সিপাহি বিদ্রোহ : ভুলে যাওয়া রক্তের ইতিহাস

ভারতের ইতিহাসে ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দটা এক উত্তাল সময়৷ ইংরেজ সরকারের নানাবিধ হঠকারিতা ও জুলুমের বিরুদ্ধে এ সময়টায় সেনা ব্যারাকে জেগে ওঠে বিদ্রোহ।

সমগ্র ভারতজুড়ে তখন নেতৃত্বের সংকট। সর্বত্রই বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিদিন নতুন নতুন সংকট দেখা দিচ্ছে। কিন্তু ইংরেজদের বিরুদ্ধে মজলুম জনতার পুঞ্জীভূত ক্ষোভ কোথাও প্রকাশিত হতে পারছে না৷ এই সময়টায় সর্বশেষ মোগল সম্রাট বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফর দিল্লির একটি বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। মিরাট থেকে ৩০০ জনের একটি বিদ্রোহী দল এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করে৷ তাঁরা বাহাদুর শাহ জাফরকে এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিতে বললে তিনি রাজি হন। কিন্তু আন্দোলনে চূড়ান্ত মাঠে নামার আগেই মার্চ মাসের ৯ তারিখ ইংরেজ সরকারের ষড়যন্ত্রমূলক এক রায়ে রেঙ্গুনে তাঁর নির্বাসন হয়ে যায়। বিপ্লব মাঠে গড়ায় মার্চের ২৯ তারিখ। এরপর ১৮৫৭ সালের জানুয়ারিতে মিরাট ও ব্যারাকপুরে শুরু হওয়া বিদ্রোহ সমগ্র ভারতে ছড়িয়ে পড়ে।

ইংরেজরা উপমহাদেশের ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছিল মুসলিমদের হাত থেকে৷ জগত শেঠ, উমি চাঁদ, বাবু কৃষ্ণচাঁদ, মীর জাফর, রায় দুর্লভ–এদের বিশ্বাসঘাতকতায় পরাস্ত হন নবাব সিরাজুদ্দৌলা। ইংরেজ সরকার ভালোভাবেই জানত, ভারতে মুসলিমদের ক্ষমতা ফেরানোর দায় আছে। হারানো মুকুট মুসলমান যেকোনো মূল্যে ফিরিয়ে আনতে চাইবে। এবং বাস্তবেও তারা সোচ্চার ছিল৷ ইংরেজদের সঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল বিরোধ ছিল কেবল মুসলমানদের সঙ্গে৷ উচ্চবিত্ত হিন্দুদের সম্পদের মোহে ফেলে বিদ্রোহ থেকে বিমুখ করে রাখা গিয়েছিল৷ এবং নিম্নবিত্তদের বিদ্রোহের সক্ষমতা ছিল না। কালক্রমে নিরানব্বই বছর ধরে চলতে থাকা এই মুসলিম আন্দোলন যখন সর্বভারতীয় বিপ্লবে রূপ নেয়, তখন ঐতিহাসিকরা কুটিলতার আশ্রয় নেন। এবং এর নাম দেন সিপাহি বিদ্রোহ৷ এই বিদ্রোহের পরই প্রথমবারের মতো ব্যাপকভাবে হিন্দুদের টনক নড়ে ওঠে। এর আগ পর্যন্ত আন্দোলন, জেল-জুলুম, নির্বাসন, ফাঁসি–এগুলি শুধু মুসলিমদের জন্যই ছিল।

সিপাহি বিদ্রোহের পর যেই বিভীষিকা নেমে এসেছিল, তা আরও করুণ। কেবল ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহেই দুই লাখ মুসলমান শাহাদাত বরণ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে কেবল আলেমদের সংখ্যাই ছিল ৫১ হাজার ৫০০! খুব পরিকল্পিত এবং নৃশংসভাবে আলেমদের একটা বিরাট অংশকে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছিল।

এডওয়ার্ড টমাস বলেন, ‘শুধু দিল্লিতেই ৫০০ আলেমকে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল। শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসান দেওবন্দি রহ.-এর রেশমি রুমাল আন্দোলনের পর ষড়যন্ত্র করে হজরত শায়খুল হিন্দ এবং চার সাথি শাগরেদ হোসাইন আহমদ মাদানি, মাওলানা ওজায়ের গুল, মাওলানা হাকিম সুনারাত হুসাইন, মৌলভি ওয়াহিদ আহমদকে সাড়ে তিন বছর মাল্টায় বন্দী করে রাখা হয়। এছাড়াও বহু আলেমকে তারা মাল্টায়, আন্দামানে, সাইপ্রাসে নির্বাসন দেয়। নির্বাসন-জীবনে তাঁদের ওপর যে অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়, এক হৃদয়বিদারক করুণ কাহিনি, এক দীর্ঘ ইতিহাস। এভাবে আলেম সমাজকে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে সমূলে উৎখাত করার জন্য অত্যাচার ও নির্যাতনের বিভিন্ন কৌশল ইংরেজরা অবলম্বন করে।

১৮৫৭ সালের ১৮ই নভেম্বর দিল্লির জামে মসজিদের আঙিনায় একই দিনে তারা ২৭ হাজার মুসলমানকে হত্যা করে। পাষণ্ড ইংরেজরা মুসলমানদের যখন হত্যা করত, তখন শুকরের চামড়ার মধ্যে পুরে সেলাই করে দিত এবং হত্যার পূর্বে শুকরের চর্বি গায়ে মাখিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিত।

লেফটেন্যান্ট মাশুজী লিখেছেন, ‘একজন মুসলিম সিপাহির মুখমণ্ডল সংগীনের আঘাতে ক্ষত বিক্ষত করা হয়, তারপর তাকে অল্প আগুনে ভুনা হয়। জ্বলন্ত মানুষের দুর্গন্ধে আমার মাথা ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল।’

খাজা হাসান নিজামি লিখেছেন, ‘হাজার হাজার মুসলিম নারী ইংরেজদের পৈশাচিক নির্যাতনের ভয়ে নিজেদের কূপে নিক্ষেপ করে আত্মহত্যা করেছে। অনেক পুরুষ তো নিজের স্ত্রীকে হত্যা করে নিজেও আত্মহত্যা করেছে।’

সকল যুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গেই শোকাবহ রক্তের দাগ লেগে থাকে। কিন্তু ভারত স্বাধীনতার সঙ্গে কেবল রক্তই নয়, অসততা এবং নিমকহারামির দাগও লেগে আছে। সিরাজুদ্দৌলার ক্ষমতাচ্যুতির পর অনেক দিন কেটে গেছে। ইতিহাস রচিত হয়েছে ক্ষমতাসীনদের হাতে। মুসলমানের রক্তে ভারতের মাটি যতই ভিজে থাক, ইতিহাসের পাতায় মুসলমানদের অবদানের অধ্যায়টি ক্রমশ বিবর্ণ থেকে বিবর্ণতর হয়ে যাচ্ছে।


কাজী মাহবুবুর রহমান
মূলঃ fateh24