নবীজীর দস্তরখানে – আবু আহমাদ – ৩য় পর্ব

২৩. খাওয়ার আগে ও পরে হাত ধুবো খানার আগে ও পরে হাত ধুবো। সারাদিন আমরা কতকিছু ধরি বা বেখেয়ালেই আমাদের হাতে কত ময়লা-ধুলোবালি লেগে যায়। এখন যদি আমি খাওয়ার আগে হাত না ধুই, সব ধুলোবালি যাবে আমার পেটে। দেখা দেবে বিভিন্ন রোগ-বালাই। সুতরাং সবসময় অমরা খাওয়ার আগে হাত ধুবো। হাতে কোনো ময়লা লেগে থাকলে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাওয়ার আগে হাত ধুয়ে নিতেন।
(দ্র. সুনানে নাসায়ী, হাদীস ২৫৬)

খাওয়ার আগে হাত ধোয়া যেমন জরুরি খাওয়ার পরও হাত ধোয়া জরুরি। তৈলাক্ত খাবার খাওয়ার পর হাতে তেল-চর্বি লেগে থাকে। আমি যদি হাত না ধুই তাহলে আমি যা-ই ধরব তাতেই আমার হাতের ময়লা লেগে যাবে। সবার আগে আমার নিজের পোষাক নষ্ট হবে। এছাড়াও খাবারের পরে হাত না ধোয়ার আরো ক্ষতি রয়েছে। যেমন, রাতে খাবার খেয়ে হাত না ধুয়ে শুয়ে গেলাম। হাতে লেগে থাকা তেল-চর্বি দেখে তেলাপোকা ভাবলো- এই তো পেয়েছি খাবার। সে হাতে লেগে থাকা চর্বি তো খাবেই সাথে আমার আঙুলের চামড়াশুদ্ধ সাবার করে দিবে। সকালে উঠে দেখব- কিসে যেন আমার আঙুলের অগ্রভাগের চামড়া খেয়ে ফেলেছে। এ বিষয়টির প্রতি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এভাবে-
من نامَ وفي يَدِهِ غَمَرٌ، ولم يَغْسِلْهُ، فأصابَه شيءٌ، فلا يَلُومنّ إلا نفسَه
যে নিজের হাতে লেগে থাকা তেল-চর্বি না ধুয়েই ঘুমিয়ে গেল আর (রাতে তেলাপোকা বা) কোনো কিছুর দ্বারা আক্রান্ত হল, এর দায় যেন সে নিজের ঘারেই চাপায়। (কারণ তার নিজের দোষেই তো এমনটি হয়েছে। অর্থাৎ কেউ যেন হাতে লেগে থাকা তেল-চর্বি পরিষ্কার করা ছাড়া না ঘুমায়।) সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৮৫২; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৫৫২১; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৭৫৬৯

২৪. তিন আঙুলে খানা খাব নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেশিরভাগ সময়ে রুটি খেতেন। নবীজী তিন আঙুলে খেতেন- বৃদ্ধাঙ্গুল, তর্জনী (বৃদ্ধাঙ্গুলের পরেরটা) ও মধ্যমা (মাঝের আঙুল)। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে-
كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ يَأْكُلُ بِثَلَاثِ أَصَابِعَ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন আঙুল দ্বারা খেতেন।
সহীহ মুসলিম, হাদীস ২০৩২
তো আমরাও তিন আঙুল দ্বারা খাব। তিন আঙুলে খাওয়া সুন্নত। আজ থেকে রুটি-পরোটা বা এজাতীয় শুকনো যে সকল খাবার তিন আঙুলে খাওয়া সম্ভব সেগুলে তিন আঙুলে খেতে চেষ্টা করব। হাঁ, ভাত বা এজাতীয় খাবার খাওয়ার সময় তিন আঙুলের বেশি ব্যবহার করার প্রয়োজন হয়। সে সময় আমরা তিন আঙুলের বেশিও ব্যবহার করতে পারি। তবে একটা বিষয় খেয়াল রাখব। ভাত খেতে গিয়ে আমরা অনেক সময় সারা হাতে ভাত লাগিয়ে নিই। হাতের তালুতে, হাতের উপরের দিকে সবদিকে মাখিয়ে ফেলি। এটা সুন্দর নয়। এজন্য মাঝে মাঝে আঙুল ও হাতের তালু চেটে খাওয়া চাই। তেমনি আরেকটা বিষয়ও ঘটে। পাত্রের চারপাশে খাবার ছড়িয়ে যায়। দেখতে অসুন্দর লাগে, খাবার নিচে পড়ে। এক্ষেত্রে আমি যদি খাওয়ার মাঝে মাঝে পাত্রের চারপাশে ছড়িয়ে যাওয়া ভাত বা অন্য খাবার পাত্রের মাঝে একটু গুছিয়ে আনি তা দেখতে ভাল লাগে এবং তা রুচিকরও বটে। সাথে সাথে খাবার নিচে পড়ার আশংকাও কমে যায়।

২৫. দস্তরখানে খাব – আমরা জেনেছি, খাবার পড়ে গেলে তুলে খাওয়া নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নত। এ সুন্নত আদায়ের জন্য আরেকটি সহায়ক আদব হল দস্তরখান। আনাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- مَا أَكَلَ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ عَلَى خِوَانٍ، وَلاَ فِي سُكْرُجَةٍ، وَلاَ خُبِزَ لَهُ مُرَقّقٌ، قُلْتُ لِقَتَادَةَ : عَلاَمَ يَأْكُلُونَ؟ قَالَ : عَلَى السّفَر.
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো ‘খিওয়ান’-এর উপর (টেবিল বা টেবিলের মত উঁচু কিছুতে) খাবার রেখে খাননি এবং ‘সুকরুজা’তেও (ছোট ছোট পাত্রবিশেষ) নয়। তাঁর জন্য কখনো পাতলা রুটিও তৈরি করা হয়নি। (কাতাদা থেকে বর্ণনাকারী) ইউনুস কাতাদাকে জিজ্ঞেস করলেন, তাহলে তাঁরা কীসের উপর খেতেন? তিনি বললেন, ‘সুফরা’র উপর।
সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৪১৫

সে যুগে ‘সুফরা’ ছিল চামড়ার। তাতে আংটা থাকত। খুলে বিছালে দস্তরখান, গুটিয়ে ফেললে সফরের পাথেয় রাখার মত ছোট ব্যাগ। ‘সুফরা’তে সাধারণত শুকনা খাবার রেখে খাওয়া হত। এই ধরনের দস্তরখান না হোক অন্য কোনো ধরনের দস্তরখান হলেও ব্যবহার করার চেষ্টা করব। আমি যদি দস্তরখান ছাড়া খাই তাহলে খাবার নিচে পড়ে ময়লা লেগে যাবে; তা আবার পরিষ্কার করে তারপর খেতে হবে। কিন্তু যদি দস্তরখান বিছিয়ে নেই তাহলে দস্তরখান থেকে তুলেই খেতে পারব। তেমনি শুকনো খাবার দস্তরখানে রাখাও যাবে।

আর মনে রাখতে হবে, দস্তরখান যেন হয় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। দস্তরখান কখনোই নোংরা করে রাখব না। অনেককে দেখা যায়, দস্তরখানে কাঁটা, হাড্ডি ইত্যাদি ফেলে। দস্তরখান তো এগুলো ফেলার জন্য নয়। এগুলো ফেলার জন্য আলাদা কোনো পাত্র থাকলে ভালো হয়। সুতরাং আমরা দস্তরখানে কাঁটা, হাড্ডি ইত্যাদি ফেলব না। তেমনি দস্তরখান ময়লা করেও রাখব না। সাথে সাথে খেয়াল রাখব কাঁটা বা হাড্ডি পানির মধ্যে ফেলব না। কারণ তা আরেক প্রাণীর খাবার।

আরেকটি বিষয়। হাত ধোয়ার পাত্র বিশেষ করে চিলম্চি কখনো দস্তরখানের উপর না রাখার চেষ্টা করব। কোনো কোনো বুযুর্গ এই পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কিন্তু যে বিষয়টি জরুরি তা হল, চিলম্চি সবসময় পরিষ্কার রাখা। হাত ধোওয়ার পর চিলম্চি দৃষ্টির আড়ালে রাখলে ভালো। আর হাত ধোওয়ার আমল দস্তরখানে খাবার পরিবেশন করার আগে সেরে ফেললে ভালো। যাতে বেখেয়ালীতে হাত ধোওয়ার সময় খাবার পাত্রে পানির ছিটা না পড়ে। মোটকথা, আমি দস্তরখানে খাব; টেবিলে নয়। কারণ নবীজী কখনো টেবিলে খাননি। হাঁ, কোনো সময় যদি এমন অবস্থা বা পরিবেশ হয়, টেবিলে খাওয়া ছাড়া উপায় নেই তখন টেবিলে খেতে পারি। টেবিলে খাওয়া অনুত্তম হলেও নাজায়েয নয়। তবে টেবিলে খাওয়াকেই অভ্যাসে পরিণত করব না। ওযর হলে ভিন্ন বিষয়।

২৬. নিচে বসে খাব হাদীস শরীফে এসেছে, ইবনে আব্বাস রা. বলেন-
كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ يَجْلِسُ عَلَى الْأَرْضِ، وَيَأْكُلُ عَلَى الْأَرْضِ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যমিনের উপর বসতেন এবং নিচে বসে খেতেন।
শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৭৮৪৩; আলমুজামুল কাবীর, তবারানী, হাদীস ১২৪৯৪; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস ১৪২২২

এখানে নিচে বসে খাওয়ার একটি অর্থ- সমতল স্থানে খাওয়া। অর্থাৎ যেখানে বসা হয়েছে পাত্র (তার চেয়ে উঁচু কিছুতে না রেখে) সেখানেই রেখে খাওয়া। যেমন কেউ যদি চকি বা খাটে বসে খান এবং খাটের উপরই পাত্র রাখেন তাহলে সেটাও নিচে বসে খাওয়ার মধ্যে গণ্য হবে।

২৭. খাওয়ার সময় হেলান দিয়ে বা টেক লাগিয়ে বসব না স্বাভাবিকভাবে বসে খাব; হেলান দিয়ে বা টেক লাগিয়ে নয়। এটি খাওয়ার একটি আদব। আবু জুহাইফা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- لاَ آكُلُ مُتّكِئًا
আমি টেক লাগিয়ে বা হেলান দিয়ে বসে খাই না। সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৩৯৮

তো এ হাদীস থেকে আমরা জানতে পারলাম, নবীজী হেলান দিয়ে বা টেক লাগিয়ে বসে খেতেন না। সুতরাং আমরাও এভাবে বসে খাব না। কারণ, পরিমাণ মত খাওয়া এবং বিনয়ের সাথে বসে খাওয়া সুন্নত। আর টেক লাগিয়ে বা হেলান দিয়ে বসলে খাওয়া বেশি হয় এবং তাতে বিনয় প্রকাশ পায় কম। তবে কারো ওজর থাকলে ভিন্ন কথা।

২৮. খাওয়ার সময় কীভাবে বসব? খাবার আল্লাহ তাআলার বড় নিআমত। এ নিআমত গ্রহণের সময় আমরা বিনয়ের সাথে গ্রহণ করব, কৃতজ্ঞতার সাথে গ্রহণ করব। আল্লাহ রিযিকদাতা আর আমরা রিযিক গ্রহণকারী। আল্লাহ আমাদের রব আর আমরা আল্লাহর বান্দা-আল্লাহর গোলাম। সুতরাং মনিবের সামনে গোলাম যেভাবে বসে, খাবার গ্রহণ করার সময় আমরা সেভাবেই বসব। বিনয় প্রকাশ পায় এমনভাবে বসব। এমনটিই নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা। নবীজী বলতেন- آكُلُ كَمَا يَأْكُلُ الْعَبْدُ، وَأَجْلِسُ كَمَا يَجْلِسُ الْعَبْدُ.
গোলাম যেভাবে খায় আমিও সেভাবে খাব। গোলাম যেভাবে বসে (খাওয়ার সময়) আমিও সেভাবেই বসব। মুসনাদে আবু ইয়া‘লা, হাদীস ৪৯২০; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস ১৪২১০; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৫৫৭২ ২৯.

উপুড় হয়ে শুয়ে খাব না অনেককে উপুড় হয়ে শুয়ে খেতে দেখা যায়। এভাবে খাওয়া ঠিক নয়। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপুড় হয়ে খেতে নিষেধ করেছেন। সাথে সাথে তা স্বাস্থ্যসম্মতও নয়। হাদীস শরীফে এসেছে- نَهَى رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ أَنْ يَأْكُلَ الرّجُلُ، وَهُوَ مُنْبَطِحٌ عَلَى وَجْهِهِ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপুড় হয়ে খেতে নিষেধ করেছেন।
সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩৩৭০; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৭৭৪
সুতরাং আমরা উপুড় হয়ে শুয়ে খাব না।

রবিউল আউয়াল ১৪৩৯ – ডিসেম্বর ২০১৭
রবিউস সানি ১৪৩৯ – জানুয়ারি ২০১৮
মাসিক আলকাউসার