কুরআন এবং আপনি – তারিক মেহান্না (পর্ব ১২)

সূরা আলে ‘ইমরানের আয়াত ১১৯ এ আল্লাহ বলেছেন,

 “দেখ! তোমরাই তাদের ভালোবাসো, কিন্তু তারা তোমাদের প্রতি মোটেও সদভাব পোষণ করে না। আর তোমরা সমস্ত কিতাবেই বিশ্বাস কর। অথচ তারা যখন তোমাদের সাথে এসে মিশে, তারা বলে, আমরা ঈমান এনেছি। আর যখন তারা নিরিবিলি হয়, তখন তোমাদের উপর রোষবশতঃ আঙ্গুল কামড়াতে থাকে…”

অন্যদের সাথে কোনো বোঝাপড়া করার ক্ষেত্রে নিজেদের সহজাত অন্তর্জ্ঞান অর্থাৎ Intuition কে কাজে লাগানোর বিষয়ে এই আয়াতটি আমাদেরকে শিক্ষা দেয়। নেকড়েদের এই সমাজে টিকে থাকতে হলে আমাদেরকে দুই ধরনের প্রান্তিক আচরণ থেকে বেঁচে থাকতে হবে। একদিকে যেমন অন্যদেরকে সাক্ষ্যপ্রমাণের স্বল্পতার কারণে সন্দেহ সত্ত্বেও ছাড় দিতে হবে ঠিক তেমনি এর বিপরীতে আবার সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও মুখের কথায় মুগ্ধ হয়ে সবকিছুকেই সরলমনে বিশ্বাস করে প্রতারিত হওয়া যাবে না। এ দুটোর মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে হবে। কেউ যেন আমাদের সরলতাকে কাজে লাগিয়ে হীন স্বার্থোদ্ধার করার সুযোগ না পায়।

সহানুভূতিশীলতা এবং সতর্কতা-এ দুয়ের মাঝে হতে হবে আমাদের অবস্থান। সবকিছুকে অতি সরল মনে গ্রহণ করা বা মানুষকে খুব সহজে বিশ্বাস করে ফেলা যেমন এক ধরনের চরমপন্থা, তেমনি সারাক্ষণ চরম নৈরাশ্যবাদে নিমজ্জিত থাকা, সবকিছুর মাঝে মন্দের আভাস খুঁজে পাওয়া আরেক ধরনের চরমপন্থা। উল্লেখিত দ্বিতীয় ধরনের চরমপন্থা একজন মানুষকে অন্যের প্রতি সদয় হতে নিরুৎসাহিত করে তোলে। তাই মুসলিমরা এ দুয়ের মাঝে এমন এক মধ্যপন্থা অবলম্বন করে যা বাস্তবধর্মী।

রাসূল (صلى الله عليه و سلم) এর সীরাহর দিকে একটু দৃষ্টিপাত করলেই আমরা দেখতে পাব যে, একজন নেতা হিসেবে রাসূলুল্লাহর(صلى الله عليه و سلم) সফল হবার কারণ হল তিনি মানুষের মনে কী চলছে তা ধারণা করতে পারতেন। তাঁর মানুষের সাথে বোঝাপড়া করার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। এতে ছিল সহানুভূতি এবং বাস্তবধর্মী অন্তর্জ্ঞানের চমৎকার এক সমন্বয়। তিনি জানতেন কার সাথে চুক্তি করতে হবে এবং কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। তিনি জানতেন কাদের হাতে অঢেল সম্পদ ঢেলে দিতে হবে আর কাদেরকে কিছু কম দিলেও চলবে। তিনি যে কারো মুখের কথাকেই বিশ্বাস করে নিতেন না। কারণ তিনি মানবচরিত্রের দুর্বলতাগুলো জানতেনকারো কথায় মোহগ্রস্ত না হয়ে তিনি এই ব্যাপারগুলো খুব বাস্তবসম্মত পন্থায় সামলাতে পারতেন। তিনি ছিলেন একজন বাস্তববাদী

যেমন, আবু ‘আযযা আল-জুমাইহ নামে এক মুশরিক ছিল যে বদর যুদ্ধে যুদ্ধবন্দী হিসেবে ধরা পড়ে। সে ছিল হতদরিদ্র আর তাকে তার বড় সংসারের দেখাশোনা করতে হত, তাই রাসূল ﷺ সেবারের মত এই শর্তে তাকে মুক্তি দিলেন যে, সে ভবিষ্যতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার শত্রুতায় জড়াবে না। কিন্তু, ঠিক এক বছর পরেই সে উহুদ যুদ্ধে মুশরিকদের পক্ষে যুদ্ধ করতে এসে মুসলিমদের হাতে আবার বন্দী হয়। উহুদ যুদ্ধে ৭০ জন সাহাবী শহীদ হন। আবু ‘আযযা আবার কাকুতি-মিনতি করে আবদার করল যেন তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। সে বদরের মতো এবারও অঙ্গীকার করল যে ভবিষ্যতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে আর কখনও সে যুদ্ধে অংশ নেবে না। কিন্তু এবার, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছিলেন কঠোর। তিনি বললেন, ‘মু’মিনরা এক গর্তে দু’বার দংশিত হয় না‘। এ কথা বলার পর আয-যুবাইর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) আবু ‘আযযাকে হত্যা করেন। কারণ, যতই অনুনয়-বিনয় সে এবার করুক না কেন, নিশ্চিতভাবেই তার অঙ্গীকার সে আবারো ভঙ্গ করত এবং সে আবার মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাহায্য করত। কিন্তু খেয়াল করুন যে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে বদরের পর একটি সুযোগ দিয়েছিলেন এবং তার মধ্যে সদিচ্ছার উপস্থিতি বোধ করে তাকে ছেড়ে দিয়েছিলেন।

কাজেই, এই আয়াতটি আমাদের নিজেদের মধ্যে অন্তর্দৃষ্টি গড়ে তোলার ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়। অনেকেরই মুখের কথা আর অন্তরের কথা এক নয়। তাদের সাথে বোঝাপড়ায় এই জ্ঞান কাজে দেয়। এ আয়াত থেকে আমরা শিক্ষা পাই যে, এমন কারো মুখের কথা প্রশ্নাতীতভাবে গ্রহণ করা উচিত নয় যা পরবর্তীতে আফসোসের কারণ হতে পারে। এই প্রসঙ্গে অধুনা বিশ্বের যে ঘটনাটি খুব করে আমাকে নাড়া দেয় তা হল ওবামার সস্তা স্লোগান ‘change we can believe in’। এই ডাকে সাড়া দিয়ে আমেরিকান মুসলিমদের তার সমর্থনে মেতে ওঠা বরাবরের মতোই আমেরিকান মুসলিমদের সবকিছু অতি সহজে হজম করার অভ্যাসের পরিচায়ক। এটা ছাড়াও কায়রোতে দেওয়া তার ভাষণ, তাতে কুরআনের আয়াত উদ্ধৃত করা এবং আরো অনেক কিছুই আমেরিকান মুসলিমদের মন অতিসহজে জয় করে ফেলেছে। এই ধরণের কূটচাল সম্পর্কে অবশ্য আল্লাহ আমাদেরকে অনেক আগেই সতর্ক করে দিয়েছিলেন, ‘…তারা যখন তোমাদের সাথে এসে মিশে, তারা বলে, আমরা ঈমান এনেছি…’

পরবর্তীতে এল মুসলিমদের হা করে শুধু দেখবার পালা। যে ওবামা মুসলিম বিশ্বের সাথে যুদ্ধে না জড়াবার অঙ্গীকার করেছিল, সেই ওবামাই মুসলিমদের সাথে যেন বুশ থেকেও আরো মারাত্মক ও তীব্রতর যুদ্ধে নামল। উদাহারণস্বরুপ, রাষ্ট্রপতির আসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার পরের ১৭ মাসে তার ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে মুসলিম ভূমিতে প্রায় ১০০টি ড্রোন হামলা করা হয়েছে। এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে এসব ড্রোন হামলায় হাজারেরও বেশি নিরীহ মুসলিম নিহত হয়েছে। বুশ তার সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে জুড়ে যত ড্রোন হামলার অনুমোদন দিয়েছে, ওবামা ১৭ মাসেই মুসলিম বিশ্বে তার দ্বিগুণ ড্রোন হামলা চালিয়েছে! অনেকের কাছে এটি অবাক করা বিষয় হতে পারে। তবে যারা এই আয়াতের মর্মার্থ বোঝে এবং মুসলিম ও কুফফারদের ইতিহাস সম্পর্কে জানে তারা এটা আগেই অনুমান করতে পেরেছিল।

সুবহানআল্লাহ! কি চমৎকার ভাবেই না ১৪০০ বছর আগে নাযিলকৃত একটি আয়াত আমাদের বর্তমান পরিস্থিতিকে চিত্রিত করেছে!

 

তারিক মেহান্না
প্লাইমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি
আইসোলেশন ইউনিট – সেল #১০৮