৭০তম পর্ব – একটি সুন্নাহকে বাঁচাবো বলে – পথের দাবী – শায়খ আতিক উল্লাহ


পথের দাবী

এখন তো শরৎ কাল। কাশফুল। পথের দাবী শব্দটার সাথেও ‘শরৎ’-জড়িয়ে আছে। তবে আমরা আজ তেমন কোনও পথের দাবী নিয়ে আসিনি! আমরা এসেছি সত্যিকারের পথের দাবী নিয়ে। নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সব সময় চেষ্টা করতেন: অন্যদেরকে কষ্ট না দিতে। সাহাবায়ে কেরামকেও নিষেধ করতেন।

মানুষকে কষ্ট দেয়ার কাজটা বিভিন্নভাবে হতে পারে। মুখের কথা দিয়ে। হাতের আঘাত দিয়ে। পা দিয়ে। চোখ দিয়ে। এছাড়া আরও অনেকভাবে আমরা অন্যকে কষ্ট দিতে পারি বা অজান্তে কষ্ট দিয়ে ফেলতে পারি!

তেমনই একটা বিষয় হলো ‘রাস্তায় বসা’। পথচারীদের পথচলাচলে বিঘ্ন ঘটিয়ে, বসে বসে আড্ডা দেয়া।
إِيَّاكُمْ وَالجُلُوسَ عَلَى الطُّرُقَاتِ!” فَقَالُوا: مَا لَنَا بُدٌّ، إِنَّمَا هِيَ مَجَالِسُنَا نَتَحَدَّثُ فِيهَا. قَالَ:”فَإِذَا أَبَيْتُمْ إِلاَّ المَجَالِسَ، فَأَعْطُوا الطَّرِيقَ حَقَّهَا”. قَالُوا: وَمَا حَقُّ الطَّرِيقِ؟ قَالَ: “غَضُّ البَصَرِ، وَكَفُّ الأَذَى، وَرَدُّ السَّلاَمِ، وَأَمْرٌ بِالْمَعْرُوفِ، وَنَهْيٌ عَنِ المُنْكَرِ
-সাবধান! তোমরা রাস্তাঘাটে বসো না।
-আমাদের যে রাস্তায় না বসে উপায় নেই? রাস্তাই আমাদের বসার জায়গা! সেখানে বসে বসে আমরা আলাপ-আলোচনা করি!
-যদি রাস্তার ওপর নিতান্ত বসতেই হয়, তাহলে পথের ‘হক’ আদায় করো!
-পথের ‘হক’ কী?
-দৃষ্টি অবনত রাখা। অন্যকে কষ্টদানে বিরত থাকা। সালামের জবাব দেয়া। সৎ কাজের আদেশ করা। অসৎ কাজে নিষেধ করা (বুখারী )।

নবীজি পথের ওপর বসতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু অতীব প্রয়োজনে শর্তসাপেক্ষে বসার অনুমতিও দিয়েছেন। আর রাস্তায় বসা মানে এই নয়, পুরো রাস্তা দখল করে বসা। মোটাদাগে গাড়ি-ঘোড়া চলাচলের ‘ফুরসৎ’ তো থাকতেই হবে! আমি রাস্তার এমাথা-ওমাথা দখল করে বসে গেলাম, আর এদিকে যানজট-জনজট লেগে গেলো, এটা কিছুতেই যৌক্তিক আচরণ হতে পারে না।

নবিজী পথের ওপর বসতে নিষেধ করেছেন। আবার অনুমতি দিয়েছেন: অন্যকে কষ্ট না দেয়ার কড়ারে! রাস্তা দখল করে মিটিং-মিছিল করলে যদি জনমানুষের কষ্ট হয়, সেটা অনেক বড় গুনাহ হয়ে যাবে। পীরানে পীরের আজীমুশশান ‘নূরানী’ মাহফিল হলেও, গুনাহ হবে! সামান্যমত গুনাহ করে, ইয়াব্বড় সওয়াব কামাবার অনুমতি ইসলাম দেয় না।

পথের ধারে বসতে নিষেধ করা হয়েছে, মানুষ ও সমাজের শান্তি ও নিরাপত্তাবিধানের জন্যে। এই হাদীসের আওতায় আরও কিছু বিষয়ও এসে যাবে:
পাড়ার রোয়াকে বা গলির মুখে চা-দোকানে বসে বসে মানুষ গোনা, কে যায় কে আসে তা লক্ষ্য করা, তাদেরকে নিয়ে কটুকাটব্য করা, মেয়েদেরকে দেখে ‘টীজ’ করা!
ঈযায়ে মুসলিম!

এমনকি আমি মসজিদে পরে এসে, জায়গা না পেয়ে মসজিদের দরজায় দাঁড়িয়ে গেলাম, মাসবুক হওয়ার কারনে সালামের পর দাঁড়িয়ে লম্বা কেরাত ধরলাম! এদিকে মানুষ বের হতে পারছে না। এটাও সুন্নাহবিরোধী কাজ!

ওজুখানায় প্রচন্ড ভীড়, একেকটা আসনের পেছনে তিনজন করে প্রার্থী দাঁড়ানো, আর এদিকে আমি মেসওয়াক করছি, ঢিমে তেতালায় গলা পরিষ্কার করছি, নাক ঝাড়ছি! একেক অঙ্গকে পাঁচবার করে ধুচ্ছি, আর দাঁড়ির ভেতর পারলে শ্যালো মেশিনই চালিয়ে দিই আর কি! আরে তুই কি ওজু করতে বসেছিস নাকি গোসল করতে? জামাত দাঁড়িয়ে গেছে, আর উনি ওজু প্রসব করছেন! এটাও অন্যের পথকে আটকে রাখার দোষে দুষ্ট হওয়ার আওতায় আসতে পারে!

আমি পরে এসে জামাত পেলাম না। একাকী নামাযের নিয়্যত বাঁধলাম। সামনের জন জামাতের সাথে নামাজ পড়ে, সুন্নাতের আখেরী বৈঠকে আছেন। আমি তার ঠিক পেছনে গিয়েই শুরু করলাম। এদিকে ও বেচারা নামাজ শেষ করে বসে আছে, বের হতে পারছে না। আর আমার নামাজে সে কি ‘খুশু-খুযু’! কি রে খেয়াল করে খালি জায়গায় দাঁড়াতে পারলি নে? এটাও অন্যকে কষ্ট দেয়ার তালিকায় আসতে পারে!

দোতলার ছাদে বসে ফুরফুরে মেজাজে পান চিবুতে চিবুতে ওয়াক থোঃ করে নিচের রাস্তায় পিচিক করে পিক ফেললাম, অফিসে যাওয়ার সময় বাসার ময়লার ঝুড়ি নিয়ে রাস্তার পাশে ফেলে দিলাম! বিকট আওয়াজ করে গলার কফের ঘিনঘিনে বিশাল দলা রাস্তায় ফেললাম, সিগারেটের গোড়ালি না নিভিয়েই রাস্তায় ফেলে রাখলাম— এককথায় অন্যকে কষ্ট দেয়া!

বাড়ি যাওয়ার সময়, বাড়ি থেকে ফেরার সময় পুকুরের মাছ থেকে শুরু করে, খোঁয়াড়ের ঝিমুনি ধরা মোরগ, নিজ ক্ষেতের মসুর ডাল সব নিয়ে ব্যাগ হয়েছে দশটা! বাসের বক্সে দেয়ার পর আরও অসংখ্য ব্যাগ হাতে রয়ে গেছে! ব্যাগগুলো রাখা হয়েছে বাসের করিডোরে! পেছনের যাত্রীদেরকে যেতে ব্যাঙের মতো লাফিয়ে! এর মধ্যে মোরগটা পলিথিনের বাইরে মাথা বের করে কক করতে শুরু করেছে, একটু ‘ইয়েও’ করে দিয়েছে!
পরিষ্কার ‘ঈযায়ে মুসলিম’। মানুষকে কষ্ট দেয়া!

বাড়ির নারিকেলের খোসা, পাটগাছের ‘খড়ি’, ধানের খড়, শুকোনোর জায়গা নেই! সরকারী রাস্তা আছে না? ওখানেই মেলে দাও! যাত্রীবাহী বাস যাওয়ার সময় অগত্যা ব্রেক কষতে হয়! ঝাঁকির চোটে যাত্রীদের পেট থেকে প্রথম দিন খাওয়া ‘শালদুধ’টুকু বেরিয়ে আসার উপক্রম!
ঈযায়ে মুসলিম!

সরু গলি দিয়ে হেলেদুলে হাঁটছে তো হাঁটছেই, সিগারেট ফুঁকছে! একেবারে রাস্তার মাঝ বরাবর! দু’দিকের মানুষেরই চলাচলে কষ্ট হচ্ছে! সিঁড়ি বেয়ে নামছে, ফোন এলো আচানক! ব্যস অমনি দাঁড়িয়ে তিনি গুজগুজ শুরু করলেন! পেছনে মানুষের লম্বা লাইন!
ঈযায়ে মুসলিম! পথের দাবী নষ্ট!

লোকটা হাঁটছে, একবার ডানদিকে যায়, আরেকবার বামদিকে! নাক বরাবর থাকছে না! খালি ‘রুট’ পাল্টাচ্ছে! পেছন থেকে বা সামনে থেকে আসা পথচারীদের গতি বারবার ব্যহত হচ্ছে! আরে ব্যাটা নির্দিষ্ট এক ছক ধরে হাঁট না!
ঈযায়ে মুসলিম!

ব্যস্ত রাস্তা আটকে রেখেই উনি ‘ইউটার্ন’ নিচ্ছেন! পুলিশ নেই, ভাত খেতে গেছেন বা উনিও ডিউটি বাদ দিয়ে ম্যাসেনজারে ‘চটকাচটকি’ করছেন! হেডলাইট নিচু না করেই বোল্টের গতিতে গাড়ি দাবড়াচ্ছেন, বিপরীত দিক থেকে আসা চালকের সরাসরি চোখে গিয়ে আলোটা পড়ছে! বাধ্য হয়েই ব্রেক কষতে হচ্ছে! সামান্য ফাঁক পেয়েই ওভারটেক করার অপরিণামদর্শী অপচেষ্টা! দুই গাড়ির যাত্রীরাই ভয়ে এতটুকুন!
নীট এন্ড ক্লীন ‘ঈযায়ে মুসলিম’! সন্দেহ আছে?

হাটবার! প্যাকপ্যাকে হাস, ককককে মোরগা, ভ্যাঁ ভ্যাঁ ছাগ, হাম্বা হাম্বা গরু নিয়ে এসেছে! বিশ্বরোড পুরোটা বন্ধ করেই ‘তারা’ মহান ‘হাটবার দিবস’ উদযাপন করছেন! ওদিকে মাইলের পর মাইল ‘জট’ লেগে আছে!
ঈযায়ে মুসলিম!

তাগড়া জোয়ান! নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই, উল্টো দিক থেকে গাড়ি চালিয়ে আসছে! ঝিমুনিরত তোবড়ানো গালের চালক, বাঁক ফেরার সময় হরণ না দিয়েই সপাটে স্টিয়ারিং হুইল ঘুরিয়ে দিল! মুখোমুখি মোলাকাত হতে হতে হলো না! ইন্ডিকেটর না জ্বেলেই, সাঁৎ সোঁৎ ডানে-বামের গলিতে ঢুকে পড়লো, পেছনের গাড়িটা পড়লো বেজায় সমস্যায়! বাসের হরণের আওয়াজ এমন বিদঘুটে ঘাঁকঘাঁক করা যে, রাস্তার মানুষ তো দূরের কথা, গরুটা পর্যন্ত দড়ি ছিঁড়ে পালানোর উপক্রম! অথবা হরণটা এতই মিঁউমিঁউ, বেড়ালও লজ্জা পাবে! পথচারীরা না শুনলে সরে দাঁড়াবে কিভাবে?
ঈযায়ে মুসলিম!

বাড়িতে গ্যাসের সংযোগ দিতে হবে, স্যুয়ারেজ লাইন ঠিক করতে হবে, পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে, এখন? কাটো রাস্তা! জমিতে পানি দিতে হবে, কাটো রাস্তা! খুবলে খুবলে রাস্তাকে ঝাঁঝরা করে দাও! কাজ শেষ। এবার কোনওরকমে নালিটা মাটি-পাথর দিয়ে ভরাট করে দায় সারো! রিকশা যাওয়ার সময় চরম ঝাঁকুনিতে শরীরের কলকজ্বা খুলে ছিটকে পড়ার উপক্রম!
ঈযায়ে মুসলিম!

ময়লা পরিষ্কার করতে হবে, রাতের অাঁধারে পাইপ দিয়ে, সদর দরজা দিয়ে রাস্তার পাশের নর্দমায় এনে ফেলা হলো! দুর্গন্ধে পথচলতি মুসাফিরের নাড়িভূঁড়ি উল্টে আসার উপক্রম!
ঈযায়ে মুসলিম!

ওভারব্রিজ আছে। চলন্ত সিঁড়িও লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। না ওটা দিয়ে যাওয়ার রুচি নেই। সেই আদি ও আসল: একটু ফাঁক পেলেই ভোঁ-দৌড়ে এপার থেকে ওপার! তুরন্ত গতিতে ধেয়ে আসা বাসটা হার্ডব্রেক কষতে বাধ্য হলো! ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা যাত্রীদের সে কি কষ্ট! গাড়ি আছে ভালো কথা, তাই বলে যত্রতত্র পার্কিং? উঁহু! পঁচা মবিল ব্যবহার? কিন্তু গাড়িরে হৌসপাইপ দিয়ে যে কালো ধোঁয়া বের হয়ে মানুষের ফুসফুস পুড়িয়ে দিচ্ছে?
ঈযায়ে মুসলিম! কোনও শক্কো-শোবাহ! এনি সন্দেহ?

আরো কতো কতোভাবে যে আমরা অন্যকে কষ্ট দিই! ফিরিস্তি নথিভুক্ত করতে বসলে, রাত ফুরোবে মাগার নটে গাছটি মুড়োবে না!
অন্যকে কষ্ট দিবো না, এটা মাথায় রাখলেই হয়।