নাসীহা – ইমাম আনোয়ার আল-আওলাকি (রহঃ)

আ’উযুবিল্লাহি-মিনাশ-শাইতনির-রযিম।
বিসমিল্লাহির-রহমানির-রহিম।
আলহামদুলিল্লাহ ওয়াসসালাতু ওয়াসসালামু আ’লা সায়্যিদিনা মুহাম্মাদিউঁ ওআ’লা আলিহি ওয়াসহাবিহি ওয়াসসাল্লাম তাসলিমান কাছি-র। রব্বানা আ-তিনা ফিদ্যুনইয়া হাসানাতাউঁ ওয়াফিল আখিরতি হাসানাতাউঁ ওয়াক্বিনা আ’যাবান্নার।

অল্প কিছু উপদেশ : যেকোন ধরনের ইসলামি আন্দোলনের সাথেই জড়ি্ত থাকা ভাইদের জন্য। কেবলমাত্র একটি বিশেষ দলের ভাইদের জন্য নয়, বরং যদি এমন হয় যে আপনি একটি ইসলামি দলের সাথে যুক্ত রয়েছেন বা কোনো ইসলামি দলের সাথে কাজ করছেন, কথাগুলো হয়ত প্রযোজ্য। প্রকৃতপক্ষে ব্যক্তিবিশেষের জন্য নয়, যদিও সাধারণভাবে তাতেও কিছুটা উপকারিতা পেতে পারেন। আমি এটা সরাসরি সেইসমস্ত ভাইদের প্রতি নিবেদন করছি যারা নিজেদেরকে দলগত কাজে নিবদ্ধ করেছেন।

প্রথমত,
কখনও কখনও দেখা যায়, যখন আপনি একটি ইসলামি সংগঠনের কাজে প্রবেশ করেন, তখন আপনি এর থেকে কিছু একটা আশা করতে শুরু করেন। আর আপনি ভাবতে থাকেন যে এ সংগঠন আপনার (দ্বীন) শেখার প্রয়োজন, আত্মিক প্রয়োজন ইত্যাদি মেটাবে। কিন্তু ব্যাপারটি মোটেও সেরকম নয়। বরং আপনিই হলেন সংগঠনের অংশ। সুতরাং সংগঠন আপনার কাছে কোনোপ্রকার হেলাফেলা না করবার দাবি রাখে। অনেকসময়ই ভাইয়েরা ইসলামিক কাজে যোগ দেন আর তারা তাতে বছরের পর বছর থাকবার পরও কোনো উন্নতি করতে পারেন না। কারণ তারা অপেক্ষায় থাকেন যে তাদের সংগঠনই তাদেরকে কিছু একটা দিবে। এটি খুবই অবাস্তব একটি চাওয়া যেহেতু সংগঠনেরই এত এত প্রকল্প আর এত এত কাজ পড়ে রয়েছে যে সংগঠনের পক্ষে আপনার ব্যক্তিগত প্রয়োজন মেটানো একেবারেই অসম্ভব। তাই এইসমস্ত ব্যাপারগুলো আপনার নিজেকেই সামাল দিতে হবে।

যখনই শেখার বা আত্মিক ব্যাপারগুলো আসবে, এগুলো এমন জিনিস যার দ্বায়িত্ব স্বয়ং আপনাকে নিতে হবে। আপনার যা যা প্রয়োজন, তাই আপনাকে দেওয়া হবে- এই ভেবে সোনার চামচ মুখে নিয়ে থাকার আশাও করবেন না। আলহামদুলিল্লাহ্ অনেকসময় ইসলামিক সংগঠনগুলো এসব ক্ষেত্রে সাহায্য করতে সমর্থ হয়। তবে আপনার তাতে ভরসা করে থাকা ঠিক নয়।

আপনার ই’বাদাতের একটি পরিকল্পনা থাকতে হবে, যেটা পূর্ণ করতে আপনি বদ্ধপরিকর থাকবেন, হতে পারে একেবারেই ব্যক্তিগত অথবা তা আপনি আপনার কাছের ভাইদেরকে নিয়ে একত্রেও করতে পারেন। কেননা কখনো হয়ত আপনি আপনার ভাইদের সাথে নিলে ই’বাদাতে আরও শক্তিশালী হবেন। আর একারণেই আমরা তারাবির নামাজ জামা’তের সাথে আদায় করে থাকি যদিও এটা একা আদায়ে আজর বা সাওয়াব বেশি। ফরজ নামাকের ক্ষেত্রে জামা’তে আদায় করলে নেকী বেশি কিন্তু নাফলের ক্ষেত্রে একা আদায়ে নেকী বেশি। তবুও আমরা তারাবির নামাজ জামা’তে আদায় করে থাকি কারণ এটি সবাইকে উৎসাহিত করে। আমরা যদি তারাবির নামাজ জা’মাতে আদায় না করি তাহলে দেখা যাবে অধিকাংশ লোক তা আদায়ই করছে না। এটি জামা’তে আদায় করা হয় বলেই লোক সমাগম হয়, এটা তাদের মাঝে অনুপ্রেরণা যোগায়। সুতরাং আপনি যদি কোন ই’বাদাত একা সম্পন্ন করতে না পারেন তাহলে কয়েকজন ভাইদেরকে সাথে নিয়ে করুন। আপনার বন্ধুদেরকে খুঁজে নিন এবং সোমবার-বৃহস্পতিবার রোজা রাখুন, একসাথে ইফতার করুন। আপনি ক্বিয়ামুল-লাইল করতে পারছেন না, আবার বন্ধুদের বা ভাইদের সহায়তা নিন। দরকার হলে একেকদিন একেকজনের বাসায় গিয়ে একত্রে কিছু রাকা’ত আদায় করুন: দুই, চার, ছয়, আট – যতটুকু সম্ভব হয়। আপনি একা একা ক্বুরআন পড়তে পারেন না, সবাই একত্রে বসে হালাক্বা করে পড়ুন। নিজেকে কোনোকিছুতে নিযুক্ত করুন। আপনার একটি দায়বদ্ধ রুটিন থাকতে হবে।
রাসূলুল্লাহ ﷺ এর পরিবার সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে যখন তাঁরা ভাল কোনকিছু করা শুরু করতেন তারা তা অধ্যবসায় এবং ঐক্যের সাথে করতেন। তাদের আমলে উত্থান পতন ছিলো না, তাঁরা তা নিয়মিত করতেন। অনেকসময় হয়ত কিছু শোনার বা পড়ার পর আপনি খুবই উৎসাহিত হয়ে ইসলামের জন্য একেবারে অনেক কিছু করে ফেলতে চাইলেন, কিন্তু পরবর্তী দিন দেখা গেল আপনি কিছুই করছেন না। কিন্তু রাসূল ﷺ এর পরিবার এমন ছিলেন না। তাঁরা দায়বদ্ধ ছিলেন। কোনো ভাল কাজ শুরু করলে সেগুলো তাঁরা নিয়মিত করতেন। তাঁদের কাজের নড়চড় হত না। সুতরাং আপনাকেও দায়বদ্ধ হতে হবে – কিছু কিছু ই’বাদাতে। হতে পারে নামাজ পরবর্তী যিকির আযকার – যা আপনি সবসময়ই নামাজের পরে করবেন।

এখন ইলম তালাশের কথায় আসি। একজন ভাই থেকে আমি লেকচারের পর লেকচার, বছরের পর বছর একটি কথা শুনে আসছি। ভাইটি লেকচারের পর আমার কাছে এসে বলত যে ‘ভাই আমি বাইরে গিয়ে (দ্বীনি) পড়াশুনা করতে চাই, আপনি আমাকে কোথায় যাবার পরামর্শ দিবেন?’ পরের বছর ভাইটি আবার আসতেন এবং একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতেন। তার পরের বছরও একই প্রশ্ন ‘আমি কোথায় যাই বলেন তো?’ আরে ভাই আজকে তিন বছর হতে চলল আর আপনি কিছুই করেন নি। আমরা যদি অন্য কোথাও গিয়ে জ্ঞান অর্জন করতে না পারি তাহলে আমরা যেখানে আছি সেখানকারই পূর্ণ সুযোগ নিতে চেষ্টা করব। আপনি যেখানেই আছেন সেখানেই আপনি অনেক বেশি শিখতে পারবেন। বাইরে গিয়ে জ্ঞান অর্জন তো আর ফরয নয়, যেখানে আছেন সেখানে থেকেই শিখুন। কিন্তু কিছু ভাই বাইরের দেশে ঘুরতে যাওয়ার এই বিষয়টা এতই পছন্দ করেন যে তারা একেবারে অজানা অচেনা পরিবেশে গিয়ে জ্ঞান অর্জন করবেন। তারা সেখানকার নানা ধরনের অভিজ্ঞতার ঘটনা শোনেন আর সেসব অভিজ্ঞতা পেতে চান। তো ভাই আপনি কি সত্যিই জ্ঞান অর্জন করতে চান নাকি অভিযানটার রোমাঞ্চ পেতে চান!?

কারণটা আসলে আমরা এখন একটি ফ্যাশনদুরস্ত সমাজে বাস করছি। মানুষ ফ্যাশনে ডুবে আছে। ফ্যাশনগুলো সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হতে থাকে। যখনই হোক আপনি একটা নতুন ফ্যাশন খুঁজে পাবেন। আর যারা এইসমস্ত হুজুগ তৈরি করেন তারা হলেন সমাজের তারকারা। তারাই মানুষ কখন কীভাবে সাজবে, কীভাবে আচরণ করবে, কথা বলবে এইসমস্ত ট্র্যান্ড তৈরি করে দেন। এমনকি মানুষ বর্তমানে সেগুলোতে গা ভাসিয়ে দম্ভও করে। যেভাবে তারা কথা বলে, যেমন অঙ্গভঙ্গি করে, গালিগালাজ করে সবই এখন ফ্যাশন। আর পরিতাপের বিষয় হল, ইসলামেও এমন কিছু ফ্যাশন প্রচলিত হয়ে গিয়েছে। একটা নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে আমাদের আমাদের সাজতে হবে, কারণ এটাই এখন ফ্যাশন। আর তারপর সেটা পরিবর্তন হয়ে আবার নতুন এক ফ্যাশন আসবে। আজ হুডিওয়ালা জোব্বা, মরোক্কান জোব্বা তো কাল ফিলিস্তিনি রুমাল। সবাইকে সেটা পড়তে হবে, এটাই এখন চলছে। আর চলমান ট্রেন্ড পরিবর্তন হতেই থাকে, হতেই থাকে। এর কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। আমি বলছি না যে আপনি আপনার আরেকজন মুসলিম ভাইদের মত মোটেই সাজবেন না, আমি মোটেও তা বলছি না। আমি যা বুঝাতে চাইছি তা হল কিছু লোকের জন্য এগুলো কেবলই ফ্যাশন। এমনকি আজকাল ফ্যাশনেবল হিজাবও রয়েছে।

সুতরাং যেহেতু আমরা একটি ফ্যাশনদুরস্ত সমাজে আছি, যেখানে কিছুদিন পর পর ট্রেন্ড পরিবর্তন হয়, আপনাকে আপনার নিয়্যত পরিষ্কার করে নিতে হবে। অর্থাৎ আপনি এখন এই রকমটা করছেন কারণ এটা অসাধারণ দেখায় নাকি আপনার দ্বীনের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে করছেন? আপনার কাজগুলো কি সেই মূহূর্তে আলাদা দেখাবার জন্য নাকি আপনি আল্লাহ আ’যযাওয়াযালকে খুশি করার জন্য করছেন?

আর দুঃখজনক হল কিছু ভাইদের জন্য জ্ঞান আহরণটাও একটি ফ্যাশন। সবাই এটা করছে, আমিও করব। অথচ আপনি আপনার এলাকায় থেকেই কতকিছুই না শিখতে পারবেন, জানতে পারবেন। আশেপাশে অনেক ভাইদের পাবেন, মুসাফা – অনুবাদ, বই সবকিছুই আপনার আশেপাশেই রয়েছে। আপনি কি জানেন যে এমন এক সময় ছিল, আমাদের দাদা-নানাদের আমলে কোনো বইপুস্তকই ছিল না, তাদের জ্ঞান ছিল সীমাবদ্ধ, বলতে গেলে রীতিমত অশিক্ষিতই ছিলেন তারা। তাদেরকে শিক্ষিত মানুষ খুঁজে নিয়ে শিখতে যেতে হত কারণ শিক্ষিত মানুষের সংখ্যাই ছিল একেবারে কম। আর এখন তো ঘরে ঘরে বই রয়েছে। আর আপনারাও সবাই লিখতে পড়তে পারেন। জ্ঞানার্জন এখন কতই না সহজ। অথচ আমরা যা সহজলভ্য তা বেছে না নিয়ে সমস্ত কঠিন পথে পাড়ি জমানোর জন্য চেয়ে আছি। আপনার যদি বিদেশ ভ্রমণের সামর্থ্য থাকে তাহলে সমস্যা নেই। কিন্তু আমাদের সবার তো সমান সামর্থ্য নেই। আর যতদিন পর্যন্ত আপনি যেতে পারছেন না ততদিন আশেপাশের উৎসের সুযোগ নিন। কুরআন পড়ুন, অর্থ এবং তাফসীর দেখে নিন। হাদীসের বইগুলো পড়ুন। আপনার আশেপাশের যারা আপনার চেয়ে বড় এবং বেশি জ্ঞান রাখেন তাদের কাছ থেকে যতটুকু সম্ভব জানার চেষ্টা করুন। আপনার ইমামের সাহায্য নিন। আপনার এলাকার মসজিদে অনেক জ্ঞানী এবং যোগ্য ইমাম রয়েছেন তো তার কাছে শিখুন। তাঁদের জ্ঞানের সদ্ব্যবহার করুন। আপনার আশেপাশে অবশ্যই এমন কিছুসংখ্যক ভাইদের পাবেন যাদের কাছ থেকে অনেক কিছুই শেখা যায়। সেই সুযোগ কাজে লাগান। চারপাশে ঘটে যাওয়া হালাকাগুলোয় যোগ দিন। আপনার ই’লম অর্জনের জন্য তো একেবারে খুব বিখ্যাত শায়খ বা ব্র্যান্ডনেমের প্রয়োজন নেই। যেসমস্ত ই’লম সহজলভ্য সেগুলোরই সুযোগ নিন।
আর ই’বাদাতের ক্ষেত্রে বলব যে নিজেকে এখনই কোনোকিছুতে নিযুক্ত করুন কারণ এটা আপনার সাথেই বেড়ে উঠবে এবং আপনার জীবনের অংশ হিসেবেই থেকে যাবে।

দ্বিতীয়ত,
আপনাকে দ্বীন গুরুত্বের সাথে নিতে হবে। আল্লাহর দ্বীন খণ্ডকালীন বা সাপ্তান্তিক কিছু নয়। এটি এমনকিছু নয় যেটি আপনি সময়-সুযোগ হলে করবেন, তা নাহলে করবেন না। এটি পূর্ণসময়ের প্রতিশ্রুতি।
আল্লাহ সুবহানাহুতা’লা ইয়াহইয়াকে (আ’লাইহি-সালাম) বলছেন যে “হে ইয়াহইয়া, কিতাবকে শক্ত করে আঁকড়ে ধর” (সূরা মারইয়াম,১২)
আল্লাহ আ’যযাওয়াযাল বনী ঈসরাঈলদেরকেও বলেছেন “আমি তোমাদেরকে যে প্রত্যাদেশ দিয়েছি তা আঁকড়ে ধর” (সূরা বাক্বারা,৬৩)

সুতরাং আল্লাহর দ্বীন অনেক গুরুত্ববহ। আজ আমাদের খালেস মানুষ প্রয়োজন কারণ এই দ্বীন প্রকৃত অর্থেই মুখলেস মানুষগুলোর জন্য। আর সাহাবারা (রাদিআল্লাহু-আ’নহু) ছিলেন প্রকৃত একাগ্রচিত্ত-মুখলেস মানুষ। তাঁরা হীনচেতা নীচ প্রজাতির ছিলেন না। তাঁরা কোনোকিছুই অবহেলাভরে নিতেন না। তাঁদের নিকট দ্বীনের ছিল প্রকৃত গুরুত্ব। সেটি কোনো হালকা বিষয় ছিল না। তাঁরা এর প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিলেন এবং তাঁরা একাগ্র ছিলেন। তাঁরা ময়দানে শক্তিশালী ছিলেন, ই’বাদাতে শক্তিশালী ছিলেন, শক্তিশালী ছিলেন তাঁদের প্রতিশ্রুতিতে এবং তাঁরা শক্তিশালী ছিলেন আল্লাহর শত্রুদের বিপক্ষে। শক্তি ছিল তাঁদের ইসলামি বৈশিষ্ট্যের অন্তর্ভুক্ত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, “আল্লাহ দুর্বল মু’মিন অপেক্ষা শক্তিমান মু’মিন বেশি পছন্দ করেন।” অর্থাৎ এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ জীবনবিধান। আমরা অবশ্যই এমন মুসলিম ভাই চাই না যারা দ্বীনকে গুরুত্ব সহকারে নেওয়ার আগে ছিলেন অনেক শক্তিধর ও কর্মক্ষম কিন্তু দ্বীনদার হবার পর কেমন যেন দুর্বল হয়ে যান, তাদের চোখগুলো কোটরের ভেতর ঢুকে যায়। আপনার মুসলিম হিসেবে সেই শক্তি ধরে রাখা উচিত।
সাহাবারা (রাদিআল্লাহু আ’নহু), নারী-পুরুষ উভয়েই, যখন আল্লাহ আ’যযাওয়াযালের দ্বীনের কোনো কাজে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতেন, তখন কোনোকিছুই… আর কোনোকিছুই তাঁদেরকে টলাতে পারত না। নারী বা পুরুষ… কাউকেই।

একবার এক সাহাবী, আ’ব্দুল্লাহ ইবন হুযাফাহ আস-সাহামী (রাদিআল্লাহু আ’নহু), রোমানদের নিকট যুদ্ধবন্দী হন। এসময় রোমান রাজা জানতে চাইলেন যে যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে কেউ সাহাবী আছেন কিনা? কারণ সেসময় তা’বেঈনরা অনেকেই ছিলেন, কিন্তু সাহাবারা খুব অল্পসংখ্যকই বেঁচে ছিলেন। তাই রাজা স্পষ্টভাবেই জানিয়ে দিলেন যে তিনি কেবল কোনো সাহাবী থাকলে তাঁর সাথেই দেখা করতে চান। লোকেরা খুঁজে এসে বলল যে একজন আছেন, আ’ব্দুল্লাহ ইবনে হুযাফাহ (রাদিআল্লাহু আ’নহু)। প্রকৃতপক্ষে সেই সময়টাতে এক একজন সাহাবী ছিলেন খুবই বিখ্যাত (তাঁদের ইসলামে দৃঢ়টার কারণে)। একারণেই রাজা দেখা করতে চাইলেন এবং তারা আ’ব্দুল্লাহ ইবনে হুযাফাহকে রাজার নিকট নিয়ে আসলেন।

এই রোমানরাজ সাহাবাদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানতেন বা কোথাও শুনেছিলেন। তাই তিনি আ’ব্দুল্লাহ ইবনে হুযাফাহকে বললেন, ‘আমি আমার মেয়েকে আপনার সাথে বিয়ে দিয়ে দেব আর আমার রাজ্যের অর্ধেকটা আপনাকে দিয়ে দেব; তবে শর্ত হল আপনাকে ইসলাম ত্যাগ করতে হবে।’

চিন্তা করুন… রাজকন্যা এবং রাজ্যের অর্ধেক মালিকানা! আ’ব্দুল্লাহ ইবনে হুযাফাহ বললেন, আপনার রাজ্য আর আপনার মেয়ে আমি চাই না। এগুলো আপনিই রাখেন। ফলে রাজা আদেশ দিলেন, একজন যুদ্ধবন্দীকে নিয়ে আসো। তাই তারা একজন যুদ্ধবন্দীকে ধরে আনলো এবং তাকে একেবারে ফুটন্ত গরম তেলে ছেড়ে দিল। সেটা এতই উত্তপ্ত ছিল এনং সেই মুসলিম লোকটি এতই দ্রুত পুড়তে আরম্ভ করল যে আ’ব্দুল্লাহ ইবনে হুযাফাহ বলেছিলেন, তার শরীরের মাংসগুলো খুলে খুলে পড়ছিল। হয়ত দেখে থাকবেন, যখন মুরগি ভাজা হয় তখন হাড্ডির সাথে লেগে থাকা মাংস খুব সহজেই খুলে আসে। এখানে এমনটাই হয়েছিল, সে এতই দ্রুত সেখানে পুড়ে গিয়েছিল যে আ’ব্দুল্লাহ ইবনে হুযাফাহ বলেন, আমি তার হাড়গুলো বের হয়ে আসতে দেখেছিলাম। তখন সেই রাজা বললেন যে, আপনি যদি আপনার দ্বীন ত্যাগ না করেন, তবে আমি আপনারও একই পরিণতি করব। জবাবে আ’ব্দুল্লাহ ইবনে হুযাফাহ বললেন, যা ইচ্ছা করুন।

তাই তারা আ’ব্দুল্লাহ ইবনে হুযাফাকে নিয়ে যখন সেই ফুটন্ত তেলের একেবারে কাছাকাছি চলে গেলেন, আ’ব্দুল্লাহ ইবনে হুযাফাহ (রাদিআল্লাহু আ’নহু) কাঁদতে শুরু করলেন। রাজা বললেন, ‘এইতো তাঁর দুর্বলতা… সে ভেঙ্গে পড়েছে। তাঁকে ফেরত নিয়ে আসো।’

এই ভেবে রাজা খুবই আনন্দিত হলেন যে তিনি আ’ব্দুল্লাহ ইবনে হুযাফাহকে (রাদিআল্লাহু আ’নহু) চাপ দিয়ে ইসলাম ত্যাগ করাতে সফল হয়েছেন। তাই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কেন কাঁদলেন?’
আ’ব্দুল্লাহ ইবনে হুযাফাহ বললেন, ‘আপনি যে কারণ ভাবছেন আমি সে কারণে কাঁদিনি। আমি এই কারণেই কেঁদেছিলাম যে আমি আল্লাহর জন্য কেবলমাত্র একটি জীবন দিতে পারছি। আমার আফসোস যদি আমার নিরানব্বইটা জীবন থাকত তবে আপনি একের পর এক সেগুলো পোড়াতে পারতেন। আর একারণেই আমি কাঁদছিলাম। আমি যে কেবল একবারই মরতে পারি, ইশ আমার নিরানব্বইটা জীবন থাকলে এই তেলে আমি নিরানব্বই বার পুড়ে মরতাম।
একথা শুনে রাজা বললেন, ‘এই লোককে কিছুই করার নেই।’ (আদর্শিক ভাবে পরাজিত ও অপমানিত রাজা সভাসদের সামনে নিজের মান রক্ষার্থে) বললেন, ‘আমি আপনার কাছে শুধুমাত্র এই চাই যে আপনি আমার কপালে একবার চুমো দিন। তাহলে আমি সমস্ত মুসলিম যুদ্ধবন্দীদের মুক্ত করে দেব। আপনাকে শুধুমাত্র একবার আমার কপালে চুমো দিতে হবে।’
আ’ব্দুল্লাহ ইবনে হুযাফাহ এটা নিয়ে ভাবলেন, যদি কাজটা করলে মুসলিমদের এত বড় উপকার হয় আর সমস্ত মুসলিম বন্দীরা মুক্তি পেয়ে যায় তবে কেন নয়। কাজটিতে তো কোনো শির্ক বা কুফরি দেখছি না। তাই তিনি সামনে গিয়ে রাজার কপালে চুমো দিলেন। ফলে সমস্ত মুসলিম বন্দীদেরকে মুক্ত করে দেওয়া হল।
আ’ব্দুল্লাহ ইবনে হুযাফাহ মদিনায় পৌঁছালে উ’মার (রাদিআল্লাহু আ’নহু) তাঁর এই ঘটনা সম্বন্ধে জানলেন। উ’মার ইবনুল খাত্তাব (রাদিআল্লাহু আ’নহু) তাঁকে মসজিদে দেখে গিয়ে তাঁর কপালে চুমো দিলেন। আর সকল মুসলিমদেরকেও তাঁর এই কৃতিত্বের জন্য তাঁর কপালে চুমো দিতে বললেন।
অর্থাৎ তাঁরা ছিলেন দৃঢ়।

তৃতীয়ত,
ভাইয়েরা, আপনাদেরকে প্রস্ততি নিতে হবে। কেননা আল্লাহ আ’যযাওয়াযাল আপনাকে অবশ্যই পরীক্ষা করবেন। যখন আপনি কলেজ বা স্কুলে যান… আচ্ছা আমরা ধরে নিই আপনি একজন মেডিকাল ছাত্র। সেখানে আপনাকে যাচাইয়ের জন্য অবশ্যই প্রস্তত থাকতে হবে, তাই নয় কি? প্রত্যেক বছর বা সেমিস্টার যাই হোক, এর পর পর একটি করে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এবং আপনাকে যাচাই করা হয়। এখন বিষয়টা হল, ইসলামের ক্ষেত্রেও একই জিনিস হবে।
“মানুষ কি মনে করে যে তারা বলবে – আমরা বিশ্বাস করি, আর তাদের কোনো পরীক্ষা নেওয়া হবে না?” (সূরা আল-আনকাবূত, ২)
এরপর ধরে নিই আপনি ডাক্তার পদে আবেদন করেছেন, যখন আপনি হাসপাতালে গিয়ে দাবি করলেন যে আপনি একজন ডাক্তার, তারা কি আপনাকে আপনার চেহারা দেখেই নিয়ে নিবে? অবশ্যই না,তারা আপনার ডিগ্রী, সার্টিফিকেট ইত্যাদি প্রমাণাদি খুঁজবে। ঠিক একইভাবে যখন আপনি দাবি করেন যে আপনি একজন ঈমানদার, আল্লাহ আপনার কাছে প্রমাণ দেখতে চান। আর সে কারণেই আল্লাহ আ’যযাওয়াযাল আপনাকে পরীক্ষা করবেন। সুতরাং আপনাকে পরীক্ষা করা হবে এবং আপনাকে সেই পরীক্ষাসমূহের জন্য প্রস্তত থাকতে হবে। আর আপনি যখন ইসলামের কাজের সাথে জড়িয়ে থাকবেন তখন আপনাকে বিশেষ প্রস্ততি রাখতে হবে কারণ আপনাকে সামনের কাতারেই থাকতে হবে। সুসংহত ইসলামি কাজের সদস্য হিসেবে আপনাকেই সমাজের মাথা হতে হবে, হতে হবে দলনেতা। সর্বোপরি এমন একজন হতে হবে যিনি কাজের ধারা এবং পরিক্রমা নির্ধারণ করে দেবেন। আপনারাই হলেন তারা, যারা সংগঠন এবং প্রতিষ্ঠানাদি গড়ে তুলবেন।

আর এসমস্ত কারণে আপনাকে মেনে নিতে হবে যে আল্লাহ আ’যযাওয়াযাল আপনাকে পরীক্ষা করবেন এবং এই পরীক্ষাসমূহ অত্যন্ত গুরুত্ববহ। আল্লাহ আপনাকে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, ভয়, পারিবারিক সমস্যা, স্বাস্থ্যহানি ইত্যাদি যেকোনো সম্ভাব্য উপায়েই আপনাকে পরীক্ষা নিতে পারেন। আপনাকে তার জন্য প্রস্ততি নিতে হবে। পথে যাই আসুক না কেন, তার জন্য সদা প্রস্তুত থাকতে হবে। আপনি হয়ত সেটি চাননি, কিন্তু যখন সেগুলো হাজির হবে তখন আপনাকেই মোকাবিলা করতে হবে।

পরিশেষে,
আমি বলতে চাই যে, ভাইয়েরা কখনো কখনো ইসলামি কাজে যোগ দেন। বিশেষত যখন আপনারা কর্মীভিত্তিক কাজে যোগ দেন, যেখানে অনেক ধরনের কার্যক্রম একইসাথে চলতে থাকে; তখন এতশত কার্যক্রম আপনাদেরকে ‘দ্বীনি শিক্ষা’ ও ‘ই’বাদাতের’ মত অতি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে শক্ত ভিত গড়ে তোলা থেকে মনোযোগ সরিয়ে দিতে পারে। আপনার শক্তিশালী ভিত না থাকলে আপনি যতই ইভেন্ট, কোর্স, সম্মেলন বা হালাক্বা পরিচালনা করুন না কেন, তার সবই মূল্যহীন। আপনার মজবুত ভিত থাকতে হবে। কেননা এসব কর্মীভিত্তিক কাজে অনেক সাওয়াব থাকলেও এটি আপনার পিছুটানের কারণও হতে পারে। যখন সাহাবারা (রাদিআল্লাহু আ’নহু) এক জায়গা হতে আরেক জায়গায় যেতেন, তাঁরা যে ভিত রেখে যেতেন সেটা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর শিক্ষা দ্বারা গড়ে উঠেছিল। তাই সেই ভিত ছিল মজবুত এবং অনড়। আপনাকেও তেমনি মজবুত ভিত তৈরি করে নিতে হবে আপনার ই’বাদাতে এবং আপনার ই’লমে।

আর যখন আমি ই’লমের কথা বলছি, আমি মোটেই উ’লামাদের মত গভীর জ্ঞান অর্জনের কথা বুঝচ্ছি না। আমি বলতে চাইছি অন্তত সেই প্রাথমিক জ্ঞানটুকুর কথা যা থাকলে আল্লাহর ই’বাদাতগুলো যথাযথভাবে সম্পন্ন করা যায়। আপনাকে জানতে হবে কীভাবে সালাত আ’দায় করতে হয়, কীভাবে সিয়াম করতে হয়, কখন কোন কোন দু’আ পড়তে হয়, কোন যিকিরগুলো কোন সময়ের জন্য ইত্যাদি। এছাড়াও আপনাকে নিজের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ব্যাপার বুঝতে হবে, আপনাকে বুঝতে হবে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সুন্নাহগুলো, যেগুলো তিনি কেবল একজন পারিবারিক সদস্য হিসেবে সম্পন্ন করেছেন। এই ন্যূনতম বিষয়গুলো আপনার মধ্যে থাকতেই হবে। কেননা এই ভিত্তিগুলো আপনার মজবুত না হলে আপনি যত বড় প্রাসাদই তৈরি করুন না কেন, তা কোনো না কোনোদিন ভেঙ্গে পড়বেই। তাই ভিত্তিটা হতে হবে মজবুত এবং অনড়। সেটাই ই’বাদাতের সর্বনিম্ন স্তর। উ’মরায় অংশ নিতে হবে, হজ্জের প্রস্তুতি নিতে হবে। কমবয়সে হলেও সুযোগ পেলেই হজ্জ করে নিতে হবে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। কেননা হজ্জ এমন এক ই’বাদাত যা মোটেও সহজসাধ্য নয়। শেষবারের মত বলছি, আপনাকে অবশ্যই নিশ্চিত করে নিতে হবে যে আপনার এইসমস্ত ভিত্তিগুলো মজবুত এবং দৃঢ়।

এই ছিল সংক্ষিপ্ত কিছু উপদেশ। আল্লাহ আমাদেরকে তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করুন যারা সবকিছু সর্বোত্তমভাবে মেনে চলার চেষ্টা করেন।
রব্বানা আ-তিনা ফিদ্যুনইয়া হাসানাহ, ওয়াফিল আ-খিরতি হাসানাহ, ওয়াক্বিনা আ’যাবান্নার।

প্রশ্নোত্তর পর্ব

১) সঠিক পথের সন্ধান এবং হক দল সম্পর্কিত প্রশ্নে ইমামের জবাব:
সত্যের সন্ধান চালিয়ে যাওয়া শুধুমাত্র অমুসলিমদের জন্য নয়। ইসলামে থাকা সত্ত্বেও আপনাকে সদা সত্যসন্ধানী হতে হবে। আর এই কাজ আপনার আমৃত্যু চালিয়ে যেতে হবে। আমরা কখনো কখনো এমন ধারণা করি যে সত্যসন্ধান কেবল অমুসলিমরাই করবে আর যখনই তারা ‘লা~ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলবে সাথে সাথে কাজ শেষ। ব্যাপারটি মোটেই তা নয়। আপনি সত্যের সন্ধান করতে থাকবেন আপনার মৃত্যু আসা পর্যন্ত।

আপনার কাজের ক্ষেত্রে সবসময় লক্ষ্য রাখতে হবে যে আপনার কাজ রাসূলুল্লাহ ﷺ এর শিক্ষার সাথে মিলছে কিনা। কেননা আমরা সকলেই ‘আত-তয়্যিফাল-মানসূরহ’ বা ‘আল্লাহর মনোনীত বিজয়ী দল’ সম্পর্কিত হাদীসটি জানি। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল, আননিহায়া বিন মাঈন সহ অন্যান্য ইমামগণ এই বিজয়ী দল সম্পর্কে বলেছেন যে তাঁরা হলেন ‘আহলে-হাদীস’ অর্থাৎ ‘হাদীসের লোকেরা’। তাঁরা এর মাধ্যমে হাদীসের আ’লেমদের বোঝান নি যেহেতু কেবল হাদীসের আ’লেমদগণই সেই দলভুক্ত হলে অন্যান্য ক্ষেত্রের যেমন ফিকহের আ’লেমগণ কি বাদ যাবেন? বস্তুত ‘হাদীসের লোকেরা’ দ্বারা ‘হাদীস বা সুন্নাহগুলোর অনুসারী’ লোকদেরকে যা বুঝানো হয়েছে। সে সমস্ত লোক যারা রাসূলুল্লাহর ﷺ হাদীসগুলো মেনে চলে, যাদের কাজগুলো হয় তাঁর সুন্নাহ অনুসারে। এরাই হলেন ‘আহলে-হাদীস’। সুতরাং আপনি রাসূলের ﷺ সুন্নাহগুলো যত বেশি ধারণ করবেন ততই আপনি ‘আল্লাহর মনোনীত বিজয়ী দল’ এর নিকটতর হবেন। তাই আপনাকে সবসময় দেখে চলতে হবে যে আপনি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কাজের কতটা নিকটে রয়েছেন।

আর যখন আমি বলছি যে ‘রাসূলের ﷺ এর নিকটে’, আমি কেবলমাত্র তিনি কীভাবে কাপড় পড়েছিলেন, কীভাবে খাবার খেয়েছিলেন সেসব বোঝাতে চাইছি না। আমরা মাঝে মাঝে এই বিষয়গুলোতে অতি গুরুত্ব দিতে গিয়ে আসল ব্যাপারটিই ভুলে যাই। আর তা হল তিনি, রাসূলুল্লাহ ﷺ কীভাবে জীবন পরিচালনা করেছেন, তাঁর কোন সময়গুলো তিনি কোন কাজে অতিবাহিত করতেন। সমস্যা সমাধানে কীভাবে এগোতেন। আমাদের রাসূলুল্লাহ ﷺ এর জীবনটাকে দেখতে হবে একজন সেনাপ্রধান হিসেবে, একজন রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে। তাঁকে দেখতে হবে একজন সার্বজনীন শিক্ষক হিসেবে, পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে। এগুলোর সবই যে রাসূলুল্লাহর ﷺ এর সুন্নাতের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সর্বোপরি, আমাদেরকে জীবনে এই সবকিছুরই প্রয়াগ ঘটাতে হবে।

২) শাহাওয়াত বা ফিতনা থেকে বেঁচে থাকা সম্পর্কিত প্রশ্নে ইমামের জবাব :
ভাই, ফিতনা থেকে বেঁচে থাকবার সবচেয়ে উত্তম পন্থা হল ‘বিয়ে করে ফেলা’। সত্যিই, এটাই সমাধান। ভাই আপনাকে বিয়ে করে ফেলতে হবে।
আর দ্বিতীয় সর্বোত্তম পন্থা,যেহেতু প্রথমটির সামর্থ্য সকলের জন্য মূহূর্তেই সম্ভব না, তা হল দৃষ্টি সংযত রাখা, সিয়াম পালন এবং ঝামেলা থেকে দূরে থাকা। আর এই ঝামেলা থেকে দূরে থাকা বলতে আমি বোঝাচ্ছি যে আপনি নিজেকে এমন পরিস্থিতিতে নিবেন না যখন আপনি নিজেকে শয়তানের অধীন করে ফেলেন। এমন কিছু পরিস্থিতি আছে যখন স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে আপনি দুর্বল। সেসব পরিস্থিতির দিকে নিজেকে নেওয়া মানে হল নিজেকে শয়তানের অধীনস্থ করে তাকে সুযোগ করে দেওয়া। সুতরাং আপনাকে ফিতনা থেকে বেঁচে থাকতে হবে। এমনসব জায়গা এড়িয়ে চলতে হবে যেখানে আপনি প্রলুব্ধ হতে পারেন। কেননা সবসময় মনে রাখতে হবে যে একজন শত্রু সবসময় আপনার বিরুদ্ধে লড়ছে এবং সেই শত্রু অনেক বেশি অভিজ্ঞ, সে হল শয়তান। সে বহু সময় ধরে এই কাজে আছে, একেবারে আদম (আ’লাইহিস সালাম) এর সময় থেকে। সুতরাং তার হাজার হাজার বছরের সংঘবদ্ধ জ্ঞান রয়েছে। আপনার ক্ষেত্রে কীভাবে কী করতে হবে, কীভাবে আঘাত করতে হবে তা সে খুব ভাল করেই জানে।

আর সে শুধু অভিজ্ঞতা সঞ্চার করেছে তাই নয়, বরং একেবারে প্রথম দিন থেকেই সে তার কাজে পাকা। যখন শয়তান আদম (আ’লাইহিস সালাম) এর কাছে গেল, তখন সে কী বলেছিল? আল্লাহ সুবহানাহু আদম (আ’লাইহিস সালাম)কে বলেছিলেন, যা ইচ্ছে খাও শুধুমাত্র এই একটি গাছ ব্যতীত। শুধু এই গাছটি ছাড়া অন্যান্য সমস্ত গাছগাছালি হালাল করা হল। এরপর ইবলিস যখন আদম (আ’লাইহিস সালাম) এর কাছে গেলেন সে কী বলেছিল? সে কি এই কথা বলল যে, যাও এবং ওই গাছটির ফল খাও যেটা আল্লাহ হারাম করে দিয়েছেন? সে কি বলেছিল যে যাও, গিয়ে আল্লাহকে অমান্য কর? যাও, গিয়ে হারাম কাজ কর? – না। আদম (আ’লাইহিস সালাম)এর দুর্বল জায়গাগুলো কী ছিল, তা সে জানত। সে বলেছিল, ‘যাও এবং গিয়ে সেই গাছটি থেকে ফল খাও যা তোমাদেরকে দান করবে অনন্ত জীবন এবং এক অপার রাজ্য।’ আর এগুলো এমন জিনিস যা আমরা সকলেই পেতে চাই। সকলেই অনন্ত জীবন পেতে চায়, আবার সকলেই তো ক্ষমতা,রাজ্য, সম্পদ – এসমস্তও পেতে চায়। এভাবে করেই ইবলিস আদম (আ’লাইহিস সালাম)কে সেই নিষিদ্ধ গাছ থেকে খাওয়ার জন্য প্রলুব্ধ করেছিল। এত কথা বলার কারণ হল, শাইতান জানে কীভাবে আপনাকে ফাঁদে ফেলতে হবে। আর তাই আপনাকে সতর্ক থাকতে হবে।

এটাকে কেবল একটি যুদ্ধ মনে করুন। যখন আপনি যুদ্ধে শত্রুর সাথে লড়ছেন, নিজেকে শত্রুর সামনে মূহূর্তের জন্যও অসংরক্ষিত করবেন না। আপনাকে নিজের নিরাপত্তা রক্ষা করতে হবে। আর সেই নিরাপত্তাগুলো হল, আপনাকে আপনার সৈন্যদলের সাথে অর্থাৎ আপনার ভাইদের সাথে থাকতে হবে। আপনাকে অস্ত্র সাথে রাখতে হবে, আপনি খালি হাতে যুদ্ধক্ষেত্রে নেমে যেতে পারেন না। আর যেই অস্ত্রসগুলো আপনি সাথে রাখবেন তা হল “আউ’যুবিল্লাহি-মিনাশ-শাইত্বনির-রযীম”, “আয়াতুল-কুরসি”, আল্লাহর যিকির। যেহেতু রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, ‘আল্লাহর যিকিরসমূহ মু’মিনদের দুর্গস্বরূপ’। এগুলো আপনাকে শাইতান থেকে রক্ষা করে। তাই আপনাকে এই দুর্গের ভিতর থাকতে হবে। নিজেকে এর থেকে বের করবেন না। এর ভিতরে থেকে যুদ্ধ করুন।

৩) নিজে নিজে জ্ঞানার্জনের কুপ্রভাব এবং একইসাথে কুরআন পড়ে চিন্তাভাবনার প্রশ্নে ইমামের উত্তর :
আমি যেটা খেয়াল করেছি তা হল, সমস্যাটা সৃষ্টি হয় যখন মানুষ সরাসরি বই বা কিতাবাদি থেকে শিখতে চায়। কিন্তু আমি বলব, বই থেকে নিজে নিজে ভুলভাবে কোনোকিছু বুঝে নেওয়াও কিছু না জানার চেয়ে উত্তম। তাই বলে আমি এটাও বলছি না যে আপনি কেবল কিতাবাদি থেকে সরাসরি শিখতে শুরু করবেন। বরং আপনি আপনার আশেপাশের ঊ’লামাদের সাহায্য নিন। আপনার কাছাকাছিতেই এমন অনেক শিক্ষক রয়েছেন যারা আপনাকে হুকুম-আহকাম এবং প্রকৃত অর্থ সম্পর্কিত বিষয়গুলোতে সঠিক জ্ঞান দিতে পারেন। কেননা যখন বিষয়টা আহকামজনিত, আপনি ইচ্ছা করলেই তা দিতে পারবেন। এটা ঊ’লামাদের জন্য বরাদ্দ। কিন্তু উত্তম কাজগুলো, তাদের ফযিলতসমূহ জানা ইত্যাদি বিষয়গুলো সকলের জন্যই উন্মুক্ত।
আবার আল্লাহ আ’যযাওয়াযাল বলেন, “তারা কি কুরআন নিয়ে চিন্তাভাবনা করে না?…” (সূরা মুহাম্মাদ, ২৪)
এই আদেশটি সার্বজনীন, শুধুমাত্র ঊ’লামাদের জন্য নয়। সাধারণ মানুষও কুরআন নিয়ে চিন্তা গবেষণা করবে। যে ব্যাপারটি নিষিদ্ধ তা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, “যে ব্যক্তি কুরআনকে নিজ মতে ব্যাখ্যা করল, সে জাহান্নামে নিজের জন্য একটি ঘর বানিয়ে নিল।” (তিরমিযী)
অর্থাৎ আপনি যখন কুরআনের মনগড়া ব্যাখ্যা করে কোনো আহকাম বা ফতোয়া দিয়ে দিলেন, তখনই হল বিপদ। কিন্তু কুরআন নিয়ে চিন্তা গবেষণা করা, বোঝার চেষ্টা করা হল এমন কিছু যা করতে উৎসাহিত করা হয়েছে, আদেশ দেওয়া হয়েছে। তা না করলে আল্লাহ বলেন যে অন্তরগুলো তালাবদ্ধ। (সূরা মুহাম্মাদ, ২৪)
সুতরাং, কুরআন নিজে ব্যাখ্যা করা যাবে না, এথেকে মনগড়া ফতোয়া দেওয়া যাবে না, তবে কুরআন নিয়ে চিন্তা গবেষণা করতে হবে।

৪) কিছু ক্ষেত্রে অমুসলিমদের সাথে ঐক্যমত্য আবার মুসলিম ভাইদের সাথেই মনোমালিন্য হওয়া প্রসঙ্গে :
সাধারণত যে কারণটা এক্ষেত্রে দেখানো হয় তা হল, অমুসলিমদের ভাল আখলাক কিন্তু মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও তাদের খারাপ আখলাক। কিন্তু এটি একটি মারাত্মক কথা। আমি আমার কোনো ভাইয়ের এমন বিশ্বাস থাকলে তাদেরকে কঠোরভাবে হুঁশিয়ার করে দিতে চাই। কেননা এটি একটি ভয়ানক বিশ্বাস, এটি ‘ওয়ালা এবং বারা’ এর সাথে জড়িত, যা এককথায় বিশ্বাসীদের প্রতি আনুগত্য ও সুসম্পর্ক এবং অবিশ্বাসীদের সাথে দুঃসম্পর্ক।

বাস্তবে, এই যে আমাদের নিজদের মধ্যকার বিষয়াদিতে সমস্যা ও মনোমালিন্য কিন্তু কুফফারদের সাথে ঐকমত্য হয়ে যাওয়া – এর মূল কারণ হল, শয়তান এটাই চায় যে আমরা নিজেরা ছন্নছাড়া থাকি আর কুফফারদের সাথে আমাদের মিল হোক। যখনই আমরা একে অপরের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সাক্ষাৎ করি, তখন সে এসে ওয়াসওয়াসা দিয়ে আমাদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করতে চায়। আর যখন আমরা কুফফারদের সাথে সাক্ষাৎ করি, সে সর্বোত্তম চেষ্টা করে তাদের প্রতি কোমল হতে।
আর তাই আল্লাহ আ’যযাওয়াযাল কুরআনে বলছেন, “আমার বান্দাদের বলুন, তারা যেন উত্তম কথা বলে; শয়তান তাদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করতে চায়; নিশ্চয়ই শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু।” (সূরা বানী ঈসরাঈল, ৫৩)
তাই আপনি যদি আপনার ভাইদের সাথে কথা বলবার সময় এমন শব্দ ব্যবহার করেন, যেগুলোর একাধিক অর্থ থাকতে পারে, তাহলে তা হবে আপনার ব্যর্থতা। কেননা শয়তান তখন সেই শব্দটি ব্যবহার করে আপনাদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টির সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। তাই আল্লাহ আ’যযাওয়াযাল উপরোক্ত আয়াতে বলছেন যে, তোমার কথাগুলো উত্তম কিনা তা নিশ্চিত হও, এমন ভাষায় কথা বল যা কেউ ভুল বুঝবে না, বিনয়ের সুরে ভাইদের সাথে কথা বল। আর এভাবেই শয়তানের মুখের উপর কপাট লাগাতে পারবেন।

আবার আমরা দেখি যে, কুফফাররা নিজেরা ঐক্যবদ্ধ কেননা শয়তান কেন চাইবে তারা ছিন্নবিচ্ছিন্ন হোক? তাই সে তাদের দিকে ভ্রুক্ষেপই করে না। সে তাদেরকে নিজদের মত ছেড়ে দেয়। কারণ তারা একত্র থাকুক বা নাই থাকুক তাতে কোনোকিছুই আসে যায় না। খালাস। “তাদের কোনো কাজেই কিছু আসে যায় না”
কিন্তু বিশ্বাসীদের ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, “শয়তান আরব বিশ্বের মুসলিমদেরকে কুফরী করানো থেকে / তার ই’বাদাত করানো থেকে হাল ছেড়ে দিয়েছে। এখন সে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে যাতে তোমাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়।”
দেখা যায়, আপনার কোনো ভাই আপনাকে কিছু বললেন, আর শয়তান যা করে তা হল আপনি যখন বাড়ি যান, আপনি সেটা নিয়ে সারারাত দুশ্চিন্তা করতে থাকেন। এরপর আপনার বোধ হয়, ‘ ওহ আচ্ছা, সে এটা বুঝিয়েছিল! সে তো আসলে আমাকে ছোট করেছে। আমি তো এটা সেসময় বুঝতেই পারিনি।’ অথচ দেখা যায়, প্রথমে থেকেই কোনোকিছু আসলে বোঝানো হয় নি।
তাই আমাদেরকে সবসময় খেয়াল রাখতে হবে যে এক শত্রু সারাক্ষণ আমাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির জন্য লেগে রয়েছে আর যখনই আমরা বিভক্ত হয়ে যাচ্ছি, আমরা প্রকৃতপক্ষে শয়তানের আদেশ মেনে নিয়ে তার ইচ্ছা পূরণ করছি। সুতরাং চাবিকাঠি হল, উত্তম কথা বলা।