কুরআন এবং আপনি – তারিক মেহান্না (পর্ব ২১)

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা সূরা আলে ইমরানের ১৮৫ নং আয়াতে বলেন,

…আর এই পার্থিব জীবন তো ছলনাময় ক্ষণিকের ভোগ-সামগ্রী ছাড়া আর কিছুই নয়”।

 

 

আয়াতের এই অংশটি আপনার জীবনে প্রয়োগ করতে চাইলে, দৈনন্দিন যেসব টুকরো সুখের মুহূর্তগুলো আপনি উপভোগ করেন সেগুলো উপভোগ করার আগে এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ান। দগ্ধ দিনের শেষে শীতল পানির স্পর্শ, হিমশীতল পানীয় কিংবা সুস্বাদু খাবার, মোটা অঙ্কের চেক কিংবা চোখ ধাঁধানো গাড়ি অথবা আনকোরা নতুন পোশাক প্রভৃতির সুখস্পর্শ উপভোগ করার আগে একবার থামুন এবং ভাবুন। উপলব্ধি করুন যে আপনার সামনে যেই উপভোগ্য বস্তুটি আছে তা বিভ্রম ছাড়া কিছুই নয়। আপাতদৃষ্টিতে বস্তুটি সৃষ্ট, স্পৃশ্য এবং বাস্তব হলেও এর সাথে আরও সুগভীর এবং গুপ্ত এক বাস্তবতা সংযুক্ত রয়েছে। আর এই গোপন বাস্তবতাটির ব্যাপারে অসচেতন হলে আপনি ধোঁকায় পড়ে থাকবেন। যে ধোঁকার কথা এই আয়াতে বলা হয়েছে এই গোপন বাস্তবতাটি ঠিক তার বিপরীত। আর এই ধোঁকার পাশাপাশি এই বাস্তবতা সম্পর্কেও আমাদের সমান ভাবে সচেতন থাকা উচিত।

পার্থিব এই ধোঁকার একটি বিশেষ দিক হচ্ছে যে এটি আমাদের মধ্যে নিজেদেরকে ক্ষমতাধর ভাবার এক মিথ্যে আত্মতুষ্টি তৈরী করে। বিশেষ করে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের ক্ষেত্রে এই ঘটনাটি বেশি ঘটে। ১৯১২ সালের কথা মনে করুন। সেবছর টাইটানিক নির্মাণ করা হয়েছিল। এর নির্মাতারা দাবি করেছিল যে ‘স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাও এই জাহাজ ডুবাতে পারবেন না।’ ক্ষণিকের আরাম-আয়েশ আর স্বাচ্ছন্দ্যে ডুবে থাকলে, নিরাপত্তা আর অপরাজেয়তার এক মিথ্যা ধারণা খুব সহজে মানুষের অন্তরে জেঁকে বসে। তাই টাইটানিকের নির্মাতারা আপাতদৃষ্টিতে নিখুঁত এই জাহাজ তৈরী করতে পেরে এই একই ফাঁদে পা দিয়ে বসে। অবশেষে আর কেউ নয়, যখন স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাই এক টুকরো বরফ খন্ড দিয়ে টাইটানিক ডুবিয়ে দেন তখন তারা তাদের ধারণার অন্তঃসারশূন্যতা বুঝতে পারে। কি নির্মম পরিহাস! যে পানির উপর টাইটানিকের চলার কথা ছিল সেই পানি দ্বারা গঠিত এক খন্ড বরফই এটাকে ডুবিয়ে দিল!

আমেরিকান ব্যাংকগুলোর দায়িত্বজ্ঞানহীন অপচয় এবং লোভের ফলে আমেরিকায় সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দার দিকে লক্ষ করুন। জাগতিক ধোঁকায় পড়ে থাকা হৃদয়ে ক্ষমতার যে মিছে আত্মতৃপ্তি জন্ম নেয় তার প্রকৃষ্ট ফলাফল হচ্ছে আজকের আমেরিকা। আর পার্থিব এই আনন্দের মাত্রা যত বেশী হয় পরবর্তীতে সৃষ্ট দুর্দশার মাত্রাও একই হারে বৃদ্ধি পায়। ধরুন দু’জন উদ্বাস্তু লোক একটি খাবার দোকানের সামনে বসে আছে। দুজনেরই দোকানের ভিতরে ঢুকে কিছু কিনে খেতে ১০ টাকা প্রয়োজন। দোকান থেকে বের হওয়ার পর একজন ক্রেতা তাদের দেখতে পেল। কিন্তু তাদের মধ্যে শুধু একজনকে তিনি ১০ টাকা দান করলেন। যাকে দান করা হল সে নিশ্চিতভাবে নিজেকে তার সঙ্গীর চেয়ে অধিক ক্ষমতাবান এবং কর্তৃত্বময় মনে করবে। শুধু ১০ টাকার পার্থক্যেই একজন মানুষের মনে এসব ধারণা তৈরী হয়ে যেতে পারে। তাহলে ভাবুন আপনি আপনার জীবনে আরও কত-শত বিলাস উপভোগ করছেন, আপনার অন্তরে সেগুলোর প্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে! এই ধোঁকা দ্বারা প্রতারিত হওয়া থেকে বেঁচে থাকার উপায় হচ্ছে দুনিয়ার জীবনের প্রকৃত বাস্তবতাকে উপলব্ধি করা। উপলব্ধি করুন যে আপনি একজন ক্ষমতাহীন জীব এবং আল্লাহ ছাড়া কোনো শক্তি বা ক্ষমতার উৎস নেই।

পার্থিব ধোঁকার আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক রয়েছে। আর তা হচ্ছে আপনি যা উপভোগ করছেন তা সবসময়ই আপনার কাছে থাকবে এমন ভেবে বসে থাকা। কোনো কিছু উপভোগ করার ঠিক আগ মূহুর্তে কি আপনার মনে কখনো এমন ধারণা উঁকি দেয় যে, যে বিলাসদ্রব্যটি আপনি উপভোগ করতে যাচ্ছেন তা চোখের পলকেই উধাও হয়ে যেতে পারে? আপনার হাতের হিমশীতল পানির গ্লাসটি উঁচু করে ধরে সূরা মুলকের শেষ আয়াতটির কথা ভাবুন,

 

‘…তোমরা ভেবে দেখেছ কি, যদি তোমাদের পানি ভূগর্ভের গভীরে চলে যায়, তবে কে তোমাদেরকে সরবরাহ করবে পানির স্রোতধারা?

আপনার স্ত্রী, স্বামী, সন্তান কিংবা বন্ধুদের সঙ্গ উপভোগ করার সময় কি কখনো মনে হয় এরা আগামীকাল জীবিত নাও থাকতে পারে? পরবর্তীতে যখনই তাদের সাথে সময় কাটাবেন তখন নিজেকে সূরা আর-রহমানের ২৬ নং আয়াতটি মনে করিয়ে দেবেন- ভূপৃষ্টের সবকিছুই ধ্বংসশীল‘। যখন আপনার গাড়িটি গ্যারেজে রেখে আপনার বিশাল বাসার দিকে এগিয়ে যাবেন তখন এক মূহুর্ত দাঁড়িয়ে আপনার বাড়ির দিকে তাকিয়ে সূরা কাহফের ৩৩-৩৪ নং আয়াতে উল্লেখিত দুই বাগান মালিকের কাহিনী স্মরণ করুন। অনুধাবন করুন, আপনার এই সব সম্পত্তি মূহুর্তের ব্যবধানে নেই হয়ে যেতে পারে। ছোট-বড়, জীবিত বা জড় যা কিছুই আপনি উপভোগ করেন না কেন তার সবই উধাও হয়ে যেতে পারে। স্বস্তির যে প্রশান্তি আপনি অনুভব করছেন তা আপনার সামনে রাখা আল্লাহর সৃষ্ট দুনিয়ার ধোঁকা মাত্র।

পার্থিব ধোঁকার তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আপনি সত্যিকারের আনন্দ কোনটি তা উপলব্ধি করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। আমাদের মন এমনভাবে তৈরী করা হয়েছে যে আমরা যদি দীর্ঘ সময় ধরে কোনো ছোটখাট কিছু বা কোনো বিলাসদ্রব্যের পেছনে ছুটি এবং অবশেষে তা অর্জন করি তখন এর চেয়ে ভালো কিছু পাওয়ার কথা আমরা আর ভাবতে পারি না। মনে করুন আপনি মরুভূমিতে হারিয়ে গেছেন। আপনি বেশ কয়েকদিন ধরে কিছুই খেতে বা পান করতে পারেননি। হঠাৎ করে আপনি এক টুকরো শুকনো রুটি, বহু দিনের পুরনো একটু পনির আর এক জগ কুসুম গরম পানি পেয়ে গেলেন। তীব্র ক্ষুধার জন্য এটুকুই তখন আপনার কাছে অমৃত বলে মনে হবে। আর এগুলো খেয়ে নিজের ক্ষুধা নিবারণ করতে করতে আপনার মনে হবে যে এর চেয়ে বেশি আপনার আর কিছুই চাওয়ার নেই। আপনি এই বাসি খাবার দিয়ে নিজের ক্ষুধা-তৃষ্ণা মিটিয়ে এতটাই সন্তুষ্ট যে গরম রুটি, তাজা পনির এবং পরিষ্কার ঠান্ডা পানির কথা চিন্তাও করবেন না।

 

 

এই পৃথিবী আর পরকালের বিলাসদ্রব্যের মাঝে তুলনাটাও ঠিক এইরকম। আর একারণেই আয়াতটির উল্লেখিত অংশের আগের বাক্যটি হচ্ছে – ‘…যাকে আগুন থেকে বহুদূরে রাখা হবে ও স্বর্গোদ্যানে প্রবিষ্ট করা হবে, নিঃসন্দেহ সে হ’ল সফলকাম । এই আয়াতটি আনন্দ এবং উপভোগের ধারণাটিকে যথাযথ দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করে। এই আয়াতটি আপনার সামনে বাস্তবতাকে উন্মোচন করে দিচ্ছে, আর তা হল এই যে, এই পৃথিবীতে আপনি সম্ভাব্য যা যা উপভোগ করতে পারেন তার কোনোটিই জান্নাতের সাথে তুলনীয় নয়। কিন্তু পার্থিব জীবন আমাদের জন্য বাস্তব ও চাক্ষুষ। আর জান্নাতের জীবন সম্পর্কে আমরা শুধু কুরআন এবং হাদীস থেকেই জানতে পারি। তাই এই পৃথিবীর প্রতিটি আনন্দ উপভোগের আগে নিজেকে মনে করিয়ে দিন যে পরকালে যা আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছে- সেটা জান্নাতের আমোদ হোক বা জাহান্নামের আতঙ্কই হোক – তার তুলনায় এই পার্থিব পুলক একটি বিভ্রম মাত্র।

পার্থিব প্রতারণা বনাম বাস্তবতার এই তিনটি বৈশিষ্ট্য যদি আপনি আত্মস্থ করতে পারেন তবে তা আপনার ব্যক্তিত্বের উপর অত্যন্ত কার্যকর প্রভাব ফেলবে।

  • প্রথমটি আপনাকে বিনয় শেখাবে।
  • দ্বিতীয়টি আপনার যা আছে সেটাকে আরো মূল্যায়ন করতে শেখাবে।
  • তৃতীয়টি আপনার অন্তরকে পরকালের সাথে আরও দৃঢ় বন্ধনে যুক্ত করবে এবং এই ক্ষণস্থায়ী পার্থিব জীবনের অসারতা থেকে আপনাকে মুক্ত করবে।

 

তারিক মেহান্না
প্লাইমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি
আইসোলেশন ইউনিট – সেল #১০৮