আন নাসর লিদ দ্বীনিল্লাহ

আন নাসর লিদ্বীনিল্লাহ আহমাদ আবুল আব্বাস বিন আল মুসতাযা বি আমরিল্লাহ ৫৫৩ হিজরির রযব মাসে যুমরাদ নামক তুর্কি বাঁদির গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন।

৫৭৫ হিজরির যিলকদ মাসের চাঁদনী রাতে তিনি তখতে আরোহণ করেন।

মুহাদ্দিসীনদের একটি জামাত তাকে হাদিস বর্ণনা করার অনুমতি দেন। সেই মুহাদ্দিসিনদের মধ্যে আবুল হুসাইন আবদুল হক আল ইউসুফী আর আবুল হাসান আলী বিন আসাকির আলবাহাতী প্রমুখ অন্যতম। তিনি নিজেও এক জামাতকে হাদিস বর্ণনা করার ইজাযত দেন। তার শাসনামলে লোকেরা তার থেকে সনদ ছাড়া বর্ণনা করাকে গর্বের বিষয় মনে করতো।

যাহাবী বলেছেন, এতো দীর্ঘ সময় ধরে কোন খলীফা খিলাফতের কাজ পরিচালনা করেননি। তিনি ৪৭ বছর তখতে নসীন ছিলেন। তিনি সারা জীবন ইজ্জত ও সম্মানের সাথে বেঁচে ছিলেন। তিনি সকল শত্রুদের মূলোৎপাটন করেন। সকল সুলতান প্রকাশ্যে তার আনুগত্য ঘোষণা করে। তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার সাহস কারো ছিল না। তার উপর হামলা করার ধৃষ্টতাও কেউ দেখায়নি। যদি কেউ হামলা করেছে তো সাথে সাথে তার গর্দান উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কোন বিরোধী চক্র মাথা তুললে সাথে সাথে তা দমন করা হয়। কেউ তার অনিষ্ট করতে চাইলে আল্লাহ তাকে ধ্বংস করে দিতেন। তিনি নিজ পিতামহের মতো কল্যাণধর্মী কাজে খুবই যত্নবান ছিলেন। তার ভাগ্য খুবই সুপ্রসন্ন। তিনি প্রজা হিতৈষী মানুষ ছিলেন। প্রত্যেক শহরে সংবাদ সরবরাহের কাজে একাধিক লোক নিয়োগ ছিল। তারা সকল সুলতানের প্রকাশ্য ও গোপনীয় সংবাদ লিখে জানাতো। তিনি রাজনৈতিক কূটচাল প্রয়োগের ক্ষেত্রে ছিলেন অবিসংবাদিত।

খলীফা আন নসর গায়েবের খবর জানোতেন না। একবার খাওয়ারিযম শাহীর দূত একটি মোহর আটানো পত্র নিয়ে বাগদাদে আসে। খলীফা তাকে বললেন, “তুমি ফিরে যাও, পত্রের বিষয়বস্তু আমার অজানা নয়।” দূত ফিরে গেলো।

যাহাবি বলেছেন, লোকদের ধারণা – খলীফার বশে জীন ছিল। খুরাসান আর মাওরাউন নাহারের বাদশাহ খাওারিযম লোকদের উপর অত্যাচার করতো, প্রতাপশালী রাজাদের হাত করেছিলো, শহরের পর শহর লুণ্ঠন করতো আর মুসলিম বিশ্বে বনু আব্বাসের নাম খুৎবা থেকে বাদ দেওয়া হয়। সে বাগদাদ দখলের জন্য হামদান শহরে পৌঁছুলে ২০ দিন পর বিরামহীন বরফ বর্ষিত হয়। ফলে সে আর সামনে এগুতে পারে না। এ পরিস্থিতিতে তার সাথীরা মন্তব্য করলো, খলীফার উপর আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে বিধায় আল্লাহ এ গযব নাযিল করেছেন। অবশেষে সে ফিরে যায়।

আন নাসর যখন লোকদের শাস্তি দিতেন, তখন দারুন কঠোরতা অবলম্বন করতেন। আর কাউকে দান করলে নিশ্চিতভাবে তার দুস্থতা ও দারিদ্রতা কেটে যেতো। এক ব্যক্তি ভারত থেকে খলীফার জন্য একটি তোতা পাখি এনেছিল। পাখিটি قُلْ هُوَ اللَّـهُ أَحَدٌ পড়তে পারতো। বাগদাদ পৌঁছে সেদিন পাখিতি মারা যায়। সকালে লোকটি দারুন বিচলিত হয়ে পড়ে। এমন সময় খলীফার খাদেম এসে বললো, “পাখিটি কোথায় ?” সে বললো, “মারা গেছে।” খাদেম বললো, “বলতো, কতটুকু পুরস্কার পাওয়ার আশায় তুমি খলীফার জন্য পাখিটি এনেছিলে ?” সে বললো, “পাঁচশো দিনারের আশা ছিল।” খাদেম তার কাঙ্ক্ষিত অর্থ তাকে দিয়ে বললো, “এগুলো খলীফা তোমাকে দিয়েছেন। তুমি ভারত যাওয়ার পর থেকেই খলীফা এ ব্যাপারে জানোতেন।”

একবার সদরে জাঁহার সাথে অনেক মুফতি বাগদাদে আসেন। এদের মধ্যে একজন ফকিহ তার নিজের ঘোড়ায় চড়ে নিজ বাসস্থান সমরকন্দ থেকে বাগদাদে আসার সময় তার স্ত্রী ঘোড়াটি রেখে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়ে বললো, “এতো সুন্দর ঘোড়াটি তুমি নিয়ে যেও না, খলীফা দেখলে কেড়ে নিবেন।” মুফতি সাহেব বললেন, “খলীফার এতোটা দুঃসাহস হবে না।” এর মধ্যেই বিষয়টি খলীফার কানে পৌঁছে যায়। তিনি তার শাহী বাবুর্চিকে বাগদাদে এলে সেই মুফতি সাহেবের ঘোড়াটি কেড়ে নেওয়ার আদেশ দেন। সেটাই হলো। শখের ঘোড়াটি হাতছাড়া হওয়ায় ফকিহ দারুন বেদনায় হতবিহবল হয়ে পড়লেন। সদরে জাঁহা ফিরে যাওয়ার সময় খলীফা সকল মুফতির খিলআত প্রদান করলেন, সেই মুফতিও খিলআত প্রাপ্ত হোন। খিলআত হিসেবে খলীফা তাকে তার অনিন্দ সুন্দর শখের প্রিয় ঘোড়াটি প্রদান করলেন। প্রদানের সময় খলীফা তাকে বললেন, “তোমার ঘোড়াটি কেড়ে নেওয়ার মতো দুঃসাহস এই খলীফার না থাকলেও তারই এক নিন্মস্তরের গোলাম তা ছিনিয়ে নিয়েছিলো।” এ কথা শুনে মুফতি সাহেব বিসসয়াবিভুত হয়ে পড়েন আর খলীফার কারামতের কায়িলে পরিণত হোন।

আল মুফিক আবদুল লতিফ বলেছেন, মানুষের অন্তরে খলীফার ভয় জেঁকে বসেছিলো। বাগদাদের লোকদের মতোই ভারত আর মিসরের জনগন তাকে ভীষণ ভয় পেতো। খলীফা মুতাসিমের পর যে বীরত্ব, নির্ভীকতা আর সাহসিকতার অপমৃত্যু ঘটেছিলো, তিনি তা পুনর্জীবিত করেন। এরপর তার অন্তর্ধানে খিলাফতের সেই দুর্দমনীয় প্রতাপেরও মৃত্যু হয়। বড় বড় শক্তিধর বাদশাহ যেমন শাম আর মিসরের সুলতানগণ নিজের দরবারেও তার দুরজয় প্রতাপের কারণে ধীরে ধীরে খলীফার নাম নিতো।

একবার সোনালি কাজ করা দিমআতের বিখ্যাত চাদরের বোঝা নিয়ে বাগদাদ আসে। নগর শুল্ক আদায়কারীরা তার পণ্যের কর চাইলে সে প্রত্যাখ্যান করে বললো, আমার কাছে মন কিছু নেই যার শুল্ক দিতে হবে। খাজনা আদায়কারীরা তার পণ্যের বিবরণ দিতে লাগলো। এরপরও সে অস্বীকার করলো। এরপর খিলাফত কর্তৃক অবহিতকরণ বিষয়টি সম্পর্কে তারা বলল, “তুমি কি তোমার অমুক তুর্কি গোলামকে দিমআত শহরে অমুক অপরাধের কারণে হত্যা করোনি, আর তাকে অমুক স্থানে দাফন দাওনি – যার কথা আজ পর্যন্ত কেউ জানে না ?” এ কথা শুনে সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লো আর কর আদায় করলো।

ইবনে বুখার বলেন, আন নাসরের কাছে সুলতানগণ আসতো। তারা খলীফার আনুগত্য প্রকাশ করতো। যারা বিরুদ্ধাচরণ করতো, তারা অসামান্য অপদস্থ হতো। অহংকারী ও নাফরমানকারীদের গর্দানের খুনে তার তলোয়ার রঞ্জিত হতো। তার দুশমনদের পদযুগল সর্বদা প্রকম্পিত ছিল। তার বিজয়ের দুরন্ত ঘোড়াটি বনু আব্বাসের রাজত্বের সীমান্ত অতিক্রম করেছিলো। চীন আর স্পেনের শহরগুলোতে তার নামে খুৎবা পড়া হতো। তিনি বনু আব্বাসের সকল খলীফার মধ্যে কঠোর। তার বীরত্বে পর্বতশৃঙ্গ কেঁপে উঠতো। তিনি চরিত্রবান, শক্তিশালী, বাগ্মী, স্পষ্টভাষী ও সাহিত্যের জগতে অবিসংবাদিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তার যুগটি ছিল আলোকিত ও গর্বিত।

ইবনে ওয়াসিল বলেছেনঃ আন নসর খুবই বুদ্ধিমান, চালাক, বীর, চিন্তাশীল, নির্ভুল অভিমত পেশকারী আর ঝানু রাজনীতিবিদ। কূটনৈতিক তৎপরতায় তিনি খুবই দক্ষ ও অভিজ্ঞ ছিলেন। তার গুপ্তচররা মুসলিম সাম্রাজ্যের সকল প্রান্তে চষে ফিরতো। সমাজের গুরুত্বহীন সংবাদও তারা যত্নসহকারে বাগদাদে সরবরাহ করতো। একদিন এক ব্যক্তি তার বাড়িতে কিছু লোককে দাওয়াত দেয়। মেজবান নিজেই মেহমানের আগে হাত ধুয়ে ফেলে। গুপ্তচরেরা এ বিষয়টিও খলীফাকে জানিয়ে দেয়। তিনি লোকটিকে ডেকে বললেন, “মেহমানের আগে হাত ধোঁয়া আদবের খেলাফ।” এ কথা শুনে লোকটি হতবিহবল হয়ে পড়ে।

ইবনে ওয়াসিল বলেন, আন নাসর প্রজাদের অধিকারের ব্যাপারে ভালো ছিলেন না। তিনি অত্যাচারের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। এমনকি তার সাম্রাজ্যের অধিকাংশ লোক নিজ ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। আর তিনি তাদের পরিত্যক্ত সম্পদ হস্তগত করেন। তার কাজ কিছুটা উল্টা ছিল। কখন কখন তার বাপ-দাদার বিরোধী আকিদা পোষণ করতেন। শিয়া মতবাদের প্রতি তার আকর্ষণ ছিল প্রবল। একবার তিনি ইবনে জাওযীকে প্রশ্ন করে বসেন, “রাসুলুল্লাহ’র (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পর সর্বোত্তম ব্যক্তি কে ?” তিনি আবু বকর (রাঃ) এর কথা বুঝাতে সক্ষম না হওয়ায় ভাসা ভাসা কথায় জবাব দিয়ে বললেন, তার সাথে তার মেয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন।

ইবনে আসির বলেছেনঃ আন নসরের চারিত্রিক গুণাবলী অনেক বেশী খারাপ ছিল। তার রুসমাত আর ট্যাক্সের ভারে গোটা ইরাক বিধ্বস্ত হয়। তিনি লোকদের সম্পদ নিজের রক্ষিত মালের সাথে একীভূত করতেন। কেউ কোন কথা বললে তিনি অবশ্যই এর উল্টোটা বলতেন।

আল মুফিক আবদুল লতিফ বলেছেনঃ তার শাসনামলের মধ্যবর্তী যুগে তার মাঝে হাদিস সংগ্রহের প্রবল ইচ্ছা জাগে। তিনি দূর-দারাজ থেকে মুহাদ্দসীনদের ডেকে এনে হাদিস শোনার ও তার বর্ণনা করার অনুমতি লাভ করতেন। এরপর তিনি অধিকাংশ সুলতান আর ওলামাদের হাদিস বর্ণনার ইজাযত দেন। তিনি একটি কিতাবে ৭০ টি হাদিস লিখে হলব শহরে পাঠিয়ে দেন। সেখানে লোকেরা সে হাদিসগুলো শ্রবণ করতো। যাহাবি বলেন, আন নাসর অনেক ওলামা সাংসদকে হাদিস বর্ণনা করার অনুমতি দেন। তাদের মধ্যে ইবনে সাকীনা, ইবনে আহযর, ইবনে বুখার, ইবনুদ দিমগানি প্রমুখ।

আল মুযাফফর বলেছেনঃ ইবনে জাওযী প্রমুখ লিখেছেন – শেষ বয়সে আন নাসরের দৃষ্টিশক্তি কমে যায়। কেউ বলেন, তিনি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। বাড়ির লোকজন আর নিজের উযির ছাড়া আর কাউকে তিনি চিনতে পারতেন না। তিনি নিজের এক বাদিকে হাতের লেখা অনুশীলন করান, বাঁদিটি অবিকল খলীফার হাতের লেখার অনুরূপ লিখতো। তিনি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলার পর সেই বাঁদিকে দিয়ে হুকুম-আহকাম লিখাতেন। অথচ কেউই বুঝতে পারতো না যে, এটা খলীফার লেখা নয়। শামসুদ্দীন জরযী বলেন, খলীফা আন নাসর ৬২২ হিজরির রমযানের শেষ শনিবারে ইন্তেকাল করেন।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ুবির লকব ছিল আল মূলক আন নাসর। ৫৭৭ হিজরিতে খলীফা তাকে জানান যে, তুমি জানো আমার উপাধি আন নাসর লিদ্বীনিল্লাহ। এ ক্ষেত্রে তোমার উপাধি আল মূলক আন নাসর হয় কি করে ?

৫৮০ হিজরিতে তিনি আহকাম জারি করলেন, যে ব্যক্তি ইমাম মুসার শহীদ হওয়ার স্থানে এসে আশ্রয় নিবে, তাকে নিরাপত্তা দেওয়া হবে। অধিকাংশ অপরাধিরা এসে সমবেত হতে লাগলো। ফলে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যায়।

৫৮১ হিজরিতে ঈশ শহরে এক কানবিশিস্ট এক ছেলে জন্মগ্রহণ করে। এ বছর পশ্চিমাঞ্চলীয় শহরগুলোতে খলীফার নামে খুৎবা পাঠ করা হয়।

৫৮২ হিজরিতে সাতশো তারকা একত্রিত হতে দেখে জ্যোতিষীরা বললো, জামাদিউল আখির মাসের নবম রাতে গাঢ় অন্ধকার নেমে আসবে, এতে গোটা শহর বিধ্বস্ত হওয়ার আশংকা আছে। এ কথা শুনে লোকেরা গর্ত খুঁড়ে বাংকার তৈরি করে খাবার-পানিসহ সেখানে অবস্থান নেয়। সে রাতটি তাড়া উদ্বেগের সাথে পার করে। কওমে আদের মতো জমকালো অন্ধকার নেমে আসবে বলা হলেও সে রাতের মৃদু হাওয়ায় কুপিও নিভেনি। ফলে জ্যোতিষীরা উপহাসের পাত্রে পরিণত হয়। অনেক কবি তাদের সমালোচনায় কবিতা রচনা করেন।

৫৮৩ হিজরির প্রথম সপ্তাহের প্রথম দিন শনিবারে শামস এবং সালে ফারসীরও প্রথম দিন ছিল। এ বছর অনেক বিজয় অর্জিত হয়। সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ুবি শাম মুলুকের অধিকাংশ শহরগুলো দখল করে নেন। এগুলোর মধ্যে সবচাইতে বড় ছিল বাইতুল মুকাদ্দাস বিজয়, যা ফিরিঙ্গীরা ৯১ বছর শাসন করেছে। ফিরিঙ্গীরা এখানে যে গির্জা নির্মাণ করেছিলো, তিনি তা ভেঙে দিয়ে সেখানে একটি মাদরাসা শাফিয়া প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি কিমামা উমর (রাঃ) এর অনুসরণে স্বস্থানে রেখে দেন, কারন বাইতুল মুকাদ্দিস দখলের পর উমর (রাঃ) ও সেটা সেভাবেই রেখে দেন। কবি মুহাম্মাদ বিন আসদ বাইতুল মুকাদ্দিসের বিজয় নিয়ে কবিতা লিখেছেন।

ইবনে বুরজানো সূরা রোমের তাফসীরে লিখেছেন, ৫৮৩ হিজরি পর্যন্ত বাইতুল মুকাদ্দিস রোমানদের অধীনে থাকবে, এরপর তারা পরাজিত হবে। মুসলমানগণ বিজয় অর্জন করবে আর ইন শা আল্লাহ, বাইতুল মুকাদ্দিস অনন্তকাল দারুল ইসলামে পরিণত হবে।

আবু শুমামা বলেন, ইবনে বুরজানো এক আশ্চর্যজনক তাফসীর পেশ করেছেন। তিনি বাইতুল মুকাদ্দিস বিজয়ের আগেই ইন্তেকাল করেন।

৫৮৯ হিজরিতে সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবি ইন্তেকাল করেন। এক দূত তার ব্যবহৃত একটি বর্শা, একটি ঘোড়া, এটি দিনার আর কিছু দিরহাম নিয়ে বাগদাদে আসে। এছাড়া তার আর কোন সম্পদ ছিল না। তার মৃত্যুর পর তদীয় ছেলে ইমামুদ্দীন উসমানুল মূলক আল আযিয মিসরের, দ্বিতীয় পুত্র আল মুলকুল আফযল নুরুদ্দিন আলী দামেশকের এবং তৃতীয় পুত্র আল মুলকুল যাহের গিয়াসুদ্দিন গাজী হলবের সুলতান মনোনীত হোন।

৫৯০ হিজরিতে সালজুল বংশীয় সর্বশেষ বাদশাহ সুলতান টগর-ল-বেগ শাহ বিন আরসালান বিন টগর-ল-বেগ বিন মুহাম্মাদ বিন মূলক শাহ মারা যায়। যাহাবি বলেন, এ বংশে বিশজন বাদশাহ অতিক্রম করে। এদের মধ্যে প্রথম বাদশাহ টগর-ল-বেগ। সে খলীফা কায়িস বি আমরিল্লাহ’র যুগে জীবিত ছিল। এ বংশের বাদশাহগণ ১৬০ বছর শাসনকার্য পরিচালনা করেন।

৫৯২ হিজরিতে পবিত্র মক্কা নগরী অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, লোকদের প্রতি লাল বালু বর্ষিত হয়, রুকনে ইয়ামানের একটি অংশ ভেঙে পড়ে। এ বছর খাওয়ারিজম শাহ খিলাফতের বিরুদ্ধে সৈন্যসমাবেশ ঘটায়, যা আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি।

৫৯৩ হিজরিতে বড় একটি নক্ষত্রের পতনে ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়। লোকেরা কিয়ামত সমাগত ভেবে খুবই বিনয়ের সাথে দুয়া করতে থাকে।

এ বছর আল মূলক আল আযিয মিসরে মারা গেলে তার স্থানে তার পুত্র মানসুর তখত নসীন হয়। কিন্তু আল মূলকুল আদেল সাইফুদ্দিন আবু বকর বিন আইয়ুব তার উপর হামলা চালিয়ে তার মুকুট আর তখত ছিনিয়ে নেয়। তার মৃত্যুর পর তদীয় পুত্র মুলকুল কামেল মিসরের বাদশাহ মনোনীত হয়।

৫৯৬ হিজরিতে নিল নদের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় মিসরে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। লোকেরা প্রকাশ্যে মৃত প্রাণী খেতো। এ দুর্ভিক্ষের করুন চিত্র বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে। লোকেরা কবর থেকে লাশ তুলে তা খেতো। মিসরের গাছপালা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। চোখের পলকে জীবন প্রদীপ নিভে যায়। গ্রামের পর গ্রামে কোন চুলায় আগুন জ্বলতো না। বাড়িগুলো লাশে ভরে উঠে। যাহাবি এ দুর্ভিক্ষের মর্মান্তিক ঘটনাগুলো লিপিবদ্ধ করেছেন। এ দুর্ভিক্ষ ৫৯৮ হিজরি পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।

৫৯৭ হিজরিতে মিসর, শাম আর জাযিরায় প্রচণ্ড ভূমিকম্প হয়। এতে বহু ভবন আর দুর্গ বিধ্বস্ত হয় এবং বসরার নিকটবর্তী একটি গ্রাম ধ্বসে পড়ে।

৫৯৯ হিজরির মুহাররম মাসের শেষ রাতে আবার নক্ষত্রের পতন ঘটে।

৬০০ হিজরিতে ফিরিঙ্গীরা নীলনদের পথ ধরে রাশেদের উপর হামলা করে। শহর দখলের পর তারা সেখানে লুটতরাজ করে আর হত্যাযজ্ঞ চালায়।

৬০১ হিজরিতে ফিরিঙ্গীরা কাসতানতুনিয়া শহর দখল করে আর সেখান থেকে রোমানদের বের করে দেয়। ইসলামের পূর্বে এ শহরটি রোমানদের অধীনে ছিল। ৬৬০ হিজরি পর্যন্ত শহরটি ফিরিঙ্গীদের কব্জায় থাকে, এরপর আবার রোমানদের হস্তগত হয়। এ বছর এক নারীর গর্ভে দুই মাথা আর চার পা বিশিষ্ট সন্তান প্রসবিত হয়। কিন্তু সে জীবিত ছিল না।

৬০৬ হিজরিতে তাতারিদের তৎপরতা শুরু হয়। যার বিশদ বিবরণ আমরা সামনে পেশ করবো।

৬১৫ হিজরিতে ফিরিঙ্গীরা দিময়াত রাজ্যের শহরগুলো দখল করতে থাকে।

৬১৬ হিজরিতে ফিরিঙ্গীরা দিময়াত শহর যুদ্ধের মাধ্যমে দখল করে। মুলকুল কামেল দারুণভাবে পরাজিত হয়। ফিরিঙ্গীরা দিমায়াতের জামে মসজিদ ভেঙে সেখানে গির্জা নির্মাণ করে। এ বছর দামেশকের শাসনকর্তা মূলক মুয়াজ্জম কাযিউল কুযযাত রুকনউদ্দিন যাহেরের কাছে বিশ মিশ্রিত কাবা পাঠিয়ে নির্দেশ জারি করে যে, এটি পড়ে তাকে ইজলাসে বসতে হবে। সে তা পড়ার সাথে সাথে মৃত্যু হয়। লোকেরা তার মৃত্যুতে বেদনাহত হয়।

৬১৮ হিজরিতে ফিরিঙ্গীরা দিমআত শহর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয়।

৬২১ হিজরিতে কাহেরা শহরে প্রাসাদের পাশে আল কামেলা নামক একটি দারুল হাদিস নির্মিত হয়। আব্ল খাত্তাব বিন ওহয়া এর প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত হোন।

খলীফা মামুনের যুগ থেকে এ পর্যন্ত রেশমের শ্বেত কাপড়ের চাদর দিয়ে কাবা শরীফ আচ্ছাদিত করা হতো। খলীফা আন নাসরুদ্বীনিল্লাহ রেশমের সবুজ চাদরে কাবা শরীফ ঢেকে দেন, এরপর কালো পর্দা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়, যা আজ অবধি অব্যাহত রয়েছে।

তার শাসনামলে অনেক বরেণ্য ওলামায়ে কেরামগণের ইন্তেকাল হয়, তাদের মধ্যে অন্যতমরা হলেন – রওযুল আনফ গ্রন্থের লেখক আবু যায়েদ আল সুহায়লী, হাফেয আবু মুসা আল মাদানী, জামেউল কবীর গ্রন্থের লেখক আবুল কাসিম আল বুখারি আল উসমানি, বুরহান, হিদায়া গ্রন্থের লেখক মুরগনীয়ানী, ফতোয়ায়ে হানাফির গ্রন্থকার কাযী খান, উলমে ফালসাফা গ্রন্থকার আবুল অলীদ বিন রশিদ, ডাক্তার আবু বকর বিন যহর, উম্মাদ কাতেব, ইবনে আযমীয়া মাকরী, ইমাম ফখরুদ্দিন রাযী, জামেউল উসুল আর নিহায়াতুল গরব গ্রন্থাকার ইবনে আসির, ফখরুদ্দিন বিন আসাকির প্রমুখ।