হযরত মূসা ও হারূণ (আঃ) – ০১

আল্লাহর গযবে ধ্বংসপ্রাপ্ত পৃথিবীর আদি ৬টি জাতির মধ্যে কওমে নূহ, ‘আদ, ছামূদ, লূত্ব ও কওমে মাদইয়ানের বর্ণনার পর ষষ্ঠ গযবপ্রাপ্ত জাতি হিসাবে কওমে ফেরাঊন সম্পর্কে আল্লাহ পাক কুরআনের ২৭টি সূরায় ৭৫টি স্থানে বিভিন্ন প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন।[1] কুরআনে সর্বাধিক আলোচিত বিষয় হ’ল এটি। যাতে ফেরাঊনের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য ও তার যুলুমের নীতি-পদ্ধতি সমূহ পাঠকদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় এবং এযুগের ফেরাঊনদের বিষয়ে উম্মতে মুহাম্মাদী হুঁশিয়ার হয়। ফেরাঊনের কাছে প্রেরিত নবী মূসা ও হারূণ (আঃ) সম্পর্কে কুরআনে সর্বাধিক আলোচনা স্থান পেয়েছে। কারণ মূসা (আঃ)-এর মু‘জেযা সমূহ অন্যান্য নবীদের তুলনায় যেমন বেশী ছিল, তাঁর সম্প্রদায় বনী ইস্রাঈলের মূর্খতা ও হঠকারিতার ঘটনাবলীও ছিল বিগত উম্মতগুলির তুলনায় অধিক এবং চমকপ্রদ। এতদ্ব্যতীত মূসা (আঃ)-কে বারবার পরীক্ষা নেবার মধ্যে এবং তাঁর কওমের দীর্ঘ কাহিনীর আলোচনা প্রসঙ্গে বহু জ্ঞাতব্য বিষয় ও আদেশ-নিষেধের কথাও এসেছে। সর্বোপরি শাসক সম্রাট ফেরাঊন ও তার ক্বিবতী সম্প্রদায় কর্তৃক সংখ্যালঘু অভিবাসী বনু ইস্রাঈল সম্প্রদায়ের উপর যুলুম-অত্যাচারের বিবরণ ও তার প্রতিরোধে মূসা (আঃ)-এর প্রচেষ্টা এবং দীর্ঘ বিশ বছর ধরে যালেম সম্প্রদায়ের উপরে আপতিত বিভিন্ন গযবের বর্ণনা ও অবশেষে ফেরাঊনের সদলবলে সলিল সমাধির ঘটনা যেন জীবন্ত বাণীচিত্র হয়ে ফুটে উঠেছে বিভিন্ন সূরায় বর্ণিত কুরআনের অনুপম বাকভঙ্গীতে। মোটকথা কুরআন পাক মূসা (আঃ)-এর কাহিনীকে এত গুরুত্ব দিয়েছে যে, অধিকাংশ সূরায় এর কিছু না কিছু বর্ণিত হয়েছে। কারণ এই কাহিনীতে অগণিত শিক্ষা, আল্লাহ তা‘আলার অপার শক্তি ও অনুগ্রহের বিস্ময়কর রহস্য সমূহ সন্নিবেশিত হয়েছে। এগুলোতে কর্মোদ্দীপনা ও চারিত্রিক সংশোধনের নির্দেশিকা সমূহ প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান রয়েছে।

মূসা (আঃ) ও ফেরাঊনের ঘটনা কুরআনে বারবার উল্লেখ করার অন্যতম উদ্দেশ্য হ’ল, এলাহী কিতাবধারী ইহুদী-নাছারাদের পিছনের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া এবং শেষনবীর উপরে ঈমান আনার পক্ষে যৌক্তিকতা উপস্থাপন করা। উল্লেখ্য যে, পরবর্তী রাসূল দাঊদ, সুলায়মান ও ঈসা (আলাইহিমুস সালাম) সবাই ছিলেন বনু ইস্রাঈল-এর সম্প্রদায়ভুক্ত এবং তাদের প্রতি প্রেরিত নবী। মূসা (আলাইহিস সালাম) ছিলেন এঁদের সবার মূল ও অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব।

উল্লেখ্য যে, কওমে মূসা ও ফেরাঊন সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের মোট ৪৪টি সূরায় ৫৩২টি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।[2]

ফেরাঊনের পরিচয় :

‘ফেরাঊন’ কোন ব্যক্তির নাম নয়। বরং এটি হ’ল তৎকালীন মিসরের সম্রাটদের উপাধি। ক্বিবতী বংশীয় এই সম্রাটগণ কয়েক শতাব্দী ব্যাপী মিসর শাসন করেন। এই সময় মিসর সভ্যতা ও সমৃদ্ধির শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিল। লাশ মমিকরণ, পিরামিড (PYRAMID), স্ফিংক্স (SPHINX) প্রভৃতি তাদের সময়কার বৈজ্ঞানিক উন্নতির প্রমাণ বহন করে। হযরত মূসা (আঃ)-এর সময়ে পরপর দু’জন ফেরাঊন ছিলেন। সর্বসম্মত ইস্রাঈলী বর্ণনাও হ’ল এটাই এবং মূসা (আঃ) দু’জনেরই সাক্ষাৎ লাভ করেন। লুইস গোল্ডিং (LOUIS GOLDING)-এর তথ্যানুসন্ধানমূলক ভ্রমণবৃত্তান্ত IN THE STEPS OF MOSSES, THE LAW GIVER অনুযায়ী উক্ত ‘উৎপীড়ক ফেরাঊন’-এর (PHARAOH, THE PERSECUTOR) নাম ছিল ‘রেমেসিস-২’ (RAMSES-11) এবং ডুবে মরা ফেরাঊন ছিল তার পুত্র মানেপতাহ (منفطه) বা মারনেপতাহ (MERNEPTAH)। লোহিত সাগর সংলগ্ন তিক্ত হরদে তিনি সসৈন্যে ডুবে মরেন। যার ‘মমি’ ১৯০৭ সালে আবিষ্কৃত হয়। সিনাই উপদ্বীপের পশ্চিম তীরে ‘জাবালে ফেরাঊন’ নামে একটি ছোট পাহাড় আছে। এখানেই ফেরাঊনের লাশ প্রথম পাওয়া যায় বলে জনশ্রুতি আছে। গোল্ডিংয়ের ভ্রমণ পুস্তক এবং এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকার নিবন্ধে বলা হয়েছে যে, ‘থেব্স’ (THEBES) নামক স্থানের সমাধি মন্দিরে ১৮৯৬ সালে একটি স্তম্ভ আবিষ্কৃত হয়, যাতে মারনেপতাহ-এর আমলের কীর্তি সমূহ লিপিবদ্ধ ছিল। অতঃপর ১৯০৬ সালে বৃটিশ নৃতত্ত্ববিদ স্যার ক্রাঁফো ইলিয়ট স্মিথ (SIR CRAFTON ELLIOT SMITH) মমিগুলো খুলে মমিকরণের কলাকৌশল অনুসন্ধান শুরু করেন। এভাবে তিনি ৪৪টি মমি পরীক্ষা করেন এবং অবশেষে ১৯০৭ সালে তিনি ফেরাঊন মারনেপতাহ-এর লাশ শনাক্ত করেন। ঐসময় তার লাশের উপরে লবণের একটি স্তর জমে ছিল। যা দেখে সবাই স্তম্ভিত হন। এ কারণে যে, অন্য কোন মমি দেহে অনুরূপ পাওয়া যায়নি।[3] উক্ত লবণের স্তর যে সাগরের লবণাক্ত পানি তা বলাই বাহুল্য। এভাবে সূরা ইউনুস ৯২ আয়াতের বক্তব্য দুনিয়াবাসীর নিকটে সত্য প্রমাণিত হয়ে যায়। যেখানে আল্লাহ বলেছিলেন যে, ‘আজকে আমরা তোমার দেহকে (বিনষ্ট হওয়া থেকে) বাঁচিয়ে দিলাম। যাতে তুমি পরবর্তীদের জন্য দৃষ্টান্ত হ’তে পার’… (ইউনুস ১০/৯২)। বস্ত্ততঃ ফেরাঊনের লাশ আজও মিসরের পিরামিডে রক্ষিত আছে। যা দেখে লোকেরা উপদেশ হাছিল করতে পারে।

মূসা ও ফেরাঊন সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,

نَتْلُوا عَلَيْكَ مِن نَّبَإِ مُوسَى وَفِرْعَوْنَ بِالْحَقِّ لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ- إِنَّ فِرْعَوْنَ عَلاَ فِي الْأَرْضِ وَجَعَلَ أَهْلَهَا شِيَعاً يَسْتَضْعِفُ طَائِفَةً مِّنْهُمْ يُذَبِّحُ أَبْنَاءَهُمْ وَيَسْتَحْيِي نِسَاءَهُمْ إِنَّهُ كَانَ مِنَ الْمُفْسِدِيْنَ- (القصص ৩-৪)-

‘আমরা আপনার নিকটে মূসা ও ফেরাঊনের বৃত্তান্ত সমূহ থেকে সত্য সহকারে বর্ণনা করব বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য’। ‘নিশ্চয়ই ফেরাঊন তার দেশে উদ্ধত হয়েছিল এবং তার জনগণকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করেছিল। তাদের মধ্যকার একটি দলকে সে দুর্বল করে দিয়েছিল। সে তাদের পুত্র  সন্তানদের হত্যা করত ও কন্যা সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখত। বস্ত্ততঃ সে ছিল অনর্থ সৃষ্টিকারীদের অন্তর্ভুক্ত’ (ক্বাছাছ ২৮/৩-৪)

পবিত্র কুরআনে ফেরাঊনের আলোচনা যত এসেছে, পূর্ব যুগের অন্য কোন নরপতি সম্পর্কে এত বেশী আলোচনা আসেনি। এর মাধ্যমে ফেরাঊনী যুলুমের বিভিন্ন দিক স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। যাতে ইঙ্গিত রয়েছে এ বিষয়ে যে, যুগে যুগে ফেরাঊনরা আসবে এবং ঈমানদার সৎকর্মশীলদের উপরে তাদের যুলুমের ধারা ও বৈশিষ্ট্য প্রায় একই রূপ হবে। যদিও পদ্ধতি পরিবর্তিত হবে। কোন যুগই ফেরাঊন থেকে খালি থাকবে না। তাই ফেরাঊন সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেওয়ার জন্য আল্লাহ পবিত্র কুরআনে এই নরাধম সম্পর্কে এত বেশী আলোচনা করেছেন। যাতে আল্লাহর প্রিয় বান্দারা সাবধান হয় এবং যালেমদের ভয়ে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত না হয়। মুসলিম নামধারী বর্তমান মিসরীয় জাতীয়তাবাদী নেতারা ফেরাঊনকে তাদের ‘জাতীয় বীর’ বলে আখ্যায়িত করছেন এবং কায়রোর ‘ময়দানে রেমেসীস’-এর প্রধান ফটকে তার বিশাল প্রস্তর মূর্তি খাড়া করেছেন’।[4]

বনু ইস্রাঈলের পূর্ব ইতিহাস :

হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর কনিষ্ঠ পুত্র হযরত ইসহাক্ব (আঃ)-এর পুত্র ইয়াকূব (আঃ)-এর অপর নাম ছিল ‘ইস্রাঈল’। হিব্রু ভাষায় ‘ইস্রাঈল’ অর্থ ‘আল্লাহর দাস’। সে হিসাবে ইয়াকূব (আঃ)-এর বংশধরগণকে ‘বনু ইস্রাঈল’ বলা হয়। কুরআনে তাদেরকে ‘বনু ইস্রাঈল’ বলে অভিহিত করা হয়েছে, যাতে ‘আল্লাহর দাস’ হবার কথাটি তাদের বারবার স্মরণে আসে।

ইয়াকূব (আঃ) ও বনু ইস্রাঈলদের আদি বাসস্থান ছিল কেন‘আনে, যা বর্তমান ফিলিস্তীন এলাকায় অবস্থিত। তখনকার সময় ফিলিস্তীন ও সিরিয়া মিলিতভাবে শাম দেশ ছিল। বলা চলে যে, প্রথম ও শেষনবী ব্যতীত প্রায় সকল নবীর আবাসস্থল ছিল ইরাক ও শাম অঞ্চলে। যার গোটা অঞ্চলকে এখন ‘মধ্যপ্রাচ্য’ বলা হচ্ছে। ইয়াকূব (আঃ)-এর পুত্র হযরত ইউসুফ (আঃ) যখন মিসরের অর্থমন্ত্রী ও পরে শাসনকর্তা নিযুক্ত হন এবং অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় কেন‘আন অঞ্চলেও চরম দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তখন ইউসুফ (আঃ)-এর আমন্ত্রণে পিতা ইয়াকূব (আঃ) স্বীয় পুত্রগণ ও পরিবারবর্গ সহ হিজরত করে মিসরে চলে যান। ক্রমে তাঁরা সেখানে আধিপত্য বিস্তার করেন ও সুখে-শান্তিতে দিনাতিপাত করতে থাকেন। তারীখুল আম্বিয়া-র লেখক বলেন, ইউসুফ (আঃ)-এর কাহিনীতে কোথাও ফেরাঊনের নাম উল্লেখ না থাকায় প্রমাণিত হয় যে, ঐ সময় ফেরাঊনদের হটিয়ে সেখানে ‘হাকসূস’ (ملوك الهكسوس ) রাজাদের রাজত্ব কায়েম হয়। যারা দু’শো বছর রাজত্ব করেন এবং যা ছিল ঈসা (আঃ)-এর জন্মের প্রায় দু’হাযার বছর আগের ঘটনা।[5] অতঃপর মিসর পুনরায় ফেরাঊনদের অধিকারে ফিরে আসে। ইউসুফ (আঃ)-এর মৃত্যুর পরে তাঁর পঞ্চম অধঃস্তন পুরুষ মূসা ও হারূনের সময় যে নিপীড়ক ফেরাঊন শাসন ক্ষমতায় ছিল তার নাম ছিল রেমেসীস-২। অতঃপর তার পুত্র মারনেপতাহ-এর সময় সাগরডুবির ঘটনা ঘটে এবং সৈন্য-সামন্ত সহ তার সলিল সমাধি হয়।

‘ফেরাঊন’ ছিল মিসরের ক্বিবতী বংশীয় শাসকদের উপাধি। ক্বিবতীরা ছিল মিসরের আদি বাসিন্দা। এক্ষণে তারা সম্রাট বংশের হওয়ায় শাম থেকে আগত সুখী-স্বচ্ছল বনু ইস্রাঈলদের হিংসা করতে থাকে। ক্রমে তা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের রূপ পরিগ্রহ করে।

এক বর্ণনায় এসেছে যে, ইয়াকূবের মিসরে আগমন থেকে মূসার সাথে মিসর থেকে বিদায়কালে প্রায় চারশত বছর সময়ের মধ্যে তাদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল কাছাকাছি প্রায় তিন মিলিয়ন[6] এবং এ সময় তারা ছিল মিসরের মোট জনসংখ্যার ১০ থেকে ২০ শতাংশ’।[7] তবে এগুলি সবই ইস্রাঈলীদের কাল্পনিক হিসাব মাত্র। যার কোন ভিত্তি নেই’। বরং কুরআন বলছে إِنَّ هَؤُلآء لَشِرْذِمَةٌ قَلِيلُونَ- (الشعراء ৫৪)- ‘নিশ্চয়ই তারা ছিল ক্ষুদ্র একটি দল’ (শো‘আরা ২৬/৫৪)। এই বহিরাগত নবী বংশ ও ক্ষুদ্র দলের সুনাম-সুখ্যাতিই ছিল সংখ্যায় বড় ও শাসকদল ক্বিবতীদের হিংসার কারণ। এরপর জ্যোতিষীদের ভবিষ্যদ্বাণী ফেরাঊনকে ভীত ও ক্ষিপ্ত করে তোলে।

মূসা (আঃ)-এর পরিচয় :

موسى بن عمران بن قاهث بن عازر بن لاوى بن يعقوب بن اسحاق بن ابراهيم عليهم السلام-

মূসা ইবনে ইমরান বিন ক্বাহেছ বিন ‘আযের বিন লাভী বিন ইয়াকূব বিন ইসহাক্ব বিন ইবরাহীম (আঃ)।[8] অর্থাৎ মূসা হ’লেন ইবরাহীম (আঃ)-এর ৮ম অধঃস্তন পুরুষ। মূসা (আঃ)-এর পিতার নাম ছিল ‘ইমরান’ ও মাতার নাম ছিল ‘ইউহানিব’। তবে মায়ের নামের ব্যাপারে মতভেদ আছে।[9] উল্লেখ্য যে, মারিয়াম (আঃ)-এর পিতার নামও ছিল ‘ইমরান’। যিনি ছিলেন হযরত ঈসা (আঃ)-এর নানা। মূসা ও ঈসা উভয় নবীই ছিলেন বনু ইস্রাঈল বংশীয় এবং উভয়ে বনু ইস্রাঈলের প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন (সাজদাহ ৩২/২৩, ছফ ৬১/৬)। মূসার জন্ম হয় মিসরে এবং লালিত-পালিত হন মিসর সম্রাট ফেরাঊনের ঘরে। তাঁর সহোদর ভাই হারূণ (আঃ) ছিলেন তাঁর চেয়ে তিন বছরের বড় এবং তিনি মূসা (আঃ)-এর তিন বছর পূর্বেই মৃত্যুবরণ করেন। উভয়ের মৃত্যু হয় মিসর ও শাম-এর মধ্যবর্তী তীহ্ প্রান্তরে বনু ইস্রাঈলের ৪০ বছর আটক থাকাকালীন সময়ে। মাওলানা মওদূদী বলেন, মূসা (আঃ) পঞ্চাশ বছর বয়সে নবী হয়ে ফেরাঊনের দরবারে পৌঁছেন। অতঃপর তেইশ বছর দ্বন্দ্ব-সংগ্রামের পর ফেরাঊন ডুবে মরে এবং বনু ইস্রাঈল মিসর থেকে বেরিয়ে যায়। এ সময় মূসা (আঃ)-এর বয়স ছিল সম্ভবতঃ আশি বছর।[10] তবে মুফতী মুহাম্মাদ শফী বলেন, ফেরাঊনের জাদুকরদের সাথে মুকাবিলার ঘটনার পর ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী মূসা (আঃ) বিশ বছর যাবত মিসরে অবস্থান করেন। এ সময় আল্লাহ মূসা (আঃ)-কে নয়টি মু‘জেযা দান করেন।

উল্লেখ্য যে, আদম, ইয়াহ্ইয়া ও ঈসা (আঃ) ব্যতীত প্রায় সকল নবীই চল্লিশ বছর বয়সে নবুঅত লাভ করেছিলেন। মূসাও চল্লিশ বছর বয়সে নবুঅত লাভ করেছিলেন বলে অধিকাংশ বিদ্বান মত পোষণ করেছেন।[11] সেমতে আমরা মূসা (আঃ)-এর বয়সকে নিম্নরূপে ভাগ করতে পারি। যেমন, প্রথম ৩০ বছর মিসরে, তারপর ১০ বছর মাদিয়ানে, তারপর মিসরে ফেরার পথে তূর পাহাড়ের নিকটে ‘তুবা’ (طُوَى) উপত্যকায় ৪০ বছর বয়সে নবুঅত লাভ। অতঃপর ২০ বছর মিসরে অবস্থান করে সেখানকার অধিবাসীদেরকে তাওহীদের দাওয়াত প্রদান। তারপর ৬০ বছর বয়সে বনু ইস্রাঈলদের নিয়ে মিসর হ’তে প্রস্থান এবং ফেরাঊনের সলিল সমাধি। অতঃপর আদি বাসস্থান কেন‘আন অধিকারী আমালেক্বাদের বিরুদ্ধে জিহাদের হুকুম অমান্য করায় অবাধ্য ইস্রাঈলীদের নিয়ে ৪০ বছর যাবত তীহ্ প্রান্তরে উন্মুক্ত কারাগারে অবস্থান ও বায়তুল মুক্বাদ্দাসের সন্নিকটে মৃত্যু সম্ভবতঃ ৮০ থেকে ১০০ বছর বয়সের মধ্যে। মূসা (আঃ)-এর কবর হয় বায়তুল মুক্বাদ্দাসের উপকণ্ঠে। আমাদের নবী (ছাঃ) সেখানে একটি লাল ঢিবির দিকে ইশারা করে সেস্থানেই মূসা (আঃ)-এর কবর হয়েছে বলে জানিয়েছেন।[12] উল্লেখ্য যে, আদম (আঃ) থেকে ইবরাহীম (আঃ) পর্যন্ত ১০/১২ জন নবী বাদে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আগমনের পূর্ব পর্যন্ত পৃথিবীতে আগত সর্বমোট এক লক্ষ চবিবশ হাযার নবী-রাসূলের[13] প্রায় সবাই ইস্রাঈল বংশের ছিলেন এবং তাঁরা ছিলেন সেমেটিক। কেননা ইব্রাহীম (আঃ) ছিলেন সাম বিন নূহ-এর ৯ম অধঃস্তন পুরুষ। এজন্য ইবরাহীমকে ‘আবুল আম্বিয়া’ বা নবীদের পিতা বলা হয়।


[1]. মুহাম্মাদ সালামাহ জাবর, তারীখুল আম্বিয়া (কুয়েত : মাকতাবা ছাহওয়াহ ১৪১৩/১৯৯৩), ১/১৩৬ পৃঃ।
[2]. যথাক্রমে (১) বাক্বারাহ ২/৪৯-৭৪=২৬, ৮৭, ৯২-৯৮=৭, ১০৮, ১৩৬, ২৪৬-২৪৮; (২) আলে-ইমরান ৩/১১, ৮৪; (৩) নিসা ৪/৪৭, ১৫৩-১৫৫, ১৬৪; (৪) মায়েদাহ ৫/২০-২৬=৭; (৫) আন‘আম ৬/৮৪, ৯১, ১৫৪; (৬) আ‘রাফ ৭/১০৩-১৬২=৬০, ১৭১, ১৭৫-১৭৬; (৭) আনফাল ৮/৫২-৫৪=৩; (৮) ইউনুস ১০/৭৫-৯০=১৬; (৯) হূদ ১১/৯৬-১০১=৬, ১১০; (১০) ইবরাহীম ১৪/৫-৮=৪; (১১) ইসরা ১৭/২, ১০১-১০৪=৪; (১২) কাহফ ১৮/৬০-৮২=২৩; (১৩) মারিয়াম ১৯/৫১-৫৩=৩; (১৪) ত্বোয়াহা ২০/৯-৯৯=৯১; (১৫) আম্বিয়া ২১/৪৮-৫০=৩; (১৬) হজ্জ ২২/৪৪; (১৭) মুমিনূন ২৩/৪৫-৪৯=৫; (১৮) ফুরক্বান ২৫/৩৫-৩৬; (১৯) শো‘আরা ২৬/১০-৬৮=৫৯; (২০) নমল ২৭/৭-১৪=৮; (২১) ক্বাছাছ ২৮/৩-৪৮=৪৬, ৭৬-৮৩=৮; (২২) আনক্বাবূত ২৯/৩৯-৪০; (২৩) সাজদাহ ৩২/২৩-২৪; (২৪) আহযাব ৩৩/৭, ৬৯; (২৫) ছাফফাত ৩৭/১১৪-১২২=৯; (২৬) ছোয়াদ ৩৮/১২; (২৭) গাফের/মুমিন ৪০/২৩-৫৪=৩২; (২৮) ফুছছিলাত/হা-মীম সাজদাহ ৪১/৪৫; (২৯) শূরা ৪২/১৩ (৩০) যুখরুফ ৪৩/৪৬-৫৬=১১; (৩১) দুখান ৪৪/১৭-৩১=১৫; (৩২) আহক্বাফ ৪৬/১২, ৩০; (৩৩) ক্বাফ ৫০/১৩; (৩৪) নজম ৫৩/৩৬; (৩৫) ছফ ৬১/৫ (৩৬) যারিয়াত ৫১/৩৮-৪০=৩; (৩৭) ক্বামার ৫৪/৪১-৪২; (৩৮) তাহরীম ৬৬/১১; (৩৯) হা-কক্বাহ ৬৯/৯; (৪০) মুযযাম্মিল ৭৩/১৫-১৬; (৪১) নাযি‘আত ৭৯/১৫-২৬=১২; (৪২) বুরূজ ৮৫/১৮; (৪৩) আ‘লা ৮৭/১৯ (৪৪) ফাজর ৮৯/১০।  সর্বমোট = ৫৩২টি।
[3]. মাওলানা মওদূদী, রাসায়েল ও মাসায়েল (ঢাকা: ১৯৯৬) ৫/৯৯ পৃ:; তানত্বাভী জওহারী (মৃ: ১৯৪০খৃ:), আল-জাওয়াহের ফী তাফসীরিল কুরআনিল কারীম (বৈরুত: দারুল ফিকর, তাবি) তাফসীর সূরা ইউনুস ৯২ দ্র: ৬/৮৪ পৃ:।
[4]. মুহাম্মাদ সালামাহ জাবর, তারীখুল আম্বিয়া (কুয়েত: মাকতাবা ছাহওয়াহ ১৪১৩/১৯৯৩) ১/১৩৭।
[5]. তারীখুল আম্বিয়া, পৃঃ ১২৪।
[6]. তারীখুল আম্বিয়া ১/১৪০।
[7]. মাওলানা মওদূদী, রাসায়েল ও মাসায়েল ৫/২৫০ পৃঃ।
[8]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ১/২২২।
[9]. তাফসীর মা‘আরেফুল কুরআন, ত্বোয়াহা ৩৮-৩৯, পৃঃ ৮৫১।
[10]. রাসায়েল ও মাসায়েল ৩/১২০, ৩য় মুদ্রণ ২০০১।
[11]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ১/২২৬।
[12]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫৭১৩ ‘ক্বিয়ামতের অবস্থা ও সৃষ্টির সূচনা’ অধ্যায় ৯  অনুচ্ছেদ।
[13]. আহমাদ, মিশকাত হা/৫৭৩৭ ‘ক্বিয়ামতের অবস্থা ও সৃষ্টির সূচনা’ অধ্যায় ৯ অনুচ্ছেদ; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৬৬৮।