কুরআন এবং আপনি – তারিক মেহান্না (পর্ব ১১)

কুরআনে সূরা বাক্বারার ২১৭ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ বলছেন,

সম্মানিত মাস সম্পর্কে তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে যে, তাতে যুদ্ধ করা কেমন? বলে দাও এতে যুদ্ধ করা ভীষণ বড় পাপ। আর আল্লাহর পথে প্রতিবন্দ্বকতা সৃষ্টি করা এবং কুফরী করা, মসজিদে-হারামের পথে বাধা দেয়া এবং সেখানকার অধিবাসীদেরকে বহিস্কার করা, আল্লাহর নিকট তার চেয়েও বড় পাপ। আর ধর্মের ব্যাপারে ফেতনা সৃষ্টি করা নরহত্যা অপেক্ষাও মহা পাপ …”

 

হিজরী ২য় বর্ষে এই আয়াত নাযিল হয়। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আব্দুল্লাহ ইবনে জাহশ (রাদিয়াল্লাহু আনহু)এর নেতৃত্বে ১২ জন সাহাবীকে কুরাইশদের একটি খাদ্যবাহী কাফেলাকে অবরোধ করতে নাখলাহ (মক্কা ও তায়েফের মাঝামাঝি) নামক স্থানে পাঠান। মুসলিমদের উপর বাড়াবাড়ি রকমের জুলুম-নির্যাতনকারী কিছু মুশরিক সেই কাফেলাতে ছিল। অত্যাচারের ক্ষেত্রে তারা সবরকমের সীমা অতিক্রম করেছিল। তারা মুসলিমদের অর্থসম্পদ আত্মসাৎ করেছিল, মুসলিমদের ঘরছাড়া করেছিল, সাহাবীদের অত্যাচার করেছিল, এমনকি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে ও তারা একাধিকবার হত্যার চেষ্টা করেছিল। সেই কাফেলার কাছাকাছি গিয়ে ‘আবদুল্লাহ ইবনে জাহশ এই ঘৃণ্য লোকগুলোকে দেখতে পান। সাহাবাদের মনে তখন এ কাফেলাটি আক্রমণ করে তাদের নিজেদের অর্থসম্পদের কিয়দাংশ ফেরত পাবার চিন্তা উদিত হয়। কিন্তু সে সময়টা ছিল রজব মাস। চারটি সম্মানিত মাসের মধ্যে অন্যতম রজব মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত হওয়া ছিল হারাম। তবে অনেকক্ষণ ভেবে দেখার পর, মুসলিমদের সেই ছোট্ট দলটি তাই করার সিদ্ধান্ত নেয় যা ইতিহাস এবং পরিস্থিতির বিচারে সমর্থনযোগ্য। তারা সে কাফেলাটি আক্রমণ করেন এবং তাদের হারানো কিছু সম্পদ পুনরুদ্ধার করেন।

এই ঘটনা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে অস্বস্তিকর পরিস্থিতে ফেলে দেয়। এই ঘটনাকে পুঁজি করে এবার মুশরিকরা সমাজে হৈ চৈ বাঁধিয়ে মুসলিমদের বিপক্ষে জনসমর্থন আদায়ের সুযোগ পায়। তারা বলে বেড়াতে থাকে মুসলিমরা যুদ্ধের পবিত্র রীতি লঙ্ঘন করেছে। তারা উগ্র, তারা জঙ্গী, তারা রক্তপিপাসু যুদ্ধবাজ; তারা শান্তি ও স্বাধীনতা বিরোধী চক্র এবং এ ধরনের আরো নানান কথা তারা বলতে শুরু করে। এক পর্যায়ে গিয়ে ইবন জাহশ ও তার বাহিনীর কুরাইশদের কাফেলা আক্রমণের ঘটনায় কীভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা উচিত তা নিয়ে মুসলিমরাও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। অবশেষে, আল্লাহ এই আয়াতটি নাযিল করেন এবং নিশ্চিত করেন যে, হ্যাঁ, সম্মানিত মাসে যুদ্ধ করা নিষিদ্ধ। কিন্তু মক্কার মুশরিকরা মুসলিমদের সাথে এতদিন ধরে যা কিছু অন্যায় করে আসছে সেগুলো নিষিদ্ধ মাসে যুদ্ধ করার চেয়েও নিকৃষ্ট। এই আয়াতের মাধ্যমে মুসলিমদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগকে কেন্দ্র করে কুরাইশরা যে মানবতার মেকি আর্তনাদ তোলে তা নিস্ফল হয়ে যায়।

বর্তমানকালেও এই ধরনের পরিস্থিতি কিভাবে মোকাবেলা করতে হবে সে ব্যাপারে এই আয়াত আমাদেরকে শিক্ষা দেয়। এই শিক্ষা হল, ইসলামের শত্রুরা কিছু ঘটনাকে পুঁজি করে ফায়দা লুটবার চেষ্টা করে। এই ঘটনাগুলো আমাদেরকে অনেক সময় রক্ষণাত্মক অবস্থানে ঠেলে দেয়। কিন্তু আমাদের রক্ষণাত্মক হয়ে পড়া মোটেই উচিত নয়। বরং কৈফিয়ত দেয়ার চেষ্টা না করে বরং ইসলামের এইসব শত্রুদের তাদের অপরাধের জন্য কাঠগড়ায় তোলা উচিত। ইবনে জাহশের আপাতদৃষ্টিতে অনুচিত কাজটিকে তারা শঠতাপূর্ণ উপায়ে এমনভাবে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে সবার সামনে তুলে ধরেছিল যে, তাদের নিজেদের সব অপকর্ম এর নীচে চাপা দিয়ে ফেলেছিল। অথচ তাদের অন্যায় ও অপকর্মই এই ঘটনার মূল প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছিল। তাদের এই উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণার জবাবে আল্লাহ মুসলিমদেরকে তাদের ফাঁদে পা দিয়ে রক্ষণাত্মক হতে বলেননি। মুশরিকদের সামনে কৈফিয়ত পেশ করতেও বলেননি। বরং আল্লাহ মুসলিমদেরকে আদেশ করেছেন এই মুশরিকদের সকল অপকর্ম সবার সামনে তুলে ধরতে। এখানে মুসলিমদের আচরণটা হবে এমন, “আরে? তুমি কাকে সন্ত্রাসী, উগ্রপন্থী বলছ? তুমি নিজে কি করেছো আমাদের সাথে, সে ইতিহাসের দিকে আগে লক্ষ্য কর!”

এই যুগে এসেও মুসলিমদেরকে এই ধরনের পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। যখনই আমাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদ, উগ্রপন্থা এবং এই ধরনের আরো অতি পরিচিত কিছু অভিযোগ তাক করা হয়, তখন অধিকাংশ মুসলিম হয়তো ভালো নিয়ত নিয়েই রক্ষণাত্মক অবস্থানে গিয়ে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। “দেখুন অল্প কিছু মানুষের কাজের জন্য আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে দেওয়া যায় না”, “আমরা শান্তিকামী মুসলমান”, “ইসলাম নিরীহ মানুষ হত্যা কোনোক্রমেই সমর্থন করে না” ইত্যাদি কিছু গৎবাঁধা বুলি আওড়ে তারা যেন ইসলামকে কলঙ্কমুক্ত করার চেষ্টা করে। হতে পারে তারা এসবের সাথে মোটেও জড়িত ছিল না।অনেক ক্ষেত্রে তাদের এই বুলিগুলো সত্যও বটে। তবুও আগ-বাড়িয়ে এসব কথা বলে নিজেদের ভাবমূর্তি পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা করাটা পরাজিত মানসিকতার একটি লক্ষণ। এই লক্ষণটি পশ্চিমা মুসলিমদের একটি সনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য। পশ্চিমারা এভাবেই আমাদের জন্য ফাঁদ পেতে রেখেছে। তারা চায় আমরা নমনীয় হই। কৈফিয়ত ও আত্মরক্ষাসুলভ প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করি যাতে করে তারা নিজেদের হিংস্র ও রক্তাক্ত ইতিহাস আড়াল করতে পারে। এ কারণেই, এই আয়াতটি আমাদের শিক্ষা দেয়, কাফিরদের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে নমঃনমঃ হয়ে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করার এই বেদনাদায়ক মানসিকতা যেন আমরা পরিত্যাগ করি। বরং হাঁটে হাড়ি ভেঙে তাদেরকে যেন তাদের অপকীর্তিগুলোকে দেখিয়ে দেই। আর তাদের অপকীর্তির উদাহারণ তো ভুরি ভুরি।

 

এই আয়াতে মুসলিমদেরকে কুরাইশদের অপকর্ম ও অন্যায়ের স্বরুপ উন্মোচন করে দিতে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। এর উদ্দেশ্য ছিল তাদের তর্জন-গর্জনকে স্তিমিত করে দেওয়া। ঠিক একইভাবে আমাদের উচিত, আজকে যারা ইসলামের শত্রু, তাদের সীমালঙ্ঘন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া এবং সেগুলোর একটি তালিকা তৈরি করা। যখনই তারা আমাদেরকে বিরুদ্ধে সন্ত্রাস বা উগ্রপন্থার অভিযোগ তুলে আঙুল তাক করার ধৃষ্টতা দেখাবে এবং নিজেদের পরম হিতৈষী শান্তিকামী হিসেবে দাবি করবে, তখন আমরা তাদের কুকীর্তির ইতিহাস উন্মোচন করব।

 

আমাদের নেটিভ আমেরিকানদের গণহত্যার ইতিহাস সম্বন্ধে জানা উচিত। কলম্বাস আসার আগে তাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১ কোটি। কিন্তু ইউরোপিয়ান হানাদাররা বর্তমান আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের এই আদি অধিবাসীদের কচুকাটা করে তাদের সংখ্যা নামিয়ে নিয়ে আসে ১০ লক্ষেরও নীচে।

আফ্রিকার দাসদের ইতিহাস নিয়ে আমাদের পড়াশোনা করা উচিত। দাস-বণিক ও উপনিবেশ স্থাপনকারীদের হাতে সেখানে ৫০ মিলিয়ন মানুষ তাদের জীবন দিয়েছে। এটি সুদূর ইতিহাসের ঘটনা নয়। এটি ঘটেছিল সেই যুগে, যে যুগকে আধুনিক পশ্চিমা সভ্যতার সূচনাকাল হিসাবে ধরা হয়। এই নিষ্ঠুরতার পেছনে কোন দেশ ছিল? পশ্চিমা ইউরোপ এবং আমেরিকা, যাদের কিনা সবচেয়ে “সভ্য” জাতি হিসেবে গণ্য করা হয়।

আমাদের মেক্সিকান-আমেরিকান যুদ্ধের ইতিহাস জানা উচিত, এবং “manifest destiny” এর অর্থ জানা উচিত। (manifest destiny হল এই নিয়তিতে বিশ্বাস করা যে, আমেরিকান সৈন্যরা বিশ্বের সকল প্রান্তে ছড়িয়ে পড়বে)।

১৯ শতকের শেষদিকে আমেরিকান দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে ফিলিপিনোদের বিদ্রোহের কাহিনী সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে।

আমাদের জ্ঞানের পরিধিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে হিরোশিমা ও নাগাসাকির পারমাণবিক বিস্ফোরণের ঘটনা। প্রায় দেড় লক্ষ মানুষ মুহুর্তের মাঝে ছাই হয়ে যায় এই বোমার কবলে পড়ে। এদের সবাই ছিল যে যার মত কাজ করা বেসামরিক লোক। ইতিহাসে এক জাতি কর্তৃক অপর জাতির উপর পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের এটিই একমাত্র ঘটনা। অথচ নির্মম বাস্তবতা এই যে, যারা সেইদিন নিজেরা পারমাণবিক বোমা ফাটিয়েছিল, তারাই আজকে হর্তা-কর্তাসেজে বিশ্বব্যাপী লেকচার দিয়ে বেড়ায় যেন যার-তার হাতে এই পারমাণবিক বোমা চলে না যায়! (জন হেরেসির(John Hersey) “হিরোশিমা” নামক বইটি পড়ুন)

 

ল্যাতিন আমেরিকা, বিশেষ করে এল সালভাদর, চিলি, পানামা, নিকারাগুয়া, হন্ডুরাস, গ্রেনেডা এবং গুয়াতেমালায় আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ করার ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান থাকা উচিত। হাওয়ার্ড যিন(Howard Zinn) এর বইগুলো সেক্ষেত্রে ভালো কাজ দিতে পারে।

 

আমাদের ১৯৯০ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধের ইতিহাস এবং তৎপরবর্তী আমেরিকা-নেতৃত্বাধীন জাতিসংঘ কর্তৃক ইরাকের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার ইতিহাস জানতে হবে। এই অবরোধের মাধ্যমে ইরাকে খাদ্য-পানি-ঔষধপত্র সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। শিশুদেরকে অনাহারে এবং ঔষধসেবা থেকে বিরত রাখা ছিল যুদ্ধের ‘আধুনিক’ একটি কৌশল। ১৯৯৬ সালে, “60 Minutes” নামের একটি অনুষ্ঠানে, ম্যাডেলিন অলব্রাইট (আমেরিকার প্রথম মহিলা সেক্রেটারি অফ স্টেট), আমেরিকার পক্ষ থেকে নিশ্চিত করেন যে তারা মনে করেন, ইরাকে ৫ লক্ষ শিশুর মৃত্যু তাদের যথার্থ প্রাপ্য ছিল।

১৯৯৩ সালে আমেরিকা কর্তৃক সোমালিয়া আক্রমণের ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের অধ্যয়ন করতে হবে। সেখানে তারা প্রায় ২০০০ সোমালিকে তারা হত্যা করেছিল।

আমেরিকা কর্তৃক ইসরাইলকে সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানের ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের খুঁটিনাটি জানতে হবে। ইসরাইলের প্রতিটি বুলেট, মিসাইল, বুলডোজার এবং যুদ্ধবিমানে আমেরিকানদের কালোহাত প্রকাশ পায়। এগুলো দিয়ে ফিলিস্তিনে প্রতিনিয়ত আমাদের ভাই-বোনদের হত্যা করা হয়। (পড়ুন নরম্যান ফিনকেলস্টাইনের (Norman Finkelstein) বইগুলো)

আমাদের জানতে চাওয়া উচিত, কীভাবে তারা আমাদেরকে সন্ত্রাসী ডাকার আস্পর্ধা দেখায়? অথচ তারাই বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে আমাদের দু-দুটো দেশে আগ্রাসন চালিয়ে জবরদখল করেছে এবং প্রতিনিয়ত বোমাবর্ষণ করছে।

মনোবিজ্ঞান শাস্ত্রে ‘সাইকোলজিক্যাল প্রজেকশান(Psychological projection)’ বলে একটি ধারণা আছে। এই ধারণামতে, কোনো অপকর্মের দায়ে দোষী ব্যক্তি নিজের বিবেকের দংশন থেকে মুক্তি পেতে নিজের উপর থেকে সকলের মনযোগ সরিয়ে নিতে চায় এবং অন্য কারো কাঁধে নিজের দোষ চাপিয়ে বাঁচতে চায়। আজকের দিনে আমাদের শত্রুদের সম্ভবত এই রোগেই ধরেছে। যা কিছুই হোক, আল্লাহ আমাদেরকে এই আয়াতে শিখিয়ে দিয়েছেন কিভাবে আমরা তাদের অপপ্রচারে জবাব দেব (এবং কিভাবে দেব না)।

তারিক মেহান্না
প্লাইমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি
আইসোলেশন ইউনিট – সেল #১০৮
জুন ১৮, সকাল ৯টা ২২ মিনিট।