কুরআন এবং আপনি – তারিক মেহান্না (পর্ব ২০)

সূরা আলে ইমরানের ১৮০ নং আয়াতে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন –

“আল্লাহ তাদেরকে নিজের অনুগ্রহে যা দান করেছেন তাতে যারা কৃপণতা করে এই কার্পণ্য তাদের জন্য মঙ্গলকর হবে বলে তারা যেন ধারণা না করে…”

কিছু কিছু দিক দিয়ে আমরা সবাই একইরকম। আমাদের সবাইকে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তার রহমত ও নি’আমত দান করেছেন, বেশি হোক আর কম হোক। আমাদের যতটুকু আছে তার চাইতে আরো বেশী পেতে আমরা সবাই ভালোবাসি। মুখে আমরা যাই বলি না কেন – যখন আমাদের নিজের কোনো জিনিস ত্যাগ করতে হয়, তখন আমরা সবাই সামান্য হলেও দ্বিধা বোধ করি। আমরা সবাই খুব ভালোমতো বুঝি আল্লাহর জন্য কোনো ত্যাগ স্বীকার করার গুরুত্ব কী ও এর মূল্য কত বড়। সেটা হতে পারে দরিদ্রকে অর্থ-সম্পদের মাধ্যমে সাহায্য করা, কিংবা হতে পারে আল্লাহর পথে অন্য কোনো ত্যাগ স্বীকার করা। আমরা কৃপণতা করি বা না করি আমাদের এই উপলব্ধিগুলো কিন্তু সার্বজনীন।

 

এই কৃপণতাকে পাশ কাটিয়ে মনের দ্বিধা-দ্বন্দ্বগুলো ঝেড়ে ফেলে আরও উদার হওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় কি?

সবচাইতে সহজ উপায় হল, দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ধাপে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার যেই নি’আমতগুলো আপনি ভোগ করছেন সেগুলো এক এক করে গুণতে শুরু করুন। সেটা হতে পারে মনে মনে, মুখে মুখে, বা কাগজে লিখে; সকাল থেকে রাত পর্যন্ত, প্রতিটি মুহূর্তে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার যেই নিয়ামতগুলো আপনি ভোগ করছেন তার একটা লিস্ট বানানো শুরু করে দিন। সবচেয়ে ছোট এবং আপাত দৃষ্টিতে অকিঞ্চিৎকর নি’আমতটাও লিস্টে টুকে রাখুন…

আপনার জীবন, আপনার প্রতিটি নিঃশ্বাস, আপনার দৃষ্টিশক্তি এবং আপনার শরীর সম্পর্কিত সব কিছু, বাড়ি-গাড়ি, পোষাক-আশাক, খাবার এবং স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি, আপনার পরিবার, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, কাজকর্ম, মসজিদ এবং আপনার সমাজ ও সামাজিকতা সবকিছুই তালিকাবদ্ধ করুন। আপনার স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াবার ক্ষমতা, জীবনের আনন্দের মুহূর্তগুলো,আপনার প্রতি আপনার স্বামী বা স্ত্রীর ভালোবাসা, ইসলাম, বিশুদ্ধ বাতাস, ঠাণ্ডা পানি, নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তার অনুভূতি – যেই দয়া, উদারতা ও ভালোবাসা আপনি অন্য মানুষের কাছ থেকে পেয়ে থাকেন সেসব কিছুকেও হিসাবে আনুন। আপনি খেয়াল করে দেখেবেন, প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে এরকম অসংখ্য নি’আমত আপনি ভোগ করছেন, যেগুলো লিখে শেষ করা যাবে না।

কিছুদিন আগে আমি ম্যাগাজিনে একটা প্রবন্ধ পড়ছিলাম, যেটাতে ইন্ডিয়া ও আফ্রিকার কিছু জায়গায় পানি স্বল্পতার জন্য কি কঠিন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এসব জায়গাতে প্রতিদিন সকালে, প্রত্যেক পরিবারের মায়েরা হেঁটে ছয় ঘণ্টার পথ পাড়ি দেওয়ার পর এক কলসী পানি যোগাড় করেন। তারপর তারা সেটা বয়ে আনেন।তারপর সেই এক কলসী পানি দিয়ে পুরো পরিবারের খাওয়া, গোসল ও রান্নার কাজ সারতে হয়, কেননা পানির আর কোনো উৎস তাদের হাতের নাগালে নেই!

অথচ এই কারাগারের সেলেও শুধু উঠে দাঁড়িয়ে দু’পা হেটে গিয়ে বেসিনের একটা বোতাম চাপলেই আমি সেকেন্ডের ব্যবধানে ইচ্ছামতো বিশুদ্ধ, ঠাণ্ডা পানি পেতে পারি। প্রথম দৃষ্টিতে আপনাদের কাছে হয়তো এটাকে একটা অভিশাপ মনে হবে, কারণ আমি কারাগারে। কিন্তু ইন্ডিয়া আর আফ্রিকার সেই মায়েদের সাথে তুলনা করুন একবার! তারা তো এত সহজে বিশুদ্ধ পানি পাবার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না। তখনই বোঝা যায়, কারাগারে সেলে বসেও আমি প্রতিদিন যেসব নি’আমত ভোগ করছি তার মধ্যে এই পানি একটি। চিন্তা করে দেখুন,জেলে বসে আমি যদি এরকম নিয়ামত ভোগ করি, তাহলে বাইরের স্বাধীন, মুক্ত জীবনে আপনার নি’আমতের লিস্টটা কতো লম্বা হবে!

কাজেই এই নি’আমতগুলোর তালিকা তৈরি করে ফেলুন। লিস্ট যতো বড় হবে আপনি ততো গভীরভাবে উপলব্ধি করবেন, আপনার চোখের সামনে থেকেও কত কী আপনার নজর এড়িয়ে গেছে। আপনার নাকের ডগায় থাকা সত্ত্বেও এতদিন এই অসাধারণ আশীর্বাদগুলো নিয়ে আপনি সামান্যতম চিন্তাও করেননি। তারপর আপনি উপলব্ধি করবেন, আপনি এই সবের কিছুই পাবার যোগ্য নন। এসব কিছুই আপনার প্রতি আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার রহমত। তিনি তাঁর অসীম করুণার বশে আপনাকে এগুলো দান করেছেন। এর কোনোটার উপরই আপনার কোনো অধিকার নেই। আপনি যখন আপনার লিস্টের উপর বারবার চোখ বোলাবেন এবং দেখতে পাবেন, কিভাবে আপনার শত অযোগ্যতা সত্ত্বেও আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তাঁর অসীম ভালোবাসা, উদারতা ও করুণায় আপনাকে একটার পর একটা নি’আমত দান করেছেন – তখন আপনি আপনার হৃদয় ও মনে পরিবর্তন দেখতে পাবেন।

মানুষের স্বভাব হল, তার সাথে যেমন ব্যবহার করা হয়, অন্যের সাথে সে তেমনই ব্যবহার করে। সারাজীবন যদি আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করা হয় তাহলে আপনার স্বাভাবিক প্রবণতা হবে মানুষের সাথে রুক্ষ ব্যবহার করা। কারণ আপনি তেমনটাই শিখে এসেছেন। একইভাবে সারাজীবন যদি আপনি উদারতা, দয়া ও করুণা পেয়ে আসেন, তাহলে আপনি মানুষের সাথে সেভাবেই আচরণ করবেন; কারণ আপনি সেই শিক্ষাই পেয়েছেন। আমাদের সমস্যা হল, আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা প্রতিনিয়ত আমাদের দয়া, করুণা ও উদারতা দেখাচ্ছেন। প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি সেকেন্ডে তিনি আমাদের পরম মমতায় ঢেকে রেখেছেন। কিন্তু বেশীর ভাগ সময়ই আমরা এটা মনে রাখি না, কিংবা মনে রাখলেও এই করুণার পরিধি ও মাত্রা নিয়ে চিন্তা করি না।

তাই আমাদের উদার ও দানশীল হবার পথে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সূক্ষ বাধাটি হল, আমাদের প্রতি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার দয়া ও করুণা সম্পর্কে আমাদের উদাসীনতা। যতো বেশী আপনি আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার নি’আমতগুলোকে আবিষ্কার করবেন, গুণতে থাকবেন এবং আপনি যতো উপলব্ধি করবেন যে এই অসংখ্য নি’আমতের কোনোটারই আপনি যোগ্য নন ততোই আপনি আল্লাহর দেওয়া নিয়ামত থেকে অপরকে সাহায্য করার আকাঙ্ক্ষা অনুভব করবেন। উদারতা ও দানশীলতাকে ভালবাসতে শেখার সবচেয়ে সহজ উপায় এটাই।

তারিক মেহান্না
প্লাইমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি
আইসোলেশন ইউনিট- সেল #১০৮