আকাবার দ্বিতীয় বাইয়াত

আকাবার প্রথম বাইয়াতে কতিপয় মদিনাবাসীর ইসলামগ্রহণ মদিনায় বেশ ইতিবাচক সাড়া ফেলে। তদুপরি মদিনার চলমান ভ্রাতৃঘাতী দ্বন্দ্বও মিটে যাচ্ছিলো। মদিনার এই আশু-শান্তিঘন পরিবেশ দীর্ঘস্থায়ী করার লক্ষ্যে একজন যোগ্য ও ন্যায়পরায়ণ নেতার প্রয়োজন ছিলো, ছিলো যোগ্য নেতৃত্ব ও একটি অনুপম আদর্শেরও;—আর এর সবকিছু নবী মুহাম্মদ (সাঃ) ও তাঁর আনীত ধর্ম ইসলামের মধ্যে ছিলো বিধায় যাঁরা মুসলমান হয়ে মদিনায় ফিরে গেলো, তাঁদের বরাত ধরে মদিনার ঘরে ঘরে ইসলামের চর্চা শুরু হয়ে যায় এবং প্রতিটি আসরে-মজলিসে এই একটি ব্যাপারেরই আলোচনা চলতে থাকে।

মদিনার এই অবস্থাদৃষ্টে আউস ও খাযরাজের দায়িত্বশীলগণ নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট চিঠি লিখেন যে, ‘আলহামদুলিল্লাহ, এখানে ইসলামের প্রচার হয়ে গেছে।  এখন এমন একজন সাহাবিকে আমাদের নিকট পাঠিয়ে দিন, যিনি আমাদেরকে কুরআন শরিফ পড়াবেন।  লোকদেরকে ইসলামের দিকে দাওয়াত দেবেন।  আমাদেরকে শরিয়তের আহকাম সম্পর্কে অবহিত করবেন এবং নামাযে আমাদের ইমামতি করবেন।’  নবীজি হযরত মুসআব ইবনে উমায়ের রাযিয়াল্লাহু আনহুকে কুরআনের শিক্ষা দেওয়ার জন্য মদিনায় পাঠিয়ে দিলেন।

এদিকে পরবর্তী বছর হজের মৌসুমে মদিনা থেকে ৭০ জন পুরুষ ও ২ জন মহিলার  বিরাট এক কাফেলা মক্কা মোকাররমায় এসে পৌঁছুলো। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদের স্বাগত জানান এবং রাতের বেলা আকাবার নিকট তাদের সাথে সাক্ষাতের প্রতিশ্রুতি দেন। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মধ্যরাতে সবাই জমায়েত হন।  নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে তাঁর চাচা হযরত আব্বাসও আসেন, তখনও তিনি ইসলাম গ্রহণ করেননি।

আসলে তত দিনে মদিনাবাসী তাঁদের নেতা হিসেবে নবীজিকে মদিনায় নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে; আর রাসূলের নিরাপত্তার প্রশ্নে মদিনার অবিঘ্নিত পরিবেশের যে অপেক্ষা ও প্রয়োজন ছিলো, সেই অপেক্ষা ও প্রয়োজনের অবসান ঘটে নবীজিকে নিজেদের নেতা হিসেবে পাওয়ার শুভ অপেক্ষা ও প্রয়োজন তাঁদের সকলের মনে দানা বেঁধেছিলো। নবীজিকে নিয়ে তাঁদের এই ইচ্ছা ও পরিকল্পনার কথা হিতাকাঙ্ক্ষী হিসেবে চাচা আব্বাসের অজানা ছিলো না, তদুপরি অমুসলিম-কালেও তো তিনি  ইসলামের মঙ্গলকামীই ছিলেন। সেই সূত্র ধরে আকাবায় উপস্থিত মদিনাবাসীকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন—

এই আমার ভাতিজা—সর্বদা নিজ গোত্রে সম্মান ও নিরাপত্তার সাথে বসবাস করে আসছে।  আপনারা যাঁরা তাঁকে মদিনায় নিয়ে যেতে চাইছেন, তাঁরা ভেবে দেখুন, যদি আপনারা তাঁর সাথে কৃত অঙ্গীকার যথাযথভাবে পালন করতে এবং শত্রুদের হাত হতে তাঁকে পূর্ণ নিরাপত্তা দিতে সক্ষম হবেন বলে মনে করেন, তবেই কেবল এ দায়িত্ব গ্রহণে এগিয়ে আসুন।  অন্যথায় তাঁকে তাঁর নিজের গোত্রেই থাকতে দিন।

উত্তরে মদিনার কাফেলার সর্দার বলে উঠলেন, ‘নিশ্চয় আমরা এই দায়িত্ব গ্রহণ করছি এবং তাঁর সাথে কৃত বাইয়াতের পূর্ণ বাস্তবায়নই আমাদের একমাত্র কাম্য।’  এ কথা শুনে (অঙ্গীকার এবং বায়আতকে দৃঢ় করার উদ্দেশ্যে) হযরত আসআদ ইবনে যুরারা দাঁড়িয়ে বললেন, ‘হে মদীনাবাসী, একটু অপেক্ষা করো।  তোমরা কি বুঝতে পারছো যে, আজ তোমরা কী বিষয়ে বাইয়াত নিতে যাচ্ছো?—বুঝে নাও,—এই বাইয়াত গোটা আরব ও অনারবের বিরোধিতা ও মোকাবেলার অঙ্গীকার;  যদি তোমরা তা পূরণ করতে পারো, তবেই কেবল বাইয়াত সম্পাদন করো;  অন্যথায় নিজেদের অপারগতা প্রকাশ করে দাও।’  এ কথা শুনে সবাই একবাক্যে বলে উঠলো, ‘আমরা কোনো অবস্থাতেই এ বাইয়াত থেকে পিছু হটবো না।’

অতঃপর তাঁরা নবীজির নিকট আরজ করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল, আমরা যদি এই অঙ্গীকার পূরণ করি, তাহলে আমরা এর কী প্রতিদান লাভ করবো?’ নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাত।’  শুনে সবাই বলে উঠলেন, ‘আমরা এর উপরই সন্তুষ্ট আছি। আপনি আপনার পবিত্র হস্ত প্রসারিত করুন, আমরা বাইয়াত গ্রহণ করবো।’  নবীজি স্বীয় হাত বাড়ালেন আর সকলেই বাইয়াত-লাভে ধন্য হলেন।

তাঁরা সকলেই বাইয়াত গ্রহণ করলেন। এই বাইয়াতে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা ছিলো ৭৩ জন পুরুষ এবং ২ জন মহিলা।  এই বাইয়াতের নাম তে ‘বাইয়াতে আকাবায়ে সানিয়া’ বা ‘আকাবার দ্বিতীয় বাইয়াত’।  এরপর নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এঁদের মধ্য থেকে ১২ জন ব্যক্তিকে পুরো কাফেলার দায়িত্বশীল বানিয়ে দিলেন।