আল ওয়াসেক বিল্লাহ

আল ওয়াসেক বিল্লাহ হারুন আবু জাফর; ভিন্ন মতে, আবুল কাসিম বিন মুতাসিম বিন রশীদ ১৯৬ হিজরীর শাবান মাসের ২০ তারিখে কারাতীস নামক রোমান জননীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। তার জননী ছিলেন বাঁদি।

পিতার খিলাফতকালে তিনি উত্তরাধিকার মনোনীত হোন। ২২৭ হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসের ৯ তারিখে তখতে আরোহণ করেন।

২২৮ হিজরীতে তিনি আশনাস নামক তুর্কী এক লোককে সাম্রাজ্যের নায়েব মনোনীত করেন। নায়েব জওহর খচিত মুকুট পড়তেন। আমার (গ্রন্থকারের) মতে, তিনি প্রথম বাদশাহ যিনি সর্বপ্রথম নায়েব মনোনীত করেন। তাছাড়া তার পিতার শাসনামল থেকেই প্রশাসনিক কাজে তুকীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।

২৩১ হিজরীতে বসরার গভর্নরের কাছে একটি পত্র পাঠিয়ে মামুন এবং মুয়াজ্জিনদের খলকে কুরআনের বিষয়ে পরীক্ষা নেন। তিনি তার পিতার অনুসরণ করতেন। অবশেষে এ বিতর্কিত মাসিয়ালা থেকে তাওবা করে সরে আসেন। ২৩১ হিজরীতে তিনি আহমাদ বিন আল মুনযার খাজায়ীকে, যিনি আহলে হাদিস এবং সৎ কাজের আদেশ প্রদানকারী ও অসৎ কাজে বাধা দানকারী – তাকে হত্য করেন। ঘটনাটি এরূপ- বাগদাদ থেকে সমরাহ পর্যন্ত আহমাদকে বন্দী করে এনে খলকে কুরআন সম্পর্কে মাসয়ালা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন,“কুরআন শরীফ মাখলুক নয়।” কিয়ামতের দিন আল্লাহর দিদার সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন,“রেওয়ায়েত দ্বারা দিদারের কথা প্রমাণিত।” তিনি একটি হাদীসও শোনালেন। ওয়াছেক বললেন, “তুমি মিথ্যা বলছো।” আহমাদ বললেন,“আপনিই মিথ্যাবাদী।” তিনি বললেন, “আফসোস! তুমি আল্লাহ তাআলাকে সীমাবদ্ধ,শরীরবিশিষ্ট এক স্থানে বন্দী আর চর্ম চোখে তাকে দেখার কথা ভাবছো, অথচ তা স্পষ্ট কুফার।”

সে সময় ওয়াসেকের পাশে এক দল মুতাযিলা মুফতী বসেছিলেন। তারা আহমাদকে হত্যার ফতোয়া দেন। ওয়াসেক তলোয়ার কোষমুক্ত করলেন। আহমদকে চামড়ার গালিচায় বসিয়ে দেয়া হলো। এরপর তিনি তাকে শহীদ করে দেন। এরপর তার কাটা মাথা বাগদাদের অলিতে-গলিতে ঘুরিয়ে এক স্থানে লটকিয়ে দেওয়ার এবং মৃত দেহটি সরমন রায় শহরে শূলেতে ঝুলে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। তাকে সেটাই করা হয়েছিল এবং তার শাসনামলে তাকে এভাবেই রাখা হয়। মুতাওয়াক্কিল বাদশাহ হওয়ার পর তার লাশ দাফন করেন। আহমদকে শূলে ঝুলিয়ে রাখা অবস্থায় লাশ পাহারার জন্য একজন পুলিশ নিয়োগ করা হয়। নির্দেশ মোতাবেক পুলিশ বর্শা দিয়ে তার মুখ কেবলা দিক থেকে ফিরিয়ে দিতো। এ পুলিশ বলেছেন,একদিন তিনি কেবালামুখি হয়ে সূরা ইয়াসিন তিলাওয়াত করেন। এ ঘটনাটি অন্য সূত্রেও বর্ণিত রয়েছে।

২৩১ হিজরীতে রোম থেকে এক হাজার ছয়শো মুসলমান কয়েদী মুক্তি পায়। ইবনে দাউদ বলেছেন,এদের মধ্যে যারা খলকে কুরআনের পক্ষে, তাদেরকে দুই দিনার দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। আর যারা পক্ষে না, তাদের অবরুদ্ধ করে রাখা হয়।

খতীব বলেছেনঃ আহমাদ বিন দাউদ ওয়াসেককে খলকে কুরআনের মাসয়ালা বুঝাতেন এবং এর প্রতি লোকদের দাওয়াত দিতেন। মৃত্যুর আগে তিনিও এ আকীদা থেকে ফিরে আসেন।

কথিত আছে,একদা এক ব্যক্তিকে ওয়াসেকের কাছে ধরে নিয়ে আসা হয়। সে সময় ওয়াসেকের কাছে ইবনে দাউদও ছিল। লোকটি ইবনে দাউদকে বললেন,“তোমরা যে মাসয়ালার প্রতি লোকদের আহবান করছো, তা কি রাসূলুল্লাহ’র (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জানা ছিল না ? যদি জানা থাকে, তবে কেন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এদিকে লোকদের আহবান করেননি ?” ইবনে দাউদ বললেন,“জানা ছিল।” বন্দী লোকটি বললেন,“জানা থাকার পরও তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তা করেননি। অথচ তোমরা তা করছো!” এ কথা শুনে সকলেই স্তম্ভিত হয়ে যায়। আর হাসতে হাসতে অন্দরে গিয়ে প্রবেশ করেন। তিনি বারবার বলতে থাকেন,“রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে বিষয়টিকে অবৈধ বলেছেন,আমরা তাকে বৈধ বলে বসে আছি।” তিনি লোকটিকে তিনশো দিনার দিয়ে মুক্ত করে দেওয়ার নির্দেশ দেন এবং ইবনে দাউদের প্রতি রুষ্ট হন। কথিত আছে,লোকটি আব্দুর রহমান, আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মদ আযদী,আবু দাউদ আর নাসায়ীর উস্তাদ।

ইবনে আবীদ দুনিয়া বলেছেনঃ ওয়াসেকের বর্ণ লালচে,দাড়ি সুন্দর আর চোখে একটি বিন্দু সদৃশ্য চিহ্ন ছিল।

ইয়াহইয়া বিন আকতাম বলেছেনঃ তিনি হযরত আলীর পরিবারের সাথে যতো সুন্দর আচরণ করেছেন, ততটুকু আর কেউ করেনি। কথিত আছে,ওয়াসেক উচু মাপের আরবী সাহিত্যিক ও কবি ছিলেন। উপহারস্বরূপ একজন গোলামকে মিসর থেকে তার কাছে পাঠানো হয়। তিনি তাকে খুব ভালোবাসতেন। একদিন তিনি তার প্রতি ভীষণ রাগ করেন। এমন সময় তিনি শুনতে পেলেন যে,সে আরেক গোলামকে বলছে,“আল্লাহর কসম, কালই ওয়াসেক আমার সাথে কথা বলতে চাইবেন, কিন্তু আমি বলবো না।” একথা শুনে তিনি এ কবিতাটি আবৃত্তি করেন – “ওহে, আমার কষ্টকে নিয়ে তুমি গর্ব করছো ? তুমি এক জালেম গোলাম হয়ে এসেছো। যদি ভালোবাসা না থাকতো, আভিজাত্যপূর্ণভাবে কথাবার্তা বলতাম। যদি এ প্রেমের বাঁধন মুক্ত হও তবে দেখবে।” এ কবিতাটি সাহিত্যের রসে পূর্ণ।

সূলী বলেছেননঃ ইলমে আদব (সাহিত্য) এবং ফজিলতের দৃষ্টিকোণ থেকে মামুন তার চেয়েও ছোট। মামুন তাকে সম্মান করতেন এবং তার ছেলের উপর তাকে প্রাধান্য দিতেন। ওয়াসেক তৎকালীন যুগের বড় আলেম আর উচু মাপের কবি ছিলেন। তিনি খলীফাদের মধ্যে সুর সৃষ্টিতে দক্ষ ছিলেন।

ফজল ইয়াযোদী বলেছেনঃ বনু আব্বাসের মধ্যে তিনি মামুনের চেয়েও বড় মাপের কবি। আসল কথা হলো, মামুন ইলমে আদবের পাশাপাশি সূচনাবিদ্যা,জ্যোতির্বিদ্যা,চিকিৎসাবিদ্যা,যুক্তিবিদ্যা ইত্যাদি বিষয়ে বিজ্ঞ ও দক্ষ ছিলেন। আর ওয়াছেক শুধু সাহিত্যে পূর্ণ দক্ষ।

ইবনে ফাহাম বলেছেনঃ তার দস্তরখানটি ছিল স্বর্ণের। এর চারটি পাট ছিল। প্রতিটি পাট বহনের জন্য বিশজন লোকের প্রয়োজন হতো। এ দস্তরখানের পেয়ালা,গ্লাস,বাটি সবই ছিল স্বর্ণের। একদিন ইবনে দাউদ তাকে বললো,“স্বর্ণের জিনিস ব্যবহার করা নিষেধ।” এ কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে তিনি সেগুলো ভেঙে বাইতুল মালে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন।

হুসাইন বিন ইয়াহইয়া বলেছেনঃ একদিন ওয়াসেক স্বপ্নে দেখেন,তিনি আল্লাহর কাছে জান্নাত প্রার্থনা করছেন। সে সময় এক ব্যক্তি বলছে,“যার অন্তর মুররত নয়, আল্লাহ পাক তাকে ধ্বংস করবেন না।” সকালে তিনি সভাসদের কাছে মুররতের ব্যাখ্যা চাইলেন। কেউ তা পারলো না। আবু মুহলিমকে ডাকা হলো। তিনি বললেন,“মুররত চাটিয়াল ময়দান বা মরুভূমিকে বলা হয়,যেখানে ঘাস জন্মায় না। অর্থাৎ যার অন্তরে ঈমান রয়েছে, তিনি তাকে ধ্বংস করবেন না।” এরপর ওয়াসেক মুররত শব্দযুক্ত একটি কবিতা পড়লেন। আর আবু মুলহিম অভিন্ন অর্থবোধক মুররত শব্দযুক্ত একটি কবিতার উদ্ধৃতি পেশ করলেন। এ জন্য তিনি তাকে এক লাখ দিনার পুরস্কার দিলেন।

হামদুন বিন ইসমাঈল বলেছেনঃ খলীফাদের মধ্যে ওয়াসেক কষ্টের প্রতি আর বিরোধীদের ক্ষেত্রে বেশী ধৈর্যশীল।

আহমাদ বিন হামদুন বলেছেনঃ একদিন তার উস্তাদ হারুন বিন যিয়াদ তার কাছে এলে তিনি তাকে খুবই সম্মান করলেন। তা দেখে লোকেরা হারুনের পরিচয় জানোতে চাইলে তিনি বললেন,“ইনি সর্বপ্রথম আমার মুখে আল্লাহর যিকির তুলে দিয়েছেন আর আমাকে আল্লাহর রহমত-এ সমৰ্পণ করেছেন।”

তিনি ২৩২ হিজরীর যিলহজ মাসের ২৪ তারিখে সরমন রায়ে ইত্তেকাল করেন। মৃত্যুর সময় তিনি এ কবিতাটি আবৃত্তি করেন –“সকল সৃষ্টি মৃত্যুর আওতাধীন। মৃত্যু বাদশাহ-ফকীর কাউকে ছাড়বে না।”

তার মৃত্যুর পর মুতাওয়াক্কিলের বাইআত ব্যস্ত হয়ে পড়ায় তার লাশ নির্জনে পড়ে থাকায় বাজপাখি এসে লাশের চোখ তুলে নিয়ে যায়।

তার শাসনামলে যে সকল ওলামাগণ ইন্তেকাল করেন তারা হলেন – মাসহাদ,খলফ বিন হিশাম,বাযযার মাকরী, ইসমাঈল বিন সাঈদ,ওকেদীর লেখক মুহাম্মাদ বিন সাদ, ইমাম শাফীর ছাত্র মুহাম্মাদ বিন যিয়াদ বিন আরাবী,আলী বিন মুগীরা প্রমুখ।