সাফফাহঃ বনু আব্বাসের প্রথম খলীফা

আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ বিন আলী বিন আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিব। উপাধি আবুল আব্বাস। সাফফাহ বনূ আব্বাসের প্রথম বাদশাহ। তিনি ১০৮ হিজরী, ভিন্ন মতে ১০৪ হিজরীতে বলকার উত্তপ্ত রণাঙ্গনে জন্মগ্রহণ করেন আর সেখানেই প্রতিপালিত হোন।

কুফায় তার বাইআত গ্ৰহণ অনুষ্ঠান হয়। মাতার নাম রায়েলাতুল হারিসা। তিনি নিজ ভাই ইবরাহীম বিন মুহাম্মাদের কাছে হাদীস শ্ৰবণ করেন। চাচা ঈসা বিন আলী তার থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। তিনি বয়সে নিজ ভাই মানসুরের ছোট।

ইমাম আহমাদ মুসনাদ গ্রন্থে আবু সাঈদ খুদরী থেকে বর্ণনা করেছেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,“একটি বিশৃঙ্খল অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হলে আমার আহলে বাইতের মধ্য থেকে সাফফাহ নামক একজনের আবির্ভাব হবে। তিনি প্রচুর পরিমাণে সম্পদ লোকদের দান করবেন।”

উবাইদুল্লাহ আয়শী বলেনঃ আমার বাবা বলেছেন,“বনু আকবাসের শাসনামল যখন এলো, তখন আমার শিক্ষক বললেন – আল্লাহর কসম, বনু আব্বাসের পরিবার অপেক্ষা বড় ক্বারী,ইবাদতকারী আর দানশীল এ ভুবনে আর কেউ নেই।”

ইবনে জারীর তাবারী বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ চাচা আব্বাস (রাঃ) কে “আপনার বংশে খিলাফত স্থানান্তর হবে” এ কথা বলার পর থেকে আব্বাসের বংশধররা খিলাফত প্ৰাপ্তির কামনা করতে থাকেন।

রাশিদীন বিন কুরায়েব কর্তৃক বর্ণিতঃ আবু হাশিম আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মদ বিন হানীফ সিরিয়া যাবার পথে মুহাম্মাদ বিন আলী বিন আব্দুল্লাহ বিন আব্বাসের সাথে সাক্ষাত হলে বললেন,“হে চাচাতো ভাই, একথা কাউকে বলবেন না,আমার মন বলছে অচিরেই খিলাফত আপনাদের হাতে এসে পড়বে।” মুহাম্মাদ বললেন,“আমারও তাই মনে হচ্ছে,এ কথা আর কাউকে জানাবেন না।”

মাদায়েনী বলেনঃ আমি অনেক লোকের কাছে শুনেছি,ইমাম মুহাম্মাদ বিন আলী বিন আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস তিন বার অর্থাৎ, প্রথমবার ইয়াযিদ বিন মুআবিয়ার মৃত্যুর সময়, দ্বিতীয়বার এ শতাব্দীর শুরুর দিকে আর তৃতীয়বার আফ্রিকায় বিশৃঙ্খলার সময় বলেছিলেন,আমার মনে হয় পূর্ব দিক থেকে দলে দলে লোকেরা আমাদের সাহায্য নিতে ছুটে আসবে আর তাদের সাহায্যে বনূ আব্বাসের ঘোড়াগুলো পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত ছুটে যাবে। ইয়াযিদ বিন আবু মুসলিম আফ্রিকায় শহীদ হওয়ার পর বারবার জাতি বিদ্রোহ করলে ইমাম মুহাম্মাদ আবু মুসলিম খুরাসানীকে একটি চিঠি দিয়ে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরিবারের প্রতি লোকদের আহবান করার জন্য পাঠান। লোকেরা প্রস্তুত ছিল। এমন সময় ইমাম মুহাম্মাদ ইত্তেকাল করেন। লোকেরা তার ছেলে ইবরাহীমের কাছে বাইআত করে। এ সংবাদ পেয়ে মারওয়ান ইবরাহীমকে উঠিয়ে নিয়ে যায় আর হত্যা করে। এরপর ইবরাহীমের ভাই সাফফার কাছে দলে দলে আমজনতা আসতে থাকে। অবশেষে ১৩২ হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসের ৩ তারিখে কুফায় সাফফাকে লোকেরা বাইআত দেয়। তিনি এসব লোকের জুমুআর নামায পড়ান আর খুৎবার মধ্যে বলেন,“সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহ পাকের যিনি বিধান হিসেবে ইসলামকে মনোনীত করেছেন।” এরপর তিনি কুরআন শরীফের আয়াত তিলাওয়াতের মাধ্যমে নিজ পরিবারের বিবরণ দিয়ে বললেন,“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পর ইসলামের সকল কাৰ্যাদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীদের উপর বার্তায় । কিন্তু বনু হারব আর মারওয়ান তা কুক্ষিগত করে অত্যাচার শুরু করে। তারা অনেক অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ে। আমাদের প্রাপ্য আমাদের দেওয়া হলে আমরা সে যুগের হতদরিদ্রদের সেবা করতে পারতাম। যারা আমাদের বংশের সাথে কোন প্রকার সম্পর্ক রেখেছে তাদেরকেও সরিয়ে দেয়া হয়েছে। সে সময় আমাদের আর আহলে বাইতের কোন প্রকার ক্ষমতাই ছিল না। হে কুফাবাসী, আপনারা আমার ভালোবাসার প্রাসাদ আর বন্ধুত্বের মারকায। আপনারা কখনোই আমার ভালোবাসা থেকে দূরে সরে যাবেন না। অত্যাচারীর নির্মম অত্যাচারও আমাদের পৃথক করে রাখতে পারবে না।”

ঈসা বিন আলী (বিন আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস হাশেমী,হিজাযী,বাগদাদী) হুমায়মা থেকে কুফা আসার সময় সাফফাহর সাথে চৌদ্দজন বীর সাহসী লোককে নিতে বলেন। সংবাদ পেয়ে মারওয়ান প্রতিরোধ করতে এলে তিনি নির্মমভাবে পরাজিত হোন আর তিনিসহ বনূ উমাইয়্যার অসংখ্য মানুষ আর অগনন সৈনিক নিহত হয়। এভাবে সাফফাহ গোটা পশ্চিমাঞ্চল পদানত করেন ।

যাহাবী বলেছেনঃ সাফফাহর শাসনামলে ঐক্যের ফাটল ধরায় তাহেরা থেকে সুদান পর্যন্ত বিস্তৃত ভূখণ্ড,গোটা স্পেন আর কিছু শহর বেদখল হয়ে যায়। এরপর সেগুলো আর হাতে আসেনি।

সাফফাহ ১৩৬ হিজরীর যিলহজ মাসে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন। তিনি ভাই আবু জাফরকে খিলাফতের উত্তরাধিকার মনোনীত করে যান। তিনি ১৩৪ হিজরীতে খিলাফতের রাজধানী কুফা থেকে আনবারে স্থানান্তর করেন।

সূলী বলেছেনঃ সাফফাহ বিভিন্ন সময় এ কথাগুলো বলেছেন – “কুদরত বাড়লে প্রবৃত্তি হ্রাস পায়। পরহেযগারী কমে গেলে সত্য ম্লান হয়। অসভ্য সেই ব্যক্তি, যে কৃপণতা গ্রহণ আর ধৈর্যকে অসম্মান জ্ঞান করে। ধৈর্য ও নম্রতা ক্ষতির কারণ হলে ক্ষমা করে দিবে। ধৈর্য এক মহৎ গুণ। শরীয়তে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত বাদশাহ কোন প্রকার বিশ্রাম নিবে না,চিন্তাভাবনা করে অবিশ্ৰান্ত কাজ চালিয়ে যেতে হবে।”

সূলী বলেছেনঃ সাফফাহ খুবই দানশীল ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ওয়াদা করলে তা পূরণ না করা পর্যন্ত স্থানচ্যুত হতেন না। একবার আব্দুল্লাহ বিন হাসান তাকে বললেন,“আমি কোন দিন এক লাখ দিরহাম দেখিনি।” সঙ্গে সঙ্গে সাফফাহ এক লাখ দিরহাম নিয়ে এসে তার বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি অনেক কবিতা রচনা করেন। তার আংটিতে খোদাই করে লিখা ছিল – الله سقة عبد الله به يؤ من

সাঈদ বিন মুসলিম বাহালী বলেছেনঃ একদিন তিনি বনূ হাশিমসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের মজলিসে বসেছিলেন। তার হাতে ছিল পবিত্র কুরআন শরীফ। এমন সময় আব্দুল্লাহ বিন হাসান এসে বললেন,“আল্লাহ তাআলা কুরআন শরীফে আমাদের যে প্রাপ্যের কথা বলেছেন, তা আমাদের বুঝিয়ে দিন।” সাফফাহ বললেন,“তোমার পূর্বপুরুষ আলী (রাঃ) আমার চেয়ে অনেক উত্তম আর ন্যায়পরায়ণ খলীফা ছিলেন। আর তোমার পিতামহ হাসান ও হুসাইন তোমার চেয়ে অনেক উত্তম ছিলেন। তাই আমার উপর কর্তব্য আলী (রাঃ) নিজ সন্তানদের যতটুকু দিয়েছেন, আমিও তোমাকে ততটুকু দিবো – এটাই ইনসাফ। এর অতিরিক্ত প্ৰাপ্তির যোগ্য তুমি নও।” এ কথা শুনে তিনি নিরুত্তর রইলেন।

ঐতিহাসিকগণ লিখেছেনঃ বনু আব্বাসের শাসনামলে প্রশাসনিক দফতরগুলো থেকে আরবদের নাম বাদ পড়ে আর তদস্থলে তুর্কীরা আসে। আস্তে আস্তে সবই তারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয় আর পরবর্তীতে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। এ সাম্রাজ্য বহু ভাগে বিভক্ত হয় আর তারা পৃথক পৃথক গভর্নরের মাধ্যমে অত্যাচারের সাথে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্র পরিচালনা করে।

কথিত আছে,তিনি রক্ত ঝরিয়ে সকল গভর্নরের আনুগত্য অর্জন করেন। তবে তার বদ্যান্যতা ছিল অপার।

তার খিলাফতকালে যায়েদ বিন আসলাম,আব্দুল্লাহ বিন আবু বকর বিন হাজাম,মদীনা শরীফের বিচারপতি রাবীআ, আব্দুল মালিক বিন উমায়ের,ইয়াহইয়া বিন আবু ইসহাক হাযরামী,সুপ্রসিদ্ধ লেখক আব্দুল হামিদ (তিনি মারওয়ানের সাথে বুসির নামক স্থানে নিহত হোন),মানসুর বিন মুতামার,হাম্মাম বিন মানবাহ প্রমুখ ওলামা ইন্তেকাল করেন।