মদিনার পথে নবীজি

মক্কা ছাড়তে হলো নবীজিকে। কাফেরদের সীমাহীন অত্যাচার, অমানুষিক নির্যাতন, বয়কট, অপবাদ, ঠাট্টা-বিদ্রুপ এমনকি সত্যের প্রচারের বিস্তৃতির প্রতি তাদের জিঘাংসীয় চেহারা নবীজিকে আর তাঁর জন্মভূমিতে থাকতে দিলো না। তিনি বিখ্যাত সহচর ও অকৃত্রিম বন্ধু আবু বকরকে সঙ্গে করে মদিনার পথ ধরেছেন।
শুরুতেই হুট করে মদিনায় যাওয়াটা ছিলো ঝুঁকিপূর্ণ। সেমতে আল্লাহর-পথে-এক এই দুই মানুষ মক্কার অদূরে এক পাহাড়ে আশ্রয় নিলেন। পাহাড়ের নাম সাওর। ততক্ষণে নবীজিকে হত্যার জন্য ওৎ পেতে থাকা কাফের যুবকরা টের পেয়ে গেছে মুহাম্মদ তাদের চোখ ফাঁকি দিয়েছে। আবু জাহল ক্রোধে ফেটে পড়লো।নবীজিকে ধরার জন্য তৎক্ষণাৎ চারদিকে খবর রটিয়ে দিলো। ঘোষণা করলো একশো উটের লোভ-চকচক পুরস্কার। লোকেরা হন্য হয়ে খুঁজতে লাগলো মুহাম্মদকে—নবীজিকে।
কতিপয় পদচিহ্ন বিশারদ ব্যক্তি নবীজির পদ-চিহ্ন ধরে খোঁজ করতে করতে ঠিক ওইগুহার কিনারা পর্যন্ত পৌঁছে গেলো।সামান্য একটু নুয়ে তাকালেই তারা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পরিষ্কার দেখতে পেতো। এ সময় হযরত সিদ্দিকে আকবর বিচলিত হয়ে পড়লেন।রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বললেন, ‘ভয় পেয়ো না, নিশ্চয় মহান আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন।’মহান আল্লাহর মহিমা, কাফেরদের দৃষ্টি গুহা হতে অন্য দিকে ফিরিয়ে দেওয়া হলো এবং কেউ ঝুঁকে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করলো না;বরং তাদের সবচেয়ে ধূর্ত ব্যক্তি উমাইয়া বিন খলফ বলে উঠলো, ‘এখানে তাঁর থাকাটা অসম্ভব।’আসলে মহান আল্লাহর নির্দেশে এই গুহার প্রবেশপথে মাকড়শা জাল বুনে রেখেছিলো এবং বন্য কবুতর কোথা থেকে এসে বাসা তৈরি করে নিয়েছিলো। শেষ পর্যন্ত কাফেররা নবীজিকে পেলো না।নবীজি ও হযরত আবু বকর টানা তিন রাত ওই গুহায় গোপন হয়ে থাকলেন।
সাওর-গুহায় অবস্থানের পালা শেষ করে নবীজি এবার মদিনার পথ ধরলেন। ওদিকে অনেকে মুহাম্মদকে খুঁজে না পেয়ে ব্যর্থ-মনোরথ ফিরে গেলেও লড়াকু সোরাকা তখনও তক্কে তক্কে ছিলো। সে কিছুতেই একশো উটের লোভ ভুলতে পারছিলো না। সঙ্গী-সাথিদের সেভুলিয়েভালিয়ে পাঠিয়ে দিয়ে একাই নবীজির পিছু নিলো। আবু বকর নবীজির সামনে-পেছনে হয়ে চলছেন;নবীজির সুরক্ষার ব্যাপারেই তাঁর যত উদ্বেগ। এমন সময় সোরাকাকে দেখা গেলো। সে কাছাকাছি চলে এসেছে। আবু বকরের মনে শঙ্কা।নবীজি তখন নিশ্চিন্ত নির্ভ্রুক্ষেপ মনে মন্দ্রমদির লয়ে কুরআন তেলাওয়াত করছেন। হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলো সোরাকা। আবার উঠে পিছু নিলো সোরাকা। তখন সোরাকা নবীজির এত কাছে যে,নবীজি পড়ছেন, সোরাকা শুনছে,নবীজি পড়ছেন, সোরাকা শুনছে। এবার ঘোড়াটি আর হোঁচট খেলো না, মরুর রুক্ষ বুকে দেবে গেলো ঘোড়ার চারটি পা, ছিটকে পড়লো সোরাকার। ঘোড়াকে তোলার ব্যর্থ চেষ্টায় সোরাকা তখন লবেজান। সে সাহায্য চাইলো নবীজির কাছে। থামলেন দয়ার নবী, আর ছাড়া পেলো সোরাকার তেজি বাহনটি। কুরআনের মন্দ্রমদ ঘোর আর এই আশ্চর্য ঘটনায় অভিভূত হয়ে পড়লো সোরাকা। সে নতি মানলো নবীজির। নিজের সবকিছু জমা করলো নবীজির পায়ে।নবীজি কিছু গ্রহণ করলেন না।শুধু বললেন, ‘কাউকে আমাদের ব্যাপারে বোলো না।’অন্য-মানুষ হয়ে ফিরতে লাগলো দুর্ধর্ষ মরুবীর সোরাকা…
এছাড়াও চলতিপথে অনেক আশ্চর্য ঘটনা ঘটে। উম্মে মাবাদ নামের এক মহিলার দুধহীন বকরিনবীজির হাতের ছোঁয়ায় দুধেল হয়ে ওঠে।নবীজিসহ সফরের সকলে সেই দুধ পান করলেও পরিমাণ আগের মতোই অটুট থাকে। অবাক-উম্মে মাবাদ স্বামী ফিরলে এই ঘটনার বিশদ করে। স্বামী শুনে চিনতে পারে যে, এ-ই মক্কার সেই বুজুর্গ! পরবর্তীতে এই দম্পতি মদিনায় গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন।
নানা পথ ও অবাক পরম্পরার ইতি তুলে তুলে নবীজি এগোতে থাকেন প্রতীক্ষা-অধীর মদিনাতুন্নবির দিকে। পেছনে পড়ে রয় পৃথিবীর প্রাচীনতম ঘরের শহর মক্কা…
তথ্যসূত্র :সিরাতে খাতামুল আম্বিয়া, মুফতি শফি।