মদিনায় হিজরতের প্রাক্কাল

আরেকবার তেঁতে উঠলো সমগ্র মক্কা। মদিনার এত বড় কাফেলা গোপনে ইসলাম গ্রহণ করে চলে গেছে, আবার মুহাম্মদকে (সাঃ) নেতা বানানোর ও নিরাপত্তা দেওয়ার ব্যাপারে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছে, এক-দুই করে সামর্থ্য মুসলিমরা প্রায় প্রতিদিনই পালাচ্ছে মদিনায়—এসবই কুরাইশদের তেঁতে ওঠার কারণ। তেঁতে তারা আগেই ছিলো, যখন তারা জানতে পেরেছিলো ইসলাম সম্বন্ধে জানতে মদিনাবাসীর গোপন আনাগোনার খবর; কিন্তু মদিনার এত বিপুল সংখ্যক লোক গোপনে মুহাম্মদের (সাঃ) হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে চলে গেছে আর তারা টেরও পায়নি তার, এই ব্যাপারখানাই তাদের তাঁতানো মগজে বারুদ ঠেলে দিলো।

মক্কায় মদিনাবাসীর গোপন আনাগোনাকে বাহানা বানিয়ে কুরাইশ-কাফেররা যখন মুসলিমদের উপর নির্যাতন চালাচ্ছিলো, তখনই নবীজি সকলকে একেক করে হিজরতের অনুমতি দিয়ে দেন। সে হিসেবে কিছু দুর্বল ও সফর-অক্ষম মুসলিম এবং নবীজি আবু বকর ও আলি রাযিয়াল্লাহু আনহুমা ছাড়া মক্কায় আর কেউই বাকি ছিলো না।  তাই কুরাইশদের এই সামগ্রিক আক্রোশের একমাত্র লক্ষ্যস্থল হয়ে যান নবীজি।

দারুন-নদওয়ায় ডাক পড়লো শীর্ষস্থানীয় সকল কাফেরের। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কেউ মুহাম্মদকে (সাঃ) বন্দির পরামর্শ দিলো, কেউ বললো দেশান্তরিত করার কথা;  তবে ধূর্ত লোকেরা বললো, ‘এগুলোর কোনটিই করা উচিত হবে না।  কেননা বন্দি করা হলে তাঁর সমর্থক ও সাথিগণ আমাদের উপর চড়াও হবে এবং আমাদের কাছ থেকে তাঁকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে।  আর দেশান্তরিত করা হলে তা হবে আমাদের জন্য একেবারেই ক্ষতিকর;—কেননা, এমতাবস্থায় মক্কার আশপাশের সমস্ত আরবরা তাঁর উত্তম চরিত্র, মিষ্টি কথা এবং পবিত্র কালামের অনুরক্ত হয়ে উঠবে এবং তিনি তাদের সবাইকে নিয়ে আমাদের উপর আক্রমণ করে বসবেন।

আবু জাহল পরামর্শ দিলো, তাঁকে হত্যা করা হোক। হত্যা-ষড়যন্ত্রের কায়দাও সে বাতলে দিলো। বললো, এ হত্যায় প্রত্যেক গোত্রের একজন করে লোক অংশগ্রহণ করুক,  যাতে বনু আবদে মানাফ (নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গোত্র) এ হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে ব্যর্থ হয়ে যায়।  উপস্থিত সবাই এ প্রস্তাব পছন্দ করলো। প্রত্যেক গোত্র থেকে একজন করে যুবক নিযুক্ত করা হলো।  তাদেরকে বলে দেওয়া হলো, অমুক রাতে এ কাজ সম্পন্ন করা হবে।

এদিকে মহান আল্লাহ তাআলা নবীজিকে তাদের এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিলেন এবং তাঁকে হিজরতের নির্দেশ দিলেন।  যে রাতে কুরাইশ কাফেররা নিজেদের হীন ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত করার ইচ্ছা করলো এবং বিভিন্ন গোত্রের বহু যুবক নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘরের চারদিক ঘেরাও করে রইলো, ঠিক সেই মুহূর্তেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরতের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন এবং হযরত আলি রাযিয়াল্লাহু আনহুকে নির্দেশ দিলেন, তিনি যেন নবীজির চাদর মুড়ি দিয়ে তাঁরই খাটিয়ায় শুয়ে থাকেন, যাতে কাফেররা নবীজির ঘরে না থাকার ব্যাপারটি আঁচ করতে না পারে।

এরপর যখন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘর থেকে বের হলেন, তখন তাঁর আঙিনায় হত্যা-উন্মত্ত কুরাইশ-কাফেরদের মেলা।  তিনি সুরা ইয়াসিন পড়তে পড়তে বের হলেন।  যখন فَاَغْشَیْنٰهُمْ فَهُمْ لَا یُبْصِرُوْنَ—এই আয়াত পর্যন্ত পৌঁছুলেন, তখন এই আয়াতটিকে তিনি কয়েকবার পুনরাবৃত্তি করলেন। ফলে মহান আল্লাহ কাফেরদের চোখের উপর পর্দা ফেলে দিলেন।  তারা নবীজিকে দেখতে পেলো না।

নবীজি সিদ্দিকে আকবরের ঘরে তাশরিফ নিয়ে গেলেন। সিদ্দিকে আকবর আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু আগে থেকেই প্রস্তুত হয়ে ছিলেন।  উভয়ে বাড়ির পেছন দিকের ছোট একটি দরজা দিয়ে বের হয়ে সাওরের দিকে এগিয়ে গেলেন। সাওর মক্কার নিকটবর্তী একটি পাহাড়। এভাবে নিকটবর্তী অজস্র পাহাড়, ধুলো আর স্মৃতির অবিরল তুলো উড়িয়ে নবীজি মক্কাকে দূরবর্তী করতে করতে এগিয়ে চলবেন…