আল্লাহওয়ালাদের অভিন্ন তা‘লীম – মুফতী মনসূরুল হক (দা.বা)

হযরত থানভী রহ. এবং হযরত ইলিয়াস রহ.– এর অভিন্ন তা‘লীম

হযরত হাকীমুল উম্মাত মুজাদ্দিদে মিল্লাত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রহ. বর্ণনা করেছেনঃ

তাকওয়া বা পূর্ণ দীন সর্বমোট পাঁচটি বিষয় বস্তুর সমষ্টিকে বলা হয় ।
(১) ঈমান আকাইদ দুরস্ত রাখা অর্থাৎ ইসলামের মূল বিষয়গুলি যা ঈমানে মুফাসসালের মধ্যে উল্লেখ আছে তাতে অটল বিশ্বাস রাখা
(২) ইবাদত বন্দেগী সুন্নাত মুতাবেক হওয়া অর্থাৎ আল্লাহর ইবাদত এমন ভাবে করা দরকার যা তাঁর মনোনীত রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম শিখিয়ে গেছেন।
(৩) মু‘আমালাত দুরস্ত রাখা অর্থাৎ বিজ্ঞ উলামাদের থেকে জেনে নিয়ে রিযিক পূর্ণ হালাল ও সহীহ রাখা।
(৪) মু‘আশারাত অর্থাৎ বান্দার হক তথা লোকদের সহিত আচার ব্যবহার ভাল করা, তাদের হক আদায় করা, যাতে কারো কষ্ট না হয়।
(৫) তাসাওউফ বা তাযকিয়ায়ে বাতেন অর্থাৎ দশটি রোগ সহ সমস্ত গুনাহ থেকে আত্মাকে পবিত্র করা এবং দশটি গুনের দ্বারা অন্তরকে সজ্জিত করা।
(সূরা বাকারা : ১৭৭ , বুখারী শরীফ ১: ৬ বাবু উমুরিল ঈমান, আদাবুল মু‘আশারাত : ১১, তালীমুদ্দীন)

উক্ত পাচঁটি জিনিস বাস্তবায়ন করতে হলে তিন লাইনে মেহনত করতে হবেঃ

(১) তাবলীগ তথা উভয় জগতে কামিয়াবীর একমাত্র রাস্তা দীনের উপর চলা, একথা বুঝিয়ে দীনের উপর চলতে উৎসাহিত করা।
(২) তা‘লীম তথা ইসলামের আদেশ নিষেধ মানুষকে শিক্ষা দান করা।
(৩) তাযকিয়া অর্থাৎ আত্মশুদ্ধি করা, আল্লাহ ওয়ালাদের সুহবতে গিয়ে দিলের থেকে বদ খাছলাত দূর করে ভাল আখলাক অর্জন করা। এই তিনটি পদ্বতির কথা আল্লাহ তা‘আলা কুরাআনে কারীমে চার জায়গায় উল্লেখ করেছেন।
(সূরা বাকারা : ১২৯ ও ১৫১ (২) সূরা আল ইমরান: ১৬৪ (৩) সূরা জুম‘আ: ২)

মুসলিহুল উম্মাহ হযরত মাওলানা ইলিয়াস রহ. কর্তৃক তাবলীগের ছয়টি সিফাত নির্ধারিত করা হয়েছেঃ

(১) কালিমা
(২) নামায
(৩) ইলম ও যিকির
(৪) ইকরামুল মুসলিমীন
(৫) তাসহীহে নিয়্যাত
(৬) তাবলীগ।

উক্ত ছয়টি সিফাতের মধ্যেই দীনের জরুরী পাঁচটি বিষয় রয়েছেঃ

(১) ঈমান আকাইদ দুরস্ত করা রয়েছে প্রথম সিফাত কালিমার মধ্যে
(২) ইবাদত বন্দেগী সহীহ করা রয়েছে দ্বিতীয় সিফাত তথা নামাযের মধ্যে
(৩) ও (৪) মুআমালাত, মুআশারাত সহীহ করার তালীম রয়েছে চতুর্থ সিফাত ইকরামুল মুসলিমীন এর মধ্যে। কারণ যাদের অন্তরে মুসলমান ভাইয়ের আজমত ও মুহাব্বত থাকবে তাদের লেন-দেন ও বান্দার হক সহীহ ভাবে আদায় হবে।
(৫) তাযকিয়া বা আত্মশুদ্বি রয়েছে তাসহীহে নিয়তের মধ্যে।

উক্ত আমলগুলী বাস্তবায়নের তিনটি পদ্ধতিও ছয়টি ছিফাতের মধ্যে রয়েছেঃ

(১) তাবলীগের গুরুত্ব যা ষষ্ঠ সিফাত, এর দ্বারা ঈমান মজবুত হয় ।
(২) তালীম তথা উলামায়ে কিরাম থেকে মূল ঈমান ও ঈমানের শাখা প্রশাখা সমূহ তথা ইবাদত মুআমালাত ও মুআশারাত তাযকিয়া শিখে নেয়া, উহা তৃতীয় সিফাত ইলমের মধ্যে আছে।
(৩) তাযকিয়া আত্মশুদ্ধি করা ইহা তৃতীয় সিফাত যিকির এর মধ্যে রয়েছে।

উল্লেখিত বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায় যে , হযরত থানবী রহ. এবং হযরত ইলিয়াস রহ. এর তা‘লীম একই ছিল। সুতরাং আমাদের সকলেরই কর্তব্য পূর্ণ দীনদারী অর্জনের জন্য তাবলীগ, তা‘লীম ও তাযকিয়ার মেহনতের সাথে জুড়ে থাকা। তিনটার কোন একটিকেও কম গুরুত্বপূর্ণ মনে না করা।

মুসলিহুল উম্মাহ হযরত মাওলানা ইলিয়াস রহ. ইরশাদ করেন

(১) আমাদের মেহনতের আসল উদ্দেশ্য হল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা কিছু নিয়ে এসেছেন তা শিক্ষা দেয়া । (অর্থাৎ ইসলামের সম্পূর্ণ ইলমী এবং আমলী রূপরেখার সাথে উম্মতকে পরিচিত করা।) এটাই হল আমাদের আসল উদ্দেশ্য। আর কাফেলা সমূহের (বিভিন্ন জামা‘আতের) এ চলাফেরা এবং তাবলীগী গাশত্‌ ইত্যাদি এগুলো হল উক্ত উদ্দেশ্যের জন্য প্রাথমিক মাধ্যম। আর কালিমা ও নামাযের তালকীন ও তা‘লীম আমাদের সম্পূর্ন নেসাবের ‘আলিফ’ ‘বা’ ‘তা’ এর মত। এটাও সুস্পষ্ট কথা যে, আমাদের এ কাফেলা (তাবলীগী জামা‘আত) দীনের সকল প্রকার কাজ করতে সক্ষম নয়। তাদের দ্বারা তো শুধুমাত্র এতটুকু হতে পারে যে, বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে নিজেদের চেষ্টা কোশেশের মাধ্যমে ঐ এলাকায় এক জাগরণ সৃষ্টি করবে এবং গাফেলদের সচেতন করে তাদেরকে স্থানীয় আহলে ইলম এর সাথে সম্পৃক্ত করার এবং উলামা ও নেক লোকদেরকে সাধারণ মানুষের ইসলাহের কাজে লাগিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবে। সব জায়গায়ই দীনের আসল কাজ তো ঐ এলাকার আলেমে দীনই করতে সক্ষম হবেন। আর সাধারণ মানুষের বেশী লাভ হবে স্থানীয় আহলে দীনের থেকে ইলম হাসিল করার দ্বারা। (মালফুজাত নং : ২৪, পৃঃ ৩৯)

(২) দাওয়াত ও তাবলীগের সাথীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আপনাদের এ সম্পূর্ণ চলাফেরা এবং চেষ্টা প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ বিফলে যাবে যদি এর সাথে ইলমে দীন এবং যিকরুল্লাহর পুরো ইহতিমাম আপনারা না করেন। (এ ইলম এবং যিকির পাখির ডানার মত। দুটি ডানা ছাড়া পাখি আকাশে উড়তেই পারবেনা) অন্যথায় প্রবল আশংকা রয়েছে যে, যদি এই দুটি বিষয়ের প্রতি উদাসীনতা প্রদর্শন করা হয় তাহলে এই প্রচেষ্টা দ্বারা (আল্লাহ না করেন) ফিত্‌না এবং গোমরাহীর একটি নতুন দরওয়াজা খুলে যাবে। (মালফুজাত নং : ৩৫, পৃঃ ৪৭)

এ বর্ণনার দ্বারা হযরত ইলিয়াস রহ. উলামাদের থেকে ইলম হাসিল এবং আল্লাহ ওয়ালাদের থেকে আত্মশুদ্ধি অর্জন করার উপর গুরুত্বারোপ করেছেন।

(৩) আমি প্রাথমিক অবস্থায় এভাবে যিক্‌র এর তা‘লীম দিয়ে থাকি, প্রতি নামাযের পর তাসবীহে ফাতেমী, সকাল সন্ধ্যায় তিন তাসবীহ, একশতবার কালেমায়ে সুওম, একশতবার দরূদ শরীফ ও একশতবার ইস্তিগফার এবং বিশুদ্ধভাবে কিরাআতের সাথে কুরআন তিলাওয়াত। আর নফল নামাযের মধ্যে তাহাজ্জুদের তাকীদ এবং আহলে যিক্‌র তথা উলামায়ে কিরাম ও মাশাইখদের কাছে যাওয়া। (মালফুজাত নং ৪৯, পৃঃ ৬২)

(৪) ইলম এবং যিক্‌র এর কাজ এখনও আমাদের মুবাল্লিগীনদের নিয়ন্ত্রনে আসেনি; এ বিষয়ে আমি অত্যন্ত চিন্তিত। এর তরীকা এটাই যে, ঐ সমস্ত লোকদেরকে আহলে ইলম এবং আহলে যিক্‌র এর নিকট পাঠানো হবে, যাতে তাদের তত্ত্বাবধানে তাবলীগও করবে এবং ইলম ও সুহবত থেকেও উপকৃত হবে। (মালফুজাত নং ৪৯, পৃঃ ৭০)

এ বর্ণনার দ্বারাও হযরত রহ. উলামাদের থেকে জরুরী ইলম ও মাশাইখদের থেকে আত্মশুদ্ধি করানোর উপর তাকীদ করেছেন।

(৫) তাবলীগ জামা‘আত সমূহের নিসাব তা‘লীমের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে তাজবীদ শিক্ষা করা। অর্থাৎ কুরআনে কারীমের সহীহ শুদ্ধ তিলাওয়াত শিক্ষা করা। (মালফুজাত নং ২০২ পৃঃ ২০১)

(৬) আমাদের সকল মসজিদ মূলত মসজিদে নববীর শাখা, এজন্য আমাদের মসজিদ গুলোতে ঐ সমস্ত কাজ হওয়া চাই যা হুজুর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মসজিদে হত, সেখানে নামায ছাড়াও তা‘লীম এবং তাযকিয়ার কাজও হতো এবং দীনের দাওয়াত সংক্রান্ত সমস্ত কাজও মসজিদ থেকেই হতো। (মালফুজাত নং ২০৭ , পৃঃ ২০৪)

এই বর্ণনায়ও হযরত ইলিয়াস রহ. তাবলীগ, তা‘লীম ও তাযকিয়া এই তিন লাইনের মেহনতকে মসজিদ সমূহে জারী করার জন্য গুরুত্ব আরোপ করেছেন। আর এই তিন লাইনেই আম্বিয়া ‘আলাইহিমুস সালামগণ আল্লাহর জমীনে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে কুরআনে কারীমের বিভিন্ন আয়াতে প্রমাণ পাওয়া যায়।