ইসলাম কি তরবারীর মাধ্যমে প্রসারিত হয়েছিল? – একটি চতুরতাপূর্ণ প্রশ্ন – উত্তর দিয়েছেন শায়খ সালেহ আল মুনাজ্জিদ

আলহামদুলিল্লাহ, আমরা ইতোপূর্বে আলোচনা করেছি, (দ্র 34830 ইংরেজি ভাষায়) জিহাদ দুই প্রকারের হয়ে থাকে; লড়াইয়ের জন্য নিজে থেকে অগ্রসর হওয়া এবং আত্মরক্ষার্থে জিহাদ করা অর্থাৎ দুই প্রকারের জিহাদের একটি হচ্ছে আক্রমণাত্মক জিহাদ ও অপরটি আত্মরক্ষামূলক জিহাদ।

নিঃসন্দেহে আক্রমণাত্মক জিহাদের জন্য পদক্ষেপ ও প্রস্তুতি নেয়ার সাথে ইসলামের প্রসারের একটি বিরাট প্রভাব রয়েছে, এর মাধ্যমেই দলে দলে মানুষদের আল্লাহর দীনের দিকে নিয়ে আসা যায়। আর একারণেই, শত্রুদের অন্তর সদা সর্বদা জিহাদের ভয় কম্পমান থাকে।

ইংরেজি ভাষার একটি ম্যাগাজিন মুসলিম ওয়ার্ল্ড বলছে, “পশ্চিমা বিশ্বে অবশ্যই এক ধরণের ভয় কাজ করতে পারে, এর অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে মক্কায় সেই প্রথম ইসলামের প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইসলামের অনুসারীদের সংখ্যা কখনো কমেনি, বরং এটা সব সময় শুধু বৃদ্ধি পেয়েছে আর প্রসারিত হয়েছে। উপরন্তু ইসলাম নিছক একটি ধর্ম নয়, বরং এর অন্যতম একটি খুঁটি হচ্ছে জিহাদ”।

রবার্ট বেন বলেন, “মুসলিমরা আগেও একবার গোটা দুনিয়া বিজয় করে ছেড়েছে, আর এটা তারা আবারও করতে পারে”। ওরিয়েন্টালিস্টরা ইসলামের নামে বিষোদগার করে থাকে এই দাবী করার মাধ্যমে যে, এটা তরবারীর মাধ্যমে প্রসারিত হয়েছে।

প্রাচ্যবিদ থমাস আরনল্ড তার একটি বই “The Preaching of Islam” এ লিখেছেন, ইসলাম তরবারীর মাধ্যমে প্রসারিত হয়নি, বরং এটা প্রসারিত হয়েছে শান্তিপূর্ণ দাওয়াহর মাধ্যমে, কোন ধরণের শক্তি প্রয়োগ ছাড়াই; উদ্দেশ্য মুসলিমদের মাঝে জিহাদের চেতনাকে বিনষ্ট করে দেয়া আর প্রমাণ করা যে, ইসলাম তরবারীর মাধ্যমে প্রচারিত প্রসারিত হয়নি।

আর মুসলিমরা (এভাবেই) তাদের সেই সাজানো ফাঁদে ধরা দিল। একদিকে যখন তারা শুনতে পেল, প্রাচ্যবিদেরা (ওরিয়েন্টালিস্ট) অভিযোগ করছে যে, ইসলাম তরবারীর মাধ্যমে প্রসারিত হয়েছে, তারা বলতে লাগল, “তোমরা ভুল করছো, আরে তোমাদের নিজেদের লোকের কাছ থেকেই এর খণ্ডন হচ্ছে, তোমাদের নিজেদের লোকেরাই তোমাদের এই দাবীর বিরোধিতা করছে, এই যে থমাস বলেছে এই কথা, এটা ইত্যাদি”।

মুসলিমদের মাঝে যারা পরাজিত মানসিকতার অধিকারী তারা এগিয়ে এল ইসলামকে রক্ষা করতে ! আর তারা ইসলামকে এই মিথ্যা অভিযোগের হাত থেকে মুক্ত করতে চাইল ! তাই ইসলাম তরবারীর মাধ্যমে প্রসারিত হয়েছে, একথা তারা অস্বীকার করলো, আর তারা বললো, ইসলামে জিহাদ বলে কিছু নেই, অবশ্য আত্মরক্ষার জন্য হলে ভিন্ন কথা। তাদের দৃষ্টিতে ইসলামে নিজে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে আক্রমণাত্মক জিহাদ বলে কিছু নেই।

অথচ এ ধরণের মন্তব্য সত্যনিষ্ঠ মুসলিম আলেমগণের বক্তব্যের বিরুদ্ধে যায়, কুর’আন সুন্নাহর দলীল থেকে প্রমাণাদি উপস্থাপনের বিষয়টি তো আরো দূরে।

শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া তাঁর মাজমু আল ফাতওয়া ২৮/২৬৩ এ বলেন,উদ্দেশ্য হচ্ছে সকল ধর্ম, মতবাদ হতে হবে শুধুমাত্র এক আল্লাহর জন্যে, আর আল্লাহর কালেমার দাবী হচ্ছে তা সবকিছুর উপরে শ্রেষ্ঠ। আল্লাহর কালাম হচ্ছে শ্রেষ্ঠ বাণী যার মাধ্যমে আল্লাহর কিতাবে তাঁর বক্তব্য সংরক্ষিত আছে, আর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন, “আমি আমার রসূলগণকে সুস্পষ্ট নিদর্শনসহ প্রেরণ করেছি এবং তাঁদের সাথে অবতীর্ণ করেছি কিতাব ও ন্যায়নীতি, যাতে মানুষ ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করে”। [হাদীদ ৫৭;২৫]

নবী রাসূলগণ প্রেরণ ও কিতাব নাযিলের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানবজাতি যেন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে আর এটাই হচ্ছে সৃষ্টির উপর স্রষ্টা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের হক। এরপর আল্লাহ বলছেন, “আর আমি নাযিল করেছি লৌহ, যাতে আছে প্রচন্ড রণশক্তি এবং মানুষের বহুবিধ উপকার। এটা এজন্যে যে, আল্লাহ জেনে নিবেন কে না দেখে তাঁকে ও তাঁর রসূলগণকে সাহায্য করে”। [হাদীদ ২৫]

কাজেই যে বিচ্যুত হয়ে পড়ে আল্লাহর কিতাবের পথ হতে তাকে ফিরিয়ে আনতে হবে লৌহের শক্তি দ্বারা হলেও। এভাবেই এই দীনের ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা পায় কুর’আন ও তরবারীর মাধ্যমে। জাবির ইবন আব্দুল্লাহ(রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, “আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে আদেশ করেছেন এটা দিয়ে আঘাত করতে, মানে তরবারী দ্বারা, যে কেউ এটা থেকে ফিরে যায়, অর্থাৎ কুর’আন হতে”।

ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহ তাঁর আল-ফারুসিয়াহ গ্রন্থে (পৃ ১৮) বলেনঃআল্লাহ তাঁকে (রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কিয়ামত দিবসের পূর্বে প্রেরণ করেছেন- (এক হাতে) হেদায়াতের কিতাব কুর’আন ও (অন্য হাতে) বিজয়ী তরবারী সহকারে। (উদ্দেশ্য) যাতে, একমাত্র আল্লাহরই ইবাদত উপাসনা বন্দেগী করা হয়ে থাকে শরীকবিহীন অবস্থায়, আর তাঁর রিযিক নির্ধারিত হয়েছিল তরবারী ও বর্শার ছায়াতলে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা এই দীন ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন একদিকে দলীল প্রমাণ সাক্ষ্য সহকারে, এবং অপরদিকে তরবারী ও বর্শা দিয়ে, উভয়ে এমনভাবে একত্রিত আছে যার একটি থেকে অপরটি আলাদা করা যায় না।

এখন কুর’আন ও সুন্নাহ হতে কিছু প্রমাণাদি উপস্থাপন করা হচ্ছে, এই দলীল প্রমাণাদি সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরছে যে তরবারী হচ্ছে ইসলাম প্রচারের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম-

. আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন, (অনুবাদ)-

“আল্লাহ যদি মানবজাতির একদলকে অপর দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তবে (খ্রীষ্টানদের) গির্জা, এবাদত খানা, (ইহুদীদের) উপাসনালয় এবং মসজিদসমূহ বিধ্বস্ত হয়ে যেত, যেগুলাতে আল্লাহর নাম অধিক স্মরণ করা হয়। আল্লাহ নিশ্চয়ই তাদেরকে সাহায্য করবেন,যারা আল্লাহর সাহায্য করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী শক্তিধর”। [ সূরা হাজ্জ ২২;৪০]

“আল্লাহ যদি একজনকে অপরজনের দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তাহলে গোটা দুনিয়া বিধ্বস্ত হয়ে যেতো। কিন্তু বিশ্ববাসীর প্রতি আল্লাহ একান্তই দয়ালু, করুণাময়।” [সূরা বাকারাহ ২৫১]

. আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাদেরকে আদেশ করেছেন কুফফারদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রস্তুতি ও উপাদান সংগ্রহের জন্যে ও তাদেরকে ভীত সন্ত্রস্ত করে রাখার জন্য। আল্লাহ বলেন,

আর প্রস্তুত কর তাদের সাথে যুদ্ধের জন্য যাই কিছু সংগ্রহ করতে পার নিজের শক্তি সামর্থ্যের মধ্যে থেকে এবং পালিত ঘোড়া থেকে, যেন প্রভাব পড়ে আল্লাহর শুত্রুদের উপর এবং তোমাদের শত্রুদের উপর আর তাদেরকে ছাড়া অন্যান্যদের উপর ও যাদেরকে তোমরা জান না; আল্লাহ তাদেরকে চেনেন”। [সূরা আনফাল ৬০]

ইসলাম যদি কেবলমাত্র শান্তিপূর্ণ গোবেচারা নিরীহ উপায়েই বিস্তার লাভ করে থাকে, তাহলে কি সেই কারণ যার কারণে কুফফাররা এত ভীত সন্তস্ত হয়ে থাকে? তাদের এতে ভীত হওয়ার কি আছে? তাহলে কি তারা কেবলমাত্র মুখের জিভ নিঃসৃত কথা আর দাওয়াত শুনেই ভীত সন্ত্রস্ত?

সহীহ কিতাবদ্বয়ে (বুখারী ও মুসলিম) একথা স্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আমাকে এক মাস দূরত্ব পর্যন্ত সৃষ্ট (কাফেরদের মনে) ত্রাস দ্বারা সাহায্য (আল্লাহর পক্ষ থেকে) করা হয়েছে” কুফফাররা কি এ কারণে ভয় পাবে যদি কেবল বলা হয়ে থাকে, “মুসলিম হও, আর যদি না হও তাহলে তোমরা স্বাধীন, যা ইচ্ছা তাই বিশ্বাস নিয়ে থাক আর যা খুশি তাই করে বেড়াও?” নাকি তাদের ভীত হবার কারণ জিহাদ (এর মুখোমুখি হওয়া) , (অন্যথায়) জিযিয়াহ কর আরোপ আর অপমান? যাতে করে তারা ইসলামে প্রবেশ করে আর এর মাধ্যমে তারা যাবতীয় অপমান থেকে মুক্তি পেতে পারে।

. যখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লোকদেরকে ইসলামের দিকে আহবান করতেন, তার সে আহবানের সঙ্গী ছিল তরবারী, তিনি যাদেরকে আমীর করে পাঠাতেন তাদেরকেও অনুরুপ পদ্ধতি অনুসরণের আদেশ দিতেন, আর যখন লোকেরা ইসলামের দিকে আহবানের এই সর্বাত্মক পদ্ধতিটি দেখত, তখন তা তাদের আল্লাহর দীনের ব্যাপারে সন্দেহ দূর করার জন্যে যথেষ্ট বলে গণ্য হত।

বুখারী ৩৮৯৫ ও মুসলিম বর্ণণা করছেন, সাহল ইবন সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, খায়বারর যুদ্ধে একদা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আগামীকাল সকালে আমি এমন এক ব্যক্তির হাতে ঝাণ্ডা অর্পণ করবো যার হাতে আল্লাহ খায়বারে বিজয় দান করবেন এবং যাকে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল ভালবাসেন আর সেও আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলকে ভালোবাসে। সাহল রা) বলেন, মুসলমানগণ এ জল্পনা কল্পনার মধ্যেই রাত কাটালো যে, তাদের মধ্যে কাকে অর্পণ করা হবে এ ঝাণ্ডা। সকাল হলো, সবাই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আসলেন, আর প্রত্যেকেই মনে মনে এ ঝাণ্ডা লাভ করার আকাঙ্ক্ষা করছিলেন। তখন রাসুলুল্লাহ সা) বললেন, আলি ইবন আবু তালিব কোথায়? সাহাবীগণ বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ ! তিনি তো চক্ষুরোগে আক্রান্ত অবস্থায় আছেন। তিনি বললেন, তাকে লোক পাঠিয়ে সংবাদ দাও। সে মতে তাঁকে আনা হল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর উভয় চোখে থুথু লাগিয়ে তাঁর জন্যে দুয়া করলেন। ফলে চোখ এরূপ সুস্থ হয়ে গেল যে, যেন কখনো চোখে কোন রোগই ছিল না। এরপর তিনি তাঁর হাতে ঝাণ্ডা অর্পণ করলেন। তখন আলী রা) বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ ! তারা আমাদের মত (মুসলমান) না হওয়া পর্যন্ত আমি তাদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাবো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি বর্তমান অবস্থায়ই তাদের দ্বারপ্রান্তে গিয়ে উপনীত হও , এরপর তাদেরকে ইসলাম গ্রহণের প্রতি আহবান করো (যদি তারা ইসলাম গ্রহণ করে তাহলে) ইসলামী বিধানে ওদের উপর যেসব হক বর্তায় সেসব সম্পর্কে তাদেরকে অবহিত করে দিও। কারণ আল্লাহর কসম ! তোমার দাওয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ যদি মাত্র একজন মানুষকেও হেদায়েত দান করেন তা হলে তা তোমার জন্য লোহিত বর্ণের (মূল্যবান) উটের মালিক হওয়া অপেক্ষাও অনেক উত্তম।

কাজেই ইসলামের দিকে এই আহবানটি শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে হয়েছিল।

মুসলিম (৩২৬১) বর্ণিত হাদীসে বুরাইদা বলেন, ‘যখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন একজন ব্যক্তিকে কমাণ্ডার(আমির) নিযুক্ত করতেন কোন বাহিনীর নেতা হিসেবে কিংবা কোন কাফেলা আক্রমণকারী দলের প্রধান হিসেবে, তিনি সেই ব্যক্তিকে উপদেশ দিতেন আল্লাহকে ভয় করতে, তার নিজের জন্য ও তার সাথী মুসলিমদের জন্য, এরপর তিনি বলতেন,

“…যে আল্লাহর সাথে কুফরী করে, ‘বিসমিল্লাহ’ বলে তার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ো। যুদ্ধ করো, তবে তোমরা সীমালংঘন করো না, বিশ্বাসঘাতকতা করো না, হাত পা কেটে খণ্ড খণ্ড করে বিকৃত করো না এবং শিশুদেরকে হত্যা করো না। আর যখন তোমার মুশরিক শত্রুদের সাথে যুদ্ধ বেঁধে যায়, তখন তিনটি নীতির দিকে তাদেরকে আহবান জানাও। এর যে কোনটি সে যখন মেনে নেয় তখন তা গ্রহণ করে নাও এবং যুদ্ধ বন্ধ করে দাও। অতঃপর তাদেরকে সর্বপ্রথম ইসলাম কবুল করার দিকে আহবান জানাও। যদি তারা তোমার এ আহবানে সাড়া দেয় তখন তুমি তাদের এ সাড়া কবুল করে নাও এবং জিহাদ বন্ধ করে দাও।…আর যদি তারা ইসলাম গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায় তখন তাদেরকে জিযিয়াহ কর প্রদানে বাধ্য করো। যদি তারা তা মেনে নেয়, তোমরা তা কবুল করে নাও এবং তাদের সাথে এ অবস্থায়ও জিহাদ বন্ধ রাখো। আর যদি তারা উক্ত জিযিয়াহ প্রদানে অস্বীকৃতি জানায়, তখন (তৃতীয় ও শেষ ফয়সালা) আল্লাহর কাছে মদদ ও সাহায্য কামনা করো এবং তাদের সাথে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ো…।“

কাজেই আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর কমাণ্ডারদের আদেশ করেছেন কুফফারদের আহবান করতে ইসলামের দিকে যখনএই আহবানের সংগী ছিল মাথার উপরে তরবারীর ঝলকানি। যদি তারা মুসলিম হতে অস্বীকৃতি জানায় তাহলে তাদের অবশ্যই জিযিয়াহ কর দিতে হবে বিনয়াবনত হয়ে। আর যদি তারা এতেও রাজী না হয়, তাহলে তাদের জন্য আর কিছুই অবশিষ্ট থাকল না তরবারী ব্যতীত- “যদি তারা (উক্ত জিযিয়াহ প্রদানে) অস্বীকৃতি জানায়, তখন (তৃতীয় ও শেষ ফয়সালা) আল্লাহর কাছে মদদ ও সাহায্য কামনা করো এবং তাদের সাথে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ো ”

৪. আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আমি কিয়ামত দিবসের পূর্বে তরবারী হাতে এ উদ্দেশ্য প্রেরিত হয়েছি যে, কেবলমাত্র এক আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তায়ালারই) ইবাদত করা হবে, আর আমার রিযিক আসে আমার বর্শার ছায়া হতে, আর যারা আমার আদেশের বিরুদ্ধে যাবে তাদের জন্য অপমান (আর লাঞ্ছনা) তাকদীরে নির্ধারিত হয়েছে, আর যে কেউ তাদের অনুকরণ করে সে তাদেরই একজন”। মুসনাদে আহমান, ৪৮৬৯; সহীহ আল জামে’,২৮৩১.

এ ঘটনাটি, অর্থাৎ ইসলামের প্রসারের একটি মাধ্যম হিসেবে তরবারী ও শক্তি ব্যবহৃত হয়েছে এটি ইসলামের জন্য লজ্জা বা হীনমন্যতার কিছু নয়, বরং এটি ইসলামের একটি শক্তি ও গুণ, কেননা এর ফলে মানুষ সেই দীনের সাথে লেগে থাকে যা তাদের দুনিয়া ও আখেরাতে উপকৃত করবে। বেশির ভাগ লোকেরাই বোকা এবং জ্ঞান ও বিচক্ষণতার অভাব তাদের মধ্যে রয়েছে, আর তাদেরকে যদি তাদের নিজেদের অবস্থার উপর ছেড়ে দেয়া হয় তাহলে তারা সত্যের প্রতি বরাবরের মতই অন্ধ গাফেল হয়ে থাকে।

তারা তাদের খামখেয়ালী মনোভাব ও কামনা বাসনার মাঝে নিমজ্জিত হতে থাকে। কাজেই আল্লাহ জিহাদের প্রেসক্রিপশন দিয়েছেন যাতে তাদেরকে সত্যের উপর ফিরিয়ে আনা যায় আর এটা তাদের উপকার করে। নিসন্দেহে বিচক্ষণতা নির্দেশ করে যে, বোকাদেরকে তাদের মূর্খতাপূর্ণ কাজ থেকে বিরত রাখতে হবে এবং তাদেরকে এমন কিছুর দিকে জোর করতে হবে যা তাদের উপকার করবে।

আল বুখারী (৪৫৭৭) বর্ণনা করেছেনঃ “তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির কল্যানের জন্যেই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দান করবে ও অন্যায় কাজে বাধা দেবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে”।(আলে ইমরান ১১০) এই আয়াতটি সম্পর্কে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, মানুষের জন্য মানুষ কল্যাণজনক তখনই হয় যখন তাদের গ্রীবাদেশে শিকল লাগিয়ে নিয়ে আসে, এরপর তারা ইসলামে প্রবেশ করে”। জিহাদ ব্যতীত কি লোকদের ঘাড়ে শিকল লাগানো অবস্থায় নিয়ে আসা সম্ভব?

এটা এমন একটি বিষয়, যার জন্য ইসলাম প্রশংসার দাবীদার, নিন্দনীয় নয়। পরাজিত ধব্জাধারীদের উচিত আল্লাহকে ভয় করা এ কারণে যে তারা আল্লাহর দীনকে বিকৃত করছে, আর একে দূর্বল করে তুলছে বার বার এ দাবী করে যে, এটা হচ্ছে শান্তির ধর্ম। হ্যাঁ, এটা শান্তির ধর্ম ঠিক, কিন্তু যে উদ্দেশ্যে কথাটি বলা হয়ে থাকে তা হচ্ছে, সমস্ত মানবজাতিকে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কিছুর ইবাদত করা থেকে রক্ষা করার মাধ্যমে, আর সমগ্র মানব জাতিকে আল্লাহর আইন বিধানের নিকট আত্মসমর্পণ করার মাধ্যমে। এটা হচ্ছে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার মনোনীত দীন, কোন ব্যক্তি বা মানুষের উর্বর চিন্তাধারার ফসল নয়। কাজেই যারা এর প্রচারের জন্য কাজ করছে তাদের উচিত নয় এই দীনের চূড়ান্ত লক্ষ্য প্রকাশে লজ্জাবোধ করা, আর তা হচ্ছে সকল দীনের উপর আল্লাহর দীন বিজয়ী থাকবে এবং সকল ইবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্যেই হতে হবে।

যখন লোকেরা এমন কিছু মতবাদ (মার্কসবাদ, জাতীয়তাবাদ, উদারতাবাদ ইত্যাদি) আর তন্ত্র মন্ত্র(গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, রাজতন্ত্র ইত্যাদি) ধ্যান ধারণার অনুসরণ করে যেগুলোর জন্মই হয়েছে মানুষের মস্তিষ্ক হতে, প্রতিটি মতবাদ আর ধ্যান ধারণা, প্রতিটি সিস্টেম, আইন কানুন যা আমাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে । এই মানব রচিত মতবাদগুলোর একটি আরেকটি থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্যের হয়ে থাকে, ফলে এদের একটি সিস্টেম আরেকটি সিস্টেমের উপর শ্রেষ্ঠত্ব বা প্রাধান্য বিস্তারের চেষ্টা করে থাকে, কাজেই এই মতবাদগুলো একে অপরের মোকাবেলায় ততক্ষণ পর্যন্ত টিকে থাকে বা সহ অবস্থান করতে পারে যখন তা নিজেদের (ভৌগলিক কিংবা রাজনৈতিক) সীমানা দ্বারা রক্ষিত হয়, তখন এক সীমারেখার আইন অন্য সীমানায় চলে না।এভাবে ভিন্ন বৈশিষ্ট্য হওয়া সত্ত্বেও এই সাংঘর্ষিক মানব রচিত বিধান ও সিস্টেমগুলো একে অপরের মোকাবেলায় টিকে থাকে। কিন্তু যখন এদের সাথে এমন একটি বিধান থাকে যা মানব রচিত নয়, বরং আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সিস্টেম ও আইন বিধান, আর এগুলোর পাশাপাশি যদি মানুষের রচিত আইন বিধান থাকে, সিস্টেম থাকে, তখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ মৌলিকভাবে ভিন্ন। তখন ( এই মতবাদগুলোর সহাবস্থানের কোন সম্ভাবনা নেই) আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত সিস্টেমের অধিকার হচ্ছে এই সকল বাধা বিপত্তিকে অপসারণ করা আর মানুষ হয়েও মানুষের গোলামী থেকে মানুষকে মুক্ত করা ।

– ফিকহ আল-দাওয়াহ , সাইয়েদ কুতুব ২১৭-২২২

ফাতাওয়া আল লাযনাহ আল দাইমাহ (১২/১৪) তে বর্ণিতঃ

যারা ইসলামের বার্তার প্রতি সাড়া দিয়েছে ও কর্ণপাত করেছে তাদের ক্ষেত্রে ইসলাম প্রসারিত হয়েছে দলীল-প্রমাণাদি সহকারে, আর যারা উদ্ধত, দাম্ভিক অহংকারী ও গোঁয়ার তাদের ক্ষেত্রে ইসলাম প্রসারিত হয়েছে শক্তি ও তরবারীর মাধ্যমে, যে পর্যন্ত না তারা নত হয়েছে, অহংকার দাম্ভিকতা পরিত্যাগ করেছে, আর সবশেষে সত্য ও বাস্তবতার সামনে আত্মসমর্পণ করেছে।

আর আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।

সূত্রঃ https://islamqa.info/en/43087