মা-বাবা ও আত্মীয়-স্বজনদের হক – মুফতী মনসূরুল হক (দা.বা)

সর্বাপেক্ষা সদ্ব্যবহারের অধিকারী হলেন মা

হাদীস : হযরত আবূ হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি বললো, হে আল্লাহর রাসূল! (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমার কাছ থেকে উত্তম আচরণ লাভের সবচেয়ে বেশি হকদার কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সাহাবী জিজ্ঞাসা করলেন, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সাহাবী জিজ্ঞাসা করলেন, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সাহাবী জিজ্ঞাসা করলেন, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার বাবা।

অপর এক বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার উত্তরে বললেন, তোমার মা, তারপর তোমার মা, তারপর তোমার মা, তারপর তোমার পিতা। তারপর তোমার নিকটতম আত্মীয়-স্বজন।

পিতা-মাতা মুশরিক হলেও তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করতে হবে

আয়াত: আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আমি মানুষকে তার পিতা-মাতা সম্পর্কে নির্দেশ দিয়েছি (কেননা) তার মা কষ্টের পর কষ্ট সয়ে তাকে গর্ভে ধারণ করেছে আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দু‘বছরে তুমি শোকর আদায় কর আমার এবং তোমার পিতা-মাতার। আমারই কাছে (তোমাদেরকে) ফিরে আসতে হবে। তারা যদি এমন কাউকে (প্রভুত্বে) আমার সমকক্ষ সাব্যস্ত করার জন্য তোমাকে চাপ দেয়, যে সম্পর্কে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তবে তাদের কথা মানবে না। তবে দুনিয়ায় তাদের সাথে সদ্ভাব বজায় রাখবে।

হাদীস: হযরত আসমা বিনতে আবূ বকর রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, কুরাইশদের সাথে সন্ধির সময় আমার মা মুশরিক অবস্থায় আমার কাছে এলেন। তখন আমি জিজ্ঞাসা করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমার মা আমার কাছে এসেছেন। কিন্তু তিনি ইসলাম থেকে বিমুখ। আমি কি তাঁর সাথে সদাচরণ করব? তিনি উত্তর দিলেন, হ্যাঁ, তাঁর সাথে সদাচরণ করো।

অক্ষম পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ সন্তানের উপর ফরয

হাদীস: হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাযি. থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বললো, হে আল্লাহর রাসূল! (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমার সম্পদও আছে, সন্তানও আছে। আর আমার পিতা আমার সম্পদের মুখাপেক্ষী। হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি এবং তোমার সম্পদ তোমার পিতার। তোমাদের সন্তানেরা তোমাদের সর্বোত্তম উপার্জন। সুতরাং তোমরা তোমাদের সন্তানদের উপার্জন থেকে খাও।

পিতা-মাতার সামনে উচ্চস্বরে কথা বলবে না

আয়াত: তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তাকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত কোরো না, পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো, পিতা-মাতার কোন একজন কিংবা উভয়ে যদি তোমার কাছে বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে উফ্ পর্যন্ত বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিয়ো না। বরং তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বলো এবং তাদের প্রতি মমতাপূর্ণ আচরণের সাথে তাদের সামনে নিজেকে বিনয়াবনত করো এবং দু‘আ করো, হে আমার প্রতিপালক! তারা যেভাবে আমার শৈশবে আমাকে লালন-পালন করেছে, তেমনি আপনিও তাদের প্রতি রহমতের আচরণ করুন।

হাদীস: হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কারো জন্য নিজ পিতা-মাতাকে গালি দেয়া কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কেউ কি নিজ পিতা-মাতাকে গালি দিতে পারে? তিনি উত্তর দিলেন, হ্যাঁ, সে অন্যের পিতাকে গালি দেয়। ফলে ঐ ব্যক্তি পাল্টা তার পিতাকে গালি দেয়। সে অন্যের মাকে গালি দেয়। ফলে ঐ ব্যক্তি তার মাকে গালি দেয়।  

পিতা-মাতার অবাধ্যতা কবীরা গুনাহ

হাদীস: হযরত মুগীরা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের উপর মায়ের অবাধ্যতা, কন্যাদেরকে জীবন্ত দাফন করা, কৃপণতা ও ভিক্ষাবৃত্তি হারাম করেছেন। আর তোমাদের জন্য বৃথা তর্ক-বিতর্ক, অধিক প্রশ্ন ও সম্পদ অপচয় করাকে নিষিদ্ধ করেছেন।

মৃত্যুর পরে পিতা-মাতার কয়েকটি হক

হাদীস: হযরত আবূ উসাইদ সাঈদী রাযি. বলেন, একদা আমরা হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে ছিলাম এমতাবস্থায় বনী সালামার এক লোক এলেন। বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমার পিতা-মাতার মৃত্যুর পরও কি তাদের সাথে সদাচরণ করার কিছু বাকী আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, তাদের জন্য দু‘আ ও ইস্তিগফার করা, তাদের মৃত্যুর পর তাদের অঙ্গীকার পূর্ণ করা, তাদের আত্মীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখা, তাদের বন্ধু-বান্ধবদের সম্মান করা।

হাদীস: হযরত ইবনে উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কোন ব্যক্তির জন্য সর্বোত্তম নেক কাজ হলো পিতার অবর্তমানে তাঁর বন্ধু-বান্ধবদের সাথে সদাচরণ করা।

স্বজনদের সাথে সদ্ব্যবহারের ফযীলত

হাদীস: হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি কামনা করে যে, তার রিযিক প্রশস্ত করে দেয়া হোক এবং হায়াত বাড়িয়ে দেয়া হোক, সে যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখে।

হাদীস: হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আমি আল্লাহ এবং রহমান। আমি রেহেম (আত্মীয়তা) সৃষ্টি করেছি এবং আমার নাম থেকে তার নাম নির্গত করেছি। যে তার সাথে সম্পর্ক বহাল রাখবে, আমি তার সাথে সম্পর্ক বহাল রাখব। আর যে তাকে ছিন্ন করবে, আমি তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করব।’

আত্মীয়তা ছিন্ন করা কাফেরদের স্বভাব

আয়াত: যারা আল্লাহ তা‘আলার সাথে কৃত অঙ্গীকারে আবদ্ধ হওয়ার পর তা ভঙ্গ করে, আল্লাহ তা‘আলা যে সম্পর্ক বজায় রাখার হুকুম দিয়েছেন তা ছিন্ন করে এবং যমীনে অশান্তি বিস্তার করে, তাদের জন্য রয়েছে লা’নত এবং আখেরাতে নিকৃষ্ট পরিণাম তাদেরই জন্য।

আত্মীয়তা ছিন্ন করার পরিণাম

হাদীস: হযরত যুবাইর ইবনে মুতঈম রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আত্মীয়তা ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।

হাদীস: হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আমি আল্লাহ এবং রহমান। আমি রেহেম (আত্মীয়তা) সৃষ্টি করেছি এবং আমার নাম থেকে তার নাম নির্গত করেছি। যে তার সাথে সম্পর্ক বহাল রাখবে, আমি তার সাথে সম্পর্ক বহাল রাখব। আর যে তাকে ছিন্ন করবে, আমি তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করব।

হাদীস: হযরত আবূ বাকরা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, (খলীফাতুল মুসলিমীনের বিরুদ্ধে) বিদ্রোহকারী এবং আত্মীয়তা ছিন্নকারী এর সর্বাধিক উপযুক্ত যে, তাকে আল্লাহ তা‘আলা আখেরাতে প্রস্তুতকৃত শাস্তির সাথে সাথে দুনিয়াতেও শাস্তি প্রদান করবেন।

সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেলে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করবে

হাদীস: হযরত ইবনে আমর রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি প্রতিদান স্বরূপ আত্মীয়তা রক্ষা করে, সে প্রকৃত অর্থে আত্মীয়তা রক্ষাকারী নয়। বরং প্রকৃত আত্মীয়তা রক্ষাকারী ঐ ব্যক্তি, যার সাথে আত্মীয়তা ছিন্ন করা হলেও পুনরায় তা স্থাপন করে।

আত্মীয়তার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠাকারীর জন্য আল্লাহ তাআলার সহযোগিতা

হাদীস: হযরত আবূ হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি বললো, হে আল্লাহ তা‘আলার রাসূল! (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমার কিছু আত্মীয় এমন আছে, যাদের সাথে আমি সম্পর্ক জুড়ে রাখি। কিন্তু তারা সম্পর্ক ছিন্ন করে। আমি তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করি। কিন্তু তারা আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে। আমি তাদের ব্যবহারে ধৈর্য ধারণ করি। কিন্তু তারা আমার সাথে মূর্খতা প্রদর্শন করে। (এ কথা শুনে) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি যা বললে, যদি প্রকৃত অবস্থা তাই হয়, তাহলে তুমি যেন তাদের উপর গরম ছাই নিক্ষেপ করছ। যতক্ষণ তুমি এই অবস্থায় বহাল থাকবে, সর্বদা তোমার সঙ্গে আল্লাহ তা‘আলার তরফ থেকে তাদের বিপক্ষে একজন সাহায্যকারী (ফেরেশতা) থাকবে।