মুসলিম কারাবন্দীদের পক্ষে কে দাঁড়াবে? – শাইখ মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল হাবদান

খুতবার প্রথম অংশ,

পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে,

হে মুসলিম উম্মাহ,
সত্য আর মিথ্যার মধ্যেকার লড়াই চলছে, লড়াই চলছে আলো এবং অন্ধকারের, লড়াই চলছে হেদায়াত ও গোমরাহীর, সঠিক পথের ও ভ্রান্ত পথের, এ লড়াই চলছে ইসলাম ও কুফরের মাঝে…আর এটা চলবে শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত। আর এটা এমন এক লড়াই যেখানে ঈমানদার লোকেরাই অধিকাংশ সময়েই বিজয় লাভ করবে, কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদেরকেও পরাজয় স্বীকার করানো হবে…আর এটা তো শুধু এমন এক সাময়িক পরাজয়, এমন কিছু ঘটনা যা কেবল আশু বিজয়ের আগমনের বিলম্ব ঘটায়।

আর এ লড়াইয়ের ফলাফলস্বরূপ,
মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাদের তিনি অধিক পছন্দ করেন তাদের নির্বাচন করেন। আমাদের মাঝেই আছেন সেসব লোকেরা যারা আল্লাহর কারণে শাহাদাত বরণ করে সফলতা লাভ করেছেন, আমাদের মাঝেই আছেন সেসব লোকেরা যারা আল্লাহর কারণে নিজেরা আহত হয়েছেন, আর আমাদের মাঝেই আছেন সেসব লোকেরা যারা আল্লাহর কারণে নিজেদের অঙ্গ হারিয়েছেন, তারা আল্লাহর রাস্তায় যা হারিয়েছেন তা তাদেরকে জান্নাতের পথে অগ্রগামী করে।
এবং আমাদের মাঝে আরো আছেন সেই সকল ভাই বোনেরা যাদেরকে বন্দী করা হয়েছে শত্রুদের হাতে, আর এটা সকল লড়াইয়ের একটি সাধারণ ফলাফল। যদি কেউ ইতিহাসের পাতা উলটে দেখতে চায়, সে দেখবে এ ধরণের আটক, নির্যাতন, বন্দীত্ব একটি সাধারণ ঘটনা যা অনেকটা নিয়মের মতই হয়ে গেছে এবং এতে অবাক হবার কিছু নেই।

কতজন বীর মুজাহিদ শহীদ হয়েছেন? কত শত মানুষ আহত হয়েছেন, কত শত যোদ্ধাদের কারাবন্দী হিসেবে আটক করা হয়েছে? কিন্তু এসবের ভয়ে কি তাদের অন্তর দূর্বল হয়ে পড়েছিল? তাদের অন্তরগুলো কি ভয়ে জরাগ্রস্ত হয়েছিল? আমরা ভাবি, চিন্তা করে দেখি, বন্দীত্বের কারণে কি তাদের অন্তরে দুর্বলতা ও কাপুরুষতা সৃষ্টি হয়েছিল?

আমাদের আছে খুবাইব বিন আদি (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এর মত উদাহরণ সৃষ্টিকারী মানুষ, 
যিনি মুশরিকদের হাতে আটকা পড়েছিলেন, তারা তাকে ঘেরাও করে মসজিদুল হারামে নিয়ে আসল হত্যা করার উদ্দেশ্যে। তিনি তাদেরকে বললেন, “আমাকে দু রাকাত সালাত আদায় করতে দাও”।

যখন তিনি সালাত শেষ করলেন তিনি বললেন, “তোমরা যদি একথা মনে না করতে যে আমি মৃত্যুভয়ে ভীত হয়ে সালাত দীর্ঘ করছি তাহলে আমি আমার সালাত আরও দীর্ঘ করতাম”। তিনিই প্রথম সেই ব্যক্তি যিনি ফাঁসির পূর্বে দুই রাকাত সালাত আদায়ের রীতি চালু করেছেন। এরপর তিনি দুয়া করলেন, “হে আল্লাহ ! তুমি তাদের এক এক করে গণনা করে রাখ, তাদের এক এক করে হত্যা করো! এবং তাদের একটাকেও বাঁচিয়ে রেখো না!” এরপর তিনি বললেন, “যতক্ষণ পর্যন্ত আমি একজন মুসলিম হিসেবে আল্লাহর কারণে নিহত হলাম, আমি পরোয়া করি না আমার মৃতদেহ কোন দিকে ঢলে পড়ল। এর পুরোটাই আল্লাহর জন্যে; যদি তিনি ইচ্ছা করেন তাহলে তিনি আমার ছিন্ন বিচ্ছিন্ন দেহখানা আবার একত্রিত করে অনুগ্রহ করবেন”, শেষ পর্যন্ত তিনি উকবাহ বিন আল-হারিস এর হাতে খুন হলেন।
নিশ্চয়ই, আল্লাহই এমন বন্দীদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করতে পারেন এবং যা তাদের অন্তরে প্রশান্তি দান করে তা প্রদান করতে পারেন। খুবাইব এর কথাই ধরুন, যখন তাকে আটক করে ফাঁসির জন্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তিনি আল্লাহ কর্তৃক এতটাই প্রশান্ত ছিলেন যে একজন প্রত্যক্ষদর্শী মহিলা বর্ণণা করছেন,“আমি আমার জীবনে খুবাইবের চেয়ে উত্তম প্রশান্ত অবস্থায় আর কোন বন্দীকে দেখিনি। আমি দেখেছি সেদিন তিনি মক্কায় (সেই মওসুমে) যে আঙ্গুর ও ফল পাওয়া যেত না, তা ভক্ষণ করেছেন-আর এ সবই হয়েছিল যখন তাকে লোহার শিকলে করে বেঁধে রাখা হয়েছিল- আর একমাত্র আল্লাহই পারেন এমন রিযিক প্রদান করতে”।

পক্ষান্তরে, একজন বন্দীকে অসহ্য নির্যাতন করা হতে পারে, সম্মানহানিকর কিছু করা হতে পারে কিংবা কঠিন পরীক্ষার মাঝে তাকে পতিত হতে পারে। যাই হোক না কেন, এসবের কারণে আল্লাহ তায়ালা জান্নাতে তাদের মর্যাদা ও সম্মান বৃদ্ধি করে দেন।

আল্লাহ বলছেন, “মানুষ কি মনে করে যে, তারা একথা বলেই অব্যাহতি পেয়ে যাবে যে, আমরা বিশ্বাস করি এবং তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না? আমি তাদেরকেও পরীক্ষা করেছি, যারা তাদের পূর্বে ছিল। আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন যারা সত্যবাদী এবং নিশ্চয়ই জেনে নেবেন মিথ্যুকদেরকে”। [সূরা আল আনকাবুত ২-৩]

হে মুসলিম উম্মাহঃ

এই হল শত্রুদের হাতে যারা বব্দী হয়েছেন তাদের কথাঃ ফিলিস্তিন, কিউবা, গুয়ানতানামো কিংবা দুনিয়ার অন্য যে কোন প্রান্তে।

এরাই সেসব লোক, যারা তাদের ভাইদের সাহায্যে সামনে এগিয়ে এসেছিলেন, তারা এসেছিলেন মুসলিম ভূমির পবিত্রতা রক্ষার্থে, এমন একটি সময়ে যখন বাকিরা হতাশ হয়ে আশা ছেড়ে দিয়েছিল। যখন তারা নিজেরা এগিয়ে এসেছিলেন উম্মাহর বিপদের সময়ে, আজকে তাদের এই দুর্দিনে সারা উম্মাহর প্রতি তাদের হক অধিকার আছে যেন আমরাও তাদের সাহায্যে এগিয়ে যাই, তাদের এই পরীক্ষায় পাশে থাকি। আর এভাবেই আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মাহর প্রতি আদেশ করেছেন, “ তোমরা বন্দীকে মুক্ত কর !” [বুখারী]

ইমাম মালিক রাহিমাহুল্লাহ বলেছেনঃ “মানুষের উপর এটা বাধ্যতামূলক যে তাদের যা কিছু আছে সব মুক্তিপণ দিয়ে কারাবন্দীদের মুক্ত করবে, আর এ বিষয়ে কোন মতভেদ নেই(ফুকাহাদের মধ্যে),কারণ রাসুলুল্ললাহ বলেছেন, “ তোমরা বন্দীকে মুক্ত কর !” [বুখারী]

উলামায়ে ইসলাম যথার্থই বলেছনঃ “যদি শত্রুদের হাত থেকে মুসলিম বন্দীদের মুক্ত করতে গিয়ে মুসলিম রাষ্ট্রের কোষাগার পুরোটাই খালি হয়ে যায়, তবু এ বিষয়ে ঢিলেমি করার অবকাশ নেই। আর এটাই সঠিকঃ এ ক্ষতিকেও বেশি বড় করে দেখার অবকাশ নেই, পারে যখন আমরা দেখি লুটেরা আমেরিকানদের হাতে মুসলিমরা তাদের সম্মান হারাচ্ছে, বেইজ্জতি হচ্ছে আর তারা তা ঘৃণার চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে আর উপভোগ করছে, আর কি বিপর্যয় আছে যা এর থেকেও বেশি ?

এ দৃশ্য আপনারাও দেখেছেন নিশ্চয়ই, যেমনি দেখেছে সারা বিশ্বের মানুষ, কি নির্মম অমানবিক ট্রাজেডির শিকার হয়েছে আমাদের ভাইয়েরা কিউবা (গুয়ানতানামো) তে। বিভিন্ন দেশ থেকে তাদের নিয়ে আসা হয়েছে, তাদের অনেকেই এসেছেন পাকিস্তান থেকে –একটি কার্গো বিমানে করে চালান করে দেয়া হয়েছে, তাদের দাড়ি কামিয়ে দিয়েছে, মাথা ন্যাড়া করা, কাপড় ছিড়ে ফেলা হয়েছে, কমলা রঙয়ের পোশাকে আপাদমস্তক, চোখ বাঁধা এবং সকল অনুভূতি ইন্দ্রিয় থেকে দূরে রাখা হয়েছে।

একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে তাদের সম্মান কোথায়? লোহার খাঁচার আবদ্ধ মানুষগুলোকে দেখে কি মনে হয় ? তারা কি নূন্যতম মানবিক সম্মানটুকুও পেয়েছেন নাকি চিড়িয়াখানার পশুদের চেয়েও বাজে অবস্থায় আবদ্ধ রাখা হয়েছে তাদের? একটি চিড়িয়াখার পশুও খাঁচার ভেতর যতটুকু জায়গা পায় তাদের ভাগ্যে ততটুকুও নেই।

তাদেরকে খাঁচা থেকে বের হবার কোন সুযোগ দেয়া হয় না দিনে একটিবার ছাড়া, আর সেটি হল যখন তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্যে বের করা হয়। হাতে-পায়ে শিকল বাঁধা অবস্থায়, মাথা নিচু করে রাখা, কালো কাপড়ে মোড়ানো, তাদের আত্মসম্মানকে ধবংস করে দেয়া হচ্ছে, সব সময় তাদের মনে যে চিন্তা দানা বাঁধছে তা অনেকটা এরকম নয় কিঃ  মুসলিমদের সেই সম্মানের দিনগুলো কোথায়? বিজয়ীদের সেই দীন কোথায়? আর কোথায় তোমরা আমাদের মুসলিম ভাইয়েরা?

আমাদের ভাইয়েরা আছে কিউবার গা ঝলসানো সূর্যের নিচে, আর এটা শীতকালের অবস্থা, ভাবুন গ্রীষ্মকালে কি অবস্থায় থাকেন তাঁরা? এমনকি যে রাতকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বিশ্রাম ও ঘুমের জন্যে তৈরি করেছেন সেই রাতেও অত্যাচারী সৈনিকেরা চোখ ধাঁধানো ফ্লাস লাইটের আলো জ্বেলে রাখেন তাদের খাঁচাগুলোর দিকে। দিনে তারা উত্তপ্ত সূর্যের নিচে আর রাতে চোখ ধাঁধানো ফ্লাস লাইটের কারণে তারা দিনের পর দিন না ঘুমিয়ে থাকছেন।
তো এই অবস্থায় কিভাবে তারা ঘুমের স্বাদ পেতে পারেন, কিভাবে তারা এই যন্ত্রণাদায়ক অবস্থায় খাদ্য-পানীয়ের স্বাদ গ্রহণ করতে পারেন? বস্তুতঃ তাদের এই যন্ত্রণা দু ধরণের।
প্রথমত,
 বন্দীদশায় অত্যাচারী আমেরিকানদের হাতে পাশবিক নির্যাতন সহ্য করার কষ্ট, আর দ্বিতীয়ত,আজকে আমরা যারা মুসলমান হয়েও তাদেরকে ত্যাগ করেছি, ছেড়ে দিয়েছি আর তাদের কথা ভুলে গেছি সেই কষ্ট। কেউ নেই আজকে তাদের প্রতি যে অত্যাচার করা হচ্ছে তার বিরুদ্ধে কথা বলবার, বরং আমরা তাদের কথা ভুলে গেছি এবং এমনভাবে আমাদের দৈনন্দিন জীবন কাটাচ্ছি যেন কিছুই ঘটেনি, যেন সব কিছু ঠিকঠাক মতই চলছে।

কিভাবে আজকে মুসলমানেরা আরাম আয়েশে বিভোর থাকতে পারে?
কিভাবে আজকে আমরা পানাহারে মত্ত আছি যখন আমাদের ভাইয়েরা শত্রুদের হাতে বন্দী?
কিভাবে আজকে আমরা শান্তিতে ঘুমাই যখন আমাদের শান্তিতে রাখার জন্যে যারা উঠে দাঁড়িয়েছিলেন তাদেরকে ভোগ করতে হচ্ছে নির্ঘুম জীবন, অত্যাচারী আমেরিকানদের হাতে?

কিভাবে একজন মানুষের চোখ শুকনো থাকতে পারে যখন সে তার ভাইদেরকে এইরূপ অত্যাচার ও যন্ত্রণা ভোগ করতে দেখে ?

মুসলিমেরা কিভাবে সন্তুষ্ট থাকতে পারে নিজেদের সন্তানদেরকে কুফফার শত্রুদের হাতে তুলে দিয়ে,
তাদেরকে তারা পাঠিয়ে দিয়েছে পৃথিবীর দূরতম একটি প্রান্তে অথচ তাদের অন্তরে কোন কিছুই জাগ্রত হয় না,
কোন হাহাকার জেগে উঠে না, আমরা একটি শন্দও উচ্চারণ করতে শুনি না, একটি আর্ত চিৎকারও শুনিনি,কেন?

আমাদের রাষ্ট্রগুলো কি অবস্থানে আছে? গোত্রগুলোর অবস্থান কি? আর তাদের পরিবার আর আত্মীয়েরা?
তাদের উপর কি বাধ্যতামূলক হয়ে যায়নি কিছু একটা করার এবং তাদের পক্ষে নিজেদের অবস্থান জানান দেয়ার?

তাদের উচিত আমেরিকানদের জানিয়ে দেয়া এই বন্দীলোকেরা সারা দুনিয়া থেকে শিকড় কাটা হয়ে যায়নি, তাদের উচিত এটা জানিয়ে দেয়া যে এখনো এমন কেউ আছে যারা তাদের ব্যাপারটিতে নজর রাখছে। তাদের অবশ্যই জেনে রাখা উচিত, যে বন্দীদের বিষয়টি শেষ হয়ে যায়নি, বরং কেবল শুরু হয়েছে।

যারা মুখ বন্ধ করে আছে, তারা কেউ ক্ষমা পেতে পারে না, বিশেষত যখন আমরা দেখছি কি নির্মমভাবে দমন নীপিড়ন করা হচ্ছে সেই লোকেদের প্রতি যারা এই উম্মাহর মাথা উঁচু করার জন্যে কাজ করে যাচ্ছে, দেশে দেশে তাদের আটক, বন্দী, নির্যাতন করা হচ্ছে।

ইসলাম ও মুসলিমের তরে
সমাহিত, যারা শহীদ
আল্লাহর ‘পরে করেছে আত্ম বিক্রয়
তারাই বীর মুজাহিদ ।

ঠিকানা তাদের স্থায়ী, জান্নাতের বিশালতায়
পেয়েছেন তাঁরা, করেছেন যার পাবন্দী,
আমরা প্রতীক্ষায় তার আজও
বন্দী কারাগারে তুমি, মুসলিম কারাবন্দী।

কে তুমি আজ ভাই, বন্দী
পড়ছো এই চিঠি
আর এদিকে মুক্তির স্বাদে
জমীনে চলছি মোরা নিরবধি

হে মুসলিম ভাই, তোমার কাছে একটু সময় চাই
কারাবন্দী তুমি, তোমাকে আমার অন্তরের খবর জানাই?
অন্তরে জ্বলছে বজ্র অনল
আছে অপমান , কষ্ট অনর্গল।

হায়! জেনে রেখো তুমি, তোমার অপমান তো শুধু লোহার শিকল আর ইটের দালানে নয়! হে বন্দী ভাই আমার! তোমার সবচেয়ে বড় অপমানের কারণ আমরা, যাদেরকে পিছনে ফেলে আজ তুমি এই কারাগারে এসেছ! তুমি তো সাহায্য করেছ সেই দীনকে যা এসেছে অদৃশ্যের জ্ঞানী থেকে, আর মরতবা মর্যাদা; অবশ্যই তুমি তা অর্জন করেছ। অন্তরের অন্তস্তল থেকে আমি জানি, তুমিই সম্মানিত। আমাদের কারাবন্দীরা, আমরা তোমাদের ভুলে গেছি; না, আসলে আমরা তোমাদের পরিত্যক্ত করেছি ! এমনকি সিংহের গর্জনেও আমাদের এই ঘুম ভাঙ্গবে না, এই দুনিয়া কতকাল ধরে ঘুমিয়ে আছে আজ আর এই লোকেরা, ক্রুশ এর পূজারীরা, যেন তারাই আছে সত্য পথের উপরে! এই দৃশ্য দেখার থেকে কষ্টের আর কি হতে পারে ও আমার মুসলিম ভাইয়েরা!

হে মুসলিম উম্মাহ! নিশ্চিতভাবেই আমাদের পূর্ববর্তী সালফে সালেহীনগণ আমাদের জন্যে উদাহরণ ও অনুসরণীয় নীতি রেখে গেছেন; রেখে গেছেন কিভাবে শত্রুদের হাত থেকে মুসলিম বন্দীদের মুক্ত করতে হয় তার দৃষ্টান্ত।
যখন মানসুর বিন আবি আমির উত্তর আন্দালুসিয়ার জিহাদ থেকে ফিরে আসলেন, তিনি করডোভার একটি ফটকে একজন মুসলিম নারীর সাক্ষাত লাভ করলেন। মহিলাটি তাকে বললেন, “হায়! আমি নিশ্চিত আমার সন্তানকে খ্রিস্টানরা বন্দী হিসেবে ধরে নিয়ে গেছে- আর তুমি মুক্তিপণ দিয়ে তাকে মুক্ত করে আনো”। মানসুর শহরের ফটক থেকেই ফিরে গেলেন, করডোভাতে প্রবেশ পর্যন্ত করলেন না। বরং, তিনি মুজাহিদিনদের সাথে করে ফিরে গেলেন এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না তাকে মুক্ত করে আনতে পারলেন ততক্ষণ পর্যন্ত ফিরে এলেন না, আর এ সবই মাত্র একজন মুসলিম বন্দীকে মুক্ত করে আনার জন্যে।

আর স্মরণ করুন আন্দালুসিয়ার সেই শাসকের কথা,
তিনি আল হাকিম বিন হিশাম, যখন জানলেন একজন মুসলিম নারীকে বন্দী হিসেবে তুলে নেয়া হয়েছে তিনি শুনলেন, “ও আল হাকাম ! আমাকে উদ্ধার করো”! ঘটনাটির গুরুত্ব তাকে ভারাক্রান্ত করে ফেলল। কাজেই তিনি লোকজন জড়ো করলেন, নিজে এবং তার সৈন্যদলকে প্রস্তুত করলেন এবং ১৯৬হিজরী (৮১২ সাল) এ শত্রুদের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন। তিনি তাদের দেশে নিজের বাহিনী চালিয়ে দিলেন, একের পর এক দূর্গ জয় করলেন। তিনি সারা দেশ তছনছ করে দিলেন, সমস্ত সম্পদ আটক করলেন। যুদ্ধে শত্রুপক্ষের পুরুষেরা নিহত হলো, নারীরা যুদ্ধবন্দী হলো…আর এসব কি জন্যে? একজন মুসলিম নারীর সম্মান রক্ষার্থে। তার মুক্তি নিশ্চিত করার পরেই তিনি ফিরে এলেন করডোভাতে বিজয়ীর বেশে।
মুতাসিমের নিকট এই মর্মে আরো সংবাদ পৌঁছুল যে, উমুরিইয়াহ নামক স্থানে একজন খ্রিস্টান ব্রুট (brute) কর্তৃক একজন মুসলিমাহকে বন্দী করা হয়েছে। আরো সংবাদ এল, তাকে বন্দী করে নির্যাতন করা হচ্ছিল এবং গালে থাপ্পড় মারা হচ্ছিল, একজন গুপ্তচর খলিফা মুতাসিমের নিকট জানাল যে নির্যাতনের সময় মহিলাটি “ওহে মুতাসিম !” বলে ডাকছিল, এবং কিভাবে একজন খলিফা বর্তমান অবস্থায় শত্রুদের হাতে মুসলমান নারী নির্যাতনের শিকার হয় তা নিয়ে চিৎকার করছিল। এ ঘটনা শুনে খলিফা মুতাসিম যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হলেন, প্রমাণ করে দিলেন একজন মাত্র একজন মুসলমানের মর্যাদা কত বেশি, যাকে মুক্ত করার জন্যে তিনি নিজে সেনাদলের প্রধান হিসেবে সত্তর হাজার সৈন্যের বাহিনী নিয়ে উমুরিয়াহ নামক স্থানে পৌঁছুলেন এবং তা জয় করলেন, এরপর সেই বিধর্মী অত্যাচারী খ্রিস্টানকে খুঁজে বের করলেন, তার শিরচ্ছেদ করলেন এবং সেই সম্ভ্রান্ত মুসলিমাহ কে মুক্ত করে একজন যথাযথ শাসকের দায়িত্ব পালন করলেন।

আবু গালিব হাম্মাম বিন আল মুহাযিব আল মা’রি তার ইতিহাসগ্রন্থে উল্লেখ করছেন,
সাইফ আল দৌলা তার সমস্ত কোষাগার খালি করে অর্থ খরচ করেছেন রোমানদের হাত থেকে মুসলিম বন্দীদের মুক্তিপণ হিসেবে, আরো উল্লেখ করেছেন আবুল আব্বাস আল খুজাই, শ্যাম দেশের যিনি গভর্ণর ছিলেন তিনি তুর্কিদের থেকে মুসলিম বন্দীদের মুক্ত করার জন্যে সেই আমলে এক মিলিয়ন দিরহাম পর্যন্ত ব্যয় করেছেন !

এই ছিল সেই সব মুসলিম দেশের শাসকেরা যারা গত হয়েছেন, যখনই তারা কোন সাহায্যের আর্তচিৎকার শুনেছেন, তারা তীরের মত সেখানে সাড়া দিতে ছুটে গেছেন, সাহায্য করেছেন এবং মযলুমকে যালিমের হাত থেকে মুক্ত করেছেন। আর হ্যাঁ, এজন্যেই খলিফা উমর বিন আবদুল আযীযে (রাহিমাহুল্লাহ) এর মত মহান ব্যক্তিরা তাঁর মন্ত্রীকে এই মর্মে পত্র লিখে পাঠিয়েছিলেন যে, ‘যদি একজন মাত্র মুসলিম কারাবন্দীকে মুক্ত করার জন্যে সমগ্র ইসলামিক রাষ্ট্রের কোষাগার খালি করে দিতে হয় তবে তাই কর’।

যদি অর্থের বিনিময়ে বন্দীদের মুক্ত করা না যায়, তাহলে চূড়ান্ত সতর্কতা এবং মৌখিক হুমকির ব্যবহার করা আবশ্যক।
যখন কুতায়বা (আল্লাহ্‌ তাঁর প্রতি রহমত নাযিল করুন) সুমানের শাসকের সাথে বন্দীদের ব্যাপারে আলোচনা করছিলেন, তখন তিনি নাইজাক টারখানের নিকট মুসলিম বন্দীদের ব্যাপারে চরমপত্র প্রেরণ করেছিলেন এবং এর ভাষা ও হুমকির ধরণ দেখে শাসক নাইজাক ভীত হয়ে তৎক্ষণাৎ রাজী হয়ে গিয়েছিল এবং মুসলিম কারাবন্দীদের মুক্ত করে দিয়েছিল।

জনসাধারণের মাঝে মুসলিম যুদ্ধবন্দী ও কারাবন্দীদের মুক্ত করার ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টিতে আলেমগণ সর্বদাই সচেষ্ট ভূমিকা পালন করেছেন, এটা তারা করেছেন নিজেদের দেশের মুসলিম শাসকের নিকট চরমপত্র প্রেরণ করে কিংবা শত্রুদেশের শাসকের সাথে সাক্ষাত করে কিংবা কমপক্ষে তাঁরা আল্লাহ্‌র দরবারে দুয়া মোনাজাত করে হলেও চেষ্টা করেছেন যেন মুসলিম যুদ্ধবন্দীদের মুক্ত করে দেয়া হয়। আমরা জানি, ইবন তাইমিয়া ‘বুলাই’ এর সাথে সাক্ষাতের জন্যে গিয়েছিলেন, সে ছিল একজন মঙ্গোলীয় জেনারেল এবং ইবনে তাইমিয়ার দাবীর প্রেক্ষিতে সে সময় মঙ্গোলদের হাত থেকে অনেক মুসলিম যুদ্ধবন্দীদের মুক্ত করা সম্ভবপর হয়েছিল।

ইবন তাইমিয়া সাইপ্রাসের সম্রাটের নিকট নিম্নলিখিত পত্রটি প্রেরণ করেনঃ

“হে সম্রাট! এটা কেমন কাজ হল, তুমি রক্তপাতের অনুমতি দিচ্ছ, মহিলাদের বন্দীনি হিসেবে ধরে নিয়ে যাচ্ছ, মানুষের সম্পদ দখল করছ অথচ তুমি কিনা আল্লাহ্‌ এবং তাঁর রাসূলের পক্ষ হতে কোন অনুমতি বা বৈধতা দিলে না? আমরা কি ধরে নিব যে সম্রাট জানে না এই আমাদের দেশে অগণিত খ্রিস্টানেরা শান্তি এবং নিরাপত্তার সাথে বাস করে আসছে? তাদের সাথে আমাদের আচরণের স্বরূপ সবাই জানে। তাহলে এটা কেমন ঘটনা হল যে তুমি আমাদের বন্দীদের সাথে এমন আচরণ করছ যে একজন নীতিবোধ সম্পন্ন মানুষ, বিবেকমান মানুষ কিংবা একজন ধার্মিক লোকও কিছুতেই সন্তুষ্ট হতে পারছে না!!?

বরং, অনেকের প্রতিই অত্যচার নির্যাতন চালানো হচ্ছে বন্দী অবস্থায়, অথচ বন্দীদের নির্যাতন সকল ধর্মে, আইনে রাজনীতিতে নিষিদ্ধ। কিভাবে তুমি সেই সকল লোকদের আটক করে রেখেছে যাদের নির্যাতন করার জন্যে বন্দী হিসেবে তুমি ধরে নিয়ে গেছ? কেবল অত্যাচার চালানোর জন্যে? তুমি কি মনে করেছ তুমি এতকিছুর পরে নিরাপদে থাকবে, এতকিছুর পরে যখন তুমি মুসলিমদের মুখোমুখি হবে, যে অত্যাচার তুমি চালাচ্ছো এরপরে কি পরিণতি হবে তোমার তা কি ভেবে দেখেছ?

আল্লাহ্‌ তাদের সহায়তা করবেন এবং তাদের বিজয় দান করবেন, বিশেষত এটা এমন এক সময় যখন মুসলিম জাতি নিজেদের সম্মানার্থে জেগে উঠছে এবং সামনের লড়াইয়ের জন্যে প্রস্তুত হয়েছে। ন্যায়সংগত লোকেরা এবং সর্বশক্তিমানের সহযোগীরা তাঁর আদেশ মেনে তোমাদের এই আচরণে তীক্ষ্ণ নজর রেখে চলছে। উপকূলবর্তী ঘাঁটিগুলোতে পুরুষ লোকের সমাবেশ ঘটছে, সাহসী এবং বীর পুরুষেরা, তারা যোদ্ধা এবং তাদের সক্ষমতা আমরা দেখেছি এবং তার কারণে তাদের মর্যাদাও উত্তোরত্তর বেড়ে চলছে।

আরও আছে, তোমার অবগতির জন্যে জানাই, এখানে নিয়োজিত আছে এমন সকল লোক যারা তাদের দীনের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ ও নিষ্ঠাবান। সেখানে নিয়োজিত নতুন এবং পুরাতন সকল লোকের সক্ষমতার কথাই তোমার জানা উচিত।

তাদের মাঝে আছেন এমন সকল ন্যায়পরায়ণ মানুষ যাদের প্রার্থনা আল্লাহ্‌ ফিরিয়ে দেন না , আর তাদের চাহিদার কথাও তিনি অবজ্ঞা করেন না। হ্যাঁ, এরাই হচ্ছেন এমন লোক যারা খুশি হলে আল্লাহও খুশি থাকেন আর তারা অসন্তুষ্ট হলে আল্লাহও অসন্তুষ্ট হন।

হে সম্রাট, জেনে রেখ সে সকল মুসলিম সীমান্তের কথা যা তোমার রাজ্যের নানাদিকে বেষ্টন করে আছে, কি কল্যাণ আর মঙ্গলের আশা তুমি করতে পার যখন কিনা আমাদের সাথে তোমাদের আচরণে কোন সুস্থ মস্তিষ্কের কেউ সন্তুষ্ট নয় এবং জানি না আর কোন মুসলিম কিংবা আমাদের মুসলিমদের সাথে যারা শান্তি চুক্তি করেছে তারা এতে তোমাদের সাথে আপোস করতে রাজি হবে কি না ?”

আবু সাঈদ আল থা’লাবী বর্ণনা করেন, যখন বিখ্যাত আব্বাসীয় খলীফা আবু জাফর আল মানসুরের বিরুদ্ধে ইব্রাহীম এবং মুহাম্মদ বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন, খলিফা চেয়েছিল যেন সীমান্তবর্তী সৈনিকেরা বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে তাকে সাহায্য করে। এরপর, তারা তা প্রত্যাখান করল এবং তাদের অনেকেই রোমানদের হাতে বন্দী হল, তখন রোমানরা বন্দীদের বিনিময়ে মুক্তিপণ দাবীকরে বসল। কিন্তু খলীফা তাদের মুক্তিপণ দিতে অস্বীকার করলেন।

এহেন অবস্থায়, ইমান আল আউযাই (রাহিমাহুল্লাহ) খলীফার নিকট চরমপত্র লিখে পাঠালেন,

“নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ মহাপবিত্র, মহামহিম তোমাকে উম্মাহর ভালোমন্দ দেখভালের জন্যে ক্ষমতা দান করেছেন, নির্বাচিত করেছেন- এ কারণে এটা আশা করা হয় যে, তুমি ন্যায়নিষ্ঠার সাথে তোমার দায়িত্ব পালন করবে এবং অনুসরণ করবে তাঁর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নির্দেশনা, লোকেদের সাথে বিনম্র আচরণ করবে এবং বিনয়ের সাথে অবনত হবে। আমি আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার নিকট এ মর্মে আবেদন পেশ করছি যেন তিনি আমীরুল মুমিনিনকে শান্ত করেন এবং উম্মাহর জনসাধারণের ব্যাপারে সদয় হবেন এবং তাদেরকে বিজয় দান করবেন।

কার্যতই প্রথম বর্ষে মুসলিমদের বিরুদ্ধে মুশরিকদের আক্রমণ সফল হয়েছে এবং মুসলিমদের সীমানার ভিতরে তারা অনুপ্রবেশ করতে পেরেছে-তারা মুসলিম নারীদের নিকট পৌঁছে গেছে এবং শিশু ও বৃদ্ধদেরকে দূর্গ হতে বের করে দিয়েছে। এ সবই ঘটেছে মুসলিমদের পাপের কারণে, যদিও যে অপরাধ আল্লাহ্‌ ক্ষমা করে দিয়েছিলেন তা আরও বৃহৎ ছিল। এটা ছিল মুসলমানদের অপরাধ যে তাদের শিশু ও বৃদ্ধদের দূর্গ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে- তারা কোন সাহায্যকারী পায়নি কিংবা তাদের রক্ষার্থেও কেউ এগিয়ে আসেনি। নারীদের টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তাদের মাথা আর পা অনাবৃত ছিল, আল্লাহ্‌ দেখলেন কিভাবে আমরা তাঁর থেকে সরে গিয়েছিলাম।

তাই বিশ্বাসীদের নেতার জন্য মানানসই আচরণ হল যে তিনি আল্লাহকে ভয় করবেন এবং আল্লাহ্‌র নির্দেশিত পথের অনুসরণ করবেন মুক্তিপণ প্রদানের মাধ্যমে বন্দীদের মুক্ত করার দ্বারা। এই নির্যাতিত লোকদেরকে তিনি আল্লাহ্‌র ভালোবাসার কসম করে মুসলিম উম্মাহ থেকে আলাদা করে রাখতে পারেন না, আল্লাহ্‌ বলেন, “আর তোমাদের কি হল যে, তেমারা আল্লাহর রাহে লড়াই করছ না দুর্বল সেই পুরুষ, নারী ও শিশুদের পক্ষে, যারা বলে, হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদিগকে এই জনপদ থেকে নিষ্কৃতি দান কর; এখানকার অধিবাসীরা যে, অত্যাচারী! আর তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য পক্ষালম্বনকারী নির্ধারণ করে দাও এবং তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য সাহায্যকারী নির্ধারণ করে দাও”। [নিসা ৭৫]

আমি আল্লাহ্‌র কসম করে বলছি, হে আমিরুল মুমিনিন, বন্দীদের কাছে না আছে কোন জমাকৃত মাল (গণীমত) না আছে কর দেয়ার মত কোন সম্পত্তি-কেবল তাদের নিত্য ব্যবহার্য সম্পদ ছাড়া। নিশ্চয়ই, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যখন আমি (জামাতে ইমামতি) সালাতরত অবস্থায় আমার পিছনে কোন শিশুর কান্না শুনি তখন আমার সালাতের দৈর্ঘ্য সংক্ষিপ্ত করি, কারণ শিশুর কান্নার ফলে মায়ের মনে কষ্ট হয়
কাজেই কিভাবে তাদেরকে আপনি শত্রুদের হাতে ছেড়ে দিতে পারেন হে আমিরুল মুমিনিন? তাদের উপর ফিতনা পতিত হয়েছে, তাদের দেহগুলো এভাবে উন্মুক্ত করে রাখা আছে যার কোন অনুমতি নেই কেবলমাত্র বিবাহিত নারী-পুরুষের মধ্যেকার আন্তরিক অবস্থা ছাড়া, আর এরাই তো দুনিয়াতে আল্লাহ্‌র প্রতিনিধি। আপনার উপরে আছেন আল্লাহ্‌, তিনি আপনাকে যে দায়িত্ব অর্পণ করেছেন শেষ বিচারের দিনে তার পূর্ণ হিসাব নিবেন- যেদিন কারো প্রতি অত্যাচার করা হবে না, যদিও একটি সরিষা দানা পরিমান কাজও হয়। তাঁর সিদ্ধান্তই আমাদের জন্য যথেষ্ট

যখন পত্রটি আবু জাফরের নিকট পৌঁছুল, তিনি আদেশ করলেন মুসলিমদের মুক্ত করার জন্যে মুক্তিপণ প্রদান করতে।

সম্মানিত উলামায়ে কেরাম এই নির্যাতিত লোকদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন সর্বদাই, তারা আপনজন হারানো মায়ের হাহাকার কিংবা একজন পিতার বুকের শূন্যতা ও আর্তনাদ ঠিকই অনুভব করতেন আর একারণেই তাঁরা তাদের দুয়ায় মুসলিম বন্দীদের কথা স্মরণ করতেন।
ইবন কাসীর রাহিমাহুল্লাহ উল্লেখ করেছেন, একজন মহিলা এসে ইমাম বাকি বিন মুকাল্লাদ রাহিমাহুল্লাহ’র নিকট পেশ করলেন,
“নিশ্চয়ই আমার সন্তানকে ফ্রাঙ্কের লোকজনেরা ধরে নিয়ে গেছে এবং আমি সন্তান হারানোর ব্যথায় রাতে ঘুমাতে পারি না। আমার একটি সামান্য বাড়ী আছে যা আমি আমার সন্তানের মুক্তিপণ হিসেবে বিক্রি করে দিতে চাই, আপনি কি আমাকে এমন কোন ক্রেতার সন্ধান দিতে পারেন যিনি আমার এই বাড়িটি ক্রয় করবেন আর আমি সেই টাকা দিয়ে আমার সন্তানকে মুক্ত করাতে পারি? আর আমার অবস্থা তো এমন যে, আমার নিজের দিন আর রাত একাকার হয়ে গেছে, চোখে ঘুম নাই, মনে শান্তি নেই, নেই কোন বিশ্রাম”। (আর এ অবস্থা কি আজকের মায়েদেরও নয়?-কিভাবে তারা ঘুমাতে পারেন যখন তারা জানেন তাদের প্রিয় সন্তানেরা বন্দী হয়ে আছে শত্রুদের হাতে- আল্লাহ্‌র নিকটই তারা ফরিয়াদ পেশ করে যাচ্ছেন)

এভাবে ইমাম বাকি বললেন, “ আচ্ছা, তুমি এখন যাও, আমি দেখছি আল্লাহর অনুমতিতে আমি এই ব্যাপারে কি করতে পারি ”। তিনি তাঁর মাথা অবনত করলেন, আল্লাহর কাছে দুয়া করলেন যেন তিনি সেই মহিলার সন্তানকে ফ্রাঙ্ক এর কবল থেকে মুক্ত করে দেন। এরপর বেশিদিনের কথা নয়, যখন সেই মহিলাটি আবার আলেমের কাছে এলেন, এবার সাথে এলেন তার সন্তান ! তার সন্তান মুক্তি লাভ করেছে ! মহিলাটি বললেন, “এর আজব ঘটনাটি শুনুন, আল্লাহ যেন তার উপর দয়া করেন”।
বালকটি বলল, “আমি ছিলাম তাদের মধ্যে একজন যারা রাজার খেদমত করত-আমাকে সর্বদাই শিকলে বেঁধে রাখা হত, একদিন যখন আমি হাঁটছিলাম, আমার পায়ে জড়ানো শিকল ছিঁড়ে গেল। কাজেই আমার পাহারাদার এসে আমাকে গালাগালি করল এবং প্রশ্ন করল, ‘তুমি কেন তোমার পায়ের শিকল ভেঙ্গেছ?”আমি বললাম, ‘না, আমি আল্লাহ্‌র শপথ করে বলছি, আমি তো এটা স্পর্শও করিনি। এটা এমনিতেই খুলে গেছে, আমি টের পাইনি’। কাজেই সে কামারকে ডেকে পাঠাল, সে আবার আমার পায়ে শিকল জড়িয়ে দিল, স্ক্রুগুলো শক্ত করে বেঁধে দিল। যখন আমি উঠে দাঁড়ালাম তখন আবার আমার পায়ের শিকল ভেঙ্গে গেল, এটা দেখে সে আবার শিকল শক্ত করে বেঁধে দিল, আবার আরো ভালোভাবে কিন্তু এবারেও এটা খুলে গেল। তাই দেখে তারা তাদের পুরোহিতের কাজে এ বিষয়ে জানতে চাইল, সে বলল, ‘বালকটির কি মা জীবিত আছে?’ আমি বলেছিলাম, ‘হ্যাঁ’। তারা বলল, ‘নিশ্চয়ই তোমার মা তোমার জন্যে প্রার্থনা করেছে আর তা কবুল হয়েছে। তাকে ছেড়ে দাও’। তাই তারা আমাকে ছেড়ে দিল এবং ইসলামিক রাজ্যে প্রবেশ পর্যন্ত আমাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে এল”।

বাকি বিন মুকাল্লাদ আরও জানতে চাইলেন বালকটির কাছে ঠিক কখন তার পায়ের শিকল ছিঁড়ে যাবার এই ঘটনাটি ঘটছিল এবং অবাক হয়ে গেলেন, এটা ছিল সেই সময় যখন তিনি বন্দীদের মুক্তির জন্যে মুনাজাত করেছিলেন।

আজকের মুসলিম উলামারা কি সেই অনন্য পথ অনুসরণ করছেন এবং তাদের ভূমিকা পালন করছেন বন্দীদের মুক্ত করার ব্যাপারে শত্রুদের হাত থেকে? যারা দায়িত্বশীল তাদেরকে কি আজকের উলামারা উপদেশ দিচ্ছেন ? তাদের কি উৎসাহিত করছেন যেন তারা বিষয়টী সত্যিকারের গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করেন? হে আল্লাহ্‌ !

আমি কি আমার বার্তা পৌঁছাতে পেরেছি? হে আল্লাহ্‌ আপনি সাক্ষী থাকুন ! আল্লাহ্‌ আমাকে এবং আপনাকে এই বরকতময় কুর’আন দ্বারা উপকৃত করুন।

খুতবার দ্বিতীয় অংশঃ
হে উম্মতে ইসলাম ! এটি হচ্ছে তেমনি একটি চিঠি তাদের প্রতি যারা প্রত্যেকে দায়ী, যারা প্রত্যেকে নীরব রয়েছে, প্রত্যেক আলেম, প্রত্যেক মুসলমানের কাছে…নারী কিংবা পুরুষ……ও মুসলমানেরা !

হে আল্লাহ ! তোমার কাছে আমি অভিযোগ জানাই আমার অসহায়ত্বের ব্যাপারে, আমার কাজের দুর্বলতার কারণে, আর মানুষের সামনে আমার মর্যাদাহানির বিষয়ে। তুমিই তো তাদের রব, যারা মযলুম ! তুমিই আমার মালিক ! সে যেই হোক না কেন, যার উপরে আমাকে তুমি ন্যস্ত করেছ, সে যেখানেই থাকুক না কেন, যত দূরের কোন দেশেই থাকুক না কেন, আমি পরোয়া করি না, তার ভয় আমি করি না,আমার শত্রু উপর ভ্রু কুঁচকে আছে না আমার উপরে এমন কাউকে দায়িত্ব দিয়ে দিয়েছে যে আমার শত্রু, আমি এসব পরোয়া করি না, যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি আমার উপর সন্তুষ্ট, সেটাই আমার জন্যে যথেষ্ট”।

“ নিশ্চয়ই আমি পরীক্ষার সময় পার করছি। অসুস্থতা আমাকে আক্রান্ত করেছে আর ক্লান্তি আমাকে বিধ্বস্ত করেছে। সারা দিন গনগনে সূর্য আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে সন্ধ্যা পর্যন্ত, সাথে আছে আটককারীদের কর্কশ আচরণ। প্রতিবার আমি আমার খাঁচায় প্রবেশ করি কিংবা বের হই, আমার হাতে পায়ে শিকল জড়ানো থাকে। মনে হয় যেন, ভারী লোহার শিকলগুলোর ওজন আমার ওজনের চেয়ে বেশি, ফুটন্ত পানির মতো শত্রুদের সাথে আটক থাকার চেয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা আর কি হতে পারে? এর থেকে আর অপমানের কি আছে হে মুসলিম ভাইয়েরা আমার, লুটেরা আমেরিকানদের সামনে আমাকে মাথা নোয়াতে বাধ্য করা হচ্ছে, অপমানিত করা হচ্ছে। যাই হোক, আমি আমার সব আকুতি পেশ করি মহান আল্লাহর দরবারে,

তোমার ক্ষমা আমার জন্যে যথেষ্ট হে রব, আমি তোমার কাছে সেই নূর এর মাধ্যমে আশ্রয় চাই যা অন্ধকার দূর করে দেয়, যার মাধ্যমে এই দুনিয়া ও আখেরাতের যাবতীয় কাজকে তুমি ভারসাম্য দান করেছ। আমি যেন কখনো তোমার অসন্তুষ্টি জাগানো কোন কাজ না করি। আর নিশ্চয়ই তুমি ছাড়া আর কারও কোন ক্ষমতা বা শক্তি নেই, তোমাকে ছাড়া আর কারও কাছে কোন আশ্রয়ও নেই ।

আজকে যিনি আমাদের এই চিঠি পড়ছেন, আমার কষ্ট,অবসাদ,দুঃখ কিছুই না
আমার মাথায় যা হচ্ছে তা যদি আপনারা জানতেন ! যখন চিন্তা করি যে মুসলিম উম্মাহর জন্যে কাজ করে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে আজকে আমাদের এই অবস্থা আর আপনারা সবাই আমাদের কথা ভুলে গেছেন তখন আমাদের শারীরিক কষ্ট মানসিক কষ্টের তুলনায় তুচ্ছ হয়ে যায়। কিভাবে সবাই আমাদের কথা ভুলে গেলেন !

কিভাবে আমাদের ইস্যু হয়ে গেল গুরুত্বহীন, কিভাবে আমাদের ব্যাপারে কোন সচেতনতা গণ জাগরণের প্রয়োজনীয়তা কেউ অনুভব করলো না … যেন আমরা ভিন্ন গ্রহের প্রাণী…কিংবা যেন আমরা মুসলিম নই ! এর চেয়ে লজ্জাজনক, মাথা হেট হতে আসার মতন ঘটনা কি আদৌ হতে পারে?? আজকে পশ্চিমা মানবাধিকার সংস্থাগুলো পর্যন্ত আমাদের পক্ষে কথা বলছে, নির্যাতন বন্ধের কথা বলছে, কারাগারগুলো উন্মুক্ত করে দেয়ার দাবী জানাচ্ছে আর আমাদের মুসলিমরা কাপুরুষ, নপুংসক হয়ে আমাদের ভুলে গেছে ! 

কিভাবে অস্ট্রেলিয়া-আমেরিকান সম্পর্কে টানাপড়েন সৃষ্টি হল কারাবন্দী নিয়ে, কিংবা দেখুন কিভাবে কয়েকজন ব্রিটিশ বন্দীর জন্যে এংলো-আমেরিকান সম্পর্কেও ভাটা সৃষ্টি হল, হায় ! আমাদের জন্যে কেউ নেই, অথচ আমাদের সংখ্যা ছয় শত জন। বরং, যদি এমন হত যে আমেরিকানরা আমাদের জাতীয়তা ঘোষনা না করত, আরব দেশগুলো আমাদের উপেক্ষা করেই যেত, আমাদের অস্তিত্ব কিংবা জাতীয়তা পর্যন্ত অস্বীকার করত।

হ্যাঁ, আপনাকেই বলা হচ্ছে যিনি এই লেখাটি পড়ছেন, …আমরা কারাবন্দী…আমরা আপনাদের সবাইকে শেষ বিচারের দিনে আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সামনে দাঁড় করাবো…আমরা বলব, ‘এই লোকগুলো, এরা জানত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কারাবন্দীদের মুক্ত করার ব্যাপারে কি আদেশ করে গেছেন, এরা সেই আদেশ শুনেনি কিংবা আমাদের মুক্ত করার জন্যে যা করণীয় ছিল তাও গ্রহণ করেনি’

নিশ্চয়ই আমরা এর মাধ্যমে সেই সব লোকদের সবাইকে আহবান জানাই যারা তাদের দীন নিয়ে গর্বিত, আমরা আপনাকে ঈমানের বন্ধনের কারণে ডাক দিচ্ছি, যাতে আপনারা আমাদের এই ইস্যুটিকে জীবন্ত আলোচিত করে তুলেন। আইনজীবীদের মাধ্যমে আমাদের মুক্তির দাবী জানিয়ে, আমাদের করুণ অবস্থার কথা মিডিয়ায় প্রকাশ করে, আমেরিকার উপর চাপ প্রয়োগ করে, তাকে এভাবে সতর্ক করে দিয়ে যে, তারা যদি মুসলিম কারাবন্দীদের ছেড়ে না দেয় তাহলে তাদের স্বার্থে আঘাত আসবে। আর যদি আপনি নিজেকে এমন অসহায় মনে করেন যে, আপনার কিছুই করার নেই, তাহলে আপনার উচিত অন্তত দুই হাত তুলে আল্লাহর কাছে কাতর কন্ঠে দুয়া করা, এই যালিমদের বিপক্ষে, মযলুমদের পক্ষে আপনি রাতের শেষ ভাগে দুয়া করুন, আল্লাহর কাছে দুয়া করুন যেন তিনি আমাদেরকে কষ্ট যন্ত্রণা থেকে মুক্ত করে দেন, যেন আমাদের বোঝা অপসারণ করে দেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,‘যে একজন মুসলিমকে সাহায্য করতে সক্ষম হওয়ার পরেও তাকে পরিত্যাগ করে, এরপর এমন এক সময় আসবে যখন সেই সক্ষম ব্যক্তি আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইবে, আর আল্লাহও তাকে পরিত্যাগ করবেন”। তিনি আরও বলেন, “ যদি কেউ কোন মুসলিমের একটি কষ্ট দূর করে দেয়, শেষ বিচারের দিনে আল্লাহও তার একটি কষ্ট দূর করে দিবেন”।

হতে পারে আজকে তোমরা আমাদের ভুলে গেছ- কিন্তু অনুরোধ তোমাদের কাছে, আমাদের স্ত্রী-সন্তানদেরকে ভুলে যেও না, তাদের দেখাশোনা কর, নিরাপত্তা দিও, আর আমরা যেন দৃঢ়পদ থাকতে পারি সেই জন্যে দুয়া করো, আমরা আমদের অভিযোগ তো কেবল আল্লাহ্‌র কাছেই পেশ করি। আর শেষ কথা বলতে চাই, আমাদের প্রাণপ্রিয় আম্মা ও আব্বাদের জন্য, সবর করুন, আল্লাহ্‌র নিকট হতে পুরষ্কার তালাশ করুন এবং বলুন, “আল্লাহ্‌ ছাড়া আর কোন শক্তি বা ক্ষমতা নেই”, ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’, যেভাবে আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন।

আউফ বিন মালিক আল আশজাই এসেছিলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালামের কাছে এবং বললেন, “হে আল্লাহ্‌র রাসূল ! শত্রুরা আমার সন্তানকে ধরে নিয়ে গেছে এবং তার মাতা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। আপনি এ অবস্থায় আমার জন্যে কি উপদেশ দিবেন?’ তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমি তোমাকে আর তোমার স্ত্রীকে একটি বাক্য বলার উপদেশ দিচ্ছি, তোমরা যত পার তত বেশি করে পড়বে, লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ মহিলা একথা শুনে তাঁর স্বামীকে বললেন, “কি বরকতময় একটি বাক্য তিনি আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন !’ আর তারা এই বাক্যটি পুনঃপুন পড়তে লাগলেন যে পর্যন্ত না শত্রুরা তার সন্তানের দিকে একসময় বেখেয়াল হয়ে পড়ল এবং তাদের সন্তান সেখান থেকে পালিয়ে আসতে পারল, সে সাথে করে চার হাজার ভেড়ার পাল নিয়ে আসল, এরপর সে তার পিতাকে তা উপহার দিল। এরপরেই কুর’আনের সেই আয়াতটি নাযিল হয়েছিল যেখানে আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলছেন, আর যে আল্লাহকে ভয় করেআল্লাহ তার জন্যে নিস্কৃতির পথ করে দেবেন। এবং তাকে তার ধারণাতীত জায়গা থেকে রিযিক দেবেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে তার জন্যে তিনিই যথেষ্ট। আল্লাহ তার কাজ পূর্ণ করবেন। আল্লাহ সবকিছুর জন্যে একটি পরিমাণ স্থির করে রেখেছেন [সূরা তালাক :২-৩]

চূড়ান্ত কথা বলছি, আমাদের দুরাবস্থা ভুলে যাবেন না।
আমরা কারাবন্দী—আমরা আপনাদের সন্তান কিউবাতে, আমাদের কষ্ট ভুলে যাবেন না…আমাদের কষ্টের কথা ভুলে যাবেন না…

হে মুসলমানেরা,
এই চিঠিগুলো দিয়ে আমি সবার প্রথমে আলেমদেরকে সম্বোধন করছি…হ্যাঁ, সেই আলেমগণ যারা নবীদের উত্তরাধিকারী। তাদের কাঁধে যে দায়িত্ব তা অন্য কারো প্রতি নেই। আপনারা দেখেছেন আমাদের পূর্বসূরীরা কারাবন্দীদের মুক্ত করার জন্যে কি না করেছেন, আমরা দেখেছি তারা এই দাবী দাওয়াহ নিয়ে কত কষ্ট করেছেন। আপনারা দেখেছেন শায়খুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া কি করেছিলেন, দেখেছেন ইমাম আল আয-যাওয়ী কি করেছেন এবং তাদের পথে আরও কত জন ছিলেন।

আপনি কি দায়িত্ব পালন করছেন কারাবন্দীদের ইস্যুটিকে নিয়ে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সাথে কি যোগাযোগ করেছেন?
তাদের মুক্ত করার কথা যদি না বলতে পারেন অন্তত তাদের সাথে যে অমানবিক আচরণ করা হচ্ছে তা বন্ধ করার ব্যাপারেও কি আপনারা কথা বলতে পারেন না ? মিডিয়াতে কথা বলে, মানুষের মাঝে আলোচনা বক্তব্য দিয়ে কি আপনারা সাধারণ মানুষের মাঝে সাবধান করে দিতে পারেন না, তাদের জানিয়ে দিন কারাবন্দী মুসলিম ভাইদের কথা ভুলে গিয়ে তারা কিভাবে নিজেদের উপর বিপদ ডেকে আনছে।

তাই আল্লাহকে ভয় করুন, হে উলামায়ে ইসলাম, শ্রেষ্ঠ উত্তরাধিকারীদের ন্যায় আচরণ করুন যাতে পূর্ববর্তী যমানার শেষ্ঠ উলামাদের মাঝে শামিল হতে পারেন।

দ্বিতীয় পত্রটি কারাবন্দীদের পরিবারের প্রতি, সেই সকল বীর নায়কদের পরিবারের প্রতি, তাদের প্রতি যাদের কারণে আমরা মাথা উঁচু করে আছি…আপনারা স্মরণ করবেন আপনাদের সন্তানেরা জেল খাটছে কোন নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে নয়, কোন অপরাধের কারণেও নয় যে কারণে মানুষের কাছে আপনাদের মাথা নিচু হয়ে যাবে। বরং, সারা দুনিয়ার মানুষ আপনাদের সন্তানদের নিয়ে গর্ব করে, তাদেরকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে কারণ তারা দীনের শীর্ষচূড়ায় অবস্থান করছিল, মুসলমানদের ইজ্জত সম্মান রক্ষা করা’ এটাই ছিল তাদের অপরাধ। তাদের মর্যাদার কারণে আপনাদের আনন্দিত হওয়া উচিত, সম্মানিত বোধ করা উচিত, আপনাদের নয়ন জুড়িয়ে যাক মুবারকবাদ আপনাদের প্রতি যারা এই সকল নায়কদের পরিবারের সদস্য।

আর তৃতীয় পত্রটি আমাদের ভাইদের জন্য…আমাদের প্রিয় বন্ধুদের জন্য…যাদের সাথে আমরা আমাদের দুঃখ ভাগ করি যাদের সহানুভূতি আমরা অনুভব করি…সেই ভাইয়েরা যারা বন্দী আছেন…হে ইসলামের নায়কেরা…সবর, দৃঢ়তা ও একাগ্রতা ! হে তুমি যে অপমানের সময়েও মর্যাদাও শির উঁচু করে আছ, তোমার তরে আমি কিছু কবিতার বাণী শোনাচ্ছি, যেন তোমার চেতনা জাগ্রত থাকে,

হে বীরেরা,
আমার প্রিয় ভাইয়েরা, তোমাদের যারা আফগানিস্তানে কিংবা পাকিস্তান থেকে ধরে নিয়ে কিউবাতে প্রেরণ করা হয়েছে, তোমাদের সবার প্রতি, আমি এই কথাগুলো নিবেদন করছি ; আর আল্লাহ্‌র সাথে যে সৎ থাকে, তার মতামতকে আল্লাহ্‌ ভুল পথে চালিত করেন না !!

( এক কারাবন্দী ভাই এর পত্র থেকে)
আমি বেঁচে থাকব সম্মানের সাথে, আমার সাথীদের মাঝে

আর এতে চিরদিন জ্বলতে থাকবে মুনাফিকদের অন্তর
এই যাত্রা আমার চলতে থাকবে এক চির গৌরবের দিকে

আমার শত্রুরা নিক না কেটে আমার হাত কিংবা পা

শাহাদাতের দিকে অটল চালু থাকব আমি।

কারণ আমি ও মৃত্যু একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করি
আর আমার মৃত্যুতেও জানি, শেষ হবেনা কুফরের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ
তো কি হয়েছে? আফসোস নেই কারণ
জানি এই দীন আল্লাহর, সুরক্ষিত ও চিরস্থায়ী।

কাজেই যারা আমার পরিচিত, ভাই
আফসোস করো না, দৃঢ়তা চাই
একথা বলোনা, বলোনা তুমি,
“কেন তুমি নিজেকে ঠেলে দিলে বন্দীত্বের এর দিকে?”

কারণ আমি একজন মুমিন, আমি উচ্চভিলাষী

আর এই অপমান বা অত্যাচার আমাকে দমাতে পারবে না
কারণ, আমার চূড়ান্ত লক্ষ্য আমার রবকে সন্তুষ্ট করা

আর সফলতা অর্জন করা আমার সর্বোচ্চ লক্ষ্য

আমার সর্বোচ্চ ইচ্ছা, অসীমের পথে যাত্রা।
কারণ আমি ব্যাকুল সেই কুমারী জান্নাতের জন্য।
হে আমার পিতা, যদি তুমি আমার সেই অবস্থা দেখতে
তারা আমার কাঁধে শিকল পড়িয়ে রেখেছে
আমার হাতকে তারা বেঁধে দিয়েছে ইস্পাতের যুলুম দিয়ে
আমার মাথাকে তারা নুইয়ে দিয়েছে অক্ষমের মত
বিনা অপরাধে ছিনিয়ে নিয়েছে আমার পোশাক, করেছে বিবস্ত্র
আমার দিকে কুচকাওয়াজ করতে করতে এসেছে আমার চোখে অশ্রু দেখতে
আর আমার উপরে অত্যাচারের চাবুকে করেছে ক্ষত
যেন আমি এক শিকারী জন্তুর পায়ের নিচে দলিত শিকার।

আমাকে দেখছো তুমি, দেখলে শুধু আমার চেহারার রক্ত?
দেখনি দক্ষ রাজনীতিকের হাতে আমারই রক্তের দাগ?

তাই বলছি, হে আমার পিতা, লা তাহযান, দুঃখ করবেন না
কারণ আমি আশ্রয় চাই আমার রবের, তাঁরই কাছে আমার শেষ
আরে এই শত্রুরা আমার কিইবা করতে পারে?
কারণ আল্লাহ নিজেই ইসলামের রক্ষাকর্তা
তাই যদি চায় তারা ঝরাতে আমার রক্ত
ঝরুক না প্রতিদিন!

হয়তো বা তারা গড়ে তুলেছে এক বাধার প্রাচীর
আমার এবং আমার ভাইদের মাঝে ।
হয়তো বা তারা আমার এই জীবনকে জাহান্নামে পরিণত করেছে
সারা দুনিয়া অন্ধকার হয়ে এল, যেন চিরকালের এই অন্ধকার
এমনকি যেন তারা আমাকে শ্বাসরোধ করে রেখেছে, দম নিতে দিতেও তারা চায় না
যেন তারা আমার রগে শিরায় দড়ি লটকিয়ে দিয়েছে
যেন তারা গলিত তামায় আমাকে ফেলতে চায়
অথচ জানে কি তারা?
এগুলো আমার দেহে, আমার চামড়ার শীতলতা ছড়ায়
এরা কখনো আমার কাছে পৌঁছতে পারবে না, হে পিতা!

আমার অন্তরে, তারা কখনো পারবে না পোঁছতে
তারা কখনো পারবে না নুইয়ে দিতে আমার উদ্দেশ্যকে
আমি থাকব চির বিজয়ী, কারণ আমার সহায় আমার এই কিতাব
আর শ্রেষ্ঠ নবীর কথা, সেখানেই আছে আমার যত অনুপ্রেরণা
আমি রইব চির দুর্ভেদ্য দুর্গের মত, হে আমার পিতা!

আমি রইব চির উন্নত, গৌরবের আকাশে উন্নত
আর ফিরিয়ে আনব সেই হারানো দিন,
সালাহউদ্দীনের ন্যায় অবশিষ্ট সিংহদের স্মৃতিতো আজও অমলিন

আসিতেছে সেই দিন, আশু অনুভব তাদের চির দুর্দশার

যারা অত্যাচারী ও প্রধান মুনাফিকদের
দুনিয়া কামনার রিপু তাদের চিন্তামুক্ত করে রেখেছে
অথচ তাদের কেউ জ্বলবে আগুনে
কিন্তু আমি বাঁচি চির বিশুদ্ধ চিত্তে
স্বাদ পাই, সম্মানের,
স্বাদ পাই চির প্রতীক্ষিত মৃত্যুর
মৃত্যুর স্বাদে চরম পুলকিত হই আমি।

হে মুসলিমেরা ! এই দীর্ঘ আলোচনার পরে, আমি আমাদের বক্তব্যকে কিছু পয়েন্টে তুলে ধরতে চাই এবং এই উপদেশ দিতে চাই যে,

১। মিডিয়াতে কারাবন্দীদের নির্যাতনের ঘটনা প্রচার করতে থাকুন, এর উপর প্রয়োজনীয় আলোকপাত করুন এবং মুসলমানদের প্রতি আমেরিকান রাজনীতির চিত্র তুলে ধরুন।
২। মানবাধিকার সংলগ্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলোর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করুন, যেন তারা কারাগারের অত্যাচারের মাত্রা হ্রাস করে যা মুজাহিদিনদের সাথে করা হচ্ছে।

৩। সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করুন যেন তারা বন্দীদের সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ করে যায় এবং যেন তাদেরকে নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠায়।
৪। দেশ ও বিদেশে যোগ্য আইনজীবিদের সমন্বয়ে একটি সংস্থা গড়ে তুলুন।
ইয়া আল্লাহ্‌ ! ইয়া হাইয়্যুল কাইয়ুম, (চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী)!
ইয়া আল্লাহ্‌, মুসলিম কারাবন্দীদের মুক্ত করে দিন!
ইয়া আল্লাহ্‌, মুসলিম কারাবন্দীদের মুক্ত করে দিন!
ইয়া আল্লাহ্‌, আমাদের কারাবন্দীদের মুক্ত করে দিন এবং বাকি মুসলিম বন্দীদেরকেও!
ইয়া আল্লাহ্‌, ফিলিস্তিনে আমাদের বন্দীদের মুক্ত করে দিন, কাশ্মীরে, ফিলিপাইনে এবং কিউবাতে!

হে আল্লাহ! দ্রুত একটি সমাধানের মাধ্যমে তাদের দুর্দশা দূর করে দিন !

হে আল্লাহ! তাদের বন্দীদশার অবসান ঘটিয়ে দিন!

হে আল্লাহ! দুর্বলদের উপর সদয় হোন!

হে আল্লাহ! তাদের অন্তরে দৃঢ়তা দান করুন!

হে আল্লাহ! তাদের অন্তরে ঈমানী দৃঢ়তা দান করুন!

হে আল্লাহ! তাদেরকে অটল অবিচলতার মাধ্যমে রহমত দান করুন!
হে আল্লাহ! তাদেরকে দৃঢ়তা দান করুন, হে চিরঞ্জীব, হে চিরজীবী!

হে আল্লাহ! তাদের দুর্বলদের উপর রহমত ! আর তাদের দুর্বলদেরকে আপনি সবল করে দিন!

হে আল্লাহ! আপনার শত্রুদের বিরুদ্ধে আপনার শক্তি প্রয়োগ করুন!
হে আল্লাহ! আপনার শত্রুদের বিরুদ্ধে আপনার শক্তি প্রয়োগ করুন!
হে আল্লাহ! আপনার শত্রুদের বিরুদ্ধে আপনার শক্তি প্রয়োগ করুন!

হে আল্লাহ! তাদেরকে অভিশপ্ত করুন, ভয়ানক অভিশপ্ত!
হে আল্লাহ! আপনার কুদরত আর ক্ষমতা দেখিয়ে দিন!
হে আল্লাহ! আপনার উপর মুনাফিকরা বিশ্বাসঘাতকেরা ক্ষমতা দেখাচ্ছে !

হে আল্লাহ! তাদেরকে একত্রিত হতে দিবেন না! আর তাদেরকে তাদের লক্ষ্য অর্জন করতে দিয়েন না!
আর তাদেরকে পরবর্তীদের জন্য একটি দৃষ্টান্ত, শিক্ষা ও নমুনা বানিয়ে দিন !

হে আল্লাহ! প্রতিটি স্থানে মুসলিমদের সাহায্য করুন!
হে আল্লাহ! এই উম্মাহকে সতকর্মশীল বানিয়ে দিন!
আপনার আনুগত্যের দিকে
আপনার নাফরমানীর দিকে নয়!
আমর বিল মারুফ ও নাহিয়ানিল মুনকারের দিকে!
হে মহান রব! সমস্ত সম্মান আপনারই!

হে আল্লাহ! আমাদের দেশ ও ঘরবাড়ি রক্ষা করুন!

আর আমাদের নেতাদের সংশোধন করে দিন! হে মহান, সবচেয়ে ক্ষমাশীল তুমি!

সুবহানাল্লাহ! হে আল্লাহ! সমস্ত সম্মানের মালিক, আপনি তা থেকে পবিত্র যা ওরা আপনার উপর আরোপ করে,
শান্তি বর্ষিত হোক সকল আম্বিয়াগণের উপর, আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আ’লামিন।
দরুদ ও শান্তি বর্ষিত হোক আমাদের নবী ও তাঁর পরিবারের উপর।


শাইখ মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল হাবদান, সৌদি আরবে রিয়াদের আল ইজ্জ বিন আব্দুস সালাম মসজিদের ইমাম, তিনি জুমার খুতবায় এই বক্তব্যটি প্রদান করেন, সেদিন ছিল ১৬ আগস্ট ২০০২ সাল ১৪২৩ হিজরী।

খুতবার শিরোনাম ছিল, “মুসলিম কারাবন্দীদের পক্ষে কে দাঁড়াবে?”
এটি ছিল এক অসাধারণ খুতবা, আশা করা যায় সেদিন যারা উপস্থিত থেকে সরাসরি খুতবাটি শুনেনি তারাও এর লিখিত রূপ থেকে উপকৃত হতে পারবেন, বিশেষতঃ যখন মুসলিম কারাবন্দীদের এই বিষয়টি সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষ বেখবর ও গাফেল হয়ে গেছে, এমনকি অনেক ইসলামিক দায়ীগণও এই বিষয়টিকে উপেক্ষা করে চলছেন।