উসমান বিন আফফান রাদিয়াল্লাহু আনহু

তার নাম উসমান বিন আফফান বিন আবুল আস বিন উমাইয়্যা বিন আব্দুশ শামস বিন আব্দে মান্নাফ বিন কুসসী বিন কিলাব বিন মুররা বিন কাব বিন লূয়ী বিন গালীব আল-কারশী আল-উমরী আবু উমর। কারো মতে, আবু আব্দুল্লাহ আবু লায়লা।

তিনি হস্তী বাহিনীর ঘটনার ষষ্ঠ বছরে জন্মগ্রহণ করেন। ইসলামের প্রাথমিক যুগে তিনি মুসলমান হোন। আবু বকর সিদ্দীকের আহবানে যাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেন,তিনি তাদের অন্তর্ভুক্ত।

তিনি দুবার – একবার হাবশায়, দ্বিতীয়বার মদীনা শরীফে হিজরত করেন।

নবুওয়াতের পূর্বে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কন্যা রুকাইয়্যার সাথে তার বিয়ে হয়। রুকাইয়্যা বদর যুদ্ধের দিন ইন্তেকাল করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রুকাইয়্যার সেবাযত্নের জন্য উসমানকে মদীনায় রেখে বদর যুদ্ধে যান। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে গনীমাতের ভাগ দিয়েছিলেন। সুতরাং উসমানকে বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বদর যুদ্ধের বিজয় সংবাদ নিয়ে দূত যখন মদীনায় আসে, লোকেরা তখন রুকাইয়্যার কবরে মাটি দিচ্ছিলো।

রুকাইয়্যা (রাঃ) এর ইন্তেকালের পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরেক কন্যা উম্মে কুলসুম (রাঃ) এর সাথে উসমানের বিয়ে দেন। আর হযরত উম্মে কুলসুম ৯ম হিজরীতে ইন্তেকাল করেন।

উলামায়ে কেরাম বলেন,উসমান ছাড়া কারো সঙ্গে কোনো নবীর দুই কন্যার বিয়ে হয়নি, আর এজন্য তাঁকে “যিননূরাইন” বলা হয়।

তিনি প্রাথমিক যুগের মুসলমান,দুই স্থানে হিজরতকারী আর আশরায়ে মুবাশশারাদের অন্তর্ভুক্ত।

তিনি কুরআনের হাফেয ছিলেন। ইবনে উবাদা বলেছেন,“খলীফাগণের মধ্যে উসমান আর মামুন রশীদ ছাড়া কেউ হাফেযে কুরআন নন।”

ইবনে সাদ বলেছেন,“নবী আকরাম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যাতুর রিকা আর গাতফান যুদ্ধে যাওয়ার সময় উসমানকে মদীনায় তার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে রেখে যান।

নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে উসমান (রাঃ) ১৪৪ টি হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং তার থেকে যায়েদ বিন খালিদ জুহানী,ইবনে যুবায়ের,সায়েব বিন ইয়াযিদ,আনাস বিন মালিক,যায়েদ বিন সাবিত,সালামা বিন আকওয়া,আবু উমামা বাহলী,ইবনে আব্বাস,ইবনে উমর,আব্দুল্লাহ বিন মুগাফফাল, আবু কাতাদা,আবু হুরায়রা প্রমুখ সাহাবায়ে কেরাম আর অসংখ্য তাবেঈ হাদীস বর্ণনা করেন।

আব্দুর রহমান বিন হাতিব থেকে ইবনে সাদ বর্ণনা করেছেন,“সকল আসহাবে রসূলের মধ্য থেকে আমি উসমানের চেয়ে সুন্দর করে হাদীস বর্ণনা করতে আর কাউকে দেখিনি। তিনি খুবই যত্ন ও সাবধানতার সাথে হাদীস বর্ণনা করতেন।”

মুহাম্মাদ বিন সিরীন বলেছেন,“তিনি হাজ্জের সবচেয়ে বেশী মাসয়ালা জানোতেন,তার পর ইবনে উমরের স্থান।”

বাইহাকী সুনান গ্রন্থে আব্দুল্লাহ বিন উমর বিন আবান জাফী থেকে বর্ণনা করেছেনঃ আমার মামা জাফী আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন,“তুমি জানো, উসমানকে কেন যিননূরাইন বলা হয় ?” আমার না জানার কথা বললে তিনি বললেন,“আদম (আঃ) থেকে আজ পর্যন্ত উসমান ছাড়া কেউ কোনো নবীর দুই মেয়েকে বিয়ে করেননি, এজন্য তাঁকে যিননূরাইন বলা হয়।”

হাসান থেকে আবু নাঈম বর্ণনা করেছেন,“নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দুই কন্যাকে বিয়ে করার কারণে তার নাম যিননূরাইন।”

খাইসামা ফাযাইলুস সাহাবা গ্রন্থে এবং ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেনঃ এক ব্যক্তি আলীকে উসমান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন,“তিনি এমন ব্যক্তি, যিনি ফেরেশতাদের মাঝে যিননূরাইন নামে প্রসিদ্ধ এবং নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দুই কন্যার সাথে তার বিয়ে হয়।”

সহল বিন সাদ দুর্বল সূত্রে বর্ণনা করেছেন,“জান্নাতে এক ভবন থেকে আরেক ভবনে স্থানান্তর হওয়ার সময় দুবার আলোকিত হওয়ার জন্য তিনি যিননূরাইন নামে প্রসিদ্ধ।”

বর্ণিত রয়েছে,জাহেলিয়াতের যুগে তার উপনাম ছিল আবু উমর। আর হযরত রুকাইয়্যার গর্ভ থেকে তার ঔরসজাত সন্তান আব্দুল্লাহ জন্মগ্রহণের পর তার উপনাম হয় আবু আব্দুল্লাহ।

তার মাতার নাম আরওয়া বিনতে কারীম বিন রাবীআ বিন হাবীব বিন আব্দুশ শামস। নানীর নাম উম্মে হাকীম আল বায়যা বিনতে আব্দুল মুত্তালিব বিন হাশিম। তার নানী এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সম্মানিত পিতা আব্দুল্লাহ এক গর্ভের সন্তান। এ দৃষ্টিকোণ থেকে তার জননী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ফুফাতো বোন।

ইবনে ইসহাক বলেছেন,“তিনি হযরত আবু বকর সিদ্দীক,আলী আর যায়েদ বিন হারিসার পর ইসলাম গ্রহণ করেন।”

ইবনে আসাকির বিভিন্নভাবে বর্ণনা করেনঃ উসমানের মাঝারি গঠন ছিল চমৎকার। সাদার সাথে ছিল লালচে বর্ণে মিশ্রিত শরীরের আকৃতি। চেহারায় বসন্তের দাগ ছিল। ঘন দাড়ি প্রশস্ত গ্রীবা,দৃঢ় পদ,লম্বা হাতে পশমের সমাবেশ,মাথায় কালো কেশ,অপূর্ব দন্তরাজি আর বাবরী চুলের অধিকারী ছিলেন। তিনি কেশগুচ্ছে হলদে বর্ণের কলপ করতেন।

আব্দুল্লাহ বিন হাযাম মাযানী থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেন,“আমি উসমানের চেয়ে বেশী সুন্দর কোনো পুরুষ দেখিনি।”

মূসা বিন তালহা বলেছেন,“উসমান কান্তিময় চেহারার অধিকারী ছিলেন।”

ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেন যে,উসামা বিন যায়েদ বলেছেন,“একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে এক বাটি গোশত দিয়ে উসমানের কাছে পাঠালেন। আমি তার বাড়ি গেলাম। রুকাইয়্যা বসেছিলেন। আমি একবার রুকাইয়্যার চেহারার দিকে,আরেকবার উসমানের দিকে তাকাতে লাগলাম। এরপর ফিরে এলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন,“তুমি বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করেছিলে ?” আমি বললাম,“হ্যা।” তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, “এতো লাবণ্যময় দম্পতি তুমি আরও দেখেছো ?” আমি বললাম,“না।”

মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম বিন হারিস আল-তাইমী থেকে ইবনে সাদ বর্ণনা করেছেনঃ তিনি ইসলাম গ্রহণ করায় তার চাচা হাকিম বিন আবুল আস বিন উমাইয়্যা ধরে নিয়ে গিয়ে শক্ত করে বেঁধে বললো,“তুমি পূর্বপুরুষদের ধর্ম ত্যাগ করে নতুন ধর্ম গ্রহণ করেছো। আল্লাহর কসম, আগের ধর্মে ফিরে না আসা পর্যন্ত আমি তোমাকে ছাড়ব না।” তিনি বললেন,“আল্লাহর কসম,কিয়ামত পর্যন্ত আমি এ দ্বীন ত্যাগ করবো না।” তার দৃঢ়তা দেখে অবশেষে তাঁকে ছেড়ে দেয়।

আনাস (রাঃ) বলেছেনঃ তিনিই সর্বপ্রথম স্বপরিবারে হাবশায় হিজরত করলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন,“আল্লাহ তাআলা উসমানের সাথে রয়েছেন। হযরত লুত (আঃ) এর পর উসমান স্বপরিবারে আল্লাহর রাস্তায় হিজরত করলেন।” (আবু ইয়ালা)

আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) বলেছেনঃ উম্মে কুলসুমকে বিয়ে দেওয়ার সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে বললেন,“তোমার স্বামী তোমার দাদা ইবরাহীম (আঃ) এবং তোমার পিতা মুহাম্মাদের অনুরূপ।” (ইবনে আদী)

ইবনে উমর থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেন যে,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,“আমি উসমানকে আমার পিতা ইবরাহীম (আঃ) এর মতো মনে করি।”

 

হাদিসের দৃষ্টিতে উসমান (রা) এর মর্যাদা

ইমাম বুখারী আর ইমাম মুসলিম হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেনঃ  উসমান (রাঃ) ঘরে প্রবেশের সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বসন সংযত করে বললেন,“যাকে দেখে ফেরেশতাগণ লজ্জা পায়,আমি কেন পাবো না ?”

আব্দুর রহমান বিন সালাম থেকে ইমাম বুখারী বর্ণনা করেছেনঃ অবরুদ্ধ অবস্থায় উসমান (রাঃ) অবরোধকারীদের উদ্দেশ্যে আসহাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কসম করে বলেন,“আমি জিজ্ঞেস করতে চাই, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন বলেছিলেন – ‘কে আছো, যে সংকটময় মুহূর্তে সামরিক বাহিনীকে সাহায্য করবে, সে জান্নাত পাবে।’ আমি তখন সাহায্য করেছিলাম। তোমরা জানো না, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন বলেছিলেন,যে রুমার কূপ খনন করবে, সে জান্নাতে যাবে। আমি তখন রুমার কূপ খনন করেছিলাম।” সকল সাহাবা তার কথাকে সত্যায়িত করেন।

আব্দুর রহমান বিন খাবাব থেকে তিরমিযী বর্ণনা করেছেনঃ একদিন আমি নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে উপস্থিত হলাম। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোনো এক যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য সাহাবীদের তাগীদ দিচ্ছিলেন। সে সময় উসমান বললেন,“ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি একশ উটসহ একশ উট বোঝাই রসদের জিম্মা নিচ্ছি।” রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবার তাগাদা দিলেন। উসমান বললেন,“দুইশ উটসহ দুইশ উট বোঝাই রসদের জিম্মা আমার।” নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পুনরায় তা বললে তিনি বললেন,“তিনশ উট আমার দায়িত্বে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিম্বর থেকে নামতে নামতে বললেন,“উসমানের নফল ইবাদতের আর প্রয়োজন নেই।”

আব্দুর রহমান বিন সামূরা থেকে তিরমিযী বর্ণনা করেছেনঃ যুদ্ধের জন্য সামরিক বাহিনী গঠনের সময় উসমান গনী এক হাজার দিনার (স্বর্ণমুদ্রা) নিয়ে এলে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর জামার আঁচলে রেখে বললেন,“উসমান যদি আর কোনো নফল ইবাদত না করে, তবুও কোনো ক্ষতি নেই।”

আনাস (রাঃ) থেকে তিরমিযী বর্ণনা করেছেনঃ বাইআতে রিদওয়ানের সময় উসমান (রাঃ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে বাইআত করছিলেন। সে সময় তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন,“উসমান আল্লাহ এবং তার নবীর কাজে রত আছেন। আমি তার পক্ষ থেকে নিজের হাতের উপর অপর হাত দিয়ে বাইআত করছি।” সুতরাং এভাবে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার পক্ষ থেকে বাইআত করেন। সে দিন তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একটি হাত মুবারক উসমানের পক্ষ থেকে বাইআত গ্রহণের জন্য মনোনীত হয়েছিলো,যা অন্যান্য সাহাবীদের হাতের তুলনায় সে হাত কতই না উত্তম ছিল। আর এতেই উসমানের মর্যাদা প্রকাশ হয়।

ইবনে উমর (রাঃ) থেকে তিরমিযী বর্ণনা করেছেনঃ একবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক ফিতনার ভবিষ্যদ্বাণী করে উসমানের দিকে ইশারা করে বললেন,“উসমান সে ফিতনায় মজলুমভাবে শহীদ হবে।”

মুররা বিন কাব থেকে তিরমিযী,হাকেম আর ইবনে মাজা বর্ণনা করেছেনঃ একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিকটবর্তী এক বিশৃঙ্খলার বিবরণ দেওয়ার সময় এক ব্যক্তি চাদর দিয়ে মাথা মুড়িয়ে হেঁটে গেলে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে লক্ষ্য করে বললেন,“এ ব্যক্তি সে দিন হিদায়াতের উপর অটল থাকবে।” আমি দাঁড়িয়ে দেখলাম,তিনি হলেন উসমান গনী। তার চেহারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি ফিরালে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলাম,“ইনিই কি হিদায়াতের উপর অবিচল থাকবেন ?” তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন,“হ্যাঁ।”

আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) বলেছেন,“হে উসমান, আল্লাহ্‌ তাআলা তোমাকে যে খিলাফত দিয়েছেন, সেখান থেকে ষড়যন্ত্রকারীরা তোমাকে উৎখাত করতে চাইলে তুমি সরে পড়বে না, বরং আমার কাছে আসবে।” এজন্য কুচক্রী কর্তৃক অবরুদ্ধ হয়ে পড়লে তিনি বললেন,“এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার কাছ থেকে ওয়াদা নিয়েছেন,আমি এখান থেকে বিন্দুমাত্র নড়বো না।” (তিরমিযী)

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে হাকিম বর্ণনা করেছেনঃ উসমান দুইবার জান্নাত কিনেছেন – এক, রুমার কূপ খনন করে এবং দুই, সৈন্যদের সাহায্য করে।”

আবু হুরায়রা কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে যে,নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,“আমার সাহাবীদের মধ্যে অভ্যাসের দিক দিয়ে উসমান আমার মতো।”

আসমাত বিন মালিক থেকে তাবারানী বর্ণনা করেছেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দ্বিতীয় মেয়ে উম্মে কুলসুম ইন্তেকাল করলে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন,“আমার তৃতীয় মেয়ে থাকলে উসমানকে তার সাথেও বিয়ে দিতাম। ওহী মোতাবেক তার সাথে আমার কন্যাদ্বয়ের বিয়ে দিয়েছিলাম।”

আলী (রাঃ) থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেন যে,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উসমান সম্পর্কে বলেছেন,“আমার চল্লিশজন মেয়ে থাকলে পরপর আমি তাদেরকে তার সঙ্গে বিয়ে দিতাম।”

যায়েদ বিন সাবিত (রাঃ) থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেন যে,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,“উসমান আমার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় এক ফেরেশতা আমার কাছে বসে ছিলো। তিনি আমাকে বললেন – ইনি শহীদ হবেন। স্বজাতি কর্তৃক তার নিহত হবার সংবাদ পেয়ে আমি লজ্জিত হলাম।”

ইবনে উমর (রাঃ) থেকে আবু ইয়ালা বর্ণনা করেছেন যে,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,“আল্লাহ এবং তার রাসূলের কাছে ফেরেশতাগণ যেভাবে লজ্জাবোধ করেন, উসমানের সামনেও তারা একইভাবে লজ্জিত হোন।”

হাসান (রাঃ) থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেনঃ এক ব্যক্তি উসমান সম্পর্কে হাসানকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন,“গোসল করার সময় শরীরের কাপড় নির্জন কক্ষে খুলতেও তিনি ভীষণ লজ্জাবোধ করতেন।”

 

 

উসমান (রা) এর খিলাফত

উমর (রাঃ) এর দাফনের তৃতীয় দিন উসমানকে বাইআত দেওয়া হয়।

কথিত আছে,একদিন লোকেরা হযরত আব্দুর রহমান বিন আউফের সাথে পরামর্শ করেন আর বুদ্ধিমানরাও তার সাথে পৃথক পৃথকভাবে সাক্ষাত করে উসমানের ব্যাপারে নিজেদের অভিমত ব্যক্ত করেন। অবশেষে আব্দুর রহমান বিন আউফ বায়আতের জন্য সমবেত মজলিসে এসে বসেন এবং হামদ ও সানার পর বলেন, “তোমাদের লোকেরা উসমান (রাঃ) ছাড়া কাউকে বাইআত প্রদানে সন্তুষ্ট নন।” (ইবনে আসাকির)

এক বর্ণনায় রয়েছেঃ আব্দুর রহমান বিন আউফ (রাঃ) হামদ ও সানার পর আলীকে বললেন,“হে আলী, আমি সকলের সাথে কথা বলে জেনেছি তাদের অভিমত উসমানকে ঘিরে।” এ কথা বলে তিনি উসমানের হাত ধরে বললেন,“আল্লাহ, তার রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং পূর্ববর্তী দুই খলিফার নীতি অনুযায়ী আমি তার কাছে বাইআত করছি, আপনিও বাইআত করুন।” এরপর সকল মুহাজির ও আনসার সাহাবীগণ বাইআত করলেন।

আনাস (রাঃ) বলেছেনঃ উমর ইন্তেকালের এক ঘন্টা আগে আবু তালহা আনসারীকে বলেছেন,“যে ঘরে আসহাবে রাসূল খলীফা নির্ধারণের জন্য তিনদিন সমবেত হবেন, কেউ যেন ভিতরে প্রবেশ করতে না পারে, সে জন্য তুমি পঞ্চাশজনকে নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকবে।” (ইবনে সাদ)

মুসনাদে আহমাদ গ্রন্থে আবু ওয়ায়েল কর্তৃক বর্ণিত হয়েছেঃ আমি আব্দুর রহমান বিন আউফকে বললাম, “আলীকে বাদ দিয়ে উসমানকে কেন বাইআত দিলেন ?” তিনি বললেন,“এতে আমার কোনো ত্রুটি নেই। আমি আলীকে বলেছিলাম – আমি কিতাবুল্লাহ, সুন্নতে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং সীরাতে আবু বকর ও উমর অনুযায়ী আপনাকে বাইআত দিবো।” জবাবে তিনি বললেন,যখন করা তা সম্ভব হবে, অন্যথায় উসমানকে একই প্রশ্ন করলে তিনি বলেন,খুব ভালো (বাইআত করুন – অনুবাদক)।

বর্ণিত রয়েছে, আব্দুর রহমান বিন আউফ (রাঃ) বলেছেনঃ আমি উসমানকে নির্জনে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,“আমি আপনার কাছে বাইআত না করলে আমাকে কার বাইআত গ্রহণের পরামর্শ দিবেন ?” তিনি বললেন,“আলীর।” আলীকে প্রশ্ন করলে তিনি উসমানের কথা বলেন। যুবায়েকে বললাম,তিনি আলী অথবা উসমানের নাম উল্লেখ করলেন। এরপর সাদের অভিমত জানোতে চাইলাম,তিনি উসমানকে নির্বাচন করেন। এরপর আমি সকল আসহাবে রাসূল এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের অধিকাংশের মতামত উসমানের পক্ষে পেলাম।

ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে ইবনে সাদ আর হাকিম বর্ণনা করেছেন যে,উসমানের বাইআতের সময় লোকেরা বলছিলেন,“জীবিতদের মধ্যে আপনি সর্বশ্রেষ্ঠ। আপনার আনুগত্যে আমরা কোনো ত্রুটি করবো না।”

উসমানের খিলাফত লাভের আগের বছর ২৪ হিজরীতে রায় অঞ্চল বিজিত হলেও হাত থেকে চলে গেলে তার আমলে দ্বিতীয়বার তা পদানত হয়। সে বছর গ্রীষ্মের তাপদাহে নাক দিয়ে রক্তক্ষরণ জাতীয় রোগ বিশেষের প্রাদুর্ভাবে উসমান আক্রান্ত হয়ে হাজ্জে যাওয়ার প্রস্তুতি স্থগিত করেন আর রুগ্নতার আশঙ্কায় প্রয়োজনীয় ওসীয়ত করেন। এজন্য এ বছরকে রক্তক্ষরণের বছর হিসেবে অভিহিত করা হয়। একই বছর রোমান সাম্রাজ্যের সিংহভাগ ভূখণ্ড ইসলামের পতাকাতলে আসে আর উসমান মুগীরাকে অপসারণ করে সাদ বিন আবী ওয়াক্কাসকে কুফার শাসনকর্তা নিয়োগ করেন।

২৫ হিজরীতে হযরত উসমান সাদকে অপসারণ করে মায়ের দিক থেকে আত্মীয়তার সম্পর্কে ভাই ওলীদ ইবনে উকবা বিন আবী মুইতকে কুফার প্রশাসক নিয়োগ করেন। তার প্রতি জনতার এটাই প্রথম অভিযোগ যে,তিনি আত্মীয়তার চর্চা করেছেন। কথিত আছে, ওলীদ ছিলেন মদ্যপ। একবার নেশা করে ফজরের নামাযের ইমামতি করেন আর চার রাকাত নামায পড়িয়ে সালাম ফিরে মুক্তাদিদের বলেন, তোমরা বললে আরো বেশী পড়িয়ে দিবো।

২৬ হিজরীতে কিছু ঘরবাড়ি কিনে উসমান (রাঃ) মসজিদে নববী সম্প্রসারণ করেন। এ বছর সাবু অঞ্চল বিজিত হয়।

২৭ হিজরীতে মুআবিয়া নৌপথে কবরয আক্রমণ করেন। এ বাহিনীতে উবাদা বিন সামেতের সাথে তার পত্নী উম্মে হারাম বিনতে মিলহান আনসারীও ছিলেন। এ অভিযানে তার স্ত্রী ঘোড়া থেকে পড়ে নিহত হোন আর  তাঁকে সেখানেই সমাহিত করা হয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ যুদ্ধে উবাদার স্ত্রীর নিহত হওয়ার ব্যাপারে আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। এ বছর আরজানো আর দারে বজর্দ করতলগত হয়। এরপর তিনি আমর বিন আসকে অপসারণ করে আব্দুল্লাহ বিন সাদ বিন আবী সারাহকে মিসরের শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। তিনি স্বপদে অধিষ্ঠিত হয়ে আফ্রিকা আক্রমণ করে তা দখল করে সকল পর্বত ও বনাঞ্চল পরিবেষ্টিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যগুলো ইসলামের ছায়াতলে আনেন। সেখানে প্রচুর সম্পদ গনীমত হিসেবে মুসলমানদের হাতে আসে। ফলে প্রত্যেক মুহাজির এক হাজার,কোনো বর্ণনা অনুযায়ী তিন হাজার দিনার ভাগে পান। এরপর আন্দলস হস্তগত হয়।

উল্লেখ্য, মুআবিয়া (রাঃ) উমর (রাঃ) কে নৌপথে কবরয আক্রমণের জন্য বারবার অনুরোধ করায় উমর (রাঃ) মিসরের শাসনকর্তা আমর বিন আস (রাঃ) কে নৌযান সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা দেবার জন্য নির্দেশ দেন। আমিরুল মুমিনীনের চিঠি পেয়ে আমর বিন আস (রাঃ) লিখলেন,“আমি এ বাহন দেখেছি। সেটি এক প্রকাণ্ড মাখলুক। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাখলুকরা এতে আরোহণ করে। যখন এ বাহনটি স্থির হয়ে দাঁড়ায় তখন অন্তর ফেটে যায়,আর যখন চলতে থাকে তখন বিবেক লোপ পায়। এতে লাভের চেয়ে ক্ষতির অংশই বেশী। এতে উপবেশনকারীরা কাষ্ঠ খণ্ডের উপর সরীসৃপ জাতীয় প্রাণীর মত আরোহণ করেছে। এটি ছিদ্র হলে নিমজ্জিত হবে।” নৌযান সম্পর্কে এ বিবরণ পড়ে আমিরুল মুমিনীন উমর (রাঃ) মুআবিয়া (রাঃ) কে লিখলেন, “আল্লাহর কসম, এমন বাহনে মুসলমানদের আরোহণ করতে দিবো না।”

ইবনে জারীর বলেনঃ অবশেষে মুআবিয়া (রাঃ) উসমান (রাঃ) এর খিলাফতকালে নৌপথে কবরয আক্রমণ করেন আর কবরযবাসী জিজিয়া কর দেবার জন্য সন্ধি করে।

২৯ হিজরীতে ইসতিখার,কাসা এবং এর পার্শ্ববর্তী ছোট ছোট রাজ্যগুলো যুদ্ধের মাধ্যমে বিজিত হয়। সে সময় তিনি মসজিদে নববী সম্প্রসারণ করেন। কারুকার্য খচিত পাথর,পাথরের স্তম্ভ আর কাঠ নির্মিত ছাদ তৈরির মাধ্যমে মসজিদের দৈর্ঘ্য ১৬০ গজ আর প্রস্থ ১৫০ গজ হয়।

৩০ হিজরীতে জুর,নিশাপুর আর খুরাসনের অধিকাংশ শহরগুলো কিছু সন্ধির মাধ্যমে, বাকীগুলো লড়াই করে মুসলমানদের হস্তগত হয়। তখন চারদিক থেকে প্রচুর সম্পদ আদায় করেন,উসমান (রাঃ) কোষাগার নির্মাণের প্রয়োজন অনুভব করেন আর তিনি প্রতিদিন মন খুলে লোকদের দান করতেন। এতে কেউ এক লাখ কেউ চার লাখ দিরহাম পেতেন। ৩৫ হিজরীতে উসমান গনী (রাঃ) শাহাদাত লাভ করেন।

যুহরী বলেছেনঃ  উসমানের বারো বছর খিলাফতের প্রথম ছয় বছর তার প্রতি লোকদের কোনো অভিযোগ ছিল না। এমনকি উমর কঠোর হওয়ার কারণে কুরাইশদের মধ্যে তিনি ছিলেন অধিক জনপ্রিয়। ছয় বছর পর উসমান অনেক নরম হয়ে পড়েন। তিনি আত্মীয় ও প্রিয়জনদের প্রশাসক পদে নিয়োগ দিতে আরম্ভ করেন। মারওয়ান আফ্রিকার শাসনকর্তকাকে এক-পঞ্চমাংশ যা বাইতুল মালে জমা হবে তা মাফ করে দেন। তিনি আত্মীয়-স্বজনকে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ভাতা দেন, এ যুক্তির আলোকে যে – আবু বকর আর উমর  উভয়ের জন্যই তা বৈধ ছিল,কিন্তু তারা সেটি গ্রহণ করেননি, আমি আল্লাহ তাআলার নির্দেশে আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করে চলেছি। এতে করে জনতার মাঝে বিশৃঙ্খলার সৃষ্ট হয়। (ইবনে সাদ)

যুহরী থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেনঃ আমি সাঈদ বিন মুসায়্যাবকে জিজ্ঞেস করলাম,“উসমানকে কেন শহীদ করা হয় ? সে সময় লোকদের অবস্থা কি ছিল ? তার রীতিনীতি কি ছিল ? আর সাহাবাগণ কেন তার সঙ্গ দেননি ?” তিনি বললেন,“উসমানকে মজলুমভাবে শহীদ করা দেয়া হয়েছে। হত্যাকারীরা ছিল জালেম, আর যারা তার সাহচর্য ত্যাগ করেছিলেন তারা অপারগ ও অক্ষম ছিলেন।” আমি বললাম,“এর বিস্তারিত বিবরণ কি ?” তিনি বললেন,“উসমান নৈকট্যপ্রাপ্তদের বেশী ভালোবাসার কারণে অনেকেই তা ভালো দৃষ্টিতে দেখেননি।”

তার বারো বছর খিলাফতের প্রথমদিকে উমাইয়্যা বংশের মধ্য থেকে আসহাবে রাসূল ছাড়া অন্যদের শাসনকর্তা নিয়োগ করতেন, আর সাহাবীগণ তাদের অধিকাংশ কাজের সমালোচনা করতেন; কিন্তু উসমান (রাঃ) তাদেরকে অপসারণ না করে ক্ষমা করে দিতেন। ছয় বছর পর চাচার সন্তানদের প্রাধান্য দিয়ে তাদেরকে আল্লাহর ভয় দেখিয়ে রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত করতে থাকেন। তিনি আব্দুল্লাহ বিন আবী সারাহকে মিসরের শাসনকর্তা হিসেবে প্রেরণের দুই বছর পর মিসরবাসী তার বিরুদ্ধে বারবার অভিযোগ আনতে থাকার কারণে উসমান মিসর শাসনকর্তা আব্দুল্লাহ বিন আবী সারাহের প্রতি একটি চিঠি লিখেন। কিন্তু পত্রে উল্লিখিত আদেশ-নিষেধের কোনো তোয়াক্কা না করে যারা খলীফার কাছে অভিযোগ করতে এসেছিলো,আব্দুল্লাহ বিন আবি সারাহ তাদের হত্যা করেন। এরপর মিসরবাসীর পক্ষে থেকে সাত সদস্যের এক প্রতিনিধি দল মুসলিম বিশ্বের রাজধানী পবিত্র মদীনা শরীফে এসে নামাযের সময় মসজিদে নববীতে সাহাবীদের কাছে আব্দুল্লাহ বিন সারাহের হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ দায়ের করে। ফলে তালহা বিন উবায়দুল্লাহ দাঁড়িয়ে এ বিষয় নিয়ে উসমানের সাথে কঠোরতার সাথে বাদানুবাদ করেন। ওদিকে আয়েশা (রাঃ) ঘটনাটি জানোতে পেয়ে উসমানের কাছে বলে পাঠান যে,“মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবীগণ আপনার নিকট এমন এক ব্যক্তির অপসারণ চাইছে, যে লোকটি হত্যার দায়ে দোষী, কিন্তু এতে আপনি কর্ণপাত করছেন না, আর তাকে অপসারণ করতে অসম্মতি জানাচ্ছেন। আপনার উচিত তাঁকে শাস্তি দেয়া।” কিছুক্ষণ পর হযরত আলী (রাঃ) এসে বললেন,“এরা হত্যার পরিবর্তে একজন শাসনকর্তার অপসারণ চাইছে। কেন সেখানে আরেকজনকে অধিষ্ঠিত করছেন না ? কেন এ কাজে ইনসাফ করছেন না ?” উসমান বললেন,এরা নিজেদের মধ্যে মীমাংসা করে নিবে। আমি আব্দুল্লাহ বিন আবী সারাহকে অপসারণ করে একটি চিঠি লিখে দিচ্ছি। লোকেরা মিসরের নতুন শাসনকর্তা হিসেবে মুহাম্মদ বিন আবু বকরকে সবদিক দিয়ে যোগ্য বিবেচনা করে।

উসমান কর্তৃক আব্দুল্লাহ বিন আবী সারাহের অপসারণের ফরমান নিয়ে মুহাম্মদ বিন আবু বকর মিসরে যাত্রা করেন। আব্দুল্লাহর অবস্থা স্বচক্ষে দেখার করার জন্য মুহাজির ও আনসারদের একটি দল মুহাম্মাদ বিন বিন আবু বকরের সাথে ছিলেন। তারা তৃতীয় মঞ্জিলে অবস্থানের সময় এক হাবশী গোলামকে উটনীর উপর আরোহণরত অবস্থায় দ্রুততার সাথে পথ চলতে দেখে ভাবলেন যে, হয়তো কারো দূত হবে অথবা পলায়নকারী। সাহাবায়ে কেরাম তার গতিরোধ করে জিজ্ঞেস করলেন,“আপনি কে ? কার অনুসন্ধানে কোথায় চলেছেন ?” সে বললো,“আমি আমিরুল মুমিনীনের গোলাম,মিসর শাসনকর্তার কাছে যাচ্ছি।” এ কথা শুনে এক ব্যক্তি মুহাম্মদ বিন আবু বকরের প্রতি ইশারা করে বললেন,“ইনি মিসর শাসনকর্তা।” সে বললো,“উনি আমার কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি নন।” এ বলে সে চলে গেলে মুহাম্মাদ বিন আবু বকর দুইজনকে পাঠিয়ে তাকে ধরে এনে জিজ্ঞেস করলেন,“কে আপনি ?” সে বিহ্বল ও হতচকিত হয়ে একবার নিজেকে আমিরুল মুমিনীন ও একবার মারওয়ানের গোলাম বলে পরিচয় দেয়। একজন তাকে চিনতে পেয়ে আমিরুল মুমিনীনের গোলাম হিসেবে সনাক্ত করলে মুহাম্মাদ বিন আবু বকর জিজ্ঞেস করলেন,“আমিরুল মুমিনীন আপনাকে কার কাছে কেন পাঠাচ্ছেন ?” সে বললো,“মিসর শাসনকর্তার কাছে পৌছানোর জন্য একটি চিঠিসহ আমাকে পাঠিয়েছেন।” মুহাম্মাদ বললেন,“আপনার কাছে চিঠি আছে ?” সে বললো,“নেই।” এরপর তালাশ করে তার কাছে চিঠি পাওয়া গেল না। অবশেষে ছোট এক মশকের মধ্যে পাওয়া গেলো আমিরুল মুমিনীনের পক্ষ থেকে ইবনে আবী সারাহের প্রতি লিখিত একটি চিঠি। মুহাম্মাদ সকল সাথীদের একত্রিত করে মোহর খুলে চিঠিটি পড়লেন – “মুহাম্মাদ আর অমুক অমুক ব্যক্তিবর্গ তোমার কাছে গিয়ে পৌছলে ফাঁদে ফেলে তাদের হত্যা করবে। যে তোমার অভিযোগ নিয়ে আসতে চাইবে, তাকে বন্দী করে রাখবে। দ্বিতীয় আদেশ পাওয়া পর্যন্ত স্বপদেই তুমি বহাল থাকবে।” এ পত্র পাঠান্তে সকলেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন আর মদীনায় ফিরে এলেন।

তারা মদীনায় এসে তালহা,আলী,সাদ,যুবায়ের প্রমুখ সাহাবীদের সমবেত করে প্রাপ্ত চিঠিটি দেখালেন আর ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিলেন। এতে সকলেই ক্রোধান্বিত হয়ে পড়েন এবং মাসউদ,আবু যর আর আম্মারের স্মরণ হওয়ায় সে ক্রোধের মাত্রা আর বৃদ্ধি পায়। সেদিনের মত সাহাবায়ে কেরাম নিজ নিজ বাড়ি চলে যান। অবশেষে লোকেরা উসমানের বাড়ি অবরোধ করে। সে সময় আলী, তালহা, যুবায়ের, আম্মার, সাদ প্রমুখ বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবীদেরকে উসমানের নিকট পাঠিয়ে তিনি প্রাপ্ত সেই পত্রটি, গোলাম আর সেই উটনীটি নিয়ে সাদ প্রমুখ বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবীদেরকে উসমানের কাছে গিয়ে বললেন, “সে কি আপনার গোলাম ?” উসমান বললেন,“হ্যাঁ।” আলী উটনীটি দেখিয়ে বললেন,“এ উটনী আপনার ?” তিনি বললেন,“আমার।” তিনি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন,“এ চিঠি কি আপনি লিখেছেন ?” তিনি বললেন,“আমি খলীফা। আমি এ চিঠি লিখিনি, কাউকে লিখার নির্দেশও দেইনি। এ চিঠি সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না।” আলী বললেন,“চিঠিতে আপনার মোহর লাগানো ছিল।” তিনি বললেন,“নিশ্চয়ই এটা আমার মোহর।” আলী বললেন,“কি আশ্চর্যের বিষয় ! গোলাম,উটনী,মোহর – সবই আপনার, অথচ আপনি কিছুই জানেন না ?” উসমান বললেন,“আল্লাহর কসম,এ চিঠি আমি লিখিনি, কারো হাতে তা লিখেও নেইনি আর তা মিসর শাসনকর্তার কাছেও পাঠাইনি।” এরপর লোকেরা বুঝলো এটা মারওয়ানের কাজ এবং উসমান কর্তৃক সৃষ্ট এ কাজে লোকদের সন্দেহ হয়। মারওয়ান হযরত উসমান (রাঃ) এর বাড়িতে ছিলেন। লোকেরা বললো,“মারওয়ানকে আমাদের হাতে তুলে দিন।” উসমান এ প্রস্তাব প্রত্যাখান করায় মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আসহাবেরা আরো বেশী ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। তাদের মধ্যে অধিকাংশ বলেন,“উসমান কখনই মিথ্যা কসম করেননি।” আর কিছু (ব্যক্তি) বলেন,“মারওয়ানকে আমাদের হাতে তুলে না দেয়া পর্যন্ত আর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবীদের হত্যার আদেশ দেওয়ার কারণ তদন্ত করে না জানা পর্যন্ত সন্দেহের উপর (ভিত্তি করে) উসমানকে কিছুতেই খারাপ ভাবা যাবে না। যদি উসমান জড়িত থাকেন, তাহলে আমরা তাঁকে অপসারণ করবো। আর যদি মারওয়ান লিখে থাকেন, তবে আমরা তাকে শাস্তি দিবো।” তারা মারওয়ানকে হত্যা করবেন সন্দেহে তিনি তাকে তুলে দিতে অস্বীকার করায় অবরোধ আরো কঠোর হয় এবং পানির সরবরাহ পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়া হয়।

উসমান উপর থেকে উঁকি দিয়ে বললেন,“তোমাদের মধ্যে আলী রয়েছেন ?” লোকেরা বললো,“না।” তিনি আবার বললেন,“তোমাদের মাঝে কি সাদ আছেন ?” লোকেরা বললো,“না।” তিনি কিছুক্ষণ নীরব থেকে আবার বললেন,“তোমাদের মধ্যে কে আছো, যে আলীকে আমার পিপাসার কথা জানিয়ে পানি পাঠাতে বলবে ?” এ সংবাদ আলীর কাছে পৌঁছামাত্র তিনি সঙ্গে সঙ্গে তিন মশক পানি পাঠিয়ে দেন,কিন্তু অবরোধের তীব্রতার কারণে পানির মশক বহনকারী বনূ হাশিম আর বনূ উমাইয়্যার কয়েকজন গোলাম আঘাতপ্রাপ্ত হয়। মারওয়ানকে তুলে না দিলে উসমানকে হত্যা করা হবে জানোতে পেরে আলী নিজের দুই ছেলে হাসান আর হোসেনকে কঠোরভাবে নির্দেশ দানে বললেন,“নাঙ্গা তলোয়ার নিয়ে উসমানের দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়ে যাও, যেন কেউ ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে।” তালহা,যুবায়ের আর কিছু সাহাবা নিজ নিজ পুত্রদের একই নির্দেশ দিয়ে উসমানকে পাহাড়া দেওয়ার জন্য পাঠিয়ে দেন। তারা তাঁকে ঘিরে নিশ্ছিদ্র প্রহরার ব্যবস্থা করেন।

উসমানকে রক্ষা করার জন্য তার সামনে দুর্ভেদ্য মানব প্রাচীর দেখে মুহাম্মদ বিন আবু বকর তীর বর্ষণ আরম্ভ করেন। উসমানকে লক্ষ্য করে ছোঁড়া তীরটি হাসানকে আঘাত করে,এতে রক্ত প্রবাহিত হয়। মারওয়ানের উদ্দেশ্যে নিক্ষিপ্ত তীরটি গিয়ে বিদ্ধ হয় মুহাম্মাদ বিন তালহার শরীরে। আরেকটি তীরের আঘাতে আলীর গোলাম কানবারের মাথা ক্ষত-বিক্ষত হয়। ইমাম হাসানের রক্ত দেখে মুহাম্মাদ বিন আবু বকর দারুণ ভীতগ্রস্ত হয়ে পড়েন এই ভেবে যে, ইমাম হাসানের রক্ত দেখে বনূ হাশিম প্রতিশোধ নিতে এগিয়ে এলে আমাদের মিশন ধুলায় লুটাবে। এজন্য মুহাম্মদ বিন আবু বকর তার অপর দুই সাথীকে বললেন,“আমরা তিনজন অন্য ঘর দিয়ে উসমানের ঘরে গিয়ে তাঁকে হত্যা করবো, তাতে কেউ টের পাবে না।” পরামর্শ অনুযায়ী মুহাম্মদ বিন আবু বকর তার দুই সাথীসহ এক আনসার সাহাবীর বাড়ি দিয়ে উসমান পর্যন্ত তারা পৌছে যায়, অথচ কেউ তা মোটেও টের পায়নি। কারন তাঁকে রক্ষাকারী দরজাটি দুই তলায় অবস্থান করছিলো,আর তিনি স্ত্রীসহ ছিলেন নীচ তলায়। মুহাম্মাদ বিন আবু বকর সাথীদ্বয়কে বললেন,“আমি আগে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনবো। তারপর তোমরা আক্রমণ করে হত্যা করবে। ছক মোতাবেক মুহাম্মদ বিন আবু বকর ঘরে ঢুকে উসমানের দাড়ি ধরলেন।” উসমান বললেন,“তোমার পিতা জীবিত থাকলে এ কাজের জন্য তিনি তোমাকে কি বলতেন, একবার ভেবেছো ?” একথা শুনে তিনি পেছনে সরে আসেন। এমন সময় তার সাথীদ্বয় এসে তাঁকে হত্যা করে যে পথে এসেছিল সে পথেই ফিরে যায়।

উসমানের স্ত্রী চিৎকার করতে থাকেন। কিন্তু হট্টগোলের কারণে কেউ তার আওয়াজ শুনতে পায়নি। অবশেষে তিনি উপরে গিয়ে বললেন,“আমিরুল মোমেনীন শহীদ হয়ে গেছেন।” তারা দৌড়ে এসে দেখলেন উসমান জবেহ হয়ে পড়ে আছেন। আলী,তালহা,যুবায়ের,সাদ আর মদীনাবাসীসহ সংবাদ পেয়ে সকলে চৈতন্য লোপ পায়। আলী এসে দুই পুত্রকে জিজ্ঞাস করলেন,“তোমরা দরজায় থাকার পরও আমিরুল মুমিনীন কিভাবে নিহত হলেন ?” এ বলে দুই পুত্রকে চড় দিলেন আর মুহাম্মদ বিন তালহা ও আব্দুল্লাহ বিন যুবায়েরকে বকাবকি করে বাড়ি চলে গেলেন।

এরপর লোকেরা দলে দলে আলীর বাড়িতে এসে বললো,“এ মুহূর্তে একজন খলীফা প্রয়োজন। আপনি হাত বাড়িয়ে দিন, আমরা আপনার কাছে বাইআত করবো।” তিনি বললেন,“বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবীগণ খলিফা মনোনীত করবেন। তারা যাঁর প্রতি সন্তুষ্ট, তিনিই হবে খলীফা।” এরপর সকল বদরী সাহাবা এসে বললেন,“আমরা আপনার চেয়ে খিলাফতের বেশী হকদার আর কাউকে দেখছি না। আপনি হাত প্রসারিত করুন,আমরা বাইআত করবো।” অবশেষে তারা বাইআত করলেন।

ওদিকে মারওয়ান আর তার পুত্র আগেই পালিয়েছিলেন। উসমানের স্ত্রীর কাছে এসে আলী জিজ্ঞেস করলেন, “কে উসমানকে হত্যা করেছে ?” তিনি বললেন,“মুহাম্মাদ বিন আবু বকরের সাথে যে দুজন ছিল, আমি তাদেরকে চিনি না।” আলী সঙ্গে সঙ্গে মুহাম্মাদকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি বললেন,“হত্যা করার জন্য আমি ভেতরে প্রবেশ করেছিলাম। কিন্তু তিনি আমার বাবার কথা বলায় আমি পেছনে সরে আসি আর আল্লাহ তাআলার কাছে তাওবা করতে থাকি। আল্লাহর কসম,আমি হত্যা করিনি,তাকে ঘায়েলও করিনি।” উসমানের স্ত্রী বললেন,“সে সত্য বলেছে, তবে সে-ই তাদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়েছে।”

সুফিয়ার গোলাম কেনানা থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেনঃ জনশ্রুতি প্রচলিত রয়েছে যে, লাল নীল মিশ্রিত চোখ বিশিষ্ট হিমার নামক মিসরের এক ব্যক্তি উসমানকে হত্যা করে।

মুগীরা বিন শোবা থেকে আহমাদ বর্ণনা করেছেনঃ অবরুদ্ধ থাকা অবস্থায় আমি উসমানের কাছে গিয়ে বললাম,“আপনি আমিরুল মুমিনীন,আপনি দুর্ঘটনায় নিপতিত হয়েছেন। আমি তিনটি পরামর্শ দিচ্ছি, পছন্দমত একটি গ্রহণ করবেন। এক -আপনি বাইরে গিয়ে লড়াই করুন, আপনার অনেক গুণগ্রাহী রয়েছে, তাছাড়া আপনি সত্যের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত, আর তারা বাতিল; দুই – আপনি উটে চড়ে মক্কায় চলে যান, হারাম হওয়ার কারণে এরা সেখানে কোনো লড়াই করতে পারবে না; তিন – আপনি সিরিয়ায় যান,সেখানে মুআবিয়া রয়েছেন, তিনি আপনাকে সাহায্য করতে পারবেন।” উসমান (রাঃ) বললেন,“আমি বাইরে গিয়ে সংঘর্ষে জড়াবো না। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খলীফা হয়ে মুসলমানদের রক্ত ঝরাতে চাই না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে শুনেছি – কুরাইশদের মধ্যে যে হারাম শরীফে ফেতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করবে, দুনিয়ার অর্ধেক শক্তি তার উপর বর্তাবে; এজন্য আমি মক্কা শরীফেও যাবো না। সিরিয়ায় যাওাটাও আমার পক্ষে সম্ভব নয়, কারণ আমরা হিজরতের পবিত্র নগরী আর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সুষমাসিক্ত পরশ ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না।”

আবু সুরুল ফাহমী থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেন,“অবরোধ চলাকালীন সময় আমি উসমানের কাছে গেলে তিনি বললেন,“আমি নিজের প্রতিপালকের কাছে দশটি আমানত রেখেছি –

(১) আমি ইসলামের চতুর্থ ব্যক্তি,

(২) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ কন্যাকে আমার সাথে বিয়ে দিয়েছেন,

(৩) তার ইন্তেকালের পর দ্বিতীয় মেয়ের সাথে আমার বিয়ে দেন,

(৪) আমি কখনো গান গাইনি,

(৫) কোন সময় খারাপ কাজের ইচ্ছা করিনি,

(৬) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে বাইআত করার পর থেকে ডান হাত দিয়ে লজ্জাস্থান স্পর্শ করিনি।

(৭) প্রত্যেক জুমায় একজন গোলাম আযাদ করেছি, কোনো জুমায় গোলাম না পেলে পরবর্তীতে তা কাযা আদায় করেছি,

(৮) জাহেলিয়াত বা ইসলামের যুগে – কখনোই যিনা করিনি।

(৯) আমি কখনো চুরি করিনি।

(১০) রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যুগেই কুরআন হিফয করেছি।”

উসমান ৩৫ হিজরীর আইয়্যামে তাশরীকের (ঈদুল আযহার তিন দিন) মধ্যভাগে শাহাদাত লাভ করেন। কারো মতে,তিনি ৩৫ হিজরীর যিলহাজ্জ মাসে ১৮ তারিখ শনিবার মাগরিব ও এশার মধ্যবর্তী সময়ে শহীদ হোন। তাঁকে জান্নাতুল বাকীতে দাফন করা হয়। কারো মতে,শনিবারে; কারো মতে ২০ যিলহাজ্জ সোমবারে শহীদ হোন। তার বয়স নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে। ৮১, ৮২, ৮৪, ৮৬, ৮০, ৮৯, ৯০ – বিভিন্ন মতামত পাওয়া যায়।

কাতাদা (রাঃ) বলেছেনন,“যুবায়ের তার জানাযা পড়ান আর দাফন করান, কারণ তিনি তাঁকে এ কাজের ওসীয়ত করেছিলেন।”

আনাস (রাঃ) থেকে মারফু সূত্রে ইবনে আসাকির আর ইবনে আদী বর্ণনা করেছেন,“উসমান জীবিত থাকা পর্যন্ত আল্লাহর তরবারী কোষবদ্ধ ছিল। তিনি শহীদ হওয়ার পর তা খাপমুক্ত হয়েছে, কিয়ামত পর্যন্ত খাপমুক্তই থাকবে।” (এ বর্ণনা উমর বিন কায়েদ মাত্র একজনই বর্ণনাকারী,এটি গ্রহণযোগ্য নয়)।

ইয়াযিদ বিন হাবীব থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেন,“আমি জেনেছি, যারা উসমানের উপর আক্রমণ করেছে তাদের অধিকাংশই পাগল হয়ে গেছে।”

হুযাইফা (রাঃ) বলেছেন,“সর্বপ্রথম ফিতনা হলো উসমানের শাহাদাত, আর সর্বশেষ ফিতনা দাজ্জালের আবির্ভাব। যে তার শাহাদাতে সামান্যতম খুশি হবে, সে দাজ্জালের যুগ পেলে অবশ্যই তার প্রতি ঈমান আনবে,আর না পেলে তার কবর দাজ্জালের আনুগত্য করবে।” (ইবনে আসাকির)

হাসান (রাঃ) বলেছেন,“তিনি শহীদ হওয়ার সময় আলী (রাঃ) মদীনায় ছিলেন না। সংবাদ পেয়ে তিনি বললেন – ‘হে আল্লাহ, আমি এ ঘটনায় সন্তুষ্ট নই, আর কোনোভাবেই এর সাথে সম্পৃক্ত না।’ ” (ইবনে আসাকির)

কায়েস বিন উবাদ বলেছেনঃ জঙ্গে জামালের দিন আমি আলীকে বলতে শুনেছি – “হে আল্লাহ, আপনি খুব ভালো করেই জানেন যে,আমি উসমানের রক্তের সাথে কোনোভাবেই জড়িত না। তার শাহাদাতের সংবাদ পেয়ে আমার জ্ঞান হারিয়ে যায়। লোকেরা আমার কাছে বাইআত করতে এলে আমি তাদের ভাল মনে করিনি,আমি তাদের বলেছি -আল্লাহর কসম, উসমানকে যারা হত্যা করেছে তাদের সম্প্রদায়ের নিকট থেকে বাইআত নিতে আমি লজ্জাবোধ করছি। তবুও এরচেয়েও আমি বেশী লজ্জিত আল্লাহ তাআলার কাছে, এরপর আমি তাদের ফিরিয়ে দিলাম। তারা আবার আসে আর বাইআত করে। আমি উসমানের জন্য দুয়া করছি, হে আল্লাহ, উসমানের প্রতি সন্তুষ্ট হোন।” (হাকিম)

আবু খালদাহ হানাফী থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেন যে,আলী বলেছেন,“বনু উমাইয়্যা মনে করে, উসমানকে আমি হত্যা করিয়েছি। আল্লাহর কসম,আমি হত্যা করিনি,হত্যকারীকে সাহায্যও করিনি। বরং আমি নিষেধ করেছি, কিন্তু কেউ তা শোনেনি।”

সমরাহ বলেছেন,“ইসলাম একটি দুর্ভেদ্য দুর্গ। উসমানের হত্যকারীরা একে ছিদ্র করে দিয়েছে, যা কিয়ামত পর্যন্ত বন্ধ হবে না। আর মদীনাবাসীর হাতে খিলাফতের দণ্ড ছিল,ঘাতকের দল তা নিক্ষেপ করায় কিয়ামত পর্যন্ত তা মদীনায় আর ফিরে আসবে না।”

মুহাম্মদ বিন সিরীন বলেছেন,“উসমানকে হত্যা করার পর থেকে ফেরেশতাগণ যুদ্ধের ময়দানে আর সাহায্য করে না। উসমানকে হত্যা করার আগ পর্যন্ত চাঁদ দেখা নিয়ে কোনো মতভেদ ছিল না। আর হুসেনকে হত্যা করার পর আকাশে রক্তিম প্ৰভা দেখা দেয়।” (এ বর্ণনাটি বিশুদ্ধ নয়)

তাসনীফ গ্রন্থে হামীদ বিন হিলাল থেকে আব্দুর রাজ্জাক বর্ণনা করেছেন যে,উসমানের কাছে গিয়ে আব্দুল্লাহ বিন সালাম বললেন,“কেউ তাকে হত্যা করতে পারবে না। যারা করবে, তারা কুষ্ট রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যাবে। মনে রাখবে,এক নবীর পরিবর্তে সত্তার হাজার, আর একজন খলীফার পরিবর্তে পয়ত্রিশ হাজার প্রাণ বিসর্জনের পর উম্মতের ঐক্য ও সংহতি ফিরে আসবে।”

আব্দুর রহমান বিন মাহদী থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেন,“উসমানের এমনও বৈশিষ্ট্য ছিল, যা আবু বকর আর উমরের মধ্যে ছিল না। এক – শহীদ হওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধারণ, এবং দুই – কিরাতের মাধ্যমে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধকরণ।

 

তেরোতম পরিচ্ছেদ

মূসা বিন তালহা থেকে ইবনে সাদ বর্ণনা করেছেন,“উসমান জুমআর দিন হলুদ পোশাক পরে মিম্বরে আরোহণ করতেন। মুআজ্জিন আযান দিতেন,আর তিনি লোকদের কুশল জিজ্ঞেস করতেন।”

আব্দুল্লাহ রুমী থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ উসমান একাই রাতে উঠে অযূ করতেন। একজন বললো,“সহযোগিতার জন্য খাদেমকে ডাকলে হয় না ?” তিনি বললেন,“তার জন্যও রাত বিশ্রামের সময়।”

উমর বিন উসমান বিন আফফান থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেনঃ তার আংটিতে খোদাই করে লিখা ছিল –

امنت بالذي خلق فسوي

দালায়েল গ্রন্থে ইবনে উমর থেকে আবু নাঈম বর্ণনা করেছেনঃ উসমান তার এক ভাষণে বললেন,“একদিন জাহজাহ খিফারী আমার হাত থেকে লাঠি কেড়ে নিয়ে ভেঙ্গে ফেলার এক বছর পর আল্লাহ তাআলা তাকে এমন রোগ দেন যে,তার শরীর থেকে গোশত খুলে খুলে পড়তো।”

আওয়ায়েল গ্রন্থে আসকারী লিখেছেনঃ উসমান (রাঃ) সর্বপ্রথম বৃত্তির প্রবর্তন,পশু চরানোর জন্য চারণভূমি নির্ধারণ,তাকবীর ধ্বনি মৃদু,মসজিদে সুগন্ধীর ব্যবস্থা,জুমআর দিন দুই আযানের নিয়ম আর মুআযযিনের বেতন নির্ধারণ করেন।” (ইবনে সাদ)

তিনিই সর্বপ্রথম সম্পদ থেকে যাকাত বের করার নিয়ম চালু করেন। পিতার জীবদ্দশায় তিনিই প্রথম খলীফা। তিনি পুলিশ বাহিনী গঠন করেন। উমরের শাহাদতের কারণে মসজিদে নিজের জন্য মিহরাব তৈরি করেন। তার যুগে ব্যাপক মতানৈক্যের কারণে পরস্পরকে ভ্রান্ত মনে করতো। কিন্তু পূর্বে এ মতানৈক্য মাসায়েল আর ফিকাহ’র মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো,মতানৈক্যের জন্য একে অপরকে ভ্রান্ত মনে করতো না। তিনি সর্বপ্রথম স্বপরিবারে আল্লাহর পথে হিজরত করেন।

হাকীম বিন উবাদা বিন হানীফ থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেন,“তার যুগে সম্পদের অফুরন্ততার কারণে অলস প্রকৃতির ধনীরা তীর দিয়ে কবুতর শিকারের প্রথা চালু করায় তিনি তো রোধ করার জন্য তার খিলাফতের অষ্টম বর্ষে লাইস বংশের এক ব্যক্তিকে নিয়োগ করেন।”

তার খিলাফতকালে সুরাকা বিন মালিক বিন জাশাম,জাব্বার বিন সখর,হাতিম বিন আবী বলতয়া,আয়াস বিন যুহায়ের,আবু উসাঈদ আস সাদী,আওস বিন সামিত,হরস বিন নওফেল,আব্দুল্লাহ বিন হুযাফা,যায়েদ বিন হজেযা (তিনি মৃত্যুর পরেও কথা বলেছিলেন), কবি লাবীদ,সাঈদের পিতা মুসায়্যাব,মুআয বিন আমর বিন জুমুহ, মাবাদ বিন আব্বাস,মুতাকীব বিন আবী ফাতেমা আদাদওসী,আবু লুবাবা বিন আব্দুল মুনযির, নাঈম বিন মাসউদ আশজায়ী প্রমুখ সাহাবা তাবেঈ  ইন্তেকাল করেন।