হযরত মূসা ও হারূণ (আঃ) – ১৩

নবুঅত-পরবর্তী ৪র্থ পরীক্ষা : বায়তুল মুক্বাদ্দাস অভিযান

আল্লাহ পাক মূসা (আঃ)-এর মাধ্যমে বনু ইস্রাঈলকে আমালেক্বা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে জিহাদ করে শাম দখল করতে বলেছিলেন। সাথে সাথে এ সুসংবাদও দিয়েছিলেন যে, শামের ভূখন্ড তাদের ভাগ্যে লেখা হয়ে গেছে (মায়েদাহ ৫/২১)। কাজেই তোমাদের বিজয় সুনিশ্চিত। কিন্তু এইসব বিলাসী কাপুরুষেরা আল্লাহর কথায় দৃঢ় বিশ্বাস আনতে পারেনি।

মূসা (আঃ) আল্লাহর নির্দেশ পালনের জন্য বনী ইস্রাঈলকে সাথে নিয়ে মিসর থেকে শাম অভিমুখে রওয়ানা হ’লেন। যথা সময়ে তাঁরা জর্দান নদী পার হয়ে ‘আরীহা’ (أريحة) পৌঁছে শিবির স্থাপন করলেন। এটি ছিল পৃথিবীর প্রাচীনতম মহানগরী সমূহের অন্যতম, যা জর্দান নদী ও বায়তুল মুক্বাদ্দাসের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। যা আজও স্বনামে বিদ্যমান রয়েছে। মূসা (আঃ)-এর সময়ে এ শহরের অত্যাশ্চর্য জাঁক-জমক ও বিস্তৃতি ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে।

শিবির স্থাপনের পর মূসা (আঃ) বিপক্ষ দলের অবস্থা ও অবস্থান পর্যবেক্ষণের জন্য ১২ জন সর্দারকে প্রেরণ করলেন। যারা ছিলেন হযরত ইয়াকূব (আঃ)-এর বারো পুত্রের বংশধরগণের ‘বারোজন প্রতিনিধি, যাদেরকে তিনি আগেই নির্বাচন করেছিলেন স্ব স্ব গোত্রের লোকদের দেখাশুনার জন্য’ (মায়েদাহ ৫/১২)। তারা রওয়ানা হবার পর বায়তুল মুক্বাদ্দাস শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছলে বিপক্ষ দলের বিশালদেহী বিকট চেহারার একজন লোকের সঙ্গে সাক্ষাত হয়। ইস্রাঈলী রেওয়ায়াত সমূহে লোকটির নাম ‘আউজ ইবনে ওনুক’ (عوج بن عنق) বলা হয়েছে এবং তার আকার-আকৃতি ও শক্তি-সাহসের অতিরঞ্জিত বর্ণনা সমূহ উদ্ধৃত হয়েছে (ইবনু কাছীর)। যাই হোক উক্ত ব্যক্তি একাই বনু ইস্রাঈলের এই বার জন সরদারকে পাকড়াও করে তাদের বাদশাহর কাছে নিয়ে গেল এবং অভিযোগ করল যে, এই লোকগুলি আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মতলব নিয়ে এসেছে। বাদশাহ তার নিকটতম লোকদের সাথে পরামর্শের পর এদের ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেন এই উদ্দেশ্যে যে, এরা গিয়ে তাদের নেতাকে আমালেক্বাদের জাঁক-জমক ও শৌর্য-বীর্যের স্বচক্ষে দেখা কাহিনী বর্ণনা করবে। তাতে ওরা ভয়ে এমনিতেই পিছিয়ে যাবে। পরবর্তীতে দেখা গেল যে, বাদশাহর ধারণাই সত্যে পরিণত হয়েছিল। এই ভীত-কাপুরুষ সর্দাররা জিহাদ দূরে থাক, ওদিকে তাকানোর হিম্মতও হারিয়ে ফেলেছিল।

বনু ইস্রাঈলের বারো জন সর্দার আমালেক্বাদের হাত থেকে মুক্ত হয়ে স্বজাতির কাছে ফিরে এল এবং আমালেক্বাদের বিস্ময়কর উন্নতি ও অবিশ্বাস্য শক্তি-সামর্থ্যের কথা মূসা (আঃ)-এর নিকটে বর্ণনা করল। কিন্তু মূসা (আঃ) এতে মোটেই ভীত হননি। কারণ তিনি আগেই অহী প্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং বিজয় সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন। সেমতে তিনি গোত্রনেতাদের যুদ্ধ প্রস্ত্ততি গ্রহণের নির্দেশ দিলেন এবং আমালেক্বাদের শৌর্য-বীর্যের কথা অন্যের কাছে প্রকাশ করতে নিষেধ করলেন। কিন্তু দেখা গেল যে, ইউশা‘ বিন নূন ও কালেব বিন ইউক্বেন্না ব্যতীত বাকী সর্দাররা গোপনে সব ফাঁস করে দিল (কুরতুবী, ইবনু কাছীর)। ফলে যা হবার তাই হ’ল। এই ভীতু আরামপ্রিয় জাতি একেবারে বেঁকে বসলো।

قَالُوا يَا مُوسَى إِنَّ فِيهَا قَوْماً جَبَّارِيْنَ وَإِنَّا لَنْ نَدْخُلَهَا حَتَّى يَخْرُجُوا مِنْهَا فَإِن يَّخْرُجُوا مِنْهَا فَإِنَّا دَاخِلُونَ- (المائدة ২২)-

‘তারা বলল, হে মূসা! সেখানে একটি প্রবল পরাক্রান্ত জাতি রয়েছে। আমরা কখনো সেখানে যাব না, যে পর্যন্ত না তারা সেখান থেকে বের হয়ে যায়। যদি তারা সেখান থেকে বের হয়ে যায়, তবে নিশ্চিতই আমরা সেখানে প্রবেশ করব’ (মায়েদাহ ৫/২২)। অর্থাৎ ওরা চায় যে, মূসা (আঃ) তার মু‘জেযার মাধ্যমে যেভাবে ফেরাঊনকে ডুবিয়ে মেরে আমাদের উদ্ধার করে এনেছেন, অনুরূপভাবে আমালেক্বাদের তাড়িয়ে দিয়ে তাদের পরিত্যক্ত অট্টালিকা ও সম্পদরাজির উপরে আমাদের মালিক বানিয়ে দিন। অথচ আল্লাহর বিধান এই যে, বান্দাকে চেষ্টা করতে হবে এবং আল্লাহর উপর ভরসা করতে হবে। কিন্তু বনু ইস্রাঈলরা এক পাও বাড়াতে রাযী হয়নি। এমতাবস্থায়

قَالَ رَجُلاَنِ مِنَ الَّذِيْنَ يَخَافُوْنَ أَنْعَمَ اللهُ عَلَيْهِمَا ادْخُلُوْا عَلَيْهِمُ الْبَابَ فَإِذَا دَخَلْتُمُوْهُ فَإِنَّكُمْ غَالِبُوْنَ وَعَلَى اللهِ فَتَوَكَّلُوْا إِنْ كُنْتُم مُّؤْمِنِيْنَ- (المائدة ২৩)-

‘তাদের মধ্যকার দু’জন আল্লাহভীরু ব্যক্তি (সম্ভবতঃ পূর্বের দু’জন সর্দার হবেন, যাদের মধ্যে ইউশা‘ পরে নবী হয়েছিলেন), যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছিলেন, তারা বলল, (মূসা (আঃ)-এর আদেশ মতে) ‘তোমরা ওদের উপর আক্রমণ করে (শহরের মূল) দরজায় প্রবেশ কর। (কেননা আমাদের নিশ্চিত বিশ্বাস যে,) যখনই তোমরা তাতে প্রবেশ করবে, তখনই তোমরা অবশ্যই জয়ী হবে। আর তোমরা আল্লাহর উপরে ভরসা কর, যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক’ (মায়েদাহ ৫/২৩)

কিন্তু ঐ দুই নেককার সর্দারের কথার প্রতি তারা দৃকপাত করল না। বরং আরও উত্তেজিত হয়ে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে মূসা (আঃ)-কে উদ্দেশ্য করে বলল,يَا مُوسَى إِنَّا لَنْ نَدْخُلَهَا أَبَداً مَا دَامُوْا فِيهَا، فَاذْهَبْ أَنتَ وَرَبُّكَ فَقَاتِلا، إِنَّا هَاهُنَا قَاعِدُوْنَ- (المائدة ২৪)- ‘হে মূসা! আমরা কখনোই সেখানে প্রবেশ করব না, যতক্ষণ তারা সেখানে আছে। অতএব তুমি ও তোমার পালনকর্তা যাও এবং যুদ্ধ কর গে। আমরা এখানেই বসে রইলাম’ (মায়েদাহ ৫/২৪)। নবীর অবাধ্যতার ফলস্বরূপ এই জাতিকে ৪০ বছর তীহ্ প্রান্তরের উন্মুক্ত কারাগারে বন্দী থাকতে হয় (মায়েদাহ ৫/২৬)। অতঃপর এইসব দুষ্টমতি নেতাদের মৃত্যুর পর পরবর্তী বংশধররা হযরত ইউশা‘ বিন নূন (আঃ)-এর নেতৃত্বে জিহাদ করে বায়তুল মুক্বাদ্দাস পুনর্দখল করে (কুরতুবী, ইবনু কাছীর)

বনু ইস্রাঈলের এই চূড়ান্ত বেআদবী ছিল কুফরীর নামান্তর এবং অত্যন্ত পীড়াদায়ক। যা পরবর্তীতে প্রবাদবাক্যে পরিণত হয়ে গেছে। বদরের যুদ্ধের সময়ে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) কিছুটা অনুরূপ অবস্থায় পতিত হয়েছিলেন। অপর্যাপ্ত ব্যবস্থাপনা ও ক্ষুৎ-পিপাসায় কাতর অল্প সংখ্যক সবেমাত্র মুহাজির মুসলমানের মোকাবেলায় তিনগুণ শক্তিসম্পন্ন সুসজ্জিত বিরাট কুরায়েশ সেনাবাহিনীর আগমনে হতচকিত ও অপ্রস্ত্তত মুসলমানদের বিজয়ের জন্য যখন নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) আল্লাহর নিকটে সাহায্য প্রার্থনা করছিলেন, তখন মিক্বদাদ ইবনুল আসওয়াদ আনছারী (রাঃ) দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে বলেছিলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কস্মিনকালেও ঐকথা বলব না, যা মূসা (আঃ)-এর স্বজাতি তাঁকে বলেছিল, فَاذْهَبْ أَنْتَ وَرَبُّكَ فَقَاتِلاَ إِنَّا هَاهُنَا قَاعِدُوْنَ- ‘তুমি ও তোমার প্রভু যাও যুদ্ধ করগে। আমরা এখানে বসে রইলাম’ (মায়েদাহ ৫/২৪)। বরং আমরা আপনার ডাইনে, বামে, সামনে ও পিছনে থেকে শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করব। আপনি নিশ্চিন্তে যুদ্ধের প্রস্ত্ততি গ্রহণ করুন’। বিপদ মুহূর্তে সাথীদের এরূপ বীরত্বব্যঞ্জক কথায় আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) অত্যন্ত প্রীত হয়েছিলেন।[43]

মিসর থেকে হিজরতের কারণ :

ইউসুফ হ’তে মূসা পর্যন্ত দীর্ঘ চার/পাঁচশ’ বছর মিসরে অবস্থানের পর এবং নিজেদের বিরাট জনসংখ্যা ছাড়াও ফেরাঊনীদের বহু সংখ্যক লোক গোপনে অনুসারী হওয়া সত্ত্বেও এবং মূসা (আঃ)-এর মত শক্তিশালী একজন নবীকে পাওয়া সত্ত্বেও বনু ইস্রাঈলকে কেন রাতের অন্ধকারে মিসর থেকে পালিয়ে আসতে হ’ল? অতঃপর পৃথিবীর কোথাও তারা আর স্থায়ীভাবে একত্রে বসবাস করতে পারেনি, তার একমাত্র কারণ ছিল ‘জিহাদ বিমুখতা’। এই বিলাসী, ভীরু ও কাপুরুষের দল ‘ফেরাঊন ও তার দলবলের ভয়ে এতই ভীত ছিল যে, তাদের নিষ্ঠুরতম নির্যাতনের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করত না। বরং মূসা (আঃ)-এর কাছে পাল্টা অভিযোগ তুলতো যে, তোমার কারণেই আমরা বিপদে পড়ে গেছি’। যেমন সূরা আ‘রাফ ১২৯ আয়াতে এ বিষয়ে স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। ‘অথচ ঐ সময় মিসরে মুসলমানের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১০ থেকে ২০ শতাংশ ছিল’।[44]

মিসর থেকে বেরিয়ে বায়তুল মুক্বাদ্দাস নগরী দখলের জন্যও তাদেরকে যখন জিহাদের হুকুম দেওয়া হ’ল, তখনও তারা একইভাবে পিছুটান দিল। যার পরিণতি তারা সেদিনের ন্যায় আজও ভোগ করছে। বস্ত্ততঃ বিলাসী জাতি ভীরু হয় এবং জিহাদ বিমুখ জাতি কখনোই কোথাও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না।

শিক্ষণীয় বিষয় :

মূসা (আঃ)-এর জীবনের এই শেষ পরীক্ষায় দৃশ্যত: তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন বলে অনুমিত হ’লেও প্রকৃত অর্থে তিনি ব্যর্থ হননি। বরং তিনি সকল যুগের ঈমানদারগণকে জানিয়ে গেছেন যে, কেবল মু‘জেযা বা কারামত দিয়ে দ্বীন বিজয়ী হয় না। তার জন্য প্রয়োজন আল্লাহর উপরে দৃঢ় বিশ্বাসী একদল মুমিনের সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা। আর এটাই হ’ল জিহাদ। ৪০ বছর পর যখন তারা পুনরায় জিহাদে নামল, তখনই তারা বিজয়ী হ’ল। যুগে যুগে এটাই সত্য হয়েছে।

বাল‘আম বা‘ঊরার ঘটনা :

ফিলিস্তীন দখলকারী ‘জাববারীন’ তথা আমালেক্বা সম্প্রদায়ের শক্তিশালী নেতারা মূসা (আঃ) প্রেরিত ১২ জন প্রতিনিধিকে ফেরৎ পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেনি। কারণ তারা মূসা (আঃ)-এর মু‘জেযার কারণে ফেরাঊনের সসৈন্যে সাগরডুবির খবর আগেই জেনেছিল। অতএব মূসা (আঃ)-এর বায়তুল মুক্বাদ্দাস অভিযান বন্ধ করার জন্য তারা বাঁকা পথ তালাশ করল। তারা অত্যন্ত গোপনে বনু ইস্রাঈলের ঐ সময়কার একজন নামকরা সাধক ও দরবেশ আলেম বাল‘আম ইবনে বা‘ঊরার (بلعم بن باعوراء) কাছে বহু মূল্যবান উপঢৌকনাদিসহ লোক পাঠাল। বাল‘আম তার স্ত্রীর অনুরোধে তা গ্রহণ করল। অতঃপর তার নিকটে আসল কথা পাড়া হ’ল যে, কিভাবে আমরা মূসার অভিযান ঠেকাতে পারি। আপনি পথ বাৎলে দিলে আমরা আরও মহামূল্যবান উপঢৌকনাদি আপনাকে প্রদান করব। বাল‘আম উঁচুদরের আলেম ছিল। যে সম্পর্কে তার নাম না নিয়েই আল্লাহ বলেন,

وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ الَّذِي آتَيْنَاهُ آيَاتِنَا فَانسَلَخَ مِنْهَا فَأَتْبَعَهُ الشَّيْطَانُ فَكَانَ مِنَ الْغَاوِيْنَ- (الأعراف ১৭৫)-

‘আপনি তাদেরকে শুনিয়ে দিন সেই লোকটির অবস্থা, যাকে আমরা আমাদের নিদর্শন সমূহ দান করেছিলাম। অথচ সে তা পরিত্যাগ করে বেরিয়ে গেল। আর তার পিছনে লাগল শয়তান। ফলে সে পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল’ (আ‘রাফ ৭/১৭৫)

কথিত আছে যে, বাল‘আম ‘ইসমে আযম’ জানত। সে যা দো‘আ করত, তা সাথে সাথে কবুল হয়ে যেত। আমালেক্বাদের অনুরোধ ও পীড়াপীড়িতে সে অবশেষে মূসার বিরুদ্ধে দো‘আ করল। কিন্তু তার জিহবা দিয়ে উল্টা দো‘আ বের হ’তে লাগল যা আমালেক্বাদের বিরুদ্ধে যেতে লাগল। তখন সে দো‘আ বন্ধ করল।  কিন্তু  অন্য  এক পৈশাচিক রাস্তা সে তাদের বাৎলে দিল। সে বলল, বনু ইস্রাঈলগণের মধ্যে ব্যভিচার ছড়িয়ে দিতে পারলে আল্লাহ তাদের উপরে নারায হবেন এবং তাতে মূসার অভিযান বন্ধ হয়ে যাবে’। আমালেক্বারা তার পরামর্শ গ্রহণ করল এবং তাদের সুন্দরী মেয়েদেরকে বনু ইস্রাঈলের নেতাদের সেবাদাসী হিসাবে অতি গোপনে পাঠিয়ে দিল। বড় একজন নেতা এফাঁদে পা দিল। আস্তে আস্তে তা অন্যদের মধ্যেও সংক্রমিত হ’ল। ফলে আল্লাহর গযব নেমে এল। বনু ইস্রাঈলীদের মধ্যে প্লেগ মহামারী দেখা দিল। কথিত আছে যে, একদিনেই সত্তর হাযার লোক মারা গেল। এ ঘটনায় বাকী সবাই তওবা করল এবং প্রথম পথভ্রষ্ট নেতাকে প্রকাশ্যে হত্যা করে রাস্তার উপরে ঝুলিয়ে রাখা হ’ল। অতঃপর আল্লাহর গযব উঠে গেল। এগুলি ইস্রাঈলী বর্ণনা।=(কুরতুবী ও ইবনু কাছীর উভয়ে এ ঘটনা বর্ণনা করেছেন উক্ত আয়াতের শানে নুযূল হিসাবে। আয়াতের মর্মে বুঝা যায় যে, ঘটনার কিছু সারবত্তা রয়েছে। যদিও সত্য বা মিথ্যা আল্লাহই ভালো জানেন। – লেখক)।

সম্ভবতঃ সম্প্রদায়ের নেতাদের ক্রমাগত অবাধ্যতা, শঠতা ও পাপাচারে অতিষ্ঠ হ’য়ে এবং একসাথে এই বিরাট জনশক্তি বিনষ্ট হওয়ায় মূসা (আঃ) বায়তুল মুক্বাদ্দাস অভিযানের সংকল্প পরিত্যাগ করেন।

তীহ্ প্রান্তরে ৪০ বছরের বন্দীত্ব বরণ :

মূসা (আঃ)-এর প্রতি অবাধ্যতা ও জিহাদ থেকে বিমুখ হওয়ার শাস্তি স্বরূপ বনু ইস্রাঈলগণকে মিসর ও শাম-এর মধ্যবর্তী একটি উন্মুক্ত প্রান্তরে দীর্ঘ ৪০ বছরের জন্য বন্দী করা হয়। তাদের অবাধ্যতায় বিরক্ত ও হতাশ হয়ে নবী মূসা (আঃ) আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করেন,

قَالَ رَبِّ إِنِّي لا أَمْلِكُ إِلاَّ نَفْسِي وَأَخِيْ فَافْرُقْ بَيْنَنَا وَبَيْنَ الْقَوْمِ الْفَاسِقِيْنَ- (المائدة ২৫)-

‘হে আমার পালনকর্তা! আমি কোন ক্ষমতা রাখি না কেবল আমার নিজের উপর ও আমার ভাইয়ের উপর ব্যতীত। অতএব আপনি আমাদের ও পাপাচারী কওমের মধ্যে ফায়ছালা করে দিন’ (মায়েদাহ ৫/২৫)। জবাবে আল্লাহ বলেন,

 قَالَ فَإِنَّهَا مُحَرَّمَةٌ عَلَيْهِمْ أَرْبَعِيْنَ سَنَةً يَّتِيْهُوْنَ فِي الأَرْضِ فَلاَ تَأْسَ عَلَى الْقَوْمِ الْفَاسِقِيْنَ- (المائدة ২৬)-

‘এদেশটি (বায়তুল মুক্বাদ্দাস সহ শামদেশ) চল্লিশ বছর পর্যন্ত তাদের জন্য নিষিদ্ধ করা হ’ল। এ সময় তারা ভূপৃষ্ঠে উদ্ভ্রান্ত হয়ে ফিরবে। অতএব তুমি অবাধ্য কওমের জন্য দুঃখ করো না’ (মায়েদাহ ৫/২৬)। تَاهَ يَتِيْهُ تِيْهًا অর্থ গর্ব করা, পথ হারিয়ে ঘোরা ইত্যাদি। এখান থেকেই উক্ত প্রান্তরের নাম হয়েছে ‘তীহ্’ (تِيْه)। বস্ত্ততঃ এই উন্মুক্ত কারাগারে না ছিল কোন প্রাচীর, না ছিল কোন কারারক্ষী। তারা প্রতিদিন সকালে উঠে মিসর অভিমুখে রওয়ানা হ’ত। আর সারাদিন চলার পর রাতে আবার সেখানে এসেই উপস্থিত হ’ত, যেখান থেকে সকালে তারা রওয়ানা হয়েছিল। কিন্তু কোনভাবেই তারা অদৃশ্য কারা প্রাচীর ভেদ করে যেতে পারত না। এভাবে চল্লিশ বছর পর্যন্ত হতবুদ্ধি অবস্থায় দিগ্বিদিক ঘুরে এই হঠকারী অবাধ্য জাতি তাদের দুনিয়াবী শাস্তি ভোগ করতে থাকে। যেমন ইতিপূর্বে নূহ (আঃ)-এর অবাধ্য কওম দুনিয়াবী শাস্তি হিসাবে প্লাবণে ডুবে নিশ্চিহ্ন হয়েছিল। বস্ত্ততঃ চল্লিশ বছরের দীর্ঘ সময়ের মধ্যে হারূণ ও মূসা (আঃ)-এর তিন বছরের বিরতিতে মৃত্যু হয়। অতঃপর শাস্তির মেয়াদ শেষে পরবর্তী নবী ইউশা‘ বিন নূন-এর নেতৃত্বে জিহাদের মাধ্যমে তারা বায়তুল মুক্কাদ্দাস জয়ে সমর্থ হয় এবং সেখানে প্রবেশ করে। বর্ণিত হয়েছে যে, ১২ জন নেতার মধ্যে ১০ জন অবাধ্য ও ভীরু নেতা এরি মধ্যে মারা যায় এবং মূসার অনুগত ইউশা‘ ও কালেব দুই নেতাই কেবল বেঁচে থাকেন, যাদের হাতে বায়তুল মুক্বাদ্দাস বিজিত হয় (কুরতুবী, ইবনু কাছীর, তাফসীর মায়েদাহ ২৬)


[43]. মুবারকপুরী, আর-রাহীকুল মাখতুম, পৃঃ ১৬৬।
[44]. মাওলানা মওদূদী, রাসায়েল ও মাসায়েল ৫/২৫০।