ কেনা যেত। তাঁদের এসব আবেদন ও প্রস্তাবের মুখে সুলতান আবদুল হামীদ বললেন, তোমরা যে ফিলিস্তিনে হিজরত (পুনর্বাসন) করতে চাচ্ছ, তাঁকে মুসলমানরা রক্ত দিয়ে দখল করেছে। তা তাদের কাছ থেকে আবার দখল করে নেয়া বিনা রক্তপাতে সম্ভব হবে না। ছুরি দ্বারা আমার দেহের কোন অংশকে কেটে ফেলা আমার নিকট ফিলিস্তিন মুসলমানদের হাত থেকে ছুটে যাওয়ার চেয়ে অধিক প্রিয়। আমি ত্রিশ বছর ধরে মুসলিম উম্মাহর খেদমত করে আসছি।আমি আমার বাপ-দাদার ইতিহাসকে এ লজ্জাজনক অপমান দ্বারা কলুষিত করতে চাই না।অতঃপত শেষবারের মত হার্টজলের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার স্বর্ণমুদ্রা তোমার কাছে রাখ।আবদুল হামীদ চলে গেলে তোমরা ফিলিস্তিনকে বিনামূল্যে দখল করে নিতে পারবে। বাস্তবেই যখন সুলতান আবদুল হামীদ চলে গেলেন, তখন তাঁরা ফিলিস্তিনকে বিনামূল্যে দখল করে নিল।যে মসজিদে সুলতান জুমআর নামায আদায় করতেন সে মসজিদের কাছে তাঁর গাড়ীতে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ১৯০৪ সালে তাঁরা তাঁকে হত্যা করার চেষ্টা করল। কিন্তু আল্লাহ তাঁকে রক্ষা করেন। অতঃপর ‘ঐক্য সংস্থা’, ‘উন্নয়ন সংস্থা’ ও ‘তুর্কী যুবক’ নামের কতিপয় জাতীয়তাবাদী সংস্থার মাধ্যমে সুলতানকে হত্যার ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে। আনোয়ার পাশা, জাভিদ পাশা ও তালআত পাশা এরা সবাই আন্তর্জাতিক ইয়াহুদীবাদের হাতের তৈরী লোক ছিল। ইয়াহুদী-খৃস্ট চক্র তাঁদেরকে সুলতান আবদুল হামীদের পতন ঘটানোর জন্য ব্যবহার করেছিল। বর্তমান যেমন পৃথিবীর সকল সংবাদপত্র পাশ্চাত্যের আজ্ঞাবহ, তৎকালীন সময়েও ইসলামী অঞ্চলের পত্রিকাগুলো পাশ্চাত্যের আজ্ঞাবহ ছিল। সকল সংবাদপত্র বাইরের ইঙ্গিতে পরিচালিত হত। এ সংবাদপত্রের লেখক সম্পাদকের অধিকাংশই চিন্তাগতভাবে ইয়াহুদী ছিল। কিন্তু তাঁদের নাম ছিল আহমদ, মুহাম্মদ, আলী,উমর ইত্যাদি। বর্তমানে মুসলিম বিশ্বের পত্র পত্রিকাগুলো দেখুন।আমেরিকা-ব্রিটেন যা বলে, তোতা পাখীর মত তারাও তাই বলছে। আপনাদের যারা চিড়িয়া খানায় গেছেন, তারা হয়তো দেখেছেন তোতা পাখীর অবস্থা। কেউ যদি তোতাপাখীকে বলে ইযিক, তখন সেও বলবে ইযিক। ওদের অবস্থাও এ রকম। আমেরিকা যদি বলে তোমার কী অবস্থা ? তারাও বলবে তোমার কী অবস্থা ? কারণ, তাঁরা যে আমেরিকা ও ব্রিটেনের হাতের গড়া !

তাঁরা ব্রিটেন ও আমেরিকার কোলে লালিত-পালিত হয়েছে এবং তাঁদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতার দীক্ষা গ্রহণ করেছে বা সেখানকার কিংবা এখানকার ফ্রীম্যাসনবাদের ক্লাব সমূহে শিক্ষা অর্জন করেছে। অতঃপর এ সাপগুলোকে তাঁরা ইসলামী অঞ্চলের মূল্যবোধকে ধবংস করার কাজে লাগিয়ে দিয়েছে। ইয়াহুদীদের আন্তর্জাতিক ফ্রীম্যাসনবাদ ১৯০৯ সালের এপ্রিলে  রাতের অন্ধকারে সুলতান আবদুল হামীদকে ক্ষমতাচ্যুত করে। এ রাত্রে দু’টি কাজ সম্পন্ন হয়। প্রথমত বিশ্বের রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে ইসলামের কার্যকর পতন। দ্বিতীয়ত ইয়াহুদীদের হাতে ফিলিস্তিনের পতন। ১৯০৯ সালের এপ্রিলের যে রাত্রে সুলতান হামীদের পতন হয়, কার্যত সে দিনই ইয়াহুদীদের হাতে ফিলিস্তিনের পতন হয় এবং বিশ্ব সভায় ইসলামের মেরুদন্ড সম্পূর্ণ রূপে ভেঙ্গে যায়। এরপর কয়েক বছর তুরস্ক কঠিন সময় অতিক্রম করে এবং প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।আর বৃহৎ সিরিয়ার ফ্রীম্যাসনবাদের হাতে গড়া একজন লোককে তুর্কী বাহিনীর অধিনায়ক বানায়। সে বৃহৎ সিরিয়াকে ইংরেজদের হাতে তুলে দেয়। এ অভিশপ্তের নাম হচ্ছে মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক। সে গ্রীসের সাথে সাইপ্রাস দখল করার জন্যে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। আর মিত্র বাহিনীর দেশ ব্রিটেন, ফ্রান্স ও আমেরিকা তাঁর পাশে এসে দাঁড়ায়। তাঁর নামে জাতীয় সংগীত তৈরী ও সে জাতীয় বীর হওয়ার জন্যেই এ কাজটি করে। আর এতে তাঁর আরো একটি উদ্দেশ্য ছিল, সেটি হচ্ছে , ইংরেজদের পক্ষ থেকে খেলাফতের পতন ঘটানোর দায়িত্ব ও দেশের ক্ষমতা লাভ।অভিশপ্তের স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হল। খেলাফতের পতন ঘটিয়ে ১৯২৪ সালে ক্ষমতা লাভের পর থেকে সে প্রকাশ্যে এবং পাশ্চাত্যের চেয়ে আরো কার্যকর ইসলামের বিরুদ্ধে ভাবে যুদ্ধ শুরু করে।সে ১৯৩৪ সালে মরার পূর্ব পর্যন্ত দশ বছর তাঁর দলের প্রধান কাজ ছিল যেখানেই ইসলামের কোন কিছু পাওয়া যাবে, সেখানে গিয়ে তাঁকে নির্মূল করা। পুলিশকে নির্দেশ দেয়া হয় রাস্তায় কোন হিজাব পড়া মহিলা পেলে হিজাব ছিনিয়ে নেয়ার জন্য। কোন কোন হিজাবপরা মহিলাকে সরকারী কোন অফিস আদালত এমনকি বিমান বন্দরেও প্রবেশের অনুমতি দেয়া হত না। ষাটের দশকে তুরস্কে একটি সমস্যা দেখা দেয়। সমস্যাটির নাম রুমাল সমস্যা। ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ের শরীয়াহ অনুষদে একজন মেয়ে মাথায় রুমাল দিয়ে যায়। তখন বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি ব্যাপারটা নিয়ে বৈঠকে বসে। কিন্তু তাঁরা কোন সিদ্ধান্তে পৌছতে সক্ষম হল না। তাই তাঁরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের কাছে সমস্যাটার সমাধান কামনা করে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ও এ ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্তে পৌছতে পারেনি। তাই তাঁরা সমস্যাটার কথা মন্ত্রীপরিষদের কাছে তুলে ধরে। মন্ত্রীপরিষদ ঘোষণা করে যে, শরীয়াহ অনুষদে মাথায় রুমাল দিয়ে প্রবেশ করা সংবিধান পরিপন্থী। অতএব, হয়তো ছাত্রীটিকে বহিষ্কার করতে হবে নতুবা রুমাল খুলে ফেলতে হবে।

ইসলামের বিরুদ্ধে এ প্রকাশ্য যুদ্ধের মাধ্যমে ইউরোপ অনেক কিছু অর্জন করেছে। তবে তাঁরা মুসলমানদেরকে ঘুমে রাখার জন্য ইসলামের লেবেল গায়ে না লাগিয়ে প্রকাশ্যে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য অনুতপ্ত হয়েছে। টাইম ম্যাগাজিন লিখেছে যে, মোস্তফা কামাল মৃত্যুশয্যায় ব্রিটেনের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে তাঁর কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার প্রস্তাব করেছিল। কারন, সংবিধান মতে প্রধানমন্ত্রী চাইলে যে কারও হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারে। কিন্তু ব্রিটেন ভয় করেছিল যে, এতে তাঁদের গোমর ফাঁস হয়ে যাবে। তাই ব্রিটেন রাষ্ট্রদূতকে কামাল আতাতুর্কের প্রস্তাবে সাড়া না দেয়ার নির্দেশ দিল। কার্যত তুরস্কের শাসক ছিল ব্রিটেনের রাষ্ট্রদূত। আতাতুর্ক ছিল তাঁর পুতুল। কামাল আতাতুর্কের জাহান্নামে পৌছার পর হেকমত ইনানু ক্ষমতায় আসল। সেও কামাল আতাতুর্কের অনুসরণ পূর্বক ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রাখে। সে এসে ঘোষণা দেয় যে, মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক তুর্কী জাতির বীর ও আধুনিক তুরস্কের স্থপতি। এ কথাই এখন ইতিহাস হয়ে গেছে।

তাগূতদের সর্বশ্রেষ্ঠ মডেল আতাতুর্ক

আরব বিশ্বে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতায় আরোহণকারী সকল তাগুতই বলেছে যে, আমাদের আতাতুর্কই আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ত্ব। এ কথা আবদুন নাসের, আনোয়ার সাদাত ও গাদ্দাফীসহ আরো অনেকের মুখ থেকে বের হয়েছে। তবে পশ্চিমারা বলল যে প্রাচ্যে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ তুরস্কের ন্যায় প্রকাশ্য করা যাবে না। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর আমেরিকা বিশ্বের সবচেয়ে ধনী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কারণ, যুদ্ধের কারণে প্রায় দেশের অর্থনীতিতে ধ্বস নেমেছিল। তাই সে প্রাচ্যে ব্রিটেনের স্থান দখল করার চেষ্টা শুরু করল এবং এ অঞ্চলে নব্য আতাতুর্কদের খোঁজে বের হল।

এ অঞ্চলে তাঁর কাজের অভিজ্ঞতা শুরু হয় ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে সিরিয়ায় তাঁর রাষ্ট্রদূতের তত্ত্বাবধানে হুসনী জঈম দ্বারা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। হুসনী জঈম তাঁর মন্ত্রী পরিষদকে বলেছিল যে, আমেরিকা ও ইউরোপ ইসরাঈলের সাথে শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌছানোর জন্য ইসরাঈলের প্রধানমন্ত্রী বিন গোরীনের সাথে আলোচনায় বসতে আমাকে চাপ দিচ্ছে। অতঃপর ইউরোপ ও আমেরিকা যখন দেখতে পেল যে, তাঁর দ্বারা তাঁদের উদ্দেশ্য পরিপূর্ণ অর্জন করা যাবে না , তখন তাঁরা হুসনীর বিকল্প খুঁজতে শুরু করল। অন্যদিকে সবাই বলাবলি করছিল যে শিগগিরই মধ্যপ্রাচ্যে ইসলাম আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে। তাই আমেরিকা সবখানেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করল এবং ইসলামী আন্দোলনকে দমানোর জন্য লোক খুঁজতে শুরু করল।

ইউরোপ ও আমেরিকার সিদ্ধান্তকৃত দুটি বিষয়

ইউরোপ ও আমেরিকা দুটি ব্যাপার পারস্পরিক অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছে। এক. পৃথিবীর কোথাও তাঁরা ইসলামকে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে দিবে না। দুই. ইসরাঈলের নিরাপত্তা ও তাঁকে টিকিয়ে রাখতেই হবে। এ দুটি বিষয় অনেক পূর্ব থেকেই সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। ইসরাঈল টিকে থাকা আবশ্যক। আর (খেলাফতের পতনের পর) সে ইসলাম পৃথিবীতে দ্বিতীয়বার প্রতিষ্ঠিত হতে দেয়া যাবে না, যার নীতির আলোকে একজন শক্তিশালী ব্যক্তি (খলীফা) মুসলমানের কার্য নির্বাহ করবে (শাসন করবে) এবং যার সৈন্যরা তাঁদেরকে ভীত সন্ত্রস্ত করে রাখবে। এ উদ্দেশ্য সাধনে তাঁরা সুক্ষ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। মুসলিম দেশের সৈন্যদেরকে তাঁরা গার্ড অব অনার ও এক ব্যক্তির প্রহরার কাজে নিয়োজিত রেখেছে। প্রচার মাধ্যমকে ধবংস করেছে। প্রচার মাধ্যমের কর্মসূচী শুরু এবং শেষ হয় তাগুতের গুণকীর্তনের মধ্য দিয়ে। এর মাঝখানে সামান্য সময় তাসবীহ তাহলীল ও কুরআন তিলাওয়াত। শিক্ষা ব্যবস্থায় বস্তুবাদী ধ্যান ধারণা ঢুকিয়ে দিয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধ্বংস করছে, মানুষ ও তার সৃষ্টিকর্তার মাঝখানে আবরণ ঢেলে দিচ্ছে। তারা প্রাচ্যকে পাশ্চাত্যের ন্যায় ধর্মহীন করতে যে পরিকল্পনা করেছে, তা বাস্তবায়নের সবচেয়ে বড় উপায় হচ্ছে শিক্ষা ব্যবস্থা ও প্রচার মাধ্যম। কিন্তু আন্দোলনের আত্মপ্রকাশ তাঁদের পথে কাটা হয়ে দেখা দেয়। তাই তাঁরা ইসলামী আন্দোলনকে দমানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করে। কারণ, ইসলামী আন্দোলনের একমাত্র লক্ষ্য মানুষের বাস্তব জীবনে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ অনুশীলন নবায়ন করা। এ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সিরিয়ায় তাঁরা হুসনী জঈমকে ক্ষমতায় আনে। হুসনী জঈমকে ক্ষমতায় আনার এক মাস পূর্বে (১৯১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে) কায়রোর সর্ববৃহৎ সড়কে ইসলামী আন্দোলনের মহান নেতা হাসান আল বান্নাকে হত্যা করা হয়। এর বার দিন পর ইয়াহুদীদের সাথে রুডস চুক্তি সম্পাদিত হয়।

আমেরিকা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল ১৯৫৫ সালে সে মিশরে ব্রিটেনের স্থান দখল করে নিবে। কিন্তু আবার বলল, যদি এত সময় ধৈর্য্য ধারণ করি, তাহলে মুসলমানরা ক্ষমতায় চলে আসবে। তাই সে কিছু সেনা অফিসারের সাথে যোগাযোগ করে যতদ্রুত সম্ভব তাঁর আজ্ঞাবহ একজনকে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আনার পরিকল্পনা গ্রহণ করল। তাঁদের মাধ্যমে সে (আমেরিকা) ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে অগ্নিকান্ড ঘটিয়ে কায়রোকে ছয়মাস অন্ধকারে রাখে।জনসাধারণের জন্য রাতে ঘোরাফেরা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। এ ছয়মাসে সামরিক অফিসার ব্যতীত আর কাউকে বদলির সুযোগ দেয়া হ্য়নি। এ সময়ের মধ্যেই অভ্যুত্থান ষড়যন্ত্রের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। যা পরবর্তীতে জুলাই অভ্যুত্থান ও স্বাধীন সেনা অফিসার অভ্যুত্থান নামে পরিচিত লাভ করে। নেপথ্য নায়ক আমেরিকা অভ্যূত্থানের পুতুলদেরকে তিনটি শর্তে আবদ্ধ করে।

এক. ইসলামী আন্দোলনকে দমন করা।

দুই. পাশ্চাত্যের সমর্থনপুষ্ট ইসরাঈলের নিরাপত্তায় আঘাত না হানা।

তিন. আল আযহারের অস্তিত্বকে বিলীন করা বা তাঁকে এমন এক প্রতিষ্ঠানে রুপান্তরিত করা, যার মাধ্যমে প্রকৃত ইসলামকে ধবংস করে আধুনিক ও প্রগতিশীল ইসলাম অন্য কথায় আমেরিকান ইসলাম প্রচার করা হবে। অর্থাৎ,এমন ইসলাম যেটা কম্যুনিজম ও নাস্তিকবাদের বিরোধীতা করবে কিন্তু আমেরিকাকে এ কথা বলবে না যে, ‘হে অত্যাচারী ! হে জাতিসমূহের রক্তচোষণকারী ! তুমি থাম’। আর ব্রিটেনকেও এ কথা বলবে না যে, ‘হে অনাচারী ! তোমার অবিচার ও অনর্থ সৃষ্টি আর নয়’। অভ্যুত্থান সফল। প্রতারিত হয়ে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা এ অভ্যুত্থানে সমর্থন ও সহযোগিতা যোগায়। ওরা দিনে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের কাছে এসে বলত আমরা তোমাদের সাথে রয়েছি। আর শেষ রাত্রে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেফার্সন সাফরীর কাছে গিয়ে সকল খবরাখবর পৌঁছে দিত। ১৯৫৪ সাকে জনসন ‘শূন্যতাপূরণ’ নামে যে রিপোর্ট তৈরী করে তাতে কীভাবে ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান হবে, তার কথাই বলা হয়। এতে জর্ডানের পানি ভাগকরণ, ফিলিস্তিনীদের বসবাসের জন্য একটি এলাকা প্রতিষ্ঠা এবং আরব ও ইয়াহুদীদের মাঝখানে একটি সীমান্ত প্রতিষ্ঠা যেখানে শান্তিকামী লোকজন বসবাস করবে প্রভৃতি উল্লেখ করা হয়। রিপোর্টের সর্বশেষে যে কথাটি উল্লেখ করা হয়, সেটা হচ্ছে মিসরে যতক্ষণ পর্যন্ত ইসলামী আন্দোলনের অস্তিত্ব থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এ অঞ্চলে শান্তি আসবে না। এ রিপোর্ট পেশ করার কয়েকদিনের মধ্যে ইসলামী আন্দোলনের উপর দমন নিপীড়ন শুরু হয়ে যায়। তড়িঘড়ি করে ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে ফাঁসি দেয়া হয় এবং হাজার হাজার যুবককে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়।

আমাকে জর্ডান ইউনিভার্সিটির এক ছাত্র বলল, উস্তাদ আপনার ভাষণ আমাদের খুব ভাল লাগে।তবে আপনি ভাষণে যে কথায় কথায় আবদুন নাসেরের বদনাম করেন, তার কারণ কি? আমি তাঁর কথার কোন উত্তর দিলাম না। ক্লাস রুমে এসে লেকচার দেয়ার সময় ছাত্রদের বললাম, এক ছাত্র আমার কাছে এ ধরণের প্রশ্ন করেছে। কিন্তু আমি এ লোককে (আবদুন নাসের) ঘৃণা না করে পারি না। কেন জান ? আমি চেষ্টা করলেও তাঁকে ঘৃণা না করে থাকতে পারব না। কারণ, এ লোক আমাদের এ অঞ্চলকে ইসলামী শাসন থেকে বঞ্চিত করেছে। মিশরে যদি ইসলামী খেলাফত কায়েম হত, তাহলে এ অঞ্চলে ইয়াহুদীদের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব হত না এবং এ অঞ্চল থেকে বরং পৃথিবীর দৃশ্যই ভিন্ন রকম হত । সবখানে ইসলাম ও মানবতার জয় হত। কিন্তু ক্ষমতার লোভে এ লোক পৃথিবীর মানুষকে ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় থেকে বঞ্চিত রাখল। কিভাবে আমার অন্তরে এ লোকের প্রতি বিন্দু মাত্র ভালোবাসা থাকতে পারে ? শত চেষ্টা করলেও এটা আমার পক্ষে সম্ভব না। এ লোকের হাতেই এ অঞ্চলে ইসলামের দুরাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। যেদিন থেকে মিশর মুসলিম শাসকদের হাত থেকে চলে গেছে, সেদিন থেকে এ অঞ্চলে (মধ্যপ্রাচ্যে) ইসলামের প্রভাব নিঃশেষ হয়ে গেছে। ১৯৪৯ সালে শায়খ বান্নাকে হত্যা ও ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের উপর অত্যাচারের ষ্টীম রোলার চালানো হয়েছে ইসরাঈল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য। ১৯৫৫ সালে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের আবার দমন করা হয়েছে ইসরাঈলের উন্নতি ও স্থিরতা অর্জন এবং সুয়েজ খাল পর্যন্ত অধিপত্য বিস্তারের জন্য। ১৯৬৬ সালে সাইয়েদ কুতুব ও তাঁর সহকর্মীদের ফাসির কাষ্ঠে ঝুলানো হয়েছে ইসরাঈলের নিরাপত্তার জন্য। অনুরূপ শুকরী মুস্তফা ও সালেহ সারিইয়া প্রমুখকেও মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে একই উদ্দেশ্যে। মিশরে ইসলামী আন্দোলন নিষিদ্ধ করা হয়েছে ইসরাঈলের সাথে কথিত ‘শান্তি আলোচনা’ অব্যাহত রাখার জন্য। পৃথিবীর যেখানেই তাগুতরা কাফিরদের স্বপ্ন পূরণ করে মুসলিম উম্মাহর ক্ষতি সাধন করতে চায়, সেখানেই ইসলামী আন্দোলনের উপর নির্মম নির্যাতন বেড়ে যায়।

এখন আমি অন্য প্রসঙ্গে আলোচনা করব। সিরিয়া কিভাবে রাজতন্ত্র থেকে কম্যুনিস্ট একনায়কদের হাতে চলে গেল। মূলত ইয়াহুদীদের যোগসাজগেই সিরিয়ার রাষ্ট্র ক্ষমতা কম্যুনিস্ট নুসাইরী সম্প্রদায়ের হাতে চলে যায়। ইয়াহুদীরা পরোক্ষভাবে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করে এবং রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থানের ইন্ধন যোগায়। ফ্রান্সে ইয়াহুদীদের ইন্ধনে রাজতন্ত্রের অবসান হয় এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থা চালু হয় । সে সময় ইহুদীরা স্লোগান তুলছিল- ‘আমরা সর্বশেষ পাদ্রির নাড়িভুড়ী দিয়ে সর্বশেষ রাজাকে ফাঁসিতে ঝুলাব।’ কারণ, রাজতন্ত্রে কিছু সমস্যা থাকলেও রাজারা কোন সময় মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে না। কারণ, রাজাকে সব সময় মানুষের শ্রদ্ধাভাজন থাকতে হয়। না হয়  রাজতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষা পায় না। ওপর দিকে সামরিক একনায়ক সরকারগুলো সম্পূর্ণ এর বিপরীত।এরা জনগণকে লাঠির জোরে শাসন করে। সম্মানিত ব্যক্তিকে অসম্মানিত করে এবং অসম্মানিত ব্যক্তিকে সম্মানিত করে। যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

“কেয়ামতের পূর্বে প্রতারণার একটা সময় আসবে, যখন আমানতদারকে প্রতারক বলা হবে এবং প্রতারককে আমানতদার বলে গণ্য করা হবে, মিথ্যাবাদীকে সত্যবাদী বলা হবে এবং সত্যবাদীকে মিথ্যাবাদী বলা হবে। নিকৃষ্ট লোকেরা উপরে উঠে যাবে এবং শ্রেষ্ঠ লোকেরা নিঃশেষ হয়ে যাবে।”

অবিচারী ও নিম্নশ্রেণীর লোকেরা ক্ষমতায় আসবে। ভালো লোকদেরকে দেশদ্রোহীতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার অভিযোগে ফাঁসি দেয়া হবে। আরব রাষ্ট্র মিশর, সিরিয়া, জর্ডান, ইরাক, লিবিয়া, আলজেরিয়া ও তিউনেশিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্রে বর্তমান এ অসৎ ও নিম্নশ্রেণীর লোকেরা ক্ষমতায়। ভালো লোকদের উপর সেখানে চলছে জুলুম নির্যাতন। ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের উপর চলছে পাশবিক নির্যাতন । তাদেরকে ফাসির কাষ্ঠে ঝুলানো হচ্ছে। তবে আমাদের আশা এ দেশগুলোর ভবিষ্যত একমাত্র ইসলামই।

পুনর্জাগরণ

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা বলেন-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا هَلْ أَدُلُّكُمْ عَلَىٰ تِجَارَةٍ تُنجِيكُم مِّنْ عَذَابٍ أَلِيمٍ [٦١:١٠]

تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَتُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنفُسِكُمْ ۚ ذَٰلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِن كُنتُمْ تَعْلَمُونَ [٦١:١١]

يَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَيُدْخِلْكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ وَمَسَاكِنَ طَيِّبَةً فِي جَنَّاتِ عَدْنٍ ۚ ذَٰلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ [٦١:١٢]

وَأُخْرَىٰ تُحِبُّونَهَا ۖ نَصْرٌ مِّنَ اللَّهِ وَفَتْحٌ قَرِيبٌ ۗ وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِينَ [٦١:١٣]

“হে মুমিনগণ ! আমি কি তোমাদেরকে এমন এক ব্যবসার সন্ধান দিব, যা তোমাদেরকে যন্ত্রণদায়ক শাস্তি থেকে মুক্তি দিবে। (আর তা হচ্ছে এই যে) তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি ঈমান আনবে এবং আল্লাহর পথে তোমাদের  জান ও মাল দ্বারা জ্বিহাদ করবে। তোমাদের এ কাজই তোমাদের জন্য সর্বোত্তম যদি তোমরা জান। তিনি তোমাদের অপরাধসমূহ ক্ষমা করে দিবেন এবং তোমাদেরকে প্রবেশ করাবেন এমন জান্নাতে, যার তলদেশে দিয়ে প্রবাহিত হয় নদীসমূহ ও (তোমাদেরকে প্রবেশ করাবেন) স্থায়ী জান্নাত সমূহের উন্নত আবাসস্থলে। আর এটাই হচ্ছে মহা সফলতা। আর তোমরা তো আখেরাতকে ভালবাস।আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য সমাগত ও বিজয় নিকটবর্তী। আর আপনি মুমিনদেরকে সুসংবাদ দিন।”[আসসাফঃ ১০-১৩]।

সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যবসা

রাব্বুল আলামিন আমাদেরকে নসীহত ও উপদেশ দিচ্ছেন। তাঁর উপদেশ যথাযথ, তার ওয়াদা সত্য ও তাঁর কথা সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী। কতইনা সুন্দর তাঁর কথা ‘আমি কি তোমাদের একটি ব্যবসার সন্ধান দিব?’ এটা সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যবসা। আল্লাহ ও বান্দার মাঝে সম্পাদিত ব্যবসা । ক্রেতা মহান আল্লাহ আর বিক্রেতা আপনি। অতএব আপনি অনেক উপরে উঠে গেলেন। আপনি রাব্বুল আলামীনের সাথে বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদিন করছেন। এর চেয়ে বড় সম্মানের বিষয় আর কী হতে পারে ? বলা হয় যে, অমুক সৌদি আরবে সিকো কোম্পানির এজেন্ট। অর্থাৎ , এ একটা বিশাল ব্যাপার। অতএব,যে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলার ব্যবসার এজেন্ট তাঁর কেমন মর্যাদা?সপ্তাকাশ, পৃথিবী ও উভয়ের মাঝখানে যা আছে সবকিছু তাঁরই মালিকানায়।

আমাকে একজন বলল , আমি আমার দেশে ফিরে যেতে চাই। বললাম, কেন ?বলল, সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্তির জন্য। বললাম, তুমি কি আল্লাহর সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত থেকে বাদ পড়ে তাগুতের সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হতে চাও ? ভাই তুমি এখানের সৈন্য তালিকায় নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত কর। আল্লাহ বলছেন- انفِرُوا خِفَافًا وَثِقَالًا  “তোমরা হালকা ও ভারি অস্ত্র নিয়ে অভিযানে বেড়িয়ে পড়।”[তাওবাহঃ৪১]।

এখানের সেনাবাহিনীতো আল্লাহর সেনাবাহিনী। তুমি ওখানে কয়েক বছর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে একটা সার্টিফিকেট পাবে। আর এখানে যে সার্টিফিকেট পাবে, তা হচ্ছে জান্নাতের সার্টিফিকেট। ঐ জান্নাতের প্রশস্ততা আসমান ও যমীনের প্রসস্ততার সমান। ওখানে তুমি বিশ বছর চাকুরী করে একটি ঘর তৈরী করবে এবং একটি সুন্দরী বিয়ে করবে আর কী। আর তুমি যদি এখানে আল্লাহর বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত থাক, তাহলে বাহাত্তরটি ডাগর চক্ষু বিশিষ্ট হূরকে বিয়ে করতে পারবে ও অনেক প্রাসাদ লাভ করবে। প্রত্যেক প্রাসাদ মনিমুক্তা দ্বারা কারুকাজকৃত দৈর্ঘ্যে সত্তর মাইল এবং এর দরজা সবুজ মরকত (মণি) দ্বারা তৈরি।

তুমি এখানে হয়তো একজন সুন্দরী সৌদী বা জর্ডানী কিংবা ইয়েমেনী মেয়ে বিয়ে করবে। কিন্তু ওখানে যে মহিলা পাবে সে সত্তরটি পোশাকে সজ্জিত থাকবে। ঐ সত্তরটি কাপড় একটার উপর একটা পরবে। কিন্তু তারপরও তাঁদের পায়ের নলার মগজ দেখা যাবে। এ ব্যবসার চুক্তি সম্পাদনকারী ক্ষতিগ্রস্থ হয় না। কারণ, এ ব্যবসার ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহ ও তোমার মাঝে হচ্ছে।তিনি ক্রয়কারী আর তুমি বিক্রয়কারী আর চুক্তি সম্পাদনকারী হচ্ছেন আমানতদার নবী সাল্লাল্লাহি আলাইহি ওয়াসাল্লাম। যে চুক্তি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে সেটা কোন মুন্সির হাতে রক্ষিত নয়, সে চুক্তি তাওরাত, ইঞ্জিল ও কুরআনেই রক্ষিত। কুরআন কখনো নষ্ট হবে না। তাই তোমার ভয়ের কোন কারণ নেই। এ কুরআন সরকারী রেজিষ্ট্রী বুক নয়, যা অনেক সময় সরকার পরিবর্তন হওয়ায় পুড়ে ফেলা হয়। তোমার চুক্তিনামা তো সম্পাদিত হয়েছে আল্লাহর সাথে। তাই এ চুক্তিনামা কখনো পরিবর্তিত হবে না, নষ্ট হবে না এবং পুড়েও যাবে না। আল্লাহর এ প্রতিশ্রুতির কথা সরাসরি তাঁর কাছ থেকে শুনুন-

إِنَّ اللَّهَ اشْتَرَىٰ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُم بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ ۚ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَيَقْتُلُونَ وَيُقْتَلُونَ ۖ وَعْدًا عَلَيْهِ حَقًّا فِي التَّوْرَاةِ وَالْإِنجِيلِ وَالْقُرْآنِ ۚ وَمَنْ أَوْفَىٰ بِعَهْدِهِ مِنَ اللَّهِ ۚ فَاسْتَبْشِرُوا بِبَيْعِكُمُ الَّذِي بَايَعْتُم بِهِ ۚ وَذَٰلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ [٩:١١١]

“আল্লাহ মুমিনদের কাছে থেকে তাঁদের সম্পদ ও প্রাণসমূহ জান্নাতের বিনিময়ে ক্রয় করে নিয়েছেন। তারা আল্লাহর পথে লড়াই করবে এবং এতে তাঁরা (শত্রুদের) মারবেও এবং (শত্রুদের হাতে) মরবেও। এ ব্যাপারে যে প্রতিশ্রুতি রয়েছে তাওরাত, ইঞ্জিল ও কুরআনে, তাতে তিনি অবিচল। আর আল্লাহর চেয়ে বড় প্রতিশ্রুতি রক্ষাকারী আর কে হতে পারে ? অতএব, তোমরা যে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছ, তা নিয়ে আনন্দিত হও, আর এ হল মহা সাফল্য।”[আততাওবাহঃ১১১]।

জ্বিহাদ মানেই কিতাল

কুরআন ও হাদীসে যে সব জায়গায় জ্বিহাদ শব্দটি সাধারণ ভাবে এসেছে, সেখানে জ্বিহাদ মানে হচ্ছে কিতাল।আল্লামা ইবনে রুশদ বলেছেন-

‘যেখানে জ্বিহাদ শব্দটি সাধারণভাবে উল্লেখ হয়েছে, সেখানে জ্বিহাদের অর্থ কিতাল বিসসাইফ তথা তরবারী দ্বারা যুদ্ধ করা । আর কাফেরদের সাথে তরবারীর যুদ্ধ ততক্ষণ পর্যন্ত চলবে, যতক্ষণ না তাঁরা লাঞ্ছিত হয়ে স্বীয় হস্তে জিযয়া না দিবে।’

অতএব, অপব্যাখ্যা করে কুরআনের আয়াত ও আল্লাহর পরিভাষা সমূহের অর্থ বিকৃত করবেন না। জিহাদের অর্থের পরিবর্তন করবেন না। জিহাদ মানে শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করা। এটাই জ্বিহাদের শরয়ী অর্থ। চেয়ারে বসে চা পান ও আপেল খেয়ে ইসলাম সম্পর্কে লেখালেখি করা বা মিম্বারে দাঁড়িয়ে খুতবা দেয়ার নাম জ্বিহাদ নয়। অনুরূপ কোন মসজিদে গিয়ে ঘন্টা দুয়েক সভা করাকেও আল্লাহর রাস্তায় বের হওয়া বলে আখ্যায়িত করা যায় না। ‘আল্লাহর রাস্তা’  বাক্যটি যখন সাধারণভাবে আসে তখন জ্বিহাদের ন্যায় তাঁর অর্থও হয় কিতাল।

হাদীসে যে আছে-“আল্লাহর রাস্তায় এক সকাল বা এক সন্ধ্যা” তাতে আল্লাহর রাস্তা থেকে উদ্দেশ্য কিতালই। তাই কুরআনের আয়াতের এমন অর্থ করা উচিত নয়, যা আমাদের জ্বিহাদ থেকে বিরত থেকে আমাদের ধবংসের পথে থাকার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। কেননা জ্বিহাদের অর্থ হচ্ছে কিতাল। আর ফী সাবীলিল্লাহর অর্থও কিতাল।

“তোমরা আল্লাহর রাস্তায় তোমাদের মাল ও প্রাণ দিয়ে জ্বিহাদ করবে। তোমাদের এ কাজ তোমাদের জন্য কল্যাণকর”। এ কাজ অমুকের সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার চেয়ে উত্তম, দেশী-বিদেশী কোম্পানীর সাথে ব্যবসা করার চেয়ে উত্তম।

শহীদের সবকিছু ক্ষমা করে হবে

আল্লাহর কথা “يَغْفِرْ لَكُمْ زُنُوبَكُمْ” “তিনি তোমাদের গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন” এর অর্থ কী ?অবশ্যই সকল গুনাহ। কারণ, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা  مِنْ زُنُوبِكُمْ “তোমাদের কতিপয় গুনাহ” বলেনি। কুরআনে যে সকল স্থানে يَغْفِرْ لَكُمْ বলা হয়েছে, সেগুলির অধিকাংশের পরে مِنْ زُنُوبِكُمْ এসেছে। আর مِنْ زُنُوبِكُمْ আসলে অর্থ হয় কতিপয়। কিন্তু এখানে বলা হয়েছে শুধু زُنُوبَكُمْ । তাই এখানে অর্থ হবে সকল গুনাহ। কারণ, زُنُوبَ শব্দটি বহুবচন এবং তা كُمْ সর্বনামের সাথে সংযুক্ত। আর বহুবচন যখন সর্বনামের সাথে সংযুক্ত যুক্ত হয়, তখন ব্যাপকতার অর্থ প্রদান করে। অর্থাৎ, সকল গুনাহই ক্ষমা করা হবে এমনকি ঋণও। হ্যাঁ, যদি শিরক থেকে পূর্বে থেকে তাওবা না করে মারা যায়, তাহলে তা ক্ষমা করা হবে না।

ঋণ রেখে জিহাদে অংশগ্রহণ

শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াকে প্রশ্ন করা হল, একজন মানুষের ঋণ রয়েছে এবং তাঁর উপর জ্বিহাদের জন্য বের হওয়াও ফরয হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাহলে সে কী করবে ? বললেন, ‘তাঁর দু’অবস্থা হতে পারে। যদি তাঁর নিকট ঋণ পরিশোধ করার সম্পদ না থাকে, তাহলে সে জ্বিহাদের জন্য বের হয়ে পড়বে। অর্থাৎ সম্পদ উপার্জন করে ঋণ পরিশোধ করা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে না।’ কারণ, ঋণ রেখে যদি তুমি হজ করতে পার, তাহলে জ্বিহাদের মত গুরুত্বপূর্ণ কাজ কেন করতে পারবে না ? ঋণ পরিশোধের দায়িত্ব অন্য কাউকে দেয়া যায়। কিন্তু জ্বিহাদ সরাসরি নিজে গিয়ে করতে হয়। অতএব, তোমার কাছে ঋণ পরিশোধের টাকা না থাকলে জ্বিহাদের বের হয়ে পড়।তুমি শহীদ হলে আল্লাহ তোমার ঋণ পরিশোধ করে দিবেন। “শহীদের জন্য ঋণ ছাড়া বাকী সব ক্ষমা করা হবে ”-এ হাদীসের ব্যাখ্যায় আলেমগণ বলেছেন, এটা এমন ঋণের ব্যাপারে বলা হয়েছে যা পরিশোধের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ঋণ গ্রহীতা পরিশোধে টালবাহানা করে। তবে যদি তাঁর কাছে ঋণ পরিশোধের করার মত সম্পদ না থাকে কিন্তু পরিশোধ করা তাঁর পাক্কা নিয়ত থাকে, তাহলে তাঁর পক্ষ থেকে আল্লাহই সে ঋণ পরিশোধ করে দিবেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

“যে পরিশোধ করার নিয়্যতে মানুষ থেকে ঋণ নেয়, (সে পরিশোধ করতে না পারলে) আল্লাহ তাঁর পক্ষ থেকে পরিশোধ করে দিবেন”[বুখারী]।

অতঃপর কিয়ামতের দিন এ দেনাদারের প্রতি তাঁর পাওনাদারকে সন্তুষ্ট করিয়ে দিবেন।বলবেন, তোমাদের ভাইকে (দেনাদার) ক্ষমা করে দাও। তারা বলবে পারব না। তখন বলবেন তোমাদের পিছনে তাকাও। পিছনে তাকালে তাঁরা কিছু প্রাসাদ দেখতে পাবে। তারা বলবে, হে আল্লাহ ! এ প্রাসাদগুলো কাদের ? বলবেন, তোমাদের, যদি তোমাদের ভাইকে ক্ষমা করে দাও। একথা শুনে তাঁরা তাঁকে ক্ষমা করে দিবে। কারন, কিয়ামতের দিন সে আর টাকা নিয়ে কী করবে ? সে তো আর মার্সিডিস গাড়ী কিনতে পারবে না।

ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, ‘আর যদি ঋণ গ্রহীতার কাছে ঋণ পরিশোধ করার সামর্থ্য থাকে এবং তাঁর কাছে সে ঋণ পরিশোধ করার সময় হাতে আছে, তাহলে সে ভেবে দেখবে, পাওনাদার ঋণের টাকাগুলো জিহাদে ব্যয় করবে তাহলে ঋণ পরিশোধ করে দিবে। আর যদি দেখে সে টাকাগুলো পেয়ে প্রবৃত্তির চাহিদা ও ভোগ সামগ্রী ক্রয় করবে, তাহলে তাঁর ঋণ পরিশোধ করবে না।’ এটা আল্লামা ইবনে তাইমিয়ার কথা। এ কথাটা তাঁর ফতওয়া কুবরা-এর চতুর্থ খন্ডের ১৮০/১৮১ পৃষ্ঠায় দেখতে পাবেন।

ভাই একথা কেন বলা হল চিন্তা করুন। আল্লাহর দ্বীনকে পৃথিবী থেকে মুছে ফেলা হচ্ছে।মুসলমানের অধিকার পদদলিত করা হচ্ছে, তাদের রক্ত ঝরানো হচ্ছে। এমন মুসলমানও রয়েছে, টাকার অভাবে জুতা কিনতে না পেরে যাদের পা ছিড়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় তুমি হাজারো ঋণ গ্রহীতা হলেও এমন লোককে তোমার টাকা দেয়া জায়েয না হবে যে ৮১-৮৭ মডেলের মার্সিডিস গাড়ী কেনার জন্য পঞ্চাশ হাজার রিয়াল কিংবা পঞ্চাশ হাজার দিরহাম ব্যয় করে। এ টাকা দ্বারা মুজাহিদদের কয়েকটি ফ্রন্ট চালু করা যাবে। এ টাকা দিয়ে তুমি মুজাহিদদের জন্য জুতা ক্রয় কর।ইনশা আল্লাহ তুমি ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে। এটা নির্বোধদের দেয়ার চেয়ে উত্তম। আল্লাহ বলেন-

وَلَا تُؤْتُوا السُّفَهَاءَ أَمْوَالَكُمُ الَّتِي جَعَلَ اللَّهُ لَكُمْ قِيَامًا

“আর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা যে সম্পদগুলোকে তোমাদের জীবন-যাত্রার অব্লম্বন করে দিয়েছেন তা নির্বোধদের হাতে তুলে দিওনা।”[সূরা নিসাঃ৫]।

ধন সম্পদ দিয়ে কী করতে হবে তাও তিনি বলেছেন-

وَجَاهِدُوا بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنفُسِكُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ

“তোমরা তোমাদের ধন-সম্পদ দিয়ে জ্বিহাদ কর।”[তাওবাহঃ৪১]

অন্যান্য ইবাদতের চেয়ে জ্বিহাদ শ্রেষ্ঠ

কুরআন ও হাদীসে জ্বিহাদের বড় গুরুত্ব রয়েছে। জিহাদের উপর কোন ইবাদত এমনকি নামাযকেও অগ্রাধিকার দেয়া যায় না। জিহাদ নামাযের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ইমাম ইবনে তাইমিয়া তাঁর ফতওয়ায় বলেছেন-

‘হানাদার যে শত্রু দ্বীন ও দুনিয়া উভয়ের ক্ষতি করে ঈমানের পর তাঁকে হঠানোর চেয়ে কোন বড় ফরয কাজ আর নেই ‘।

প্রথমে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ। এরপর হানাদার শত্রুকে হটানো, যারা মুসলমানের দ্বীন ও দুনিয়া উভয়ের উপর আঘাত করে তাঁর ক্ষতি সাধন করছে, যেমন রুশ, ইয়াহুদী ও অন্যান্যরা। তাই প্রথমে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ অতঃপর হানাদারকে হটানো। অতঃপর নামায, রোযা ও হজ। তাই আল্লামা ইবনে রুশদ বলেছেন-

‘জ্বিহাদ ফরয হওয়ার বিষয়টি যখন নিশ্চিত হয়ে যায়, তখন তাঁকে উম্মতের ঐক্যমতের ভিত্তিতে ফরয হজের উপর অগ্রাধিকার দিয়ে হয়।’

ভাই তুমি কিভাবে হজে যেতে চাচ্ছ অথচ মুসলমানদের হত্যা করা হচ্ছে। তুমি এতে পাঁচ থেকে ছয় হাজার দিরহাম ব্যয় করছ অথচ এ অর্থগুলো দিয়ে তুমি আফগানিস্তানে মুজাহিদদের একটি ফ্রন্ট চালু করতে পার। তুমি গিয়ে বলছ- ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইকা’। তিনিইতো তোমাকে বলেছেন-

انفِرُوا خِفَافًا وَثِقَالًا

“তোমাদের জ্বিহাদের জন্য হাল্কা ও ভারি সরঞ্জাম নিয়ে বের হয়ে পড়। ”[তাওবাহঃ৪১] ।

তুমি আল্লাহর রাস্তায় বের হয়ে বল ‘ লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইকা’। তোমার তো ওখানে তালবিয়া বলা সহজ। তুমি তালবিয়া বলছো ওখানে বিমানে বসে, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত স্থান থেকে এমনকি আরাফাতেও ছায়া আপেল এবং ঠাণ্ডা পানির ব্যবস্থা রয়েছে। আর এখানে তো গরম, শুষ্কতা, শীত, বরফ, ক্লান্তি ও পিপাসার সম্মুখীন হতে হয়। ‘ লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক ‘ এর বাস্তবতা তো এখানেই অধিক বিদ্যমান।

সম্পদ দ্বারা জ্বিহাদ করার ব্যাপারে আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রহ.-কে প্রশ্ন করা হল, আমরা যদি জিহাদে যাই, তাহলে কিছু লোক অভাবের কারণে মারা যাবে। এ অবস্থায় আমরা কী করব ? তিনি বললেন, অভাবীরা মারা গেলেও জিহাদে যাও। কারণ, মুসলমানরা যদি পরাজিত হয়, তাহলে ধনী-গরীব সকলেই মারা যাবে এবং দ্বীন-দুনিয়া উভয়ই ধ্বংস হবে।