মানবতার জীবন্ত ছবি – মাওলানা মুহাম্মাদ মনযূর নোমানী (রহঃ)

এক. ভুলতে পারি না

৪২-৪৩ বছর আগের কথা। সম্ভবত ১৯২৮ সাল। আমি তখন আমরোহাতে অধ্যাপনা করি। একটি জরুরী কাজে দেওবন্দ যেতে হয়েছিল। তখন ছিল শীতকাল। খুব ঠান্ডা পড়েছিল। সেদিন বিকালের ট্রেনেই ফিরে আসার কথা ছিল আমার। তাই রাতে থাকার মতো গরম কাপড়-বিছানা বা কম্বল কিছুই সঙ্গে নেইনি। কাজ সেরে আমি গাজীয়াবাদের ট্রেনে উঠি। গাজীয়াবাদ থেকে আমরোহাগামী ট্রেন ছাড়ে। কিন্তু একটি সমস্যা হয়ে যায়। ঘটনাক্রমে সেদিন গাজীয়াবাদের ট্রেনটি এসেছিল একটু দেরিতে। সন্ধ্যায় আমি গাজীয়াবাদ পৌঁছে জানতে পারলাম আমরোহাগামী ট্রেন চলে গেছে! পরের ট্রেন রাত এগারোটায়।

এগারোটা বাজতে অনেক দেরি, কী করি? প্লাটফর্মের একটি বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। কিছুক্ষণ পর এশার নামায পড়ে ঐ বেঞ্চে গা এলিয়ে দিয়েছিলাম। ঘুমানোর ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু কখন যে চোখ লেগে এল। …হঠাৎ কারো আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল, দেখি স্টেশনের এক কর্মচারি আমাকে জিজ্ঞাসা  করছে, কোথায় যাবেন মিয়াসাব?  বললাম, আমরোহা যাব। ওহ্হো! এই মাত্রই তো আমরোহার ট্রেন চলে গেল, পরবর্তী ট্রেন সকালে। আপনি এক কাজ করম্নন, স্টেশনের  মুসাফিরখানায়  চলে  যান।

আমি মুসাফিরখানায় চলে এলাম। রাত বাজে তখন এগারোটা। ঘুম থেকে উঠার পর থেকেই খুব ঠান্ডা লাগছিল। এদিকে এখনো অনেক  রাত বাকি। সেখানে একটি বেঞ্চ দেখতে পেলাম। সেটাতে গিয়ে কখনো বসছিলাম। আবার বেশি ঠান্ডা লাগলে উঠে পায়চারি করছিলাম। সে-সময় গাজীয়াবাদ স্টেশনে ছোট্ট একটি চায়ের দোকান ছাড়া আর কিছুই ছিল না।[১] দোকানদারও দোকান বন্ধ করে শুয়ে পড়েছিল। আমি কিছুক্ষণ পরপর গিয়ে তাকে খোশামোদ করে জাগিয়ে চা খাচ্ছিলাম।

ঠান্ডার এই কষ্ট ছাড়াও একটি মানসিক কষ্ট হচ্ছিল। আমার সাথে সফরের কোনো সামান  না থাকায় মুসাফিরখানার অন্যান্য যাত্রীরা আমাকে সন্দেহের চোখে দেখছিল। নিজেদের মালসামানের চিন্তায় তারা ঘুমাতে পারছিল না। কিছু বলে যে তাদের আশ্বস্ত করব-তাও পারছিলাম না। মনে পড়ে, খুব বিব্রত হয়েছিলাম ব্যাপারটাতে। লজ্জায়  মাটিতে  মিশে যাচ্ছিলাম। কিন্তু কিছুই করার ছিল না। একদিকে ঠান্ডা অন্যদিকে এই মানসিক চাপ-কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। এ অবস্থায়ই রাত কাটছিল। কখনো  বেঞ্চিতে গিয়ে বসছিলাম। কখনো পায়চারি করছিলাম। কখনো দোকানে গিয়ে চা খাচ্ছিলাম। এমনি করেই রাত আড়াইটা বাজল।

একটু পর সম্ভবত  দেরাদুন থেকে একটি ট্রেন এল। ট্রেন থেকে দু’তিনজন যাত্রী মুসাফিরখানায় এসেছিল। তারা বিছানা বিছিয়ে শুয়ে পড়ল। তাদের মধ্যে একটি শিখ কিশোর ছিল। বয়স পনেরো-ষোলো হবে। মনে হচ্ছিল বিত্তবান ঘরের ছেলে। পাহাড়ি অঞ্চল থেকে আসার কারণে ওর বিছানাটা ছিল বেশ বড়। বিছানা খুলে ছেলেটি তাতে বসল। আমি তখন বেঞ্চে বসে ছিলাম। ও আমাকে জিজ্ঞাসা করল, এখানে দুধ পাওয়া যাবে কোথাও?  বললাম, এই সামনে একটি চায়ের দোকান আছে, তাতে পাবে। ‘আপনি একটু আমার বিছানাটা দেখুন, আমি দুধ নিয়ে আসি, আমি রাতের খাবার খাইনি।’ ছেলেটি দুধ নিয়ে এল। ভদ্রতার খাতিরে আমাকেও সাধল। আমি না করে দিলাম।  দুধ খেয়ে ও শুয়ে পড়ল। আমি খেয়াল করলাম, এ বেচারাও আড়চোখে বারবার আমাকে দেখছে। মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল; এ-ও আমার কারণে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারছে না।

কয়েক মিনিট পর ও উঠে আমার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, এই ঠান্ডার মাঝে আপনি এখানে এভাবে কেন বসে আছেন, কম্বল বা চাদর-টাদর কিছু নেই আপনার কাছে? ‘বাবা, তুমি আরাম করো। আসলে রাত নয়টার আগেই আমার আমরম্নহা পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিল, তাই সঙ্গে কিছু আনিনি। ঘটনাক্রমে ট্রেন ছুটে গেছে, সকাল  ছাড়া আর কোনো ট্রেন নেই।’ এ কথা শুনে ও তাড়াতাড়ি গিয়ে ওর বিছানা থেকে দুটো কম্বল বের করল। একটি কম্বল বিছাল, আরেকটি গায়ে দেওয়ার জন্য রেখে আমাকে বলল, আমি এখানে শুয়ে পড়ছি, আপনি আমার বিছানায় শুয়ে পড়ুন। আমি সঙ্কোচে  না করলাম। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা, শুতেই হবে। আমি বললাম, আচ্ছা, তাহলে অন্তত তুমি তোমার বিছানায় শোও, আমি এখানে শুচ্ছি। ‘না, না, আপনাকে আমার বিছানায়ই শুতে হবে।’ কিন্তু আমার লজ্জা লাগছিল। আমার সঙ্কোচ দেখে ও বলল, আপনি যদি আমার বিছানায় না শোন তাহলে আমি সকাল পর্যন্ত এখানেই দাঁড়িয়ে থাকব। অগত্যা আমি ওর বিছানায় শুয়ে পড়লাম। বিছানাটি ছিল বেশ আরামদায়ক, দামি আর উন্নত। ছেলেটির এই সৌজন্যবোধে এতটা অভিভূত হলাম যে, চোখে পানি এসে গেল। ও  একটু পর ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু আমি ঘুমুতে পারলাম না। ওর আচরণ মনে এমন রেখাপাত করেছিল যে, সারা রাত  আর আমার চোখে  ঘুম এল না।

সকালে আমাদের দুজনের ট্রেন একসাথেই এল। আমরা একে অপর থেকে বিদায় নিয়ে নিজ নিজ ট্রেনে উঠলাম। ওর ব্যবহারে আমি তখন এমনই আচ্ছন্ন ছিলাম যে, ঠিকানা রাখার কথাও মনে আসেনি। ঠিকানা না থাকায় পরবর্তীতে আর ওর সাথে যোগাযোগ রাখা সম্ভব হয়নি। এখন মনে হলে খুব খারাপ লাগে। জানি না এখন ও কোথায় আছে, কেমন আছে। এ ঘটনা মনে পড়লে ৪৩ বছর আগের স্মৃতি জীবন্ত হয়ে উঠে। অজান্তে চোখের কোণে অশ্রু জমে। মন থেকে ওর জন্য দুআ আসে। জীবনে যদি আর একবার ওর সাথে দেখা হত, আর আমি ওর জন্য কিছু করতে পারতাম! কিন্তু কত আশা বুকে নিয়ে মানুষকে কবরে চলে যেতে হয়…!

 

দুই. ৪৬-এর সাম্প্রদায়িক সহিংসতা

১৯৩৪ থেকে ১৯৪৬ পর্যন্ত আমি বেরেলিতে ছিলাম। ইউ পি-এর যে ক’টা শহর হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার জন্য খ্যাত ছিল বেরেলি তার অন্যতম। এই বারো-তেরো বছরে বেশ কয়েকবার সহিংসতা হয়। যতদূর মনে পড়ে ১৯৪৬ সালের ঘটনা। দীর্ঘদিন ধরে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা চলছিল। অবস্থা বেগতিক দেখে প্রশাসন কারফিউ দিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছিল। কিছুদিন পর প্রশাসনের পক্ষ থেকে সামান্য ছাড় দেওয়া হয়। সকালে কিছুক্ষণের জন্য কারফিউ বন্ধ থাকত। সাধারণ মানুষ যেন নিতান্ত প্রয়োজনীয় কাজগুলো এ সময়ে সেরে নিতে পারে।

আমার বাসা ছিল পূর্ব শাহাবাদ এলাকায়। (মরহুম মওলবী আবদুল কাইয়ুম সাহেবের এরিয়া)। এর চারপাশে মুসলিম জনবসতি। এরিয়ার একেবারে পাশঘেষে এলাকার মসজিদ। মাঝখানে শুধু একটি সড়ক। আমাদের এলাকা থেকে কিছুটা দূরে পূর্বপাশের প্রায় গোটা অঞ্চল ছিল হিন্দুপ্রধান অঞ্চল। মসজিদ ও আমাদের এলাকার মাঝের সেই রাস্তাটিই ছিল তাদের চলাচলের রাস্তা। বাজারে বা অন্য কোনো জায়গায় যেতে হলে এ রাস্তা দিয়েই তাদের যেতে হত।

কারফিউ বিরতি চলাকালীন একদিন সকালে আমি মসজিদে গিয়েছিলাম। মসজিদের পাঁচিলের উপর উঠে রাস্তার দিকে মুখ করে বসে ছিলাম। একটু পর দেখলাম, একজন হিন্দু লোক বাজারের দিকে যাচ্ছে। নিতান্ত গরিব আর নিরীহ গোছের এক প্রৌঢ়। খুব দ্রুত পা ফেলছিল। মনে হয় জরুরি কোনো কাজে যাচ্ছে। হঠাৎ দেখতে পেলাম, দুটো বখাটে ছেলে লাঠি নিয়ে তার দিকে দৌড়ে যাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছিল ছেলে দুটো মুসলমান। গায়ে ময়লা জীর্ণ কাপড়। আমার অপরিচিত, অন্য কোনো মহল্লার ছেলে হবে এরা। বুঝতে বাকি রইল না ওদের মতলব। পাঁচিলের উপর থেকেই ওদের জোরে ধমক দিলাম, এরপর দ্রুত নেমে এসে ওদের সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, খবরদার! কারো গায়ে যদি হাত তোলো তো আমি নিজে তোমাদের পুলিশে ধরিয়ে দেব। ছেলে দুটো কিছু বলল না। চুপ করে আমার পাশ দিয়ে চলে গেল। আমি লোকটিকে কুলহাড়াপেড়-এর বাজারে পৌঁছে দিয়ে বাসায় ফিরে এলাম।

একটু পর পাশের মহল্লা থেকে দু’জন লোক এসে আমাকে বলল, আপনি এটা কী করলেন? রাস্তায় একটি হিন্দু লোককে সহায়তা করলেন আবার তার সাথে বাজার পর্যন্ত গেলেন, এদিকে হিন্দুপ্রধান অঞ্চলগুলোতে মুসলমানদের উপর কী নির্যাতনই-না করা হচ্ছে। আমি বললাম, কী হচ্ছে-না-হচ্ছে তা আপনার চেয়ে আমি ভালো জানি। আসলে গুজব বাস্তবতার তুলনায় ঢের বেশি। আর অন্য কোনো এলাকায় মুসলমানদের উপর নির্যাতন হলেই এ রাস্তায় চলাচলকারী নিরপরাধ হিন্দু জনসাধারণের গায়ে হাত দেওয়া জায়েয হয়ে যাবে? সাহস থাকে তো ঐ হিন্দু মহল্লায় গিয়ে কিছু করুন যেখানে মুসলমানদের নির্যাতন করা হচ্ছে। তা-না করে নিরপরাধ হিন্দুদের কষ্ট দেওয়া কেন? এ কাজ ইসলামের আদর্শবিরুদ্ধ। অসহায় মানুষের গায়ে হাত তোলা কাপুরুষতা। এর চেয়ে ঘৃণ্য কাজ আর কী হতে পারে?

আমার কথা শুনে তারা বলল, দেখুন, ঝামেলা করবেন না; আমরা আপনাকে সাফ জানিয়ে দিচ্ছি, সামনে এসব সহ্য করা হবে না, আপনি যে ছেলেদের বাঁধা দিয়েছেন তারা আমাদের বলে দিয়েছে, আপনি যেন আর কখনো তাদের বাঁধা না দেন, অন্যথায় তারা আপনার মান-সম্মানের লেহাজ করবে না। আমি বললাম, আমিও আপনাকে সাফ জানিয়ে দিচ্ছি, এখন থেকে আমি নিয়মিত ঐ চৌরাস্তা পাহারা দিব এবং আমার পরিবারের কোনো ছেলেও যদি নিরপরাধ কোনো হিন্দুর দিকে হাত বাড়ায় তো কসম খোদার আমি তাকেও পুলিশে ধরিয়ে দেব। আমি বিশ্বাস করি, এটাই আমার প্রতি আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের নির্দেশ, এ কাজে যদি আমার জান যায় তো আমার নিশ্চিত বিশ্বাস আমি শহীদের মর্যাদা পাব। জবাব শুনে যে তাদের ভালো লাগবে না তা তো স্পষ্ট, কিন্তু তারা কোনোরূপ উচ্চবাচ্যও করেনি। কয়েক ঘণ্টা পর ঐ মহল্লার আরেকজন লোক এল। দশাসই চেহারা, রূঢ় মেজাজ। বেশ রাগতস্বরে সে আমাকে বলল, আপনি এখানে বসে বসে হিন্দুদের পাহারা দিচ্ছেন আর এদিকে ‘জাখিরাতে’ (একটি অঞ্চলের নাম) শত শত মুসলমানকে একটু আগে গুলি করে মারা হয়েছে। বন্দুক নিয়ে সংগঠিত হয়ে হিন্দুরা মুসলমানদের উপর হামলা করেছে। কিছুক্ষণ আগে একটি লোক সেখান থেকে এসেছে। সে বলছে, ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি বর্ষিত হচ্ছে, শত শত মুসলমান শহীদ হয়ে গেছে।

আমি বললাম, হতে পারে, এরকম হওয়া তো অসম্ভবের কিছু নয়। কিন্তু আমার মনে হয় আপনি ভালোভাবে খোঁজ-খবর না নিয়েই এ কথা বলছেন। এ রকম যাচাই-বাছাই ছাড়া কথা দ্বারা হাঙ্গামা বাড়তে থাকে। চলুন আমরা কোতয়ালি যাই, সেখান থেকে কাউকে সঙ্গে নিয়ে জাখিরা যাব, তখন আসল হাকীকত উদ্ধার হয়ে যাবে। কথা শুনে সে আরও রেগে গেল। আমাকে বলল, আপনি চাইলে যেতে পারেন, আমার যাওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, একাই যাব। মনে হল, গিয়ে দেখে আসলে এ সকল গুজব শক্তভাবে রোধ করতে পারব। মুশকিল হল, কারফিউ চলছিল, পুলিশের সহায়তা ছাড়া যাওয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু আল্লাহ ব্যবস্থা করে দিলেন। সৌভাগ্যক্রমে একটু পর আমাদের রাস্তা দিয়ে একদল পুলিশ গেল। আমি তাদের একজনকে সাথে নিয়ে কোতয়ালি গেলাম। সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম, সব উড়োকথা, জাখিরাতে আজ কিছুই ঘটেনি। ফিরে এসে মহল্লাবাসীকে সব খুলে বললাম। কিন্তু আশ্চর্য, যে লোকটি ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি বর্ষিত হওয়ার, শত শত মুসলমানের লাশ পড়ে যাওয়ার খবর নিয়ে এসেছিল সে এরপরও ঘাউড়ামি করছিল। আসলে এ ধরনের লোক মুসলমানদের জন্য শত্রুত চেয়েও ক্ষতিকর। আল্লাহ আমাদের শুভবুদ্ধি দান করুন।

সে সময় সরকারিভাবে রেশন দেওয়া হত। এই গোটা অঞ্চলের জন্য সরকারি খাদ্যদ্রব্যের দোকান ছিল আমাদের চৌহদ্দিতে। আমি জানতে পারলাম, এলাকার অনেক হিন্দুবাসিন্দা নিরাপত্তার অভাবে খাবার-খাদ্য কিনতে এই চৌহদ্দিতে আসে না। এ কারণে কিছু দরিদ্র পরিবারে উপোস চলছে। সকালে যখন কারফিউ বিরতি চলে সাধারণত লোকেরা তখন খাবার কিনতে আসে। এ সময়টুকু যদি পাহারার ব্যবস্থা করা যায় তাহলে সমস্যার সমাধান সম্ভব। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, এ সময়ে রাস্তা পাহারা দেওয়ার ব্যবস্থা করব। এলাকার কিছু যুবকও আমার সাথে পাহারার কাজে অংশ নিল। যতদিন পরিস্থিতি অস্থিতিশীল ছিল ততদিন আমরা পাহারার কাজ করেছি। একটি আফসোস আমার থেকে গেছে, শহরের আরও কিছু অঞ্চলের পরিস্থিতি আমাদের এলাকার মতই ছিল। তখন আরেকটু ভাবলে এবং হিম্মতের পরিচয় দিতে পারলে শহরের আরও কিছু এলাকায় এ রকম পাহারার ব্যবস্থা করা যেত। কিন্তু তখন তা মনে আসেনি।

তিন. ১৯৪৭-৪৮ এর রক্তক্ষয়ী সময়ের সফর

পাঠকদের মধ্যে যাদের ২৪-২৫ বছর আগের কথা মনে আছে তাদের হয়তো মনে আছে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর হিন্দুস্তান ও পাকিস্তানে যখন আলাদা শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন উভয় রাষ্ট্রে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা কী প্রকট রূপ ধারণ করেছিল। পাকিস্তানে নির্দোষ শিখ ও হিন্দুদের আর হিন্দুস্তানে নিরপরাধ মুসলিমদের এমন নিষ্ঠুর-নির্দয়ভাবে হত্যা করা হচ্ছিল যার কথা মনে হলে আজও গা শিউরে উঠে। মনে হচ্ছিল মানুষ হিংস্র পশুতে পরিণত হয়েছে। অসহায় নারী ও মাছুম বাচ্চাদের পর্যন্ত নির্বিচারে জবাই করা হচ্ছিল। চলন্ত ট্রেন থেকে জীবন্ত মানুষকে ঢিল ছুড়ে ফেলার মতো ছুড়ে ফেলা হচ্ছিল।

এ নাযুক পরিস্থিতির কারণে হিন্দুস্তানের উত্তর প্রদেশের অনেক এলাকায় বেশ কিছুদিন মুসলমানদের রেলভ্রমণ বন্ধ ছিল। এরপর প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়; প্রত্যেক ট্রেনে মুসলমানদের জন্য দু’একটি বগি নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়, যাতে শুধু মুসলমান যাত্রীরা উঠবে আর তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য একদল পুলিশ পাহারায় নিয়োজিত থাকবে।

এ সময়েরই কথা। একটি কাজে লক্ষ্ণৌ থেকে সাহারানপুর, তারপর দেওবন্দ যাওয়ার প্রয়োজন হয়েছিল। নিয়মানুযায়ী লক্ষ্ণৌ স্টেশনে  আমাকে নির্দিষ্ট বগিতে উঠতে হল। সংবাদপত্র ও অন্যান্য মাধ্যমে আমি আগেই জেনেছিলাম যে মুসলমান যাত্রীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে-তাদের পুলিশি নিরাপত্তায় নির্দিষ্ট বগিতে উঠতে হয়, কিন্তু দৃশ্যটি সরাসরি দেখার সুযোগ হয়নি। আজ প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হল।

একটু পর ট্রেন চলতে শুরু করল। বগির ধারণক্ষমতার তুলনায়  মুসলমান যাত্রী ছিল অনেক বেশি। বগি যাত্রীতে গিজ গিজ করছিল। খুব কষ্ট লাগছিল আমার। মনে মনে ভাবছিলাম, যে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আমাদের পূর্বসূরীরা যারপরনাই ত্যাগ স্বীকার করেছেন, যে স্বাধীনতা-আন্দোলনে আমাদের অনবদ্য অবদান ছিল সে-স্বাধীনতা অর্জনের পর আজ আমাদের এত করুণ অবস্থা যে, সাহারানপুর যেতে হলেও সশস্ত্র পুলিশের নিরাপত্তার বেষ্টনীতে ট্রেনের এই আবদ্ধ পিঞ্জিরে করে যেতে হয়। ট্রেনের অন্যান্য মুসলমান যাত্রীদের এ সম্পর্কে কোনো ভাবনা আছে বলে মনে হল না, পরিস্থিতি সম্পর্কে সহজ-সরল, সোজা-সাপ্টা মন্তব্য করছিল তারা। তাদের অবস্থা দেখে মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল। তাদের কথাবার্তা থেকে মনে হচ্ছিল, এ পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনের কারণ সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই তাদের। এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কিছু করার ন্যূনতম ইচ্ছা-আগ্রহও তাদের নেই। আর আল্লাহর সাথে সম্পর্ক দুরস্ত  করে আল্লাহর পক্ষ থেকে মদদ লাভের ফিকির-তা তো বলাই বাহুল্য।

কিছুক্ষণ পর হারদূঈ স্টেশন এল। আমি আসরের নামাজ পড়ার জন্য প্লাটফর্মে নামতে যাব-ও মা! বগির সব যাত্রী একসাথে চিৎকার করে উঠল-‘কি করছেন আপনি? বগির বাইরে পা ফেলবেন না।’ তারা ভয় করছিল, না জানি প্লাটফর্মে নামতেই আমার উপর হামলা হয়। আমি অনেক চেষ্টা করলাম তাদের বোঝাতে। কিন্তু কীসের কী, কিছুই হল না, তারা গোঁ ধরে রইল-কিছুতেই যেন আমি বগির বাইরে পা না ফেলি।

একজন তো আমার উপর রীতিমতো গরম হয়ে গেলেন। তাদের শঙ্কা আর এই পীড়াপীড়ি দেখে প্লাটফর্মে নেমে নামায পড়াটাই আবশ্যক মনে হল। সবকিছু উপেক্ষা করে আমি প্লাটফর্মে নামলাম। পানির কল একটু দূরে ছিল। সেখান থেকে পানি এনে ঠাণ্ডা মাথায় ওযু করলাম। এরপর প্লাটফর্মে জায়নামায বিছিয়ে নামায পড়া শুরু করলাম। নামায শেষ হতে-না-হতেই ট্রেন ছেড়ে দিল। আমি দৌড়ে বগিতে উঠে এলাম।

তখন আমি যাত্রীদের বললাম, আমি ইচ্ছা করলেই বগিতে নামায পড়তে পারতাম, কিন্তু আপনাদের ভয় দূর করার জন্য প্লাটফর্মে নেমে নামায পড়া জরুরি মনে হচ্ছিল। আপনারা তো দেখলেন, আমি প্লাটফর্মে নামায পড়লাম, পানির কল দূরে ছিল, সেখান থেকে পানিও আনলাম, আমার কোনো ক্ষতি হয়নি। শুনুন, যদি আপনারা এই দেশে থাকতেই চান তাহলে মন থেকে এই শঙ্কাবোধ দূর করেই থাকুন। নতুবা এমন কোনো জায়গায় চলে যান যেখানে মৃত্যু আপনাদের স্পর্শ করবে না। পৃথিবীতে বিভিন্ন জাতির উপর কঠিন থেকে কঠিন সময় আসে, কিন্তু যদি তাদের মাঝে হিম্মত ও সাহস থাকে এবং তারা উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সঠিক কর্মপন্থা অবলম্বন করে তাহলে একদিন না একদিন অবশ্যই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। আপনারা পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করুন। এতদিন যে ভুলগুলো করে এসেছেন -নিজেরা না বুঝে কিংবা আপনাদের অপরিণামদর্শী লিডারদের উস্কানিতে বিভ্রান্ত হয়ে-সেগুলো সম্পর্কে সচেতন হোন, ভবিষ্যতের জন্য সঠিক কর্মপন্থা নির্ধারণ করুন। সবচেয়ে বড় কথা, আল্লাহ তাআলার সাথে সম্পর্ক ঠিক করুন এবং সাচ্চা মুসলমান হয়ে যান। এ ছাড়া কিছুতেই আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে মদদ আসবে না।

আল্লাহর তাওফীকে তখন আমার পক্ষে যা বলা সম্ভব ছিল আমি তাদের বলেছিলাম। আমি জানি না, আমার কথা তাদের মনে কতটা রেখাপাত করেছিল।

এরপর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, সামনের স্টেশনে ট্রেন থামলে সেখানেও বগি থেকে নেমে নামায পড়ব তারপর পুলিশি নিরাপত্তার এই বগি ছেড়ে একটি সাধারণ বগিতে উঠার চেষ্টা করব। পুলিশের রাইফেলের ছায়ায় এভাবে বন্দির মতো সফর করা আমার কাছে লাঞ্ছনাকর মনে হচ্ছিল। তাছাড়া-আল্লাহ না করুন-যদি এভাবে সফর করার রেওয়াজ হয়ে যায় তাহলে এই দেশে চিরদিনের জন্য মুসলমানদের ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় চলাফেরা করাই হবে তাদের নিয়তি।

শাহজাহানপুর স্টেশনে এসে ট্রেন থামল। মাগরিবের সময় হয়ে গিয়েছিল। আমি প্লাটফর্মে নেমে নামায পড়া শুরু করলাম। মনে হল, এখন নামায শেষ করে অন্য বগিতে উঠতে গেলে দায়িত্ব-পালনরত পুলিশ আমাকে উঠতে দেবে না, তাই ঠিক করলাম, ট্রেন ছাড়ার আগ পর্যন্ত নামায পড়তে থাকব, ট্রেন ছেড়ে দিলে দৌড়ে গিয়ে অন্য বগিতে উঠে পড়ব। এমনই করেছিলাম। ট্রেন ছাড়ার আগ পর্যন্ত নামায পড়ছিলাম, ট্রেন ছেড়ে দিলে দৌড়ে গিয়ে অন্য বগিতে উঠে পড়ি। নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ বেচারা চিৎকার করে ডাকছিল। আমি শুনেও না শোনার ভান করলাম।

মওলবী সুরতের দাড়িওয়ালা এক লোককে হঠাৎ বগিতে ঢুকতে দেখে সবাই আশ্চর্য হয়ে গেল। বগির যাত্রীরা সবাই আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তাদের বিস্ময় কাটছিল না। লক্ষ্য করলাম, কিছু সম্ভ্রান্ত লোক আমাকে বগিতে উঠতে দেখে চিন্তায় পড়ে গেছে। তাদের চোখ দেখে মনে হচ্ছিল, তারা মনে মনে ভাবছে, এই সহজ-সরল লোকটা কী করে এখানে চলে এল, না জানি এখন তার সাথে কে কী আচরণ করে বসে।

আমি তাদের চোখের ভাষা বুঝতে পেরে  বললাম, আপনারা চিন্তা করবেন না। আমি জেনেশুনেই এই বগিতে এসেছি, ভুলে চলে আসিনি। আমি মুসলিম যাত্রীদের বগিতেই ছিলাম, আমার সামানপত্র এখনও সেই বগিতেই আছে। কিন্তু মুসলিম যাত্রীদের জন্য কৃত এই আলাদা ব্যবস্থা আমার ভালো লাগেনি। আমার মনে হয়েছে এটি একটি ভুল সিদ্ধান্ত। এর মানে তো এই যে পুরো ট্রেন ভর্তি যাত্রীরা মানুষ নয়, হিংস্র জানোয়ার। যাদের ভয়ে মুসলিম যাত্রীদের আলাদা বগিতে সফর করতে হবে। অথচ বাস্তবতা তো এমন নয়। আমি সবাইকে আমার মতই ভদ্র মানুষ মনে করি এবং সেটা প্রমাণ করার জন্যই আমি এ বগিতে এসেছি।

দ্বিতীয়ত, আমি বিশ্বাস করি আল্লাহ তাআলা আমার মৃত্যুর একটি সময় নির্দিষ্ট করে রেখেছেন, তার আগে কেউ আমাকে মারতে পারবে না, আর মৃত্যুর নির্দিষ্ট সময়ের পর কেউ আমাকে বাঁচিয়েও রাখতে পারবে না।

আমি বগিতে ঢুকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম, বসার জন্য খালি জায়গা নজরে পড়ছিল না। শ্রোতাদের মাঝে আমার কথার এমন প্রতিক্রিয়া পড়ল যে, আমার কথা শেষ হওয়া মাত্র সবাই চেপে বসে আমাকে পাশে বসাতে চাইল। বয়স্ক একজন লোকের পাশে আমি বসলাম। এরপর বগির সবাই তখনকার প্রতিকূল পরিস্থিতি ও মানবতাবিরোধী কর্মকাকাণ্ডের কঠোর সমালোচনা করল। দেখা গেল সবার মনেই এগুলোর প্রতি ঘৃণা রয়েছে। প্রায় এক ঘণ্টা পর আমরা বেরেলি পৌঁছলাম।

শাহজাহানপুর স্টেশনে নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ দেখে রেখেছিল আমি কোন্ বগিতে উঠেছি। বেরেলি স্টেশনে ট্রেন থামতেই এক পুলিশ এসে বলল, আপনি তো আমাদের চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলেন, আপনার নিরাপত্তা বিধান করা আমাদের দায়িত্ব। বেচারা কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিল, আর বেশ রাগও হয়েছিল আমার উপর। আমি বললাম, দেখতেই তো পাচ্ছেন আমি এখানে ভালো আছি, ইনশা আল্লাহ ভালোই থাকব। পুলিশ তা মানতে রাজি হল না। বলল, চলুন ঐ বগিতে গিয়ে বসবেন। কিন্তু এই বগির যাত্রীরা আমাকে যেতে দিল না। সবাই বলে উঠল, না, না, উনি এই বগিতেই থাকবেন। বগির এক যাত্রী বলল, আপনি বসুন, আমি ঐ বগি থেকে আপনার মালপত্র নিয়ে আসি। ঐ লোক পুলিশের সাথে গিয়ে আমার মালপত্র নিয়ে এল।

এই অভিজ্ঞতার পর আমার মন চাইছিল, প্রত্যেক স্টেশনেই বগি পরিবর্তন করে নতুন বগিতে উঠতে। কিন্তু এই বগির যাত্রীরা নামতে দিল না। তারা খুব পীড়াপীড়ি করল, তাদের সাথেই সাহরানপুর পর্যন্ত যেতে। তাদের আন্তরিকতা আর অকৃত্রিম ভালোবাসার কারণে-তাছাড়া তখন যাত্রীদের শোয়ার সময় হয়ে গিয়েছিল-এই বগিতেই রয়ে গেলাম। রাত তিনটা নাগাদ সাহারানপুর পৌঁছলে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি বগি থেকে নামলাম।

দেওবন্দ যাওয়ার ট্রেন আসবে সকালে। পাঞ্জাব থেকে এসে এ ট্রেন দিল্লী যায়। সময় কাটানোর জন্য সাহারানপুর স্টেশনের ওয়েটিংরুমে গিয়ে বসলাম। সকালে নির্দিষ্ট সময়ই ট্রেন এল। সে সময় পাঞ্জাব থেকে যে ট্রেন আসত তাতে বেশিরভাগ যাত্রী থাকত পশ্চিম পাঞ্জাব, সিন্ধু ও পাকিস্তানের পশ্চিম প্রদেশের সীমানা থেকে আসা শিখ ও হিন্দু যাত্রী। তাদের মাঝে এমন অনেক লোক থাকত যাদের নিকটজনকে তাদের চোখের সামনে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে। সহিংসতায় আহত হয়েছে এমন লোকও থাকত অনেক। মুসলিমদের প্রতি এদের মনে নিদারুণ ঘৃণা ও ক্ষোভ থাকত। এ কারণে কড়া নজরদারি করা হত মুসলিম যাত্রীরা যেন কিছুতেই নির্দিষ্ট বগি ছেড়ে অন্য কোনো বগিতে না উঠে। আমি এ সবই জানতাম। তার পরও সাধারণ কোনো বগিতে উঠারই সিদ্ধান্ত নিলাম। মনে পড়ে এ সিদ্ধান্ত নিতে নিজের মনকে অনেক বোঝাতে হয়েছিল, কুরআন মাজীদের বেশ কিছু আয়াতের মর্ম নিয়ে ভাবতে হয়েছিল।

যাই হোক, আমি ঠিক করলাম ট্রেন চলতে শুরু করলে দৌড়ে গিয়ে সাধারণ কোনো বগিতে উঠে পড়ব। ট্রেন ছাড়ার আগ পর্যন্ত ওয়েটিং রূমে বসে অপেক্ষা করছিলাম। শেষ সিটি দিয়ে ট্রেন দ্রুত চলা শুরু করলে দৌড়ে গিয়ে একটি সাধারণ বগিতে ঢুকে পড়লাম। এ বগিতে খুব ভীড় ছিল। তাই আমাকে দাঁড়িয়েই থাকতে হল। আমি খেয়াল করলাম, কিছু যাত্রী আমাকে দেখে আশ্চর্য হয়েছে, কিন্তু কিছু যাত্রীর চোখে ছিল রাগ ও বিরক্তি। পাকিস্তান থেকে আগত শিখ ও হিন্দু যাত্রীই বেশি ছিল ঐ বগিতে। বরং বলা চলে হিন্দু যাত্রীই ছিল বেশি, শিখ ছিল চার-পাঁচজনের মত। দু’চার মিনিট না যেতেই উপরের সিটে শুয়ে থাকা এক লোক আমাকে দেখে চিৎকার করতে শুরু করল; ‘আরে মুসলমানরা এখানে এভাবে নির্ভয়ে চলাফেরা করে আর পাকিস্তানে আমাদের সাথে কী নির্মম আচরণ করা হয়’। তার বাক্য হুবহু আমার মনে নেই, তবে মর্ম ছিল অনেকটা এমনই। ভাষা আধা উর্দূ আধা পাঞ্জাবি। আমি মাথা উঠিয়ে লোকটিকে দেখলাম। গুরুতর আহত এক হিন্দু লোক, শরীরের কয়েক জায়গায় পট্টি বাঁধা। তার এই আবেদন শুনে অধিকাংশ যাত্রীই যেন জ্বলে উঠল। পরিস্থিতি এমন ঘোলাটে হয়ে গেল যে, আমার মনে হচ্ছিল এ-ই আমার শেষ। কিছু যাত্রী দেখলাম আমার দিকে এগিয়ে আসছে। হঠাৎ একটি ঘটনা ঘটল…।

আমার পিছনে দুজন শিখ যুবক বসেছিল। তারা আমাকে টান দিয়ে তাদের দুজনের মধ্যে বসিয়ে দিয়ে নিজেরা দাঁড়িয়ে গেল। আমার দিকে তেড়ে আসা লোকদের সামনে গিয়ে বলল, খবরদার! এর দিকে কেউ হাত বাড়াবে না। এর গায়ে যদি কেউ হাত দাও তো হয় তার লাশ পড়ে যাবে আর নয় এখানে আমাদের লাশ পড়বে। তোমাদেরকে কেউ যদি মেরে থাকে তো তার কাছ থেকে গিয়ে প্রতিশোধ নাও, এ-লোক তোমাদের কী করেছে?

এটা ছিল আল্লাহ তাআলার কুদরতের আশ্চর্য কারিশমা। নতুবা মুসলিম বিদ্বেষে এবং পূর্ব পাঞ্জাবের মুসলমানদের হত্যা করার ক্ষেত্রে হিন্দুদের তুলনায় শিখদের দৌরাত্ম্য ছিল বেশি। এমনটিই আমরা শুনে আসছিলাম এবং বাস্তবতাও ছিল তাই।

যাই হোক, তাদের দু’জনের গর্জে উঠার কারণে এগিয়ে আসা লোকগুলো থেমে গেল। কিছুক্ষণের জন্য বগিতে নীরবতা নেমে এল। একটু পর আমি ঐ আহত যাত্রীটিকে উদ্দেশ্য করে বললাম, ভাই তুমি মাজলুম, তোমার উপর জুলুম করা হয়েছে, তাই তোমার রাগ ওঠারই কথা। কিন্তু একটু চিন্তা করো, যদি সেখানকার জুলুমের বদলা এখানের নির্দোষ মুসলিমদের থেকে নেওয়া হয় আর এখানকার জুলুমের বদলা সেখানের নিরপরাধ হিন্দু ও শিখদের থেকে নেওয়া হয় আর এই শয়তানি চক্কর এভাবেই চলতে থাকে তাহলে আমাদের উভয়ের পরিণতি কী হবে? এই পাগলামি আমাদের উভয় পক্ষের কত লাখ ঘরবাড়ি উজার করে দিয়েছে! এখন তো আমাদের হুঁশ হওয়া দরকার।

এরপর আমি সকল যাত্রীদের উদ্দেশ্যে বললাম, আমি ভুলে এ বগিতে আসিনি, ইচ্ছে করেই এসেছি। এ বিশ্বাস মনে নিয়েই এসেছি যে, আমার সৃষ্টিকর্তা আমার মৃত্যুর একটি সময় নির্দিষ্ট করে রেখেছেন। তার আগে আমাকে কেউ মারতে পারবে না। আর যখন সে সময় হয়ে যাবে তখন আমাকে কেউ মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতেও পারবে না। এ আমার বিশ্বাস। আশা করি আপনারাও এমনই বিশ্বাস পোষণ করেন। এরপর শিখ যুবকদের দেখিয়ে বললাম, না এদেরকে আমি চিনি আর না এরা আমায় চেনে। কিন্তু যেহেতু আমার মৃত্যুর সময় হয়নি তাই আল্লাহ তাআলা এদেরকে আমার সহযোগিতার জন্য প্রস্তুত করে দিয়েছেন।

বগির এক কোণে বাদামি রঙের খদ্দরের কাপড় ও গান্ধি ক্যাপ পরা এক বাবুজি ছিলেন। আমার কথা শেষ হওয়ার পর তিনি সহিংসতা ও প্রতিশোধের এই শয়তানি চক্করের বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য দিলেন। সম্ভবত তিনি লিডার পর্যায়ের লোক ছিলেন। কথা শুনে মনে হচ্ছিল বক্তৃতা দেওয়ার অভ্যাস আছে। তবে তিনি এই উপদেশবাণী বিলানোর সাহস তখনই করেছিলেন যখন বগির পরিস্থিতি শান্ত হয়ে এসেছিল।

এই ট্রেন সাহারানপুর ও দেওবন্দের মাঝে আর কোথাও থামে না। দেওবন্দ স্টেশন পৌঁছতে আধা ঘণ্টার মত লাগল। ট্রেন থামলে আমি বগি থেকে নামলাম।

দেওবন্দ থেকে দিল্লী

দেওবন্দে দু’তিন দিন ছিলাম। এর পর দিল্লী যাওয়ার দরকার ছিল। দিল্লী সফরে আমি মুসলিম যাত্রীদের জন্য নির্দিষ্ট বগিতে করেই গিয়েছিলাম না সাধারণ বগিতে তা এখন মনে পড়ছে না। যাই হোক আমি দিল্লী গিয়েছিলাম। সে সময় দিল্লীতে মুসলমানরা নিজেদের এলাকা ছাড়া অন্য এলাকায় স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারত না। নির্ভয়ে বাজারেও যেতে পারত না। আমার গন্তব্য ছিল কাসেমজানে অবস্থিত জমিয়তে উলামার কার্যালয়। চাঁদনিচক ও বিল্লিমারান হয়ে পায়ে হেঁটেই কাসেমজান চলে যাওয়া যায়। এটাই ছিল সোজা পথ। কিন্তু মানুষ ভয়ে এ পথ দিয়ে যেত না। অমি স্থির করলাম, এ পথ দিয়েই হেঁটে চলে যাব। আমার মনে হয়েছিল, এখন মুসলমানদের বাজারে চলাফেরা করার মত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কিছু লোক সাহস করে আল্লাহর উপর ভরসা রেখে চলাফেরা শুরু করলেই আস্তে আস্তে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে।

স্টেশন থেকে বেরিয়ে এসে কাসেমজান যাওয়ার জন্য এক কুলির সাথে কথা বললাম। এরপর তার মাথায় মালপত্র চাপিয়ে দিয়ে চলতে শুরু করলাম। স্টেশনের বাইরে কিছু মুসলমান টাঙ্গাওয়ালা ছিল। তারা জিজ্ঞাসা করল কোথায় যাবেন? বললাম, কাসেমজান যাব। তারা বলল, টাঙ্গায় উঠুন, পৌঁছে দিচ্ছি। আমি বললাম, আমরা পায়ে হেঁটে যেতে চাচ্ছি। তারা মনে করল, আমি এখানকার পরিস্থিতি জানি না। তাই বলল, এ রাস্তা দিয়ে কোনো মুসলমানের হেঁটে যাওয়ার মত পরিস্থিতি নেই। আমি তাদের সহমর্মিতার শুকরিয়া আদায় করে বললাম, আমি পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত আছি, আমি পায়ে হেঁটেই যাব, ইনশা আল্লাহ কিছুই হবে না। ঐ বেচারারা মনে করল, আমার কাছে ভাড়া নেই কিংবা আমি খরচ করতে চাইছি না। তাই একজন বলল, আপনি ভাড়ার চিন্তা করবেন না, ভাড়া যা পারেন দিবেন, আল্লাহর ওয়াস্তে উঠে বসুন। আমি বললাম, ভাই ভাড়ার প্রশ্ন না, আল্লাহ তাআলা অনেক ধন-দৌলত দিয়েছেন, আল্লাহর রহমতে খরচও করি অনেক। আসল কথা হল, আমি চাঁদনিচক দিয়ে হেঁটে যেতে চাই। তাদের মধ্যে বয়স্ক এক টাঙ্গাওয়ালা-আমার প্রতি যার সহমর্মিতা একটু বেশি বলেই মনে হল-কিছুটা রাগ হয়ে আমাকে বলল, আরে মোল্লাজী আমার টাঙ্গায় এসে বসো, আমি তোমাকে পৌঁছে দিচ্ছি, আমাকে ভাড়া দেওয়া লাগবে না। তার কথার কোনো জবাব না দিয়ে আমি সামনে হাঁটা শুরু করলাম। তখন তিনি খুব রুষ্ট হলেন, বললেন, আচ্ছা যাও যাও, মরণ যখন ডাক দিয়েছে তখন আমাদের আর কী করার আছে। আমি আবার তার শুকরিয়া আদায় করে সামনে হাঁটা শুরু করলাম।

যারপরনাই আল্লাহমুখী হয়ে কয়েক ফারলঙের[২] এ পথটুকু অতিক্রম করেছিলাম। জীবনে আর কখনো তখনকার মত ধ্যানমগ্ন অবস্থা নসীব হয়েছে কি না সন্দেহ। কোম্পানিবাগের মাঝখানের সড়ক ধরে চাঁদনিচক অতিক্রম করলাম। খেয়াল করে দেখলাম, সবাই আমাকে আশ্চর্য হয়ে দেখছে। কিন্তু কেউ অবাঞ্ছিত কিছু বলেনি, কারও চোখ দেখে খারাপ কিছুও মনে হয়নি। একসময় বিল্লিমারান অতিক্রম করে কাসেমজান পৌঁছলাম।

দিল্লীতে দু’তিন দিন ছিলাম। ফিরে আসার দিন খুব ভোরে বের হলাম। সকালের ট্রেন ধরতে চাইছিলাম। এবারও পায়ে হেঁটে স্টেশনে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। তাই ফজর নামায পড়েই কুলির খোঁজে বেরিয়ে পড়লাম। কাসেমজান বা বিল্লিমারানে কোনো কুলি পাওয়া গেল না। চাঁদনিচক যেতে হল। সেখানে গিয়ে দেখি সীমান্তের পাঠানদের পোশাক পরা দুই যুবক। পাঞ্জাবি-পায়জামা ও বড় পাগড়ি পরা। আমি তো দেখে অবাক-এরা এখানে কী করে এল, আর চাঁদনিচকেই বা কী করছে যেখানে কোনো মুসলিমের পা রাখারও পরিস্থিতি নেই। পরে কথা বলে বুঝতে পারলাম এরা মুসলিম নয় হিন্দু পাঠান। বিপদে পড়ে এখানে এসেছে। পেশোয়ারের এক গ্রামের বাসিন্দা এরা। আট দশ দিন হল এখানে এসেছে। খুব কষ্টে দিন কাটছে। ক্যাম্প থেকে যে রেশন দেওয়া হয় তাতে ওদের এক বেলাই ভালো করে চলে না।

আমি ওদের বললাম, আমি স্টেশনে যাব, কাসেমজানে আমার কিছু মালপত্র আছে, আমার একজন কুলি দরকার। ওরা বলল, চলুন আমরা পৌঁছে দিচ্ছি। আমি পারিশ্রমিক ঠিক করে নিতে চাইলাম। ওরা বলল, আপনার যা মন চায় দিবেন, আমরা কিছু বলব না।

: আমার মালপত্র তো কম। আমার একজন হলেই চলবে। তোমাদের যে কোনো একজন আমার সাথে চল।

: আমরা দু’জন সবসময় একসাথেই থাকি। আমরা দু’জনই যাব।

: ঠিক আছে তোমাদের মর্জি।

আমি ওদের নিয়ে জমিয়তে উলামার কার্যালয়ে এলাম। এরপর মালপত্র নিয়ে স্টেশনের দিকে রওয়ানা দিলাম।

পথে যেতে যেতে ওদের হালপুরসি করলাম। যে ছেলেটি মাথায় মালপত্র নিয়েছিল ও বলল, আমরা এক গ্রামের বাসিন্দা। আমি গরিব ঘরের ছেলে আর ও অনেক বিত্তবান ঘরের ছেলে। কিন্তু এখন আমাদের উভয়ের অবস্থা এক। ও কোনো পরিশ্রম করতে পারে না। এ জন্য আমরা দু’জন একসাথেই থাকি। আমি সামান্য পরিশ্রম করি, এতে আমাদের দিন চলে যায়। আমার নিজের কষ্ট আমার কাছে কিছু মনে হয় না, কিন্তু ওর কষ্ট আমার সহ্য হয় না। কথার মাঝে ও এ-ও বলল, আমাদের গ্রামের মুসলিম বাসিন্দারা আমাদের অনেক সহযোগিতা করেছে। আমাদেরকে পুলিশ গ্রাম থেকে বের করে দিতে এলে তাদের সাথে লড়াই করেছে। কিন্তু শেষে একদিন গাড়ির বহর নিয়ে সেনাবাহিনী এল। তখন আর তাদের কিছু করার ছিল না। আমরাও তাদের বললাম, থাক, আমাদের যেতে দাও। আমরা যখন গ্রামের লোকদের ছেড়ে আসছিলাম তখন তারা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল। গ্রামের সকল মুসলিম বসিন্দারা এসে কাঁদতে কাঁদতে আমাদের বিদায় দিয়েছে। তার পর ও বলল, ঐ ছেলেটির বাবাকে পথিমধ্যে (পাঞ্জাবের এক জায়গায়) হত্যা করা হয়। এখন আমরা দু’জন একে অপরকে ভাই বানিয়ে নিয়েছি। এ কথা শুনে আমার বুক ফেটে কান্না আসছিল। গাল বেয়ে অবিরত অশ্রু ঝরছিল। ওদের খেদমতে পেশ করার মত বড় অংকের অর্থকড়িও তখন আমার কাছে ছিল না। খুব আফসোস হল। ভাড়ার অতিরিক্ত যে কয় রূপি পকেটে ছিল তা ওদের খেদমতে পেশ করলাম।


[১] ৪০-৪৫ বছর আগে গাজীয়াবাদ স্টেশনের অবস্থা যে কত সাধারণ ছিল তা এখন কল্পনাও করা যায় না।

[২] এক ফারলঙে বাইশ গজ। এক মাইলের আট ভাগের এক ভাগ।

 

সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ২০১৪

মাসিক আল কাউসার