আল কায়িম বি আমরিল্লাহ

আল কায়িম বি আমরিল্লাহ আবু জাফর আবদুল্লাহ বিন আল কাদের বিল্লাহ ৩৯১ হিজরির যিলকদ মাসের মাঝামাঝিতে উম্মে ওলাদ মাসুমা বদরুদ্দোজা, ভিন্ন মতে কতরুননিদা নামক দাসীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন।

তিনি পিতার জীবদ্দশায় ওলিয়ে আহাদ ছিলেন। তিনিই তাকে কায়েম বি আমরিল্লাহ খেতাব দেন। পিতার ইন্তেকালের পর ৪২২ হিজরিতে তিনি খিলাফতের তখতে আরোহণ করেন।

ইবনে আসির বলেছেন, “তিনি খুবই সুদর্শন, সংযমী, ইবাদাতকারী, দানশীল, আলেম, আল্লাহ’র উপর ভরসাকারী, ধৈর্যশীল, সুসাহিত্যিক, সদা প্রফুল্ল, ইনসাফকারী আর অভাব পূরণকারী ব্যক্তি ছিলেন। কোন কিছু চাইলে তিনি কাউকে বঞ্চিত করতেন না।

খতীব বলেছেনঃ মুসলিম সাম্রাজ্যে বসাসিরী অপ্রতিদ্বন্দ্বী হিংস্র হয়ে উঠে। তাকে প্রতিহত করার মতো কেউ ছিল না। আরবে আযমে সকলেই তার ভয়ে কাঁপতো। তার থেকে পরিত্রাণের জন্য দুয়া করা হতো। সে লোকদের সম্পদ আত্মসাৎ করতো, গ্রামের পর গ্রাম লুট করতো। কায়িম তাকে প্রতিহত করেন। প্রথমে উভয়ের মধ্যে প্রীতিকর সম্পর্ক ছিল, পরবর্তীতে সম্পর্কে চিড় ধরলে বসাসিরী দারুল খুলাফা লুণ্ঠন আর খলিফাকে বন্দী করার ষড়যন্ত্র করে। ফলে খলীফা রায়ের শাসনকর্তা আবু তালিব মুহাম্মাদ বিন মাকয়ালের সাহায্য প্রার্থনা করেন। রায়ের শাসনকর্তা টগর বেগ নামে প্রসিদ্ধ ছিল। সে ৪৪৭ হিজরিতে এসে বসাসিরীর বাসগৃহে আগুন ধরিয়ে দেয়। সে রহবা শহরে পালিয়ে যায়। তুর্কীরা বসাসিরীর পতাকা তলে সমবেত হয়। সে খলীফাদের বিরুদ্ধে মিসর শাসনকর্তার সাহায্য চাইলে সে তাকে অর্থ সম্পদ দিয়ে সহযোগিতা করে। এরপর সে টগর বেগের ভাই টপালকে তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে সাহায্য করার জন্য আহবান জানায়। সে তাকে লোভ দিয়ে এ মর্মে পত্র লিখে যে – আমি বিজিত হল তোমাকে রায়ের শাসনকর্তা বানাবো। লোভে পড়ে টপাল টগর বেগের উপর আক্রমণ করলে বসাসিরী ৪৫০ হিজরিতে বাগদাদের দিকে কুজ করে। খলীফা বাগদাদের বাইরে এসে তার সাথে লড়াই করেন। মানসুর জামে মসজিদে মিসর শাসনকর্তার নামে খুৎবা পাঠ করা হয়। আযানে এ শব্দগুলো বৃদ্ধি করা হয় – حي علي خير العمل সে সময় খলীফা নিয়ন্ত্রিত এলাকা ছাড়া সর্বত্র তার নামে খুৎবা পাঠ করা হতে থাকে। এক মাস পর্যন্ত লড়াই চলতে থাকে। যিলহজ মাসের শেষ দিকে সে খলীফাকে বন্দী করে গানায় নিয়ে গিয়ে কয়েদ করে রাখে।

ওদিকে টগর বেগ তার ভাইকে পরাজিত ও হত্যা করে গানার প্রশাসককে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে খলীফাকে দারুল খুলাফায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য পত্র লিখে। সে তা-ই করে। ৪৫১ হিজরির যিলকদ মাসের পাঁচ তারিখে খলীফা এসে পৌঁছেন। সে সময় তিনি খুব খোশহাল অবস্থায় ছিলেন। এরপর টগর বেগ সুসজ্জিত বাহিনী নিয়ে বসাসিরীর উপর হামলা করে। যুদ্ধে বসাসিরী পরাজিত হয়। সে তাকে হত্যা করে তার কাটা মাথাটি বাগদাদে পাঠিয়ে দেয়।

খলীফা দারুল খুলাফায় ফিরে এসে জায়নামাযে ঘুমাতেন। দিনে রোযা রাখতেন, রাতে নামায পড়তেন। যারা তাকে কষ্ট দিতো তিনি তাদের ক্ষমা করে দিতেন। তিনি তার লুণ্ঠিত সম্পদ মূল্য প্রদান ছাড়া ফেরত নিতেন না। তিনি বলতেন, “সব বিষয়ের সওয়াব আমি আল্লাহ’র কাছ থেকে নিবো।” তিনি বালিশে মাথা রাখতেন না। কথিত আছে, তার প্রাসাদ লুণ্ঠিত হওয়ার সময় খেলাধুলার কোন আসবাবপত্র পাওয়া যায়নি। এটা তার বুজুর্গির উন্নত দলীল।

বর্ণিত আছেঃ বসাসিরী তাকে কয়েদ করে নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি এ দুয়াটি লিখে কাবাঘরের দেওয়ালে ঝুলিয়ে দেওয়ার জন্য মক্কা শরীফে পাঠিয়ে দেন – “বান্দা মিসকিনের পক্ষ থেকে মহান আল্লাহ’র দরবারে, হে ত্রিভুবনের শাহানশাহ, আপনি তো মনের গোপন অভিব্যক্তি সম্পর্কেও জানেন। অন্তরের অবস্থা আপনার সামনে দিবাকরের মতোই ভাস্বর। হে মাবুদ, আপনার অপার জ্ঞানভাণ্ডার নিজের সৃজনশীলতার ব্যাপারে সম্যক অবগত। ইলাহি, আপনার এ বান্দা আপনার নিয়ামত অস্বীকার করেছে, কৃতজ্ঞতা আদায় করেনি, নিয়ামতরাজির উপর নির্ভর করেনি। আপনার হুকুম মানার ক্ষেত্রে অমনোযোগী হয়েছে। ফলে আমার উপর এক বিদ্রোহীকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, যাদের সাথে আমার দুশমনি, হে প্রতিপালক। সাহায্য কমে গিয়েছে আর অত্যাচার বেড়ে গিয়েছে। হে পালনকর্তা, আপনিই প্রত্যেক বিষয়ে অবিসংবাদিত, পরিজ্ঞাত, নিয়ন্ত্রক আর বিচারক। আপনারই সমীপে ফরিয়াদ, প্রত্যাবর্তন আর পানাহ চাইছি। হে দয়াময়, আপনার মাখলুক আমার উপর প্রভুত্ব করছে। আমি আপনার কাছেই ফরিয়াদ করছি। আমি আপনার ইনসাফপ্রার্থী। আপনি আমার উপর থেকে অন্ধকারের যবনিকা অপসৃত করুন। আপনার দয়া আর মমতার দুয়ার অবারিত করুন। আমাদের মাঝে ইনসাফ করুন। আপনিই খাইরুল হাকেমীন।”

৪২৮ হিজরিতে মিসর শাসনকর্তা আয যাহের উবায়দী আট বছর চার মাস রাজত্ব করে মারা যায়। তার স্থানে তার পুত্র আল মুসতানসির সাত বছরের জন্য কায়েম থাকে।

যাহাবি বলেছেন, “তার শাসনামলে মিসরে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, যার তীব্রতা একমাত্র ইউসুফ (আঃ) এর যুগের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। এ দুর্ভিক্ষ সাত বছর স্থায়ী হয়। লোকেরা একে অপরকে কেটে খেয়ে ফেলতো। সে সময় একটি রুটি পঞ্চাশ দিনারে বিক্রি হয়।”

৪৪৩ হিজরিতে মুয়ায বিন নাদিস খুৎবা থেকে উবায়দীদের নাম বাদ দিলে পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে বনু আব্বাসের নাম পঠিত হতে থাকে।

৪৫১ হিজরিতে গাযনার বাদশাহ সুলতান ইব্রাহীম মাহমুদ বিন সবক্তগীন আর টগর বেগের ভাই খুরাসানের শাসনকর্তা জাফর বেগ বিন সালজুকের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। পড়ে উভয়ের মাঝে সন্ধি হয়। এর এক বছর পর জাফর বেগ ইন্তেকাল করেন। তার স্থানে তার পুত্র তখত নশীন হয়।

৪৫৪ হিজরিতে খলীফা নিজ কন্যাকে টগর বেগের সাথে বিয়ে দেন, যা কখনোই এমনটা হয়নি। বনু আব্বাস নিজের বংশের ছাড়া কোথাও (কন্যা) বিয়ে দেয় নি। এমনকি বনু যুয়া, যারা খলীফাদের উপর হুকুমত চালিয়েছে, তাদেরকেও বনু আব্বাস কন্যা দেয়নি। আর আমার (গ্রন্থকারের) যুগে খলীফা তার মেয়েকে ডেপুটি সুলতানের গোলামের সাথে বিয়ে দেন।

৪৫৫ হিজরিতে টগর বেগ খলীফার মেয়েকে নিয়ে বাগদাদে এসে মাওয়ারিস আর খারাজ ফিরিয়ে দেয়। এরপর বাগদাদের উপর দেড় লাখ দিনার ট্যাক্স বসিয়ে রায়ে চলে যায়। সেখানে পৌঁছে সে মারা যায়। আল্লাহ তার গুনাহ ক্ষমা করবেন না। তার শূন্য পদে তার ভাতিজা খুরাসানের শাসনকর্তা ইরসালান অধিষ্ঠিত হয়। খলীফা তার কাছে খিলাআত পাঠান।

যাহাবি বলেছেনঃ ইরসালান সর্বপ্রথম বাগদাদে মিম্বরে আরোহণ করে নিজের উপাধি সুলতান হিসেবে ঘোষণা করে। সে অন্যান্য সুলতানের চেয়ে অধিক শক্তিশালী হওয়ায় খ্রিস্টানদের অধিকাংশ শহর, নগর, জনপদ দখল করে নেয়। সে নিযামুল মুলুককে উযির নিয়োগ করে। উমায়দুল মুলুকসহ সভাসদদের বরখাস্ত করে। সে শাফি মাযহাবের মদদদাতা। হারামাইন শরিফাইনের ইমাম আর আবু কাসিম আল কুশায়রীকে খুবই সমাদর আর সম্মান করতো। সে মাদ্রাসায়ে নিযামিয়ার ভিত্তি স্থাপন করে। বর্ণিত আছে যে, সর্বপ্রথম ফিকহ এর জন্য এ মাদরাসার ভিত্তি দেওয়া হয়।

৪৫৮ হিজরিতে দুই চেহারা বিশিষ্ট এক কন্যা সন্তান জন্ম নেয়। এ বছর আকাশে চাঁদের সমান একটি তারকা দেখা দেয়, এ থেকে তীব্র তাপদাহ নির্গত হয়। এ দৃশ্য দেখে লোকেরা ভীষণ ভয় পায়। দশরাত পর্যন্ত এর অস্তিত্ব ছিল। পড়ে তা আস্তে আস্তে ম্লান হয়ে যায়।

৪৫৯ হিজরিতে মাদরাসা নিযামিয়ার কাজ সমাপ্ত হয়। শিক্ষক হিসেবে শায়খ আবু ইসহাক শিরাজী নিয়োগ পান। চারিদিক থেকে ছাত্ররা আসতে থাকে। এমন সময় শায়খ আবু ইসহাক শিরাজী চলে যান। তার সাথে ইবনে সবাগ সাহেবে কামেল দরস দিতে শুরু করেন। এরপর লোকেরা শায়খ আবু ইসহাক শিরাজীকে বুঝিয়ে নিয়ে এলে পরে তিনি দরস-তদরিসের কাজ শুরু করেন।

৪৬০ হিজরিতে রমলায় বড় ধরণের ভূমিকম্প হয়। এতে রমলা সমূলে বিধ্বস্ত হয়। পঁচিশ হাজার লোক নিহত হয়।

৪৬১ হিজরিতে দামেশকের জামে মসজিদে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে কারুকার্য ও স্বর্ণ-রৌপ্য খচিত সাদের ব্যাপক ক্ষতিসাধিত হয়।

৪৬২ হিজরিতে মক্কার আমীরের দূত এসে সুলতান আলব আরসালানকে এ সংবাদ দেয় যে, মক্কা শরীফে মুসতানসিরের নামে খুৎবা বন্ধ হয়ে বনু আব্বাসের নামে খুৎবা পড়া শুরু হয়েছে। আযান থেকে এ শব্দগুলো বাদ পড়েছে – حي علي خير العمل এ কথা শুনে সুলতান দূতকে খুশী হয়ে ত্রিশ হাজার দিনার আর খিলআত প্রদান করেন। সে সময় মিসরীয় সালতানাত দুর্ভিক্ষে দুর্বল হয়ে পড়ে। কারন এ দুর্ভিক্ষ সাত বছর স্থায়ী হয়েছিলো। মানুষ মানুষের গোশত খেতো। স্বর্ণের সমপরিমাণে খাদ্য কেনা হতো। একটি কুকুর পাঁচ দিনার আর একটি বিড়াল তিন দিনারে বিক্রি হতো। কথিত আছে, এক নারী এক ঝুড়ি মণি-মুক্তা নিয়ে কায়রো থেকে এই উদ্দেশ্য নিয়ে বের হয় যে, সে এক ঝুড়ি মণি-মুক্তার বিনিময়ে এক ঝুড়ি খাদ্য চায়। কিন্তু সে তা পায়নি।

৪৬৩ হিজরিতে বনু আব্বাস ও সুলতান আলব আরসালানের শক্তি আর মুসতানসিরের সালতানাতের পতন দেখে লোকেরা বনু আব্বাসের নামে খুৎবা পাঠ করতে থাকে। এ বছর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মাধ্যমে রোমানরা মুসলমানদের কাছে পরাজিত হয়। এ যুদ্ধে সুলতান আরসালান স্বয়ং সেনাপতিত্বের দায়িত্ব পালন করেন আর রোম সম্রাটকে বন্দী করে নিয়ে আসেন। এরপর মোটা অংশের মুক্তিপণ নিয়ে রোম সম্রাটকে ছেড়ে দেওয়া হয় আর পঞ্চাশ বছর মেয়াদী উভয়ের মাঝে এক সন্ধিপত্র সাক্ষরিত হয়।

৪৬৪ হিজরিতে ছাগলের মাঝে মরণ ব্যাধি রোগের প্রাদুর্ভাব হওায়পালের পর পাল ছাগল মরে সাফ হয়ে যায়।

৪৬৫ হিজরিতে আলব আরসালান নিহত হয়। তার জায়গায় পুত্র মূলক শাহ অধিষ্ঠিত হয়। তাকে জালালুদ্দৌলা উপাধিতে ভূষিত করা হয়। সে নিযামুল মূলককে কলমদানি ও দোয়াত উপহার দেয়। এরপর সে তাকে আতা বেগ, যার অর্থ আমিরুদ্দৌলা উপাধি দেয়। ইনি প্রথম ব্যক্তি যাকে তিনি সর্বপ্রথম উপাধি প্রদান করেন।

৪৬৬ হিজরিতে দজলা নদীর ত্রিশ হাত খাড়া পানিতে বাগদাদ প্লাবিত হয়। এতে প্রচুর জানো আর মালের ক্ষতি হয়। লোকেরা জাহাজে আশ্রয় নেয়। দুটো জুমআর নামায জাহাজেই হয়। খলীফা খুবই বিনয়ের সাথে আল্লাহ’র দরবারে দুয়া করেন। এক লাখের বেশী ঘরবাড়ি ধ্বংস হওয়ায় বাগদাদ বিরান ভূমিতে পরিণত হয়।

৪৬৭ হিজরিতে পঁয়তাল্লিশ বছর খিলাফত পরিচালনার পর তিনি শাবান মাসের ১৩ তারিখ বৃহস্পতিবার রাতে জগতের মায়া কাটিয়ে পরপারে পাড়ি জমান।

তার খিলাফতকালে যে সব ওলামায়ে কেরাম ইন্তেকাল করেন তারা হলেন – আবু বকর ইয়ুরকানী, আবুল ফজল ফালকী, সাআলাবী, কুদদারী শায়খে হানাফীয়া, দার্শনিক ইবনে সিনা, কবি মিহয়ার, আবু নাঈম, আবু যায়েদ, তাহযীবের লেখক বুরুয়ী মালিকী, আবুল হাসান বসরী মুতাযানী, মক্কী, শায়খ আবু মুহাম্মাদ জুবিনী, মাহদী সাহেবে তাফসীর, আকলিলী, সুমানিনী, ইরশাদের লেখক আবু আমর দাদানী জালিল, সালিম রাযী, আবুল আলা মুফযী, আবু উসমান সাবুনী, বুখারি শরীফের ব্যাখ্যাকার ইবনে বাত্তাল, কাযী আবু তৈয়ব তাবারী, ইবনে শায়তী মাকরী, মাদরদী শাফী, ইবনে বাব শাদ, নাহুবিদ শিহাব বিন বুরহান, ইবনে হাযাম যাহেরি, বায়হাকী, ইবনে সাইয়েদাহ, আবু ইয়ালা বিন ফারার শায়খে হানাবালা, শাফি হাযালী, শায়খে বাগদাদি ইবনে রাশীক, উমদাহ বিন আবদুল বার প্রমুখ।