সমরকন্দ বিজেতা কুতাইবা বিন মুসলিম

কুতাইবা বিন মুসলিমের জন্ম ৪৯ হিজরিতে, হজরত মুয়াবিয়ার শাসনকালে। কুতাইবার পিতা মুসলিম ছিলেন ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়ার বন্ধু। বসরায় কুতাইবার পরিবারের বেশ প্রভাব ছিল। কুতাইবার পিতা ছিলেন বসরার কারাগারের দায়িত্বে। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ৮৬ হিজরিতে কুতাইবাকে মুফাজজাল ইবনু মুহাল্লাবের পরিবর্তে খোরাসানের গভর্নর নিযুক্ত করেন। কুতাইবা খোরাসানে এসে জিহাদের গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে একটি ভাষণ দেন। এই ভাষণে তিনি বলেন, আল্লাহ তোমাদের জন্য জিহাদকে বৈধ করেছেন তার দীনকে সমুন্নত করার জন্য। এরপর তিনি তিলাওয়াত করেন,

مَا كَانَ لِأَهْلِ الْمَدِينَةِ وَمَنْ حَوْلَهُم مِّنَ الأَعْرَابِ أَن يَتَخَلَّفُواْ عَن رَّسُولِ اللّهِ وَلاَ يَرْغَبُواْ بِأَنفُسِهِمْ عَن نَّفْسِهِ ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ لاَ يُصِيبُهُمْ ظَمَأٌ وَلاَ نَصَبٌ وَلاَ مَخْمَصَةٌ فِي سَبِيلِ اللّهِ وَلاَ يَطَؤُونَ مَوْطِئًا يَغِيظُ الْكُفَّارَ وَلاَ يَنَالُونَ مِنْ عَدُوٍّ نَّيْلاً إِلاَّ كُتِبَ لَهُم بِهِ عَمَلٌ صَالِحٌ إِنَّ اللّهَ لاَ يُضِيعُ أَجْرَ الْمُحْسِنِينَ

মদিনাবাসী ও পাশ্ববর্তী বেদুঈনদের জন্য উচিত নয় আল্লাহর রসুলের সঙ্গ ত্যাগ করে পেছনে থেকে যাওয়া এবং রসুলের প্রাণ থেকে নিজেদের প্রাণকে অধিক প্রিয় মনে করা। এটি এজন্য যে, আল্লাহর পথে যে তৃষ্ণা, ক্লান্তি ও ক্ষুধা তাদের স্পর্শ করে এবং তাদের এমন পদক্ষেপ যা কাফিরদের মনে ক্রোধের কারণ হয় আর শত্রুদের পক্ষ থেকে তারা যা কিছু প্রাপ্ত হয় তার প্রত্যেকটির পরিবর্তে তাদের জন্য লিখিত হয়ে থাকে নেক আমল। নিঃসন্দেহে আল্লাহ সৎকর্মশীলদের প্রতিফল বিনষ্ট করেন না।

وَلاَ يُنفِقُونَ نَفَقَةً صَغِيرَةً وَلاَ كَبِيرَةً وَلاَ يَقْطَعُونَ وَادِيًا إِلاَّ كُتِبَ لَهُمْ لِيَجْزِيَهُمُ اللّهُ أَحْسَنَ مَا كَانُواْ يَعْمَلُونَ

আর তারা কম বা বেশী যা কিছু ব্যয় করে, যত প্রান্তর তারা অতিক্রম করে, তা সবই তাদের নামে লেখা হয়, যেন আল্লাহ তাদের কৃতকর্মসমূহের উত্তম বিনিময় প্রদান করেন। সুরা তওবা ১২০, ১২১।

তাঁর এই ভাষণের ফলে জনসাধারণের মধ্যে ঈমানি চেতনা জাগ্রত হয়। প্রচুর মানুষ জিহাদের জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। কুতাইবা এই বাহিনী নিয়ে তুর্কিস্তানের পথ ধরেন। সেখানে বেশকিছু গোত্র বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে রেখেছিল। পথে কুতাইবার সাথে বলখের সরদারও একত্রিত হন। কুতাইবা তাঁর বাহিনী নিয়ে আমু দরিয়া অতিক্রম করেন। তিনি আখরুন ও শোমান অঞ্চলে পৌঁছতেই এই এলাকার রাজারা আনুগত্যের বিনিময়ে সন্ধি করে নেয়। কুতাইবা এরপর মার্ভে ফিরে আসেন। ৮৭ হিজরিতে কুতাইবা বোখারার বেকন্দ শহরে হামলা করেন। বেকন্দিরা পাশের এলাকার লোকদের সাহায্য প্রার্থনা করে। তাদের সাহায্যে এক বিশাল বাহিনী এগিয়ে আসে। এই বাহিনী মুসলিম বাহিনীকে ঘিরে ফেলে।

প্রায় দুই মাস এই অবরোধ টিকে থাকে। এই সময়ে কুতাইবা কোথাও দূত প্রেরণ করতে পারেননি, কিংবা তাঁর কাছেও কোনো দূত আসতে পারেনি। এই পরিস্থিতিতে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ চিন্তায় পড়ে যান। কুতাইবার সাফল্যের জন্য মসজিদে মসজিদে দোয়া করা হয়। অবশেষে একদিন মুসলমানরা প্রচণ্ড হামলা চালায়। আক্রমণের তীব্রতায় শত্রুদের পা টলে যায়, তারা শহরের দিকে পালাতে থাকে। মুসলিম বাহিনী তাদের ধাওয়া করে। শত্রুদলের অনেককে হত্যা করা হয়। অনেকে বন্দী হয়।

অল্পকিছু সেনা শহরে প্রবেশ করে শহরের ফটক বন্ধ করে দেয়। কুতাইবা আদেশ দেন শহরের প্রাচীর ভেঙে ফেলতে। বেকন্দিরা বুঝলো আর টিকে থাকার আশা নাই। তারা এবার সন্ধির আহ্বান জানায়। কুতাইবা এ আবেদন কবুল করেন। একজন প্রশাসক নিয়োগ করে ফিরে আসেন। কুতাইবা মাত্র পাঁচ ক্রোশ দুরত্বে গিয়েই জানতে পারলেন বেকন্দিরা বিদ্রোহ করেছে এবং শহরের প্রশাসককে হত্যা করেছে। কুতাইবা দ্রুত ফিরে আসেন। তিনি শহরের প্রাচীর ধ্বংস করার আদেশ দেন। শহরবাসী আবারও সন্ধি করার আহ্বান জানায়। কিন্তু কুতাইবা এবার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি জোর করে শহরে প্রবেশ করেন। বেছে বেছে উস্কানিদাতাদের হত্যা করা হয়।

একজন অন্ধ ব্যক্তি এই বিদ্রোহের নেতৃত্বে ছিল। তাকে কুতাইবার সামনে আনা হয়। সে ব্যক্তি বলে, আমার জীবনের বিনিময়ে পাঁচ হাজার রেশমি থান দেব। কুতাইবা বলেন, এখন আর আমরা তোমাদের প্রতারণার শিকার হবো না। তিনি আদেশ দেন এই ব্যক্তিকে হত্যা করতে। বেকন্দ জয়ের ফলে এখান থেকে প্রচুর অস্ত্র, স্বর্ণ ও রূপার পাত্র মুসলিম বাহিনীর হাতে আসে। ৮৮ হিজরিতে কুতাইবা মার্ভ থেকে তাশখন্দের পথ ধরেন। এখানকার বাসিন্দারা সন্ধি করার আবেদন জানালে তা কবুল করে নেয়া হয়। এদিকে কুতাইবার বিজয়াভিযান শাসকদের চিন্তিত করে তুলছিল। চীন সম্রাটের ভাই কোরলগাবুল দুই লক্ষ সেনা নিয়ে কুতাইবার উপর হামলা করে বসে। প্রচণ্ড লড়াই হয়। লড়াইয়ে মুসলিম বাহিনী বিজয় লাভ করে। (১)

৮৯ হিজরিতে কুতাইবা বোখারার উদ্দেশ্যে রওনা হন। তিনি আমুদরিয়া অতিক্রম করেন। সিফলি অঞ্চলে শত্রুবাহিনীর সাথে তাঁর লড়াই হয়। কুতাইবা এই বাহিনীকে পরাজিত করে বোখারায় পৌঁছেন। বোখারার শাসক দরওয়ান কুতাইবার আগমনের সংবাদ আগেই জেনেছিল। সে প্রস্তুত ছিল। তার শৃংখল বাহিনী নিয়ে সে কুতাইবার মুখোমুখি হয়। এই যুদ্ধে কুতায়বা বেশ নাজেহাল হন। তিনি বোখারা জয় না করেই মার্ভে ফিরে আসেন।

হাজ্জাজ এই সংবাদে বেশ ক্রোধান্বিত হন। এক পত্রে তিনি কুতাইবাকে বলেন, তুমি এই ব্যর্থতার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। আমি পরিকল্পনা বাতলে দিচ্ছি, সেমতে বোখারায় হামলা করো। পরের বছর কুতাইবা আবার বোখারার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। বোখারার রাজা সুগদের রাজার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে। সাহায্য আসার আগেই কুতাইবা বোখারা অবরোধ করে ফেলেন। প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে মহিলারাও ছিলেন। একদিন আক্রমণের তীব্রতায় মুসলিম বাহিনী পিছু হটতে চাইলে মহিলারা তাদেরকে সামনে ঠেলে দেন। মহিলারা কাঁদতে থাকেন। এ দৃশ্য দেখে পুরুষরা উজ্জীবিত হন। তাঁরা আবার সাহসিকতার সাথে লড়তে থাকেন। আবারও তীব্র লড়াই শুরু হয়। এবার মুসলমানদের জয় হয়। বোখারার পতন হয়। সুগদের রাজা এই যুদ্ধে ভীত হয়ে কুতাইবার সাথে সন্ধি করে নেয়। কুতাইবা মার্ভে ফিরে এসে হাজ্জাজকে পত্র লিখে বিস্তারিত জানান। হাজ্জাজ খুশি হন।

৯৩ হিজরিতে কুতাইবা খা ওয়ারেজম সাম্রাজ্য আক্রমণ করলে এর শাসক সন্ধি করে নেয়। যুদ্ধ ছাড়াই এ অঞ্চল মুসলমানদের হাতে আসে। এরপর কুতাইবা সমরকন্দ বিজয়ের ইচ্ছা করেন। প্রথমে তিনি তাঁর ভাই আবদুর রহমানকে সমরকন্দে প্রেরণ করেন। কয়েকদিন পর একটি বাহিনী নিয়ে তিনিও সমরকন্দের পথে রওনা হন। শহরবাসী মুসলিম বাহিনীর দেখা পেয়ে শহরের ফটক বন্ধ করে দেয়। তারা কেল্লাবন্দী হয়ে বসে থাকে। মুসলিম বাহিনী প্রায় এক মাস শহর অবরোধ করে রাখে। শহরবাসী পত্র মারফত চীন ও ফারগানার শাসকের সাহায্য কামনা করে। পত্রে তারা লিখেছিল, আজ আমাদের উপর যে বিপদ নেমে এসেছে আগামীকাল তা তোমাদের দিকে যাবে। এখন আমাদেরকে সাহায্য না করলে আগামীকাল আরবের এই ঝড় তোমাদের দিকে ধেয়ে যাবে।

এই পত্র নিয়ে আশপাশের শাসকরা চিন্তা করতে থাকে। তারা নিজেদের ক্ষমতা নিয়ে শংকিত হয়ে পড়ে। শেষে তারা সিদ্ধান্ত নেয় সমরকন্দের সাহায্যে এগিয়ে যাবে। চীন সম্রাট তাঁর পুত্রকে বিশাল বাহিনী দিয়ে কুতাইবার বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। কুতাইবা এই বাহিনীর আগমনের সংবাদ পেয়ে তাদেরকে প্রতিহত করার জন্য সালেহ ইবনে মুসলিমের নেতৃত্বে ৬০০ সেনার একটি বাহিনী প্রেরণ করেন। মধ্যরাতে এই বাহিনী শত্রুপক্ষের উপর গেরিলা হামলা চালায়। আচমকা আক্রমণের জন্য শত্রুরা মোটেই প্রস্তুত ছিল না। রাতের আচমকা হামলার ধকল কাটিয়ে ওঠার আগেই তাদের বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। আতংক ছড়িয়ে পড়ে। তারা ঘুরে দাঁড়ানোর পরিবর্তে পালাতে থাকে। অনেক রাজকুমার বন্দী হয়। অনেকে নিহত হয়। সাহায্যে এগিয়ে আসা এই বাহিনীর পরাজয়ের সংবাদ শুনে সমরকন্দবাসীর মনোবল ভেঙে যায়। এদিকে কুতাইবা তখন মিনজানিকের মাধ্যমে শহরের প্রাচীরে গোলাবর্ষণ করছিলেন। শহরের প্রাচীরের একাংশ ভেঙে যায়। মুসলিম বাহিনী প্রাচীরের কাছে চলে যায়। বাধ্য হয়ে শহরের বাসিন্দারা আত্মসমর্পণ করে। শর্ত ছিল–১. তারা বার্ষিক ২২ লাখ দিরহাম কর দেবে। ২. মুসলমানরা মসজিদ নির্মাণ করে নামাজ আদায় করবে। ৩. মূর্তিগুলো মুসলামানদের অধিকারে থাকবে।

মুসলমানরা বিজয়ীর বেশে শহরে প্রবেশ করে। কুতাইবা আদেশ দেন মূর্তিসমূহ ভেঙে ফেলতে। শহরের শাসনকর্তা গোজাক বলে, এই কাজ করবেন না। এই মূর্তি ভাঙলে আপনিও ধ্বংস হয়ে যাবেন। কুতাইবা বলেন, তুমি যদি এমনটা ভেবে থাকো, তাহলে আমি নিজেই এসব জ্বালিয়ে দিচ্ছি। দেখো, আমার কী হয়। মূর্তি পুড়িয়ে ফেলা হয়। তা থেকে ৫০ হাজার মিসকাল স্বর্ণ বের হয়। মূর্তির দূরবস্থা দেখে শহরের বাসিন্দাদের এক বিরাট অংশ ইসলাম গ্রহণ করে। কুতাইবা সমরকন্দে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন এবং সেখানে খুতবা দেন।

কুতাইবা এরপর আব্দুল্লাহ ইবনে মুসলিমকে শহরের শাসক নিযুক্ত করে মার্ভে ফিরে আসেন। ৯৪ হিজরিতে কুতাইবা বিন মুসলিম আবার আমু দরিয়া অতিক্রম করেন। তিনি ২০ হাজার সেনাকে চেচনিয়া প্রেরণ করেন। এই বাহিনীর হাতে চেচনিয়া বিজয় হয়। কুতাইবা এগিয়ে যান ফারগানার দিকে। তিনি ফারগানা জয় করে কাশান পৌঁছেন এবং কাশান জয় করেন। এরপর তিনি মার্ভে ফিরে আসেন।

৯৬ হিজরিতে কুতাইবা বিন মুসলিম সিদ্ধান্ত নেন তিনি চীনে হামলা করবেন। মার্ভ থেকে তাই সেনাবাহিনী নিয়ে রওনা হন। ফারগানা পৌঁছে তিনি সেখান থেকে কাশগড় পর্যন্ত পাহাড়ি পথ সমতল করেন। অভিজ্ঞ সেনাপতি কাসিরকে পাঠান কাশগড়ে হামলা করার জন্য। কাশগড় চীনের সীমান্ত শহর। কাসির এই শহর জয় করেন। এরপর তিনি চীনের ভেতরে প্রবেশ করেন। চীনের সম্রাট মুসলমানদের লাগাতার হামলায় ভয় পেয়ে যায়। সে কুতাইবার কাছে পত্র লিখে বলে, আমার কাছে আপনাদের কোনো সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে প্রেরণ করুন যেন আপনাদের উদ্দেশ্য ও আপনাদের ধর্ম সম্পর্কে জানতে পারি। কুতাইবা তখন হুবাইরা ইবনুল মুশামরাজ কিলাবি ও কয়েকজন সুবক্তাকে চীন সম্রাটের দরবারে প্রেরণ করেন। তাঁদের প্রেরণ করার সময় কুতাইবা বলে দেন, তোমরা সম্রাটকে জানিয়ে দিয়ো আমি শপথ করেছি, হয় তারা ইসলামে প্রবেশ করবে অথবা আমি তাদের থেকে জিজিয়া নেব, আমি চীনের মাটি মাড়াবো, এবং তাদের শাহজাদাদের নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসব।

হুবাইরা উপস্থিত হলেন সম্রাটের রাজধানীতে। ইবনে কাসির লিখেছেন, এটি ছিল অত্যন্ত মনোরম একটি শহর। শহরের ফটক ছিল ৯৯ টি।

প্রথমদিন সম্রাটের সাথে সাক্ষাতকালে প্রতিনিধিদলের সদস্যরা পরেছিলেন সাদা পোষাক। ভেতরে ছিল পাতলা গাউন। শরীরে সুগন্ধী। পায়ে ছিল জুতো। তার পরদিন প্রতিনিধিদলের সদস্যরা সম্রাটের সামনে এলেন নকশা করা পোষাক পরে। তাঁদের মাথায় ছিল পাগড়ি। তৃতীয়দিন তাঁরা পরলেন সাদা পোষাক। মাথায় ছিল শিরস্ত্রাণ। হাতে বর্শা ও তরবারি। সম্রাট জিজ্ঞেস করলেন, তিনদিন তোমরা তিন রকমের পোষাক পরলে কেন?

হুবাইরা বললেন, প্রথম দিন যে পোষাক পরেছি তা পরে আমরা আমাদের পরিবারের কাছে যাই। দ্বিতীয় দিন যা পরেছি তা পরে আমরা আমাদের আমিরের সামনে যাই। আর আজ যা পরেছি তা পরে আমরা শত্রুদের মুখোমুখি হই।

চীন সম্রাট নানা বিষয়ে কথা বলেন। শেষে তিনি বলেন, তোমাদেরকে তো জ্ঞানীই মনে হয়েছে। আমি জানতে পেরেছি তোমাদের সেনাসংখ্যা অনেক কম। আমার সেনারা তোমাদের পিষ্ট করে ফেলবে। তোমাদের সেনাপতিকে বলে দিয়ো, এখন ফিরে যাওয়াতেই তোমাদের কল্যাণ নিহিত।

হুবায়রা সম্রাটকে জবাব দিলেন, হে সম্রাট, কে এই বাহিনীকে অল্প বলতে পারে, যার একমাথা রয়েছে আপনার সীমান্তে, আর অন্য মাথা জায়তুনের বাগানে (এখানে দারুল খিলাফাহ দামেশকের দিকে ইঙ্গিত করেছেন)। আপনি হত্যার হুমকি দিয়েছেন। আমরা বিশ্বাস করি, আমাদেরকে একটি নির্দিষ্ট সময় দেয়া হয়েছে। যখন তা আসবে আমরা তাকে বরণ করে নেব। আমরা মৃত্যুকে ভয় করি না।

হুবায়রার জবাব শুনে চীন সম্রাট ঘাবড়ে যান। তিনি বলেন, কী করলে তোমাদের সেনাপতি ফিরে যাবেন?

হুবায়রা বললেন, তিনি শপথ করেছিলেন, হয় আপনারা ইসলাম গ্রহণ করবেন অথবা জিজিয়া দেবেন। এরপর তিনি আপনাদের মাটি মাড়াবেন এবং শাহজাদাদের নিজের আয়ত্তে নেবেন।

সম্রাট বললেন, ঠিক আছে আমি তাঁর শপথ পূরণ করবো।

এরপর সম্রাট কয়েকটি স্বর্ণের পাত্রে কিছু মাটি, জিযিয়া হিসেবে প্রচুর নগদ অর্থ আর চারজন শাহজাদাকে কুতাইবার নিকট পাঠিয়ে দিলেন। (২)

এভাবে চীন সম্রাটের সাথে তাঁর সন্ধি হলো। এরপর তিনি মার্ভে ফিরে আসেন। এই অভিযানের শুরুতেই কুতাইবার কাছে সংবাদ আসে খলিফা অলিদ বিন আবদুল মালিক ইন্তেকাল করেছেন। পরবর্তী খলিফা হিসেবে সুলাইমান বিন আব্দুল মালিক সিংহাসনে আরোহণ করেছেন।

কুতাইবা চিন্তিত ছিলেন। ইতিপূর্বে অলিদ বিন আবদুল মালিক সুলাইমানকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য একটি পরিকল্পনা করেছিলেন। হাজ্জাজ বিন ইউসুফের সাথে কুতাইবাও এই পরিকল্পনায় সায় দিয়েছিলেন। কুতাইবা আশংকা করছিলেন সুলাইমান তাঁর উপর প্রতিশোধ নেবেন। কুতাইবা তাই শুরুতেই সুলাইমানের কাছে তিনটি পত্র লিখলেন। প্রথম পত্রে তিনি সুলাইমানকে অভিষেকের অভিনন্দন জানালেন, তাঁকে মোবারকবাদ দিলেন এবং তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশের ঘোষণা দিলেন। দ্বিতীয় পত্রে তিনি খোরাসান ও তুর্কিস্তানে নিজের বিজয়সমূহের বর্ণনা দিলেন। এখানকার সরদারদের মনে নিজের প্রভাব সম্পর্কেও আলোচনা করলেন। তৃতীয় পত্রে তিনি লিখলেন যদি তাঁকে খোরাসান থেকে বরখাস্ত করে ইয়াজিদ বিন মুহাল্লাবকে তাঁর স্থানে স্থলাভিষিক্ত করা হয় তাহলে তিনি খলিফার বায়াত প্রত্যাহার করবেন।

কুতাইবা একজন দূতকে পত্র তিনটি দিয়ে বললেন, তুমি খলিফাকে প্রথম পত্রটি দেবে। যদি তিনি তা পাঠ করে ইয়াজিদ বিন মুহাল্লাবের দিকে এগিয়ে দেন তাহলে তাঁকে দ্বিতীয় পত্রটি দেবে। যদি এটিও তিনি ইয়াজিদের হাতে দেন তাহলে তৃতীয় পত্রটি দেবে।

তিন পত্র নিয়ে দূত এলো দারুল খিলাফাহ দামেশকে। দূত যখন সুলাইমানের দরবারে উপস্থিত হলো, তখন ইয়াজিদ বিন মুহাল্লাবও দরবারে উপস্থিত ছিল। সুলাইমান প্রথম পত্র পড়ে ইয়াজিদের হাতে তুলে দিলেন। দূত এবার খলিফাকে দ্বিতীয় পত্র দিল। সুলাইমান এটিও পড়ে ইয়াজিদের হাতে তুলে দিলেন। দূত এবার খলিফার হাতে কুতাইবার তৃতীয় পত্র তুলে দিল। পত্র পড়ে সুলাইমানের চেহারা রাগে লাল হয়ে যায়। তবুও তিনি চুপ থাকেন। দূতকে অনেক যত্ন করেন। কুতাইবাকে খোরাসানের ওয়ালি দায়িত্বে বহাল রাখার ঘোষণা দেন। বাহ্যত খলিফা কুতাইবার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপই নেননি।

কিন্তু কুতাইবা আতংকে ছিলেন। এই আতংক তাঁকে বাধ্য করে অপরিণামদর্শী একটি সিদ্ধান্ত নিতে। তিনি দূতের কাছ থেকে কোনো সংবাদ পাওয়ার পূর্বেই বিদ্রোহ করে বসেন। তিনি ভেবেছিলেন এই বিদ্রোহে সরদাররা তাঁর পাশে থাকবে। কিন্তু কেউই এই বিদ্রোহে তাঁকে সঙ্গ দিল না। সবাই মিলে বনু তামিমের সরদার ওকিকে সিপাহসালার মনোনীত করে। এক লড়াইয়ে কুতাইবাকে হত্যা করা হয়। (৩)

কুতাইবার মৃত্যুর সংবাদে এক খোরাসানি বলেছিল, কুতাইবার মতো কোনো বিজেতা যদি আমাদের মধ্যে থাকতেন তাহলে আমরা তাঁর মরদেহ মমি করে রাখতাম, দুশমনের সাথে লড়াইয়ের সময় তাঁর আশির্বাদ কামনা করতাম।

তথ্যসূত্র
১। খাত্তাব, মাহমুদ শীত (মৃত্যু ১৪১৯ হিজরি), কদাতুল ফাতহিল ইসলামি ফি বিলাদি মাওয়াউন্নাহার, পৃ-৩৮৫ (বৈরুত, দার ইবনি হাজম, ১৪১৮ হিজরি)
২। ইবনুল আসির, আবুল হাসান আলি বিন মুহাম্মদ বিন মুহাম্মদ (মৃত্যু ৬৩০ হিজরি), আল-কামিল ফিত তারিখ, ৪/২৮৯ (বৈরুত, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, ১৪০৭ হিজরি)
৩। ইবনু কাসির, ইমাদুদ্দিন আবুল ফিদা ইসমাইল ইবনু উমর (মৃত্যু ৭৭৪ হিজরি), আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ১২/৬১৫ (মারকাজুল বুহুস লিদ দিরাসাতিল ইসলামিয়্যাহ, ১৪১৮ হিজরি


ইমরান রাইহান
সূত্রঃ fateh24