মাহদী

আল-মাহদী আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন মানসুর ১২৭ হিজরীতে আইদবিজ নামক স্থানে,ভিন্ন মতে ১২৬ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তার মাতার নাম উম্মে মূসা বিনতে মানসুর আল-হুমায়রিয়া।

তিনি ছিলেন খুবই দানশীল,জনপ্রিয় আর প্রশংসিত। তিনি সুন্দর চেহারা আর নির্মল বিশ্বাসের অধিকারী। তিনি ভ্রান্ত বিশ্বাসীদের মূলোৎপাটন করেন। মাহদী প্রথম খলীফা, যিনি প্রাথমিক জীবনে ভ্রান্ত মতে বিশ্বাসীদের সাথে তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হন।

তিনি পিতা মানসুর আর মুবারাক বিন ফুযালা থেকে হাদীস শ্রবণ করেন, আর তার থেকে ইয়াহইয়া বিন হামযা,জাফর বিন সুলায়মান আনসাবয়ী,মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ রাকাশী,আবু সুফিয়ান,সাঈদ বিন ইয়াহইয়া আল-হুমায়রী হাদীস বর্ণনা করেছেন।

যাহাবী বলেছেনঃ মাহদীর রেওয়ায়েতকে (বর্ণনাকে) কেউ খণ্ডন আর পরিমার্জন করেনি।

উসমান থেকে ইবনে আদী বর্ণনা করেছেন যে,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,“মাহদী হবেন আমার চাচা আব্বাসের বংশধর।” এ হাদীস মাওষু।

আবু দাউদ আর তিরমিযী শরীফে বর্ণিত বিশুদ্ধ হাদীসটি হলো,“মাহদীর নাম আমার নামের সাথে আর তার পিতার নাম আমার পিতার নামের সাথে মিল থাকবে।” (টীকাঃ তাই এই “খলীফা মাহদী” সেই মাহদী নন, যার সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনেক হাদিস থেকে তার ব্যাপারে জানা যায়, সেই ‘আল-মাহদি’র নাম হবে মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ, যিনি শেষ জমানায় এসে তাগুতের বিরুদ্ধে জিহাদ করবেন আর ঈসা আলাইহিস সালাম তার ইমামতিতে সালাত আদায় করবেন)

মাহদী যৌবনপ্রাপ্ত হলে মানসুর তাকে তিবরিস্তানের গভর্নর নিয়োগ করেন। তিনি সেখানে জ্ঞান চর্চা ও আলেমদের সহচার্য গ্রহণে ভালো মন্দ বিচারের ক্ষমতা অর্জন করলে মানসুর তাকে খিলাফতের উত্তরাধিকার মনোনীত করেন।

মানসুরের ইন্তেকালের সংবাদ বাগদাদে গিয়ে পৌছলে আমজনতা সেখানে মাহদীর কাছে বাইআত দেয়। এরপর তিনি মিম্বরে দাড়িয়ে এ ভাষণ প্ৰদান করেন –

“আমিরুল মুমিনীনও এক আল্লাহর বান্দা। ডাক আসলে তিনিও চলে যাবেন,অথবা কোন নির্দেশ এলে তা পূর্ণমর্যাদায় বাস্তবায়ন করবে।”

এ কথা বলতে বলতে তার চোখ দুটো অশ্রু সিক্ত হয়ে উঠলো। তিনি নিজেকে সংবরণ করতে পারলেন না। তিনি আবার বলতে লাগলেন –

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুই বন্ধুর পৃথক হওয়ায় কেঁদেছিলেন। আর আমি প্রথমত বাবার শোকে মুহ্যমান, আর দ্বিতীয়ত, আমার উপর খিলাফতের বোঝা অৰ্পিত হয়েছে। আমিরুল মুমিনীনের জন্য আল্লাহ তাআলাই যথেষ্ট। আমি মুসলমানদের খিলাফত পরিচালনার জন্য তারই সাহায্য প্ৰার্থনা করছি। উপস্থিতি, আপনার আমার আনুগত্যের প্রকাশ যেভাবে করেছেন, ঠিক সেভাবেই আমার আদেশ পালন করার জন্য নিজেদের মনকে প্রস্তুত করুন, যাতে আমি আপনাদের খেদমত করতে পারি আর প্রতিটি কাজের ফলাফল সুন্দর হবে। আপনাদের মধ্যে যারা ইনসাফের প্রসার ঘটাতে চায়, আমি তাদের ফরমাবরদারী করবো। আপনাদের উপর কঠোরতা হলে আমি তা দমন করার চেষ্টা করবো। আমি আপনাদের প্রতি সাধ্যমত সর্বদা প্রশান্তির শীতল বাতাস ছড়িয়ে দিবো। আপনাদেরকে কষ্ট থেকে পরিত্রাণ দিতে আর ইহসান করতে আমি জীবনকে উৎসর্গ করবো।”

লাফযুয়া বলেছেনঃ ধনভাণ্ডারপ্রাপ্ত হলে মাহদী অত্যাচারীদের দমন করার জন্য প্রচুর ব্যয় করেন। অভাবীদের প্রয়োজন মেটাতে ব্যাপক খরচ করেন। তিনি গভর্নরদের পুরস্কার দেন আর পরিবার-পরিজন ও গোলাম বাঁদিদের সাথে সুন্দর ব্যবহার করেন।

তিনি বলেনঃ আবু দালামা সর্বপ্রথম মাহদীকে তার খিলাফতের সুসংবাদ আর তার পিতার মৃত্যুতে সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। আবু দালামা খিলাফতের জন্য অভিনন্দন আর বাবার মৃত্যুতে সমবেদন জানাতে গিয়ে মাহদীর সামনে এ কবিতাটি আবৃত্তি করেন – “আমার চক্ষুদ্বয় আজব দৃশ্য দেখছে। এক দিকে খিলাফতের আনন্দ, অন্য দিকে বইছে শোকের অশ্রু। সর্বদা একটি চোখ রোদন করছে,অন্যটি হাসছে। একটি কষ্ট ভারী মনে হলেও অপর প্রান্তে রয়েছে খুশী ও আনন্দ। এক খলীফার মৃত্যুতে দুঃখ পেলেও অপর দয়ার্দ্র খলীফার তখতে আরোহণের খুশি ছড়িয়ে পড়েছে। একজন খলীফা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনীত দ্বীনের উপর ইন্তেকাল করার পর সহকারী এসেছে আপনার কাছে। আল্লাহ তাকে হিদায়েত দিন,খিলাফতের মর্যাদা দান করুন আর জান্নাতুন নাঈমের পথে পরিচালিত করুন।”

১৫৯ হিজরীতে মাহদী তার দুই ছেলে মূসা হাদী,এরপর হারুন রশীদকে উত্তরাধিকার মনোনীত করেন।

১৬০ হিজরীতে ভারতের আরবাদ যুদ্ধের মাধ্যমে বিজিত হয়। মাহদী এ বছর হাজ্জ আদায় করেন। পর্দার ভারে কাবা গৃহ ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কায় কাবা শরীফে মাহদী কর্তৃক নির্দিষ্ট পর্দা ছাড়া অতিরিক্ত পর্দা দেয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। মাহদীর জন্য মক্কায় বরফ সরবরাহ করা হয়। যাহাবী বলেন,“মাহদী ছাড়া অন্য কোন খলীফার জন্য মক্কায় আর কোনো দিন বরফ তৈরি বা সরবরাহ করা হয়নি।”

১৬১ হিজরীতে মাহদী মক্কা শরীফে প্রশস্ত রাস্তা,ভবন আর পানির হাউস তৈরি করেন। তিনি জামে মসজিদগুলোর গভীর মিহরাব তৈরির প্রক্রিয়া বন্ধ আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগের অনুরূপ ছোট মিম্বার নির্মাণ করেন।

১৬৩ হিজরী আর এর পরবর্তীতে রোমান সাম্রাজ্যের অধিকাংশ অঞ্চল বিজিত হয়।

১৬৬ হিজরীতে তিনি দারুস সালামকে দারুস সুলতানাত হিসেবে অভিহিত করেন আর এখান থেকে মক্কা,মদীনা ও ইয়ামানের সাথে উট ও খচ্চরের মাধ্যমে ডাক যোগাযোগ স্থাপন করেন। যাহাবী বলেছেন, মাহদীই সর্বপ্রথম হিজায থেকে ইরাক পর্যন্ত ডাক ব্যবস্থা চালু করেন। এ বছর তিনি অনেক জায়গায় পথভ্রষ্টদের সাথে সরাসরি বিতর্কে অংশগ্রহণ করেন।

১৬৭ হিজরীতে মসজিদে হারাম সম্প্রসারণের নির্দেশ দেন। এতে অনেক ঘর বাড়ি ভেঙ্গে মসজিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

১৬৯ হিজরীতে একবার মাহদী এক শিকারের পেছনে ঘোড়া ছুটান,শিকারটি এক পুরনো বাড়ির মধ্যে গিয়ে আত্মগোপন করে। ঘোড়াটিও শিকার ধরার জন্য প্ৰাণপণে ছুটে চলে। দ্রুত চলতে গিয়ে বাড়িতে ঢোকার সময় মাহদীর কোমরে এমনভাবে আঘাত লাগে যে,সেখানেই তার জীবন সাঙ্গ ঘটে। সেদিন ছিল ১৬৯ হিজরীর মুহাররম মাসের ২২ তারিখ। কারো মতে বিষ খাইয়ে তার মৃত্যু হয়। সালেম আল-খাতির মাহদীর মৃত্যুতে একটি করুণ শোক গাঁথা রচনা করেছেন।

সূলী বলেছেনঃ এক রমণী মাহদীর কাছে এসে বললো,“রাসুলুল্লাহ’র (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হে বংশধর, আমার প্রয়োজন মিটিয়ে দিন।” তিনি বললেন,“এ শব্দগুলো আজ পর্যন্ত কাউকে বলতে শুনিনি।” এরপর তিনি তাকে দশ হাজার দিরহাম পুরস্কার দিলেন।

কুরাইশ খাত্তালী বলেছেনঃ সালেম বিন আব্দুল কুদ্দুস বসরীকে অপরাধের শাস্তি দেওয়ার জন্য মাহদীর সামনে হাযির করা হলো। তিনি তাকে হত্যা করতে চাইলেন। সে বললো,“আমি ভ্রান্ত আকীদা গ্রহণের জন্য তাওবা করছি।” এরপর সে একটি কবিতা আবৃত্তি করলো। তিনি ক্ষমা করে দিলেন। সে চলে যেতে উদ্যত হলে তিনি তাকে বললেন,“তোমার পঠিত কবিতার একটি চরণ তুমি গোপন করেছো। আর যা হল- ‘বৃদ্ধকালে কোন লোক তার অভ্যাস ছাড়তে পারে না।’ ” সে বললো,“হ্যাঁ।” এরপর তিনি তাকে হত্যার আদেশ দিলেন।

যহির বলেছেনঃ দশজন হাদীস বিশারদ মাহদীর কাছে এলেন। যাদের মধ্যে ফরজ বিন ফুযালা আর গায়াস বিন ইবরাহীমও ছিলেন। মাহদী কবুতর নিয়ে খেলতে ভালোবাসতেন। মাহদী গায়াস বিন ইবরাহীমকে বললেন,একটি হাদিস শোনান। তিনি বললেন, অমুক ব্যক্তি আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে মারফুআন বর্ণনা করেছেন – অশ্বারোহী,তীরন্দাজ (মাহদীর কারণে হাদীসের মধ্যে এতটুকু বৃদ্ধি করে বললেন), পাখিপ্রেমীদের মোকাবিলা করা জায়েয নেই। মাহদী এটি শুনে দশ হাজার দিরহাম পুরস্কার দিলেন। গায়াস যাবার সময় (মাহদীর মনে হলো, তাঁকে খুশি করার জন্য সে হাদীসের কিছু অংশ বৃদ্ধি করেছে।) তিনি বললেন,আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আপনি মিথ্যা বলেছেন আর মিথ্যার বেড়াজালে অর্থ উপার্জন করেছেন। এরপর তিনি কবুতরগুলো যবেহ করার নির্দেশ দেন।

কথিত আছেঃ একবার শরীক মাহদীর কাছে এলে মাহদী বললেন,“হয় আমার আনুগত্য করতে হবে,নতুবা আমার ছেলেদের ইলম শিক্ষা দিতে হবে,না হয় আমার সাথে খাবার খেতে হবে – এ  তিনটির মধ্যে যে কোন একটি আপনাকে গ্রহণ করতেই হবে।” শরীক কিছুক্ষণ ভেবে বললেন,“আপনার সাথে খাবার খাওয়াই সবচেয়ে সহজ।” মাহদী দস্তরখানে বিভিন্ন প্রকার খাবার দিতে বললেন। খাদ্য গ্রহণের সময় শাহী বাবুর্চি বললো,“হযরত, এখন আপনি ফেঁসে গেছেন।” বর্ণনাকারী বলেন,তিনি এরপর শিক্ষাদান শুরু করেন আর আনুগত্য গ্রহণ করেন।

বাগবী জাদিয়াদ গ্রন্থে হামদান ইস্পাহানী থেকে রেওয়ায়েত করেছেনঃ আমি একদিন শরীকের সাথে বসেছিলাম। মাহদীর ছেলে এসে হেলান দিয়ে বসে শরীককে একটি হাদীস জিজ্ঞেস করলো। তিনি কোন উত্তর দিলেন না। সে আবার প্রশ্ন করলো। তিনি কোনোই ভ্রুক্ষেপ করলেন না। শাহজাদা বললো,“আপনি খলীফার বংশধরকে অবজ্ঞা করছেন।” শরীক বললেন,“আহলে ইলমদের দৃষ্টিতে ইলম অর্জনের ক্ষেত্রে শাহজাদার বিশেষ কোন মর্যাদা নেই।” এরপর সে আদবের সাথে বসে আবারো প্রশ্ন করলে শরীক বললেন,“হ্যাঁ,এটা হল তালাবে ইলমদের পদ্ধতি।”

মাহদী অনেক কাব্য-কবিতা আবৃত্তি করেন। সূলী মুহাম্মদ বিন আম্মারাহ থেকে নকল করেনঃ মাহদী এক বাঁদির প্রেমে পড়েন। একদিন বাঁদির মনের ভাব বুঝার জন্য তিনি এক ব্যক্তিকে বাঁদির কাছে পাঠান। লোকটি কথা বললে বাঁদি তাকে বললো,“আমার ভয় হচ্ছে,তিনি আমাকে বিরক্ত করবেন আর বর্জন করবেন। আর এতে আমার মৃত্যু ত্বরান্বিত হবে।” এ প্রেক্ষিতে মাহদী এই কবিতাটি পাঠ করেন – “চাঁদের চেয়েও কোমল এক প্রেমিকা আমার অন্তর জয় করেছে। তার প্রতি আমার প্রেম বিশুদ্ধ, অথচ সে অসুস্থতার বাহানা করছে, আবার সে পৃথকও হয়ে যায় না।”

উমর বিন ইয়াযিআ হলো মাহদীর বন্ধু। তিনি তার সম্বন্ধে এ কবিতা রচনা করেন – “হে আল্লাহ, আমার একান্ত বন্ধু আবু হাফযের জন্য আমার অবদানকে পরিপূর্ণ করে দিন। গান,বদান্যতা,সুগন্ধ,বাঁদী,সুরা আর আভিজাত্যের মধ্যে আমার জীবন সীমাবদ্ধ।”

গ্রন্থকার বলেন,“আমার মতে মাহদীর কবিতাগুলো পিতা মানসুর আর তার ছেলেদের চেয়েও সৌন্দর্যের রসে সিক্ত। তিনি কবিদের জন্য এক অনন্য দৃষ্টান্ত।”

সূলী আবু কারীমা থেকে নকল করেছেনঃ মাহদী হঠাৎ এক বাঁদির কক্ষে ঢুকে পড়ে। বাদি সে সময় কাপড় খুলে অন্য কাপড় পরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। মাহদীকে আসতে দেখে তড়িঘড়ি করে সে হাত দিয়ে সতর ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টা করে। মাহদী হেসে উঠে এ কবিতাটি আবৃতি করেন – “আমার চক্ষু আমাকে ধ্বংসের দৃশ্য দেখিয়েছে।”

ইসহাক মসূলী বলেনঃ মাহদী এক বছর পর্যন্ত সাথীদের সাথে পর্দার আড়ালে বসতেন। পরে পর্দা উঠিয়ে দেয়া হলে এক ব্যক্তি বললো,“আপনার জন্য পর্দাই উত্তম ছিল।” মাহদী বললেন,“দেখার মধ্যে যে তৃপ্তি,অদৃশ্যে তা নেই।”

মাহদী বিন সাবেক বলেছেনঃ একদিন মাহদী একটি ছোট্ট সেনাদল পরিবেষ্টিত হয়ে ঘোড়ায় চড়ে এক যাচ্ছিলেন। এক ব্যক্তি চিৎকার করে এ কবিতা আবৃত্তি করে -“খলীফাকে জানিয়ে দাও,আপনার হাতিম বিশ্বাসঘাতক। আপনি আল্লাহকে ভয় করুন আর আমাদেরকে হাতিম থেকে রক্ষা করুন। যদি সৎ লোক বিশ্বাসঘাতককে সাহায্য করে,তার সওয়াবও গুনায় পরিণত হবে।”এ কবিতা শুনে মাহদী নির্দেশ দিলেন,“আমার সাম্রাজ্যে হাতিম নামে যে গভর্নর আছে, তাকে অপসারণ করো।”

আবু উবায়দা বলেছেনঃ মাহদী বসরায় এলে জামে মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়াতেন, একদিন তিনি এলেন।  লোকেরা নামায্যের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। এক গ্ৰাম্য লোক বলে উঠলো,“আপনার পেছনে নামায পড়ার খুব ইচ্ছা। কিন্তু আমি অযূ করিনি।” মাহদী মুসল্লিদের লোকটির জন্য অপেক্ষা করতে বলে তিনি নিজেও মিহরাবে দাড়িয়ে তার অপেক্ষায় রইলেন। লোকেরা এ সুন্দর চরিত্র দেখে বিমুগ্ধ হয়।

ইবরাহীম বিন নাফে বলেছেনঃ একটি নদী নিয়ে বসরাবাসীর মধ্যে ঝগড়া হলে মাহদী বললেন,“আল্লাহ্‌ তাআলা এ ভূখণ্ড মুসমানদের দান করেছেন, তাই এর কোন একক মালিক নেই। কেউ একে ক্রয়-বিক্রয় করতে পারবে না। যদি করা হয়, তবে এর সমুদয় অর্থ সকল মুসলমানের মধ্যে বণ্টন করতে হবে,নয়তো মুসলমানদের সাহায্যার্থে তা ব্যয় করতে হবে।” একদল লোক নিজেদের দাবীতে অনঢ় রইলো। তারা বললো,“নদী আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন – যে মৃত যমীনকে জীবিত করে (যে পরিত্যক্ত যমীনে চাষাবাদ করে ফসল ফলায় – অনুবাদক) সে হবে সেই যমীনের হকদার। আমাদের যমীন মৃত। ফলে এটি শুধুই আমাদের হক।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ফরমান শুনে মাহদী মাথা এতই নিচু করলেন যে তা যমীন স্পর্শ করবে। তিনি বললেন,“তোমরা যে হাদীস শরীফের বিবরণ পেশ করছো, তা আমি মানি আর শুনেছি, তবে আমি সরেজমিনে এটাই দেখতে এসেছিলাম যে,এ যমীন মৃত কিনা। কুদরতীভাবে যার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয় সে যমীন মৃত হতে পারে না – আমি এটা মানতে পারি না। তবে তোমরা যদি তা প্রমাণ করতে পার তাহলে মানবো।”

আসমায়ী বলেছেনঃ আমি বসরায় মিম্বরে দাড়িয়ে খুতবার মধ্যে বলতে শুনেছি যে,তিনি বলেন,“আল্লাহ তাআলা আপনাদের সেই কাজ করতে আদেশ করেছেন, যা তিনি নিজ সত্ত্বা আর ফেরেশতাদের জন্য পছন্দ করতেন। কুরআন শরীফে বলা হয়েছে –

إِنَّ اللَّـهَ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِيِّ

“নিঃসন্দেহে আল্লাহ ও তার ফেরেশতারা নবীর উপর দরূদ পাঠান …” (সূরাহ আল-আহযাব, ৩৩ :৫৬)

বর্ণিত আয়াত দিয়ে এ কথা বুঝায় যে,আল্লাহ তাআলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সকল রাসূলদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদা দান করেছেন। এভাবেই আপনাদেরকেও সকল উম্মতগণের মধ্যে শ্ৰেষ্ঠত্ব প্ৰদান করা হয়েছে।”

গ্রন্থকার বলেন,“সর্বপ্রথম মাহদীই খুৎবার মধ্যে এ আয়াত পাঠ করেন। এরপর থেকে সকল খতীব তাদের নিজ নিজ খুৎরায় আবশ্যকীয়ভাবে এ আয়াত উল্লেখ করেন।

 

মাহদী কর্তৃক বর্ণিত হাদীসসমূহ

সূলী আহমাদ বিন মুহাম্মাদ আর তিনি আব্দুর রহমান বিন মুসলিম মাদায়েনী থেকে বর্ণনা করেছেনঃ মাহদী তার খুতবায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঐ খুৎবাটি উল্লেখ করতেন, যা আবু সাঈদ খুদরী থেকে সূর্য অস্তমিত হওয়ার সময় সম্বন্ধে বর্ণিত।

সূলী বলেছেন যে, ইয়াকুব বিন হাফয খাত্তাবী কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে যে, মাহদী বলেছেনঃ অনারব এক প্রতিনিধি দল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে এলো। তাদের দাড়ি ছিল কমানো,আর গোঁফ লম্বা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন,“তোমরা এদের বিপরীতে দাড়ি লম্বা আর গোঁফ ছোট করবে, যাতে তা মুখে এসে না পড়ে।” মাহদী হাদীসটি বর্ণনা করার সময় ঠোঁটে হাত দিয়ে দেখিয়ে দেন।

ইয়াহইয়া বিন হামযা বলেছেনঃ মাহদী আমাদের মাগরীবের নামায পড়ানোর সময় উচ্চস্বরে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম বলতেন। আমি বললাম,“আমিরুল মুমিনীন, এটা আপনি কি করছেন ?” মাহদী জবাবে বললেন,“আমি আমার পিতা থেকে,তিনি আমার দাদা থেকে,আমার দাদা আব্বাস থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমনটাই করতেন।” আমি বললাম,“এ জন্যই কি আপনি এমনটা করছেন ?” মাহদী বললেন,“হ্যাঁ।”

যাহাবী বলেছেনঃ এ হাদীসের সনদগুলো মুত্তাসিল (সংযুক্ত)। তবে আমার জানা নেই যে, কে মাহদী আর তার পিতাকে শরীয়তে দলীল বানিয়েছেন।

এ হাদীসের রাবীদের মধ্যে বনূ হাশিমের গোলাম মুহাম্মাদ ইবনে ওলীদ একজন। তার সম্বন্ধে ইবনে আদী বলেছেন,“তিনি মুনফারিদ (একক)। তিনি হাদীস পরিবর্তন করেছেন।” গ্রন্থকার বলেন,“এটা বললে বিশুদ্ধ হবে না। তিনি মুনফারিদ নন, আর লোকদের তার বাধ্যতায় দেখা গেছে।”

মাহদীর শাসনামলে যেসব ওলামায়ে কেরাম ইন্তেকাল করেন তারা হলেন – শুবা বিন আবু যানবা,সুফিয়ান সাওরী,ইবরাহীম বিন আদহাম (দানশীল),দাউদ তাঈ (দানশীল),হাদীস বিশারদদের মধ্যে প্রথম কবি বাশার বিন বারদ,হাম্মাদ বিন সালামা,ইবরাহীম বিন তহান,খলীল বিন আহমাদ।