প্রিয় বোন! কেন পর্দা করবেন? – হযরত মাওলানা জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী – ৩য় পর্ব

কিছু অভিযোগ:

ওয়াজ-মাহফিলে পর্দা সম্পর্কে একটু জোরালো ভাষায় বলা হলে অনেক সময় বেপর্দানারীরা অস্থির হয়ে ওঠেন। পর্দাহীনতাকে বৈধ প্রমাণের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন অভিযোগ করে থাকেন। এভাবে পর্দাহীনতা তো বৈধ হয়ে যায় না, তবে গুনাহর দিকটা আরো জঘন্য হয়ে ওঠে। গুনাহকে গুনাহ মনে করে যে ব্যক্তি গুনাহ করে তার কৃতগুনাহ তাওবা দ্বারা তড়িৎ মাফ হয়ে যায়। কিন্তু গুনাহকে জায়েয মনে করে করলে ওই ব্যক্তির ব্যাপারে আশঙ্কা থাকে কুফরির সীমানাতেও ঢুকে পড়ার। এজন্য পর্দার যুক্তি-প্রমাণগুলোকে পূর্ণাঙ্গতাদানের উদ্দেশে কিছু অভিযোগ উত্তরসহ পেশ করা হচ্ছে–

অভিযোগ-০১ : চাদর বা বোরকা পরলে কী আর হয়? মূলত পর্দা তো চোখের হয়।
উত্তর : যারা বলে, মূলপর্দা চোখের, তাদের উচিত উলঙ্গ হয়ে ঘোরাফেরা করা। কাপড় পরিহিত থেকে লাভ কী! বস্ত্রহীন হয়ে নিজের ঘরের মহিলাদের সামনে একটু এসে দেখো না; তখনই বুদ্ধি সঠিক ঠিকানা পেয়ে যাবে। এ জাতীয় প্রশ্ন ওইসব নারীই করে যাদের বুদ্ধির ওপর তালা ঝুলে আছে কিংবা যাদের পুরুষদের বিবেকের ওপর পর্দা পড়ে গেছে।

بے پرده نظر آئيں مجهے چند بيبيا ں
اكبر زميں ميں غيرت قومى سے گڑ گيا
پوچها جو ان سے آ پكا پرده وه كيا ہوا
كہنے لگيں كہ عقل پہ مردو ں كى پڑ گيا
‘আমার দৃষ্টির আওতায় কিছু পর্দাহীননারী পড়ল,
(যা দেখে) জাতির আত্মমর্যাদাবোধের কারণে আকবর জমিনের সাথে লেপ্টে গেল ।
যখন জিজ্ঞেস করলাম, আপনাদের পর্দার কী হল?
বলল, আমাদের পর্দা পুরুষদের বিবেকে পড়ে গেল ।’

আমার ধারণা এ টাইপের চিন্তা তখনই তৈরি হয়, যখন অন্তরে উদাসীনতার আবরণ পড়ে যায়। পর্দা প্রথমে চোখ থেকে খসে পড়ে তারপর চেহারা থেকে।

অভিযোগ ০২ : পর্দা শিক্ষার প্রতিবন্ধক।
উত্তর : আমরা বলব, পর্দা শিক্ষার অন্তরায় নয়; বরং সহযোগী। সহশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিদিন নতুন পরিস্থিতি জন্ম নেয়। মেয়েরা সেজেগুজে নিজেদের রূপ-সৌন্দযের জানান দিতে আসে, আর ছেলেরা তাদের রমণীয়জাদুতে মুগ্ধ হয়ে নিজেদের অধিকারের বাগডোরে তাদেরকে আবদ্ধ করার নেশায় থাকে। ছেলেমেয়ে কারোই মনোযোগ পড়ালেখার প্রতি থাকে না। বেচারা-বেচারিদের অবস্থা অনেকটা এমন হয়-

كتاب كهول كے بيٹهو ں تو آنكھ روتى ہے
ورق ورق تيرا چہره دكهائى ديتا ہے
‘বই খুলে বসলেই চোখ কান্নায় ভিজে ওঠে,
প্রতিটি পৃষ্ঠায় শুধু তোমার মুখখানা দেখা যায়।’

অনেক জায়গা তো প্রফেসররাও মেয়েদের জন্য যেন প্রাণ দিয়ে দেয়।

جب مسيحا دشمن جا ں ہوتو كياہو زند گى
كون ره بتلاسكے جب خضر بهكانے لگے
‘রক্ষকই যদি ভক্ষক সাজে, জীবনের তখন কী হবে?
খিযিরই যদি ভুলপথ দেখায় তবে রাস্তা দেখাবে কে?’

এসব সমস্যার উত্তম সমাধান তো এটাই যে, ছেলেদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মেয়েদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে আলাদা হবে। তখন ছেলেমেয়ে পরস্পর দৃষ্টিবিনিময় নয়; বরং বইয়ের দিকে মনোযোগ দিতে সক্ষম হবে।

অভিযোগ ০৩ : পর্দা প্রগতির পথে বাঁধা। কারণ, এতে সমাজের অর্ধাংশ অচল হয়ে পড়ে। যারা সমাজউন্নয়নে নিজেদের কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না।
উত্তর : আগে বুঝতে হবে, আমরা প্রগতি বলতে কী বুঝি? নারীকে ঘর থেকে বের করে অফিসে, ক্লাবে, পাবলিক-প্লেসে দাঁড় করিয়ে দেয়ার নামই কি প্রগতি! না তাদের নিজস্ব ভুবনে একাগ্রতার সঙ্গে নিজেদের দায়িত্বপালন করার নাম প্রগতি বা উন্নতি। সৃষ্টিগতভাবে তাদের প্রকৃত উন্নতি তো এরই মধ্যে বিদ্যমান।
তাদের আসল দায়িত্ব তো হল, তারা সমাজের জন্য উত্তম প্রজন্ম তৈরি করবে। এমন প্রজন্ম যারা আলোকিত-ভবিষ্যত রচনা করতে সক্ষম হবে। আর এটা তখনই সম্ভব হবে, যখন নারী আপন সংসারে অবস্থান করে নিজের সন্তানদের উত্তম প্রতিপালনের দায়িত্ব একাগ্রতার সাথে আদায় করবে।
পশ্চিমাদের উদরে জন্ম নেয়া প্রগতি ও উন্নতি এবং প্রকৃত প্রগতি-উন্নতি এক নয়। সুতরাং প্রগতি ও উন্নতিকে পশ্চিমাদের চশমা লাগিয়ে দেখার প্রয়োজন নেই। বরং ওই মাপকাঠিতে দেখতে হবে যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ স্থাপন করেছেন।

অভিযোগ ০৪ : পর্দা নারীদের জন্য একপ্রকার বন্দিশালা।
উত্তর : শব্দ ও তাৎপর্যবিচারে পর্দা ও বন্দিত্ব এক বিষয় নয়। বন্দিত্ব বলা হয়, কাউকে তার লক্ষ্য ও ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোথাও আবদ্ধ করে দেয়া। আর পর্দা হল, সন্তুষ্টচিত্তে নিজেকে পরপুরুষের আড়ালে রাখা। বন্দিত্বে উদ্দেশ্য হল, লোকেরা যেন তার অনিষ্ট থেকে বাঁচতে পারে। পক্ষান্তরে পর্দার উদ্দেশ্য হল, নারী যেন পরপুরুষের অনিষ্ট থেকে বাঁচতে পারে। মানুষ পোশাক পাল্টানোর সময় কোনো রুমে কিংবা দেয়ালের আড়ালে গিয়ে পাল্টায়। কারণ, সে এটা চায় না যে, তার সতর কেউ দেখে ফেলুক। এটাকে বন্দিত্ব বলা যায় না। বরং এটার নাম পর্দা। বন্দিত্ব হয় জোরপূর্বক। আর পর্দাপালন করা হয় নিজের ইচ্ছায়। বন্দিত্ব হয় অপকর্মের সাজা হিসাবে। অথচ পর্দা হয় মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কার লাভের তামান্নায়। সুতরাং নারী পর্দাপালন করলে বন্দি হয় না; বরং অনেক অনেক বিপদ থেকে বেঁচে যায়।

অভিযোগ ০৫ : বোরকা তো কেবল শরীর ঢাকে। বোরকাধারী-নারীও তো অপকর্ম করে।
উত্তর : এটা অন্তরে গেঁথে নিন যে, পর্দাপালনকারীদের মাঝেও পর্দাহীনতার কারণেই গোলমাল হয়। কেউ পর্দাহীনতা থেকে সম্পূর্ণ দূরে থাকলে তার পদস্খলনের কোনো আশঙ্কা নেই। ভাবনার বিষয় হল, পর্দাপালনকারীরাও যদি একটু পর্দাহীনদের মত চলে তাহলে গÐগোল দেখা দেয়, সুতরাং যেসব নারী মোটেই পর্দা করে না, না জানি তাদের জীবনে কত কী ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ জন্য দেখা যায়, বেপর্দানারীর বেশিরভাগ সময় কেটে যায় নিজের অপকর্মের ওপর পর্দা টাঙ্গানোর পেছনে।

অভিযোগ ০৬ : কিছু মহিলা বলে থাকেন, আমরা তিনসন্তানের মা হয়ে গেছি, এখন আমাদের দিকে কে তাকাবে?
উত্তর : যারা খারাপচোখে তাকায় তারা তিনসন্তানের মায়ের প্রতিও তাকায়। এবার তিনসন্তানের মায়েরা কী বলবেন? অভিযোগকারীনী কিভাবে এ সিদ্ধান্ত নিলেন যে, আপনাকে কেউ মন্দদৃষ্টিতে দেখে না? আমি বলব, মনে করুন, যদি কেউ দেখে তাহলে দুর্ভাগ্য তো আপনিই ডেকে আনলেন। এজাতীয় অর্থহীন বাহানা ধরে বেপর্দায় থাকবেন। এর মোটেও অবকাশ নেই। বলুন তো, আপনি তিনসন্তানের মা হয়েছেন বলে কি নিজের স্বামীকে আকর্ষণ করার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছেন? যদি স্বামীর প্রয়োজন আপনাকে দিয়ে পূরণ হয় তাহলে পরপুরুষের ক্ষেত্রে বাঁধা কোথায়? আরবিভাষায় প্রবাদ আছে- لِكُلِّ سَاقِطٍ لَاقِطٌ.‘প্রতিটি পরিত্যক্তবস্তু উঠিয়ে নেয়ার লোক থাকে।’

অভিযোগ ০৭ : পর্দা করলে পরপুরুষ বেশি আগ্রহসহ দেখে।
উত্তর : আপনি নিজেই চিন্তা করুন, পর্দানশীলনারীর প্রতি যদি পরপুরুষ এতটা আগ্রহের দৃষ্টিতে তাকায়, তাহলে পর্দাহীননারীর প্রতি কতটা লোভ-লিপ্সাঘেরা দৃষ্টিতে তাকাবে? আমাদের কাছে তো মনে হয়, কসাই বকরির দিকে যে দৃষ্টিতে তাকায়, সে দৃষ্টিতেই বখাটেরা বেপর্দানারীর প্রতি তাকায়। এর প্রমাণ হল, পর্দাপালনকারী নারীর প্রতি তাকালে তো কালোকাপড় ছাড়া কিছু দেখা যায় না, কিন্তু বেপর্দা নারীর সবকিছু চোখ ধাঁধিয়ে ভেসে ওঠে। এমন কি অনেক ক্ষেত্রে এটাও অনুমান করা যায় যে, গোশত কত কেজি, চর্বি কত কেজি!

পর্দাহীনতার করুণ পরিণতি:

পশ্চিমা সমাজে আপন-পর ও পর্দা-বেপর্দা বলতে কিছু নেই। নগ্নতা ও অশ্লীলতা একেবারে তুঙ্গে। লেখাপড়াজানা কথিত লোকগুলো দীনের সাথে পরিচিত না হওয়ার কারণে দু’পাবিশিষ্ট জন্তুতে পরিণত হয়েছে। বাসায় মা-বাবা বেডরুমের ভালোবাসা ছেলে-মেয়ের সামনে দেখায়। নারী-পুরুষ সবাই বাসায় শর্টপোশাক পরে। নারী-পুরুষ স্বেচ্ছায় ব্যভিচার করলে তা আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ মনে করা হয় না। তাদের চারিত্রিকঅবক্ষয়ের এপিট-ওপিঠ নি¤েœাক্ত ঘটনার মাধ্যমে অনুমান করতে পারেন।
এক অমুসলিম বাসার জন্য মুসলিম ড্রাইভার রেখেছিল। কয়েকবছর পর ওই অমুসলিমকে অফিসিয়াল কাজের উদ্দেশ্য বাইরে যেতে হল। যাওয়ার সময় ড্রাইভারকে খুব গুরুত্ব দিয়ে বলে গেল, যেন সে ঠিকভাবে ডিউটি পালন করে এবং বাসার প্রতি খুব খেয়াল রাখে। ড্রাইভার নির্দেশমাফিক প্রতিদিন ডিউটিতে চলে আসত এবং বাসার জন্য কিছু আনার দরকার হলে এনে দিত। বাসার মেম সাহেব বাইরে যেতে বললে নিয়ে যেত। পনের বিশদিন পর একদিন মেম সাহেব ড্রাইভারকে তার বেডরুমে ডেকে পাঠাল এবং বলল, আমার যৌনক্ষুধা নিবারণ কর। ড্রাইভার ভাবল, আমি মালিকের সঙ্গে খেয়ানত করব কিভাবে? তাই সে রাজি হল না। এতে মেম সাহেব ক্ষেপে গেল এবং তাকে রুম থেকে বের করে দিল। তিনমাসের মধ্যে অন্তত আট-দশবার মেম সাহেব একই চেষ্টা করেছিল। কিন্তু প্রতিবারই ড্রাইভার ‘না’ করে দিয়েছিল। তিনমাস পর মালিক ফিরে এল এবং পরের দিন ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করল, আমার স্ত্রী তোমার সাথে যৌনকর্ম করার আগ্রহ প্রকাশ করেছিল কিÑনা? ড্রাইভার উত্তর দিল, হ্যাঁ, করেছিল, তবে আমি রাজি হয় নি। কারণ, আমি আমার মালিকের সঙ্গে খেয়ানত করতে পারি না। এবার মালিক বলল, আরে বোকা! খেয়ানত আবার কোন্ বস্তুর নয়! আগে বলো, যদি দুঃখ পাওয়ার কারণে আমার স্ত্রীর কিছু একটা হয়ে যেত তাহলে এর দায়ভার কে নিত? তোমার উচিত ছিল তার কথা শোনা। আমি তোমার মত অবাধ্যকে বাসার চাকর হিসাবে রাখতে পারি না। সুতরাং আজ থেকে তোমার ছুটি। তোমাকে চাকরি থেকে বের করে দেয়া হল।
অমুসলিম সমাজে সম্মতিতে-ব্যভিচার কোনো পাপ নয়। উক্ত ঘটনা তার প্রমাণ। তাদের খাহেশ হল, মুসলমানদের সমাজে ব্যভিচার ব্যাপক হোক। মুসলমানদের থেকে লজ্জা ও শালীনতাবোধ বিদায় নিয়ে যাক। এ লক্ষেই পপ গান ও নগ্নফ্লিমের মাধ্যমে তারা মুসলিম সমাজে সংস্কৃতিকআগ্রাসন চালু করেছে। যে মুসলমান ইংরেজস্টাইলের জীবনযাপনে সন্তুষ্ট হয়, পর্দাহীনতাকে গ্রহণ করে, নিজ সন্তানদের সাথে বসে যৌনসুড়সুড়িজাত ফ্লিম দেখে, তাদের সংসারজীবন খুবই ভয়াবহ হয়।

ناطقہ سر بگريبا ں ہے اسے كيا كہے
‘বাকশক্তিসম্পন্ন মাথাটা জালে ধরা পড়েছে, এটাকে কী বলা হবে!’

পাতলাপোশাকের ব্যবহার:
আল্লাহ তাআলা বলেন,غَيْرَ مُتَبَرِّجَاتٍ بِزِيْنَةٍ‘নিজের সৌন্দর্য প্রদর্শন করে ফিরো না।’

উক্ত আয়াত দ্বারা মুফাসসিরগণ প্রমাণ পেশ করেছেন যে, সৌন্দর্য-ঝলক বোঝা যায় এমন পাতলা-পিনপিনে কাপড় পরার অনুমতি নারীদের জন্য নেই।

ইবনুল আরাবি রহ. আহকামুল কুরআনে লিখেছেন, وَمِنَ التَّبَرُّجِ اَنْ تَلْبَسَ الْمَرْأَةُ ثَوْبًا رَقِيْقًا يَصِفُهَا ‘নারীরা পাতলাকাপড় পরিধান করা যার কারণে তার সৌন্দর্য বোঝা যায়; এটাও প্রদর্শনের অন্তর্ভুক্ত।’ (আহকামুলকুরআন ২/১১৪)

এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

رُبَّ نِسَاءٍ كَاسِيَاتٍ عَارِيَاتٍ مَائِلَاتٍ مُمِيْلَاتٍ لَا يَدْخُلْنَ الْجَنَّةَ وَلَا يَجِدْنَ رِيْحَهَا

‘কিছু নারী, যারা পোশাক পরিধান করেও উলঙ্গ, পরপুরুষকে আকৃষ্ট করে, নিজেরাও পরপুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হয়, এরা জান্নাতে প্রবেশ করবে না এবং জান্নাতের সুগন্ধি পাবে না।’ (মিশকাত)

হাদীসটিতে كَاسِيَاتٍ (পোশাকপরিহিত) শব্দের পর عَارِيَاتٍ (উলঙ্গ) শব্দটি এসেছে এটা বোঝানোর জন্য যে, এরা পোশাক বা শাড়ি পরবে কিন্তু ভেতরটা বোঝা যাবে, সুতরাং এরা উলঙ্গ। সকল আলেম এব্যাপারে একমত যে, মহিলাদের জন্য এমন কাপড় পরিধান করা হারাম, যা দ্বারা দেহ স্পষ্ট দেখা যায়। সতর ঢেকে রাখা ফরজ। যদি কোনো মহিলা এমন ওড়না দ্বারা নামায পড়ে যার দ্বারা মাথার চুল স্পষ্ট দেখা যায়, তাহলে তার নামায হবে না। বর্তমানে কিছু মহিলা মোটাকাপড়ের সেমিজের ওপর পাতলা জামা পরে, তাকওয়ার দাবি হল, এ জাতীয় পোশাকও পরিধান না করা।

উম্মে আলকামা রাযি. বলেন, আয়েশা রাযি.-এর ভাতিজি হাফসা বিনতে আবদুররহমান রাযি. তাঁর সাথে দেখা করতে এসেছেন, তখন তাঁর গায়ে ছিল পাতলা কাপড়ের একটি ওড়না। এটা দেখে আয়েশা রাযি. ওড়নাটি ছিঁড়ে ফেলেন এবং এর পরিবর্তে তাকে দু’টি মোটা ওড়না দেন। (মিশকাত, পোশাক অধ্যায়)

মুসলিম শরীফের এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন,خُذْ عَلَيْكَ ثَوْبَكَ وَلَا تَمْشُوْا عُرَاةً ‘গায়ে কাপড় জড়িয়ে নাও, উলঙ্গ চলাফেরা করো না।’ (মিশকাত )

এর দ্বারা প্রতীয়মান হল, এমন পাতলাকাপড় যার দ্বারা সতর আবৃত হয় না, বরং সতরের অঙ্গগুলো দেখা যায়, তা পরিধান করা হারাম।

পর্দাহীন নারীর সাজা:

এক. হযরত আলী রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি এবং আমার স্ত্রী ফাতেমা রাযি. গেলাম রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর দরবারে। আমরা দেখলাম, তিনি কাঁদছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ওগো আল্লাহর রাসূল ﷺ! আপনার জন্য আমার মা-বাবা কুরআন হোক। আপনি কাঁদছেন কেন? তিনি উত্তর দিলেন, আলী! আমি মিরাজের রাতে আমার উম্মতের নারীদেরকে দেখেছি, তাদেরকে বিভিন্নপদ্ধতিতে সাজা দেয়া হচ্ছে। আজ সে দৃশ্য আমার মনে পড়ে গেল, তাই মায়া ও দয়ার কারণে আমার কান্না এসে গেছে।
আমি কিছু নারীকে দেখলাম, তাদেরকে মাথার চুলে সঙ্গে বেঁধে উল্টো ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে এবং তাদের মগজ টগবগ করছে।
আরো কিছু নারীকে দেখলাম, তাদেরকে জিহবার সঙ্গে বেঁধে উল্টো ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে এবং গরম পানি তাদের গলার ভেতরে ফেলা হচ্ছে।
তৃতীয় একশ্রেণীর নারীকে দেখলাম, তাদের দুই পা দুই স্তনের সঙ্গে এবং দুই হাত কপালের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে।
চতুর্থপ্রকার কিছুনারীকে দেখলাম, তাদেরকে স্তনের সঙ্গে বেঁধে উল্টো ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
পঞ্চম শ্রেণীর নারীগুলোকে দেখলাম, তাদের মাথা শূকরের মত, অবশিষ্ট দেহ গাধার মত।
ষষ্ঠপ্রকার কিছু নারীকে দেখলাম, তাদের চেহারা কুকুরের মত এবং আগুন তাদের মুখে ঢুকছে, বের হচ্ছে পায়খানার রাস্তা দিয়ে। ফেরেশতারা আগুনের মুগুর দিয়ে তাদের মাথায় আঘাত করে যাচ্ছে।
এই বিবরণ শুনে ফাতেমা রাযি. বসে থাকতে পারলেন না, দাঁড়িয়ে গেলেন এবং বললেন, প্রাণপ্রিয় আব্বাজান! আমার চোখের শীতলতা আপনি। দয়া করে বলুন, এসব নারীর অপরাধ কী, যার কারণে এত ভয়াবহ শাস্তি দেয়া হচ্ছে?
রাসূলুল্লাহ ﷺ উত্তর দিলেন, প্রথমশ্রেণীর নারী যাদেরকে মাথার চুল দ্বারা বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, এরা পরপুরুষের সামনে নিজেদের চুল ঢেকে রাখত না। (খালি মাথায় বাজারে মার্কেটে ঘুরাঘুুরি করার অভ্যাস ছিল।)
দ্বিতীয়প্রকার নারী যাদেরকে জিহŸার সঙ্গে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছেÑ এরা নিজেদের স্বামীকে কষ্ট দিত। (স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ করার অভ্যাস ছিল।)
তৃতীয়শ্রেণীর নারী যাদেরকে দুই পা স্তনের সঙ্গে এবং দুই হাত কপালের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে, এরা ঋতু¯্রাব ও সহবাসের পর ভালোভাবে গোসল করে পবিত্র হত না। আর নামাযের ব্যাপারে উপহাস করত।
চতুর্থপ্রকার নারী যাদেরকে স্তন দ্বারা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এরা ওই সকল অসতী ছিল যারা পুরুষের সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হত।
পঞ্চমশ্রেণীর নারী যাদের মাথা শূকরের মত এবং দেহ গাধার মত। এরা মানুষের বদনাম করত এবং মিথ্যা বলত।
ষষ্ঠপ্রকার নারী যাদের চেহারা কুকুরের মত এবং আগুন মুখ দিয়ে ঢুকিয়ে পায়খানার রাস্তা দিয়ে বের করা হচ্ছে। এরা লোকদের হিংসা করত। এবং উপকার করে খোঁটা দিত। (ইমাম যাহাবিকৃত আলকাবাইর, পৃষ্ঠা : ১৭৭)

দুই.  ইমাম যাহাবী রহ. একটি ঘটনা লিখেছেন,

وَقَدْ حُكِىَ اَنَّ اِمْرَأَةً كَانَتْ مِنَ الْمُتَبَرِّجَاتِ فِى الدُّنْيَا وَكَانَتْ تَخْرُجُ مِنْ بَيْتِهَا مُتَبَرِّجَةً. فَمَاتَتْ فَرَاهَا بَعْضُ اَهْلِهَا فِى الْمَنَامِ وَقَدْ عُرِضَتْ عَلَى اللهِ عَزَّ وَجَلَّ فِىْ ثِيَابٍ رِقَاقٍ، فَهَبَّتْ رِيْحٌ فَكَشَفَتْهَا فَاَعْرَضَ اللهُ عَنْهَا وَقَالَ خُذُوْابِهَا ذَاتَ الشِمَالِ اِلَى النَّارِ فَاِنَّهَا كَانَتْ مِنَ الْمُتَبَرِّجَاتِ فِى الدُّنْيَا.

‘এক মহিলা ছিল। দুনিয়ার জীবনে দেহপ্রদর্শনী করে চলত। সাজগোজ করে চোখ ধাঁধিয়ে বাড়ি থেকে বের হত। সে মারা গেল। তখন তার এক আত্মীয় তাকে স্বপ্নে দেখল। আল্লাহতাআলার দরবারে তাকে পাতলা পিনপিনে কাপড় পরিয়ে পেশ করা হয়েছে। আচমকা এক পশলা ঝড়োবাতাস এসে তাকে উলঙ্গ করে দিল। আল্লাহ তাআলা তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন এবং বললেন, একে জাহান্নামের বামদিকে ফেলে আসো। কেননা এ দুনিয়াতে পর্দাহীন হয়ে সেজেগুজে বেড়াত।’

হযরত মাজযূব রহ.-এর কয়েকটি পঙক্তি–

يہى دهن ہے تجهكو رہو ں سب سے بالا
ہو زينت نرالى اور فيشن نرالا
تجهے حسن ظاهر نے دهوكے ميں ڈالا
جيا كرتا ہے يونہى مر نے والا
جگہ جى لگا نے كى دنيا نہيں ہے
يہ عبرت كى جا ہے تماشہ نہيں ہے
‘সকলের ঊর্ধ্বে থাকাটাই তোমার আকর্ষণ,
(তোমার) সৌন্দর্য হবে নিরব, ফ্যাশন হবে ঘরোয়া।
(কিন্তু) বাহ্যিক সৌন্দর্য তোমাকে ধোঁকায় ফেলে দিয়েছে,
মৃত্যুপথের যাত্রী এভাবেই কি জীবন কাটায়!
মন গেঁথে রাখার মত স্থান এজগত নয়,
এটা শিক্ষাগ্রহণের জায়গা, খেল-তামাশার নয়।’

ফলাফল : পর্দাহীনতার সাজা অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক। এর ভয়াবহতা বিশাল এবং এর ফলাফল খুবই মন্দ।

পর্দাপালনের বরকত:
ইমাম ইবনুল আরাবী রহ. বলেন, আমি ‘নাবলিস’ দেশের প্রায় একহাজার এলাকায় গিয়েছি। এসব এলাকার কোনো একটিতে হযরত ইবরাহীম আলাইহিসসালামকে আগুনে ফেলা হয়েছিল। আমি নাবলিসের মহিলাদের চেয়ে সতী-সাধবী মহিলা কোথাও দেখি নি। আমি এলাকাগুলোতে বহুদিন থেকেছি। দিনেরবেলায় কোনো মহিলাকে বের হতে দেখি নি। হ্যাঁ, জুমআরদিন মহিলারা আসত। তাদের জন্য নির্ধারিত স্থান ওইদিন ভরে যেত। নামাযশেষে তারা প্রত্যেকে নিজেদের ঘরে চলে যেত। পরবর্তী জুমআ পর্যন্ত অলি-গলিতে একজন নারীও চোখে পড়ত না। (তাফসীরে কুরতুবী ১৪/১১৬)

অধমের তাবলিগের সুবাদে কয়েকবছর থেকে চতরালে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়। সেখানকার একজন বুযুর্গ আলেম আমাকে জানিয়েছেন, এখানে হত্যা-গুম-সন্ত্রাস হয় না বললেই চলে। জিজ্ঞেস করলাম, এমন শান্তি ও নিরাপত্তার সমাজ কিভাবে তৈরি হল? তিনি উত্তর দিলেন, আমাদের নারীরা পর্দার প্রতি পুরোপুরি যতœশীল। কয়েকমাসেও অলি-গলিতে পর্দাহীননারী দেখবেন না। এই পর্দার বরকতে ব্যভিচার ও অশ্লীলতার দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ফলে মারামারি-হানাহানি নেই। সবদিকেই আছে শান্তি, নিরাপত্তা, ভালোবাসা, ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্য। একমুসলমানকে অপরমুসলমানের হিতাকাক্সক্ষী হিসাবেই এখানে পাবেন।

আমেরিকার একযুবতী মুসলিম হয়ে যথারীতি নেকাবি-বোরকা পরা শুরু করল। তাকে বেশকিছু মহিলা জিজ্ঞেস করল, তুমি তো খোলামেলা পরিবেশে উন্মুক্তদেহে বিচরণকারী আধুনিকমেয়ে ছিলে। এখন তোমার এই পরিবর্তন! এত কঠিন পর্দাপালন করতে তোমার অসুবিধা হয় না? নিঃশ্বাস বের হয়ে যাওয়ার মত বিরক্তিকর লাগে না? নিজেকে কি বন্দি-টাইপের মনে হয় না? যুবতী উত্তর দিল, আমি আমার বহু রাত নাইটক্লাব ও নাচের আসরগুলোতে কাটিয়েছি। আমি দেখেছি, প্রতিটি পুরুষ আমার প্রতি কামুকদৃষ্টিতে তাকাত। যখন মার্কেটে যেতাম, তখন পুরুষগুলোকে আমার দিকে লোভীচোখে তাকাতে দেখেছি। মনে সবসময় ভয় কাজ করত। আশঙ্কায় ভুগতাম, কোনো বখাটে অসভ্যযুবক আমার ওপর হামলে পড়ে কিÑনা? কোনো হায়েনা আমার ইজ্জত নষ্ট করে কিনা? প্রাণ কেড়ে নেয় কিনা? এখন আর এসব ভয়-ভীতি নেই। কারণ, যেদিন থেকে আমি পর্দা শুরু করেছি, সেদিন থেকে পুরুষরা আমাকে দেখতে পায় না। আমার রূপ-সৌন্দর্য কেউ দেখে না। আমার অন্তরে কোনো আশঙ্কা ও ভীতি নেই। পর্দাপালন করেই আমি সুখী ও নিরাপত্তাপূর্ণ জীবনের ঠিকানা খুঁজে পেয়েছি। এখন আমার হৃদয় সুখপ্রাচুর্যে এতটাই তৃপ্ত ও পরিপূর্ণ যে, আমার অন্তরের সুখগুলো পর্দাহীননারীদের মাঝে বণ্টন করে দেয়া হলে সম্ভবত তারা সুখ-শান্তির ছোঁয়া পেয়ে যেত। উক্ত যুবতী ইবযরহফ ঃযব াবরষ নামক একটি বই রচনা করেছে।

ফাতেমা। আমেরিকার এক যুবতী মুসলিম। নেকাবি-বোরকা পরে ধীরে ধীরে বাসার দিকে যাচ্ছিল। তার হাত-পায়েও ছিলা মোজা। জনৈক পুলিশঅফিসার দেখে সন্দেহ করল যে, এভাবে আপাদমস্তক আবৃত হয়ে যাচ্ছে কে? তাই সন্দেহবশতঃ তাকে পুলিশের পাঁচ-ছয়জন সদস্য গ্রেফতার করার উদ্দেশে পথ আগলে দাঁড়াল এবং বলল, চেহারা থেকে কাপড় সরাও, আমরা দেখতে চাই যে, তুমি কে? ফাতেমা উত্তর দিল, কোনো মহিলাপুলিশ ডাকো, সেই আমার চেহারা দেখতে পারবে। তোমরা মোটেও দেখতে পারবে না। পুলিশেরা বলল, তুমি কাপড় না সরালে আমরা তোমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাব। কারণ ১৯৬৩ সালে আমেরিকাতে একটি আইন পাশ করা হয়েছে যে, কেউ শরীরের শতভাগ ঢেকে চলতে পারবে না। যেহেতু এর দ্বারা বড় বড় অপরাধীরাও পার পেয়ে যেতে পারে। ফাতেমা বলল, আমি এদেশে জন্ম নিয়েছি। এখানেই আমার বেড়ে ওঠা। এখানেই আমার শিক্ষা-দীক্ষা। আমি জানি, আমার দেশের আইন সকলকে ধর্মীয় স্বাধীনতা দেয়। আমি কোনো চাপে নয়; বরং আল্লাহর বিধান হিসাবেই এই পর্দা করেছি। এটা আমার আইনগত অধিকার। ফাতেমার কথা শুনে পুলিশ তাকে পুলিশস্টেশনে নিয়ে গেল। একমহিলার মাধ্যমে তাকে যাচিয়ে-খতিয়ে দেখা হল। অবশেষে তাকে একটি কার্ড বানিয়ে দেয়া হল। বলে দেয়া হল, যদি ভবিষ্যতে কোনো পুলিশ ধরে তাহলে কার্ডটি দেখালেই চলবে। এভাবে ফাতেমা এখনও পর্দাপালন করে চলাফেলা করে। তার সম্ভ্রম ও প্রাণ নিয়ে নিজের মাঝে কোনো ভয় নেই, ভীতি নেই। তার জীবন যেন لَا خَوفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُوْنَ. ‘তাদের কোনো ভয় নেই ও পেরেশানি নেই’-এর বাস্তব নমুনা।


অনুবাদ ও সম্পাদনা
মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী নকশবন্দী

প্রিয় বোন! কেন পর্দা করবেন? – ১ম পর্ব
প্রিয় বোন! কেন পর্দা করবেন? – ২য় পর্ব