মুজিযা, কারামাত ও ইসতিদরাজ – ৩য় পর্ব

মুজিযা নবুওয়াতের প্রমাণ না নিদর্শন?
“মুজিযা নবুওয়াতের প্রমাণ না নিদর্শন” – বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্তে পৌছতে প্রাচীন মুসলিম মনীষীদের মধ্যে যেমন মতবিরোধ হয়েছে, বর্তমানকালেও তাতে প্রচণ্ড মতভেদ বহাল রয়েছে। অতীত ও প্রাচীন মুসলিম মনীষীদের মধ্যে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আশাইরা আকিদা বিশেষজ্ঞ আলীমদের অভিমত এই যে, মুজিযা নবুওয়াত ও রিসালাতের হুজ্জত বা প্রমাণস্বরূপ। পক্ষান্তরে, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত বহির্ভূত মুতাজিলা সম্প্রদায়ভুক্ত চিন্তাবিদগণের অভিমত এই যে, মুজিযা নবুওয়াতের হুজ্জত বা প্রমাণ নয়, তবে তা নবুওয়াতের আলামত যে নিদর্শন মাত্র।(সিরাতুন্নবী, ৪খ.)

বর্তমান কালে মিসরীয় ইসলামী চিন্তাবিদ ও লেখকগণও এই অভিমত পোষণ করে থাকেন, এর বিপরীতে সংখ্যাগরিষ্ঠ আলিম, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও ইসলামী বিশেষজ্ঞ মনীষীদের সর্বসম্মত অভিমত এই যে, মুজিযা নবুওয়াত ও রিসালাতের দাবীর সত্যতার প্রকৃষ্ট প্রমাণ, তা নিছক আলামত বা নিদর্শনের পর্যায়ের নয়। (দ্র. মানহাজুল মাদরাসাতিল আকলিয়া আল হাদিসাহ ফিত তাফসীর, ড. ফাহদ বিন আবদুর রহমান, বৈরুত, মুআসসাসতুর রিসালাহ, ১৪১৪ হিজরি, ২খ.)

যুক্তি ভিত্তিক প্রমাণ
মুতাযিলাদের দাবীর পক্ষে যুক্তি এই যে, তর্কশাস্ত্রের বিধানানুসারে দাবী ও দলীলের মধ্যে পারস্পরিক যোগসূত্র থাকা অপরিহার্য। কিন্তু মুজিযা ও নবুওয়াতের মধ্যে কোন প্রকার যোগসূত্র লক্ষ্য করা যায় না। যেমন, কোন ব্যক্তি যখন নবুওয়াতের দাবী করেন তখন তার উদ্দেশ্য হয়, তিনি আল্লাহ’র পক্ষ থেকে মানব জাতির আকিদা ও বিশ্বাস, আমল ও কার্যক্রম এবং আখলাক ও চরিত্র সংশোধনের জন্য প্রেরিত হয়েছেন। কিন্তু যখন তার কাছে এই দাবীর সত্যতা নিরূপণের জন্য দলীল প্রমাণ তলব করা হয়, তখন তিনি বিশুদ্ধ কুয়াকে পানি দিয়ে পরিপূর্ণ করে দেন কিংবা চাঁদকে দুই টুকরো করে দেখান অথবা তার লাঠি সাপে পরিণত হয়ে যায়। এ সমস্ত ঘটনা যদিও নেহায়েত আশ্চর্যজনক ও অভাবিতপূর্ব, কিন্তু এই সমস্ত দলীল-প্রমাণের সাথে দাবীর কোন কোন যোগসূত্র আছে কি?

আশাইরা মনীষীগণ মুতাযিলাদের এই তর্ক-যুক্তির উত্তরে বলেন, নবুওয়াত হচ্ছে ইলম ও আমলের সমন্বিত রূপ। যে ব্যক্তি নবুওয়াতের দাবী করেন ও তার সম্পর্কে এ কথা স্বীকার করে নেওয়া হয় যে, তিনি এই ইলম ও আমল সম্বন্ধে পরিপূর্ণ দক্ষতার অধিকারী এবং তার এই পরিপূর্ণতার বিকাশকল্পে তার কাছে মুজিযা তলব করা হয়। নবীগণের মুজিযা যদিও বিভিন্ন শ্রেণীর হয়ে থাকে, তবুও এগুলোকে শুধু দুই শ্রেণীতে বিন্যস্ত করা যায়। যেমন, অদৃশ্য জগতের সংবাদ প্রদান করা এবং সৃষ্টি জগতের বস্তুনিচয়ের উপর স্বীয় কর্তৃত্ব বজায় রাখা। এই দুই শ্রেণীর কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন অংশের সাথে এবং নবুওয়াতের বিভিন্ন অংশের সাথে রয়েছে এক নিবিড় বন্ধন ও একাত্মতা। অদৃশ্য জগতের সংবাদ প্রদানের মাধ্যমে নবী-রাসুলগণের জ্ঞান ও মনীষার পরিপূর্ণতা বিকশিত হয়ে উঠে। অপরদিকে সৃষ্টি জগতের বস্তুনিচয়ের উপর কর্তৃত্ব নিষ্পন্ন করার দ্বারা তার ব্যবহারিক শক্তির বিকাশ সাধিত হয়।

অপর একটি যোগসূত্র হচ্ছে, মুজিযা হলো সহজাত স্বভাবের অতীত কোন স্বভাবের নাম। তবে এ ক্ষেত্রে এটি নিয়ে কোন মতবিরোধ নেই যে, বস্তুনিচয় তার গুণাবলী আর তার কারণসমূহ কেবল আল্লাহ’র নির্দেশ ও হুকুম দ্বারা আত্মপ্রকাশ করে। এখন যদি কোন শক্তি এসব বৈশিষ্ট্য ও কারণসমূহকে স্বীয় মুজিযার দ্বারা নিশ্চিহ্ন কিংবা ভেঙ্গে-চুরে একাকার করে দিতে সক্ষম হোন, তাহলে তিনি বস্তুত এ কথার যথার্থতাই তুলে ধরলেন যে, যে মহানুভব ও সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তির অধিকারী সত্তা এ সমস্ত কারণ ও উপাদান সৃষ্টি করেছেন, কেবল তিনিই সেগুলোকে ধ্বংস কিংবা অকেজো করে দিতে পারেন। এই ভাঙ্গা-গড়ার অবিকল ধারা যেহেতু তার (নবীর) মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, সেহেতু এটা প্রমাণ করে যে, ইনিই সেই সত্তার প্রতিনিধি।

এর দৃষ্টান্ত এরূপ যে, একজন বাদশাহ স্বীয় প্রজাদের কাছে প্রয়োজনের তাকিদে দূত প্রেরণ করেন। প্রজাগণ জিজ্ঞাসা করলো, এ কথার প্রমাণ কি যে, আপনি মহান বাদশাহর একজন বার্তাবাহক প্রতিনিধি? তখন সে তার প্রতিউত্তরে বাদশাহর সীলমোহর আর অঙ্গুরী পেশ করতে বাধ্য হয়; যদিও প্রকাশ্যভাবে দূতের পয়গাম্বরীসুলভ দাবীর সাথে সীলমোহর আর অঙ্গুরীয়ের সরাসরি কোন যোগসূত্র নেই, কিন্তু তবুও এর মধ্যে সম্পর্ক এভাবে প্রতিপন্ন হয় যে, সীলমোহর আর অঙ্গুরীয় বাদশারই নিদর্শন বটে, যা একজন সাধারণ মানুষের হাতে কখনো আসতে পারে না। সুতরাং এতে সুস্পষ্ট প্রমাণ হয় যে, এই দূতকে বাদশাহ সরাসরি তার একান্ত ব্যক্তিগত নিদর্শন প্রদান করেই প্রেরণ করেছেন।

মুজিযা নবুওয়াতের প্রমাণ হওয়ার অনুকূলে কুরআন-হাদিসের দলীল
(১) আল্লাহ তাআলা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগের মুশরিক ও পৌত্তলিকদের নিন্দা, তিরস্কার ও ভৎসনা করেছেন এবং এই মর্মে তাদের বর্ণনা দিয়েছেন যে, মুশরিকরা আল্লাহ’র আয়াত ও মুজিযায় বিশ্বাসী না। যদি মুজিযা নবুওয়াতের প্রমাণই না হতো, তাহলে মুজিযা দেখার পর তাতে ঈমান না আনলে তারা ভৎসনা ও নিন্দার যোগ্য হবে কেন? অথচ দেখুন, নিচের আয়াতসমূহে মুজিযা অস্বীকার করার কারণে মুশরিকদেরকে কীরূপ ভৎসনা করা হয়েছে -“তাদের প্রতিপালকের নিদর্শনাবলীর এমন কোন নিদর্শন তাদের কাছে উপস্থিত হয় না, যা থেকে তারা মুখ না ফিরায়। সত্য যখন তাদের কাছে এসেছে, তারা তা প্রত্যাখ্যান করেছে; যা নিয়ে তারা ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতো, তার যথার্থ বিবরণ অচিরেই তাদের কাছে পৌঁছবে।” (সূরাহ আল-আনআম, ৬ : ৪-৫)

“তাদের মধ্যে কিছুলোক তোমার দিকে কান পেতে রাখে, কিন্তু আমি তাদের অন্তরের উপর আবরণ দিয়েছি যেন তারা তা উপলব্ধি করতে না পারে, আমি তাদেরকে বধির করেছি এবং তারা সমস্ত নিদর্শন দেখলেও তাতে ঈমান আনবে না, এমনকি তারা যখন তোমার কাছে উপস্থিত হয়ে বিতর্কে লিপ্ত হয়, তখন কাফিররা বলে, এটা তো সেকালের উপকথা ছাড়া কিছুই না। তারা অন্যকেও তা শুনতে বিরত রাখে আর নিজেরাও তা থেকে দূরে থাকে, আর তারা নিজেরাই তো শুধু নিজেদেরকে ধ্বংস করে, অথচ তারা উপলব্ধি করে না। তুমি যদি দেখতে পেতে যখন তাদেরকে আগুনের পার্শ্বে দাঁড় করানো হবে আর তারা বলবে, হায়! যদি আমাদের প্রত্যাবর্তন ঘটতো তবে আমরা আমাদের প্রতিপালকের নিদর্শনসমূহকে অস্বীকার করতাম না এবং আমরা মুমিনদের অন্তর্ভুক্ত হতাম।” (সূরাহ আল-আনআম, ৬ : ২৫-২৭)

মুজিযা যদি হুজ্জত বা প্রমাণই না হয়, তাহলে কিসের ভিত্তিতে উপরে উল্লিখিত আয়াতসমূহে মুজিযা অস্বীকারকারীদেরকে এরূপ তিরস্কার করা হলো?

(২) আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেনঃ”পূর্ববর্তীগণ কর্তৃক নিদর্শন অস্বীকার করাই আমাকে নিদর্শন প্রেরণ করা থেকে বিরত রাখে, আমি শিক্ষাপ্রদ নিদর্শনস্বরূপ সামুদ জাতিকে উস্ট্র দিয়েছিলাম, এরপর তারা তার প্রতি জুলুম করেছিলো, আমি ভীতি প্রদর্শনের জন্যই নিদর্শন প্রেরণ করি।” (সূরাহ আল-ইসরা, ১৭ : ৫৯)
এ আয়াতের সারমর্ম এই যে, আল্লাহ দয়াপরবশ হয়ে মানুষের প্রতি মুজিযা প্রেরণ করেন না। কেননা, মুজিযা প্রকাশের পর মানুষ যদি তা অস্বীকার করে তাহলে তারা আযাবের যোগ্য হয়ে পড়বে। যেমন, অতীতের উম্মতসমূহের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেছে। সুতরাং এটাই এ কথার প্রমাণ বহন করে যে, মুজিযা নবুওয়াতের হুজ্জত বা প্রমাণ, যার প্রকাশের পর আর কোন দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবকাশ নেই। এর পরেও কেউ দ্বিধা-দ্বন্দ্ব করলে সে শাস্তিযোগ্য হয়ে যাবে। সুতরাং মুজিযা হুজ্জত না হলে তা অস্বীকার করার প্রেক্ষিতে আযাব অবধারিত হয় কিভাবে?

(৩) আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেনঃ”স্মরণ করো, হাওয়ারীগণ বলেছিলো, হে মরিয়ম-পুত্র ঈসা, আপনার প্রতিপালক কি আমাদের জন্য আসমান থেকে খাদ্য পরিপূর্ণ খাঞ্চা প্রেরণ করতে সক্ষম? সে বলেছিলো, তোমরা আল্লাহ’কে ভয় করো, যদি তোমরা মুমিন হও। তারা বলেছিলো, আমরা চাই যে, তা থেকে আমরা কিছু খাবো আর আমাদের চিত্ত প্রশান্তি লাভ করবে, আর আমরা জানতে চাই যে, আপনি আমাদেরকে সত্য বলেছেন আর আমরা তার সাক্ষী থাকতে চাই। মরিয়ম-পুত্র ঈসা বললো, হে আল্লাহ, হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের জন্য আসমান থেকে খাদ্য পরিপূর্ণ খাঞ্চা প্রেরণ করুন, এটা আমাদের আর পরবর্তী সকলের জন্য হবে আনন্দোৎসবস্বরূপ এবং আপনার নিকট থেকে নিদর্শন, আর আমাদেরকে জীবিকা দান করুন আর আপনিই তো শ্রেষ্ঠ জীবিকাদাতা। আল্লাহ বললেন, আমিই তোমাদের কাছে তা প্রেরণ করবো, কিন্তু এর পর তোমাদের মধ্যে কেউ কুফরি করলে তাকে এমন শাস্তি দিবো, যে শাস্তি বিশ্বজগতের অপর কাউকেও দিবো না।” (সূরাহ আল-মাইদাহ, ৫ : ১১২-১১৫)

উপরে উল্লিখিত আয়াতসমূহে পরিষ্কার বলা হয়েছে যে, হ্যা, আমি তোমাদের কাঙ্ক্ষিত মুজিযা প্রদান করবো, কিন্তু তা প্রদানের পর কেউ তা অস্বীকার করলে তাকে নজীরবিহীন শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। “মুজিযা নবুওয়াতের প্রমাণ” – এই অভিমতের সমর্থনে কুরআনের এই আয়াতগুলো অকাট্য ও দ্ব্যর্থহীন প্রমাণ।

(৪) আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেনঃ”মুসা বললো, আমি তোমার কাছে স্পষ্ট কোন প্রমাণ আনয়ন করলেও? ফিরআউন বললো, তুমি যদি সত্যবাদী হও তবে তা(প্রমাণ) পেশ করো। এরপর মুসা তার লাঠি নিক্ষেপ করলে তৎক্ষণাৎ তা এক সাক্ষাৎ অজগর হলো। এবং মুসা হাত বের করলো আর তৎক্ষণাৎ তা দর্শকদের দৃষ্টিতে শুভ্র উজ্জ্বল প্রতিভাত হলো। ফিরআউন তার পরিষদবর্গকে বললো, এ তো সুদক্ষ যাদুকর।” (সূরাহ আশ-শুয়ারা, ২৬ : ৩০-৩৪)
উক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুসা আলাইহিস সালাম’কে প্রদত্ত মুজিযাকে “স্পষ্ট ব্যাপার” (بشيء مبين) তথা প্রমাণ বলে উল্লেখ করেছেন এবং ফিরআউনও সেটিকে তার নবুওয়াতের দাবীর সত্যতার প্রমাণ হিসেবে উপস্থিত করার জন্য আহবান করেছে। এরপর মুসা আলাইহিস সালাম তার নবুওয়াতের দাবীর সত্যতার প্রমাণ হিসেবে তাকে প্রদত্ত মুজিযা পেশ করেছেন।

(৫) নবী ও রাসুলগণকে প্রদত্ত মুজিযা তাদের নবুওয়াত ও রিসালাতের দাবীর সত্যতার প্রমাণস্বরূপ – এ কথা স্বয়ং আল্লাহ তাআলা মুসা আলাইহিস সালাম’কে প্রদত্ত দুটো মুজিযা সম্বন্ধে স্পষ্টত বলেছেন। যেমন – “আরো বলা হলো, তুমি তোমার লাঠি নিক্ষেপ করো; এরপর সে যখন সেটাকে সাপের মতো ছুটাছুটি করতে দেখলো তখন পিছনের দিকে ছুটতে লাগলো এবং ফিরিয়ে তাকালো না; তাকে বলা হলো, হে মুসা, সামনে এসো, ভয় করো না, তুমি তো নিরাপদ। তোমার হাত তোমার বগলে রাখো, এটি বের হয়ে আসবে শুভ্র সমুজ্জ্বল নির্দোষ হয়ে; ভয় দূর করার জন্য তোমার হাত দুটো নিজের দিকে চাপিয়ে ধরো; এ দুটো তোমার প্রতিপালক প্রদত্ত প্রমাণ, ফিরআউন ও তার পরিষদবর্গের জন্য; তারা তো সত্যত্যাগী সম্প্রদায়।” (সূরাহ আল-কাসাস, ২৮ : ৩১-৩২)

অতএব, কুরআনের এ জাতীয় সুস্পষ্ট প্রমাণ বর্তমান থাকার পর “মুজিযা প্রমাণ না নিদর্শন” – এ বিষয়ে কোনরূপ মতবিরোধ ও দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবকাশ নেই।

মুজিযার সত্যতা প্রতিষ্ঠা
হিজরি দ্বিতীয় শতাব্দীর সূচনাক্ষণ পর্যন্ত ইসলামী আকাইদ ও মুজিযা সম্পর্কে বুদ্ধিবৃত্তিক কোন বিতর্কের সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু হিজরি দ্বিতীয় শতাব্দীর মধ্যভাগে যখন গ্রীক দর্শন সম্বলিত গ্রন্থাবলীর আরবী তরজমা মুসলমানদের মধ্যে বিস্তৃতি লাভ করে, তখন এটা ইসলামের ইলমে কালাম তথা আকাইদ তর্কশাস্ত্রের একটি প্রয়োজনীয় বিষয় হিসেবে রচিত হয় এবং এ সমস্ত যুক্তি-তর্কের গুরুত্ব এতোই বৃদ্ধি পায় যে, তখন এই গ্রীক দর্শনের কষ্টিপাথরে যাচাই ছাড়া কোন বিষয়ই গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হতো না।

গ্রীসের অধিবাসীরা আল্লাহ প্রদত্ত শরীআত সম্বন্ধে পরিচিত ছিল না। তারা ছিল পৌত্তলিক। এজন্য তারা নবুওয়াত, নবুওয়াতের বৈশিষ্ট্য, ওহী, ইলহাম ও মুজিযা সম্পর্কেও ছিল সম্পূর্ণ অজ্ঞ ও অপরিচিত। এ কারণে গ্রীক দর্শনে এ সমস্ত বিষয়ের কোন আলোচনাই স্থান পায়নি। এ প্রসঙ্গে আল্লামা ইবন রুশদ তার “তাহাফাতুত তাহাফুত” নামক গ্রন্থে বিস্তৃত বিশ্লেষণ পেশ করেছেন। আল্লামা ইবন তাইমিয়াও নিজ রচনাবলীতে এ প্রসঙ্গে বিক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করেছেন। তবে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন মুসলিম দার্শনিক শায়খ ইয়াকুব আল-কিন্দী। তার পর দার্শনিক ফারাবীও এ সম্পর্কে যথেষ্ট লেখালেখি করেছেন। তিনি মুজিযা সম্পর্কে লিখেছেনঃ নবুওয়াতের অধিকারী সত্তার রূহের মধ্যে এক ধরণের পবিত্র শক্তির বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। যেমন তোমাদের দেহের মধ্যে তোমাদের প্রানশক্তি রয়েছে এবং তোমাদের দেহ তোমাদের রূহের অনুগত হয়ে থাকে, অনুরূপ সেই পবিত্র শক্তিসম্পন্ন রূহ সার্বিকভাবে বিশ্বের অবয়বধারী বস্তুনিচয়ের মধ্যে ক্রিয়াশীল আছে এবং সমগ্র বিশ্বজগৎ তার প্রতি আনুগত্য ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে এবং এ কারণেই পবিত্র রূহানী শক্তিসম্পন্ন সত্তা থেকে সহজাত স্বভাবের অতীত কর্মকাণ্ড প্রকাশ পেয়ে থাকে। এটাই মুজিযা। (দ্রষ্টব্যঃ সিরাতুন্নবী, ৪খ.)

“যে কোন বস্তুর সহজাত স্বভাবের অতীত কর্মকাণ্ডের নাম মুজিযা” – কথাটির ব্যাখ্যা এই যে, প্রত্যেক বস্তুর এমন কিছু বৈশিষ্ট্য ও নিয়মতান্ত্রিকতা আছে, যা তা থেকে কখনো পৃথক হয় না। যেমন, আগুনের সহজাত বৈশিষ্ট্য হলো ভস্মীভূত করা, সমুদ্রের সহজাত বৈশিষ্ট্য হলো প্রবাহিত থাকা, বৃক্ষের সহজাত স্বভাব হলো স্থির থাকা, পাথরের বৈশিষ্ট্য হলো চলতে না পারা, মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য হলো মৃত্যুর পর পুনরায় দুনিয়াতে জীবিত না হওয়া ইত্যাদি। এখন যদি এমন হয় যে – আগুন ভস্মীভূত করেনি, সমুদ্র স্থির হয়ে রয়েছে ও প্রবাহ নেই, পাথর চলতে শুরু করেছে আর কথা বলতে আরম্ভ করেছে, মৃত জীবিত হয়ে গিয়েছে – তাহলে বলতে হবে যে, এটি পৃথিবীর স্বাভাবিক নিয়মকে বিলুপ্ত করে দিয়েছে। এটা সেই বস্তুর সহজাত কার্যকরণ সম্পর্কের সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে, প্রাকৃতিক নিয়মাবলীকে পরিবর্তন করে দিয়েছে। এখন স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে যে, পৃথিবীর বস্তুনিচয়ের এই সহজাত নিয়মাবলী কি পরিবর্তনযোগ্য? দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিকদের একটি দলের অভিমত এই যে, বস্তুনিচয়ের সহজাত নিয়মতান্ত্রিকতার কোনরূপ পরিবর্তন সম্ভব না। এই ভিত্তিতে তারা মুজিযার অসম্ভাব্যতা প্রতিপন্ন করার প্রয়াস পান। মুসলিম দার্শনিকদের একটি শ্রেণীও এই অভিমত সমর্থন করেছেন। যেমন ফারাবী, ইবন সিনা, ইবন মিসকাওয়ায়হ প্রমুখ। (দ্রষ্টব্যঃ সিরাতুন্নবী ৪খ.)

ইবন তাইমিয়্যা তার”রাদ্দুল মানতিক” নামক গ্রন্থে এবং ইবন হাযম জাহিরী তার “আল ফিসাল ফিল মিলালি ওয়ান নিহাল” নামক গ্রন্থে ফারাবী, ইবন সীনা প্রমুখ দার্শনিকের অভিমতকে পরিত্যাজ্য বলে সাব্যস্ত করেছেন। কারণ “প্রকৃতির সহজাত নিয়মাবলীর পরিবর্তন সম্ভব নয়” কথাটি বাস্তবসম্মত না। দৃষ্টান্তস্বরূপ, কোন প্রাণীর জন্মের প্রাকৃতিক নিয়ম হলো, এক ফোঁটা বীর্য থেকে রক্ত উৎপন্ন হয়, রক্ত থেকে গোশত উৎপন্ন হয়, এরপর পর্যায়ক্রমে একটি নির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত তা মাতৃ উদরে প্রতিপালিত হয়, ফলে তা পরিণত হয় একটি পূর্ণাঙ্গ দেহাবয়বে। এরপর তা নবজাত শিশুরূপে ভূমিষ্ঠ হয় এবং পর্যায়ক্রমে শিশুরূপ ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে এবং পরবর্তীতে সুস্থ, সুডৌল দৈহিক কান্তির অধিকারী একজন শৌর্য-বীর্য সমৃদ্ধ যুবকে রূপান্তরিত হয় এবং তার স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের বিকাশ ঘটায়।

এই হলো একজন মানুষের জন্মের সহজাত প্রাকৃতিক নিয়ম। এখন এই নিয়ম ভঙ্গ করে অর্থাৎ অন্তর্বর্তীকালীন পর্যায়সমূহ অতিক্রম করা ছাড়া কারো পক্ষে সুদেহী প্রাণী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করাও সম্ভব, মোটেও অসম্ভব না। এ ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিকদের বক্তব্য এই যে, এক ফোঁটা বীর্য রক্তে রূপান্তরিত হতে, এরপর গোশতে, এরপর অস্থি-মজ্জায় ও সুডৌল-সুঠাম থেকে অন্তর্বর্তীকালীন যে পর্যায়গুলো অতিক্রম করার আবশ্যকতা রয়েছে, তা যদি কোনভাবে পূরণ করে দেওয়া যায়, তাহলে উক্ত অন্তর্বর্তীকালীন পর্যায়গুলো অতিক্রম করা ছাড়াই এক ফোঁটা বীর্য একটি সুঠাম-সুডৌল দেহে রূপান্তরিত হতে পারে। আধুনিক কালে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে স্বল্প সময়ে নানান ফসলাদির উৎপাদন বিজ্ঞান প্রকৃতির নিয়ম ভঙ্গের প্রকৃষ্ট উদাহারন নয় কি?

কিছু দার্শনিক মনে করেন, পৃথিবীর ঘটনাবলী কোন না কোন প্রাকৃতিক কার্যকরণ দ্বারাই সংঘটিত হয়ে থাকে। কিন্তু সহজাত প্রকৃতির অতীত কর্মকাণ্ডে এই কার্যকারণ অনুপস্থিত। এই ভিত্তিতেও তারা মুজিযা অস্বীকার করার প্রয়াস পান। এর সমাধান এই যে, হ্যা, যাবতীয় ঘটনার পিছনে কোন না কোন কার্যকারণ ক্রিয়াশীল রয়েছে। কিন্তু এটা তো জরুরী নয় যে, সকল ধরণের প্রাকৃতিক কারণসমূহ আমরা আমাদের জ্ঞান ও মনীষা দ্বারা সার্বিকভাবে অনুধাবন করতে সক্ষম হবো? কিছু কিছু কার্যকারণ এমনও রয়েছে, যা অতিশয় প্রচ্ছন্ন ও সূক্ষ্ম হওয়ার দরুন স্বভাবত মানুষের জ্ঞান ও মনীষা তা অনুধাবন করতে সক্ষম হয় না। এ পৃথিবীতে অসংখ্য অগণিত সৃষ্টি রয়েছে যার সূক্ষ্ম রহস্যটির যৎসামান্যই মানুষের পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব হয়েছে। আবার বহু সংখ্যক এমনও আছে যে, তার কার্যকারণের গুঢ় রহস্য আজও অজানার পর্দার অন্তরালেই রয়ে গেছে। যেমন, নবী-রাসুলগণ চল্লিশ দিন পর্যন্ত একটানা সিয়াম সাধনা করেছেন। এ সময়ের মধ্যে তারা সামান্যতম আহার্য-পানীয় গ্রহণ করেননি। কিন্তু এতেও তাদের শারীরিক শক্তির মধ্যে কোনই পরিবর্তন দেহা দেয় নি। এটা স্পষ্টত আশ্চর্যজনক বিষয়। কিন্তু এ ঘটনাও কার্যকারণ থেকে পৃথক নয়। কেননা, আমরা যদি অনুসন্ধান করি, মানুষের ক্ষুধার তাড়না দেখা দেয় কেন, তাহলে দেখা যাবে যে, মানুষের উদরস্থ হজমশক্তি ভক্ষিত খাদ্যকণাকে পরিপূর্ণরপে হজম করার পর তা থেকে উদ্ভূত রক্ত কনিকাগুলোকে দেহের বিভিন্ন অংশে পৌঁছিয়ে দেয়। তার উদরস্থ হজম শক্তির আর কোন কাজ অবশিষ্ট থাকে না, যার ফলে তার মধ্যে তালাশ করার প্রবণতা প্রবল হয়ে উঠে। এরই ফলে মানুষ ক্ষুধার তাড়না অনুভব করে থাকে।

কিন্তু আমরা চলমান জীবনে এমন অভিজ্ঞতারও সম্মুখীন হই যে, কোন রোগের কারণে অথবা ভয়ভীতির কারণে অথবা গভীর চিন্তায় নিমগ্ন থাকার কারণে আমাদের দেহে এমন এক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়, যার প্রভাবে দীর্ঘ কয়েক দিন পর্যন্ত আমাদের পাকস্থলীর হজমশক্তি লোপ পেয়ে যায়। এর ফলে আমরা ক্ষুধার তাড়না অনুভব করি না। ঠিক একই নীতির ভিত্তিতে যদি কোন ব্যক্তির মধ্যে আধ্যাত্মিকতার সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠে এবং দৈহিক অবস্থার সাথে তার সম্পর্ক শিথিল হয়, এমতাবস্থায়ও তার শারীরিক শক্তির মধ্যে স্থবিরতা বা শক্তিহীনতা দেখা দিতে পারে। এ ক্ষেত্রেও সে কয়েক দিন পর্যন্ত উপবাস থাকতে পারে।

মোটকথা, আধ্যাত্মিক শক্তির সাথে যখন গভীর সম্পর্ক স্থাপিত হয়, তখন দৈহিক স্বাভাবিক গতিবিধি ও কার্যক্রমের মধ্যে নিস্পৃহ ভাব দেখা দেয়। এই নাজুক লগ্নেও মানুষ দীর্ঘদিন পর্যন্ত উপবাস করে বেঁচে থাকতে পারে। সুতরাং এই সহজাত প্রকৃতির বরখেলাপ কার্যপ্রবাহকে যদি স্বীকার করে নিতে কষ্ট না হয়, তাহলে অতি প্রকৃত আধ্যাত্মিক শক্তির পরিপূর্ণ বিকাশ মুজিযাসমূহকে অস্বীকার করার কোনই কারণ থাকতে পারে না। (সিরাতুন্নবী, ৪খ.)

বস্তুত কার্যকারণ সম্পর্কের উপর সর্বাঙ্গীণ অভিজ্ঞতা মানুষের নেই। মানুষ যা কিছু জানার সুযোগ লাভ করেছে, তার তুলনা বিশাল সমুদ্রের এক ফোঁটা পানি অথবা তা থেকেও স্বল্প ও ক্ষীণ। উপরন্তু মানুষ যা কিছু জানার ও অনুধাবন করার সুযোগ পেয়েছে, তাও পৃথিবীর কিছু বস্তুর চলমান গতি-প্রকৃতির সামান্য নিরীক্ষা মাত্র। তার হাকিকতও প্রকৃত জ্ঞান নয়। মানুষ জ্ঞানের এই সীমানায় পৌঁছতে অক্ষম যে, বস্তুটি কেন চলছে আর যদি বস্তুটি বিপরীত দিকে চলতো তাহলে কি কি অসামঞ্জস্য প্রকাশ পেতো? এ কারণেই পৃথিবীর স্বনামধন্য বৈজ্ঞানিকগণ একবাক্যে এ কথা স্বীকার করে নিয়েছেন যে, তারা কেমন প্রশ্নটির উত্তর দিতে সক্ষম, কিন্তু কেন প্রশ্নটির যথার্থ উত্তর দেওয়া তাদের আলোচ্য বিষয়ের বাইরে। উদাহারনস্বরূপ বলা যায়, পানি কেমন? এর উত্তর বৈজ্ঞানিকগণ তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু পানি কেমন? এই প্রশ্নের উত্তর তারা দিতে পারেননি, এমনকি এই প্রশ্নের আলোচনাও তারা করেননি।

প্রকৃত সত্য এই যে, দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিকগণ কার্যকারণ সম্বন্ধে যে মতাদর্শ দৃঢ়ভাবে আঁকড়িয়ে ধরেছেন, বস্তুত এটির পরিণতি অজ্ঞতা ও বুদ্ধিহীনতা বৈ কিছু নয়। কারণ তাদের বিশ্বাস যে, এই বস্তুটি এই কার্যকারণ ও উপাদানে সৃষ্টি হয়েছে। এটি ছাড়া এই বস্তুটি অস্তিত্বে আসতেই পারে না। যেমন বীর্য থেকে প্রাণের উৎপত্তি, ডিম থেকে পাখির উৎপত্তি, উদ্ভিদের উৎস বীজ, তাদের বিশ্বাসের এই সমস্ত উপাদান ছাড়া এসব বস্তু অস্তিত্বে আসার কথা কল্পনাও করা যায় না। এখানে আমাদের প্রশ্ন যে, দুনিয়ার প্রথম প্রাণী, প্রথম পাখি এবং প্রথম উদ্ভিদ কি বীর্য, ডিম ও বীজ ছাড়াই সৃষ্টি হয়েছে? এর উত্তরে যদি তারা “হ্যা” বলেন, তাহলে তো তারা নিজেদের দাবী ও মতাদর্শের বিপরীত সাক্ষ্য প্রদান করবেন। আর যদি এটা অস্বীকার করেন, তাহলে এ কথাও তাদেরকে অবশ্যই স্বীকার করে নিতে হবে যে, প্রথম বীর্য, প্রথম ডিম ও প্রথম বীজ, প্রাণী, পাখী, উদ্ভিদ ছাড়াই সৃষ্টি হয়েছে।

মোটকথা, এই লক্ষ্যমাত্রাকে কখনো বিজ্ঞান তার বুদ্ধির শাণিত অস্ত্র দ্বারা নির্মূল করতে পারবে না। এমতাবস্থায় কার্যকারণ সম্পর্কিত কিছু দর্শন ও মতাদর্শ তাদেরকে অবশ্যই পরিহার করতে হবে। পাশাপাশি তাদেরকে এ কথারও স্বীকৃতি দিতে হবে যে, এক মহাশক্তিমান ইচ্ছাশক্তির অস্তিত্ব অবশ্যই বর্তমান রয়েছে, যার ইচ্ছা ও নির্দেশে বিশ্বজগতের এই কারখানা পরিচালিত হচ্ছে। উপরন্তু তাকে এ কথাও মেনে নিতে হবে যে, কার্যকারণ সম্পর্কে সেই মহান শক্তিমান সত্তার ইচ্ছা এবং নির্দেশ বিকাশের বাহ্যিক দৃষ্টান্ত ছাড়া অতিরিক্ত আর কিছু না। বস্তুত কার্যকারণও তার সার্বভৌম ইচ্ছার অধীন। পবিত্র কুরআনে এ কথাই বিবৃত হয়েছেঃ
“……. জেনে রাখো, সৃজন ও আদেশ তারই; মহিমাময় বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহ।” (সূরাহ আল-আরাফ, ৭: ৫৪)
সুতরাং বিশ্বজগতের সবকিছুর পিছনে আল্লাহ’র কুদরত এবং তার ইচ্ছাই হলো মূল কারণ।

আল্লামা রুমী বলেছেন, বাহ্যিক কারণসমূহের উপর হাকীকী ও মৌলিক কারণসমূহের নিয়ন্ত্রাণাধিকার থাকে। সুতরাং হে দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ, তোমরা বাহ্যিক কারণসমূহ দেখে অভিভূত হয়ো না, বরং হাকীকী ও মৌলিক কারণসমূহ সম্পর্কেও গভীর চিন্তা-গবেষণা করো। কেননা, নবীগণ বাহ্যিক কারণ ও উপাদান সম্পর্ককে পরিহার করে নিজেদের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যান এবং আল্লাহ প্রদত্ত মুজিযা ও অলৌকিক শক্তির ঝাণ্ডা সর্বত্র সমুন্নত করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। তাই দেখা যায়, কোন কার্যকারণ সম্পর্ক ছাড়াই তারা গহীন সমুদ্রকে দ্বিধাবিভক্ত করে নিজেদের চলার পথ রচনা করেন এবং কৃষিক্ষেত-খামার ছাড়াই গম ও যবের ফসল লাভ করেন। এমনকি পবিত্র কুরআনে যে দিকনির্দেশনা মূর্ত হয়ে উঠেছে, তাও এই যে, কার্যকারণ সম্পর্ক শক্তিহীন ও নিষ্ক্রিয়। এজন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে বিজয়ী হয়েছেন এবং তারই (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পার্শ্বে আবু জাহল হয়েছে ধ্বংস। এভাবে ক্ষুদ্র আবাবিল পাখীর প্রস্তর খণ্ডে আবিসিনিয়ার হস্তিবাহিনী হয়েছে পর্যুদস্ত। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রস্তর কণা আবাবীলের চঞ্চু থেকে নিক্ষিপ্ত হতো হস্তিবাহিনীর উপর, ফলে দীর্ণ-বিদীর্ণ এবং ঝাঁজরা করে দিতো চর্বিত তৃণলতার মতো।

মোটের উপর পবিত্র কুরআনে আগাগোড়া এ কথাই তুলে ধরা হয়েছে যে, কার্যকারণ সম্পর্কিত চলমান দুনিয়ার বাহ্যিক কারণের মধ্যে কোনই মৌলিক ক্ষমতা ও শক্তি নেই। মূল কার্যকারণের নিয়ন্ত্রণকারী মহান আল্লাহ নিজ ইচ্ছানুসারে বাহ্যিক কার্যকারণের মধ্যে কখনো কখনো কার্যকরী শক্তি ও ক্ষমতার বিকাশ ঘটিয়ে থাকেন। তথাপি এই বিকাশ কারণসম্ভুত নয়, বরং আল্লাহ প্রদত্ত গুণাবলীর বাহ্যিক প্রতিফলন মাত্র। (মসনবী)

এ পর্যন্ত আমরা যা কিছু আলোচনা করেছি তার সারমর্ম এই যে, সহজাত স্বভাবকে এবং কার্যকারণ সম্পর্কের নিয়মতান্ত্রিকতাকে সর্বতোভাবে পরাজিত করা নাম হচ্ছে মুজিযা, যা মহান আল্লাহ নিজ মনোনীত পয়গাম্বরের সত্যতার প্রমাণস্বরূপ মানুষের সম্মুখে প্রকাশ করে থাকেন। দ্বিতীয় কথা এই যে, সহজাত স্বভাবের বিপরীত কোন কিছু সংঘটিত হওয়া এবং কার্যকারণ সম্পর্কের বাঁধন ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হওয়া খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু স্মরণ রাখতে হবে যে, কোন বিষয়ের জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্ভাব্যতা তার কার্যত সংঘটিত হওয়ার দলীল বহন করে না, বরং কোন বিষয়ের কার্যত সংঘটিত হওয়াকে কবুল করার জন্য নিন্মোক্ত শর্তাবলীর উপস্থিতি অপরিহার্য –
(১) বর্ণনাকারীর সন্দেহাতীত প্রত্যক্ষ করা এবং গ্রহণযোগ্য সাক্ষ্যপ্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া;
(২) বর্ণনাকারীর সত্যবাদী হওয়া এবং তার স্মৃতিশক্তি তীক্ষ্ণ ও সূক্ষ্ম হওয়া, তার মধ্যে প্রতারণা ও প্রবঞ্চনার প্রবণতা না থাকা;
(৩) বর্ণনাটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সমগুণ সম্পন্ন বর্ণনাকারীদের দ্বারা বিবৃত হওয়া;
(৪) উপরন্তু এই প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা ও প্রাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ অবিচ্ছিন্ন ধারায় সকল যুগের নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীদের সূত্র-পরম্পরায় সংরক্ষিত হয়ে আমাদের পর্যন্ত পৌঁছা।

এখন উল্লিখিত নীতি ও মানদণ্ডের আলোকে আমাদের দেখতে হবে যে, হাদিস, ইতিহাস ধর্মীয় কিতাবাদিতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যে সমস্ত মুজিযার বর্ণনা লিপিবদ্ধ রয়েছে, তাতে উপরোক্ত শর্তানুসারে দলীল-প্রমাণ ও সাক্ষ্য পাওয়া যায় কিনা?

আমাদের উসুলে হাদিসে প্রত্যেকটি রিওয়ায়াত গ্রহণ করার জন্য উপরে উল্লিখিত নীতিসমূহকে পূর্বশর্তরূপে নির্ধারণ করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুজিযাত সম্পর্কে যে সকল সাহাবী প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য প্রদান করেছেন, তাদের সত্যবাদিতা, জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তা, স্মরণশক্তি ও সুষ্ঠ বিচার-বিশ্লেষণী প্রতিভার প্রমাণ সর্বজন স্বীকৃত। তাদের কাছ থেকে পরবর্তী সময়ে যে সমস্ত মুহাদ্দিসীনে কেরাম উক্ত বর্ণনাসমূহ নকল করেছেন তাদের সত্যবাদিতা, জ্ঞান-বুদ্ধি ও তীক্ষ্ণ ধীশক্তির কথা আসমাউর রিজাল এর কিতাবসমূহে বিস্তারিতভাবে সুসংরক্ষিত রয়েছে। উপরন্তু তাদের সামনে সর্বদা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই সতর্ক হুঁশিয়ারি বারবার ঝংকৃত হতো – “যে ব্যক্তি আমার প্রতি মিথ্যা আরোপ করে, তার ঠিকানা হবে দোযখ।” (মুসলিম, ১খ.)

এ কারণে তারা যখনই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সম্পর্কিত কোন বক্তব্য রিওয়ায়াত করতেন, তখন পরিপূর্ণ মানবিক সচেতনতা এবং বিশেষ বিবেচনার সাথে তা বর্ণনা করতেন। তবে যেহেতু প্রকৃতিগতভাবে সকলের সচেতনতা ও স্মৃতিশক্তি সমান নয়, সেহেতু সার্বিক সতর্কতা আর মনোনিবেশের পরও সকলের বর্ণনা একই মূল্যমানের হওয়া সম্ভব ছিল না। এ কারণে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সম্পর্কিত মুজিযার বর্ণনাসমূহ নির্ভরযোগ্যতার মাত্রা বা স্তর বিবেচনায় কম-বেশী হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার ছিলো, কিন্তু আমাদের সচেতন মুহাদ্দিসীনে কেরাম অক্লান্ত পরিশ্রম ও পরিপূর্ণ আমানতদারির সাথে নিরপেক্ষ বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে দুর্বল বর্ণনাসমূহকে সহিহ বর্ণনাসমূহ থেকে পৃথক করতে সক্ষম হয়েছেন এবং এই মানদন্ডের দ্বারা সত্যতা ও যথার্থতা প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

সারকথা এই যে, মুজিযার সত্যতা প্রমাণ ও প্রতিষ্ঠার জন্য প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্যপ্রমাণ বিদ্যমান থাকা একান্ত জরুরী। সহিহ মুজিযাতই পরবর্তী সাক্ষ্য-প্রমাণ সম্বলিত রিওয়ায়াতসমূহ এতোই মজবুত ও সুদৃঢ় যে, দুনিয়ার কোন বর্ণনা তার মুকাবিলা করতে সক্ষম না। এর ফলে মুজিযার অকাট্যতা আর সহজাত প্রকৃতির বহির্ভূত কর্মকাণ্ডের বাস্তবতাকে কেউই অস্বীকার করতে পারে না।


সূত্রঃ সিরাত বিশ্বকোষ – একাদশ খণ্ড (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ)