মুজিযা, কারামাত ও ইসতিদরাজ – ৪র্থ পর্ব

মুজিযা ও কারামাতের মধ্যে পার্থক্য
মুজিযা নিয়ে আলোচনা পূর্বেই হয়ে গেছে। এখন কারামাত বলতে কি বুঝায় এবং মুজিযা ও কারামাতের পার্থক্য তুলে ধরা হবে।
কারামাত (كرامة) শব্দটি (كرم) ধাতুমূল থেকে গঠিত হয়েছে। এর অর্থ – উদার, দয়ালু, সম্মানিত হওয়া। আল্লাহ পাকের অসংখ্য গুণবাচক নামের মধ্যে “কারীম” একটি গুণবাচক নাম। আল-কুরআনে এটি একাধিকবার ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ পাক সেখানে আল-কারীম (الكريم) অর্থাৎ উদার বা দয়ালু নামে আখ্যায়িত হয়েছেন। তবে কারামাত বলতে যা বুঝায়, আল-কুরআনে উল্লিখিত আল-কারীম শব্দ তা বুঝায় না।

কারামাত (كرامة) শব্দটির বহুবচন কারামাত (كرامات)। ধর্মীয় পরিভাষায় এর অর্থ – আল্লাহ’র দেওয়া দান, যা সম্পূর্ণ মুক্ত, অবারিত অনুগ্রহ (ইহসান বা ইনআম)। তবে যথাযথ ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে এভাবে যে, আল্লাহ তাআলা অনুগ্রহপূর্বক তার প্রিয়জনদেরকে অলৌকিক ঘটনা সম্পাদন করার যোগ্যতা প্রদান করে থাকেন। আর তারাও আল্লাহ পাকের অনুকম্পাসিক্ত হয়ে অলৌকিক ঘটনা প্রকাশ করেন। এটিই কারামাত নামে অভিহিত। এ সমস্ত ঘটনা সাধারণত বস্তুজগতে সংঘটিত বিস্ময়কর ঘটনার সমন্বয়ে ঘটিত নতুবা ভবিষ্যতের কোন পূর্ব সংকেতস্বরূপ অথবা আধ্যাত্মিক বিষয়ের কোন ব্যাখ্যাস্বরূপ। (ইসলামী বিশ্বকোষ, ৭ম খ.)

মুজিযা ও কারামাতের সংজ্ঞা থেকে এ কথা সুস্পষ্ট যে, মুজিযা ও কারামাতের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য আছে। তবে আউলিয়ায়ে কিরামগণের দ্বারা কারামাত প্রকাশ পাওয়া আদৌ সঠিক কিনা, সে ব্যাপারে আলিমগণ মতভেদ করেছেন।

মুতাযিলি মতবাদঃ অধিকাংশ মুতাযিলি সম্প্রদায় কারামাতের বাস্তবতাকে অস্বীকার করে। তাদের প্রসিদ্ধ যুক্তি, যা আল-কুরআনের সুপ্রসিদ্ধ ভাষ্যকার জারুল্লাহ যামাখশারী কর্তৃক ৭২ : ২৬-২৭ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় আলোচিত হয়েছে। আল্লাহ বলেন- “তিনি অদৃশ্যের পরিজ্ঞাতা, তিনি তার অদৃশ্যের জ্ঞান কারো কাছে প্রকাশ করেন না; – তার মনোনীত রাসুল ব্যতীত, সে ক্ষেত্রে আল্লাহ রাসুলের অগ্রে ও পশ্চাতে প্রহরী নিয়োজিত করেন।” (সূরাহ আল-জিন্ন, ৭২ : ২৬-২৭)
আল-কুরআনের এ আয়াত থেকে যামাখশারী বুঝাতে চান যে, আল্লাহ তাআলা তার প্রেরিত নবীগণের মিশনের সত্যতা সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে তাদের দ্বারা প্রকাশ্যভাবে বিভিন্ন রকমের অলৌকিক ব্যাপার প্রকাশ করেন, কিন্তু অন্য সকল অতি-প্রাকৃত ঘটনা তিনি সৃষ্টির অগোচরে সম্পন্ন করেন। আল জুব্বাঈ বলেন, ওয়ালীগণ যদি এই ক্ষমতার অধিকারী হোন তাহলে কিভাবে তাদেরকে নবীগণ থেকে পৃথক করা যাবে? এভাবে মুতাযিলি সম্প্রদায় কারামাতের যথার্থতা অস্বীকারের ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেন।

দার্শনিকগণের অভিমতঃ দার্শনিক ইবনে সীনার দৃষ্টান্ত থেকে কারামাতের স্বীকৃতি পাওয়া যায়। তার সৃষ্টিতত্ত্ব “অপরিহার্য ও আত্মসচেতন ইচ্ছাসম্পন্ন” উদ্ভবের অস্তিত্বমূলক অদৃষ্টবাদের মধ্যে মুজিযাত ও কারামাতকে তিনি স্থান দিয়েছেন। নবীগণ তাদের মানবীয় প্রকৃতির পরিপূর্ণতা ও বাহ্যিক বস্তুনিচয়ের উপর প্রকৃতিগত আত্মিক প্রভাবেই মুজিযা দ্বারা তাদের আগমনকে সুনিশ্চিত করে থাকেন। উল্লেখ্য যে, ইবন রুশদ তার “তাহাফুতুত তাহাফুত” গ্রন্থে (সম্পা. Bouyes, 515) একটি পার্থক্য উল্লেখ করেছেন। তা হলো, যার মধ্যে গুনগত পার্থক্য নিহিত শুধু সেগুলোই অলৌকিক ঘটনা। কারণ সাধারণ মানুষের পক্ষে তা অসম্ভব হলেও প্রকৃতপক্ষে তা সম্ভব। তার রিসালা ফি আকসামিল উলুম গ্রন্থে (তিসউর রাসাইলের অন্তর্ভুক্ত, কায়রো সংস্করণ, ১৩২৬/১৯০৪)

ইবনে সিনা বলেন, কারামাত প্রকৃতিগতভাবে মুজিযার সমার্থক। তার ইশারাত গ্রন্থে (সম্পা. Foger Leiden, ১৮২০ খৃ.) তিনি এ কথা সমর্থন করেন যে, আধ্যাত্মিক গভীরতার কল্যাণে যার আত্মা জাগতিক বস্তুর উপর প্রভাবশীল এবং যিনি এই প্রভাব কল্যাণকর ও নীতিসিদ্ধ পন্থায় ব্যবহার করেন, যদি তিনি নবী হোন তাহলে আল্লাহ’র দান হিসেবে তিনি তা লাভ করেন, সেটিই মুজিযা। আর যদি তিনি ওলী হোন, তাহলে তিনি কারামাতের সৌভাগ্য অর্জন করেন। নবীগণ নবুওয়াতপ্রাপ্ত হোন আল্লাহ’র প্রতি তাদের প্রকৃতিগত সহজাত প্রবৃত্তি, প্রজ্ঞার ত্রিবিধ পরিপূর্ণতা, চিন্তাশক্তি ও কঠোর সত্যনিষ্ঠার মাধ্যমে, যদিও সেই সাধনা বা মুজিযা নিম্ন মানের হয়। (ইসলামী বিশ্বকোষ, ৭ম খ.)

আশআরী সম্প্রদায়ের জবাবঃ ধারণা করা হয়, কিছু সংখ্যক আশআরী, যেমন – আল ইসফারাইনী, আল হালিমী প্রমুখ কারামাত প্রসঙ্গে মুতাযিলি সম্প্রদায়ের জোরালো মতামত বা বিচার-বিবেচনাকে সমর্থন করে। তবে আশআরী সম্প্রদায়ের সাধারণ মতবাদের যথার্থতা নিন্মে বর্ণিত যুক্তির ভিত্তিতে স্বীকৃত –

(ক) বুদ্ধিবৃত্তিক সম্ভাব্যতাঃ কোন নবীর নৈতিক পরিপূর্ণতার নিদর্শন কোন অলৌকিক ঘটনা বা মুজিযা অহেতুক না, বরং তা আল্লাহ পাকের সদিচ্ছা বা কার্যকর ইচ্ছা। তিনি তার সেই ইচ্ছাকে একজন নবীর মাধ্যমে সম্পাদন করে থাকেন। সেই অলৌকিক কাজটি সম্পাদিত হয় কোন ঘোষণা বা চ্যালেঞ্জের মুকাবিলায়। সুতরাং আল্লাহ পাকের পক্ষে কোন বিজ্ঞপ্তি বা চ্যালেঞ্জ ছাড়াই কোন সাধকের মাধ্যমে অতি প্রাকৃত কোন ঘটনা ঘটানো বৈধ বা জায়েজ।

(খ) আল-কুরআনের সমর্থনঃ এমন কতগুলো ঘটনার অস্তিত্ব দিবালোকের মতো দেদীপ্যমান ও যথার্থ বলে প্রমাণিত, কুরআন মাজিদে যা উল্লেখ হয়েছে, যার ধারকগণ কোন নবুওয়াতের দাবীদার ছিলেন না, যেমন –
“….. যখনই যাকারিয়া কক্ষে তার সাথে সাক্ষাৎ করতে যেতো, তখনই তার কাছে খাদ্য-সামগ্রী দেখতে পেতো; সে বলতো, এসব তুমি কোথায় পেলে? সে বলতো, তা আল্লাহ’র কাছ থেকে, নিশ্চয়ই আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অপরিমিত রিযিক দান করেন।” (সূরাহ আলি ইমরান, ৩ : ৩৭) সন্দেহাতীতরূপে ঘটনাটি ছিল বিস্ময়কর, অলৌকিক। ঈসা আলাইহিস সালামের মা মারিয়াম নিজে কোন নবী ছিলেন না, নবুওয়াতের দাবীদারও ছিলেন না, অথচ তার কাছে পাওয়া যেতো অসম মৌসুমে মৌসুমী ফল। আরো উল্লেখ হয়েছে- “তুমি কি মনে করো যে, গুহা ও রাকীমের অধিবাসীরা আমার নিদর্শনাবলীর মধ্যে বিস্ময়কর?” (সূরাহ আল-কাহফ, ১৮ : ৯)

যারা একটি পার্বত্য গুহাতে একাধারে তিনশত বছর ঘুমন্ত ছিলেন, তারা নবী-রাসুল নন, অথচ এ সকল ঘুমন্ত ব্যক্তির ঘটনা আল্লাহ’র পক্ষ থেকে অলৌকিক নিদর্শন। আরো উল্লেখ পাওয়া যায় -“কিতাবের জ্ঞান যার ছিলো, সে বললো, আপনি চোখের পলক ফেলার আগেই আমি তা আপনাকে এনে দিবো; সুলায়মান যখন তা সামনে রক্ষিত অবস্থায় দেখলেন তখন বললেন, এটি আমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ ….” (সূরাহ আন-নামল, ২৭ : ৪০)

ঘটনাটি ঘটেছিলো সুলায়মান আলাইহিস সালামের আদেশে হয় একজন জিন্ন বা কোন বিজ্ঞ ব্যক্তির মাধ্যমে (নোটঃ তাফসীরে ইবনে কাসিরে এই ব্যক্তির মানুষ হওয়ার পক্ষেই মত দেখা যায়, বিস্তারিত দেখুন তাফসীরে ইবনে কাসিরে এই আয়াতের তাফসীরে), যারা কোন নবী ছিলেন না যিনি চোখের পলকে রানী বিলকিসের বিরাট সিংহাসন এনেছিলেন অনেক দূর থেকে।

সুতরাং কারামাত সম্ভব, তাবে তাকে মুজিযার সাথে সংযুক্ত করা কোনক্রমেই সঙ্গত হবে না। আল্লাহ মুজিযা প্রকাশ করেন নবীগণের মিশনের প্রমাণস্বরূপ, আর কারামাতকে প্রকাশ করেন ওলীগণকে সম্মানিত ও তাদের ধর্মনিষ্ঠা ও তাকওয়া সংরক্ষণ মানসে। মুজিযাত সকল মানুসের সামনে প্রকাশ করা উচিৎ, তবে কারামাত গোপন করাই বিধেয়। সর্বদা দুটোর মধ্যে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পার্থক্য বজায় রাখা কর্তব্য। জেনে রাখতে হবে, যাবতীয় ঐন্দ্রজালিক বিদ্যা এটা থেকে ভিন্নতর। উল্লেখ্য যে, আশআরী মতবাদ আরো বিধৃত হয়েছে – ইবন খালদুন, মুকাদ্দিমা, অনু ৬খ. ; DE Slane, ১খ. , ৪৩খ. ; অনু. Rosenthal, ১খ. , ৯১খ. গ্রন্থসমূহে।

(গ) সূফী মনস্তত্ত্ব কর্তৃক স্বীকৃতঃ ওলীগণের কারামাত সূফী দার্শনিকগণ কর্তৃক স্বীকৃত হয়েছে। সুন্নী সূফী বিদ্যায় পারদর্শীগণ কর্তৃক প্রদত্ত ব্যাখ্যা সাধারণভাবে আশআরী মতবাদের খুবই নিকটবর্তী। এই মতবাদে কারামাত ও মুজিযার পার্থক্যের উপর বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। কোন ওলী-দরবেশ বিস্ময়কর কার্যাবলী সম্পাদন করলে তিনি সে কারণে নবী হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করতে পারেন না। তিনি তদানীন্তন রাসুল কর্তৃক প্রবর্তিত ধর্মীয় আইনের অনুশাসন মানতে বাধ্য থাকেন।

কারামাত কখনো মুজিযার প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে না, বরং মুজিযার পৃষ্ঠপোষকতা করে। মনে রাখতে হবে যে, ওলীগণের কারামাত সেই নবীর মুজিযার প্রমাণ, যে নবীর তিনি উম্মত। সে কারণে মুজিযা নবীর সত্যতার প্রতীক। আমরা দেখতে পাই, খুবাইব রাদিয়াল্লাহু আনহু’কে অবিশ্বাসীরা যখন মক্কাতে শূলীতে দেয়, তখন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনেক দূরে মদিনার মসজিদে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সহচরবৃন্দ পরিবেষ্টিত অবস্থায় উপবিষ্ট ছিলেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অন্তর্দৃষ্টিতে দেখলেন খুবাইব রাদিয়াল্লাহু আনহু’র উপর জুলুম-অত্যাচারের করুণ অবস্থা। সহচরবৃন্দকে তা সবিস্তারে অবহিত করেন। অপরদিকে আল্লাহ পাক খুবাইবের অন্তরায় দূরীভূত করেন। তিনি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র দর্শন লাভ করেন, তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সালাম পেশ করেন, তিনিও (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সালামের জবাব দেন, খুবাইব রাদিয়াল্লাহু আনহু সালামের জবাব শুনতে পান। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার জন্য দুয়া করেন। মক্কা-মদিনার মধ্যে দূরত্ব ছিল বিস্তর। তবুও তাদের মধ্যে সাক্ষাৎ, সালাম আদান-প্রদান সুনিশ্চিতরূপে অস্বাভাবিক ব্যাপার। এটি খুবাইব রাদিয়াল্লাহু আনহু’র জন্য ছিল কারামাত আর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য ছিল মুজিযা। (দাতা গনজে বখশ, কাশফুল মাহজুব)

ইসতিদরাজ
ইসতিদরাজ শব্দটি সাধিত হয়েছে “দারজ” ধাতুমূল থেকে। ইসতিদরাজ অর্থ ধোঁকা দেওয়া, প্রতারণা করা। আবার ইসতিদরাজ অর্থ নিকটবর্তী হওয়া। বলা হয়, ইসতাদরাজাল্লাহুল আবদা, অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলা ধীর গতিতে বান্দার নিকটবর্তী হলেন। এর অর্থ, বান্দা যখন নিত্য-নতুন পাপ কর্মে লিপ্ত হয়, আল্লাহ’ও তখন নতুন নতুন নিয়ামতরাশি দিয়ে তাকে পরিতুষ্ট করেন, তাকে ভুলিয়ে দেন ক্ষমা প্রার্থনা করতে। যেমন, আল্লাহ বলেছেন – “আর যারা আমার আয়াতসমূহকে মিথ্যা অভিহিত করেছে, আমি অচিরেই তাদেরকে আস্তে আস্তে এমনভাবে পাকড়াও করবো যে, তারা বুঝতেই পারবে না।” (সূরাহ আল-আরাফ, ৭ : ১৮২)

এ কারণেই উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু’র সামনে যখন বাদশাহ কিসরার ধনভাণ্ডার আনা হলো, তখন তিনি আল্লাহ’র কাছে দুয়া করেছিলেন – ইয়া আল্লাহ, ইসতিদরাজকারী হওয়া থেকে আমি আপনার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি; যেহেতু আমি আপনার ঘোষণা শুনেছি যে আপনি বলেছেন, “আমি অচিরেই তাদেরকে আস্তে আস্তে এমনভাবে পাকড়াও করবো যে, তারা বুঝতেই পারবে না”।(আল-যাবীদী, তাজুল আরুস, ৫খ.)

ধোঁকা ও প্রবঞ্চনার দ্বারা মানুষকে ধীরে ধীরে নিজের দিকে আকৃষ্ট করার প্রক্রিয়াকে আরবী পরিভাষায় ইসতিদরাজ বলে। সিহর, যাদু, ইন্দ্রজাল, সম্মোহন, ভেল্কীবাজি, নজরবন্দী ইত্যাদি পরিভাষাগত ইসতিদরাজ। যাদুকররা সম্মোহন বা ইন্দ্রজালের দ্বারা মানুষকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করে। আস্তে আস্তে মানুষ তাদের খপ্পরে পড়ে।

অস্বাভাবিক কার্যকলাপ দিয়ে মানুষকে প্রতারণা করে। ফলে এটিও অলৌকিক মুজিযা বা কারামাতের পর্যায়ে বিবেচিত হয়, তবে এটি শরীআত সমর্থিত না। মুফতি মুহাম্মাদ ইউসুফ বলেন, যে অস্বাভাবিক ক্রিয়া-কর্ম কোন ফাসিক পাপী বিধর্মী কাফির থেকে প্রকাশ পায়, তাকে প্রতারণা বা ইসতিদরাজ বলে। একজন ফাসিক ফাজির থেকে এ রকম অলৌকিক কাজ প্রকাশ পাওয়া একটি ফিতনা আর মানুষের জন্য মহাপরীক্ষা। (মুফতি মুহাম্মাদ ইউসুফ, যাওয়াহিরুল ফারাইদ)

মুজিযা, কারামাত ও ইসতিদরাজের মধ্যে পার্থক্য – কারামাত শব্দের ভাবার্থ মুজিযা থেকে ভিন্নতর। তবে বিষয় দুটোই বস্তুর স্বাভাবিক নিয়মকানুন ভঙ্গের সাথে জড়িত। তা একটি বিস্ময়কর ঘটনা যা আল্লাহ’র নিয়ম-কানুনের (সুন্নাতুল্লাহ) স্বাভাবিক ধারাকে লঙ্ঘন করে। তা যদি নবী-রাসুলের মাধ্যমে প্রকাশ পায় তাহলে মুজিযা, আর যদি কোন ওলীর মাধ্যমে প্রকাশ পায় তাহলে কারামাত বলে অভিহিত হয়।

আল্লামা জুরজানী বলেন, “নবী নন – এমন কোন মুসলিম ব্যক্তি থেকে যদি অস্বাভাবিক কিছু প্রকাশ পায় তাহলে তা কারামাত। আর প্রকাশিত বিষয় যদি ঈমান ও পুণ্য কর্মের সহায়ক না হয়, তবে তা ইন্দ্রজাল। আর যদি অনুরূপ ঘটনা প্রকৃতই নবুওয়াতের দাবীদার থেকে প্রকাশ পায় তাহলে তা মুজিযা বলে অভিহিত।” (কিতাবুত তারীফাত)

আল্লামা শাব্বির আহমাদ বলেন, মুজিযা এবং কারামাত দুটোই সুসম্পন্ন হয় আল্লাহ’র পক্ষ থেকে। মুজিযা একজন নবী থেকে আর কারামাত একজন ওলী থেকে প্রকাশ পায়। এ দুটোই শিক্ষন-প্রশিক্ষণের ঊর্ধ্বে। দুটোরই কারণ একমাত্র আল্লাহ।

আল্লাহ’র অন্যান্য ক্রিয়াকর্মের মতো মুজিযাও একটি কর্ম যা সাধারণ নিয়মনীতির ঊর্ধ্বে। তিনি তার ইচ্ছার অধীন মুজিযাকে কার্যকর করে থাকেন। পক্ষান্তরে যাদু বা ইন্দ্রজাল এমনই একটি বিষয়, যার জন্য যথারীতি শিক্ষণ-প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। যে কেউ এই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করবে তার দ্বারাই বিস্ময়কর ও আশ্চর্যজনক কার্যাদি প্রকাশিত হবে। অথচ মুজিযা শিক্ষণ-প্রশিক্ষণের লক্ষ্যে কোন শিক্ষাসার বা পাঠ্যসূচি, কোন নীতিমালা রচিত হয়নি।

পক্ষান্তরে ইন্দ্রজাল বা সম্মোহন বিদ্যা শিক্ষার জন্য বই-পুস্তক রচিত হয়েছে, যার অধিকাংশই হিন্দু ধর্মাবলম্বী লোকদের দিয়ে রচিত। আজ যদি প্রতিদিন কেউ ঈসা আলাইহিস সালামের কথা”আল্লাহ’র হুকুমে উঠে দাঁড়াও” হাজারবারও মুখে আওড়ায়, তবুও কোন মৃত উঠে দাঁড়াবে না। মুসা আলাইহিস সালামের লাঠি দিয়ে মাটিতে লক্ষবার আঘাত করলে বা মাটিতে নিক্ষেপ করলেও কোনরূপ মুজিযাই প্রকাশ পাবে না – না সাপে পরিণত হবে, না পানির ঝর্ণা প্রবাহিত হবে। কারণ শিক্ষণ-প্রশিক্ষণের দ্বারা মুজিযাকে আয়ত্ত করা যায় না।

মুজিযা প্রদর্শনকারী নবী মুজিযা প্রকাশ হওয়ার পূর্বে তার রূপ-প্রকৃতি সম্পর্কে কিছুই জানতে পারেন না। পক্ষান্তরে, যাদুকর তার যাদুর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত থাকে। মুজিযার জন্য কোন সময়ও নির্ধারিত থাকে না। পক্ষান্তরে যাদু নির্দিষ্ট স্থান ও কালের মুখাপেক্ষী। মুসা আলাইহিস সালামের প্রতিদ্বন্দ্বী ফিরআউনের যাদুকররা রশির উপর মন্ত্র পাঠ করার আগেই জানতো যে, রশিতে মন্ত্র পড়ে ছেড়ে দিলে তা সাপে পরিণত হবে। এ কারণেই যাদুর প্রতিক্রিয়াতে সাপ দেখার পরও তাদের মধ্যে কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি, বরং তাদের যাদুর প্রতিক্রিয়া প্রদর্শনে দর্শকদের কাছ থেকে তারা বাহবা লুটছিল, আনন্দে বিভোর ছিল।

অপরদিকে, লাঠি নিক্ষেপের জন্য মুসা আলাইহিস সালামের উপর আদেশ হলে তিনি লাঠি নিক্ষেপ করলেন, সাথে সাথে তা পরিণত হলো একটি বিরাট অজগর সাপে, যা দেখে মুসা আলাইহিস সালাম ভীত-বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন। এরপর প্রত্যাদেশ হলো – হে মুসা, তা ধারণ করো, ভীত হয়ো না, আমি তাকে পূর্বাকৃতিতে পরিবর্তিত করবো। তার ভীত সন্ত্রস্ত হওয়ার কারণ একটিই ছিল যে, তিনি আগে থেকে জানতেন না যে, লাঠি ছেড়ে দিলে তার প্রতিক্রিয়া কি হবে। সুতরাং মুজিযার রূপ-প্রকৃতি সম্পর্কে আল্লাহ পাকই সর্বজ্ঞ।

যাদুবিদ্যায় শয়তান অংশগ্রহণ করে। এ কারণেই একজন অভিজ্ঞ যাদুকর অশ্লীলতার শিরোমনী সর্বশ্রেষ্ঠ দাজ্জাল। আর মুজিযার শিরোমনী খতমে নবুওয়াত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। সুতরাং এই দুটো কল্যাণ ও অকল্যাণ, আলো ও আঁধারকে এই নশ্বর জগতে জড়াজড়ি করে রাখা একটি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা।

মুজিযা ও ইসতিদরাজের মধ্যে পার্থক্য
পূর্ববর্তী আলোচনায় মুজিযার সংজ্ঞা, স্বরূপ ও তাৎপর্য এবং ইসতিদরাজের যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তাতেই মুজিযা ও ইসতিদরাজ এবং নবী ও যাদুকরের মধ্যে তারতম্য সুস্পষ্ট রূপে বিশ্লেষিত হয়েছে। যাদু, সম্মোহন বা ভেল্কিবাজি শুধু হাসি-কৌতুকের সাময়িক প্রহসন মাত্র। পক্ষান্তরে মুজিযা বা নিদর্শন হলো বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর সংস্কার ও ধ্বংস, নির্মাণ ও বিনষ্ট, উন্নতি ও অবনতির উপায় উপাদান। যাদুকরের উদ্দেশ্য থাকে, যাদুর প্রহসন দ্বারা কোন অসাধারণ ঘটনাকে শুধু বিস্ময়কর পদ্ধতিতে প্রতিহত করা, যাতে সে কিছুক্ষণের জন্য দর্শকমণ্ডলীকে বিস্ময়াভিভূত করে দিতে পারে।

পক্ষান্তরে একজন নবীর উদ্দেশ্য থাকে সেই বিস্ময়কর নিদর্শনাবলীর মাধ্যমে বিশ্বজোড়া সংস্কার সাধন, জাতিকে চিরসত্যের পথে আহবান, গোত্রসমূহকে কৃষ্টি ও ঐতিহ্য ঐশ্বর্যশালী হওয়ার শিক্ষাদান ও আল্লাহ’র দ্বীনকে সুদৃঢ় করা। নবী-রাসুলগণ হলেন সুসংবাদদাতা, ভীতি প্রদর্শনকারী, পূত-পবিত্রকারী, উজ্জ্বল আলোক বর্তিকা ও বিশ্ববাসীর সাক্ষ্যদাতা। আর যাদুকর এ সকল গুণের দিক থেকে সম্পূর্ণ রূপে বঞ্চিত।

পবিত্র কুরআনে যাদুমন্ত্র সম্পর্কে যা আলোচিত হয়েছে তাতে স্পষ্ট বুঝা যায় আল-কুরআন যাদু-মন্ত্রের অস্তিত্ব বা প্রতিক্রিয়াকে স্বীকার করে, কিন্তু তা অনুমোদন বা সমর্থন করে না। একটি ধাঁধা বা সম্মোহন ব্যতীত তার কোন গুরুত্বই দেয় না। লক্ষ্য করা যায়, হারুত-মারুত ঘটনায় যাদুর শক্তি ও ক্ষমতার সীমা সম্পর্কে বলা হয়েছে –
“….. তারা উভয়ের (হারুত-মারুত) কাছে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যা বিচ্ছেদ সৃষ্টি করে তা শিক্ষা করতো, অথচ আল্লাহ’র নির্দেশ ছাড়া তারা কারো কোন ক্ষতিসাধন করতে পারতো না, তারা যা শিক্ষা করতো তা তাদের ক্ষতিসাধন করতো, কোন উপকারে আসতো না …… ” (সূরাহ আল-বাকারাহ, ২ : ১০২)
“….. তাদের যাদুর প্রভাবে অকস্মাৎ তার (মুসার) মনে হলো তাদের দড়ি ও লাঠিগুলো ছুটাছুটি করছে।” (সূরাহ তো-হা, ২০: ৬৬)

মুসা আলাইহিস সালামের সামনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী যাদুকররা প্রথমে তাদের যাদু দেখালে এরকম ঘটনা ঘটেছিলো। এরপর আল্লাহ’র পক্ষ থেকে মুসা আলাইহিস সালামের প্রতি প্রত্যাদেশ হলো – “আমি বললাম, ভয় করো না, তুমিই প্রবল। তোমার ডান হাতে যা আছে তা নিক্ষেপ করো, তারা যা করে তা গ্রাস করে ফেলবে, তারা যা করেছে তা তো কেবল যাদুকরের কলাকৌশল, যাদুকর যেখানেই আসুক সফল হবে না।” (সূরাহ তো-হা, ২০ : ৬৮-৬৯)

আল্লাহ যাদুকর ও নবীর মধ্যে যে পার্থক্য নিরূপণ করেছেন তা হলো – নবী কৃতকার্য হোন আর যাদুকর হয় অকৃতকার্য। নবীর কার্যকলাপ চেষ্টা-সাধনা ও মুজিযার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে সফলকাম ও কল্যাণধর্মী হওয়া।
অপরপক্ষে যাদুকরের উদ্দেশ্য হলো ধোঁকাবাজি, প্রবঞ্চনা ও অনিষ্ট সাধন করা। অপর একটি আয়াতে এ ব্যাখ্যারই পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। মিসরীয় যাদুকরদেরকে লক্ষ্য করে মুসা আলাইহিস সালাম বললেন –
“….. তোমরা যা এনেছো তা যাদু, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাকে অসার করে দিবেন; নিশ্চয়ই আল্লাহ অশান্তি সৃষ্টিকারীদের কর্ম সার্থক করেন না।” (সূরাহ ইউনুস, ১০ : ৮১)

যাদু ও তন্ত্রমন্ত্র একটি সাময়িক ক্রীড়া-কৌতুক। আর মুজিযার প্রভাব, ক্রিয়াশীলতা সার্বজনীন ও সর্বকালীন। এ জগতে তার ফলাফল অত্যন্ত ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী। মুসা আলাইহিস সালামের মুজিযা দেখে ফিরআউন যখন বললো, এটা তো সব যাদুমন্ত্রের লীলাখেলা। জবাবে মুসা আলাইহিস সালাম বললেন -“…. এটি কি যাদু? যাদুকররা তো সফলকাম হয় না।” (সূরাহ ইউনুস, ১০ : ৭৭)

পৌত্তলিক অবিশ্বাসীরা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে বলাবলি করতো, এই লোকটি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শয়তানী শক্তির সাহায্যে এসব বাণী পেশ করছে, তার(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বাণীর উৎস হলো শয়তানী শিক্ষা। তার জবাবে আল্লাহ পাক তাদেরকে জানিয়ে দিলেন, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণীর উৎসমূল ভালো না মন্দ, শয়তানী শক্তির বহিঃপ্রকাশ না ফেরেশতা শক্তির ফল – এই তত্ত্ব ও তথ্যটি অনুধাবন করা খুবই সহজ। স্বয়ং আহবানকারীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবন, তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চরিত্র ও কার্যকলাপ সেটার উজ্জ্বল সাক্ষী। ঈসা আলাইহিস সালামের ভাষায় বৃক্ষের পরিচয় ফল দ্বারাই। সুতরাং শয়তানী ও আসমানি উচয় শক্তির মধ্যে তারতম্য নিরূপণ করা মোটেই কষ্টসাধ্য নয়। আল্লাহ পাক ঘোষণা করেন শয়তান কার কাছে যায় –
“তারা তো অবতীর্ণ হয় প্রত্যেক ঘোর মিথ্যাবাদী ও পাপীর উপর। তারা কান পেতে থাকে আর তাদের অধিকাংশই মিথ্যাবাদী।” (সূরাহ আশ-শুয়ারা, ২৬ : ২২২-২২৩)

আসল ও নকল নবীর মধ্যে তারতম্য নিরূপণের নিমিত্ত তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চারিত্রিক জীবনই যথেষ্ট। এতদ্ব্যতীত মিথ্যাবাদী ও অপবাদ রটনাকারী ও অসৎ চলাফেরা কম বৈশিষ্ট্যপূর্ণ, দীর্ঘস্থায়ী কিংবা চিরন্তন হয় না। যেমন আল-কুরআন ঘোষণা দেয় –
“…. নিশ্চয়ই যারা আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা উদ্ভাবন করবে তারা সফলকাম হবে না। তাদের সুখ-সম্ভোগ সামান্যই আর তাদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি।” (সূরাহ আন-নাহল, ১৬ : ১১৬-১১৭)(আল্লামা শিবলী নুমানী, সিরাতুন্নবী, ৩খ.)


সূত্রঃ সিরাত বিশ্বকোষ – একাদশ খণ্ড (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ)