নবীজির (সাঃ) কান্তিময় অবয়ব ও সুন্দর গঠন

প্রাককথন

নবীজির স. গঠন-প্রকৃতি বিষয়ে বর্ণনাকারীর সংখ্যা খুব বেশি নয়, অন্তত হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবিদের সংখ্যা বিবেচনা করলে সংখ্যা একটু বেশিই অপ্রতুল বলে মনে হয়। এর প্রধান কারণ হলো, সাহাবিগণ শরিয়তের বিধিবিধান সম্পর্কিত নবীজির কথা ও কাজের বর্ণনা করায় গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি, যতটা মনোযোগ তাঁর গঠন বর্ণনায় ছিল না—যেহেতু নবীজি স. খোদ তাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন এবং দিনে-রাতে প্রয়োজন হলেই তাকে দেখতে পেতেন তারা।অতএব, মুখ্য বিষয় হিসেবে তার গঠন-প্রকৃতির বিস্তারিত বর্ণনা খুব একটা পাওয়া যায় না; যা পাওয়া যায়, তা হলো, অন্য হাদিসের মধ্যে গঠনবিষয়ক প্রাসঙ্গিক বর্ণনামাত্র।

প্রখ্যাত সিরাত গবেষক সালেহ আহমদ শামি এর জন্যে অবশ্য সাহাবিদের শ্রদ্ধাভীতিকেও দায়ি করেছেন। তিনি বলেন : “সাহাবিদের অন্তরে নবীজির স. প্রতি শ্রদ্ধাভীতি এত বেশি ছিল যে, তারা তাঁর দিকে ভালোভাবে তাকাতে পারতেন না। তিনি তার বক্তব্যেও সমর্থনে আমর ইবনুল আস রা.-এর একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন, ‘আমার কাছে রসুলের স. চেয়ে প্রিয় কোনও মানুষ ছিল না বটে এবং আমার চোখে তার চেয়ে মযার্দাবানও কেউ নেই। কিন্তু আমি কখনও পূর্ণদৃষ্টিতে তাকে চেয়ে দেখি নি। সুতরাং কেউ যদি তার বিবরণ জানতে চায়, আমি বলতে পারব না।’ (১)  প্রত্যেক সাহাবীর অবস্থাই ছিলো এমন।” (২)

শামায়েল গ্রন্থকারগণ আরও মনে করেন, মানুষের গঠন-সৌষ্ঠব বর্ণনা করাও যথেষ্ট কঠিন বিষয়। খুব কম মানুষই মানুষের গঠন-প্রকৃতি এককথায় বর্ণনা করার মতো যথাশব্দ ব্যবহারের যোগ্যতা রাখে। যেমন : যদিও মানুষের দেহের দৈর্ঘ্য বিবরণের জন্য লম্বা, মাঝারি ও খাটো—এমন তিন তিনটি শব্দের ব্যবহার রয়েছে। কিন্তু লম্বাও অনেক ধরনের হয় এবং মাঝারি ও খাটোরও রমকফের আছে।

কিন্তু তাবেয়িদের যুগে প্রথমবারের মতো নবীজির গাঠনিক দিকটি জানার প্রবল আগ্রহ দেখা দেয়, কেননা, তারা নবীজির আদর্শ, চরিত্র ও আচরণের ইতোমধ্যে সর্বৈব জানতে পেরেছেন ঠিক, কিন্তু তাকে এতো অল্প সময়ের ব্যবধানের কারণে তাকে দেখতে না-পাওয়ায় বেদনার একটি সূচতীব্র আঘাত বারংবার তাদের আহত করে চলেছিল। এখন জানার একমাত্র উপায় সাহাবিগণ। সুতরাং সাহাবিদের সামনে প্রশ্নের স্তূপ উঠে আসে এবং তারাও বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনার ফাঁকে-ফাঁকে স্মৃতিহাতড়ে অল্পবিস্তর বর্ণনা করতে থাকেন। নবিপ্রেমের এই আকুতির কথা কি নবীজি নিজেও জানতেন? যেমন তিনি বলেছেন : ‘একটি সময়ের দেখা তোমরা পাবে, যখন গচ্ছিত সম্পদ ও পরিজনের মতোই আমার সাক্ষাৎ মানুষের কাম্য হবে।’ (৩)   বলেছেন : আমার অবর্তমানে উম্মাহের একটি দলের আবির্ভাব হবে, যারা আমাকে এত ভালোবাসবে যে, তাদের সম্পদ-পরিজনের বিনিময়ে হলেও আমাকে দেখতে চাইবে।’ (৪)

দৈহিক গঠন

নবীজির দৈহিক গঠন বর্ণনায় শামায়েলে তিরমিজির জুড়ি নেই বললেই চলে। তার অধিকাংশ বর্ণনাই বুখারি ও মুসলিমের সমার্থক। আমরা চেষ্টা করব শুধু সহিহ হাদিসের মতে তার বিবরণ উল্লেখ করতে।

বারা ইবনে আযেব রা.-এর ভিন্ন ভিন্ন কয়েকটি বর্ণনা একত্র করলে দাঁড়ায় : রসুল স. ছিলেন মাঝারি গড়নের—অতি লম্বাও না, খাটোও না। তবে আনাস রা.-এর বর্ণনা থেকে বোঝা যায় নবীজি মাঝারি গড়নের চেয়ে একটু দীর্ঘ ছিলেন। (৫) তাঁর উভয় বাহুমূলের মধ্যবর্তীস্থান অন্যদের তুলনায় কিছুটা প্রশস্ত ছিল। (৬)

তার মাথার কেশরাশি ছিল উভয় কানের লতি পর্যš— প্রলম্বিত। কখনও তাঁর চুল কাঁধ ছুঁয়ে যেত। কুঞ্চিত চুল ছিল না তার, আবার চুলগুলো একেবারে সোজাও ছিল না। (৭) বাবরি চুল বিশিষ্ট ও পরনের লাল পোশাকে তিনি অতুলনীয় সুন্দর হয়ে উঠতেন। কিন্তু উজ্জ্বল কটকটে লাল পোশাক তিনি পছন্দ করতেন না। কিছুটা ডোরাকাট লাল পোশাক ছিল তার পছন্দ। (৮)

তিনি ছিলেন সবচে’ সুন্দর চেহারা ও গঠনের অধিকারী। বারা’কে রা.- জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, রাসুল স.-এর চেহারা কি তরবারির মতো ছিলো? তিনি জবাব দেন : না; বরং চাঁদের মতো।(৯) তাঁর মাথা ছিল একটু বড়।(১০) তিনি ধবধবে সাদা ছিলেন না, আবার সম্পূর্ণ তামাটে বর্ণেরও না।(১১) বরণে তিনি ছিলেন ফর্সা লাবণ্যময় আকর্ষণীয় ও সুসামঞ্জস্যপূর্ণ চেহার অধিকারী।(১২) আবু হোরায় রা. বলেন : তিনি ছিলেন রূপার মতো শুভ্র। (১৩) আর আনাস রা. বলেন : তিনি ছিলেন গৌরবর্ণের।(১৪)

জাবের ইবনে সামুরার রা. ভাষায় সেই চেহারায় মুখবিবর ছিল কিছুটা প্রশস্ত, চোখ ছিল টানা।(১৫) চোখের শুভ্রতার মধ্যে কিছুটা লালিমা ছিল। (১৬) চোখে সুরমা দিতে ভালোবাসতেন। প্রায় প্রতি রাতেই সুরমা দিতেন। (১৭)

মাথার অগ্রভাগের কিছু চুল ও কিছু দাড়ি ধুসর বর্ণের হয়ে গিয়েছিলো। তেল ব্যবহার করলে তা প্রকাশ পেতো না। চুলগুলো এলোমেলো থাকলে বোঝা যেত। তিনি ছিলেন ঘন দাঁড়িবিশিষ্ট।(১৮) আনাস রা. বলেন : ওফাতকালে তার মাথা ও দাড়ির বিশটি চুলও সাদা হয় নি।(১৯) তেল ব্যবহার করার পর তা-ও বোঝা যেত না। এমনতিও সাদা চুলক’টি সাদা নয় ঠিক, লাল লাল হয়েছিল মাত্র।(২০) নবীজি তার চুল বেশ পরিপাটি করে রাখতেন। কখনও সখনও মধ্যিখানে সিঁথি কাটতেন। (২১)

নবীজির স. হাত ও পায়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে আনাস ইবনে মালিক রা. বলেন : তার হাত-পা ও আঙ্গুলগুলো ছিল মাংসল। হাতের তালু ছিলো প্রশস্ত। (২২) তাঁর হাতের তালুর মতো কোমল রেশমও আমি স্পর্শ করি নি। (২৩) তাঁর পায়ের গোড়ালি ছিল সরু ও হালকা গোশতবিশিষ্ট। (২৪) জাবের ইবনে সামুরা’র রা. শৈশবে নবীজি স. তাঁর গালে হাত বুলিয়েছিলেন, সে-কথা স্মরণ করতে গিয়ে বলেন : আমি তার হাতে এমন শীতলতা ও সুগন্ধি অনুভব করেছি, যেনো তিনি তা সুগন্ধির কস্তুরি থেকে বের করেছেন।(২৫)

আসলে নবীজির সমগ্র শরীরের ঘ্রাণই ছিল সুন্দর সুগন্ধির মতোই। আনাস রা. বলেন : তার শরীরের ঘ্রাণের চেয়ে উত্তম কোনো ঘ্রাণ অনুভব করি নি। তাঁর ঘাম মুক্তার মতো চকচক করত। (২৬)  বুক থেকে নাভি পর্যন্ত পশমের একটি সরু রেখা প্রলম্বিত ছিল। (২৭)

নবীজির দুই কাঁধের মাঝামাঝি পিঠের দিকে ছিল একটি গোশতের টুকরা। এটাই নবুয়তের নিদর্শন—মোহরে নবুয়ত। সাহাবিদের বিভিন্ন বর্ণনা মেলালে বোঝা যায়, মোহরে নবুয়ত ছিল অনেকটা কবুতরের ডিমের মতো; কিছুটা লাল, (২৮) তবে তা তার শরীরের বর্ণের সাথেই সুসাম্য বজায় রেখেছে।(২৯) তাতে পশমের মতো একগুচ্ছ কেশের আবরণ ছিল।(৩০) আর আচিলের মতো কতগুলো তিলক তাকে ঘিরে রেখেছিল।(৩১) কিন্তু এই সম্মানিত নিদর্শন এতটা অবাধ ছিল যে, চাইলে যে-কেউ চুম্বন করতে পারতেন।(৩২)

অবয়বের সুসাম্য

রাসুল স.-এর দেহাবয়ব ও সৌন্দর্য বিবরণ-সম্বলিত উপর্যুক্ত হাদিসগুলো একত্র করলে দুটি বিষয় স্পষ্ট ফুটে ওঠে— ১. সুষম ও মধ্যম ধরন এবং ২. শরীরের প্রতিটি অঙ্গের সামঞ্জস্য। দৈর্ঘ্যে তিনি ছিলেন মাঝারি আকৃতির। বেশি লম্বা বা খাটো ছিলেন না। বর্ণের দিক থেকে ছিলেন স্বাভাবিক ফর্সা, ধবধবে সাদা বা তামাটে বর্ণের নয়, বরং উজ্জ্বল বর্ণের। বারা রা. তরবারির তুলনাকে অস্বীকার করেছেন এ-কারণেই যে, তাতে চেহারা অধিক লম্বা ধারণা হতে পারে। আবার তরবারির চমকে উজ্জলতার চেয়ে চাকচিক্যের আধিক্য বেশি থাকে। কেননা, যা তার মাথার চুল ছিলো মধ্যম ধরনের, অর্থাৎ কোঁকড়ানোও না. একেবারে সোজাও না। শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে যথাযথ সামঞ্জস্য থাকলেই দেহের সৌন্দর্য পূর্ণতা পায়, তিনি তেমনই ছিলেন। উভয় বাহুর মধ্যবর্তী স্থানের প্রশস্ততা, উভয় হাত ও পায়ের মাংসল হওয়া—এগুলো কোনো দৈহিক ত্রুটি নয়। বরং তা সামঞ্জস্যেরই বিবরণ।

শেষকথা

এভাবেই সাহাবিগণ নবীজির স. দৈহিক বিবরণ তুলে ধরেছেন, কখনো সংক্ষেপে, কখনো কিছুটা বিস্তারিত, আবার কখনো-বা আংশিক। যদিও যতো সুষম তুলনাই দেওয়া হোক, শ্রোতা কিছুতেই দর্শকের সমান তৃপ্তি পাবে না। কিন্তু বান্দার প্রতি আল্লাহর অপার অনুগ্রহ হলো, তিনি চাইলে কাউকে স্বপ্নযোগে নবীজির স. দর্শন লাভের সুযোগ দিতে পারেন। এই স্বপ্ন সত্য—নিশ্চিত, নির্দ্বিধ। রসুল স. নিজেই বলেছেন : যে ব্যক্তি আমাকে স্বপ্নযোগে দেখেছে, সে আমাকেই দেখেছে। কেননা, শয়তান আমার রূপ ধারণ করতে পারে না। (৩৩)

মূলঃ নবীজি


  1. সহীহ মুসলিম ১২১
  2. মিন-মায়ীনিশ শামায়েল/৯৫
  3. সহীহ মুসলিম ৩৪৬৪
  4. সহীহ মুসলিম ২৮৩২
  5. সহীহ বুখারী ৫৯০০
  6. সহীহ বুখারী ৫৯০৭
  7. সহীহ বুখারী ৫৯০০
  8. কারহুস সুন্নাহ-হাদিস ৩৬৪০
  9. সহীহ বুখারী ৩৫৪৯, ৩৫৫১, ৩৫৫২
  10. সহীহ ইনবে হিব্বান-হাদিস ৬৩১১
  11. সহীহ বুখারী ৫৯০০, ৫৯০৭
  12. সহীহ মুসলিম ২৩৪০
  13. জামিউস সগীর-হাদিস ৮৭৪৮
  14. মুসনাদে আবু ইয়ালা-হাদিস ৩৮৩২
  15. সহীহ মুসলিম ২৩৩৯
  16. সহীহ মুসলিম ৬২১৬
  17. সুনানুল কুবরা লিল বাইহাকি-হাদিস ৮৫৬১
  18. সহীহ মুসলিম ২৩৪৪
  19. সহীহ বুখারী ৫৯০০
  20. মুস্তাদারাকে হাকেম-হাদিস ৪২০৩
  21. সহীহ বুখারী ৩৫৫৮
  22. সহীহ মুসলিম ২৩৪৭
  23. সহীহ বুখারী ৩৫৬১
  24. সহীহ মুসলিম ২৩৩৯
  25. সহীহ মুসলিম ২৩২৯
  26. সহীহ বুখারী ৩৫৬১
  27. মুসনাদে আহমদ-হাদিস ৭৪৬
  28. সহীহ মুসলিম ৬২৩০
  29. সহীহ মুসলিম ২৩৪৪
  30. ম’জামুল কাবির-হাদিস ২০১৬৫
  31. জামি’উস সগির-হাদিস ৮৯৩৯
  32. মুসনাদে আহমদ-হাদিস ২৬৮৩৬
  33. সহীহ বুখারী ২৫৫২