আল মুতাযদ বিল্লাহ

আল মুতাযদ বিল্লাহ আহমাদ আবুল আব্বাস বিন মুফিক তালহা বিন মুতাওয়াক্কিল বিন মুতাসিম বিন হারুন রশীদ ২৪২ হিজরির যিলকাদা মাসে, সুলীর মতে ২৪৩ হিজরির রবিউল আউয়াল মাসে সাওয়াব বা হরজ বা যরার নামক বাঁদির গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। তার চাচা মুতামাদের পর ২৭৯ হিজরিতে তিনি খিলাফতের তখতে উপবেশন করেন।

বনু আব্বাসের খলীফাদের মধ্যে মুতাযদ সুদর্শন, সাহসী, নির্ভীক, জ্ঞানী আর বুদ্ধিমান। বীরত্বের কারনে তিনি একাই বাঘের সাথ লড়াই করতেন, তিনি রেগে গেলে খুব কম ক্ষমা করতেন, অপরাধীদের জীবন্ত পুঁতে ফেলতেন। তিনি ছিলেন ঝানু রাজনীতিবিদ।

আবদুল্লাহ বিন হামদুন বলেছেনঃ একদিন মুতাযদ শিকার ধরতে যান, আমি সাথে ছিলাম। ক্ষীরা বা শশার ক্ষেত অতিক্রম করার সময় ক্ষেতের পাহারাদাররা ফরিয়াদ জানালো। মুতাযদ বললেন, “কি হয়েছে ?” তারা বললো, “তিনজন গোলাম এসে আমাদের ফসল নষ্ট করে দিয়েছে।” এরপর তিনি গোলামদের ডেকে এনে ক্ষেতের এক পাশে হত্যা করেন। কয়েক দিন পর তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “সত্য করে বলো তো, লোকেরা কেন আমার প্রতি সন্তুষ্ট না ?” আমি বললাম, “আপনি রক পিপাসু তাই।” তিনি বললেন, “আল্লাহ’র কসম, আমি খিলাফতের তখতে উপবেশন করার পর থেকে কোনো দিন অবৈধ রক্তপাত করিনি।” আমি বললাম, “আহমাদ বিন তৈয়বকে কেন হত্যা করেছেন ?” তিনি বললেন, “সে আমাকে বক্রতার দিকে আহ্বান করতে চাইছিলো।” আমি বললাম, “সেই তিন গোলামকে কেন হত্যা করলেন ?” তিনি বললেন, “আল্লাহ’র কসম, অনুসন্ধান ছাড়া আমি তাদের হত্যা করিনি, তারা হত্যাকারী আর চোর ছিল।”

কাযী ইসমাইল বলেছেনঃ আমি মুতাযদের কাছে গিয়ে দেখলাম, তার পিছে কয়েকজন রোমান সুন্দরী যুবতী দাঁড়িয়ে আছে। চলে আসার পর তিনি বললেন, “কাযী সাহেব, খারাপ ধারণা করবেন না। আল্লাহ’র কসম, আমি আজ পর্যন্ত কখনোই হারাম কাজের জন্য কোমরের দড়ি খুলিনি।” একদিন আমি তার কাছে গেলাম। তিনি আমার দিকে এক টুকরো কাগজ নিক্ষেপ করলেন। এতে লিখা রয়েছে – “কিছু আলেম এক স্থানে একত্রিত হয়ে হালালকে হারাম আর হারামকে হালাল ফতোয়া দিয়েছে। বাদশাহ’র অবর্তমানে তারা এর উপর আমল করবে।” আমি বললাম, “তারা বেদ্বীন।” তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “তারা বেদ্বীন নাকি মিথ্যাবাদী ?” আমি বললাম, “যারা মদকে মুবাহ আর মুতাআকে মুবাহ মনে করে না, এবং যারা মুতাআকে মুবাহ আর গানকে মুবাহ বলে না, এরা কি পথভ্রষ্ট নয় ? আর যে ব্যক্তি আলিমদের ত্রুটি নিয়ে উপহাস করবে সে দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠা পাবে না।” এ কথা শুনে মুতাযদ সঙ্গে সঙ্গে কাগজটি পুড়ে ফেলার নির্দেশ দেন।

মুতাযদ প্রতিটি রনাঙ্গনে অব্যর্থ ও সফল। লোকেরা তাকে ভয় পেতো। ফলে নতুন ফিতনা মাথাচাড়া দিতে পারতো না, বরং অনেক ফিতনা এমনিতেই প্রতিহত হয়। তিনি খারাজ হ্রাস আর শুল্ক মওকুফ করেন। তিনি সুশাসন ও ন্যায় বিচারের সুবাতাস বয়ে দেন। প্রজাদের উপর আরোপিত অত্যাচার বিদূরিত করেন। বনু আব্বাসের খিলাফতের ভিত্তি অপরিচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলো। বনু আব্বাসের খিলাফতের ইমারতকে রক্ষা করায় তিনি দ্বিতীয় সাফফাহ নামে পরিচিত।

তিনি পথে ঘাটে গান-বাজনা, পথনাট্য করার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। তিনি লোকদের ঈদুল আযহার নামায পড়াতেন। তিনি প্রথম রাকআতে ছয় তাকবীর আর দ্বিতীয় রাকআতে এক তাকবীর বলতেন। তবে তিনি নিজে কোন খুৎবা পড়তেন না।

২৮০ হিজরিতে তিনি কায়রো যান আর আফ্রিকার গভর্নরের সাথে তার লড়াই হয়। এ বছর দেবল থেকে সূর্যগ্রহণের সংবাদ আসে। এ বছর শাওয়াল মাসে দেবলে সূর্যগ্রহণ লাগে, ফলে আসর পর্যন্ত অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল, এরপর কালো আধার নেমে আসে, যা প্রথম রাত পর্যন্ত ছিল, এরপর ভুমিকম্প হয়। এতে শহরের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়। বিধ্বস্ত ভবনের নীচ থেকে আনুমানিক লক্ষাধিক বনী আদমকে উদ্ধার করা হয়।

২৮১ হিজরিতে রোমের মুকুরিয়া শহর বিজিত হয়। এ বছর রায় আর তবরিস্তানে পানির সংকট দেখা দেওয়ায় এক রিতল পানির মূল্য দাঁড়ায় এক দিরহাম, লোকেরা দুর্ভিক্ষের কারনে মৃত প্রাণী খেতে শুরু করে। এ বছর তিনি মক্কার দারন নাদওয়া ভেঙে মসজিদে হারামের পাশে আরেকটি মসজিদ নির্মাণ করেন।

২৮২ হিজরিতে মুতাযদ কাবীহার রেওয়াজগুলো নিষিদ্ধ করেন। নওরোজের দিন আগুন জ্বালানো আর লোকদের গায়ে পানি ছিটানোর প্রথা রহিত করেন। এটা ছিল অগ্নিপূজকদের রীতি। এ বছর তিনি কতর আল নাদা বিনতে খামারুয়া বিন আহমাদ বিন তুলুনকে বিয়ে করেন। সে রবিউল আউয়াল মাসেই পৃথক হয়ে যায়। বিয়ের সময় কতর আল নাদা পিতার বাসা থেকে চার হাজার কমরবন্দ আর দশ সিন্দুক ভর্তি মণিমুক্তা নিয়ে স্বামীর ঘরে আসেন।

২৮৩ হিজরিতে গরভের বাচ্চাকেও মিরাস প্রদানের নির্দেশ দেন। এ লক্ষ্যে পৃথক একটি দফতর প্রতিষ্ঠা করেন। এ আইনটি জনতার অভিনন্দন কুড়ায় আর তারা খলীফার জন্য দুয়া করে।

২৮৪ হিজরিতে মিসরে এক প্রকার গভীর লাল বর্ণের প্রকাশ ঘটে। এতে মানুষের চেহারা আর দেওয়ালগুলো পর্যন্ত লাল হয়ে যায়। ফলে তারা খুবই বিনয়ের সাথে এ থেকে পরিত্রাণের জন্য দুয়া করলে এ লাল বর্ণটি আসর থেকে রাত পর্যন্ত থাকে।

ইবনে জারির বলেছেন, ২৮৪ হিজরিতে মুতাযদ মিম্বরে দাঁড়িয়ে মুয়াবিয়া (রাঃ) এর প্রতি অভিশাপ বর্ষণের জন্য ফরমান জারি করতে চাইলে তার উযীর উবাইদুল্লাহ বাধা দিয়ে বললেন, এতে মুসলিম মিল্লাতের মাঝে ক্ষোভের সঞ্চার হবে। কিন্তু সে তার কথা শুনলো না, আহকাম জারি করলো। হুকুমনামায় সে আলী (রাঃ) এর প্রশংসা আর মুয়াবিয়া (রাঃ) এর দোষত্রুটি বিধৃত করে। এটা দেখে কাযী ইউসুফ বললেন, “আমিরুল মুমিনীন, আপনার এ কাজে ফিতনা সৃষ্টির আশংকা আছে। আপনি এমনটা করবেন না।” সে বললো, “এর উপায় হিসেবে আমার কাছে তলোয়ার আছে।” কাযী সাহবে বললেন, “আর আপনি আলী পরিবারের জন্য কি উপায় বের করবেন ? তাদের বিচরণ তো জ্ঞানের শেষ সীমানা পর্যন্ত। তারা যদি অধিকারের কথা শুনে লোকদের হাতে তলোয়ার তুলে দেয় ?” এ কথা শুনে সে তার ইচ্ছা প্রত্যাখ্যান করলো।

২৮৫ হিজরিতে বসরায় এক প্রকার হলুদ বর্ণের অন্ধকার দেখা যায়। এরপর তা ক্রমান্বয়ে সবুজ আর কালো বর্ণ ধারণ করে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর আকাশ থেকে দেড়শো দিরহাম ওজনের একটি চাদর পড়ে। প্রবল ঝরে পাঁচ শতাধিক বৃক্ষ উপড়ে যায়। তারপর আসমান থেকে সাদা-কালো পাথর বর্ষিত হয়।

২৮৬ হিজরিতে বাহরাইনে আবু সাইদের আবির্ভাব ঘটে, সে হাজরে আসওয়াদ উপড়ে ফেলে। খলীফার সৈন্যদের সাথে তার লড়াই হয়। তারা পরাজিত হলে সে বসরা আর এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলো তার হস্তগত হয়।

আবুল হুসাইন আল খারীবী থেকে খতীব আর ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেনঃ একদিন মুতাযদ কাযি আবু হাযিমের কাছে বলে পাঠালেন, “অমুক ব্যক্তি আমার কাছ থেকে কর্জ নিয়েছে। আমি আপনার আদালতের মাধ্যমে আমার পাওনা ফিরে পেতে চাই।” কাযী সাহেব বলে পাঠালেন, “আমিরুল মুমিনীন, আল্লাহ আপনার হায়াত দারাজ করুন। আপনার মনে আছে যে, আপনি আমার কাঁধে এ দায়িত্ব অর্পণের পর বলেছিলেন, আজ থেকে আদালতের এ কর্তব্য তোমার উপর বর্তাবে। অতএব সাক্ষী ছাড়া আপনার অভিযোগ কিভাবে বিশুদ্ধ হিসেবে মেনে নেওয়া যেতে পারে ?” তিনি জানিয়ে দিলেন যে, অমুক অমুক আমার সাক্ষী। কাযী সাহেব তাদের পাঠিয়ে দিতে বললেন। খলীফার সাক্ষীদ্বয় কাযীর সামনে এসে ভয়ে বিষয়টি অস্বীকার করলে কাযী সাহেব খলীফার অভিযোগ খারিজ করে দেন।

ইবনে হামদুন নাদিম বলেছেনঃ মুতাযদ তার খাস বাঁদি আর বিশেষ করে তার প্রিয়তমা দারিরাহকে নিয়ে উপসাগরে ষাট হাজার দিনার ব্যয়ে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করে বসবাস করার ইচ্ছা করেন। কিন্তু কিছুদিন পর দারিরাহ পরলোক গমন করায় তিনি দারুন ব্যথিত হোন।

২৮৯ হিজরিতে মুতাযদ জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে রবিউল আখির মাসের ২২ তারিখ সোমবারে ইন্তেকাল করেন।

মাসউদী বলেছেনঃ মুমূর্ষু অবস্থায় একজন ডাক্তার এসে তার নাড়ীতে হাত দিলে তিনি জোরে লাথি দেন। এতে ডাক্তারের মৃত্যুর পরই তার মৃত্যু হয়।

মুতাযদ অনেক কবিতা জানোতেন। তিনি চার পুত্র আর এগারো জন কন্যা রেখে যান।

তার শাসনামলে যে সকল ওলামাগণ ইন্তেকাল করেন তারা হলেন – ইবনুল মাওয়াযী আল মালেকী, ইবনে আবিদ দুনিয়া, কাযী ইসমাইল, হারেস বিন আবু উসামা, আবুল আইনা মুবাররদ, আবু সাইদ, কবি নাহতারী প্রমুখ।