১৬তম পর্ব – একটি সুন্নাহকে বাঁচাবো বলে – কিয়ামুল লাইল – শায়খ আতিক উল্লাহ


কিয়ামুল লাইল

কিছু আমল আছে, রাব্বে কারীম খুউব পছন্দ করেন। আম্বিয়ায়ে কেরাম পছন্দ করেন। আল্লাহর প্রিয় বান্দাগন পছন্দ করেন। কিয়ামুল লাইল তেমন এক আমল। কুরআন কারীম ও হাদীস শরীফে তাহাজ্জুদের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। তাহাজ্জুদের মতো আমলের সংখ্যা বেশি নেই। ঐচ্ছিক হলেও, ফযীলতে অনেক এগিয়ে। কুরআন কারীমে অন্য কোনও নফল আমল সম্পর্কে এতটা গুরুত্বের সাথে আলোচনা করা হয়নি,
(এক) রাতের কিছু অংশ তাহাজ্জুদ পড়বেন, যা আপনার জন্যে এক অতিরিক্ত ইবাদত। আশা করা যায় আপনার প্রতিপালক আপনাকে ‘মাকামে মাহমুদ’-এ পৌঁছাবেন (ইসরা ৭৯)।
وَمِنَ اللَّيْلِ فَتَهَجَّدْ بِهِ نَافِلَةً لَّكَ عَسَى أَن يَبْعَثَكَ رَبُّكَ مَقَاماً مَّحْمُوداً
(দুই) (রাতের বেলা) তাদের পাশর্^দেশ বিছানা থেকে পৃথক হয়ে যায় এবং তারা নিজ প্রতিপালককে ভয় ও আশার (মিশ্রিত অনুভূতির) সাথে ডাকে (সাজদা ১৬)।
تَتَجَافَى جُنُوبُهُمْ عَنِ الْمَضَاجِعِ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ خَوْفاً وَطَمَعاً
(তিন) তারা রাতে কমই ঘুমাত এবং তারা সাহরীর সময় ইস্তিগফার করত (যারিয়াত ১৭-১৮)।
كَانُوا قَلِيلًا مِّنَ اللَّيْلِ مَا يَهْجَعُونَ وَبِالْأَسْحَارِ هُمْ يَسْتَغْفِرُونَ
(চার) তবে কি (এরূপ ব্যক্তি সেই ব্যক্তির সমতুল্য হতে পারে,) যে রাতের মুহূর্তগুলোতে ইবাদত করে, কখনও সিজদাবস্থায়, কখনও দাঁড়িয়ে, যে আখেরাতকে ভয় করে এবং নিজ প্রতিপালকের রহমতের আশা করে? (যুমার ৯)।
أَمَّنْ هُوَ قَانِتٌ آنَاءَ اللَّيْلِ سَاجِدًا وَقَائِمًا يَحْذَرُ الْآخِرَةَ وَيَرْجُو رَحْمَةَ رَبِّهِ ۗ
(পাঁচ) (রাহমানের বান্দা হল) যারা রাত অতিবাহিত করে নিজ প্রতিপালকের সামনে (কখনও সিজদারত অবস্থায় এবং (কখনও) দন্ডায়মান অবস্থায় (ফুরকান ৬৪)।
وَالَّذِينَ يَبِيتُونَ لِرَبِّهِمْ سُجَّدًا وَقِيَامًا

নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবনে কখনো কিয়ামুল লাইল বা তাহাজ্জুদ ছাড়েননি। শত কষ্টেও তিনি এই আমল চালু রেখেছেন। আম্মাজান আয়েশা রা. বলেছেন,
لاَ تَدَعْ قِيَامَ اللَّيْلِ، فَإِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ্রكَانَ لاَ يَدَعُهُ، وَكَانَ إِذَا مَرِضَ، أَوْ كَسِلَ، صَلَّى قَاعِدًا
তুমি কিয়ামুল লাইল ছেড়ো না, আল্লাহর রাসূল (কখনোই) এই আমল ছাড়তেন না। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে অথবা অবসাদ বোধ করলে বসে বসে হলেও তাহাজ্জুদ আদায় করে নিতেন (আবদুল্লাহ বিন আবি কায়স রহ আবু দাউদ)।

তাহাজ্জুদের ব্যাপারে, নবীজি সব সময় উৎসাহ দিতেন সাহাবায়ে কেরামকে। শিথিলতা না করার তাকিদ দিতেন,
يَا عَبْدَ اللَّهِ، لاَ تَكُنْ مِثْلَ فُلاَنٍ كَانَ يَقُومُ اللَّيْلَ، فَتَرَكَ قِيَامَ اللَّيْلِ
আবদুল্লাহ, তুমি অমুকের মতো হয়ো না, সে রাত জেগে ইবাদত করতো (তাহাজ্জুদ পড়তো) পরে কিয়ামুল লাইল ছেড়ে দিয়েছে।
(আবুদল্লাহ বিন আমর বিন আস রা, মুত্তাফাক)।

বেশি পড়তে হবে না, দুই বা চার রাকাত আদায় করলেই ফযীলত অর্জন হয়ে যাবে। তবে ইচ্ছা করলে বেশিও পড়া যাবে। তাহাজ্জুদের সময় শুরু হয় ঈশার পর থেকে। শেষ হয় ফজরের সময় হওয়ার আগে। নবীজি চাইতেন তার উম্মত এই বরকতপূর্ণ সালাত নিয়মিত আদায় করুক। তিনি বলেননি, পুরো রাত জাগতে হবে, অনেক রাকাত পড়তে হবে। এমন কঠিন শর্তারোপ করেননি। যার যার সাধ্যানুযায়ী আদায় করতে বলেছেন। খুবই সহজ আমল। যে যতটুকু আদায় করবে, ততটুকুর ফযীলত লাভ করবে,
مَنْ قَامَ بِعَشْرِ آيَاتٍ لَمْ يُكْتَبْ مِنَ الغَافِلِينَ، وَمَنْ قَامَ بِمِائَةِ آيَةٍ كُتِبَ مِنَ القَانِتِينَ، وَمَنْ قَامَ بِأَلْفِ آيَةٍ كُتِبَ مِنَ المُقَنْطِرِينَ
সালাতে (তাদাব্বুরের সাথে) কেউ দশ আয়াত তিলাওয়াত করলে, তার নাম গাফেলদের তালিকায় লেখা হবে না। একশ আয়াত তেলাওয়াত করলে, তার নাম বিন¤্রদের তালিকায় লেখা হবে। একহাজার আয়াত তেলাওয়াত করলে তার নাম অগণিত সওয়াব অর্জনকারীদের তালিকায় লেখা হবে (আবদুল্লাহ বিন আমর বিন আস রা.আবু দাউদ)।

তাহাজ্জুদে কুরআন কারীম তিলাওয়াতের অনেক উপকারিতা। সাধারন সালাতে তিলাওয়াতেরও উপকারিতার শেষ নেই।
كَانَ رَسْوْلُ اللهِ إِذَا فَاتَتْهُ الصَّلاةُ مِنَ الَّليْلِ مِنْ وَجَعٍ أَوْ غَيْرِهِ صَلّى مِنَ النَّهَارِ ثِنْتَيْ عَشْرَةَ رَكْعَةً
আল্লাহর রাসূল অসুস্থতা বা অন্য কোনও কারণে রাতে কিয়ামুল লাইল আদায় করতে না পারলে, দিনের বেলা (কাযাস্বরূপ) বারো রাকাত আদায় করে নিতেন (আয়েশা রা.। মুসলিম)।

তাহাজ্জুদ হল আমারও প্রিয় রবের মাঝে সেতুবন্ধন। রবের সাথে একান্ত কিছু সময় কাটাতে চাইলে, তাহাজ্জুদ হতে পারে অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাধ্যম।
أَفْضَلُ الصَّلاةِ بَعْدَ الصَّلاةِ الْمَكْتُوْبَةِ الصَّلاةُ في جَوْفِ اللَّيْلِ،
ফরয নামাজের পর শ্রেষ্ঠ নামায হল গভীর রাতের নামায (আবু হুরায়রা রা., মুসলিম)।

يَنْزِلُ رَبُّنَا تَبَارَكَ وَتَعَالى كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا حِيْنَ يَبْقَى ثُلُثُ اللَّيْلِ الآخِرِ ، فَيَقُوْلُ : مَنْ يَدْعُوْنِيْ فَأَسْتَجِيْبُ لَه ؟ ، مَنْ يَسْأَلُنِيْ فَأُعْطِيْهِ ؟ مَنْ يَسْتَغْفِرُنِيْ فَأَغْفِرُ لَه ؟
আমাদের রব প্রতি রাতে দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন। রাতের শেষ তৃতীয়াংশ (শুরু হওয়া) পর্যন্ত অবস্থান করেন। ঘোষণা দিয়ে বলেন,
-কে আছো, আমাকে ডাকলে আমি সাড়া দেব! আমার কাছে (কিছু) চাইলে আমি দিয়ে দেব। আমার কাছে ক্ষমা চাইলে আমি ক্ষমা করে দেব (আবু হুরায়রা রা., মুত্তাফাক)

أَلا إِنَّ اللهَ عَزَّ وجَلّ يَضْحَكُ إِلى رَجُلَين ؛ رَجُلٍ قَامَ في لَيْلَةٍ بَارِدَةٍ مِنْ فِرَاشِه ولِحَافِهِ ودِثَارِه ، فَتَوَضَّأ ثُمَّ قَامَ إلى صَلاةٍ ، فَيَقُوْلُ اللهُ عَز وجَلَّ لِمَلائِكَتِهِ : ما حَمَل عَبْدِيْ هذا على ما صَنَعَ ؟ فَيَقُوْلُوْنَ : رَبَّنا رَجاءَ مَا عِنْدَكَ ، وشَفَقَةً مِّمَّا عِنْدَكَ ، فَيَقُوْلُ : فَإِنِّي قَدْ أَعْطَيْتُه ما رَجَا ، وأمَّنْتُهُ مما خَاف ، وَرَجُلٍ كَانَ فِي فِئَةٍ فَعَلِمَ مَا لَهُ فِي الْفِرَارِ ، وَعَلِمَ مَا لَهُ عِنْدَ اللَّهِ ، فَقَاتَلَ حَتَّى قُتِلَ ،
আল্লাহ তা‘আলা দুই ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে হাসেন।
(এক) মানুষটা শীতের রাতে, বিছানা, লেপ-কাঁথা ছেড়ে উঠে যায়। ওজু করে সালাতে দাঁড়ায়। তাকে আল্লাহ তা‘আলা ফিরিশতাগনকে বলেন,
-আমার বান্দাকে এমন কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করল কিসে?
-আপনার কাছ থেকে প্রাপ্তি ও করুণার আশাই তাকে এমন কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করেছে!
-সে যা আশা করেছে, আমি তাকে তা দিয়ে দিয়েছি। তাকে ভয় থেকে নিরাপদ করে দিয়েছি।
(দুই) লোকটা একদল লোকের সাথে আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধরত ছিল। আত্মরক্ষার্থে ময়দান ছেড়ে পালায়নি, আল্লাহর কাছ থেকে পুরস্কারের আশায় জীবনবাজি রেখে কিতাল চালিয়ে শহীদ হয়ে গেছে।
(ইবনে মাসউদ রা.। তাবারানী কাবীর)

অল্পকথায় তাহাজ্জুদের ফযীলত ও বরকত বলে শেষ করা যাবে না। সালাফ তাহাজ্জুদ বিষয়ে বড় বড় কিতাব লিখে গেছেন। আমরা বেশি গবেষণা বিশ্লেষণে না গিয়ে, সরাসরি তাহাজ্জুদের আমলে নিয়োজিত হয়ে যেতে পারি। তাহাজ্জুদ আমাকে সহজেই আল্লাহর কাছে পৌঁছে দেবে। নেককারদের কাতারে শামিল করে দেবে।