অন্যের সাথে ঐ আচরণ করি যা পেলে আমি খুশী হই – মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া আব্দুল্লাহ

কুরআন মজীদের প্রসিদ্ধ আয়াত-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا ادْخُلُوا فِي السِّلْمِ كَافَّةً وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُبِينٌ

‘হে ঈমানদারগণ! পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ কর। শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য দুশমন।’

এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুমিনদের সম্বোধন করে বলেছেন, ‘তোমরা ইসলামে পরিপূর্ণভাবে প্রবেশ কর।’ পরিপূর্ণভাবে প্রবেশ করার অর্থ কী? এই যে আমরা মসজিদে প্রবেশ করেছি, পরিপূর্ণভাবে প্রবেশ করেছি। অর্থাৎ আমাদের দেহের কোনো অংশ মসজিদের বাইরে নেই। যদি আমার পা মসজিদের ভেতরে থাকে আর মাথা মসজিদের বাইরে তাহলে বলা হবে না যে, আমি মসজিদে পরিপূর্ণভাবে প্রবেশ করেছি। তো আল্লাহ মুমিনদের আদেশ করেছেন, ‘তোমরা ইসলামে পরিপূর্ণভাবে প্রবেশ কর।’ অর্থাৎ তোমাদের জীবনের সকল অংশ যেন ইসলামের ভেতরে চলে আসে। জীবনের কিছু অংশ ইসলামের ভেতরে আর কিছু অংশ ইসলামের বাইরে, কিছু অংশে  ইসলামের অনুসারী আর কিছু অংশে ইসলাম থেকে খারিজ এমন যেন না হয়। আর এ আদেশ আল্লাহ কোনো অমুসলিমকে করেননি। এ আদেশ করেছেন মুমিনকে, মুসলিমকে।

ইসলামে পরিপূর্ণভাবে প্রবেশ করতে হলে সর্বপ্রথম ইসলামকে পরিপূর্ণভাবে জানতে হবে, ইসলামের শিক্ষা ও বিধানের বিস্তৃতি সম্পর্কে জানতে হবে। তা জানলে মানার চিন্তা আসবে। না জানলে মানার চিন্তাও আসবে না। তাই ইসলামের  শিক্ষা ও বিধানের ব্যাপকতা সম্পর্কে সচেতন হওয়া প্রয়োজন।

এ বিষয়টি দু’ভাবে চিন্তা করা যায়। এক. জীবনের অঙ্গনগুলো সম্পর্কে চিন্তা করা। জীবনের সকল অঙ্গনে ইসলামের শিক্ষা ও দিকনির্দেশনা আছে। দুই. ইসলামী শিক্ষার বিভাগগুলো সম্পর্কে চিন্তা করা। এর একটি সহজ উপায় হল, আপনি একটি হাদীসের কিতাব হাতে নিন এবং শুধু শিরোনামগুলো পড়ুন। তাহলে দেখতে পাবেন আমরা যতটুকু চিন্তা করি তার চেয়ে বিস্তৃত আকারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশনা রয়েছে। তেমনি একটি ফিকহের কিতাব হাতে নিন এবং শুধু সূচীপত্রে নযর বুলান। দেখবেন আমরা যতটুকু ভাবি তার চেয়ে অনেক ব্যাপকভাবে ইসলামের বিধানাবলী বিদ্যমান।

আলিমগণ ইসলামের মৌলিক বিধানাবলী পাঁচটি শিরোনামে তুলে ধরেছেন : আকীদা, ইবাদত, মোয়ামালাত, মোয়াশারাত ও আখলাক।

আকীদা অর্থ বিশ্বাস। এটি অনেক ব্যাপক বিষয়। ইসলামের একটি মৌলিক বিভাগ। ইসলাম মানুষকে সঠিক ও যথার্থ আকীদা শিক্ষা দান করে। যেমন আল্লাহ এক, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল ও শেষ রাসূল, কিয়ামত হবে, পুনরুত্থান হবে ইত্যাদি।

দ্বিতীয় বিভাগ, ইবাদত। ইবাদত মানে  উপাসনা। ইসলামে ইবাদতের প্রসঙ্গ অনেক বিস্তৃত। আমরা যে নামাজ পড়ি, রোজা রাখি, হজ্ব করি, যাকাত দেই, কুরবানী করি এগুলো  ইসলামের একেকটি ইবাদত।

তৃতীয় বিভাগ, মোয়ামালাত তথা লেনদেন। লেনদেনের ক্ষেত্রে ইসলামের অনেক বিধান আছে। একটি মৌলিক বিধান, বেচাকেনা হালাল, রিবা বা সুদ হারাম।

চতুর্থ বিভাগ, মোয়াশারা। পারস্পরিক আচরণ। বিভিন্ন ক্ষেত্রে একের সাথে অন্যের আচরণ কী হবে এটি ইসলামের অনেক বড় শাখা।

পঞ্চম বিভাগ, আখলাক। স্বভাব-চরিত্র। যেমন এক হাদীসে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার প্রিয় সাহাবী হযরত আনাস বিন মালিক রা. কে বলেছেন, হে আমার বৎস! তোমার পক্ষে যদি সম্ভব হয় তুমি সকাল সন্ধ্যা এমন অবস্থায় অতিবাহিত করবে যে, তোমার অন্তরে কারো প্রতি বিদ্বেষ নেই, তাহলে তাই কর। কারণ এটি আমার সুন্নাহ। আর যে আমার সুন্নাহকে যিন্দা করে সে আমাকে ভালবাসে। যে আমাকে ভালবাসে সে আমার সাথে জান্নাতে থাকবে। -জামে তিরমিযী, হাদীস : ২৬৭৮

আমরা তো সুন্নত বলতে বুঝি নামাজের সুন্নত, রোযার সুন্নত, হজ্বের সুন্নত ইত্যাদি। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছেন, কারো প্রতি বিদ্বেষ না থাকা, সবার প্রতি অন্তর নির্মল থাকা এটিও তার সুন্নত। তো আখলাক সম্পর্কে কুরআন মাজীদে অনেক আয়াত রয়েছে এবং হাদীসের কিতাবসমূহে অনেক হাদীস রয়েছে।

এই যে বিভাগগুলো এর মধ্য থেকে সাধারণত আকায়েদ ও ইবাদতকে দ্বীনের অংশ মনে করা হয়। লেনদেনকেও  কিছু মানুষ মনে করেন ইসলামী শিক্ষার অধীন। কিন্তু এক্ষেত্রেও অধিকাংশ মানুষ অসচেতন। তারা মনে করে, আমাদের লেনদেন আমরা যেভাবে ইচ্ছা করব, যেভাবে লাভ হয় সেভাবে করব।

আর মোয়াশারা এবং আখলাক! হাকীমুল উম্মত হযরত আশরাফ আলী থানবী রাহ. বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে অধিকাংশ মানুষ অসচেতন। বিশেষভাবে মোয়াশারা বা পারস্পরিক আচরণ সম্পর্কে।’ তারা নফল নামায পড়াকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মনে করে, বুযুর্গী ও দ্বীনদারী মনে করে কিন্তু কষ্টদায়ক আচরণ থেকে বেuঁচ থাকাকে দ্বীনদারীর বিষয় মনে করে না। তারা এটাকে ব্যক্তিগত সভ্যতা মনে করে । কেউ তা লÿ্য করলে সে সভ্য মানুষ। না করলে বড় জোর সে সভ্য ভদ্র নয়। তবে দ্বীনদার থাকতে কোনো অসুবিধা নেই। কী ভয়াবহ ধারণা! অসভ্য অথচ দ্বীনদার!! এটা কীভাবে সম্ভব?

সহীহ মুসলিমে একটি হাদীস  আছে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

فمن أحب أن يزحزح عن النار و يدخل الجنة فلتأته منيته وهو يؤمن بالله واليوم الآخر و ليأت إلى الناس الذي يحب أن يؤتى إليه.

‘যে চায় তাকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করা হোক এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হোক তার মৃত্যু যেন এমন অবস্থায় আসে যে, সে আল্লাহর প্রতি এবং শেষ দিবসের প্রতি ঈমান রাখে। আর মানুষের সাথে তেমন আচরণ করে যেমন আচরণ পেতে সে পসন্দ করে।’

এখানে দুটো বিষয় লক্ষণীয়। এক. সকল দ্বীনদারী ও পরহেযগারীর মূল উদ্দেশ্য, জান্নাত লাভ করা এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়া। তো রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানিয়ে দিলেন, জাহান্নাম  থেকে বাঁচা ও জান্নাত লাভ করা দুটি জিনিসের উপর নির্ভর করে। একটি হল আল্লাহ তাআলার প্রতি ও কিয়ামত দিবসের প্রতি ঈমান রাখা। আর দ্বিতীয়টি হল মানুষের সাথে সদ্ব্যবহার করা। তো পারস্পরিক উত্তম আচরণকে আল্লাহর রাসূল জাহান্নাম  থেকে মুক্তি লাভের মাধ্যম সাব্যসত্ম করেছেন। বোঝা গেল, আদাবুল মুআশারা বা পারস্পরিক আচরণবিধি দ্বীনের একটি অংশ। এটি দ্বীনদারী ও তাকওয়া পরহেযগারীর অন্তর্ভর্ুক্ত। এটি নিছক ব্যক্তিগত ভদ্রতার বিষয় নয়, দ্বীনের বিষয়। এ ছাড়া কেউ পূর্ণাঙ্গ মুমিন হতে পারে না। পরিপূর্ণ দ্বীনদার হতে পারে না।

দ্বিতীয় লক্ষণীয় বিষয় এই যে, মানুষের সাথে এমন আচরণ করা যে আচরণ মানুষের কাছ থেকে পেতে সে পসন্দ করে। একটি মাত্র বাক্য আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যবহার করেছেন, যাতে ‘আদাবুল মুআশারা’ এর সব কিছু এসে গেছে। মানুষের সাথে সুন্দর আচরণের যত ক্ষেত্র হতে পারে এবং যত রূপ হতে পারে, তেমনি অসুন্দর আচরণ থেকে বেঁচে থাকার যত ক্ষেত্র ও রূপ হতে পারে সবকিছু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই এক বাক্যে এসে গেছে। তদ্রূপ যে মূলনীতি মনে রাখা দ্বারা কোন ক্ষেত্রে কী আচরণ বাঞ্ছনীয় তা সহজভাবে উপলব্ধি করা যায় তাও এই বাক্যে এসে গেছে। এই যে ওলামায়ে কেরাম একেকটি বিষয়ের আদব ও আচরণবিধি উলেস্নখ করেন- এভাবে করলে সুন্দর হবে,ওভাবে করলে অসুন্দর হবে, এভাবে করলে মানুষ শান্তি পাবে,ওভাবে করলে কষ্ট পাবে, এই যে একেকটি বিষয়ে বিসত্মারিত আলোচনা- এ সবই এ হাদীসের ব্যাখ্যা ও প্রায়োগিক রূপ। আলিমগণ আদব বিষয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিতাব রচনা করেছেন। ইমাম বুখারী রাহ.এর কিতাব আছে ‘আল আদাবুল মুফরাদ’। হাকীমুল উম্মত হযরত থানবী রাহ.-এর কিতাব রয়েছে ‘আদাবুল মুআশারা’। এ সকল কিতাবে তারা মানবজীবনের পরস্পর আচরণবিধি নিয়ে আলোচনা করেছেন। এ সব কিছুর গোড়ার কথা, আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই বাণী, মানুষের সাথে তুমি ঐ আচরণ করবে যে আচরণ তুমি মানুষের কাছ থেকে পেতে পসন্দ কর।

আদাবুল মুআশারা রক্ষা করা নফল আমলের চেয়ে উত্তম

আদাবুল মুআশারা রক্ষা করা নফল আমল ও নফল ইবাদত যেমন, নফল নামায নফল রোযা ইত্যাদির চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। এর দলীল হল, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে দ’ুজন মহিলার কথা আলোচনা করা হল। একজন রাতভর ইবাদত করে আর দিনের বেলা রোযা রাখে। কিন্তু প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সে জাহান্নামে যাবে। আরেকজন এত বেশী নফল নামায পড়ে না, এত বেশী নফল রোযা রাখে না। শুধু দ্বীনের ফরজ – ওয়াজিবগুলো আদায় করে। দিনভর রোযা রাখার এবং রাতভর নামায পড়ার সুযোগ তার হয় না। কিন্তু  সে প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয় না। রাসূলে কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সে জান্নাতে যাবে।

তাহলে বোঝা গেল, নফল ইবাদতের চেয়ে অন্য মানুষকে কষ্ট না দেয়া বেশী গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে জান্নাতে যাওয়া, জাহান্নাম থেকে বাঁচা বেশী সহজ হবে।

আদাবুল মুআশারা গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার আরেক কারণ হল, শরীয়তের এই মূলনীতি যে, দ্বীনের কোনো বিষয় যখন সাধারণভাবে অবহেলিত হয়ে পড়ে তখন চর্চা ও আলোচনার মাধ্যমে এর প্রচার-প্রসার বেশী গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়। যা সকলে জানে ও মানে, তার চেয়ে যা মানুষ ছেড়ে দিয়েছে, যাকে মানুষ এখন দ্বীনের অংশ মনে করে না তা প্রতিষ্ঠা করা, আমল করা, ঐ বিষয়টির শিক্ষা গ্রহণ করা এবং শিক্ষা দান করা শরীয়তের দৃষ্টিতে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এখন এ বিষয়টির উপর গুরুত্ব দেয়া না হলে ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ইসলামের একটি বিধানকে বাঁচিয়ে রাখা অনেক নফল ইবাদতের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর আদাবুল মুআশারা তো একটি বিধানমাত্র নয়, একটি বিভাগ। দ্বীনের এক গুরুত্বপূর্ণ ও বিস্তৃত শাখা। এ সকল কারণে আলোকে আলিমগণ বলেন, হুসনে আখলাক ও হুসনুল ‘ইশরা তথা সুন্দর স্বভাব-চরিত্র ও সুন্দর ব্যবহার ইসলামের দৃষ্টিতে অনেক বেশী গুরুতবপূর্ণ।

আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম যা বলেছেন, তিনি নিজে ছিলেন তার সবচেয়ে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি নামাযের কথা বলেছেন আর তার নামায ছিল সবচেয়ে সুন্দর। তিনি রোযার কথা বলেছেন আর তার রোযা ছিল সবচেয়ে সুন্দর। তিনি হজ্বের কথা বলেছেন তার হজ্বই ছিল সবচেয়ে সুন্দর। তিনি দান সদকার কথা বলেছেন দান সাদাকার ক্ষেত্রে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে অগ্রগামী। তিনি সুন্দর আচরণের কথা বলেছেন, আপনি হাদীসের গ্রন্থ পাঠ করুন, ইতিহাসের গ্রন্থ পাঠ করুন, দেখবেন- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচরণই ছিল সবচেয়ে সুন্দর। এর দলীল হল, তার নিকটজনদের সাক্ষ্য যারা তার সাথে জীবন অতিবাহিত করেছেন। তার ভেতর বাহির যাদের সামনে ছিল, তাদের সাক্ষ্য এবং আল্লাহর সাক্ষ্য। আল্লাহ রাববুল আলামীন তার রাসূল সম্পর্কে বলেন,

إِنَّكَ لَعَلى خُلُقٍ عَظِيْمٍ

নিশ্চয় আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী।

উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা.- কে জিজ্ঞাসা করা হল, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্বভাব-চরিত্র কেমন ছিল? তিনি বললেন, ‘তার চরিত্র ছিল কুরআন।’ তিনি ছিলেন কুরআনের বাসত্মব রূপ।

হযরত আনাস রা.-কে তার আম্মা রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এই বলে রেখে  গিয়েছিলেন যে, এই আমার ছেলে। সে আপনার কাছে থাকুক। আপনার কাছে থেকে সে দ্বীন শিখবে। আর ছোটখাট কাজ করে দেবে। হযরত আনাস ইবনে মালিক রা. বলেন, আল্লাহর রাসূল ছিলেন সবচেয়ে সুন্দর আখলাকের অধিকারী। আমি দশ বছর তার কাছে ছিলাম। তিনি আমাকে একদিনও উফ শব্দটি পর্যন্ত বলেননি।

ছোট মানুষ কত ভুলই তো করেছেন। কিন্তু আল্লাহর রাসূল সম্পর্কে তার সাক্ষ্য, একদিনও তিনি আমাকে উফ শব্দটি পর্যন্ত বলেননি। হাদীস শরীফে আরো আছে, তিনি কখনো তার কোনো খাদেমকে, কোনো স্ত্রীকে প্রহার করেননি।

সহীহ মুসলিমে হযরত মিকদাদ রা. থেকে দীর্ঘ এক ঘটনা বর্ণিত হয়েছে । তারা কয়েকজন ব্যক্তি রাসূললুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসেছিলেন। রাতে মসজিদে অবস্থান করতেন। তো রাতে যখন আল্লাহর রাসূল মসজিদে আসতেন তখন এমনভাবে সালাম দিতেন যাতে কোনো ঘুমন্ত মানুষের ঘুম না ভাঙ্গে এবং জাগ্রত মানুষ শুনতে পারে।

وكان يسلم تسليما لايوقظ نائما ويسمع اليقظان

মানুষের ঘুমের দিকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কত লক্ষ্য করতেন! আমরা আমাদের নিজেদের সম্পর্কে একটু চিন্তা করে দেখি, আমরা কি অন্যদের ঘুমের বেলায় ততটা লক্ষ্য রাখি? কত সময় এমন হয়, একজন মানুষ ঘুমিয়ে আছে, আমি ঠাস করে দরজা খুললাম। ড্রয়ার খুলে জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করতে থাকলাম। আর ঐ বেচারার ঘুম ভেঙ্গে গেল। অথচ আমাদের একটু অনুভূতিও হল না। আমরা মনে করছি, এই তো স্বাভাবিক। দরজা খুলতে তো আওয়াজ  হবেই। এই আওয়াজে যদি কারো ঘুম ভেঙ্গে যায় তাতে আমার কী করার আছে? অথচ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাম দিচ্ছেন এমন অনুচ্চ স্বরে যে, কারো ঘুম না ভাঙ্গে, কষ্ট না হয়। কখনো এমন হয় যে, একটি কক্ষে পাঁচজন মানুষ থাকেন। তিনজন ঘুমিয়ে আছেন আর দুইজন উচ্চস্বরে গল্প করছেন, হাসাহাসি করছেন। এ অনুভূতি তাদের নেই যে, আমার সঙ্গীদের কষ্ট হচ্ছে। কখনো জোরে মোবাইল বাজিয়ে তিলাওয়াত শোনা হচ্ছে, যে তেলাওয়াতের আওয়াজে পাশের ঘুমন্ত লোকটির ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছে। অথচ তিনি নির্বিকার। তিনি তো তিলাওয়াত শুনছেন! এ তিলাওয়াত শোনায় কী সওয়াব হবে?

আমরা ঘরে বাইরে যখন কিছু মানুষ একসাথে থাকি তখন একে অন্যের আরামের দিকে লক্ষ্য রাখা খুব দরকার। নতুবা কষ্টের কারণে মন অপ্রসন্ন থাকবে, বিরক্তির সৃষ্টি হবে। বলা বাহুল্য, এদের মাঝে কখনো বন্ধুত্ব হবে না। কারণ বন্ধুত্ব তখনই হয় যখন মন প্রসন্ন থাকে, মনে কষ্ট না থাকে। আরবের এক কবি বলেছেন-

فإني رأيت الحب في الصدر و الأذى /  إذا اجتمعا لم يلبث الحب يذهب

 

মনের মধ্যে ভালবাসা এবং কষ্ট যখন একত্র হয় তখন কষ্ট থাকে, ভালবাসা চলে যায়। ‘এমন হয় না যে, ভালবাসা থাকে, কষ্ট চলে যায়; বরং সব সময় ভালবাসাই চলে যায়।

তো আদাবুল মুআশারার মূল কথা হচ্ছে, মানুষকে শান্তি দেওয়া, কষ্ট না দেওয়া।  আমার আচরণে কেউ যেন বিরক্ত না হয়। অপ্রসন্ন না হয়।  আমার প্রতি কারো মনে যেন ঘৃণা না জাগে। আলিমগণ আদাবুল মোয়াশারা বিষয়ে যা লিখেছেন, তার মূল কথা এটাই।

একবার আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জুমার খোতবা দিচ্ছিলেন। এক লোক সবার ঘাড় ডিঙ্গিয়ে ডিঙ্গিয়ে সামনে আসছিল। আল্লাহর  রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘বস! তুমি মানুষকে কষ্ট দিলে।’ ঘাড়ের উপর দিয়ে আসার দ্বারা কি শারীরিক কষ্ট হয়? হয় না। তবে অন্তরে বিরক্তির সৃষ্টি হয়। এই বিরক্তিকর কাজ সম্পর্কেই বলছেন, فقد أذيت তুমি কষ্ট দিলে।

তো আদাবুল মোয়াশারা সংক্রান্ত আয়াত-হাদীস এবং এ বিষয়ে আলিমগণের অভিজ্ঞতালব্ধ আলোচনা যদি মনযোগ সহকারে পাঠ করা হয় তাহলে ইনাশাআল্লাহ আস্তে আস্তে চেতনা জাগবে এবং আমল করা সহজ হবে। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দিন। আমীন।

মুহাররম ১৪৩৬ – নভেম্বর ২০১৪

মাসিক আল কাউসার