ব্যক্তি ও সমাজ গঠনে সীরাতের ভূমিকা – মুহাম্মাদ সিফাতুল্লাহ [৩য় পর্ব]

সাত. আইনের চোখে সবাই সমান

এই সাম্য ইসলাম সর্বক্ষেত্রে রক্ষা করেছে। আরবের এক সম্ভ্রান্ত গোত্রের এক নারী চুরি করেছিল। গোত্রের সম্মানে তারা ঐ নারীর হাত না কাটার অনুরোধ করেছিল। তখন ক্রোধে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চেহারা মুবারক বিবর্ণ হয়ে গেল। তিনি দাঁড়িয়ে খুতবা দিলেন-

إِنَّمَا أَهْلَكَ الَّذِينَ قَبْلَكُمْ، أَنَّهُمْ كَانُوا إِذَا سَرَقَ فِيهِمُ الشَّرِيفُ تَرَكُوهُ، وَإِذَا سَرَقَ فِيهِمُ الضَّعِيفُ أَقَامُوا عَلَيْهِ الحَدَّ، وَأيْمُ اللهِ لَوْ أَنَّ فَاطِمَةَ بِنْتَ مُحَمَّدٍ سَرَقَتْ لَقَطَعْتُ يَدَهَا.

যে বিষয়টি তোমাদের পূর্ববর্তীদের ধ্বংস করেছে তা এই যে, যখন তাদের অভিজাত কেউ চুরি করত তারা তাকে ছেড়ে দিত। আর দুর্বল কেউ চুরি করলে তার উপর দ- প্রয়োগ করত। খোদার কসম যদি ফাতেমা বিনতে মুহাম্মাদও চুরি করত আমি তার হাত কেটে দিতাম। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৩০৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৮৮

অন্যের প্রাপ্য পরিশোধ

স্বার্থপরতার পরিবর্তে ইসলামে ন্যায় ও ইনসাফের শিক্ষা দেয়া হয়েছে। স্বার্থপর শুধু নিজের প্রাপ্য সম্পর্কে চিন্তা করে, অন্যের প্রাপ্য সম্পর্কে চিন্তা করে না। অথচ সমষ্টিগত জীবনে একে অপরের প্রাপ্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া ছাড়া শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। মানুষ স্বভাবগতভাবেই নিজের হক ও অধিকার সম্পর্কে সচেতন তাই অন্যের হকের ব্যাপারে কুরআন-সুন্নাহয় বিশেষভাবে তাকিদ করা হয়েছে। প্রত্যেকে যদি অন্যের হক আদায়ে সচেষ্ট হয় তাহলে শান্তি-শৃঙ্খলার সাথে প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বের আবহে  প্রত্যেকেই তার প্রাপ্য পেয়ে যায়। কুরআন মাজীদ প্রত্যেক শ্রেণির মানুষকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করেছে এবং তার উপর অন্যের যে হক তা আদায়ে উৎসাহিত করেছে।

সন্তানকে বলা হয়েছে বাবা-মার সাথে সদাচার করতে-

وَ قَضٰی رَبُّكَ اَلَّا تَعْبُدُوْۤا اِلَّاۤ اِیَّاهُ وَ بِالْوَالِدَیْنِ اِحْسَانًا ؕ اِمَّا یَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ اَحَدُهُمَاۤ اَوْ كِلٰهُمَا فَلَا تَقُلْ لَّهُمَاۤ اُفٍّ وَّ لَا تَنْهَرْهُمَا وَ قُلْ لَّهُمَا قَوْلًا كَرِیْمًا.

তোমার রব নির্দেশ দিয়েছেন- তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করো না। পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো, তাদের একজন বা উভয়ে যদি বার্ধক্যে উপনীত হয় তবে তাদেরকে ‘উফ্’ পর্যন্ত বলো না। এবং তাদেরকে ধমক দিয়ো না। বরং তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বলো। -সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ২৩

সন্তান-সন্ততি ও পরিবার পরিজন সম্পর্কে পরিবারের কর্তাকে আদেশ করা হয়েছে-

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا قُوْۤا اَنْفُسَكُمْ وَ اَهْلِیْكُمْ نَارًا.

হে ঈমানদারগণ! তোমরা জাহান্নাম থেকে রক্ষা কর নিজেকে ও পরিবারকে। : সূরা তাহরীম (৬৬) : ৬

স্বামীকে আদেশ করা হয়েছে-

وَ عَاشِرُوْهُنَّ بِالْمَعْرُوْفِ.

তোমরা স্ত্রীদের সাথে উত্তম আচরণ করো। -সূরা বাকারা (২) : ১৯

আর স্ত্রীকে বলা হয়েছে-

أَيُّمَا امْرَأَةٍ مَاتَتْ وَزَوْجُهَا عَنْهَا رَاضٍ دَخَلَتِ الجَنَّةَ.

যে নারী স্বামীকে খুশী রেখে মৃত্যুবরণ করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১১৬১; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৮৫৪

কর্মী, শ্রমিক, চাকুরকে বলা হয়েছে আমানত রক্ষা করতে, তথা অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে। আর মালিক, কর্তা ও নিয়োগদাতাকে বলা হয়েছে, তাদের প্রাপ্য পরিশোধ করতে। ধনীকে বলা হয়েছে তোমার সম্পদে গরীবের হক আছে। আর গরীবকে বলা হয়েছে কারো কাছে হাত পেতো না। দাতার হাত গ্রহীতার হাত থেকে উত্তম।

মোটকথা, প্রত্যেককে অন্যের হক ও প্রাপ্য সম্পর্কে সচেতন করা হয়েছে এবং তা পরিশোধের তাকিদ করা হয়েছে।

অন্যের হক আদায় না করার কঠিন পরিণাম সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-তোমরা মজলুমের বদ দুআ হতে বেঁচে থাক। কারণ আল্লাহ ও তার দুআর মাঝে কোনো বাধা থাকে না।  -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৪৪৮

আরো বলেছেন,

الظُّلْمُ ظُلُمَاتٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ.

যুলুম রোজ কিয়ামতে বহু অন্ধকার হয়ে দেখা দিবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৪৪৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৭৯

হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-

إِذَا خَلَصَ المُؤْمِنُونَ مِنَ النَّارِ حُبِسُوا بِقَنْطَرَةٍ بَيْنَ الجَنَّةِ وَالنَّارِ، فَيَتَقَاصُّونَ مَظَالِمَ كَانَتْ بَيْنَهُمْ فِي الدُّنْيَا حَتَّى إِذَا نُقُّوا وَهُذِّبُوا، أُذِنَ لَهُمْ بِدُخُولِ الجَنَّةِ.

মুমিনরা যখন জাহান্নাম থেকে মুক্তি  পেয়ে সামনে অগ্রসর হবে জান্নাত জাহান্নামের মাঝে এক পুলে তাদের পথ রোধ করা হবে। তখন দুনিয়াতে তারা একে অপরকে যে যুলুম করেছিল তার কিছাছ নেয়া হবে। এবং (পাপ থেকে) পূতপবিত্র করে তাদের জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৪৪০

ইছার ও পরার্থপরতা

শুধু হক আদায় ও প্রাপ্য পরিশোধ নয়, পবিত্র সীরাতে খুব গভীরভাবে আছে ইছার ও পরার্থপরতার শিক্ষা। সুতরাং ইসলামী সমাজ-জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ পরার্থপরতা। তা যেমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগঠনের ক্ষেত্রে তেমনি সমাজের ঐ সকল ব্যাধির নিরাময় ও প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও, যার উৎপত্তি ও বিকাশ স্বার্থপরতা থেকে। ইসলামে পরার্থপরতার শিক্ষা অতি গভীরভাবে রয়েছে। যেমন-

এক. ইসলামের আখিরাত-বিশ্বাস মানুষকে পরার্থপরতায় উৎসাহিত করে এবং এই বাস্তবতা তুলে ধরে যে, অন্যের উপকার সাধনে রয়েছে তার নিজেরই উপকার।

এক হাদীসে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কত সুন্দর বলেছেন-

أَيُّكُمْ مَالُ وَارِثِهِ أَحَبُّ إِلَيْهِ مِنْ مَالِهِ؟ قَالُوا: يَا رَسُولَ اللَّهِ، مَا مِنَّا مِنْ أَحَدٍ إِلَّا مَالُهُ أَحَبُّ إِلَيْهِ مِنْ مَالِ وَارِثِهِ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: اعْلَمُوا أَنَّهُ لَيْسَ مِنْكُمْ أَحَدٌ إِلَّا مَالُ وَارِثِهِ أَحَبُّ إِلَيْهِ مِنْ مَالِهِ، مَالُكَ مَا قَدَّمْتَ، وَمَالُ وَارِثِكَ مَا أَخَّرْتَ.

“তোমাদের মধ্যে কে আছ যার কাছে তার নিজের সম্পদ তার ওয়ারিছের সম্পদের চেয়ে প্রিয়? সাহাবীগণ বললেন, আল্লাহর রাসূল! আমাদের প্রত্যেকের কাছেই তো তার নিজের সম্পদ ওয়ারিছের সম্পদের চেয়ে প্রিয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না, তোমাদের কাছে তোমাদের ওয়ারিছের সম্পদ নিজের সম্পদের চেয়ে প্রিয়। তোমার নিজের সম্পদ তো তা, যা তুমি (আখিরাতের জন্য) প্রেরণ করেছ আর ওয়ারিছের সম্পদ তা, যা তুমি (পৃথিবীতে) রেখে যাচ্ছ। -আল আদাবুল মুফরাদ, হাদীস ১৫৩

অর্থাৎ  যা আল্লাহর পথে খরচ করা হয়েছে তা-ই সঞ্চিত থাকছে। আখিরাতে এর বিনিময় পাওয়া যাবে। আর যা আল্লাহর পথে খরচ না করে রেখে দেওয়া হচ্ছে তা তো ওয়ারিছের সম্পদে পরিণত হবে। কাজেই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যে পরোপকারে ব্রতী হয় বস্তুত সে নিজেরই কল্যাণ সাধন করে।

তো আখিরাতের ঈমান অত্যন্ত গভীর থেকে পরোপকার ও পরার্থপরতায় উৎসাহিত করে।

দুই. স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন পরোপকারের সর্বোত্তম নমুনা। নবুওতের পূর্ব থেকেই তাঁর এই গুণ ছিল স্বীকৃত ও প্রসিদ্ধ। এ কারণে প্রথম ওহীর পর তিনি যখন প্রাণের আশঙ্কা ব্যক্ত করেন তখন উম্মুল মুমিনীন খাদীজা রা. তাঁকে যে কথাগুলো বলে সাহস ও সান্ত¡না দিয়েছিলেন তা ছিল-

كَلَّا وَاللَّهِ مَا يُخْزِيكَ اللَّهُ أَبَدًا، إِنَّكَ لَتَصِلُ الرَّحِمَ، وَتَحْمِلُ الكَلَّ، وَتَكْسِبُ المَعْدُومَ، وَتَقْرِي الضَّيْفَ، وَتُعِينُ عَلَى نَوَائِبِ الحَقِّ

কক্ষনো নয়! খোদার কসম, আল্লাহ কখনো আপনাকে লাঞ্ছিত করবেন না। আপনি আত্মীয়তা রক্ষা করেন, দুস্থের ভার বহন করেন, নিঃস্বের জন্য উপার্জন করেন, মেহমানের সমাদর করেন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে (মানুষের) সহযোগিতা করেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৬০

হযরত আনাস রা. বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يُحِبَّ لِأَخِيهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ

তোমাদের কেউ ঐ পর্যন্ত মুমিন হবে না যে পর্যন্ত না সে তার ভাইয়ের জন্য তা-ই পছন্দ করবে যা নিজের জন্য পছন্দ করে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪৫

হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

الْمُؤْمِنُ مِرْآةُ الْمُؤْمِنِ، وَالْمُؤْمِنُ أَخُو الْمُؤْمِنِ، يَكُفُّ عَلَيْهِ ضَيْعَتَهُ، وَيَحُوطُهُ مِنْ وَرَائِهِ.

মুমিন মুমিনের আয়না এবং মুমিন মুমিনের ভাই, সে তার (অনুপস্থিতিতে) তার জমি রক্ষা করে এবং তাকে পেছন থেকে বেষ্টন করে রাখে। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৯১৮; সুনানে কুবরা, বায়হাকী ৮/১৬৭, হাদীস ১৬৬৮১

আর জীবনব্যাপী ছোট ছোট উদাহরণ তো অসংখ্য। একটি উদাহরণ দেখুন, হযতর সাহ্ল রা. থেকে বর্ণিত, এক নারী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এল একটি ধারিদার চাদর নিয়ে। এবং বলল, আমি এটা নিজের হাতে বুনেছি এবং আপনি তা পরবেন- এজন্য নিয়ে এসেছি। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা এমনভাবে গ্রহণ করলেন যে, চাদরটি তাঁর প্রয়োজন। এরপর তা পরিধান করে তার কাছে এলেন। তখন একজন আরজ করলেন, এটি তো খুব সুন্দর; এটি আমাকে দিয়ে দিন। অন্যরা তাকে বললেন, তোমার কাজটি ঠিক হয়নি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা পরিধান করেছেন এমনভাবে যে, এটি তাঁর প্রয়োজন। আর তোমার জানা আছে যে, তিনি যাঞ্চাকারীকে ফেরান না। ঐ সাহাবী বললেন, আমি তা পরার জন্য চাইনি বরং এজন্য চেয়েছি যে, এটা আমার কাফন হয়। সাহ্ল রা. বলেন, চাদরটি তার কাফন হয়েছিল।। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১২৭৭

আব্দুল্লাহ আল হাওযানী বলেন, হালাব শহরে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মুয়াযযিন বিলাল রা.-এর সাথে আমি সাক্ষাৎ করি। আমি তাঁকে বললাম, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খরচ নির্বাহ কীভাবে হত তা আমাকে জানান। তিনি বললেন, তাঁর তো কিছুই ছিল না। তাঁর কাছে যখন বস্ত্রহীন কোনো মুসলিম আসত তিনি আমাকে আদেশ করতেন, আমি ধার কর্জ করে তাঁর খাবার ও পোষাকের ব্যবস্থা করতাম। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩০৫৫; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩৩৫১

এরপর কুরআন মাজীদের শিক্ষা এবং সুন্নাহ ও সীরাতের সাহচর্যে যে জামাত গড়ে ওঠেছিল তাঁদের জীবনে পরার্থপরতার এমন সব দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়, যার তুলনা খুব বিরল। কুরআন মাজীদে তাঁদের প্রশংসা করে বলা হয়েছে-

وَ یُطْعِمُوْنَ الطَّعَامَ عَلٰی حُبِّهٖ مِسْكِیْنًا وَّ یَتِیْمًا وَّ اَسِیْرًا اِنَّمَا نُطْعِمُكُمْ لِوَجْهِ اللهِ لَا نُرِیْدُ مِنْكُمْ جَزَآءً وَّ لَا شُكُوْرًا.

তারা আল্লাহর ভালবাসায় মিসকীন, ইয়াতীম ও বন্দীদেরকে খাবার দান করে, (এবং বলে) আমরা তো তোমাদেরকে খাওয়াই কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে, আমরা তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান চাই না এবং কৃতজ্ঞতাও না। -সূরা দাহর (৭৬) : ৮-৯

কুরআন মাজীদের আরেক জায়গায় এসেছে ঐ মহান জামাতের প্রসঙ্গ, যারা ‘আনসার’ নামে অভিহিত, তাদের ত্যাগ ও পরার্থপরতার সমতুল্য নযীর পাওয়া দুষ্কর। কুরআন মাজীদ তাদের সম্পর্কে বলেছে-

یُحِبُّوْنَ مَنْ هَاجَرَ اِلَیْهِمْ وَ لَا یَجِدُوْنَ فِیْ صُدُوْرِهِمْ حَاجَةً مِّمَّاۤ اُوْتُوْا وَ یُؤْثِرُوْنَ عَلٰۤی اَنْفُسِهِمْ وَ لَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ وَ مَنْ یُّوْقَ شُحَّ نَفْسِهٖ فَاُولٰٓىِٕكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ.

আনসারগণ মুহাব্বত করেন মুহাজিরদের। তাদেরকে (ফাই-এর সম্পদ থেকে) যা দেয়া হয় সে ব্যাপারে নিজেদের অন্তরে তারা কোনো চাহিদা বোধ করেন না এবং তারা  নিজেদের উপর প্রাধান্য দেন। যদিও তাদের প্রয়োজন থাকে। আর যারা স্বভাবগত কার্পণ্য হতে মুক্তি লাভ করে তারাই তো সফলকাম। -সূরা হাশর (৫৯) : ৯

আনাস ইবনে মালিক রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন-

لَمَّا قَدِمَ النَّبِيُّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْمَدِينَةَ أَتَاهُ الْمُهَاجِرُونَ فَقَالُوا: يَا رَسُولَ اللهِ، مَا رَأَيْنَا قَوْمًا أَبْذَلَ مِنْ كَثِيرٍ وَلاَ أَحْسَنَ مُوَاسَاةً مِنْ قَلِيلٍ مِنْ قَوْمٍ نَزَلْنَا بَيْنَ أَظْهُرِهِمْ، لَقَدْ كَفَوْنَا الْمُؤْنَةَ وَأَشْرَكُونَا فِي الْمَهْنَإِ حَتَّى لَقَدْ خِفْنَا أَنْ يَذْهَبُوا بِالأَجْرِ كُلِّهِ. فَقَالَ النَّبِيُّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : لاَ مَا دَعَوْتُمُ اللَّهَ لَهُمْ وَأَثْنَيْتُمْ عَلَيْهِمْ.

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মদীনায় আগমনের পর মুহাজিরগণ তাঁর কাছে এসে বললেন, আল্লাহর রাসূল! প্রাচুর্যের সময় খরচ করতে আর সংকটের মধ্যেও সহানুভূতি করতে এই কওমের চেয়ে অগ্রগামী আর কোনো কওম দেখিনি, যাদের মাঝে আমরা এসেছি। তারা আমাদের ভার নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছেন আর খুশি-আনন্দে আমাদের শামিল করেছেন। এমনকি আমাদের আশঙ্কা হচ্ছে যে, সকল ছওয়াব তারাই নিয়ে যাবেন।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা তাদের জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করতে থাক এবং তাদের প্রশংসা করতে থাক। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৪৮৭

ইমাম বুখারী রাহ. সহীহ বুখারীতে এক ঘটনা উল্লেখ করেছেন। হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন-

“এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে এসে তার কষ্টের কথা বললেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের ঘরে বিবিদের কাছে খোঁজ নিলেন। কিছু না পেয়ে সাহাবীদের বললেন, কে আছে এই রাতের জন্য তার মেহমানদারী করবে; আল্লাহ তাকে রহম করবেন। এক আনছারী দাঁড়িয়ে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আছি। এরপর আগন্তককে নিয়ে ঘরে গেলেন এবং স্ত্রীকে বললেন, ইনি আল্লাহর রাসূলের মেহমান। যা আছে তার জন্য হাজির কর।

স্ত্রী বললেন, বাচ্চাদের খাবার ছাড়া আর কিছু নেই। সাহাবী বললেন, তারা যখন খাবার চাইবে (আদর করে) তাদের ঘুম পাড়িয়ে দিয়ো এবং (আমরা যখন খাবারে বসব) তুমি এসে বাতি নিভিয়ে দিয়ো। (যাতে মেহমান বুঝতে না পারেন যে, আমি তার সাথে কেবল খাওয়ার ভান করছি, খাচ্ছি না) স্ত্রী তাই করলেন।

আনসারী সকাল বেলা যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ  করলেন, আল্লাহ তাআলা ‘ফুলান’ (তলহা রা.) ও তার স্ত্রীর প্রতি হেসেছেন। এরপর আল্লাহ তাআলা এই আয়াত নাযিল করেন-

وَ یُؤْثِرُوْنَ عَلٰۤی اَنْفُسِهِمْ وَ لَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ

এবং তারা নিজেদের উপর প্রাধান্য দেয় যদিও তাদের প্রয়োজন থাকে। -সহীহ বুখারী, ১০/৬৫, হাদীস ৪৮৮৯

ইনফাক ফী সাবীলিল্লাহ

ইসলামের সমাজ-বিধির এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ‘ইনফাক ফী সাবীলিল্লাহ’ আল্লাহর পথে খরচ করা। সূরাতুল বাকারার শুরুতে ‘মুত্তাকী’দের পরিচয়- প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে- وَ مِمَّا رَزَقْنٰهُمْ یُنْفِقُوْنَ

আর আমি তাদের যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে খরচ করে। -সূরা বাকারা (২) : ২

সম্পদের ব্যাপারে একজন মুমিনের দৃষ্টিভঙ্গি এটাই হবে যে, সম্পদ আল্লাহর দান। আর আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে তাঁর হুকুম মোতাবেক খরচ করার অর্থ নিজের জন্য সঞ্চয় করা।

ইরশাদ হয়েছে-

وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ خَيْرٍ يُوَفَّ إِلَيْكُمْ وَأَنْتُمْ لَا تُظْلَمُونَ

যে ধনসম্পদ তোমরা ব্যয় কর তার পুরস্কার তোমাদেরকে পুরোপুরি ভাবে দেওয়া হবে এবং তোমাদের প্রতি অন্যায় করা হবে না। -সূরা বাকারা (২) : ২৭২

‘ইনফাক ফী সাবীলিল্লাহ’ তথা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী খরচের ক্ষেত্র অনেক বিস্তৃত। নিজের ও পরিবারের ভরণ-পোষণ, বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজনের প্রয়োজন পূরণ, এতিম-মিসকীনের জন্য খরচ প্রভৃতি ‘ইনফাক ফী সাবীলিল্লাহ’র বিভিন্ন ক্ষেত্র।

তেমনি দ্বীনী শিক্ষা-দীক্ষার বিস্তার, দ্বীনের নুসরত ও প্রতিষ্ঠার সকল অঙ্গন ইনফাক ফী সাবীলিল্লাহর ক্ষেত্র। এককথায় আল্লাহর সন্তষ্টির জন্য আল্লাহর হুকুম মোতাবেক সম্পদ খরচ করা ইনফাক ফী সাবীলিল্লাহ।

সম্পদের ব্যাপারে ইসলাম যেমন এই শিক্ষা দিয়েছে যে, সম্পদের মালিক আল্লাহ। তিনি বান্দাকে সম্পদ দান করেছেন এবং তা ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন তেমনি এই শিক্ষাও দান করে যে, সম্পদশালীর সম্পদে রয়েছে বঞ্চিতের হক ও অধিকার। সুতরাং সেই হক তাদের পৌঁছে দিতে হবে। ইরশাদ হয়েছে-

وَ الَّذِیْنَ فِیْۤ اَمْوَالِهِمْ حَقٌّ مَّعْلُوْمٌ  لِّلسَّآىِٕلِ وَ الْمَحْرُوْمِ

এবং (নিন্দিত তারা নয় যারা মনে করেন) তাদের সম্পদে নির্দিষ্ট হক রয়েছে যাচক ও বঞ্চিতদের। -সূরা মা‘আরিজ  (৭০) : ২৪-২৫

সম্পদের ব্যাপারে এই কুরআনী শিক্ষামালার বিস্তারিত ব্যাখ্যা রয়েছে সুন্নাহ ও সীরাতে। এই দৃষ্টিভঙ্গি একজন মুমিনকে সম্পদের দ্বারা প্রতারিত ও মোহগ্রস্ত হওয়া থেকে রক্ষা করে এবং তাকে সামাজিক দায়িত্ব পালনে উৎসাহিত করে।

সম্পদের ব্যাপারে যে ফরয ও অবশ্য-পালনীয় বিধানগুলো রয়েছে তন্মধ্যে একটি হচ্ছে যাকাত। যাকাত এত গুরুত্বপূর্ণ বিধান যে, স্বয়ং আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একে ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ সাব্যস্ত করেছেন। কুরআন মাজীদে একদিকে যেমন চূড়ান্ত তাকীদের সাথে এর আদেশ করা হয়েছে অন্যদিকে যে মুমিন এই বিধান পালন করে তার জন্য নিশ্চিত প্রাপ্তি ঘোষণা করেছে, যেন সে আল্লাহকে করযে হাসানা দান করছে; সুবহানাল্লাহ!

কুরআনুল কারীমে এরশাদ হয়েছে-

وَ اَقِیْمُوا الصَّلٰوةَ وَ اٰتُوا الزَّكٰوةَ وَ اَقْرِضُوا اللهَ قَرْضًا حَسَنًا  وَ مَا تُقَدِّمُوْا لِاَنْفُسِكُمْ مِّنْ خَیْرٍ تَجِدُوْهُ عِنْدَ اللهِ هُوَ خَیْرًا وَّ اَعْظَمَ اَجْرًا.

তোমরা সালাত আদায় কর, যাকাত প্রদান কর এবং আল্লাহকে দাও উত্তম ঋণ আর তোমরা নিজেদের জন্য যাই অগ্রিম পাঠাবে আল্লাহর কাছে গিয়ে তা উৎকৃষ্ট অবস্থায় মহা পুরস্কাররূপে বিদ্যমান পাবে। -সূরা মুযযাম্মিল (৭৩) : ২০

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

بُنِيَ الإِسْلاَمُ عَلَى خَمْسٍ: شَهَادَةِ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ، وَإِقَامِ الصَّلاَةِ، وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ، وَالحَجِّ، وَصَوْمِ رَمَضَانَ.

ইসলামের বুনিয়াদ পাঁচটি। এই সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল। সালাত আদায় করা, যাকাত প্রদান করা, হজ্ব করা এবং রোযা রাখা। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৬

আরো ইরশাদ হয়েছে-

فَاِنْ تَابُوْا وَ اَقَامُوا الصَّلٰوةَ وَ اٰتَوُا الزَّكٰوةَ فَاِخْوَانُكُمْ فِی الدِّیْنِ  .

যদি তারা সালাত আদায় করে, যাকাত প্রদান করে তাহলে তারা তোমাদের দ্বীনি ভাই। -সূরা তাওবা (৯) : ১১

অর্থাৎ একজন মানুষকে মুসলিম সমাজের অন্তর্ভুক্ত হতে হলে এবং মুসলিম ভ্রাতৃত্বের মর্যাদা পেতে হলে তাকে বিশ্বাসগত ও কর্মগত যে কাজগুলো করতে হবে তার অন্যতম হচ্ছে যাকাত।

হযরত জাবের রা. বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

إِذَا أَدَّيْتَ زَكَاةَ مَالِكَ أَذْهَبْتَ عَنْكَ شَرَّه.

যাকাত আদায়ের মাধ্যমে তুমি সম্পদের অনিষ্ট থেকে রক্ষা পেতে পারে। -মুস্তাদরাকে হাকেম ১/৩৯০, হাদীস ১৪৩৯

যে সম্পদশালী যাকাত দেয় না তার মর্মন্তুদ পরিণাম সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে আল্লাহর রাসূল  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

مَنْ آتَاهُ اللَّهُ مَالًا، فَلَمْ يُؤَدِّ زَكَاتَهُ مُثِّلَ لَهُ مَالُهُ يَوْمَ القِيَامَةِ شُجَاعًا أَقْرَعَ لَهُ زَبِيبَتَانِ يُطَوَّقُهُ يَوْمَ القِيَامَةِ، ثُمَّ يَأْخُذُ بِلِهْزِمَتَيْهِ -يَعْنِي بِشِدْقَيْهِ- ثُمَّ يَقُولُ أَنَا مَالُكَ أَنَا كَنْزُكَ، ثُمَّ تَلاَ : “لَا يَحْسِبَنَّ الَّذِينَ يَبْخَلُونَ… ” الآيَةَ.

যাকে আল্লাহ সম্পদ দান করেছেন, সে তার যাকাত আদায় করল না, তার সম্পদকে তার জন্যে বিষধর সাপে রূপান্তরিত করা হবে। সাপটার চোখের উপর থাকবে দুটি কালো বিন্দু। কেয়ামত দিবসে সাপটি তার গলা পেঁচিয়ে ধরবে। তারপর দুই চোয়ালে তাকে চেপে ধরে বলতে থাকবে- আমি তোমার সম্পদ। আমি তোমার সঞ্চিত ধনভান্ডার। অতপর হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই আয়াত তিলাওয়াত করেন-

وَ لَا یَحْسَبَنَّ الَّذِیْنَ یَبْخَلُوْنَ بِمَاۤ اٰتٰىهُمُ اللهُ مِنْ فَضْلِهٖ هُوَ خَیْرًا لَّهُمْ  بَلْ هُوَ شَرٌّ لَّهُمْ  سَیُطَوَّقُوْنَ مَا بَخِلُوْا بِهٖ یَوْمَ الْقِیٰمَةِ ؕ وَ لِلهِ مِیْرَاثُ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ ؕ وَ اللهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ خَبِیْرٌ۠

আর আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে যা তোমাদের দিয়েছেন তাতে যারা কৃপণতা করে তা তাদের জন্য মঙ্গল এ যেন কিছুতেই মনে না করে। না এ তাদের জন্য অমঙ্গল। যাতে তারা কৃপণতা করেছে কিয়ামতের দিন তা-ই তাদের গলার বেড়ি হবে। আসমান ও যমীনের স্বত্ত্বাধিকার একমাত্র আল্লাহরই। তোমরা যা কর আল্লাহ তা বিশেষভাবে অবহিত। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৮০

ছদকা

যাকাতের সাথে সাথেই আসে ছদাকা প্রসঙ্গ। ছদাকার মাধ্যমে আল্লাহ সম্পদে বরকত ও সমৃদ্ধি দান করেন। এরশাদ হয়েছে-

یَمْحَقُ اللهُ الرِّبٰوا وَ یُرْبِی الصَّدَقٰتِ

আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন আর যাকাতকে বর্ধিত করেন। -সূরা বাকারা (২) : ২৬৭

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

مَا نَقَصَتْ صَدَقَةٌ مِنْ مَالٍ

কোনো দান সম্পদে ঘাটতি সৃষ্টি করে না। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৮৮

বিখ্যাত তাবেয়ী হযরত মারছাদ ইবনে আব্দুল্লাহ রাহ. বলেন, আমি একাধিক সাহাবীকে বলতে শুনেছি, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাহ এরশাদ করেছেন,

إِنَّ ظِلَّ الْمُؤْمِنِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ صَدَقَتُهُ

রোজ কিয়ামতে দান-ছদকা মুমিন বান্দার উপর ছায়া হয়ে থাকবে। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৮০৪৬; সহীহ ইবনে খুজাইমা, হাদীস ২৪৩২

হযরত আনাস রা. বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

الصَّدَقَةُ تُطْفِئُ غَضَبَ الرَّبِّ، وَتَدْفَعُ مِيتَةَ السُّوءِ.

ছদাকা আল্লাহর ক্রোধ নিবারিত করে এবং অসুন্দর মৃত্যু থেকে হেফাজত করে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৬৬৪; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৩৩০৯

যাঞ্চা ও ভিক্ষাবৃত্তির নিষিদ্ধতা

হযরত হাকীম ইবনু হিযাম রা. বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

اليَدُ العُلْيَا خَيْرٌ مِنَ اليَدِ السُّفْلى، وَابْدَأْ بِمَنْ تَعُولُ، وَخَيْرُ الصَّدَقَةِ عَنْ ظَهْرِ غِنًى، وَمَنْ يَسْتَعْفِفْ يُعِفَّهُ اللهُ، وَمَنْ يَسْتَغْنِ يُغْنِهِ اللهُ.

উপরের হাত নিচের হাত অপেক্ষা উত্তম। প্রথমে তার জন্য খরচ কর, যার ভরণ-পোষণ তোমার উপর। আর উত্তম ছদকা তা, যার পর সচ্ছলতা বাকি থাকে। যে (সুয়ালের যিল্লতি থেকে) পবিত্র থাকতে চায় আল্লাহ তাকে পবিত্র রাখেন। আর যে নির্মুখাপেক্ষী থাকতে চায় আল্লাহ তাকে নির্মুখাপেক্ষী রাখেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৪২৭

সুয়ালের মন্দ পরিণাম সম্পর্কে সাবধান করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

مَا يَزَالُ الرَّجُلُ يَسْأَلُ النَّاسَ، حَتَّى يَأْتِيَ يَوْمَ القِيَامَةِ لَيْسَ  فِي وَجْهِهِ مُزْعَةُ لَحْمٍ (أي قطعته، كما في الفتح).

যে মানুষের কাছে সুয়াল করে বেড়ায় কেয়ামতের দিন সে এমনভাবে আসবে যে, তার চেহারা মাংসহীন থাকবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৪৭৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০৪০ আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা.-এর সূত্রে।

যারা নিজেদের প্রয়োজন সত্ত্বেও হাত গুটিয়ে রাখে আল্লাহ তাদের প্রশংসা করে বলেছেন-

لِلْفُقَرَآءِ الَّذِیْنَ اُحْصِرُوْا فِیْ سَبِیْلِ اللهِ لَا یَسْتَطِیْعُوْنَ ضَرْبًا فِی الْاَرْضِ ؗ یَحْسَبُهُمُ الْجَاهِلُ اَغْنِیَآءَ مِنَ التَّعَفُّفِ  تَعْرِفُهُمْ بِسِیْمٰىهُمْ  لَا یَسْـَٔلُوْنَ النَّاسَ اِلْحَافًا  وَ مَا تُنْفِقُوْا مِنْ خَیْرٍ فَاِنَّ اللهَ بِهٖ عَلِیْمٌ۠

(আর্থিক সহযোগিতার জন্য বিশেষভাবে উপযুক্ত) সে সকল গরীব যারা নিজেদেরকে আল্লাহর পথে এভাবে আবদ্ধ করে রেখেছে যে, (অর্থের সন্ধানে) তারা ভূমিতে চলাফেরা করতে পারে না, তারা অতি সংযমী হওয়ার কারণে কারো কাছে সুয়ালও করে না। তাই অনবগত লোকেরা তাদেরকে বিত্তবান মনে করে। তোমরা তাদের (বিশুষ্ক) চেহারার আলামত দ্বারা তাদেরকে চিনতে পারবে। মানুষের কাছে তারা নাছোড় হয়ে সুয়াল করে না। -সূরা বাকারা (২) : ২৭৩

পবিত্র সীরাতে ভিক্ষাবৃত্তি থেকে বাঁচার উপায়ও নির্দেশ করা হয়েছে, যার প্রথম কথা হচ্ছে, মানুষের কাছে হাত পাতা থেকে নিবৃত্ত থাকার মানসিক প্রস্তুতি। সংকল্প দৃঢ় হলে এবং আল্লাহর নুসরত প্রার্থনা করলে আল্লাহ পথ খুলে দিবেন।

দ্বিতীয় করণীয় হচ্ছে আল্লাহর উপর ভরসা করে হালাল উপার্জনের চেষ্টা করা।

হযরত যুবায়ের ইবনুল আওয়াম রা. বয়ান করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

لَأَنْ يَأْخُذَ أَحَدُكُمْ حَبْلَهُ، فَيَأْتِيَ بِحُزْمَةِ الحَطَبِ عَلَى ظَهْرِهِ، فَيَبِيعَهَا، فَيَكُفَّ اللهُ بِهَا وَجْهَهُ خَيْرٌ لَهُ مِنْ أَنْ يَسْأَلَ النَّاسَ أَعْطَوْهُ أَوْ مَنَعُوهُ.

তোমাদের কেউ রশি নিয়ে বনে গেল এবং কাঠ (কেটে) পিঠে বহন করে এনে (বাজারে) বিক্রি করল- এভাবে সে নিজের সম্ভ্রম রক্ষা করল এ তো (এই অবস্থার চেয়ে) অনেক ভালো যে, সে কারো কাছে হাত পাতল এরপর ঐ লোক তাকে দিল বা দিল না! -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৪৭১

হযরত আনাস রা. থেকে একটি দীর্ঘ ঘটনা বর্ণিত হয়েছে যে, জনৈক আনসারী রাসূলের কাছে এসে সুয়াল করলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার একমাত্র সম্বল একটি কম্বল ও পেয়ালা বিক্রি করে কুঠার কিনে দিলেন এবং নিজের হাতে তাতে হাতল লাগিয়ে তাকে বনে পাঠিয়ে দিলেন। কয়েক দিন পর আনসারী দশ দেরহাম নিয়ে এলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাপড় ও খাবার কিনে তার হাতে দিলেন এবং বললেন, “রোয কিয়ামতে ভিক্ষার ছাপ নিয়ে ওঠার চেয়ে এই অবস্থাটা তোমার জন্য অনেক ভালো। শোন! শুধু তিন ব্যক্তি চাইতে পারে :

যে চরম ক্ষুধিত ও দারিদ্র-পীড়িত।

যে ঋনের ভারে ন্যুজ।

এবং যে রক্তপণ আদায়ে ব্যর্থ। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১২১৩৪; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৬১৪;  সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ২১৯৮

তো পবিত্র সীরাতে দু‘টো শিক্ষাই খুব গুরুত্বের সাথে রয়েছে : সম্পদশালীদের আদেশ করা হয়েছে সম্পদের ব্যাপারে মোহগ্রস্ত না হয়ে আখিরাতের সঞ্চয়ে আগ্রহী হতে। আর অভাবীদের আদেশ করা হয়েছে মানুষের কাছে হাত না পেতে মেহনত করে জীবিকা উপার্জন করতে।

সীরাতের এই শিক্ষার অনুসরণ করা হলে একদিকে যেমন সমাজ থেকে দারিদ্র্য বিদায় নেবে অন্যদিকে শান্তি-শৃঙ্খলার পাশাপাশি প্রত্যেক শ্রেণির মানুষের মানবীয় মর্যাদাও রক্ষিত হবে।

ইসলামের এক যাকাত-ব্যবস্থা যদি শতভাগ বাস্তবায়িত হয় তাহলে আল্লাহর রহমতে সমাজ থেকে চরম দারিদ্র্য নির্মূল হয়ে যেতে পারে।

এ শুধু অনুমান নয়। ইসলামের ইতিহাসে এর বাস্তব দৃষ্টান্তও রয়েছে। একটি মাত্র বর্ণনা দেখুন :

হযরত ওমর ইবনু উসাইদ রাহ. বলেন, ওমর ইবনে আব্দুল আজীজ ত্রিশ মাস রাজত্ব করেছেন। খোদার কসম, তিনি এমন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন যে, লোকেরা আমাদের কাছে সম্পদ নিয়ে এসে বলতো-

اجْعَلُوا هَذَا حَيْثُ تَرَوْنَ فِي الْفُقَرَاءِ فَمَا يَبْرَحُ حَتَّى يَرْجِعَ بِمَالِهِ يَتَذَكَّرُ مَنْ يَضَعُهُ فِيهِمْ فَلَا يَجِدُهُ فَيَرْجِعُ بِمَالِهِ.

قَدْ أَغْنَى عُمَرُ بْنُ عَبْدِ الْعَزِيزِ النَّاسَ.

এই সম্পদ তোমরা দরিদ্র লোকদের যাকে খুশী বণ্টন করে দাও। কিন্তু গ্রহণ করার মত কাউকে পেত না। কারণ ওমর ইবনে আব্দুল আজীজ মানুষকে ধনী বানিয়ে রেখে গেছেন। -দালাইলুন নুবুওয়াহ, বায়হাকী ৬/৪৯৩; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৫/৫৮৯; ফাতহুল বারী ১৩/১০৮ (৭১২০)

ইসলাম শুধু কর্তব্য পালন, অন্যের হক আদায় ও যুলুম থেকে বিরত থাকার সাধরণ তাকিদই করেনি। যে সকল উপায়ে অন্যের হক লুণ্ঠন করা হয় অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে হস্তগত করা হয়, এই সকল উপায়কেও হারাম ও নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-

وَلَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ وَتُدْلُوا بِهَا إِلَى الْحُكَّامِ لِتَأْكُلُوا فَرِيقًا مِنْ أَمْوَالِ النَّاسِ بِالْإِثْمِ وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ.

তোমরা পরস্পর একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করো না এবং বিচারকের কাছে সে সম্পর্কে এই উদ্দেশ্যে মামলা রুজু করো না যে, মানুষের সম্পদের কোনো অংশ জেনে শুনে পাপের পথে গ্রাস করবে। -সূরা বাকারা (২) : ১৮৮

ঘুষ ও উৎকোচ গ্রহণ হারাম ও কবীরা গুনাহ

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আম্র রা. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘুষদাতা ও গ্রহীতা উভয়কেই লা’নত করেছেন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৯০৩১; জামে তিরমিযী, হাদীস ১৩৩৬; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৫৮০; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৫০৭৬; মুসতাদরাকে হাকেম ৪/১৩০

হযরত ছাওবান রা. বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘুষদাতা, গ্রহিতা ও উভয়ের মাঝে মধ্যস্থতাকারীকে লা’নত করেছেন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২২৩৯৯; আলমুজামুল কাবীর, তবারানী, হাদীস ১৪১৫

হযরত উম্মে সালামা রা. বলেন, বিচারাচারের ক্ষেত্রে যারা ঘুষের লেনদেন করে উভয়কে আল্লাহ লা‘নত করেছেন। -আল মুজামুল কাবীর তবারানী, হাদীস ৯৫১

হযরত আমর ইবনুল আছ রা. বলেন,

سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: مَا مِنْ قَوْمٍ يَظْهَرُ فِيهِمُ الرِّبَا، إِلَّا أُخِذُوا بِالسَّنَةِ، وَمَا مِنْ قَوْمٍ يَظْهَرُ فِيهِمُ الرُّشَا، إِلَّا أُخِذُوا بِالرُّعْبِ.

আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে জাতির মাঝে সুদের বিস্তার ঘটে তারা দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত হয়। আর যাদের মাঝে ঘুষের বিস্তার ঘটে তাদের শংকাগ্রস্ত করা হয়। -মুসনাদে আহমাদ ৪/২০৫, হাদীস ১৭৮২২

এক দীর্ঘ হাদীসে সুদখোরের পরিমাণ বর্ণনা করে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

حَتّى أَتَيْنَا عَلَى نَهَرٍ مِنْ دَمٍ فِيهِ رَجُلٌ قَائِمٌ وَعَلَى وَسَطِ النَّهَرِ رَجُلٌ بَيْنَ يَدَيْهِ حِجَارَةٌ، فَأَقْبَلَ الرَّجُلُ الَّذِي فِي النَّهرِ، فَإِذَا أَرَادَ الرَّجُلُ أَنْ يَخْرُجَ رَمَى الرَّجُلُ بِحَجَرٍ فِي فِيهِ، فَرَدَّهُ حَيْثُ كَانَ، فَجَعَلَ كُلَّمَا جَاءَ لِيَخْرُجَ رَمَى فِي فِيهِ بِحَجَرٍ، فَيَرْجِعُ كَمَا كَانَ، فَقُلْتُ مَا هَذَا؟ فَقَالَ: الَّذِي رَأَيْتَهُ فِي النَّهَرِ آكِلُ الرِّبَا.

এরপর আমরা এক রক্তের নদীর কাছে এলাম, যার কিনারায় এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছে, যার সামনে অনেক পাথর। নদীর মাঝে এক লোককে দেখা যাচ্ছে, সে যখনই কিনারায়ঝ এসে (ঐ রক্তের নদী থেকে) বের হতে চায় কিনারায় দাঁড়ানো লোকটি তার মুখে পাথর নিক্ষেপ করে, ফলে সে আবার আগের জায়গায় ফিরে যেতে বাধ্য হয়। এভাবে যখনই সে বের হতে চায় তখনই তাকে পাথর মেরে ফিরে যেতে বাধ্য করা হয়। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এটা কী? ফেরেশতা বললেন, যাকে নদীর মধ্যে দেখছেন ও হচ্ছে সুদখোর। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২০৮৫

এককথায় অন্যায়ভাবে মানুষের অর্থ-সম্পদ গ্রাস করার যত উপায় আছে চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই রাহাজানি, সুদ-ঘুষ, জুয়া-দুর্নীতি সবকিছুই ইসলামে হারাম ও নিষিদ্ধ।

একইসাথে ইসলামী রাষ্ট্র-ব্যবস্থায় এসবের জন্য রয়েছে  কঠিন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা।

জুমাদাল উখরা ১৪৩৮ – মার্চ ২০১৭

মাসিক আলকাউসার