মুজিযা, কারামাত ও ইসতিদরাজ – ২য় পর্ব

মুজিযা সম্পর্কে বিতর্ক
নবী-রাসুলগণকে আল্লাহ জাহেরী ও বাতেনী উভয় প্রকার মুজিযা প্রদান করেছেন। এটা প্রত্যেক নবীর বেলায়ই ঘটেছে। কিন্তু এই জাহেরী ও বাতেনী মুজিযার পার্থক্য এবং উপরে উল্লিখিত আয়াতসমূহের গুঢ়ার্থ অনুধাবনের ব্যর্থতার কারণে কোন কোন লোক মনে করে বসেছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাফিরদেরকে কোন জাহেরী মুজিযা দেখাননি। যদি তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জাহেরী মুজিযা দেখাতেন, তাহলে বারবার কেন তারা মুজিযা তলব করেছিলো? এমনকি কোন কোন অবিবেচক ইসলামী পণ্ডিত এ কথাও বলেছেন – “রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কুরআন ছাড়া অন্য কোন মুজিযা ছিল না!” এ কারণে বর্তমানে কালে নতুন বিতর্কের সূচনা হয়েছে যে, আসলে কুরআন ছাড়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্য কোন মুজিযা ছিল কিনা?

মিসরের কয়েকজন মুসলিম পণ্ডিত, যথা উস্তাদ মুহাম্মাদ ফারীদ ওয়াজদী, শায়খ মুহাম্মাদ আবদুহু, সায়্যিদ আবদুল আযীয জাবীশ, আল-মানার সাময়িকীর সম্পাদক সায়্যিদ রাশীদ রিদা এবং মিসরের আল-আযহার রেক্টর মুহাম্মাদ মুস্তাফা আল-মারাগী এবং প্রখ্যাত লেখক শায়খ মুহাম্মাদ হুসায়ন হায়কাল প্রমুখ আধুনিক মুসলিম পণ্ডিতদের অভিমত এই যে, “পবিত্র কুরআনের বাইরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্য কোন মুজিযা ছিল না।”
[দৃষ্টব্যঃ (১) মুহাম্মাদ ফারীদ ওয়াজদী, আল-মাদীনা ওয়াল ইসলাম, মিসর, হিজরি ১৩৫৩ / খৃ. ১৯৩৩, পৃষ্ঠা ৭১-৭২; (২) মুহাম্মাদ রাশীদ রিদা, তাফসিরুল মানার, মিসর, হিজরি ১৩৭৩ / খৃ. ১৯৫৪; ১১খ. ; (৩) ঐ লেখক, আল- ওয়াহয়ুউল মুহাম্মাদী, মিসর, হিজরি ১৩৫৪ ; (৪) শায়খ মুহাম্মাদ আবদুহু, রিসালাতুত তাওহীদ, মিসর, হিজরি ১৩৬৫ ; (৫) মুস্তাফা আল-মারাগী, মুকাদ্দাম হায়াতে মুহাম্মাদ লিল-হায়কাল, মিসর, খৃ.১৯৭৪ ; (৬) সায়্যিদ আবদুল আযীয জাবিশ, দ্বীনুল ফিতরাতি ওয়াল-হুরারিয়্যাহ ; (৭) মুহাম্মাদ হুসায়ন হায়কাল, হায়াতে মুহাম্মাদ, মিসর, দারুল আআরিফ, খৃ. ১৯৭৪, ১২শ সংস্করণ, ভুমিকা]

ড. মুহাম্মাদ হুসায়ন হায়কাল তার কিতাব “হায়াতে মুহাম্মাদ” গ্রন্থের ভুমিকায় তাদের উক্ত অভিমতের সমর্থনে পবিত্র কুরআনের পূর্বোক্ত চারটি আয়াত (১৭ :৯০-৯৩) আর তার সাথে নিন্মোক্ত আয়াত প্রমাণ হিসেবে পেশ করেছেনঃ “তারা আল্লাহ’র নামে কঠিন শপথ করে বলে যে, তাদের কাছে যদি কোন নিদর্শন আসতো, তবে অবশ্যই তারা এতে ঈমান আনতো; বলুন, নিদর্শন তো আল্লাহ’র এখতিয়ারভুক্ত, তাদের কাছে নিদর্শন আসলেও তারা যে ঈমান আনবে না এটা কিভাবে তোমাদের বোধগম্য করানো যাবে?” (সূরাহ আল-আনআম, ৬ : ১০৯)

ড. হায়কাল আয়াত দুটো উপস্থাপনের পর লিখেছেনঃ বস্তুত পবিত্র কুরআন ও তার সাথে সাজস্যপূর্ণ হাদিসসমূহ কুরআন ছাড়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্যান্য মুজিযার ব্যাপারে অনেকটা নীরব বলা চলে। এ ক্ষেত্রে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে যে, এমতাবস্থায় পূর্ববর্তীদের থেকে শুরু করে বর্তমান যুগের মুসলমানগণ পর্যন্ত সকলেই পবিত্র কুরআন ছাড়া অন্যান্য মুজিযার ব্যাপারে এতোটা সোচ্চার কেন? এ প্রশ্নের একটাই উত্তর হতে পারে। তা এই যে, মুসলমানগণ পবিত্র কুরআনে পূর্ববর্তী নবী-রাসুলগণের বিভিন্ন মুজিযার ঘটনা ও কাহিনী দেখতে পেয়েছে। এতে তারা প্রভাবিত হয়ে পড়েছে। তারা মনে করেছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামে জন্যও মুজিযা হওয়া অত্যাবশ্যক। তাদের ধারণায় জড়ো অলৌকিক ঘটনা ছাড়া বিশ্বাস-ই পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে না। তারা অলৌকিক ঘটনাবলীর ব্যাপারে বর্ণনাগুলোকে নির্ভরযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য মনে করে বসেছে, অথচ এ সকল বর্ণনা যে পবিত্র কুরআন সমর্থিত না, এ দিকটির প্রতি তারা কোন প্রকার গুরুত্বারোপই করেননি। তারা ধারণা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুজিযার প্রাচুর্য তার রিসালাতের প্রতি মানুষের ঈমান ও বিশ্বাসকেই শক্তিশালী ও বৃদ্ধির কারণ হবে। অথচ পূর্ববর্তী নবী-রাসুলগণের সাথে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাদৃশ্য ভিন্নধর্মী বিষয়কে একত্রিকরণ বৈ আর কিছু না। (হায়াতে মুহাম্মাদ, ভুমিকা)

“পবিত্র কুরআন ছাড়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্য কোন মুজিযা ছিলো না” – এই দাবীর সমর্থনে ড. হায়কাল কুরআনের যে দুটো আয়াত উদ্ধৃত করেছেন, তা দিয়ে তার দাবী কোনভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয় না। কারণ, সকল নির্ভরযোগ্য তাফসীর ও হাদিসে উক্ত আয়াত দুটোর যে শানে নুযূল, প্রেক্ষাপট ও ব্যাখ্যা বর্ণিত হয়েছে, তাতে তার দাবীর সমর্থন নেই, বরং আয়াত দুটোর মর্ম এই যে, এতে মক্কার মুশরিকদের কূট-উদ্দেশ্য তুলে ধরা হয়েছে। “পবিত্র কুরআনের বাইরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আর কোন মুজিযা নেই” – এতে এমন উক্তি করা হয়নি।

আল্লামা ইবনে কাসির তার “তাফসিরুল কুরআনিল আযীম” গ্রন্থে প্রথমোক্ত আয়াতটির পটভূমি বর্ণনা প্রসঙ্গে ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু’র সূত্রে সহিহ হাদিস রিওয়ায়াত করেছেন যে, একদিন মক্কার মুশরিক সর্দারেরা বসে খোশগল্প করছিলো। তারা এক লোক দিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’কে ডেকে পাঠালো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখানে হাজির হলে তারা তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপরের আয়াতে উল্লিখিত প্রশ্নগুলো করলো। এ সমস্ত প্রশ্নের পিছনে তাদের কোন সদুদ্দেশ্য ছিল না। এমনকি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের দাবীগুলো বাস্তবায়িত করে দেখালেও তারা ঈমান আনতো না, বরং আরো হাজারো মুজিযা দাবী করে বসতো। আর তাদের দেখাদেখি অন্যরাও এই ধরণের দাবী করতে আরম্ভ করতো। ফলে আল্লাহ’র নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’কে ইসলাম প্রচারের মহান ব্রতকে বাদ দিয়ে তাদের এই সমস্ত গোঁয়ার্তুমিমূলক প্রশ্নের উত্তরেও দাবী-দাওয়া পূরণের কাজ করেই বেড়াতে হতো। তাই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুশরিকদের এ সমস্ত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রশ্নের কোন গুরুত্ব দেননি। (তাফসীর ইবনে কাসির, ৩খ.)

পবিত্র কুরআনের উক্ত আয়াতটির পটভূমিও এমন একটি ঘটনা। মক্কার মুশরিকরা শপথ করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’কে বললো, আপনি আমাদের প্রত্যাশিত মুজিযার অংশবিশেষ বাস্তবায়িত করে দেখালে আমরা ঈমান আনবো। বস্তুত তাদের এই শপথ ছিল মিথ্যা, অসার। আল্লাহ তাদের এই মিথ্যা শপথের পর্দা উন্মোচনের লক্ষ্যে উক্ত আয়াতটি নাযিল করেন আর বলেন, একটি মুজিযা প্রকাশের পর আরেকটি, এরপর আরো একটি, এভাবে মুজিযার পর মুজিযা প্রকাশের মাধ্যমে কোন শুভ ফল হতে পারে না; বরং সত্যবাদী ও মিথ্যাবাদীর মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করার মতো একটি মুজিযাই যথেষ্ট। বারবার অলৌকিক ঘটনা প্রদর্শনের দাবী নিরর্থক বৈ কিছু না। (তাফসীর ইবন কাসির, ২খ.)

মোটকথা, উক্ত ভাষ্য দুটোতে এ কথা বুঝানো হয়নি যে, কুরআনের বাইরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোন মুজিযা নেই, বরং তাতে এ কথা বুঝানো হয়েছে যে, সত্য প্রমানের জন্য বারবার জাহেরী মুজিযা তলব ও তা প্রদর্শনের মধ্যে কোন ফায়দা নেই। হঠকারী ও গোঁয়ার্তুমিমুক্ত অন্তর নিয়ে একটি মুজিযা দেখাই সত্য প্রমাণের জন্য যথেষ্ট।

পূর্বোল্লিখিত বক্তব্যের বিপরীতে ড. হায়কাল যুক্তি পেশ করেছেন যে, “কুরআনের বাইরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুজিযা আছে” মেনে নিলে পূর্ববর্তী নবী-রাসুলগণের সাথে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাদৃশ্য ভিন্নধর্মী বিষয়কে একত্রকরণ অপরিহার্য হয়ে পড়ে। তার এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য না। কারণ, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সকল নবী-রাসুলগণের নেতা এবং সর্বশেষ নবী ও রাসুল ছিলেন। কিন্তু তাই বলে অন্য নবী-রাসুলগণের সাথে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন সাদৃশ্য ও মিল থাকবে না, এমন না। যেমন আল্লাহ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে বলেছেনঃ “মুহাম্মাদ একজন রাসুল মাত্র, তার পূর্বে বহু রাসুল গত হয়েছেন; সুতরাং তিনি যদি মারা যান বা নিহত হোন, তবে তোমরা কি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে? ……” (সূরাহ আলি ইমরান, ৩ : ১৪৪)

অনুরূপ অসংখ্য আয়াতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের নানাবিধ অবস্থাকে পূর্ববর্তী নবী-রাসুলগণের অবস্থার সাথে তুলনা করা হয়েছে এবং তা থেকে উপদেশ ও দিক-নির্দেশনা গ্রহণের জন্য বলা হয়েছে। (দ্রষ্টব্যঃ ৬ : ১০, ৩৩, ৩৪, ৪২)।

উপরন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,”আমার আর অন্যান্য রাসুলগণের উদাহারন এরূপ, যেমন একটি সুরম্য অট্টালিকা নির্মিত হলো। বহু লোক সমবেত হয়ে এর মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখতে লাগলো, তারা সকলেই বাহবা বলে প্রশংসা করতে লাগলো। কিন্তু এই সুরম্য অট্টালিকার এক কোণে একটি ইস্টকের স্থান শূন্য দেখে তারা বলতে লাগলেন – আহ, এই শূন্য স্থানটি যদি পূর্ণ হতো তবে কতোই না সুন্দর হতো।” এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “অনন্তর আমিই সেই(শূন্যস্থান পূর্ণকারী) ইষ্টক, আর আমিই সর্বশেষ নবী।” (বুখারী, ১খ. ; মুসলিম, ২খ.)
সুতরাং অন্যান্য নবী-রাসুলগণের জাহেরী ও জড়ো মুজিযা ছিল বলে অনুরূপ মুজিযা তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থাকতে পারবে না, এটা কোন যুক্তিগ্রাহ্য কথা নয়।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র জীবনের বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনায় অতীতে কিছু কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটেছে, এ কথা অস্বীকার করা যায় না। তবে এ কথাও স্বতঃসিদ্ধ যে, অতীতের বিভিন্ন যুগের মুহাদ্দিসীন ও হাদিস বিশেষজ্ঞগণ নানাভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবন-চরিত বিষয়ক বর্ণনারাজিকে সে সমস্ত ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে মুক্ত করার নিরলস চেষ্টা চালিয়েছেন আর এ ক্ষেত্রে তারা অভাবিত সাফল্য অর্জন করেছেন। তারা রিওয়ায়াতসমূহের শুদ্ধ-অশুদ্ধ পার্থক্যকরণে সক্ষম হয়েছেন। সুতরাং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের অলৌকিক ঘটনাবলী সম্পর্কিত বিশুদ্ধ হাদিস ও রিওয়ায়াতসমূহ গ্রহণ করতে এখন আর আপত্তি করার সঙ্গত কোন কারণ নেই।

কিন্তু ড. হায়কাল তার কিতাব “হায়াতে মুহাম্মাদ” এর ভুমিকায় এ সমস্ত হাদিস ও রিওয়ায়াতসমূহকে শুদ্ধ-অশুদ্ধ নির্বিশেষে এক দৃষ্টিতে দেখেছেন। তিনি লিখেছেন – “পবিত্র কুরআনই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একক মুজিযা।” এরপর তিনি লিখেছেন – “যদি রিসালাত প্রমাণের জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্য কোন মুজিযা থাকতো, তবে তা পবিত্র কুরআন উল্লেখ করা হলো না কেন?” এ পর্যন্ত বলেই তিনি ক্ষান্ত হোননি, আরেকটু অগ্রসর হয়ে তিনি মুজিযাকে যুক্তি-বুদ্ধির নিরিখে বিচার করতে চেয়েছেন। তিনি বলেন – “আজও যদি কোন অমুসলিম সম্প্রদায় ইসলাম গ্রহণ করে এবং মুজিযার ক্ষেত্রে পবিত্র কুরআন ছাড়া অন্য কোন কিছু স্বীকার না করে, তাহলে এজন্য তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করা যাবে না। এতে তাদের ধর্মবিশ্বাস অসম্পূর্ণ হবে না। কেননা, সে ব্যক্তি আল্লাহ ও তার রাসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি ঈমান এনেছে। তার এই অধিকার রয়েছে যে, সে পবিত্র কুরআনের আলোকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্যান্য মুজিযা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিন্তা-গবেষণা করতে পারবে। এরপর যদি অকাট্য প্রমাণ দিয়ে কোন কিছু সাব্যস্ত হয়, তা বিনা দ্বিধায় মেনে নিবে।”

ড. হায়কালের এই অভিমতও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ যা অস্বাভাবিক ও যা যুক্তি-বুদ্ধির ঊর্ধ্বে, তা-ই তো মুজিযা। সুতরাং যুক্তি বুদ্ধির নিরিখে কিরূপে কোন নবী ও রাসুলের অলৌকিক কর্মকীর্তির বিশুদ্ধতা মূল্যায়ন করা যাবে? তিনি প্রশ্ন তুলেছেন যে, কুরআন ছাড়া অন্য কোন মুজিযা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের থাকলে তা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করা হলো না কেন? অথচ কুরআনের সাধারণ পাঠক মাত্রই জানেন, কুরআনে মাত্র একটি দুটি না, বরং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একাধিক মুজিযার উল্লেখ রয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ এখানে কয়েকটির উল্লেখ করছি –
(১) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মিরাজে গমন তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবনের একটি ঐতিহাসিক সুবিখ্যাত মুজিযা। পবিত্র কুরআনে মিরাজ সম্পর্কে পরিষ্কার আলোচনা হয়েছে। এমনকি কুরআনের একটি সূরার নামকরণ করা হয়েছে “ইসরা” তথা মিরাজ নামে। এই সূরাতুল ইসরা’র সূচনাই হয়েছে এভাবে -“পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রি বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত – যার চার দিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি যাতে আমি তাকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই; নিশ্চয়ই তিনি পরম শ্রবণকারী ও দর্শনশীল।” (সূরাহ আল-ইসরা, ১৭ : ১)
(২) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতও ছিল তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবনের একটি অলৌকিক ও অস্বাভাবিক ঘটনা। হিজরত মাত্র একটি মুজিযাই নয়, বরং এটি ছিল একাধিক মুজিযার ধারক ও সংঘটন স্থল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন পার্থিব সহায়-সম্বলহীন। অপরদিকে কুরাইশ কাফিররা ছিল অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত ধনে-জনে বলীয়ান। তারা তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হত্যার পরিকল্পনা করেছিলো। প্রত্যেক গোত্র থেকে একজন করে দুর্ধর্ষ বীর খোলা তরবারি নিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’কে হত্যা করার দৃঢ় উদ্দেশ্যে বের হয়ে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘরে চারদিকে অবস্থান করছিলো। আল্লাহ কাফিরদের কবল থেকে তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অলৌকিকভাবে রক্ষা করলেন। পবিত্র কুরআনে সেই ভয়াল ষড়যন্ত্রের দৃশ্য এভাবে চিত্রিত হয়েছে শব্দের গাঁথুনিতে (যার অনুবাদ) – “আর স্মরণ করুন, কাফিররা আপনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে আপনাকে বন্দী করার জন্য, হত্যা করার জন্য অথবা নির্বাসিত করার জন্য, এবং তারা ষড়যন্ত্র করে আর আল্লাহ’ও কৌশল করেন; আর আল্লাহ’ই তো কৌশলীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।” (সূরাহ আল-আনফাল, ৮ : ৩০)
কুরআনের অপর একটি সূরায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতের অলৌকিক ঘটনাবলী এভাবে বিবৃত হয়েছেঃ “যদি তোমরা তাকে সাহায্য না করো তবে স্মরণ করো, আল্লাহ তাকে সাহায্য করেছিলেন যখন কাফিররা তাকে বহিস্কার করেছিলো এবং সে ছিল দুইজনের একজন, যখন তারা উভয়ে গুহার মধ্যে ছিল, সে তখন তার সঙ্গীকে বলেছিলো – বিষণ্ণ হয়ো না, আল্লাহ আছেন আমাদের সাথে; এরপর আল্লাহ তার উপর প্রশান্তি বর্ষণ করেন এবং তাকে শক্তিশালী করেন এমন এক সৈন্যবাহিনী দিয়ে, যা তোমরা দেখোনি; তিনি কাফিরদের বাক্য হেয় করেন আর আল্লাহ’র বাক্যই সর্বোপরি, আল্লাহ পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়।” (সূরাহ আত-তাওবাহ, ৯: ৪০)
(৩) অনুরূপ বদর যুদ্ধে আল্লাহ মুসলমানগণকে অলৌকিকভাবে বিজয় দান করেছিলেন, বদরে তিনি তার ফেরেশতা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। এটা ছাড়া আরো অলৌকিক ঘটনা বদরে সংঘটিত হয়েছে, যার প্রতিটির বর্ণনা কুরআনে রয়েছে। ফেরেশতা বাহিনীর মাধ্যমে যুদ্ধের ফলাফল মুসলমানদের অনুকূলে আনয়নের মুজিযা এভাবে উপস্থাপিত হয়েছেঃ “স্মরণ করো, যখন তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেছিলে, তিনি তা কবুল করেছিলেন আর বলেছিলেন, আমি তোমাদেরকে সাহায্য করবো এক হাজার ফেরেশতা দিয়ে যারা একের পর এক আসবে। আল্লাহ এটা করেন কেবল শুভ সংবাদ দেওয়ার জন্য এবং এই উদ্দেশ্যে যাতে তোমাদের চিত্ত প্রশান্তি লাভ করে, আর সাহায্য তো শুধু আল্লাহ’র কাছ থেকেই আসে; আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” (সূরাহ আল-আনফাল, ৮ : ৯-১০)
(৪) এমনিভাবে বদর প্রান্তরে মুসলমানদের কল্যাণে অসময়ে বৃষ্টি বর্ষণের মুজিযা কুরআনে বিবৃত হয়েছেঃ”… এবং আকাশ থেকে তোমাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ করেন তা দিয়ে তোমাদের পবিত্র করার জন্য, তোমাদের থেকে শয়তানের কুমন্ত্রণা অপসারণের জন্য, তোমাদের হৃদয় দৃঢ় করার জন্য আর তোমাদের স্থির রাখার জন্য।” (সূরাহ আল-আনফাল, ৮ : ১১)
(৫) অনুরূপ বদর প্রান্তরে কাফিরদের চোখে মুসলমানদের সংখ্যা কম দেখানো হয়েছে যাতে তারা অধিক প্রস্তুতি গ্রহণ করে। অপর দিকে মুসলমানদের চোখে কাফিরদের কম দেখানো হয়েছে যাতে মুসলমানগণ ঘাবড়িয়ে না যায়। এটি ছিল একটি মুজিযা ও অসাধারণ ব্যাপার। কুরআনে উদ্ধৃত হয়েছেঃ”দুটি দলের পরস্পর সম্মুখীন হওয়ার মধ্যে তোমাদের জন্য নিদর্শন রয়েছে- একদল আল্লাহ’র পথে লড়াই করছিলো, অন্যদল কাফির ছিলো; তারা তাদেরকে চোখের দেখায় দ্বিগুণ দেখছিলো; আল্লাহ যাকে ইচ্ছে নিজ সাহায্য দ্বারা শক্তিশালী করেন; নিশ্চয়ই এতে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন লোকের জন্য শিক্ষা রয়েছে।” (সূরাহ আলি ইমরান, ৩ : ১৩)

বিস্তারিত বিবরণের জন্য দেখুন মাওলানা তফাজ্জল হুসাইন রচিত হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) : মুজিযার স্বরূপ ও মুজিযা। দৃষ্টান্তস্বরূপ মাত্র কয়েকটি মুজিযা এখানে উল্লেখ করা হলো। এগুলো ছাড়াও আরো বহু মুজিযার ঘটনা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ রয়েছে। সুতরাং ড. হায়কালের এই দাবী যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুজিযা বলতে শুধু পবিত্র কুরআনকে বুঝায় এবং এটি ছাড়া তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন মুজিযা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করা হয়নি – এই দাবী সম্পূর্ণ মনগড়া ও ভিত্তিহীন।

ড. হায়কালের মতে, হাদিস ও সিরাত গ্রন্থসমূহে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনে সংঘটিত যে সমস্ত অসাধারণ ও অলৌকিক ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়, তা হয় মনগড়া, বানোয়াট কিংবা সমালোচনার ঊর্ধ্বে না। সুতরাং তার নানারূপ ব্যাখ্যার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। এরপর তিনি কুরআন ছাড়া অন্যান্য মুজিযাসমূহের অসারতা ও অবাস্তবতা প্রমাণের উদ্দেশ্যে দুটো কাহিনী উপস্থাপন করেছেন এবং তার অসারতা প্রমাণের জন্য যুক্তিতর্কের অবতারণা করেছেন। কাহিনী দুটো নিন্মরূপঃ
(১) ড. হায়কাল লিখেছেন, সিরাত বিষয়ক সকল গ্রন্থেই অভিন্ন মত প্রকাশ করা হয়েছে যে, মিরাজের পূর্বে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তারা একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখে শুনতে পেলেন যে, একই রাতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’কে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসায় ভ্রমণ করানো হয়েছে এবং সেখানের পবিত্র স্থানগুলো পরিদর্শন করানো হয়েছে। এ কথা শুনার সাথে সাথে একদল মুসলমান তা অবিশ্বাস করে ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করলো। (হায়াতে মুহাম্মাদ, ভূমিকা)
(২) ড. হায়কাল লিখেছেন, সুরাকা ইবন মালিক ইবন জুশুমের ঘটনাও এই ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। হিজরতের সময় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনার উদ্দেশ্যে মক্কা ত্যাগ করেন। তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবিত কিংবা মৃত ধরিয়ে দেওয়ার জন্য মক্কাবাসী কাফিররা পুরস্কার ঘোষণা করে। সুরাকা পুরস্কারের লোভে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’কে ধরার জন্য তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পিছু ধাওয়া করে। সে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পর্যন্ত পৌছতে সক্ষম হয়। এমনকি কোন কোন জীবন-চরিতকার লিখেছেন, সে তার(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছে পৌছলে অলৌকিকভাবে তার ঘোড়ার ক্ষুর মাটিতে দেবে যায়। (হায়াতে মুহাম্মাদ, ভূমিকা)

ড. হায়কালের এই দুটো ঘটনা বর্ণনার উদ্দেশ্য এই যে, নবী- রাসুলগণের মুজিযা তাদের দাবীর সত্যতা প্রতিষ্ঠা ও তাদের প্রতি ঈমান আরো সুদৃঢ়করণের জন্য সহায়কস্বরূপ। সে হিসেবে কোন নবী-রাসুল থেকে কোন মুজিযা প্রকাশ পাওয়া তার প্রতি অবিশ্বাসীদের ঈমান আনয়নের সহায়ক হবে, আর বিশ্বাসীদের ঈমানকে আরো সুদৃঢ় করবে। এটিই যুক্তির চাহিদা। অথচ মিরাজের ঘটনায় কোন কাফিরের ঈমান আনা তো দূরের কথা, স্বয়ং ইতিপূর্বে যারা ঈমানদার ছিলো তাদের একটি দল পর্যন্ত এই ঘটনা শুনে মুরতাদ হয়ে গেলো। এটি তো এ কথাই প্রমাণ করে যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনে আল-কুরআন ভিন্ন অন্য কোন মুজিযা ছিল না।

অনুরূপ, সুরাকার ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন যে, এই মুজিযা দেখেও সুরাকা ঈমান আনলো না কেন? ফিরআউনের যাদুকররা তো মুসা আলাইহিস সালামের মুজিযা দেখে ঈমান এনেছিলো। মুজিযার সত্যতা পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে ড. হায়কালের গৃহীত মূলনীতি দেখে বড়ই আশ্চর্যবোধ হয়। তিনি কোথা থেকে এই মূলনীতি আবিস্কার করলেন যে, কোন নবীর মুজিযা দেখে তার উম্মত ঈমান না আনলে উক্ত মুজিযা মিথ্যা বলে প্রমাণিত হবে? স্বয়ং ড. হায়কালের দাবী মতে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একমাত্র মুজিযা পবিত্র কুরআন শুনে তার সকল শ্রোতাই কি ঈমান এনেছিলো? উত্তর”না” হলে পবিত্র কুরআন কি অসত্য হয়ে যাবে? বস্তুত তিনি তার ভিত্তিহীন মনগড়া একটি যুক্তি দিয়ে দুটো সুপ্রতিষ্ঠিত মুজিযা অস্বীকার করার প্রয়াস পেয়েছেন, যার একটি (মিরাজ) স্বয়ং কুরআনে বর্ণিত হয়েছে এবং অপরটি (সুরাকার ঘটনা) বুখারী ও মুসলিমসহ হাদিস ও সিরাতের সকল বিশুদ্ধ গ্রন্থে সহিহ সনদে সংরক্ষিত আছে। (দ্রষ্টব্যঃ বুখারী, ১ম খণ্ড ; মুসলিম, ২য় খণ্ড)

ড. হায়কাল আরো একটি যুক্তি পেশ করেছেন যে, অন্যান্য নবী-রাসুলগণের মুজিযা দেখে বিরুদ্ধবাদীদের ঈমান আনার ঘটনা পবিত্র কুরআন ও ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোন মুজিযা দেখে কোন মুশরিক ঈমান এনেছে এমন বর্ণনা ইতিহাসে উল্লেখ করা হয়নি। এটা প্রমাণ করে যে, কুরআন ছাড়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোন মুজিযা ছিল না। (হায়াতে মুহাম্মাদ, ভূমিকা)

ড. হায়কালের এই যুক্তি তথ্যনির্ভর না। কারণ হাদিস ও সিরাতের গ্রন্থসমূহে এ জাতীয় একাধিক ঘটনা সহিহ সনদ দ্বারা সংরক্ষিত হয়ে আসছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ আমরা তার কয়েকটি ঘটনা এখানে উদ্ধৃত করছিঃ
(১) এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে হাজির হয়ে বললো, আমি ঐ পর্যন্ত আপনাকে সত্য নবী বলে স্বীকার করবো না, যতক্ষণ না এই খেজুর বৃক্ষের কাঁদিসমূহ আপনার কাছে এসে আপনার রিসালাতের সত্যতা সম্পর্কে সাক্ষ্য দেয়। আল্লাহ’র কৃপায় তা-ই ঘটলো। যখন সে এই ঘটনা নিজ চোখে দেখলো, তখন ইসলাম গ্রহণ করলো। (তিরমিযি)
(২) একবার এক সফরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে এক বেদুঈনের সাক্ষাৎ হলো। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) লোকটিকে ইসলামের প্রতি আহবান জানালেন। লোকটি বললো, আপনার সত্যতার সাক্ষ্য কে দিচ্ছে? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সামনের এই বৃক্ষটি। এই কথা বলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বৃক্ষটিকে কাছে ডাকলেন। তৎক্ষণাৎ বৃক্ষটি তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সামনে হাজির হলো আর তার মধ্য থেকে তিনবার কালেমা তায়্যিবার ধ্বনি উচ্চারিত হলো। এই দৃশ্য দেখে লোকটি তৎক্ষণাৎ ইসলামে দাখিল হয়ে গেলো। (সিরাতুন্নবী, ৪খ.)
(৩) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতকালে উম্মে মাবাদ ও আবু মাবাদ নামক দুইজন মরুবাসীর ইসলাম গ্রহণের কথা সুবিখ্যাত। তারা ছিলেন খুজাআ গোত্রের লোক। মদিনার পথে একটি ঝুপড়ীতে তারা বাস করতো আর পথিক-মুসাফিরদের সেবা ও মেহমানদারী করতো। মেষ পালনই ছিল তাদের একমাত্র জীবিকা নির্বাহের উপায়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আর আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু উম্মে মাবাদের ঝুপড়ীর পার্শ্ব অতিক্রম করে যাচ্ছিলেন। তারা কিছু পাথেয় খরীদ করার জন্য উম্মে মাবাদের ঝুপড়ীতে আসলেন। কিন্তু খরীদ করার মতো কিছুই তার কাছে পাওয়া গেলো না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেখলেন, উম্মে মাবাদের ঝুপড়ীর এক কোণে একটি ছাগী দাঁড়িয়ে আছে। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিজ্ঞেস করলেন, এই ছাগীটি দুধ দেয় কি? উম্মে মাবাদ বললেন, সে তো হাঁটতেই পারে না, এতো দুর্বল ছাগী আবার দুধ দেয়? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আপনি অনুমতি দিলে আমি দোহন করে দেখতে পারি। উম্মে মাবাদ বললেন, আচ্ছা, আপনি দোহন করুন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিসমিল্লাহ বলে তার দুধ দোহন করতে লাগলেন। দেখা গেলো, দুধ বের হয়ে আসছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথীগণ, উম্মে মাবাদ ও তার ঝুপড়ীর লোকজন সকলেই তৃপ্তি সহকারে পেট ভরে দুধ পান করলেন। তারপর আরো কিছু দুধ উম্মে মাবাদের কাছে অবশিষ্ট রয়ে গেলো।

দুধ পান করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথীসহ মদিনা অভিমুখে রওয়ানা হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পরেই আবু মাবাদ মরুভূমিতে মেষ চারণ করে ঝুপড়ীতে ফিরে আসলেন। আবু মাবাদ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ শুনে বললেন, আল্লাহ শপথ, ইনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মনে হয় কুরাইশ গোত্রের সেই লোকটি, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কথা অনেক শুনেছি, আমাদের সুযোগ হলে আমরা তার(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দরবারে উপস্থিত হবো। ইবন কাসির রিওয়ায়াত করেছেন যে, এ ঘটনার পর উম্মে মাবাদ ও আবু মাবাদ উভয়ই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। (ইবন হিশাম, ১খ. ; আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ৩খ.)

কিছু আধুনিক সিরাতকার উম্মে মাবাদের হাদিসটিকে সনদের দিক থেকে দুর্বল আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু মুহাক্কিক আলিমগণ হাদিসটির সনদ সম্বন্ধে তথ্য তালাশের পর হাদিসটিকে সহিহ বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাদের অনুসন্ধান মতে এ হাদিসটি একাধিক সাহাবী থেকে একাধিক সনদে বর্ণিত হয়েছে, যথা –
(১) উম্মে মাবাদের সনদে ইবনুস সাকান, আল ইসাবায়। (দ্রষ্টব্যঃ ইসাবা, বাবুল আসমা ওয়াল কুনা)
(২) আবু মাবাদের সনদে ইমাম বুখারী তার তারিখ গ্রন্থে। (দ্রষ্টব্যঃ তাবাআত ইবন সাদ, ১খ.)
(৩) হুবায়শ ইবন খালিদের সনদে আল্লাম বাগাবী, ইবন শাহীন, ইবনুস সাকান ও ইমাম তাবারানী প্রমুখ মুহাদ্দিস নিজ নিজ গ্রন্থে। (দ্রষ্টব্যঃ তাহযিবুল কামাল, ১খ.)
(৪) আবু সালিত বদরীর সনদে হাদিসটি উয়ুনুল আসার গ্রন্থে বর্ণিত আছে। (দ্রষ্টব্যঃ সিরাতে মুস্তফা, ১খ.)
(৫) হিশামের সনদে মুসতাদরাকে হাকেম গ্রন্থে। হাকেম হাদিসটি রিওয়ায়াত করার পর মন্তব্য করেছেন- “এই হাদিসটি সনদ সহিহ”।(মুসতাদরাক, ৩খ.)

উপরন্তু এ ঘটনাটি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতের সাথী আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকেও সহিহ সনদে বর্ণিত হয়েছে। (দ্রষ্টব্যঃ দালায়েল লিল বায়হাকী, মুসতাদরাক লিল হাকেম ও আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া লি ইবন কাসির, ৩খ.) ইবন কাসির বলেন, “তার সনদ হাসান-নির্ভরযোগ্য।”

অতএব উম্মে মাবাদের বর্ণিত এই মুজিযার ঘটনাটি সম্বন্ধে কোন প্রকার সন্দেহ-সংশয় পোষণ করার কোনই যুক্তিসংগত কারণ নেই। ড. হায়কালের বক্তব্যের অসারতা প্রমাণের জন্য সূরাহ আল-কামারের প্রথম দুই আয়াতই যথেষ্ট। ইরশাদ হয়েছেঃ”কিয়ামত নিকটবর্তী হয়েছে, আর চন্দ্র বিদীর্ণ হয়েছে। এরা কোন নিদর্শন দেখলে মুখ ফিরিয়ে নেয় আর বলে- এটা তো চিরাচরিত যাদু।” (সূরাহ আল-কামার, ৫৪: ১-২)

ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সময়ে চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হয়েছিলো, এক খণ্ড পাহাড়ের উপরের দিকে আর অপর এক খণ্ড পাহাড়ের নিচের দিকে ছিলো। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন – তোমরা সাক্ষী থাকো। (বুখারী, কিতাবুত তাফসীর)

আধুনিক মুসলিম পণ্ডিতদের এরূপ অভিমতের কারণ
জড়বাদী, বস্তু পূজারী ইউরোপীয় লেখকদের মধ্যে একটি প্রবণতা বিশেষভাবে দেখা যায় যে, তারা নবী-রাসুলগণের জীবদ্দশায় সংঘটিত যথার্থ তথ্য-প্রমাণে সুপ্রতিষ্ঠিত অলৌকিক (মুজিযা) ঘটনাবলী অস্বীকার করে থাকেন অথবা তারা নিজেদের সীমাবদ্ধ মানবীয় বিচার-বুদ্ধি ও যুক্তি দ্বারা তা বিকৃত করার অপচেষ্টা চালিয়ে থাকেন। তাদের এই সংকীর্ণ মানসিকতা সম্বন্ধে এটাই যথার্থ বক্তব্য হবে যে, যারা আধ্যাত্মিক জগতের খোঁজ জানে না, যাদের জ্ঞানের দৌড় বস্তুতান্ত্রিক জগতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, যাদের অন্তর ও মস্তিষ্ক জড় জগতের মধ্যে সীমাবদ্ধ – তাদের চোখে এ সমস্ত অলৌকিক (মুজিযা) ঘটনাবলী এভাবে প্রতিভাত হওয়াই স্বাভাবিক।

যারা নিজেদের রাসুল ঈসা আলাইহি সালামের অলৌকিক জন্মের কথা অস্বীকার করতে পেরেছে, তারা যে অন্যান্য নবী-রাসুলের, বিশেষ করে শেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনে সংঘটিত অলৌকিক (মুজিযা) ঘটনাবলী অস্বীকার করবে, এতে বিস্মিত হওয়ার কি আছে? তবে বিস্ময় লাগে আমাদের কিছু মুসলিম পণ্ডিতের জ্ঞান-বুদ্ধি ও যুক্তি-বিবেচনার উপর। কারণ তারা আল্লাহ’র জড়-ঊর্ধ্ব মহান কুদরত ও অসাধারণ ক্ষমতায় বিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও সহিহ সনদ দিয়ে প্রমাণিত মুজিযাসমূহকে নিজেদের প্রসার যুক্তি ও সংকীর্ণ মেধা বুদ্ধি দিয়ে অস্বীকার করতে কিংবা তার অপব্যাখ্যা সন্ধানে উদ্যত হয়েছেন। তারা যে নিরপেক্ষ, সুস্থ যুক্তি ও বিবেক দিয়ে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাননি, বরং ইউরোপীয় জড়বাদী লেখকদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন – তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ মিলে তাদেরই অন্যতম লেখক বন্ধু মিসরের ড. হুসাইন হায়কালের এই বক্তব্য থেকে।

তিনি তার গ্রন্থ “হায়াতে মুহাম্মাদ” এর ভুমিকায় মুজিযা প্রসঙ্গে লিখেছেন যে, খুব সম্ভব সে কালের ইসলামী চিন্তাবিদ ও লেখকগণ যুগের প্রয়োজনীয়তার প্রেক্ষিতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সংশ্লিষ্ট পবিত্র কুরআন বহির্ভূত অলৌকিক ঘটনাবলী তাদের গ্রন্থরাজিতে সংকলন করেছিলেন। বলা চলে, যুগের প্রয়োজনে এই ব্যাপারে তারা নিরুপায় ছিলেন। পরবর্তী যুগের লেখক ও চিন্তাবিদগণও এ ব্যাপারে তাদের পূর্ববর্তীদের অনুসরণের প্রয়োজনীয়তা বোধ করেছেন। তারা মনে করেছেন যে, এ সমস্ত অলৌকিক ঘটনার মাধ্যমে মুসলমানদের ঈমান সুদৃঢ় হবে। এমনকি এ সমস্ত ঘটনার পুনরাবৃত্তি করাও তাদের ধারণায় উপকার বৈ ক্ষতি ছিল না। তারা যদি এ ধরনের সুধারণা পোষণ না করতেন, তাহলে অবশ্যই তারা এ সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করা থেকে বিরত থাকতেন। তারা বর্তমানে জীবিত থাকলে দেখতে পেতেন, ইসলামের শত্রুরা এ সমস্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইসলাম সম্পর্কে জঘন্য সমালোচনা করেছে। এ পরিণতি দেখতে পেলে পবিত্র কুরআন বহির্ভূত অলৌকিক ঘটনাবলী কখনো তারা নিজেদের গ্রন্থগুলোতে সংকলন করতেন না। (হায়াতে মুহাম্মাদ, ভূমিকা, মুজিযা প্রসঙ্গে)


সূত্রঃ সিরাত বিশ্বকোষ – একাদশ খণ্ড (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ)