জিহাদের হাকীকত, হিকমত এবং কিছু ভ্রান্তির নিরসন – মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল মালেক [পর্ব -৩]

৪. তাবলীগের অনুমতি পেয়ে যাওয়াই কি জিহাদ পরিত্যাগের জন্য যথেষ্ট?

কোনো কোনো বন্ধুর এই ভুল ধারণাও আছে যে, কোনো অমুসলিম সরকার তার দেশে তাবলীগের অনুমতি দিলে তাদের সাথে ইক্বদামী (আক্রমণমূলক) জিহাদ ঠিক নয়! এ জাতীয় ভুল ধারণার শিকার এক ব্যক্তি হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ তক্বী উসমানী (দাঃবাঃ)-কে একটি দীর্ঘ চিঠি লিখেন। হযরত মাওলানা পত্র লেখকের ভ্রান্তি দূর করেন এবং এ বিষয়ে শরয়ী নির্দেশনার ব্যপারে তাকে অবহিত করেন। তাঁর পুরো উত্তর ফিক্বহি মাক্বালাত খঃ ৩, পৃ ২৮৭-৩০৪ এ মুদ্রিত আছে। উত্তরের নির্বাচিত অংশ পাঠকের সামনে পেশ করা হলো—

“আপনি জিহাদের ব্যপারে যা লিখেছেন তার সারাংশ আমি এই বুঝি যে, কোনো অমুসলিম সরকার তার দেশে তাবলীগের অনুমতি প্রদান করলে অতঃপর তার সাথে আর জিহাদ জায়েয থাকে না। যদি এই আপনার উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তবে আমি আপনার সাথে একমত নই। ইসলাম প্রচারের পথে প্রতিবন্ধকতা শুধু এই নয় যে, সরকার ইসলাম প্রচারের ব্যপারে আইনী নিষেধাজ্ঞা জারী করে বরং মুসলমানদের বিপরীতে কোনো অমুসলিম রাষ্ট্র অধিক প্রতিপত্তির মালিক হওয়াও দ্বীনে হক্ব এর প্রচারে অনেক বড় বাধা। বর্তমান সময়ে পৃথিবীর অধিকাংশ রাষ্ট্রে তাবলীগের ব্যপারে কোনো আইনী নিষেধাজ্ঞা নেই কিন্তু পৃথিবীতে তাদের বর্তমান প্রতিপত্তির কারণে বিশ্বব্যাপী সাধারণভাবে এমন একটি মানসিকতা তৈরি হয়ে গেছে যা সত্য প্রচারের ব্যপারে কোনো আইনী নিষেধাজ্ঞার চেয়ে কোনো অংশে কম নয় বরং বেশি। এজন্য কাফিরদের প্রতিপত্তি চুরমার করা জিহাদের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্যসমূহের অন্যতম। যাতে তাদের বিদ্যমান এই প্রতিপত্তির কারণে যে মানসিক ভীতি মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে তা দূরীভূত হয় এবং সত্য গ্রহণের পথ উন্মুক্ত হয়। যতদিন পর্যন্ত তাদের এই প্রতিপত্তি বজায় থাকবে, ততদিন পর্যন্ত মানুষের মনে এই ভীতিও অটুট থাকবে এবং দ্বীনে হক্ব কবুল করার জন্য পুরোপুরি অগ্রসর হওয়া তাদের পক্ষে সম্ভবপর হবে না।

অতএব জিহাদ জারী থাকবে। কুরআনুল কারীমে ইরশাদ হয়েছে—
যাদের প্রতি কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে তাদের মধ্যে যারা আল্লাহর প্রতি ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান আনে না এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ যা হারাম করেছেন তা হারাম গণ্য করে না এবং সত্য দ্বীন অনুসরণ করে না; তাদের সাথে যুদ্ধ করবে যাবৎ না তারা নত হয়ে স্বহস্তে জিযইয়া দেয়। [সূরা তাওবা : আয়াত ২৯]

উপরোক্ত আয়াতে ততদিন পর্যন্ত ক্বিতাল জারী রাখার আদেশ করা হয়েছে যতদিন না কাফেররা অবনত হয়ে জিযইয়া প্রদান করে। যদি ক্বিতালের উদ্দেশ্য শুধু তাবলীগের আইনী অনুমতি অর্জনই হত তবে বলা হত, “যাবত না তারা তাবলীগের অনুমতি প্রদান করে”। কিন্তু জিযইয়া ওয়াজিব করা এবং এর পাশাপাশি তাদের অবনত হওয়ার উল্লেখ এ বিষয়ের সুস্পষ্ট প্রমাণ যে, তাদের প্রতিপত্তি বিলুপ্ত করাই আসল উদ্দেশ্য যাতে কুফরের রাজনৈতিক প্রভুত্বের কারণে ভীতির যে পর্দায় মনমানস আচ্ছন্ন হয়ে আছে তা উন্মোচিত হয় অতঃপর মানুষের পক্ষে ইসলামের সৌন্দর্যের প্রতি স্বাধীন ও মুক্ত মনে চিন্তা করার সুযোগ ঘটে। ইমাম রাযী (রহঃ) এই আয়াতের আলোচনায় তাফসীরে কাবীরে বলেন—

“জিযিয়ার উদ্দেশ্য কাফেরকে কুফরীর হালতে বাকী রাখা নয় বরং উদ্দেশ্য হল তাকে বাঁচিয়ে রেখে কিছুদিন সময় দেওয়া, যে সময়ের মধ্যে তার ব্যপারে এই আশা করা হবে যে, সে ইসলামের সৌন্দর্য অবলোকন করে কুফর থেকে ইসলামের দিকে আসবে। অতএব যখন কাফেরকে কিছুদিন সময় দেওয়া হবে এবং সে ইসলামের প্রভাব দেখবে, তার সত্যতার দলীলসমূহ শুনবে, এবং কুফরের লাঞ্ছনা দেখবে তখন এইসব বিষয় তাকে ইসলামের প্রতি অগ্রসর হওয়ার ব্যপারে সাহায্য করবে। বস্তুতঃ জিযইয়া বিধিবদ্ধ হওয়ার উদ্দেশ্য এই”।

দ্বিতীয় যে বিষয়টি ভাবার তা হল, রাসূলুল্লাহ ﷺ এর যুগে বা সাহাবায়ে কেরামের যুগে কোথাও কি একটি নযীরও  এমন পাওয়া যায় যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বা সাহাবায়ে কেরাম কোনো রাষ্ট্রে জিহাদের পূর্বে কোনো তাবলীগী মিশন পাঠিয়েছেন এবং অপেক্ষা করে দেখেছেন যে, তারা তাবলীগের অনুমতি দেয় কি না? অতঃপর তাবলীগী কাজের অনুমতি দানে অস্বীকৃতি জানানোর ক্ষেত্রেই শুধু জিহাদ করেছেন?

বলা বাহুল্য এমন কখনো হয়নি৷ উপরোক্ত আলোচনা থেকে এছাড়া আর কি ফলাফল বের করা সম্ভব যে, শুধু তাবলীগের অনুমতি লাভ করাই উদ্দেশ্য ছিল না। অন্যথায় বহু রক্তক্ষয়ী লড়াই শুধু এই এক শর্ত দিয়েই বন্ধ করা সম্ভবপর হত যে, মুসলমানদের তাবলীগের ব্যপারে কোনোরূপ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবে না। কিন্তু অন্তত অধমের সীমাবদ্ধ অধ্যয়নে পুরো ইসলামী ইতিহাসের কোথাও এমিন একটি ঘটনাও নেই যাতে এটুকু সুযোগ চেয়ে লড়াই বন্ধ করার ব্যপারে আগ্রহ প্রকাশ করা হয়েছে। অথচ এর পরিবর্তে কাদেসিয়্যার যুদ্ধের সময় মুসলমানগণ নিজেদের যে উদ্দেশ্য ব্যক্ত করেছেন তা এই ছিল—

মানুষকে মানুষের দাসত্ব থেকে মুক্ত করে আল্লাহর দাসত্বে নিয়োজিত করা।
[কামিল, ইবনে আসীর, খঃ ২, পৃঃ ১৭৮]

অনুরূপ কুরআনুল কারীমে ইরশাদ হয়েছে—
তাদের সাথে ঐ সময় পর্যন্ত লড়াই করো যখন আর ফিতনা বিদ্যমান না থাকে এবং যে সময় বিজয় সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর হয়ে যায়। [সূরা আনফাল : আয়াত ৩৯]

এই আয়াতের তাফসীরে আমার পিতা হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ শফী (রহঃ) লিখেন—

“দ্বীন অর্থ বিজয় ও কর্তৃত্ব। এই অর্থে আয়াতের তাফসীর এই হবে যে, মুসলমানদের জন্য কাফেরদের সাথে ঐ সময় পর্যন্ত লড়াই জারি রাখা উচিত যতক্ষণ না মুসলমানরা তাদের অত্যাচার থেকে নিরাপদ হয়ে যায় এবং দ্বীন ইসলামের বিজয় অর্জিত হয় যাতে সে অন্যদের অত্যাচার থেকে মুসলমানদেরকে রক্ষা করতে পারে।”

“এই তাফসীরের সারকথা হল, মুসলমানদের উপরে ততক্ষণ পর্যন্ত ইসিলামের দুশমনদের সাথে জিহাদ ও জারী রাখা ওয়াজিব যতক্ষণ না মুসলমানদের উপর তাদের অত্যাচারের ফিতনা বন্ধ হয় এবং ইসলাম সকল ধর্মের উপর বিজয়ী হয়। এই অবস্থা ক্বিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে সৃষ্টি হবে তাই জিহাদের বিধানও ক্বিয়ামত পর্যন্ত চলমান থাকবে।”
[মা’আরিফুল কুরআন খ. ৪ পৃ. ২৩৩]

মোটকথা, জিহাদের উদ্দেশ্য শুধু তাবলীগের আইনগত অনুমতি লাভ করা নয় বরং কাফেরদের প্রতিপত্তি বিলুপ্ত করে মুসলমানদের প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা করা, যাতে একদিকে কোনো মুসলমানের প্রতি খারাপ দৃষ্টিতে তাকানোর সাহস তাদের না হয় এবং অন্যদিকে কাফিরদের প্রতিপত্তিতে ভীত সন্ত্রস্ত মানুষ এই মানসিক ভীতি থেকে মুক্ত হয়ে মুক্ত মনে ইসলামের সৌন্দর্য অনুধাবন করতে আগ্রহী হতে পারে। বাস্তবিক পক্ষে এই বিষয়টিও ইসলামের হেফাজতের উদ্দেশ্যই পূর্ণ করে। এজন্য যে উলামায়ে কেরাম জিহাদের জন্য ‘হেফাজতে’র শব্দ অবলম্বন করেছেন তাদের উদ্দেশ্যও তাই। মনে রাখতে হবে কুফরের প্রতিপত্তি বিলুপ্ত করা ও ইসলামের প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা করা হেফাজতে ইসলামের একটি মৌলিক স্তম্ভ। অতএব এই মৌলিক স্তম্ভটিকে ‘হিফাযত’ এর আওতা থেকে কোনোভাবেই বের করা যায় না। আমার মতে সকল বড় বড় আলেম জিহাদের উদ্দেশ্য এই বিষয়টিকেই সাব্যস্ত করেছেন। হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ ইদরীস কান্ধলবী (রহঃ) লিখেন—

“জিহাদের আদেশ প্রদান করার পিছনে মহান আল্লাহ তা’আলার উদ্দেশ্য এই নয় যে, এক মুহূর্তে সকল কাফিরের প্রাণ সংহার করা হবে বরং উদ্দেশ্য হল, আল্লাহর দ্বীন পৃথিবীতে কর্তৃত্ববান হবে, মুসলমান মর্যাদার সাথে জীবনযাপন করবে এবং নিরাপত্তার সাথে আল্লাহর ইবাদতে সক্ষম হবে। কাফিরদের ব্যপারে এই আশংকা থাকবেনা যে তারা দ্বীনের ব্যপারে কোনো অসুবিধার সৃষ্টি করতে পারে। ইসলাম তার দুশমনদের অস্তিত্বের দুশমন নয় বরং তাদের এমন প্রতিপত্তির দুশমন যা ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য হুমকির কারণ হয়।”
[সীরাতে মুস্তাফা ﷺ, খঃ ২ পৃঃ ৩৮৮]

অন্যত্র লিখেন—

“আল্লাহ তা’আলার বাণী—
وَقَٰتِلُوهُمْ حَتَّىٰ لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ ٱلدِّينُ كُلُّهُۥ لِلَّهِۚ
এ আয়াতে এই ধরণের জিহাদই উদ্দেশ্য। অর্থাৎ হে মুসলমানজাতি! তোমরা কাফেরদের সাথে ততক্ষণ পর্যন্ত লড়াই করো, যখন আর কুফরের ফিতনা বিদ্যমান না থাকে এবং আল্লাহর দ্বীনের পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এই আয়াতে ফিতনা বলতে কুফরের শক্তি ও প্রতিপত্তির ফিতনা উদ্দেশ্য এবং وَيَكُونَ ٱلدِّينُ كُلُّهُۥ لِلَّهِۚ থেকে দ্বীনের বিজয় ও কর্তৃত্ব উদ্দেশ্য। অন্য আয়াতে এসেছে لِيُظْهِرَهُۥ عَلَى ٱلدِّينِ كُلِّهِۦ অর্থাৎ দ্বীনের এ পরিমাণ শক্তি ও কর্তৃত্ব অর্জিত হবে যে, কুফরি শক্তির সামনে তার আর পরাস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না এবং দ্বীন ইসলাম কুফরের ফিতনা থেকে পুরোপুরি নিরাপদ হয়ে যাবে। [প্রাগুক্ত, খঃ ২, পৃঃ ৩৮৬]

যদি শুধু তাবলীগের অনুমতি লাভের পর জিহাদের প্রয়োজন বাকি না থাকে তবে তো আজ দুনিয়ার অধিকাংশ দেশেই তাবলীগের অনুমতি আছে (এবং আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে, অনুমতি না থাকলে কিছু মুসলিম দেশেই নেই) অতএব বলতে হবে এখন আর মুসলমানদের জন্য অস্ত্র ধারণ করার প্রয়োজন নেই। বিশ্ববাসীর মন মগজে তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি বসতে থাকুক, তাদেরই নীতিমালা প্রচলিত হতে থাকুক, বিধি-বিধানও তাদেরই চলুক, তাদের ধ্যান-ধারণা, চিন্তা ও মতবাদই প্রচারিত হোক আর মুসলমানগণ শুধু এই নিয়ে পরিতৃপ্ত থাকুক যে, ঐসব অমুসলিম দেশে আমাদের মুবাল্লিগগণের প্রবেশাধিকারতো আর বন্ধ হয় নাই! প্রশ্ন হয়, যে পৃথিবীতে কুফর তার ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের জয়ভেড়ী বাজিয়ে চলেছে সেখানে যদি আপনাকে তাবলীগের অনুমতি প্রদান করা হয় তবে কয়জন লোক এমন পাবেন যারা এই তাবলীগকেই স্থিরচিত্তে শোনার জন্য এবং এতে চিন্তা ফিকির করার জন্য প্রস্তুত হবে?

যে পরিবেশে রাজনৈতিক শক্তি ও ক্ষমতার সাহায্যে ইসলাম ও তার শিক্ষার পুরো বিপরীত চিন্তাভাবনা পূর্ণ শক্তিতে প্রচারিত হচ্ছে এবং এসব প্রচারের জন্য এমন সব মাধ্যমও ব্যবহৃত হচ্ছে যা মুসলমানদের পক্ষে ব্যবহার করা সম্ভব নয়, সেখানে তাবলীগের অনুমতি লাভ হলেও তা কী পরিমাণ ফলদায়ক হতে পারে?

হ্যাঁ যদি ইসলাম ও মুসলমানের এমন শক্তি সামর্থ অর্জিত হয়ে যায় যার মোকাবেলায় কাফেরের শক্তিমত্তা পরাস্ত হয় বা অন্তত তারা ঐ ফিতনা সৃষ্টি করতে সক্ষম না হয় যা ইতিপূর্বে উল্লেখিত হয়েছে তো সেক্ষেত্রে অমুসলিম রাষ্ট্রসমূহের সাথে নিরাপদ চুক্তির মাধ্যমে শান্তি বজায় রাখা জিহাদের বিধানের পরিপন্থি নয়। অনুরূপ যে পর্যন্ত কুফরের প্রতিপত্তি নির্মূল করার মত প্রয়োজনীয় শক্তি মুসলমানদের অর্জিত না হয়, ততদিন পর্যন্ত শক্তি অর্জনের পাশাপাশি অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে নিরাপদ চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়াও নিঃসন্দেহে জায়েয। মোটকথা অমুসলিমদের সাথে শান্তি চুক্তি দুই অবস্থায় হতে পারে।

ক. যে সব রাষ্ট্রের শক্তি মুসলমানদের শক্তির জন্য বিপজ্জনক নয় তাদের সাথে সন্ধিমূলক ও নিরাপত্তা চুক্তি করা যেতে পারে যাবৎ না তারা দ্বিতীয়বার মুসলমানদের প্রভাব প্রতিপত্তির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।

খ. মুসলমানদের কাছে সশস্ত্র জিহাদের সামর্থ না থাকলে সামর্থ অর্জিত হওয়া পর্যন্ত চুক্তিবদ্ধ থাকা যেতে পারে। [ফিক্বহী মাক্বালাত, খঃ ৩, পৃঃ ৩৫১]

৫. জিহাদের বিধান কি বিশেষ পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে ছিল?

জিহাদের হাক্বীকত, লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও এর বিধানাবলী সম্পর্কে যিনিই অবহিত হবেন তিনিই নিঃসংশয় হবেন যে, জিহাদ একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ‘আলমী ইসলাহী (আন্তর্জাতিক সংশোধনমূলক) দায়িত্ব, জিহাদের ফরযিয়্যত এখনো বাকী আছে এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত বাকী থাকবে এবং তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ এর নিকট অতি পছন্দনীয় আমলসমূহের অন্যতম।
ইরশাদ হয়েছে—

বলো, তোমাদের নিকট যদি আল্লাহ, তাঁর রাসূল ﷺ এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করার চেয়ে অধিক প্রিয় হয় তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই, তোমাদের পত্নী, তোমাদের স্বগোষ্ঠী, তোমাদের অর্জিত সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য যার মন্দা পড়ার আশংকা করো এবং তোমাদের বাসস্থান যা তোমরা ভালোবাসো, তবে অপেক্ষা করো আল্লাহর আদেশ আসা পর্যন্ত, আল্লাহ সত্যত্যাগী সম্প্রদায়কে সৎপথ প্রদর্শন করেন না।
[সূরা তাওবা : আয়াত ২৪]

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে—

হে মুমিনগণ! আমি কি তোমাদেরকে এমন এক বাণিজ্যের সন্ধান দিব যা তোমাদেরকে রক্ষা করবে মর্মন্তুদ শাস্তি হতে? তা এই যে, তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলে বিশ্বাস স্থাপন করবে এবং তোমাদের ধন সম্পদ ও জীবন দ্বারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে। এটাই তোমাদের জন্য শ্রেয় যদি তোমরা জানতে। আল্লাহ তোমাদের পাপ ক্ষমা করবেন এবং তোমাদেরকে দাখিল করবেন জান্নাতে, যার পাদদেশে ঝর্ণাসমূহ প্রবাহিত এবং স্থায়ী জান্নাতের উত্তম বাসগৃহে। এবং এই মহা সাফল্য।

এবং তিনি দান করবেন তোমাদের বাঞ্ছিত আরো একটি অনুগ্রহঃ আল্লাহর সাহায্য ও আসন্ন বিজয়; মুমিনদেরকে সুসংবাদ দাও।
[সূরা সাফফ : আয়াত ১০-১৩]

হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে—

আমার পছন্দ যে, আমি আল্লাহর পথে নিহত হব পুনরায় জীবিত হব ও পুনরায় নিহত হব এবং পুনরায় জীবিত হয়ে নিহত হব। [সহীহুল বুখারী ১/১০, সহীহ মুসলিম ২/১৩৩]

মোটকথা, জিহাদের ফযীলত সংক্রান্ত আয়াতে কুরআনের পৃষ্ঠাসমূহ পরিপূর্ণ এবং শত শত হাদীসে এর ফযীলত উল্লেখিত হয়েছে।

কিন্তু ইসলামী শিক্ষা ও নির্দেশনা থেকে দূরত্বের কারণে অথবা না জানি অন্য কী কারণে কোনো কোনো লোককে বলতে শোনা যায় যে, “যেহেতু তখন ক্বিতাল ছাড়া পট পরিবর্তনের অন্য কোনো মাধ্যম ছিল না তাই ইসলাম এই পন্থাটিকেই বহাল রেখেছে কিন্তু বর্তমান অবস্থা ভিন্ন” অর্থাৎ এখন রাজনৈতিক কর্ম প্রচেষ্টার মাধ্যমেই ক্ষমতা দখল করে পৃথিবীতে ইসলামের মর্যাদা ও কর্তৃত্ব স্থাপন সম্ভব। অতএব এখন জিহাদের প্রয়োজন নেই। জিহাদের বিধান মানসুখ বা রহিত হয়ে যাওয়াই উচিত। নাঊযুবিল্লাহ! কেই তো এই ধারণাও প্রকাশ করেছে যে, “যে সরকার তার নিজেদের দেশে দাওয়াত ও তাবলীগের অনুমতি প্রদান করে তাদের সাথে ইক্বদামী বা আক্রমণাত্মক জিহাদ করা উচিত নয় বিশেষত বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে, যখন সাম্রাজ্যবাদকে নিন্দার দৃষ্টিতে দেখা হয়, কিন্তু যখন রাজ্যজয়ের সাধারণ প্রচলন ছিল এবং এ বিষয়টি রাজ রাজড়ার কীর্তি ও গুণাবলির মধ্যে পরিগণিত হত তখনকার কথা ভিন্ন। যেসব ইক্বদামী জিহাদের ঘটনাবলীতে ইসলামী ইতিহাস পরিপূর্ণ তা সবই ঐ সময়কার।”

এই দুইটি মত যে ভ্রান্ত এবং কিতাব ও সুন্নাহর জিহাদ সংক্রান্ত নির্দেশনাবলী এবং শরীয়তের ইজমায়ী বিধানাবলীর পরিপন্থি তা তো একেবারেই স্পষ্ট কিন্তু লক্ষ্যনীয় ব্যপার হল, এই দুই মতের মধ্যে অজান্তেই ইসলামী শরীয়তের প্রতি কত বড় অপবাদ আরোপ করা হল যে, একটি সাময়িক বা পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির কারণে সৃষ্ট বিধানকে ইসলামী শরীয়ত কিয়ামত পর্যন্ত সময়ের জন্য চলমান একটি বিধান বানিয়ে দিয়েছে এবং তার এত এত ফাযাইল বর্ণনা করেছে এবং এর প্রতি এত বেশি উদ্বুদ্ধ করেছে যদ্দরুন তা একটি সাময়িক বিধান নয় বরং চিরন্তন বিধান হওয়া সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হচ্ছে৷

আর দ্বিতীয় মতটিতো আরো বেশী ভয়াবহ। হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ তাক্বী উসমানী (দাঃ বাঃ) এর ভাষায়, “যদি এই মতটি ঠিক ধরে নেওয়া হয় তবে এর অর্থ এই হবে যে, কোনো বস্তু ভালো বা মন্দ হওয়ার জন্য ইসলামের নিজস্ব কোনো মাপকাঠি নেই৷ যদি কোনো যুগে কোনো একটি মন্দ বিষয়কেও “ভালো ও কীর্তিমূলক” গণনা করা হয় তবে ইসলাম ও তার অনুসরণ করে এবং যে যুগে মানুষ একে মন্দ মনে করে ইসলামও সেখানে থেমে যায়!

প্রশ্ন হল, ‘ইক্বদামী জিহাদ’ কোবো ভালো বিষয় কিনা? যদি ভালো হয় তবে মুসলমান এ থেকে শুধু এজন্য কেন বিরত থাকবে যে, আজকাল সাম্রাজ্যবাদকে নিন্দার দৃষ্টিতে দেখা হয়? আর যদি বিষয়টি আসলেই ভালো না হয় তবে বিগত সময়ে ইসলাম কেন এ কাজ থেকে বাধা প্রদান করে নাই! ইসলাম কি শুধু এজন্যই একে অবলম্বন করেছিল যে, তা রাজা বাদশার কীর্তির মধ্যে পরিগণিত হত?

আমার মতে ইসলামী ইতিহাসের ইক্বদামী জিহাদসমূহের এই ব্যাখ্যা নিতান্তই ভুল ও বাস্তবতা বিরোধী। বাস্তব কথা হল, কুফরের প্রতিপত্তি খর্ব করার জন্য ঐ যুগেও জিহাদ করা হয়েছে যখন তা “রাজ রাজড়ার কীর্তি হিসেবে পরিগণিত হত” কিন্তু তা এজন্য হয় নাই যে, ঐ যুগে তার ব্যাপক প্রচলন ছিল বরং এজন্য ছিল যে, আল্লাহর দ্বীনের প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠার জন্য এই বিষয়টি বাস্তবিকপক্ষেই উপযোগী ও ভালো। অন্যথায় রাজা বাদশার বীরত্ব প্রদর্শনের মধ্যে তো এও পরিগণিত হতো যে, তারা জয়ের নেশায় চুর হয়ে নারী, শিশু ও বৃদ্ধদেরও রেহাই দিত না কিন্তু ব্যাপক প্রচলনের কারণে এসব বিষয়কে ইসলাম কখনো সমর্থন করে নাই বরং লড়াইয়ের এমন সব বিধিনিষেধ ও সীমারেখা নির্ধারণ করেছে এবং বাস্তবক্ষেত্রে তা অনুসরণ করে দেখিয়েছে যা তখনকার রাজা বাদশার কল্পনারও অতীত ছিল বরং তা ঐসব নিপীড়িত মানবশ্রেণির জন্যও অকল্পনীয় ছিল যারা শুধু রাজা বাদশার এজাতীয় জুলুম অত্যাচারে কেবল অভ্যস্তই ছিল না বরং এর প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল। যে উদ্দেশ্যে ইক্বদামী জিহাদ অতীতে জায়েয ছিল ঠিক সেই একই উদ্দেশ্যে আজও তা জায়েয এবং শুধু এজন্য এই বৈধতাকে আড়াল করার কোনো অর্থ নেই যে, “এটম বোমা” ও “হাইড্রোজেন বোমা” আবিষ্কার ও উৎপাদনকারী শান্তিপ্রিয় (?) ব্যক্তিবর্গ একে নিতান্তই অপছন্দ করেন এবং এতে ঐসব মহান (?) ব্যক্তিবর্গের নাকমুখ কুঁচকে যায় যাদের নিক্ষিপ্ত গোলামীর জিঞ্জিরে এশিয়া ও আফ্রিকার অধিকাংশ জাতির শরীর রক্তে রঞ্জিত।

মূলতঃ এই বিষয়টিও কুফরের প্রভাব প্রতিপত্তিরই অবাঞ্ছিত ফলাফল বলে আমার বিশ্বাস যে, মানুষ ভালো মন্দ নির্ধারণের মাপকাঠিও এই বিশ্বব্যাপী প্রচারণাকেই বানিয়ে নিয়েছে যা দিনকে রাত ও রাতকে দিন করে মানুষের মন মগজে স্থাপন করছে এবং শুধু অমুসলিমই নয় খোদ মুসলমানরাও এই প্রচারণায় কাবু হয়ে নিজেদের দ্বীন ও ধর্মের বিধানাবলীর ব্যপারে ওজরখাহীর পথ অবলম্বন করতে আরম্ভ করেছে। যদি অন্যায় অসত্যের এই  প্রতিপত্তিকে চুরমার করা ‘সাম্রাজ্যবাদের’ সংজ্ঞায় আসে তবে এ জাতীয় সাম্রাজ্যবাদের অভিযোগ পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সাথে মাথা পেতে গ্রহণ করা উচিত। এমন হওয়া উচিত নয় যে, আমরা ঐসব অভিযোগকারীদের সামনে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে যাব এবং বলব, জনাব! যখন আপনি ইক্বদামী জিহাদকে নন্দিত মনে করতেন তখন আমরাও তা ভালো মনে করতাম এবং তা কর্মে রূপ দিতাম এবং যখন আপনি আপনার লিখনীতে এবং শুধুই লিখনীতে একে মন্দ বলছেন এবং শুধুই বলছেন তখন আমরাও একে নিন্দিত মনে করছি এবং নিজেদের জন্য একে হারাম করে নিচ্ছি। এ জাতীয় চিন্তারীতির পথে একমত হওয়া এই অধমের পক্ষে কখনো সম্ভব নয়। [ফিক্বহী মাক্বালাত, খঃ ৩, পৃঃ ৩০২-৩০৫]

পরিশিষ্ট

মোটকথা জিহাদের উভয় প্রকার, ইক্বদামী ও দিফায়ী ইসলামের চিরন্তন ফরযসমূহের অন্যতম। যতদিন পর্যন্ত ভূপৃষ্ঠে কুফর ও শিরকের প্রভাব প্রতিপত্তির ফিতনা বিদ্যমান থাকবে ততদিন পর্যন্ত সত্য-ন্যায়ের বিজয় নিশ্চিত করার জন্য জিহাদের দায়িত্বও অবশ্যপালনীয় থাকবে। রাসূলুল্লাহ ﷺ ইরশাদ করেছেন—

“আমার বি’ছতের (প্রেরিত হওয়ার) সময় থেকে নিয়ে আমার উম্মতের শেষভাগ দাজ্জালের সাথে লড়াই করা পর্যন্ত জিহাদ চলমান থাকবে। কোনো ন্যায়পরায়ণ শাসকের ন্যায়পরায়ণতা এবং কোনো জালিমের যুল্ম একে রহিত করবে না”। [সুনানে আবু দাউদ, ১/৩৪৩]

এই দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য মুসলিম রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনদের নিম্নোক্ত আয়াত অনুযায়ী আমল করা অপরিহার্য।

“তাদের মুকাবিলার জন্য তোমরা যা কিছু শক্তি ও পালিত ঘোড়া সংগ্রহ করতে সক্ষম হও, তা তৈরি রাখো। তা দ্বারা ত্রাস সৃষ্টি হবে আল্লাহর শত্রু ও তোমাদের শত্রুদের উপর এবং এতদ্ব্যতীত অন্যদের উপর, যাদের তোমরা জানো না, আল্লাহ জানেন। আর তোমরা যা কিছু আল্লাহর পথে ব্যয় করবে, তোমরা তা পুরোপুরিই লাভ করে, তোমাদের প্রাপ্য বাকি থাকবে না।” [সূরা আনফাল : আয়াত ৬০]

মুসলমান রাষ্ট্রসমূহের সেনাবাহিনী শুধু রাষ্ট্রের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব এবং রাষ্ট্রের সীমান্ত রক্ষার জন্যই নয় বরং ইসলাম ও ইসলামী শা’আইর (নিদর্শনাবলী) সংরক্ষণ করা, মুসলমানদের শক্তি বৃদ্ধি করা এবং কুফরের প্রভাব প্রতিপত্তি নির্মূল করাও তাদের গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।

প্রত্যেক মুসলিম দেশের সরকার এবং প্রত্যেক মুসলিম রাষ্ট্রসংঘকে জিহাদের এই সবক পুনরায় ইয়াদ করা অপরিহার্য যদি তারা নিজেদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আগ্রহী হন এবং দুনিয়া থেকে জুলুম অত্যাচার দূর করে ন্যায় ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার আশা রাখেন।

জাতির অনুসরণীয় ব্যক্তিত্বদের দায়িত্ব শুধু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ বা সংঘসমূহকে জিহাদের প্রতি উদ্বুদ্ধ করার মধ্য দিয়েই শেষ হয়ে যায় না কেননা যদি তাদের আহবানে সাড়া না দেওয়া হয় এবং জিহাদের সুন্নতকে পুনরায় জীবিত না করা হয় তবে তাদের আরো কিছু দায়িত্ব বাকি থেকে যায়। কী দায়িত্ব বাকি থাকে? এর উত্তর পাওয়া যাবে হযরত মাওলানা সাইয়েদ আহমাদ শহীদ (রহঃ), শাহ ইসমাঈল শহীদ (রহঃ) এবং সালাফ ও খালাফের এ প্রকৃতির জানবাজ মুজাহিদগণের জীবনীতে।

মুহাম্মাদ আবদুল মালেক
তারিখ ১৭/৭/১৪২৫ হিজরী


অন্যান্য পর্বঃ
পর্ব ১
পর্ব ২