نحمده ونصلى على رسوله الكريم
আমাদের শায়েখ ও মুর্শিদ মাহবুবুলওলামা হযরত মাওলানা পীর জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী মুজাদ্দেদী দা. বা.। একজন বিশ্বমানের আলেমেদীন হওয়ার পাশাপাশি আধ্যাত্মিকজগতে অত্যন্ত পরিচিত নামও। তিনি একজন ইঞ্জিনিয়ারও বটে। সুলূক তথা তাঁর আধ্যাত্মিক খেদমতের গ্রহণযোগ্যতা, গভীরতা ও বিস্তৃতির তুলনা বর্তমান বিশ্বের ওলামায়েকেরাম নকশবন্দি-তরিকার প্রাণপুরুষ খাজা বাহাউদ্দীন নকশবন্দী রহ. এর সঙ্গে করে থাকেন। হৃদয়ের গভীর থেকে উতলে ওঠা দরদমাখা প্রতিটি কথা তাঁর ‘আলহামদুলিল্লাহ’ এতটাই প্রভাববিস্তারকারী হয় যে, পাঠক অভিভূত হন, নিজেকে সংশোধন করার চিন্তায় আলোকিত হন। উভয় শিক্ষায় সমৃদ্ধ হওয়ায় তিনি সমাজে অবস্থান করা রোগগুলোর নাড়িতে একজন দক্ষ চিকিৎসকের মত হাত রাখতে সক্ষম হন। যুহুদ, তাকওয়া, লিল্লাহিয়াত, ইনাবাত ইলাল্লাহর গুণগুলো তাঁর চোখের পানিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে বিধায় উম্মতের প্রতি তাঁর দরদ কী পরিমাণ; যারা তাঁকে কাছ থেকে দেখেছেন, তারাই তা কিছুটা অনুধাবন করতে পারেন। প্রকাশের ভাষা অধমের নেই। মহান আল্লাহর দরবারে শুধু এই দুআ করি যে, হে দয়াময় আল্লাহ! আপনি আমাদের হজরতজীর বরকতময় ছায়াকে এ এতিম-উম্মতের জন্য আরো সুদীর্ঘ করুন। আমীন। ছুম্মা আমীন।
বক্ষমান পুস্তিকাটি হযরতজীর একটি বহুল প্রচলিত বইয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশবিশেষ। বর্তমান উম্মতের কাছে অবহেলিত ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধান ‘পর্দা’ সম্পর্কে এখানে আলোচিত হয়েছে। বিষয়টির ব্যাপক আবশ্যকতা অনুধাবন করে অধম এর তরজমা করে আপনাদের খেদমতে পেশ করেছি। দুআ করি, দুআ চাই। আল্লাহ যেন ইখলাস দান করেন। আমীন। ছুম্মা আমীন।
ভুলত্রুটি হওয়াটা স্বাভাবিক। যা কিছু ভুল পাবেন, তা অধমের দুর্বলতা; মূল লেখকের নয়। তাই শুধরে দিলে দুআ করব। ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের সকলকে গুনাহমুক্ত জীবন দান করুন। আমীন। ছুম্মা আমীন।
বক্ষমান পুস্তিকাটি হযরতজীর একটি বহুল প্রচলিত বইয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশবিশেষ। বর্তমান উম্মতের কাছে অবহেলিত ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধান ‘পর্দা’ সম্পর্কে এখানে আলোচিত হয়েছে। বিষয়টির ব্যাপক আবশ্যকতা অনুধাবন করে অধম এর তরজমা করে আপনাদের খেদমতে পেশ করেছি। দুআ করি, দুআ চাই। আল্লাহ যেন ইখলাস দান করেন। আমীন। ছুম্মা আমীন।
ভুলত্রুটি হওয়াটা স্বাভাবিক। যা কিছু ভুল পাবেন, তা অধমের দুর্বলতা; মূল লেখকের নয়। তাই শুধরে দিলে দুআ করব। ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের সকলকে গুনাহমুক্ত জীবন দান করুন। আমীন। ছুম্মা আমীন। – অনুবাদক।
الله الله الله
بسم الله الرحمن الرحيم
আল্লাহতাআলা মানবজাতিকে সৃষ্টির সেরা বানিয়ে বুদ্ধির আলো দান করেছেন। এই সুস্থবুদ্ধির কারণেই মানুষ এবং জীবজন্তুর জীবনের মাঝে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। পানাহার ও জৈবিকচাহিদাজাত কাজে মানুষ এবং জীবজন্তু অভিন্ন। ঘর বানিয়ে বসবাস করার ক্ষেত্রেও বিশেষ কোনো ব্যবধান নেই। মানুষের প্রয়োজন বেশি তাই তাদের দরকার হয় বসবাস করার সুযোগসমৃদ্ধ আকাশচুম্বি ইমারতের। পক্ষান্তরে জীবজন্তুর জীবন সাদামাঠা। এজন্য তাদের বসবাসের স্থান হয় অতিসাধারণ। চড়ুইপাখি নীড় তৈরি করে বসবাস করে। সাপ বাস করে গর্তে। বাঘ থাকে গুহায়।
বাকি থাকে একসঙ্গে মিলেমিশে বসবাসের প্রসঙ্গ। এক্ষেত্রে জীবজন্তু মানুষ থেকে পিছিয়ে নয়। পিঁপড়ার জীবনে ঐক্য ও সমতার চমৎকার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। মৌমাছির জীবনে রাজকীয় ঠাঁটবাট অসমান্য। পাখির জীবনে আছে যিকির ও ইবাদত। কিন্তু একটি বিষয় এমন আছে, যার কারণে অন্যান্য প্রাণির তুলনায় মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ফুটে ওঠে। তা হল, লজ্জা ও শালীনতাবোধের গুণ। এই গুণের কারণে মানুষ পবিত্র জীবনযাপন করে। পদে পদে আপন ¯্রষ্টার আনুগত্য করে। গুণটির দাবী হল মানুষ অন্যের সামনে আসবে লজ্জাস্থান আবৃত করে। মানুুুষসৃষ্টির ইতিহাসও এই বাস্তবতার প্রতি ইঙ্গিত করে। হযরত আদম আলাইহিসসালাম ও তাঁর স্ত্রীকে জান্নাতে পোশাক দেওয়া হয়েছিল। নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার পর তাঁদের জান্নাতি-পোশাক খুলে নেওয়া হয়েছিল। তখন তাঁরা সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের গোপনাঙ্গ গাছের পাতা দিয়ে ঢেকে নিয়েছিলেন। আল্লাহতাআলা বলেন,
وَطَفِقَا يَخْصِفَانِ عَلَيْهِمَا مِنْ وَّرَقِ الْجَنَّة
‘এবং তারা জান্নাতের পাতা দ্বারা নিজেদেরকে আবৃত করতে লাগল। (সূরাআরাফ : ২২)
সতরের প্রেক্ষাপট:
শরীরের গোপন অংশ আবৃত করার জন্য আরবিতে ‘আওরাত’ ফার্সিতে ‘সতর’ শব্দ ব্যবহার করা হয়। আদমসন্তানেরা সেই পাথরযুগ থেকেই নিজেদের সতর ঢেকে আসছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যখন বুদ্ধি ও অনুভূতিতে সমৃদ্ধতা এসেছে এবং মানুষ সামাজিকতা ও শিষ্টাচারের সাথে পরিচিত হয়ে ওঠেছে তখন পাশাপাশি তাদের পোশাকেও আরও বেশি শালীনতা ও শিষ্টাচার প্রস্ফুটিত হয়েছে। এমনকি পৃথিবীর সকল ধর্ম মানুষকে শালীন পোশাক পরিধানের শিক্ষা দিয়েছে। খৃস্টধর্মের প্রতি একটু গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এই ধর্ম নারীদেরকে কেবল সতরঢাকারই নির্দেশ দেয় নি, বরং এ ধর্মের নারীরা হাত-পা ও চেহারা ছাড়া শরীরের অবশিষ্ট পুরা অংশ কাপড় দ্বারা আবৃত করে রাখত। গির্জায় জীবনযাপনকারী খৃস্টাননারীদেরকে আজও এ জাতীয় পোশাকে আচ্ছাদিত দেখা যায়। বোঝা গেল, দেহের স্পর্শকাতর অংশসমূহ ঢেকে রাখা স্বভাব, বিবেক ও শরিয়ত সবদিক থেকেই জরুরি। সকল নবী-রাসূলের শরিয়তে এটাকে ফরজবিধানের মর্যাদা দেয়া হয়েছে।
হিজাবের প্রেক্ষাপট:
ইসলাম পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। এ জন্য ইসলাম লজ্জাশীলতাকে ঈমানের অংশ হিসাবে সাব্যস্ত করেছে। লজ্জাশীলতার দাবি হল, সমাজ থেকে নগ্নতা ও অশ্লীলতা একেবারে মিটিয়ে দেয়া। ইসলাম ব্যভিচারকে হারাম সাব্যস্ত করে বলেছে, وَلَا تَقْرَبُوا الزِّنَا‘তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেও না।’
শরিয়তেমুহাম্মাদী কেয়ামত পর্যন্ত মানবজাতিকে নিজের স্বচ্ছ ঝর্ণধারা থেকে পরিতৃপ্ত করবে। তাই এখানে যেসব কাজ হারাম সাব্যস্ত করা হয়েছে, তার মাধ্যমসমূহকেও নিষিদ্ধ করে শয়তানের অনুপ্রবেশের দরজা-জানালা এমনকি ছিদ্রও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ-
-মদ ইসলামে হারাম। এজন্য তা তৈরি কেনা-বেচা ও কাউকে দেয়াও হারাম করা হয়েছে।
-সুদ হারাম। এ জন্য নিষিদ্ধপদ্ধতিতে উপার্জিত মুনাফাও সুদের মত ‘নাপাক’ বলা হয়েছে।
-শিরক হারাম করা হয়েছে। তাই ছবি ও মূর্তি বানানোও হারাম সাব্যস্ত করা হয়েছে।
-ব্যভিচার হারাম। এ কারণে পরনারীকে দেখা, স্পর্শ করা, তার সঙ্গে যৌনালাপ করা এবং মনে মনে তার কল্পনা করাকেও হারাম হিসাবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
প্রমাণিত বাস্তবতা হল, পর্দাহীনতার কারণেই ব্যভিচার হয়। এ জন্যই ইসলাম নারীদেরকে হিজাব তথা পর্দার নির্দেশ দিয়েছে। পবিত্র আত্মার অধিকারীরা তো পর্দার গুরুত্ব নিজেরাই অনুভব করেছেন। পঞ্চম হিজরীতে হযরত উমর রাযি. নবীজী ﷺ-এর কাছে নিবেদন করলেন,
يَا رَسُوْلَ اللهِ ﷺ اِنَّ نِسَآءَكَ يَدْخُلُ عَلَيْهِنَّ الْبِرُّ وَ الْفَاجِرُ فَلَوْ حَجَبْتَهُنَّ فَاَنْزَلَ اللهُ ايَةَ الْحِجَابِ.
‘ওগো আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনার স্ত্রীদের কাছে ভালো-মন্দ সব ধরনের লোক আসে। যদি তাদেরকে পর্দার বিধান দিতেন! এ পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহতাআলা পর্দার আয়াত নাযিল করেন।’ (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ)
মুফতি শফী রহ. মাআরিফুলকুরআনে লিখেছেন, পর্দা সম্পর্কে কুরআনে সাতটি আয়াত এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর সত্তরটি হাদীস রয়েছে। পর্দা পালনের দ্বারা উদ্দেশ্য হল, নারীরা যথাসম্ভব ঘরে থাকবে। বিশেষ প্রয়োজনে বের হতে হলে শরীর ও সৌন্দর্য বোরকা ও ওড়না দ্বারা এমনভাবে ঢেকে রাখবে যাতে কোনোভাবেই পরপুরুষের সামনে প্রকাশ না পায়।
সতর ও হিজাবের মধ্যে তুলনামূলক পার্থক্য:
সুতরাং সতর অর্থাৎ গোপনাংশ আবৃত রাখা এবং হিজাব তথা পর্দাপালন করা দু’টি ভিন্ন বিষয়। উভয়ের মধ্যে তুলনামূলক পার্থক্য হল-
- সতর ঢেকে রাখার বিধান সকল শরিয়তে ফরজ বা অবশ্যপালনীয়। পক্ষান্তরে পর্দার বিধান উম্মতেমুহাম্মাদির জন্য পঞ্চম হিজরিতে দেয়া হয়েছে।
- সতর ঢেকে রাখা লোকচক্ষুর আড়ালে ও সামনে সর্বাবস্থায় জরুরি। পক্ষান্তরে পর্দা নারীর জন্য পরপুরুষের সামনে জরুরি।
- সতর ঢেকে রাখা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য জরুরি। পক্ষান্তরে পর্দার বিধান শুধু নারীদের জন্য ফরজ।
- সতর ঢেকে রাখা লজ্জাশীলতার প্রথমস্তর। পক্ষান্তরে নারীদের পর্দা লজ্জা ও শালীনতার চূড়ান্তধাপ।
হিজাবের পক্ষে প্রমাণসমূহ:
বর্তমানের যুগটা বিজ্ঞানের যুগ। একদিকে বস্তুবাদের উৎকর্ষ তুঙ্গে পৌঁছেছে, অপরদিকে নগ্নতা ও অশ্লীলতার তুফান চলছে। পাশ্চাত্যসভ্যতার দাপটে ফ্যাশনপূজা ও বেহায়াপনা ব্যাপক হয়ে পড়েছে। ইউনিভার্সিটি ও কলেজপড়–য়া মেয়েরা পর্দাকে গুরুত্বহীন ভাবতে শুরু করেছে। এজন্য পর্দার গুরুত্ব ও আবশ্যকতা কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে পেশ করা প্রয়োজন।
এক. কুরআন মজিদ থেকে প্রমাণাদি:
এক. আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَى
‘আর তোমরা স্বগৃহে অবস্থান করবে এবং জাহিলিয়াতযুগের মত নিজেদেরকে প্রদর্শন করে বেড়াবে না।’(সূরাআহযাব : ৩৩)
আয়াতটিতে নারীদেরকে সাধারণ অবস্থায় ঘরে অবস্থান করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ঘরের চারদেয়ালে অবস্থান করে নিজেদের দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করবে। শরীয়ত নারীদের ওপর এমন দায়িত্ব আরোপ করে নি, যার কারণে তাদের চারদেয়ালের বাইরে যেতে হয়। প্রয়োজনের সময় তো ‘অপরাগতা’ কিংবা ‘ঠেকায় পড়া’র মধ্যে পড়ে। তাছাড়া নারীরা যত বেশি ঘরে থাকে তত বেশি আল্লাহতাআলার ঘনিষ্ঠ হতে পারে। হাদীসে আছে,
اَقْرَبُ مَا تَكُوْنُ مِنْ وَجْهِ رَبِّهَا وَهِىَ فِىْ قَعْرِ بَيْتِهَا
‘নারী নিজ প্রভুর সবচে’ নিকটতম তখন হয় যখন সে নিজের ঘরের মাঝে লুকিয়ে থাকে।’ (ইবনু খুযাইমা, ইবনু হিব্বান)
তাবারানী শরীফের এক বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
لَيْسَ لِلنِّسآءِ نَصِيْبٌ فىْ الْخُرُوْجِ اِلَّا مُضْطَرَّةٌ
‘নারীরা কেবল শরঈ-প্রয়োজন দেখা দিলে বাইরে বের হবে।’ (তাবারানী, আলজামিউসসগির)
সুতরাং খুব বেশি প্রয়োজন পড়লে নারীদের ঘর থেকে বের হওয়া জায়েয। আরবীতে প্রবাদ আছে,لَا تُحْفَظُ الْمَرْأَةُ اِلَّا فِىْ بَيْتِهَا‘নারীরা আপন ঘর ছাড়া কোথাও নিরাপদ নয়।’
রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর পবিত্র স্ত্রীগণ সাধারণ অবস্থায় ঘরের চারদেয়ালের ভেতরে থাকতেন, সফরের সময় অবস্থানগ্রহণ করতেন তাবুতে। ‘ইফকের’ ঘটনা ঘটার অন্যতম কারণ ছিল, সাহাবায়েকেরাম ভেবেছিলেন হযরত আয়েশা রাযি. উটের হাওদার ভেতরে আছেন। অথচ তিনি ছিলেন হারানো হারের খোঁজে প্রাকৃতিকপ্রয়োজন পূরণ করার স্থানে। আলোচ্যে আয়াতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, প্রথম জাহিলিয়াতযুগের মত পর্দাহীনতার প্রদর্শন করবে না। আশ্চর্যের বিষয় হল, ইসলামের সূচনাকালে প্রথম জাহিলিয়াত তথা অন্ধকারযুগের কারণে পর্দাহীনতা ছিল। বর্তমান যুগ দ্বিতীয় জাহিলিয়াত। দ্বিতীয় অন্ধকারযুগ। এযুগের কারণেও পর্দাহীনতার প্রচার-প্রসার ব্যাপকহারে আছে। কিছু ইংরেজিশিক্ষায় শিক্ষিত নারী তো পর্দার বিরোধিতা করে নিজেদেরকে ‘শিক্ষিতমূর্খ’ হিসাবে প্রমাণ দেয়।
দুই. আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَإِذَا سَأَلْتُمُوهُنَّ مَتَاعًا فَاسْأَلُوهُنَّ مِنْ وَرآءِ حِجَابٍ ذَلِكُمْ أَطْهَرُ لِقُلُوبِكُمْ وَقُلُوبِهِنَّ.
‘যখন তোমরা তাঁদের কাছে কিছু চাও, পর্দার অন্তরাল থেকে চাও। এই বিধান তোমাদের ও তাঁদের হৃদয়ের জন্য অধিকতর পবিত্র।’ (সূরা আহযাব : ৫৩)
আলোচ্য আয়াতে শিক্ষা দেয়া হয়েছে, সাহাবায়েকেরাম নবীজীর স্ত্রীদের কাছ থেকে কিছু চাওয়ার প্রয়োজনে তাঁদের কাছে গেলে যেন পর্দার আড়াল থেকে চায়। অর্থাৎ মনে করুন, যদি দেয়ালের পর্দা না থাকে তাহলে অন্তত চাদরের পর্দা যেন থাকে। সামনাসামনি জায়েয নেই। এখানে একটি বিষয় নেহায়েত গুরুত্বপূর্ণ। তাহল, একদিকে সাহাবায়েকেরামের মত হৃদয়প্রাচুর্যের অধিকারী মহান পুরুষগণ, অপরদিকে রয়েছে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর পবিত্র স্ত্রীগণের মত সতী-সাধবী নারীগণ। তা সত্তেও পর্দার আড়াল থেকে কথাবার্তা ও কিছু দেয়া নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি পরিষ্কার ভাষায় বলা হচ্ছে, এটা তোমাদের ও তাঁদের অন্তরের পবিত্রতার জন্য উত্তম।
তিন. আল্লাহ তাআলা বলেন,
يآ أَيُّهَا النَّبِيُّ قُلْ لِأَزْوَاجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسآءِ الْمُؤْمِنِينَ يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلَابِيبِهِنَّ
‘হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীগণকে কন্যাগণকে ও মুমিনদের নারীগণকে বলে দিন, তারা যেন নিজেদের চাদর টেনে নেয়।’ (সূরা আহযাব : ৫৯)
جَلَابِيب শব্দটি আরবিভাষায় جِلْبَاب এর বহুবচন। এর দ্বারা উদ্দেশ্য ওই চাদর যা মহিলারা বক্ষদেশ ঢেকে রাখার জন্য ব্যবহার করে। مِنْ جَلَابِيبِهِنَّ দ্বারা উদ্দেশ্য চাদরের কিছু অংশ দ্বারা চেহারাও ঢেকে নিবে। ফলে লোকেরা বুঝতে পারবে যে, ইনি ভদ্রমহিলা। একে উত্যক্ত করা যাবে না। অর্থাৎ কোনো মুনাফিক ও বখাটে তার প্রতি চোখ তুলে দেখবে না।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাযি. বলেন, ‘মুসলিমনারীদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যাতে তারা নিজেদের মাথা ও চেহারা চাদর দ্বারা ঢেকে নেয়। শুধু চোখ খোলা রাখবে, যাতে হাঁটাচলায় কোনো সমস্যা না হয়।’ বর্তমানের প্রচলিত বোরকা উক্ত চাদরেরই স্থলাভিষিক্ত।
চার. আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا
‘তারা (নারীরা) যা সাধারণত প্রকাশ থাকে তা ব্যতীত নিজেদের আবরণ প্রকাশ না করে।’ (সূরা নূর : ৩১)
অর্থাৎ নারীরা নিজেদের সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটাবে না, তবে যে অংশটুকু ঠেকাবশতঃ খোলা রাখতে হয়। زِيْنَةٌ দ্বারা উদ্দেশ্য ওই বস্তু যা দ্বারা মানুষ নিজেকে সজ্জিত করে। (অর্থাৎ অলঙ্কার ও পোশাক) اِلَّا مَا ظَهَرَ দ্বারা উদ্দেশ্য আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাযি. এর মতে তৈরি পোশাক। এর প্রমাণ কুরআনের অন্য আয়াতে পাওয়া যায়। আল্লাহ তাআলা বলেন, خُذُوا زِينَتَكُمْ عِنْدَ كُلِّ مَسْجِدٍ
‘নাও তোমাদের সৌন্দর্য প্রত্যেক নামাযের সময়।’
আয়াতটিতে زِيْنَةٌ তথা সৌন্দর্য দ্বারা উদ্দেশ্য পোশাক। مَسْجِدٌ দ্বারা উদ্দেশ্য নামায। এই মর্মার্থ অনুযায়ী নারীরা নিজেদের পোশাক ও অলঙ্কার পরপুরুষের সামনে প্রদর্শনী করতে পারবে না। এ অবস্থায় মর্মার্থ পরিষ্কার। সাধারণ পোশাকের ওপর ব্যবহৃত ওড়না, চাদর, বোরকা ইত্যাদি উক্ত নিষেধের আওতাভুক্ত নয়। এর দ্বারা প্রতীয়মান হল, দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রকাশ করা আরো শক্তভাবে নিষেধ। সুতরাং নারীদের সব ধরনের পোশাক পরপুরুষের সামনে থেকে আড়ালে রাখতে হবে। তবে বোরকাজাতীয় পোশাক পরপুরুষ দেখলে কোনো সমস্যা নেই।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাযি. زِيْنَةٌ তথা সৌন্দর্য দ্বারা উদ্দেশ্য নিয়েছেন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সৌন্দর্য। সুতরাং আয়াতটির মর্মার্থ হবে, বিশেষ প্রয়োজন যেমন চিকিৎসার প্রয়োজনে ডাক্তারের সামনে অথবা পরিচয়প্রদানের প্রয়োজনে কিংবা সাক্ষীদানের প্রয়োজনে বিচারকের সামনে সৌন্দর্যের অংশ খোলার নিতান্ত প্রয়োজন হলে এটা হবে অপারগতা কিংবা ঠেকায় পড়া। এজাতীয় পরিস্থিেিত চেহারা ও হাতের কবজি পর্যন্ত খোলা জায়েয। উল্লেখ্য, এখানে ‘সৌন্দর্যের স্থান’ বলতে কেবল চেহারা ও কবজি উদ্দেশ্য। এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই যে, কোনো নারীর চেহারার দিকে তাকালে যদি কামশিহরণ সৃষ্টি হয় তখন ওই নারীর জন্য চেহারা ঢেকে রাখা এবং পুরুষের জন্য তার দিকে না তাকানো ফরজ।
পাঁচ. আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَالْقَوَاعِدُ مِنَ النِّسَاءِ اللَّاتِي لَا يَرْجُونَ نِكَاحًا فَلَيْسَ عَلَيْهِنَّ جُنَاحٌ أَنْ يَضَعْنَ ثِيَابَهُنَّ غَيْرَ مُتَبَرِّجَاتٍ بِزِينَةٍ وَأَنْ يَّسْتَعْفِفْنَ خَيْرٌ لَهُنَّ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ.
‘বৃদ্ধা নারী, যারা বিয়ের আশা রাখে না, যদি তারা সৌন্দর্যপ্রদর্শন না করে বহির্বাস (নেকাব) খুলে রাখে; তাদের জন্য কোনো অপরাধ নেই। তবে এ থেকে তাদের বিরত থাকাই তাদের জন্য উত্তম। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’ (সূরা নূর : ৬০)
যারা বিয়ের যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে, যাদের দিকে তাকালে যৌনকামনা সৃষ্টি হয় না, এমন বৃদ্ধনারীর পর্দার ব্যাপারে শরিয়ত ছাড় দিয়েছে। যেসব পুরুষের সঙ্গে বিবাহ হারাম তাদের সামনে যেসব অঙ্গ খোলা রাখার অনুমতি আছে, বৃদ্ধমহিলারা পরপুরুষের সামনে সেসব অঙ্গ খোলা রাখতে পারবে। তবে এক্ষেত্রে আয়াতটিতে শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে যে, যদি তারা সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে। এটাও বলা হয়েছে, পরপুরুষের সামনে আসা থেকে বিরত থাকাটাই তাদের জন্য উত্তম। প্রসিদ্ধ প্রবাদ আছে, لِكُلِّ سَاقِطٍ لَاقِطٌ‘প্রতিটি পরিত্যক্তবস্তু ওঠানোর লোক কেউ না কেউ থাকে।’
ভাবনার বিষয় হল, বৃদ্ধমহিলার ক্ষেত্রে যদি এতটা সতর্ক থাকার নির্দেশ দেয়া হয়, তবে যুবতীদের পর্দার ক্ষেত্রে কী পরিমাণ সতর্ক ও সচেতন থাকা জরুরি।
ছয়. আল্লাহ তাআল বলেন,
الْمَالُ وَالْبَنُونَ زِينَةُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا
‘সম্পদ ও ছেলেসন্তান পার্থিবজীবনের সৌন্দর্য।’ (সূরা কাহফ)
আয়াতটিতে সম্পদ ও ছেলেসন্তানকে দুনিয়ার সৌন্দর্য বলা হয়েছে। মেয়েসন্তানকে এ থেকে আলাদা রাখা হয়েছে। কারণ, মেয়ে গোপন রাখার জিনিস, প্রদর্শনী করার জিনিস নয়। এ থেকেও নারীদের পর্দায় থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। সুতরাং মুসলিমনারীদের উচিত পর্দাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া। অন্তরে ভালোভাবে বসিয়ে নিন,
اَلْحِجَابُ! اَلْحِجَابُ!! قَبْلَ الْعَذَابِ
‘পর্দা! পর্দা!! শাস্তি আসার আগে।’
অনুবাদ ও সম্পাদনা
মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী নকশবন্দী
প্রিয় বোন! কেন পর্দা করবেন? – ২য় পর্ব
প্রিয় বোন! কেন পর্দা করবেন? – ৩য় পর্ব