মুয়াবিয়া বিন আবু সুফিয়ান রাদিয়াল্লাহু আনহু

মুয়াবিয়া বিন আবু সুফিয়ান সখর বিন হরব বিন উমাইয়া বিন আব্দুশ শামস বিন আব্দে মানাফ বিন কুতসী আল উমুরী আবু আব্দুর রহমান। তার পিতা আবু সুফিয়ান আর তিনি মক্কা বিজয়ের সময় মুসলমান হোন এবং হুনাইনের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। প্রাথমিক অবস্থায় মুয়াল্লাফাতুল কুলুব ছিলেন,পরবর্তীতে খাঁটি মুসলমানে পরিণত হোন। তিনি রাসূলুল্লাহ’র (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কেরানী ছিলেন।

তিনি ১৬৩টি হাদীস নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে বর্ণনা করেছেন। অনেক সাহাবী, যেমন – ইবনে উমর,ইবনে আব্বাস,ইবনে যুবাইর,আবুদ দারদা,জারীরুল বিজলী,নুমান বিন বশীর প্রমুখ এবং তাবেঈদের মধ্যে যেমন ইবনুল মুসায়েব, হুমায়েদ বিন আব্দুর রহমান প্রমুখ তার কাছ থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন।

তিনি সমসাময়িক যুগে বুদ্ধিমান,আলিম আর বীরত্বে খ্যাতি অর্জন করেন। তার মর্যাদা সম্বলিত অনেক হাদীস রয়েছে।

তিরমিযী শরীফে আব্দুর রহমান বিন আবু উমাই(রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমীর মুয়াবিয়ার ক্ষেত্রে বলেছেন,“হে আল্লাহ, মুয়াবিয়াকে হিদায়াতপ্রাপ্তকারী আর হিদায়াতদানকারী হিসেবে বানিয়ে দিন।” ইমাম তিরমিযী এ হাদীসটি হাসান বলে অভিহিত করেছেন।

ইমাম আহমাদ ‘মুসনাদ’গ্রন্থে আরবাস বিন সারিয়া থেকে বর্ণনা করেছেন,“আমি রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে বলতে শুনেছি, “হে আল্লাহ, মুয়াবিয়াকে হিসাব-কিতাব শিক্ষা দিন আর তাকে আযাব থেকে হেফাযত করুন।”

আবু শায়বা ‘মুসান্নাফ’গ্রন্থে এবং তাবারানী ‘কবীর’গ্রন্থে আব্দুল মালিক বিন উমায়ের থেকে বর্ণনা করেছেন যে,মুয়াবিয়া (রাঃ) বলেছেন,“আমি সে সময় থেকে খিলাফতের আশা পোষণ করে আসছি, যখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছিলেন – ‘মুয়াবিয়া, তুমি বাদশাহ হলে লোকদের কাছে খুব ভালোভাবে উপস্থাপিত হবে।’ ”

আমীর মুয়াবিয়া (রাঃ) শারীরিক উচ্চতাসম্পন্ন আর সুন্দর চেহারাবিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন। উমর (রাঃ) তাঁকে দেখে বলতেন,“এ আরবের কিসরা (পারস্য সম্রাট)।”

আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে,তিনি বলেছেন,“মুয়াবিয়াকে খারাপ ভেবো না। তার অন্তর্ধানে দেখবে অনেক মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।”

মুকবিরী বলেছেন,“আশ্চর্য! লোকেরা কিসরা আর কায়সাররে আলোচনায় মগ্ন,কিন্তু তারা মুয়াবিয়ার কথা ভুলে গেছে!”

আমীর মুয়াবিয়ার দয়াদ্রতা ছিল উপমাহীন, তার নম্রতাও ছিল উপমাহীন। ইবনে আবীদ দুনিয়া আর আবু বকর বিন আবু আসেম তার নম্রতার উপর পৃথক গ্রন্থ রচনা করেছেন।

ইবনে আউফ (রাঃ) বলেছেন যে,এক ব্যক্তি আমীর মুয়াবিয়াকে বললো,“মুয়াবিয়া, আপনি সোজা হয়ে যান,নাহলে আমি আপনাকে সোজা করবো।” তিনি জিজ্ঞেস করলেন,“তুমি কিভাবে সোজা করতে পারো ?” সে বললো,“কাঠের আঘাতে।” তিনি বললেন,“সে সময় ঠিকই সোজা হয়ে যাবো।”

কাবিসা বিন জাবের বলেছেন,“আমি অনেক দিন তার সাহচর্যে থেকে দেখেছি, তার চেয়ে বেশী জ্ঞানী, ধৈর্যশীল আর বুদ্ধিমান দেখিনি।”

আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) সিরিয়ায় সেনাবাহিনী পাঠানোর সময় আমীর মুয়াবিয়া (রাঃ) নিজের ভাই ইয়াজিদ বিন আবু সুফিয়ানের সাথে সিরিয়ায় যান। ইয়াজিদের মৃত্যুর পর আবু বকর সিদ্দীক (রা.) তার স্থানে মুয়াবিয়ার নাম ঘোষনা করেন। এরপর উমর ফারুক (রাঃ) তাঁকে অপরিবর্তিত রাখেন। উসমান গনী (রাঃ) এর যুগে তিনি গোটা সিরিয়ার গভর্নরের পদ অংকৃত করেন। এ দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি বিশ বছর আমীর আর বিশ বছর খলীফার তখত শোভিত করেন।

কাবে আহবার (রহঃ) বলেছেন,“এ উম্মত আমীর মুয়াবিয়ার চেয়ে দীর্ঘ শাসন প্রত্যক্ষ করেনি।”

যাহাবী (রহঃ) বলেছেন,আমীর মুয়াবিয়ার খিলাফতের আগেই কাব আহবারের মৃত্যু হয়। কাব স্বীকার করেছেন,তার একাধারে বিশ বছর খিলাফতকালে কোথাও কোন গভর্নর অথবা স্থানীয় প্রশাসক বিদ্রোহ করেননি, যেমন তার পরবর্তীতে অন্য খলীফাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হয়েছিলো, আর এতে করে অনেক জনপদ তাদের হাতছাড়া হয়েছে।

আমীর মুয়াবিয়া (রাঃ) আলী (রাঃ) এর উপর নিজের নাম খলীফা রাখেন। এভাবে ইমাম হাসান (রাঃ) এর উপরও প্রস্থান করেন। এজন্য ইমাম হাসান (রাঃ) পৃথক হয়ে যান,ফলে আমীর মুয়াবিয়া (রাঃ) ৪১ হিজরীর রবিউস সানী অথবা জমাদিউল আউয়াল মাসে মসনদে আরোহণ করেন। একজন খলীফার ব্যাপারে উম্মতের ইজমার কারণে এ বছরকে ‘সালে জামায়াত’নামে অভিহিত করা হয়।

৪১ হিজরীতে আমীর মুয়াবিয়া (রাঃ) মারওয়ান বিন হাকামকে মদীনা শরীফের গভর্নর নিযুক্ত করেন।

৪৩ হিজরীতে রাহাজ শহর সিজিসতান থেকে, দাওয়ান বারাকা থেকে আর কুযী শহর সুদান থেকে বিজয় লাভ করে। এ বছর তিনি স্বীয় ভ্রাতা যিয়াদকে নিজের উত্তরাধিকারী নিয়োগ করলে সর্বপ্রথম বিবাদের সূচনা হয়, যা নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নির্দেশের বৈপরিত্য সৃষ্টি করে।

৪৫ হিজরীতে কায়কাহন আর ৫০ হিজরীতে কুহিস্তান যুদ্ধের মাধ্যমে জয় হয়। সে বছরেই আমীর মুয়াবিয়া নিজের ছেলে ইয়াযিদের জন্য পরবর্তী খলীফা হিসেবে সিরিয়াবাসীর কাছ থেকে বাইয়াত গ্রহণ করেন। এ দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলামের ইতিহাসে তিনি প্রথম সেই ব্যক্তি, বেঁচে থাকা অবস্থায় (যিনি) নিজের ছেলের জন্য বাইয়াত গ্রহণ করেছেন। এরপর আমীর মুয়াবিয়া (রাঃ) মদীনাবাসীর কাছ থেকে ইয়াযিদের জন্য বাইয়াত গ্রহণ করতে মারওয়ানের প্রতি লিখিত ফরমান পাঠালেন। সুতরাং মারওয়ান খুতবার মধ্যে বললেন, “খলীফার পক্ষ থেকে নির্দেশ এসেছে আমি তার ছেলে ইয়াযিদের জন্য আপনাদের কাছ থেকে আবু বকর আর উমরের রীতিনীতি অনুযায়ী বাইয়াত নিবো।” সঙ্গে সঙ্গে আব্দুর রহমান বিন আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) প্রতিবাদ করে বললেন,“না, না, বরং তা কিসরা ও কায়সারের রীতিনীতি। কারণ আবু বকর আর উমর নিজের সন্তানাদি ও পরিবার-পরিজনের জন্য কখনো কারো কাছ থেকে বাইয়াত গ্রহণ করেননি।”

৫১ হিজরীতে আমীর মুয়াবিয়া হাজ্জ পালন করেন আর ইয়াযিদের জন্য বাইয়াত গ্রহণ করেন। তিনি ইবনে উমর (রাঃ) কে ডেকে বললেন,“একদিন তুমি আমার নেতৃত্বের প্রশংসা করেছিলে,কিন্তু আজ আমার খিলাফত সম্পর্কে জনসাধারণ্যে সংশয়ের বীজ বপন করছো।” ইবনে উমর (রাঃ) হামদ ও সানার পর বললেন,“আপনার আগের খলীফারবৃন্দের পুত্র সন্তন ছিলো,যাঁদের থেকে আপনার ছেলে কোন দিক থেকেই শ্রেষ্ঠ নয়। তবুও পুর্ববর্তী খলীফাগণ নিজ সন্তানদের কখনো ক্ষমতার উত্তরাধিকার করেননি;বরং তারা বিষয়টি জনসাধারণের উপর ন্যস্ত করেছেন। আপনিও সেভাবে ইজমা করুন, আমি ইজমাকারীদের একজন। আপনি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন যে,আমি মানুষদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছি,অথচ আমি তা করিনি।” এ বলে তিনি চলে গেলেন।

এরপর তিনি ইবনে আবু বকর (রাঃ) কে ডেকে একই বিষয় উত্থাপন করলে ইবনে আবু বকর (রাঃ) মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন,“আপনি কি মনে করেছেন এ কাজের জন্য আমরা আপনাকে প্রতিনিধি বানিয়েছি ?” আল্লাহর কসম, আমরা এ কাজের জন্য আপনাকে নেতা মনোনীত করিনি। আল্লাহর কসম, আমরা চাই এ বিষয়টি সকল মুসলমানের ঐক্যবদ্ধ শূরার (কমিটি) কাছে ন্যস্ত করতে,নাহলে আমরা প্রতারিত হয়ে বিষয়টি খারাপ করে দিবো।” এ বলে তিনি চলে গেলেন।

ইবনে আবু বকর (রাঃ) যাওয়ার সময় আমীর মুয়াবিয়া (রাঃ) প্রথমে এ বলে দুয়া করলেন,“হে আল্লাহ, এ লোকের অনিষ্ট থেকে আপনি যেভাবেই হোক আমাকে রক্ষা করুন।” এরপর আমীর মুয়াবিয়া (রাঃ) বললেন, “তুমি কাজের মধ্যে কঠোরতা অবলম্বন করে এ সংবাদ সিরিয়াবাসীকে জানিয়ে দিয়ো না। তারা যেন তোমাদের সাথে মিলিত হয়ে কিছু না করতে পারে। আমি চাই তোমরা ইয়াযিদের জন্য বাইয়াত করেছো – এ খবর সিরিয়ায় পৌছে দিতে।”

এরপর আমীর মুয়াবিয়া (রাঃ) ইবনে যুবায়ের (রাঃ) কে ডেকে বললেন,“হে যুবায়েরের ছেলে, তুমি তো খেঁকশিয়ালের মতো এক ক্ষেত থেকে বের হয়ে আরেক ক্ষেতে গিয়ে লুকাও। তুমি ওদের কানে (ইবনে উমর রাঃ আর ইবনে আবু বকর রাঃ) কোন বাতাস ছড়িয়ে দিয়েছো,যা তাঁদেরকে বাইয়াত গ্রহণে বিরত রেখেছে ?” ইবনে যুবায়ের (রাঃ) বললেন,“আপনি খিলাফত সম্পর্কে অসন্তুষ্ট হলে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ান। আমরা আপনার ছেলের হাতেই বাইয়াত দিবো। আপনিই বলুন, আমরা আপনার বাইয়াত না আপনার বাইয়াতের আনুগত্য করবো ? একই যুগে দুই বাদশাহর বাইয়াত গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।” এ বলে তিনি চলে গেলেন।

তারপর আমীর মুয়াবিয়া মিম্বরে আরোহণ করে হামদ ও নাতের পর বললেন,“আমি অপরিপক্ক লোকদের বলতে শুনেছি, ইবনে উমর, ইবনে আবু বকর আর ইবনে যুবায়ের কখনো ইয়াযিদকে বাইয়াত দিবে না। বস্তুত,তারা ইয়াযিদের ইতাআত ও বাইয়াত সবই করেছে।” এ কথা শুনে সিরিয়াবাসী বললো,“আল্লাহর কসম, তারা আমাদের সামনে বাইয়াত না করলে আমরাও বাইয়াত করবো না। আর তারা বাইয়াত করতে অস্বীকার করলে আমরা তাদের গর্দান উড়িয়ে দিবো।” আমীর মুয়াবিয়া বললেন,“সুবহান-আল্লাহ! আল্লাহর কসম, এর আগে তোমাদের মুখে কুরাইশদের শানে দৃষ্টতাপূর্ণ উক্তি আর কখনো শুনিনি।” এ বলে তিনি নিচে নেমে এলেন। এরপর লোকেরা ইবনে উমর,ইবনে আবু বকর আর ইবনে যুবায়ের কর্তৃক ইয়াযিদের বাইয়াত গ্রহণের বিষয়ে আলোচনা করছিলো, অথচ তারা তার বাইয়াতের বিষয়টি সবসময় প্রত্যাখ্যান করে এসেছে। আমীর মুয়াবিয়া হাজ্জ শেষে সিরিয়ায় ফিরে যান।

ইবনে মানকাদর বলেছেন,“ইয়াযিদকে বাইয়াত দেওয়ার সময় ইবনে উমর বলেছিলেন,তিনি যদি ভালো মানুষ হোন, তবে তার প্রতি সন্তুষ্ট,নতুবা বিপদের সময় ধৈর্য ধারণ করবো।”

হাওয়াতিফ গ্রন্থে হুমায়েদ বিন ওহাবের বরাত দিয়ে খারায়েতী লিখেছেনঃ আমীর মুয়াবিয়ার মা হিন্দা বিনতে উতবা বিন রবীয়ার প্রথমে ফাকা বিন মুগীরার সাথে বিয়ে হয়। ফাকার একটি বৈঠকখানা ছিল,এখানে অবাধে লোক যাতায়াত করতো। একদিন হিন্দা আর ফাকা বৈঠকখানায় বসে ছিল। কিছুক্ষণ পর কোনো এক কাজে ফাকা উঠে যায়। এমন সময় এক ব্যক্তি বৈঠকখানায় এসে একাকী নারীর উপস্থিতি দেখে চলে যেতে উদ্যোত হয়। ঠিক এ মুহূর্তে ফাকা এসে বৈঠকখানা থেকে অপরিচিত লোক বের হতে দেখে হিন্দাকে আক্রমণ করে জানোতে চায় ওর সাথে তার কি সম্পর্ক। হিন্দা নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে চাইলে ফাকা বললো,আমার বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যাও। সংবাদটি দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে আর তা নিয়ে মানুষের মাঝে ব্যাপক কানাঘুষা আরম্ভ হয়। ফলে হিন্দার বাবা উতবা মেয়েকে বললো,“আলোচনা সমালোচনায় লোকেরা কান ভারি করে ফেলেছে। তুমি আমাকে সত্য করে বলো,যদি তোমার স্বামী সঠিক হয় তবে লোক নিয়োগ করে তার গর্দান উড়িয়ে দিবো। আর যদি সে মিথ্যাবাদী হয় তবে ইয়ামানের কোন যাদুকরের কাছে বিষয়টি পেশ করবো।”

এরপর হিন্দা নিজেকে সতী প্রমাণ করার জন্য জাহেলি যুগে যত কসম ছিল সব কসম করতে শুরু করলো। এতে করে উতবার বিশ্বাস হয় যে,হিন্দা সতী। আর ফাকা তার মেয়ের প্রতি অপবাদ দিয়েছে। এজন্য উতবা নিজ গোত্রীয় লোকদের নিয়ে ইয়ামানে যায়। এদিকে ফাকাও বনু মাখযুম আর উকবা বিন আব্দে মান্নাফ গোত্রের লোকদের ইয়ামান যাত্রা করে। ইয়ামানের কাছাকাছি গিয়ে হিন্দার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেলে উতবা বললো,“এটাই প্রমাণ করে যে,তুমি অপরাধী।” হিন্দা উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করে বললো, “আপনি আমাকে এমন লোকের কাছে নিয়ে যাচ্ছেন, যার কথা সত্যও হতে পারে,আবার মিথ্যাও হতে পারে। যদি সে আমাকে কুলটা বলে দেয়, তবে আমি আর আরবে মুখ দেখাতে পারবো না।” উতবা বললো,“তোমার বিষয় উত্থাপন করার আগে আমি তার পরীক্ষা নিবো। উত্তীর্ণ হলে তবেই তোমার বিষয়টি পেশ করবো,নতুবা নয়।”

উতবা ঘোড়ার কানে গমের একটি দানা দিয়ে কানের ছিদ্র বন্ধ করে দিলো। ইয়ামানে পৌছার পর পশু যবেহ করে সম্মানের সাথে যাদুকরকে খাওয়ানোর পর উতবা বললো,“আমি একটি গোপন বিষয় নিয়ে এসেছি; এর আগে বলুন,আমি কি করেছি ?” সে ঘোড়ার কানে গম দিয়ে ছিদ্র বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়টি বলার পর উতবা বললো,“আপনি সঠিক বলেছেন।” এরপর হিন্দার ব্যাপারে জানোতে চাইলে সে অন্য এক রমনীর কাছে গিয়ে তার মাথার চুল ধরে বললো,“দাঁড়িয়ে যা।” এভাবে তিনিবার করার পর হিন্দার কাছে এসে তার মাথায় হাত রেখে বললো,“তুমি সতী ও পবিত্রা রমণী। তুমি যিনা করোনি। মুয়াবিয়া নামে তোমার গর্ভে এক বাদশাহ জন্মগ্রহণ করবেন।”

এ কথা শুনে ফাকা হিন্দার হাত চেপে ধরে,কিন্তু সে তা ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,“তুমি চলে যাও। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করবো আমার গর্ভের সম্ভাব্য বাদশাহ যেন তোমার ঔরস থেকে না হয়।” এরপর হিন্দার সাথে আবু সুফিয়ানের বিয়ে হয় আর আমীর মুয়াবিয়া জন্মগ্রহণ করেন।

আমীর মুয়াবিয়া (রাঃ) ৬০ হিজরীর রজব মাসে ইন্তেকাল করেন। বাবে জাবীয়া আর বাবে সগীরের মধ্যবর্তীতে তাঁকে সমাহিত করা হয়।

কথিত আছে,তার বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর। তার কাছে রাসূলুল্লাহ’র (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কেশ আর নখ ছিল। মৃত্যুর সময় তিনি ওসীয়ত করেছিলেন, সেগুলো যেন তার চোখে আর মুখে দিয়ে তাঁকে দাফন করা হয়।

 

আমীর মুয়াবিয়ার জীবনের কিছু খন্ডচিত্র

ইবনে আবি শাইবা ‘মুসান্নাফ’গ্রন্থে সাঈদ বিন জুমহানের বরাত দিয়ে লিখেছেনঃ আমি সাফীনাকে বললাম, বনূ উমাইয়া বলেছে, খিলাফত তাদের বংশীয়। তিনি বললেন,সে সঠিক বলেনি। তিনি বাদশাহ,কঠোর বাদশাহ। আর সর্বপ্রথম বদশাহ হলেন মুয়াবিয়া।

বায়হাকী আর ইবনে আসাকির ইবরাহীম বিন সুওয়াইদুল আরমানীর বরাত দিয়ে বলেছেনঃ ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলকে জিজ্ঞেস করা হলো,“খলীফা কে কে ?” তিনি বললেন,“আবু বকর,উমর,উসমান আর আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম।” আমি বললাম,“আর মুয়াবিয়া ?” তিনি বললেন,“হযরত আলী (রাঃ) এর যুগে খিলাফতের যোগ্য আলী ছাড়া আর কেউ ছিল না।”

সালাফী ‘তৌরিয়াত’গ্রন্থে লিখেছেনঃ আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) হযরত আলী (রাঃ) আর হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) সম্পর্কে তার পিতাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন,“আলীর অনেক শত্রু ছিল। তারা সর্বদা তার ভুল ক্রুটির অনুসন্ধান করতো। তার কোন দোষ-ক্রুটি না পেয়ে তারা এমন লোকের কাছে সমবেত হয়,যে আগে থেকেই হযরত আলীর ব্যাপারে শত্রুতা পোষণ করতো।”

ইবনে আসাকির আব্দুল মালিক বিন উমায়ের (রহঃ) থেকে বর্ণনা করেছেনঃ একদিন জারিয়া বিন কুদামা সাদী আমীর মুয়ায়বিয়ার কাছে গেলে তিনি বললেন,“তুমি কে ?” জারীয়া বললেন,“আমি জারীয়া বিন কুদামা।” তিনি বললেন,“তুমি কি সৃষ্টি করতে চাও ? তুমি তো মূল্যহীন মধুওয়ালা মাছি।” জারীয়া বললেন,“আপনি এমন দৃষ্টান্ত দিয়েছেন যে,সেই মাছির হুল অত্যন্ত শক্ত আর মজবুত।”

ফজল বিন সুওয়ায়েদ বলেছেনঃ জারীয়া বিন কুদামা আমীর মুয়াবিয়ার কাছে গেলে তিনি বললেন, “তোমাদের (হযরত আলী) পক্ষ হতে এমন অগ্নি প্রজ্বলিত হবে,যা আরবের সকল জনপদকে ভস্মীভূত করে ফেলবে আর রক্তের নদী প্রবাহিত করে দিবে।” জারীয়া বললেন,“হে মুয়াবিয়া, আপনি হযরত আলীর পিছু ছেড়ে দিন। আমরা যেদিন থেকে তাঁকে ভালোবেসেছি, সেদিন থেকে আর তাঁকে অসন্তুষ্ট করিনি। যেদিন থেকে তার মঙ্গল কামনা করেছি, সেদিন থেকে তাঁকে ধোঁকা দেইনি।” মুয়াবিয়া (রাঃ) বললেন,“জারীয়া, তোমার ব্যাপারে দুঃখ হয়। তুমি তোমার বংশের বোঝা। যে তোমার জারীয়া (বাঁদী) রেখেছে, সে সার্থক।” জারীয়া বললেন,“হে মুয়াবিয়া, আপনিই সমাজের বোঝা। যে আপনার নাম মুয়াবিয়া (ঘেউ ঘেউকারী) রেখেছে, সে ধন্য।” তিনি বললেন,“তুমি আমাকে ধোঁকা দিয়েছো।” জারীয়া বললেন,“আপনি তলোয়ারের শক্তি দিয়েও আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারেননি। আমরা যুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছি। কিন্তু সন্ধির মাধ্যমে আপনি জেঁকে বসেছেন। প্রতিশ্রুতি রক্ষা করলে আমরাও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবো। শর্ত ভঙ্গ করলে আমরা বিকল্প পথ খুঁজবো। আমাদের সাথে অনেক সাহায্যকারী রয়েছে যাদের বর্ম খুব মজবুত আর লোহার চেয়েও পরিপক্ক। আমাদের সাথে বিশ্বাসঘতকতা করলে আমরা বিদ্রোহ করবো। এরপর আমাদের বিদ্রোহের স্বাদ আস্বাদন করবেন।” মুয়াবিয়া (রাঃ) বললেন,“আল্লাহ তাআলা তোমার মতো আর কাউকে যেন সৃষ্টি না করেন।”

আবু তোফায়েল আমের বিন ওয়াতালা সাহাবী বলেছেনঃ একদিন আমি মুয়াবিয়ার কাছে গেলে তিনি বললেন,“তুমি কি উসমান (রাঃ) এর হত্যাকারীদের একজন ?” আমি বললাম,“না,আমি উপস্থিত ছিলাম, তবে সাহায্য করিনি।” তিনি বললেন,“কে সাহায্য করতে তোমাকে নিবৃত্ত করেছে ?” আমি বললাম, “মুহাজির আর আনসারদের মধ্যে কেউ নয়।” তিনি বললেন,“লোকেরা সে প্রতিশোধ নেওয়ার অধিকার সংরক্ষন করে।” আমি বললাম,“হে আমিরুল মুমিনীন,আপনি কেন সেদিন তাঁকে সাহায্য করেননি ? অথচ সিরিয়াবাসী আপনার সাথে ছিল।” তিনি বললেন,“আমি তার রক্তের প্রতিশোধ নিয়ে তাঁকে সাহায্য করেছি।” আমি তার কথা শুনে হাসলামে আর বললাম,“উসমান (রাঃ) আর আপনার দৃষ্টান্ত এ রকম, যেরূপ কবি বলেছেন – এমনটা যেন না হয় যে,মৃত্যুর পর আমার জন্য বিলাপ করবে; আর জীবিত থাকা অবস্থায় আমার যা পাওনা ছিল তা বুঝিয়ে দিয়ো না।”

শাবী (রাঃ) বলেছেনঃ আমীর মুয়াবিয়া (রাঃ) সর্বপ্রথম বসে খুতবা পাঠের প্রবর্তন করেন। কারণ সে সময় তিনি অনেক মোটা আর পেট বড় হয়েছিলো। (ইবনে আবী শায়বা)

যুহরী বলেছেনঃ তিনি ঈদের খুৎবা নামাযের আগে পাঠ করার নিয়ম চালু করেন। (আব্দুর রাজ্জাক)

সাঈদ বিন মুসায়্যাব (রাঃ) বলেছেনঃ তার যুগে ঈদের নামাযের আযান দেয়ার মতো বিদয়াত কাজটি করা হতো। (ইবনে আবী শায়বা) তিনি এও বলেন যে, মুয়াবিয়া (রাঃ) নামাযের তাকবীর কম করে বলতেন।

আওয়ায়েল গ্রন্থে আল্লামা আসকারী লিখেছেনঃ তিনি প্রথম ডাক বিভাগের প্রবর্তন করেন। তার সাথে জনগন প্রথম গোস্তাখী করে।

তিনি এ পদ্ধতিতে সালামের রীতি প্রবর্তন করেন –

السلام عليك يا امير المؤمنين ورحمة الله وبر كاة الصلوة ير حمك الله

তিনি সর্বপ্রথম দাপ্তরিক কাজে আব্দুল্লাহ বিন আউস গাসসানীর তত্ত্বাবধানে لكل عمل سواب   খোদিত মোহর ব্যবহার করেন। আব্বসীয়া বংশের সকল খলীফা এ মোহর ব্যবহার করেছেন। আমীর মুয়াবিয়ার ফরমানে এক লক্ষ দিরহামের স্থানে এক কর্মচারী কর্তৃক দুই লক্ষ লিখিত হওয়ার প্রেক্ষিতে মোহরের প্রবর্তন করা হয়। তিনি জামে মসজিদের মেহরাব তৈরি করেন। তিনি সর্বপ্রথম কাবার গিলাফ নামানোর নির্দেশ জারি করেন।

মুকাযিয়াত গ্রন্থে যুহরীর ভাতিজার বরাত দিয়ে যুবায়ের বিন বাকার লিখেছেনঃ আমীর মুয়াবিয়া (রাঃ) সর্বপ্রথম বাইয়াতের সময় কসম খাওয়ার প্রথা চালু করেন। তিনি খিলাফতের বিষয়ে কসম করেছিলেন। আব্দুল মালিক বিন মারওয়ান গোলাম আযাদ করার ক্ষেত্রেও কসম নিতেন।

আওয়ায়েল গ্রন্থে সুলায়মান বিন আব্দুল্লাহ বিন মুআম্মারের বরাত দিয়ে আসকারী লিখেছেনঃ একদিন আমীর মুয়াবিয়া (রাঃ) মক্কা অথবা মদীনার মসজিদে গেলেন। সেখানে ইবনে উমর,ইবনে আব্বাস আর ইবনে আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম বসেছিলেন। মুয়াবিয়া (রাঃ) তাদের কাছে এসে বসলে ইবনে আব্বাস (রাঃ) মুখ ফিরিয়ে নিলেন। আমীর মুয়াবিয়া বললেন,“হে মুখ ঘুরিয়ে লেনেওয়ালা, আমি তোমার চাচাতো ভাইয়ের চেয়ে বেশী খিলাফতের হকদার।” ইবনে আব্বাস (রাঃ) বললেন,“প্রাথমিক যুগে ইসলাম গ্রহণের জন্য ? রাসূলুল্লাহ’র (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে সর্বপ্রথম সহাচার্য দানের জন্য ? না রাসুলুল্লাহ’র (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকটত্মীয় হওয়ার কারণে আপনি তার চেয়ে বেশী খিলাফতের হকদার ?” আমীর মুয়াবিয়া বললেন,“তোমার চাচার ছেলে নিহত হওয়ার কারণে।” ইবনে আব্বাস বললেন,“এ দৃষ্টিকোণ থেকে ইবনে আবু বকর বেশী হকদার।” মুয়াবিয়া বললেন,“আবু বকর (রাঃ) তো স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছেন।” ইবনে আব্বাস বললেন,“তাহলে ইবনে উমর হকদার।” মুয়াবিয়া বললেন,“এদিক থেকে তোমার যুক্তি পরিত্যাজ্য। কারণ তোমার চাচার ছেলের উপর যারা আক্রমণ করে শহীদ করেছে তারা মুসলমান।”

আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ বিন আকীল বলেছেনঃ আমি একবার মদীনা শরীফে আমীর মুয়াবিয়া (রাঃ) এর কাছে গেলাম। কিছুক্ষণ পর আবু কাতাদা (রাঃ) আনসারীও এলেন। আমীর মুয়াবিয়া তাকে বললেন,“আমার নিকট সকলেই আসলেও আনসারগণ এলেন না।” তিনি জবাব দিলেন,“আমাদের আনসারদের কাছে কোনো বাহন নেই।” আমীর মুয়াবিয়া বললেন,“তোমাদের উটগুলো কি হয়েছে ?” তিনি বললেন,“বদর যুদ্ধে আপনাদের আর আপনার বাবার পশ্চাদ্ধাবন করতে গিয়ে সবগুলো মারা গিয়েছে।” এরপর তিনি আবার বললেন, “রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে বলেছেন – আমার পর অন্যরা হকদারদের উপর প্রাধান্য পাবে।” মুয়াবিয়া বললেন,“তুমি এ পরিস্থিতিতে কি করবে ?” তিনি বললেন,“সহনশীল হবো, ধৈর্যধারণ করবো।” মুয়াবিয়া বললেন,“তবে ধৈর্যধারণ করে থাকো।”

এ প্রেক্ষিতে আব্দুর রহমান বিন হাসসান এ কবিতাটি রচনা করেন – “আমিরুল মুমিনীন মুয়াবিয়া বিন হরবের কাছে অবশ্যই এ সংবাদ পৌছে দিবে যে,কিয়ামত দিবস পর্যন্ত আপনাকে সুযোগ দেয়া হয়েছে আর আমরা সেই ইনসাফের দিন পর্যন্ত ধৈর্যধারণ করবো।”

জাবালা বিন সাহীম থেকে ইবনে আবীদ দুনিয়া আর ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেনঃ আমি আমীর মুয়াবিয়ার কাছে গিয়ে মুয়াবিয়ার গলায় দড়ি লাগিয়ে এক বাচ্চাকে টানতে দেখে বললাম,“এ বাচ্চা কি করছে ?” তিনি বললেন,“চুপ করো। আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে বলতে শুনেছি যে,বাচ্চার সাথে মিশলে নিজেকে বাচ্চা হয়ে যেতে হয়।” ইবনে আসাকিরের মতে হাদীসটি গারীব।

মুসান্নাফ গ্রন্থে ইবনে আবী শায়বা লিখেছেনঃ এক কুরাইশ ব্যক্তি আমীর মুয়াবিয়ার কাছে গিয়ে অনেক নরম-গরম মন্তব্য শুনানোর পর মুয়াবিয়া বললেন,“ভাতিজা, এ ধরনের মন্তব্য থেকে ফিরে আসো। বাদশাহর রাগ বাচ্চার রাগের মতো। আর বাদশাহর আক্রমণ বাঘের মতো ক্ষিপ্র ও দুর্ধর্ষ।”

যিয়াদের বরাত দিয়ে শাবী বলেছেনঃ আমি খারাজ আদায় করার জন্য এক লোককে পাঠালাম। সে ফিরে এসে সন্তোষজনক হিসাব দিতে না পারায় আমার ভয়ে আমীর মুয়াবিয়ার কাছে আশ্রয় নেয়। আমি বিষয়টি তাঁকে জানালে তিনি চিঠি লিখে জানালেন,আমাদের একই পদ্ধতিতে রাজনীতি করা সম্ভব নয়। আমরা উভয়ে নমনীয় হলে জাতি পাপকার্যে নিমজ্জিত হবে। আবার উভয়ে কঠোর হলে আমজনতা শেষ হয়ে যাবে। অতএব,তুমি নমনীয় হলে আমার অবস্থান শক্ত হবে,আর তুমি কঠোর হলে আমি মমতার আশীর্বাদ নিয়ে জাতির সামনে এসে দাঁড়াবো।

শাবী বলেছেনঃ আমি মুয়াবিয়াকে বলতে শুনেছি, যে জাতি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে অনৈক্য ও মতভেদ থাকবে, সে জাতির উপর ভ্রান্ত মতবাদে বিশ্বাসী সম্প্রদায় প্রাধান্য পাবে; তবে এ উম্মতের উপর এমনটা হবে না।

তৌরিয়াত গ্রন্থে সুলায়মান আল-মাখযুমী কর্তৃক বর্ণিতঃ একদিন আমীর মুয়াবিয়া (রাঃ) জনসাধারণের এক উন্মুক্ত সমাবেশে নিজের জন্য প্রযোজ্য এমন অর্থবোধক তিনিটি আরবী কবিতা শোনার আগ্রহ প্রকাশ করলে আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের (রাঃ) তিন লক্ষ্য দিরহামের বিনিময়ে তা শোনাতে সক্ষম হোন। পরিশেষে মুয়াবিয়ার রাজি হওয়ার প্রেক্ষিতে আবদুল্লাহ বিন যুবায়ের আবৃত্তি করেন; প্রথম কবিতা -“আমি জনতাকে পালন করে থাকি, আমি তোমাকে ছাড়া লোকদের মধ্যে কাউকে শত্রুতা পোষণ করতে দেখিনি।” দ্বিতীয় কবিতা –“আমি তোমার যুগে বেদনায় বিধ্বস্ত জনতার দলকে শত্রুতা ছাড়া আর কিছু করতে দেখিনি।” তৃতীয় কবিতা – “আমি সকল দুঃখ ও লজ্জার স্বাদ পেয়েছি, কিন্তু ভিক্ষাবৃত্তির চেয়ে বড় লজ্জাকর কাজ আর দেখিনি।” মুয়াবিয়া বললেন,“তুমি যথার্থই বলেছো।” এরপর তিনি কবিকে তিনি লক্ষ দিরহার দেওয়ার নির্দেশ দিলেন।

ইমাম বুখারী,ইমাম নাসাঈ আর ইবনে হাতিম (রহঃ) কর্তৃক স্বরচিত তাফসীর গ্রন্থে লিখেছেনঃ মারওয়ান যখন আমীর মুয়াবিয়া (রাঃ) কর্তৃক মদীনার গভর্নর, সে সময় একদিন তিনি খুতবার মধ্যে বলেছিলেন, “আমিরুল মুমিনীন মুয়াবিয়া (রাঃ) তার  ছেলেকে খলীফা মনোনীত করার ব্যাপারে যে অভিমত পেশ করেছেন তা যথাযথ। কারণ এটাই ছিল আবু বকর আর উমরের নীতি।” এটা শুনে আব্দুর রহমান বিন আবু বকর (রাঃ) বললেন,“এটা আবু বকর (রাঃ) আর উমর (রাঃ) এর নীতি নয়, বরং তা কিসরা ও কায়সারের নীতি। কারণ আবু বকর আর উমর নিজের সন্তানাদি আর পরিবারের মধ্য থেকে কারো জন্য বাইয়াত গ্রহণ করেননি। আর মুয়াবিয়া (রাঃ) দয়ার্দ্র পিতা হিসেবেই ছেলের জন্য এমনটা করেছেন।” মারওয়ান বললেন, “তোমরা তো সেই ব্যক্তি নও, যাদের কথা কুরআনে বিধৃত রয়েছে। তোমাদের পিতার মৃত্যুতে তোমরা তো আহ শব্দটুকুও বলোনি। তোমরা তো নিজ পিতাদের প্রতিরোধ করেছিলে।” ইবনে আবু বকর (রাঃ) বললেন, “তুমি কি অভিশপ্তের পুত্র নও ? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তোমার বাবাকে অভিশাপ দিয়েছিলেন।” বিষয়টি আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) পর্যন্ত পৌছে গেলে তিনি বললেন,মারওয়ান মিথ্যা বলেছে। আয়াতটি অমুক লোকের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে। আর মারওয়ান তার পিতার ঔরসে থাকা অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মারওয়ানের পিতাকে অভিশাপ দিয়েছিলেন। এ দিক থেকে মারওয়ান অভিশাপের মধ্যেই জন্মগ্রহণ করেছে।

মুসান্নাফ গ্রন্থে ওরওয়ার বরাত দিয়ে ইবনে আবি শায়বা লিখেছেন যে,মুয়াবিয়া বলেছেন,“মানুষের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা ছাড়া ধৈর্য ও সহনশীলতা সৃষ্টি হয় না।”

শাবী থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেনঃ মুয়াবিয়া,আমর বিন আস,মুগীরা বিন শোবা আর যিয়াদ হলেন আরবের শ্রেষ্ঠ চার বুদ্ধিমান। মুয়াবিয়া (রাঃ) ভদ্রতা,বিনয় আর বিচক্ষণতায়; আমর বিন আস কষ্ট সহিষ্ণুতায়,মুগীরা বিন শোবা স্বাধীনতা হাত ছাড়া না হওয়ার জন্য যত্নশীল হওয়ায় এবং যিয়াদ বগ্লাহীন কথা বলার জন্য বিখ্যাত।

ইবনে আসাকির এটাও বর্ণনা করেছেনঃ উমর (রাঃ), আলী (রাঃ),ইবনে মাসউদ (রাঃ) আর যায়েদ বিন সাবিত (রাঃ) ছিলেন আরবের শ্রেষ্ঠ চার বিচারক।

কুবায়সা বিন জাবির বলেছেনঃ আমি উমর বিন খাত্তাব (রাঃ) এর সাহচর্যে থেকে এটুকু বুঝতে পেরেছি যে, তার চেয়ে বেশী কুরআন শরীফ আর আইনের জ্ঞান কারো ছিল না। আমি তালহা বিন উবায়দুল্লাহর সাথেও ছিলাম, না চাইতে দান করার প্রবণতা তার চেয়ে বেশী কারো মধ্যে দেখিনি। আমি মুয়াবিয়ার সাথেও ছিলাম, মুয়াবিয়ার চেয়ে ধৈর্যশীল আর বিচক্ষণ আলেম আমার চোখে পড়েনি। আমর বিন আসের চেয়ে নিরাপদ সহকর্মী এবং বিশ্বস্ত বন্ধু আর কেউ নেই।

জাফর বিন মুহাম্মদের পিতার বরাত দিয়ে ইবনে আসাকির উল্লেখ করেনঃ একদিন আকীল (রাঃ) আমীর মুয়াবিয়ার কাছে গেলে তিনি বললেন,“এ তো সেই আকীল, যার চাচা আবু লাহাব।” আকীল বললেন,“এ তো সেই মুয়াবিয়া যার ফুফু হামালাতুল হতব (আবু লাহাবের স্ত্রীর নাম -অনুবাদক)

আওযায়ী থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেনঃ একদিন হুযায়েম বিন ফাতাক আমীর মুয়াবিয়ার কাছে গেলেন। হুয়ায়েমের পায়ের গোছা ছিল খুবই সুদর্শন,তা দেখে মুয়াবিয়া বললেন,“এ পায়ের গোছা কোন নারীর ?” হুযায়েম বললেন,“হে আমিরুল মুমিনীন,আপনার পত্নীর।”

তার খিলাফতকালে যেসব প্রখ্যাত আলেম বুযুর্গ ইন্তেকাল করেছেন তারা হলেন – সাফওয়ান বিন উমাইয়া, হাফসা,উম্মে হাবীবা,সুফিয়া,মাইমূনা,সাওদা,জুয়াইরিয়া,আয়েশা সিদ্দীকা,লাবীদ কবি,উমরান বিন হাসীন,উসমান বিন তালহা,আমর বিন আস,আব্দুল্লাহ নিন সালাম,মুহাম্মদ বিন মাসলামা,আবু মূসা আশয়ারী,যায়েদ বিন সাবিত,আবু বকর,কাব বিন মালিক,মুগীরা বিন শোবা,জারিরুল বিজলি,আবু আউয়ুব আনসারী,সাঈদ বিন যায়েদ,আবু কাতাদা আনসারী,ফুজালা বিন উবায়েদ,আব্দুর রহমান বিন আবু বকর,যুবায়ের বিন মুতঈম,উসামা বিন যায়েদ,সওবান, আমর বিন হাজম,হাসসান বিন সাবিত,হাকিম বিন হাযাম,সাদ বিন আবী ওয়াক্কাস,আবু লাইসাম,কসম বিন আস,তার ভাই উবায়দুল্লাহ এবং উকবা বিন আমের (রাঃ)।

আবু হুরায়রা (রাঃ) ৫৯ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। তিনি এ মর্মে প্রার্থনা করেছিলেন যে,“হে আল্লাহ, আমাকে ৬০ হিজরী আর বাঁদীদের রাজত্ব থেকে রক্ষা করুন।” তার দোয়া কবুল হয়েছিলো।