কুরআন এবং আপনি – তারিক মেহান্না (পর্ব ১৪)

আল্লাহ তা’আলা সূরা আলে-ইমরানের ১২১ নম্বর আয়াতে বলেছেনঃ

“আর স্মরণ করুন আপনি যখন ভোরবেলায় আপনার আপনজনদের কাছ থেকে বেরিয়ে গিয়ে মুমিনগণকে যুদ্ধের ঘাঁটিসমূহে মোতায়েন করলেন…”

 

উহুদের যুদ্ধ নিয়ে অবতীর্ণ হওয়া প্রায় ৬০টি আয়াতের মধ্যে এ আয়াতটি-ই প্রথম। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উহুদ পর্বতে মুজাহিদীনদের সংগঠিত করার জন্য ভোরবেলাকে বেছে নিয়েছিলেন। এ আয়াতে সেই কথাই বলা হচ্ছে। এখানে লক্ষণীয় বিষয়টি হলো সময়ের উল্লেখ। আল্লাহ তা’আলা সুনির্দিষ্ট ভাবে “ভোরবেলা” কথাটি বলে দিয়েছেন।

ভোরবেলা বা দিনের প্রথম ভাগ হলো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সেরে ফেলার জন্য সর্বোৎকৃষ্ট সময়। সাখর বিন ওয়াদা’আ আল-গামিদী বর্ণনা করেছেন যে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: ‘হে আল্লাহ! আমার উম্মাহর ভোরের-পাখিদের তুমি বরকত দাও!’ আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোনো সেনাবাহিনী পাঠালে বা অভিযান পরিচালনা করলে তা সর্বদা করতেন একেবারে দিনের প্রারম্ভে। সাখর বিন ওয়াদা’আ নিজেও একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি সবসময় সকালবেলায় তার কাফেলা পাঠাতেন। যার ফলে তার ছিল অঢেল বিত্তবৈভব।

সত্যিকার অর্থেই কুর’আনের মধ্যে একটু ঘেঁটে দেখলে দেখা যাবে যে বহু তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা দিনের প্রারম্ভে সংঘটিত হয়েছে। এই ভোরবেলাতেই আল্লাহ তা’আলা লুতের সম্প্রদায়কে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। সূরা হুদের ৮১ নম্বর আয়াতে এই ঘটনার কথাই বর্ণিত হয়েছে:

“নিঃসন্দেহ তাদের নির্ধারিত সময় হচ্ছে ভোরবেলা। ভোরবেলা কি আসন্ন নয়?”

আর সূরা আল-হিজরের ৬৬ তম আয়াত:

“আমি লূতকে এই বিষয়ে জানিয়ে দিলাম যে, সকাল হলেই তাদেরকে সমূলে বিনাশ করে দেয়া হবে।”

এবং সূরা আল-ক্বমারের আয়াত ৩৮: “আর নিশ্চিতভাবে প্রত্যুষে তাদেরকে নির্ধারিত শাস্তি আঘাত হেনেছিল।”

এভাবে বার বার “ভোর” কথাটি কুরআনে এসেছে। সূরা আশ-শু’আরার ৬০-৬৬ আয়াতেও আমরা দেখি যে, ফির’আউন ও তার সৈন্যদলের ধাওয়া করার পর, এই সূর্যোদয়ের সময়েই মূসা (আলাইহিস সালাম) সমুদ্র বিদীর্ণ করেছিলেন।

এই ভোরবেলার ফজরের ফরয সালাতের পূর্বে আদায় করা দু’ রাকআত সুন্নাহ সালাতের কথা বলতে যেয়েই আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: এটা আমার কাছে দুনিয়া ও তাতে যা কিছু আছে তার চাইতেও বেশি প্রিয়”। সত্যিই! তাঁর কাছে তা এতোটাই প্রিয় ছিল যে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোনোদিনও এ দু’রাকআত সালাহ বাদ দেননি। আর এই ফজর সালাত-ই যখন জামাতের সাথে আদায় করা হয়, তার বর্ণনা নিয়ে নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: “এ সালাত বান্দাকে আল্লাহর নিরাপত্তার ছায়াতলে নিয়ে আসে”

আপনি নিজের দিকেই লক্ষ করুন। দেখবেন, যে দিনগুলোতে আপনি ফজরের পর থেকেই কাজকর্ম শুরু করে দেন, সে দিনগুলি অন্যান্য দিনের চাইতে অনেক বেশি কার্যকর। আর যে দিনগুলিতে ফজরের পর আবার কয়েক ঘণ্টা ঘুমান, সে দিনগুলো কখনোই এত কর্মমুখর হয় না। সকালে উঠে একটু হাঁটতে বের হওয়া বা তাড়াতাড়ি অফিসে পৌঁছানোর জন্য সকাল সকাল উঠে পড়ার কোনো বিকল্প নেই। অথবা ক্লাসের পড়াটা তৈরি করে ফেলা এবং কুর’আন মুখস্থ করার জন্য কিংবা সফরে বের হওয়ার জন্য ভোরবেলার কোনো জুড়ি নেই। এমনকি দিনের প্রথম খাবার দেরি করে খাওয়ার বিপরীতে সকাল সকাল নাস্তা করার মতো ছোট্ট বিষয়টাও আপনার পুরো দিনটিকে সতেজ করে তোলে। ভোর থেকে শুরু হওয়া আপনার কর্মব্যস্ত দিনগুলোর সাথে সেই দিনগুলোর তুলনা করে দেখুন যখন পুরো সকালটা আপনি কিছু না করেই কাটিয়ে দেন। সেই অলস দিনগুলোতে হয়তো ঘুম থেকে উঠে কেবলমাত্র সকালের নাস্তা সারতে সারতেই বেলা বারোটা বেজে যায়। এই দুই ধরনের দিনে আপনার অর্জন কি কখনো সমান হয়? তফাৎটা তো দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার! আর এ কারণেই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং তাঁর সাহাবাদের সুন্নাহ ছিল সকাল সকাল কাজ শুরু করে দেয়া। এমনকি কঠোর শারীরিক শ্রমজড়িত আমল, জিহাদের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটে নি।

সুতরাং ফজর সালাতের পর অলসতা ঝেড়ে ফেলুন। জড়তা কাটিয়ে জেগে ওঠার চেষ্টা করুন। আর এসময়টিকে কাজে লাগান। আপনার দৈনন্দিন কাজগুলো আগে আগে সেরে নিন। সেই দলের সাথে যোগ দিন যাদেরকে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আখ্যায়িত করেছেন “ভোরের-পাখি” হিসেবে। তাদের জন্য তিনি আল্লাহর কাছে বরকতের দু’আ চেয়েছেন! আর জেনে রাখুন সকালে করা সবচেয়ে উত্তম, সতেজ ও উপকারী কাজটি হলো আল্লাহর স্মরণে নিমগ্ন হওয়া। নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর নিজের সম্পর্কে বলেছিলেন: “ইসমাঈল (আলাইহিস সালাম) এর উত্তরসূরীদের মধ্য হতে চারজন দাস মুক্ত করার চাইতে ভোর থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত আল্লাহর স্মরণে রত কোনো দলের সাথে বসে থাকা আমার নিকট অধিক প্রিয়”।

শেষ একটি ছোট্ট কথা বাকি রয়ে গেছে। আমাদের মাঝে অনেকেই আছেন যারা দিনের প্রথম ভাগের নি’আমত সম্পর্কে ভালো ভাবেই অবগত। তারা সকাল থেকে শুরু করে সমগ্র দিন কাজে লাগাতে চান, কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রতিদিন সকালে শরীরে যে আলস্য আর জড়তা জেঁকে বসে, তা কোনোভাবেই কাটিয়ে উঠতে পারেন না। আমার মতো আরো অনেকেই মোটেও “ভোরের-পাখি” নন। তাহলে কীভাবে আমরা নিজেকে বদলাবো? কীভাবে আমাদের প্রতিটি দিনকে সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে পারব?

প্রথমত, আমাদের নিজেদেরকে শৃঙ্খলার মাঝে নিয়ে আসতে হবে। ইশার সালাতের পর কাজকর্ম সীমিত করে ফেলতে হবে। ইশার পর বেশি দেরি না করে শুয়ে পড়তে হবে। সহীহ হাদীস থেকে বর্ণিত হয়েছে যে – ইশার সালাতের পরে অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলা এবং ইশার পূর্বে ঘুমানো – এ দু’টি কাজের ব্যাপারে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অত্যন্ত জোরালোভাবে আমাদেরকে নিরুৎসাহিত করেছেন। কেননা এই দু’টো অভ্যাস ত্যাগ করলে আমরা দ্রুত ঘুমাতে পারবো। আর গাঢ় একটি ঘুমের পরে ঝরঝরে দেহ ও মন নিয়ে পরদিন সকালে জেগে উঠবো।

দ্বিতীয়ত, ভোরের কিছু আগে উঠে ইবাদতে নিয়োজিত হওয়ার বিষয়টি আমাদের মন ও মেজাজের উপর সরাসরি ছাপ ফেলে। বুখারী ও মুসলিম উভয়েই বর্ণনা করেছেন যে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:

“যখন তোমাদের কেউ ঘুমিয়ে পড়ে, শয়তান তোমাদের (মাথার) পশ্চাদাংশে তিনটি গিঁট দেয়। প্রতি গিঁটে সে এ বলে চাপড়ায়, “তোমার সামনে রয়েছে দীর্ঘ রাত, অতএব শুয়ে থাকো। অতঃপর সে যদি জাগ্রত হয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে তাহ’লে একটি গিঁট খুলে যায়। অত:পর যদি সে ওজু করে আরেকটি গিঁট খুলে যায়, তারপর যদি সে নামাজ পরে আরেকটি গিঁট খুলে যাবে। তখন তার প্রভাত হয় উৎফুল্ল মনে ও অনাবিল চিত্তে। অন্যথা সে সকালে উঠে কলুষ কালিমা ও আলস্য সহকারে”। (বুখারী : ১১৪২, মুসলিম : ৭৭৬)

 

এসব কিছু চিন্তা করার পর যখন উপরের আয়াতটির দিকে আবার তাকাই তখন বুঝি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা’আলা কেন বিশেষ ভাবে সময়ের কথা উল্লেখ করেছেন। এই একটি আয়াত-ই আমাদের দিনগুলোকে আরো বেশি কর্মতৎপর করে তুলতে পারে, ইনশা আল্লাহ..।

 

তারিক মেহান্না
প্লাইমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি
আইসোলেশন ইউনিট – সেল # ১০৮