প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত

মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গোপনেই ইসলাম প্রচার করছিলেন। এই প্রচারের ফলস্বরূপ ভ্রাতৃত্ব-বন্ধনে আবদ্ধ ও পরস্পর সাহায্য-সহযোগিতার মাধ্যমে মুমিনদের যখন একটি দল সৃষ্টি হলো, রিসালাতের বোঝা বহনের মতো যোগ্যতা তাঁর অর্জিত হলো ও ইসলাম  এবং ইসলামের অবস্থান পোক্ত হওয়ার মতো একটি ভিত্তি তৈরি হলো, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দেওয়া ও বাতিল-দ্বীন-উপাস্যদের উত্তম পন্থায় প্রতিহত করতে আদিষ্ট হলেন।‏

এ বিষয়ে সর্বপ্রথম আল্লাহ তাআলার এ বাণী অবতীর্ণ হয় :‏

‏وَأَنذِرْ عَشِيْرَتَكَ الْأَقْرَبِيْنَ
অর্থ :‏ আর তমি সতর্ক করো তোমার নিকটাত্মীয় স্বজনদের। (আশ-শুআরা ২৬ : ২১৪)‏

এ সূরায় প্রথমে মূসা আলাইহিস সালামের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে;—এতে মূসা (আঃ)-এর নবুওতের প্রারম্ভিক-কাল কীভাবে অতিবাহিত হয়েছিলো, বনি ইসরাঈলসহ কীভাবে তিনি হিজরত করে ফেরাউনের কবল থেকে পরিত্রাণ লাভ করলেন এবং পরিশেষে কিভাবে সদলবলে ফেরাউনকে নিমজ্জিত করা হলো, সেসব কথা বলা হয়েছে। অন্য কথায়, ফেরাউন এবং তাঁর কওমকে আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত প্রদান করতে গিয়ে মুসা আলাইহিস সালামকে যে সকল পর্যায় অতিক্রম করতে হয়েছিলো, এ ছিলো সেই কর্মকাণ্ডের একটি সমন্বিত আলোচনা।

‏রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যখন তাঁর আত্মীয়-পরিজন এবং স্বগোত্রীয় লোকজনদের নিকট দ্বীনের প্রকাশ্য দাওয়াত পেশ করার নির্দেশকালে মুসা আলাইহিস সালামের ঘটনাবলির বিস্তারিত বিবরণাদি এ কারণেই তুলে ধরা হলো, যাতে প্রকাশ্য দাওয়াতের পর কীভাবে মিথ্যা এবং বাতিলের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি হয়ে যায় এবং হকপন্থীদের কীভাবে অন্যায়-অত্যাচারে সম্মুখীন হতে হয়, তার একটি চিত্র নবি করিম সাল্লাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবিগণের সম্মুখে বিদ্যমান থাকে।

এছাড়াও বিভিন্ন জাতি ও সম্প্রদায়ের কাছে পাঠানো অন্যান্য নবিগণের দাওয়াতকে যারা অস্বীকার করেছে, তাদের পরিণতির কথাও এ সূরায় উল্লিখিত হয়েছে, এ কল্পে যে, নবি মুহাম্মদ যাদের কাছে দাওয়াত নিয়ে যাবেন, তারা যেন পূর্ববর্তী কওমের মতো ভুল বা অন্যায়ের পথে হেঁটে সত্য নবিকে অস্বীকার না করে।

প্রকাশ্য দাওয়াতের নির্দেশ পালনার্থে নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু হাশিম (নবিজির বংশ) গোত্রকে একত্রিত করে এক সম্মেলনের আয়োজন করেন। সম্মেলনে উপস্থিত লোকদের সংখ্যা ছিলো পঁয়তাল্লিশ জন। মুহাম্মদ যে গোপনে কিছু করছেন, সমাজের আচরিত বিষয়ের বাইরে গিয়ে নতুন কিছুর প্রচারণা করছেন, এ ব্যাপারে সম্মেলনের সকলে অনবগত ছিলেন, তেমন নয়;—তো সেই সূত্রেই হয়তো সম্মেলনের শুরুতেই আবু লাহাব আকস্মিকভাবে বলে উঠলো, ‘দ্যাখো, এরা সকলেই তোমার নিকটাত্মীয়—চাচা, চাচাতো ভাই। বাচালতা বাদ দিয়ে এদের সঙ্গে ভালোভাবে কথাবার্তা বলার চেষ্টা করবে। তোমার জানা উচিত যে, তোমার জন্য সকল আরববাসীদের সঙ্গে শত্রুতা করার শক্তি আমাদের নেই। তোমার আত্মীয়-স্বজনদের পক্ষে তোমাকে ধরে কারারুদ্ধ করে রাখাই কর্তব্য। সুতরাং তোমার জন্য তোমার পিতৃ-পরিবারই যথেষ্ট। তুমি যদি তোমার ধ্যান-ধারণা এবং কথাবার্তায় অটল থাকো, তবে এটা অনেক সহজ এবং স্বাভাবিক যে, সমগ্র কুরাইশ-গোত্র তোমার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করবে এবং অন্যান্য আরব-গোত্র এ ব্যাপারে সহযোগিতা করবে। স্বীয় পিতৃপরিবারের বাইরে আর অন্য কারা তোমার চাইতে বড় সর্বনাশা হতে পারে, তা আমি জানি না। আবু লাহাবের এ জাতীয় অর্থহীন আস্ফালনের প্রেক্ষাপটে নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পূর্ণ নীরবতা অবলম্বন করলেন এবং ওই নীরবতার মধ্য দিয়েই সম্মেলন শেষ হয়ে গেলো।

এই মজমা এভাবে ভেঙে গেলেও নবিজি বিচলিত হলেন না। তিনি আবার তাঁর গোত্রের লোকদের একত্রিত করলেন। এবার তিনি পৌঁছে দিতে পারলেন তাঁর অভিষ্ঠ বার্তাটি; —তিনি হৃদয়মথিত হাহাকার নিয়ে বললেন, ‘কোনো জাতির রূপকার তার জাতির সাথে ছলনা করে না, নেয় না মিথ্যা বা প্রতারণার আশ্রয়; আপনারা শুনুন, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই আর আমি সেই আল্লাহর রাসূল; যেভাবে আপনারা ঘুমিয়ে যান, সেভাবে একদিন মৃত্যুর ঘুম এসে যাবে; আবার যেভাবে জেগে ওঠেন, সেভাবে মৃত্যুর পরেও আবার জেগে ওঠা আছে;—জেগে উঠে আপনাদের দিতে হবে হিসাব নিজ নিজ কর্মের; আর তখন পরিণাম নিরূপিত হয়ে কেউ হবে জান্নাতি, কেউ জাহান্নামি।’

এ সভায় আবু লাহাব কিছু বলার আগেই আবু তালিব জানালেন, মুহাম্মদের ব্যাপারে তাঁর পূর্ণ সমর্থন রয়েছে; আর কাউকে না পেলেও আবু তালিবকে তিনি তাঁর পাশে পাবেন। এতে আবু লাহাব খুব ক্ষেপে ওঠে। তার তোয়াক্কা না করে আবু তালিব জোর দিয়ে জানান, আমার জীবন থাকতে আমি মুহাম্মদের হিতই করে যাবো। আবু লাহাব রাগে গজরাতে গজরাতে সভাস্থল ত্যাগ করে।

আবু তালিবের জোরালো সমর্থন পেয়ে রাসূলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রকাশ্য দাওয়াতের পরিধি বাড়িয়ে নেওয়ার মনস্থ করেন। একদা তিনি মক্কার সাফা পাহাড়ে গিয়ে মক্কার গোত্রের নাম ধরে ধরে ডাকতে থাকেন। সেকালে কোনো বিশেষ বিষয়ের দিকে মানুষকে মনোযোগী করার এ-ই ছিলো নিয়ম। সকলে জড়ো হলে তিনি দরদি ব্যথীর মতো বলেন, ‘যদি বলি, এই পাহাড়ের পেছনে আছে ভয়ঙ্কর শত্রুর বাহিনী, তোমরা কি বিশ্বাস করবে?’ সমবেত কণ্ঠ জানায়, ‘আমরা তো তোমাকে মিথ্যায় দেখিনি; নিশ্চয়ই বিশ্বাস করবো।’ তিনি আরও ব্যথা নিয়ে বললেন, তোমাদের দিকে উবু হয়ে আছে এর থেকেও ভয়ঙ্কর বিপদ। আমি সে বিপদের দেখা পেয়ে তোমাদের সাবধান করতে এসেছি…’ এরপর তিনি একে একে বলে যেতে থাকেন সমাজের নানা বিসম্বাদ নিয়ে, এর থেকে পরিত্রাণের উপায় নিয়ে; কীভাবে মানুষ নিজেকে, সমাজকে, রাষ্ট্রকে এমনকি বিশ্বকে করতে পারে সুন্দর, মহান ও বাসযোগ্য, বলেন সেই অতুলনীয় জীবনের কথাও; জান্নাত ও জাহান্নামের বিবরণ শুনিয়ে গোত্রের নাম ধরে ধরে সেই সুখী জীবনের দিকে ধাবিত হতে আর নারক জীবন থেকে ফিরে আসতে সমবেত জনতাকে সাদর আহ্বান জানান; তার কণ্ঠের মাদকতা সবাইকে জড়িয়ে নেয়; তাঁর কথায় ছড়ানো ব্যথাপুঞ্জে আর্দ্র হয়ে ওঠে শ্রোতাদের মন; কিন্তু আবু লাহাব জরিপ করে যাচ্ছিলো সভার অবস্থা; সে আচমকা বলে উঠলো, ‘তোমার ধ্বংস হোক; এসব বলতেই আমাদের এক করেছো?’ তার এই প্রতিক্রিয়ায় অনেকক্ষণ ধরে বুনতে থাকা একটি তসবিদানা যেমন ঘন হতে হতে হঠাৎ ছিঁড়ে বিক্ষিপ্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে অসংখ্য দিকে, তেমনি নবিজির কথায় সম্মোহিত মানুষগুলোরও আচমকা এই বাধাদানে সেই অবস্থা হলো। ভেঙে গেলো সভা।

আবু লাহাব গোড়া থেকেই এভাবে শেষ দিন পর্যন্ত নবিজির পেছনে লেগে ছিলো; হলেও নবিজি তো আর কোনো দিন তাঁর কর্তব্য থেকে বিচলিত হননি। তবে এই প্রকাশ্য দাওয়াতের ভেতর দিয়ে রাসূল দ্বীন প্রচারের জন্য যেমন সর্বত্র পৌঁছে যাচ্ছিলেন, ঠিক তেমনি করে আবু লাহাবের বাধাপ্রদানের ভেতর দিয়ে এই দ্বীনের পথ যে বাধারও সম্মুখিন হবে, সেই কুটিল ও কুচক্রী ধারারও রেখা দেখা গেলো সময়ের গায়ে।

নবি মুহাম্মদ এক অস্থির বাধাবিক্ষুব্ধ কালের দিকে যাত্রা শুরু করলেন…