কুরআন এবং আপনি – তারিক মেহান্না (পর্ব ১৭)

সূরা আলে ইমরানে, ১৪৪ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ বলছেন,

আর মুহাম্মদ একজন রসূল বৈ কিছু নন! তাঁর পূর্বেও বহু রসূল অতিবাহিত হয়ে গেছেন। অতএব তিনি যদি মারা যান অথবা নিহত হন, তবে কি তোমরা পশ্চাদপসরণ করবে? …

কুরআনে হাতেগোণা অল্প কিছু আয়াত আছে, যে আয়াতের শব্দগুলো কোনো সাহাবার মুখে প্রথমে উচ্চারিত হয়েছিল এবং পরে আল্লাহ কুরআনে ওহী হিসেবে সেগুলোকে নাযিল করেন। এই আয়াতটি তেমনই একটি আয়াত।

 

উহুদের ময়দান। মুশরিকরা চারিদিক থেকে মুস’আব বিন ‘উমাইরকে ঘিরে ফেলেছে। তিনি সামনে তাকিয়ে দেখলেন রাসূলুল্ললাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজেও বিপদের সম্মুখীন। মুশরিকরা রাসূলুল্লাহকেও (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘিরে ফেলেছে। তখন মুস’আব (রাদিয়াল্লাহু আনহু) নিজেই নিজেকে বলে উঠেন,

 

আর মুহাম্মদ একজন রসূল বৈ কিছু নন! তাঁর পূর্বেও বহু রসূল অতিবাহিত হয়ে গেছেন

 

এর পরপরই মুস’আবকে মুশরিকরা হত্যা করে। কিন্তু গুজব ছড়িয়ে পড়ে মুস’আব নয়, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে মুশরিকরা হত্যা করেছে। এই বানোয়াট তথ্যটি যখন সাহাবাদের কাছে পৌঁছল তখন তারা তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। তাদের মধ্যে একটি দল এতটাই বিষাদগ্রস্ত এবং মনোবলহীন হয়ে পড়ল যে তারা পুরোপুরি হাল ছেড়ে দেন। কেউ কেউ পালিয়ে মুনাফিক্বদের সাথে যোগ দিল। আর কেউ ছিল তাদের অবস্থানে অনড়। তারা বলল, ‘যদি আল্লাহর নবী মারা গিয়ে থাকেন, তবে যে উদ্দেশ্যে তিনি যুদ্ধ করে গেছেন, সে উদ্দেশ্য সাধনে আমরাও লড়াই করে যাব’। মৃত্যু সংবাদের গুজব শোনার আগে এবং পরে তারা একইরকম অবিচল ছিলেন। মুশরিকদের দ্বারা অবরুদ্ধ অবস্থায় মুস’আবের মুখ নিঃসৃত এ কথাগুলোকেই সম্পূর্ণ করে আল্লাহ কুরআনের আয়াত হিসাবে নাযিল করেন। এর মাধ্যমে তিনি মুস’আবের এ কথাটির প্রতি সমর্থন জানান। ইসলামের সঠিক দা’ওয়াহর অনুসারীদের জন্য এই আয়াতটি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।

 

কোনো কিছু বিশ্বাস করা বা অনুসরণ করার পেছনে একজন মানুষ বিভিন্ন কারণে উদ্বুদ্ধ হতে পারে। যেমন:

 

–       কিছু মানুষ সংখ্যাগরিষ্ঠের দলে থাকতে পছন্দ করে। তারা স্রোতে গা ভাসিয়ে চলে এবং আর দশজনের মত করে চলতে         চায়। তারা এমন একটা মানহাজ বা পদ্ধতির অনুসরণ করে যা তার বন্ধু এবং পরিচিতজনেরা মেনে চলছে।

–       কেউ কেউ নিজেদের আক্বীদা-বিশ্বাস এবং মানহাজ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে থাকে। একটি ব্যর্থ হলে আরেকটি যাচাই         করে। যেন তারা ‘ এ-সপ্তাহের-সেরা-আকর্ষণ ‘ খুঁজতে ব্যস্ত !

–       কেউ কেউ আবার আবেগচালিত। হয়তো একটা অনলবর্ষী বক্তৃতা বা উপস্থাপনা তাদেরকে আবেগাপ্লুত করে একটি বিশ্বাস         বা মানহাযের দিকে ধাবিত করে। অনেকক্ষেত্রেই আবেগের সেই জোয়ারে ভাঁটা পড়লে তারা পুরনো পথে ফিরে যান।

–       অনেকে একটি নির্দিষ্ট মানহাজ বা পদ্ধতি অনুসরণ করে কোনো বিশেষ ব্যক্তিত্বের প্রতি তাদের ভালো-লাগা থেকে।

 

এই কারণগুলোই ব্যাখ্যা করে কেন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর মৃত্যুর নিছক গুজব শুনেই একদল সাহাবী আশাহত হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। এই আয়াতটি আমাদের এই মানবীয় দুর্বলতাগুলোর প্রতি ইঙ্গিত করে এবং আমাদেরকে শিক্ষা দেয় যে, যদি আমরা ইসলামের যে মূল নির্যাস বা আদর্শ রয়েছে তার প্রতি অনুরক্ত বা আকৃষ্ট না হয়ে উপরোক্ত কোনো একটি কারণে ইসলামের অনুসারী হই, তবে তুচ্ছাতিতুচ্ছ চাপের মুখেই আমরা ভেঙে পড়ব এবং পশ্চাদপসরণ করে বসব। আমরা আল্লাহর রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একজন নবী হিসেবে অবশ্যই ভালবাসি কেননা তিনি আমাদেরকে আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহীর মাধ্যমে ইসলামের বাণী ও পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছেন। তা সত্ত্বেও আমাদের মূল আনুগত্য এবং ভালোবাসা হতে হবে ইসলামের মূল বিষয়বস্তুর প্রতি।

ইসলামের প্রতি আমাদের ভালবাসা ব্যক্তিকেন্দ্রিক হওয়া চলবে না। আর সে কারণেই, উহুদের দিনে বেশ কিছু সাহাবী ছিলেন যারা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর মৃত্যুর গুজব শুনে পিছপা হননি বরং বলে উঠেছিলেন, ‘যদি তিনি মারা যান, তবে তিনি যে উদ্দেশ্যে লড়েছেন, আমরাও সে উদ্দেশ্যে লড়ে যাব।’ অর্থাৎ সহজ ভাষায় তাদের মনোভাব ছিল, ‘তিনি মারা গেছেন তো কি হয়েছে? তিনি আমাদেরকে যা শিখিয়েছেন আমরা সেটা অনুসরণ করছি। ব্যক্তি হিসেবে তাঁকে আমরা অনুসরণ করিনি, বরং অনুসরণ করছি একজন নবী হিসেবে। তিনি একজন নবী, এর বেশি কিছু তিনি নন।’ আর এ কারণেই, সাত বছর পরে যখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সত্যিই মারা যান, সেদিন আবু বকর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) উঠে দাঁড়িয়ে সকলকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা মুহাম্মদের ইবাদাত করত, (জেনে রাখ) মুহাম্মদ মারা গেছে। আর তোমরা যারা আল্লাহর ইবাদাত কর, (জেনে রাখ), আল্লাহ চিরঞ্জীব এবং তাঁর কোনো মৃত্যু নেই।’ এরপর তিনি এই আয়াতটি আবৃত্তি করেন। তিনি এ কথাগুলো বলেছিলেন এই বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিতে যে, আমরা ইসলামের সত্য আদর্শের কারণে মুসলিম। কোনো বিশেষ ব্যক্তিত্বের প্রতি অনুরাগ বা মোহ থেকে নয়।

 

পশ্চিমা সমাজে ব্যক্তিপূজা অত্যন্ত প্রবল। হোক তা গায়ক, নায়ক বা অন্য কোনো ধরনের খ্যাতিমান লোক। ভালো করে লক্ষ করলে দেখা যাবে, এই অভ্যাসটি ইসলামী দা’ওয়াহ প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝেও ছড়িয়ে পড়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে ‘সুপারস্টার শাইখ বা স্কলার’ এর একটি সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে। এটি জাহেলী সমাজের ‘তারকাব্যক্তি পূজা ‘র (Celebrity Culture) বিকল্পরূপে আবির্ভূত হয়ে ব্যক্তিপূজার ধারাটিকে ইসলামী ছদ্মবেশে বজায় রেখেছে। এই ধারাটির বিপদ দ্বিমাত্রিক,

#এক, এ ধরণের শাইখ বা ‘আলিমের উচ্চারিত যেকোনো কথাকে চূড়ান্ত এবং বিতর্কের উর্ধ্বে হিসেবে ধরা হয় যাকে কোনোভাবেই চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। যদিও ইসলামের সত্য উদঘাটন ও প্রচারের অধিকার কোনো বিশেষ দলভুক্ত আলিম বা কোর্স ইন্সট্রাক্টরদের একচেটিয়া সম্পত্তি নয়!

এবং #দুই, কোনো শাইখ বা নেতার প্রতি তাদের অনুসারীদের গভীর ভক্তি এবং অযাচিত আসক্তি থাকলে আরো যে সমস্যাটি হতে পারে তা হল, যদি সেই নেতা বা শাইখ তার অবস্থান থেকে সরে আসে, কিংবা গ্রেপ্তার হয় কিংবা তার মৃত্যু ঘটে, তখন তাদের অনুসারীরা পথের দিশা হারিয়ে ফেলে এবং পিছু হটতে আরম্ভ করে। কিছু সাহাবীদের ক্ষেত্রে ঠিক এমনটাই হয়েছিল। তারা কেউ কেউ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর মৃত্যুর খবর শুনে উহুদের ময়দান থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন।

 

এই সমস্যার সমাধান হল একটি মুক্ত, সমালোচক, বিশ্লেষণধর্মী এবং অনুসন্ধিৎসু মনের অধিকারী হওয়া। এর ফলে আপনার আর সত্যের মাঝে কোনো বাধা থাকবে না। এবার সে সত্য যেখান থেকেই আসুক না কেন। এ ধরনের ইতিবাচক মানসিকতা আপনাকে সত্য গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করবে কেবল তা সত্য হওয়ার গুণেই। কে সেই সত্য বলছে তা আপনার কাছে আর মুখ্য হয়ে দাঁড়াবে না। যেমন করে আল-ইমাম আহমাদ(রহিমাহুল্লাহ) বলেছিলেন, ‘একজন মানুষের জ্ঞানের ঘাটতি থাকে তখনই, যখন সে অন্য কাউকে অন্ধ ভাবে বিশ্বাস করে।’ এবং সম্ভবত এ কারণেই, ইমাম আহমদ তাঁর ক্লাসগুলোকে ‘মুসনাদ থেকে হাদীস শিক্ষা দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতেন এবং তাঁর নিজস্ব মতগুলোকে লিখে রাখার ব্যাপারে খুব জোরালোভাবে নিরুৎসাহিত করতেন। তিনি চাইতেন তার ছাত্ররা যেন তাঁর ব্যক্তিত্ব এবং মতামতের অনুসারী না হয়ে শুধুমাত্র কুরআন এবং সুন্নাহর অনুসারী হয়।

 

এটা খুবই দুঃখজনক যে, অনেক মুসলিম প্রাথমিক পর্যায়ে বেশ উৎসাহী এবং উদ্যমী হওয়া সত্ত্বেও এই আয়াতের মূলভাব হৃদয়ঙ্গম করতে ব্যর্থ হওয়ায় পরবর্তীতে নানান মানহাজের মাঝে ছুটাছুটি করতে থাকে। আজকে তারা সালাফি, কালকে সুফী বা আশ’আরি, আরেকটা দিন হয়তো আসবে যেদিন তারা পুরো দ্বীনকেই পরিত্যাগ করে ফেলবে। এই সবকিছুর পেছনে ফিরে তাকালে যে সমস্যাটি আমরা আবিষ্কার করব তা আমি উপরে পয়েন্ট আকারে উল্লেখ করেছি। মূলত, ইসলামের পথে তাদের প্রবেশের মুহূর্তটি ছিল অত্যন্ত ভাসাভাসা এবং ক্ষণিকের প্রণোদনায় উদ্বুদ্ধ। তাই প্রবল দ্রুততার সাথে তারা বারবার নিজেদের রঙ বদলায়। এর পেছনে মূল কারণ হল, তারা নানান কারণে একসময় সত্যের অনুসারী হলেও সঠিক কারণটি অনুধাবন করে অনুসারী হয়নি। আর সত্যকে অনুসরণ করার সঠিক কারণটি হচ্ছে সত্যের বাণীকে গভীরভাবে উপলব্ধি করার মাধ্যমে তা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা।

 

কাজেই, কোনো ব্যক্তিবিশেষের প্রতি অতিভক্তি এবং অপরিমিত শ্রদ্ধাবোধ থেকে সতর্ক হোন। মানুষ বদলায়, মৃত্যুবরণ করে। তাই, ইসলামী দা’ওয়াহর মূল বার্তাকে অধ্যয়ন করুন এবং ভালবাসুন। ইসলামের মূল বার্তা দ্বারা আন্তরিকভাবে উদ্বুদ্ধ হোন এবং অন্যকে উদ্বুদ্ধ করুন। কোনো ব্যক্তি বা সংগঠন নয় বরং এই দা’ওয়াহর মূল উৎসের প্রতি আন্তরিক হোন। কেননা, মানুষের মৃত্যু ঘটে। কিন্তু এই আদর্শ মৃত্যুঞ্জয়ী। এই আদর্শ অপরিবর্তনীয়।

 

তারিক মেহান্না
প্লাইমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি
আইসোলেশন ইউনিট – সেল #১০৮