আল মুসতাসিম আবু আহমাদ

আল মুসতাসিম বিল্লাহ আবু আহমাদ আবদুল্লাহ বিন আল মুসতানসির বিল্লাহ ইরাকের শেষ খলীফা। তিনি ৬০৯ হিজরিতে ‘হাজের’ নামক বাঁদির গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন।

পিতার মৃত্যুর সময় তিনি খিলাফতে আরোহণ করেন।

তিনি ইবনুল বুখার আল মুঈদুত তাওসী, আবু রুহুল হরবী, আন নাজমুল বাদরায়ী, শরফুদ দিময়াতী প্রমুখদের কাছ থেকে হাদিস বর্ণনা করার সনদ ও ইযাজত লাভ করেন। দিময়াতী তাকে চল্লিশটি হাদিস লিখে দিয়েছিলেন, যে হাদিসগুলো আমি নিজেও দেখেছি। তিনি ছিলেন উদার, ধৈর্যশীল, স্বচ্ছ মনের আর দ্বীনদার ব্যক্তি।

শায়খ কুতুবুদ্দিন বলেছেন, তিনি তার বাবা ও দাদার মতো সুন্নতের প্রতি যত্নশীল ছিলেন। কিন্তু তার মধ্যে তাদের মতো যুদ্ধের প্রতি সচেতনতা, সাবধানতা আর বীরত্ব ছিল না। খলীফা মুসতানসিরের খুফাযী নামক এক ভাইয়ের মধ্যে সকল গুণাবলীর সমাবেশ ছিলো। তিনি ছিলেন বীর ও সচেতন। তদনিন্তন যুগে তার সাহসিকতা ছিল প্রসিদ্ধ। তিনি অধিকাংশ সময় বলতেন, আল্লাহ আমাকে খিলাফত দান করলে আমি সসৈন্যে জায়হুন সানার গাড়ি দিয়ে তাতারদের উপর আক্রমণ করে তাদের রাজ্য দখল করে নিতাম। খলীফা মুনতাসিরের মৃত্যুর পর বনু আব্বাসের মদ্যপ সভাসদবর্ণা খুফাযির ভয়ে তার হাতে বাইয়াত না করে নিজেদের প্রভাব অটুট রাখার হীন মানসে কুফাযির চেয়ে তুলনামূলক নরম মেজাজের হীন মানসে মুসতাসিমের কাছে বাইয়াত করে। তিনি রাফেযী সম্প্রদায়ভুক্ত মঈদুদ্দীন আনকামীকে উযির নিয়োগ করেন। এই কমবখত লোকটি গোটা খিলাফত ধ্বংস করে ফেলে। সে খলীফাকে হাতে রেখে পর্দার আড়ালে তাতারদের সাথে মিলিত হয়। সে খিলাফতের গোপন সংবাদ পৌঁছে দিতো। সে তাদের বাগদাদ আসার মতামত পেশ করে। বাগদাদ দখলের জন্য সেই তাদের উত্তেজিত করে। সে বনু আব্বাসের রাজত্বের মূলোৎপাটনের সহায়ক হিসেবে কাজ করতে থাকে। সে আলি (রাঃ) এর আওলাদদের উপর খিলাফত অরপনের চেষ্টা করেছিলো। তাতারদের কোন গুপ্ত সংবাদ বাগদাদে এসে পৌঁছুলে সে তা গোপন করে ফেলতো। এর ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছিলো।

৬৪৭ হিজরিতে ফিরিঙ্গীরা দিময়াত শহর দখল করে নেয়। সে সময় সুলতান মূলকুস সালিহ অসুস্থ ছিল। পরবর্তীতে শাবান মাসের মাঝামাঝিতে সে মারা যায়। এ ঘটনায় ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে উম্মে খলিল মুসুমা শাজরুদ দারাজ নামের তার এক বাঁদি মুলকুস সালিহ’র পুত্র শাহ মুলকুল মুয়াযযমকে দিময়াত শহরে ডেকে পাঠায়। কিন্তু ৬৪৮ হিজরির মুহাররম মাসে তার বাবার এক গোলাম তাকে হত্যা করে। এরপর তাজরুদ দারাজ নায়েবে সালতানাত আযুদ্দীন আইবেগ তুর্কামানীর কাছ থেকে হলব নেয় আর আমিরদের খিলআত ও উপহার প্রদান করে। আযুদ্দীন রবিউল আখির মাসের শেষ দিকে সুলতান পদে অধিষ্ঠিত হয়। সে আল মুয়ায উপাধি ধারণ করে। সে নিজেই জনগণের উপর অসন্তুষ্ট হয়। ফলে সৈন্যরা আট বছর বয়সী মুলকুল আশরাফ বিন সালাহুদ্দিন ইউসুফ বিন মাসউদুল কামেলের কাছ থেকে হলব নেয়। এভাবে এক রাজ্যে দুই সুলতান তখতে উপবেশন করে। দুজনের নামেই খুৎবা পাঠ করা হয় আর দুজনের নামেই খোদিত মুদ্রা চালু থাকে।

৬৪৮ হিজরিতে মুসলমানরা আবার দিময়াত শহর ফিরিঙ্গীদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়।

৬৫২ হিজরিতে আদন শহরে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড ঘটে। রাতে এর অগ্নিস্ফুলিঙ্গ সাগরের দিকে ছুটে যায় আর দিনে সাগর থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখা যায়। এ বছর মুয়ায মুলকুল আশরাফকে প্রতিহত করে নিজেই সুলতান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

৬৫৪ হিজরিতে মদিনা শরীফেও ভয়াবহ অগ্নিকান্ড ঘটে। আবু শামা বলেন, মদিনা শরীফ থেকে আমাদের কাছে এ মর্মে একটি চিঠি আসে যে, জামাদিউল আখির মাসের ৩ তারিখ মঙ্গলবার রাতে বজ্রপাতের বিকট আওয়াজ শোনার পর কিছুক্ষন পর পর ভূমিকম্প হতেই থাকে। ৫ তারিখ পর্যন্ত এ ভূকম্পন অনুভূত হয়। এরপর শক্ত পাথুরে যমীনে আর নদীর পাশে ভয়ংকর আগুন প্রজ্বলিত হয়ে উঠে। আমরা মদিনা শরীফে ছিলাম। মনে হলো, আমাদের পাশেই কোথাও যেন আগুন ধরেছে। আমরা দেখলাম, একটি পাহাড় আগুন হয়ে তা চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। ভবনগুলো জ্বলে উঠলো। মক্কাবাসীও এ আলোর তীব্রতা দেখতে পায়। লোকেরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাযার শরীফে এসে সমবেত হয় আর তাওবা-ইস্তিগফার পড়তে থাকে। এ অবস্থা এক মাসের বেশী সময় ধরে অব্যাহত ছিল।

যাহাবি বলেছেনঃ মদিনা শরীফে অগ্নিকান্ডের ঘটনাটি অসংখ্য ও অগণিত লোকের সাক্ষ্য প্রদানে প্রমাণিত, এ বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশই নেই। এ অগ্নিকান্ডের বিষয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন, “বসরার উটগুলোর গর্দান দেখা যাবে – এমন অগ্নিকান্ড হিজাযে না হওয়া পর্যন্ত কিয়ামত হবে না।” যারা সে সময় বসরায় ছিল তাদের অধিকাংশরাই বলেছেন যে, রাতে মদিনার সেই তীব্র আগুনের আলোতে বসরার উটগুলোর গর্দান দেখা গিয়েছিলো।

৬৫৫ হিজরিতে মিসর সুলতান আল মুয়ায আয়বেগকে তার স্ত্রী শাজরুদ দার হত্যা করে। এরপর তার ছেলে আল মানসুর তখতে আরোহণ করে।

এরই মধ্যে তাতারিদের বিশৃঙ্খলার আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। খলীফা আর তার মন্ত্রী পরিষদ প্রজাদের বিষয়ে উদাসীন হয়ে পড়েন। মুসলিম সাম্রাজ্যের অভিশপ্ত উযির আব্বাসীয় রাজত্ব ধ্বংসের গভীর ষড়যন্ত্রের ফাঁদ পাতায় আর উমাইয়া রাজত্ব প্রবর্তনের স্বপ্ন দেখে। সে তাতারিদের সাথে গোপনে আঁতাত করে। সে খলীফাকে ভুল পরামর্শ দিয়ে উম্মাহকে বিভ্রান্ত করে ফেলে। খলীফা তার পরামর্শে তাতারিদের রসদ সরবরাহ আর সম্মান প্রদান করেন। তার পরামর্শে খলীফা সৈন্য রাহ করেন। উযির আলকামী সকল পরিবেশ ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর বাগদাদ দখলের আহ্বান জানায়। এ প্রতিশ্রুতি গ্রহণের শর্তে – সে হবে বাদশাহ’র নায়েব।

 

তাতারিদের সংক্ষিপ্ত বিবরণ

মুফিক আবদুল লতিফ লিখেছেনঃ ভারতের পার্শ্ববর্তী দেশের লোক হওয়ায় তাতারিদের ভাষা অনেকটাই ভারতীয়দের ভাষার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ ছিল। তাতার থেকে মক্কা চার মাসের পথ। তাতাররা তুর্কীদের মতো চওড়া চেহারা, প্রশস্ত বুক, পাতলা কোমর আর বাদামী রঙের লোক ছিল। এরা দ্রুততার সাথে নিজেদের অভিমত তুলে ধরতো আর ক্ষিপ্রতার সাথে চলাফেরা করতো। ভিনদেশের সংবাদ তারা পেয়ে যেতো, কিন্তু তাদের রাজ্যের কোন খবর কেউ জানোতে পারতো না, কারন তাদের রাজ্যে ভিনদেশী গুপ্তচরের সংখ্যা ছিল খুবই নগণ্য। যার ফলে সেখানে সহজেই অপরিচিত লোকদের সনাক্ত করা যেতো।

এরা কোন যুদ্ধে গেলে নিজেদের ইচ্ছার কথা কাউকে জানাতো না, গোপন করে রাখতো। তারা হঠাৎ অতর্কিতভাবে আক্রমণ চালাতো, লোকেরা তাদের হামলা টের পেতো যখন তারা শহরময় ছড়িয়ে পড়তো। তাদের কোন সিপাহি এ কথা বিশ্বাস করতো না যে, সে শত্রুর হাতে বন্দী হতে পারে। তাদের এ প্রবল আত্মবিশ্বাসের কারণে শত্রুরা তাদের সামনে থেকে কোন দিকেই পালিয়ে যেতে পারতো না। তারা শত্রুদের সকল পথ বন্ধ করে দিতো। তাদের নারীরাও তাদের সাথে লড়াই করতো। তারা অসি আর তীর চালনায় পুরুষদের থেকে কম যেতো না। তারা সকল প্রাণীর গোশত খেতো, কোন বিষয়ে তাদের বাছবিচার ছিল না। নির্বিচারে তারা আবাল বৃদ্ধবণিতা হত্যা করতো, হত্যাযজ্ঞে তারা কোন প্রকার ছাড় দিতো না। তারা বংশের পর বংশ মানুষ হত্যা করতো একটি সম্প্রদায়কে সমূলে ধ্বংস করার জন্য। তাদের ইচ্ছাই ছিল পৃথিবীকে ধ্বংস করে ফেলা, সম্পদ ও রাজত্ব দখল তাদের ইচ্ছা ছিল না।

কিছু বর্ণনাকারীর বিবরণ হচ্ছে, তাতারিদের জনপদ ছিল চীনা সাম্রাজ্যের সাথে সম্পৃক্ত। তৎকালীন যুগে তারা জঙ্গি, পামর ও ধরপাকড় কারী হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিল। তাদের আত্মপ্রকাশের ঘটনাটি এমন –

বিশাল চীনা সাম্রাজ্যটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছয়টি রাজ্য নিয়ে গঠিত হয়েছিল। এই ছয় রাজ্যের একই বাদশাহ ছিল, তার নাম ইলকানে আকবর। সে তিমগাজ শহরে বসবাস করতো। মুসলিম জাহানের মতো তার ছয়টি রাজ্যের ছয়জন নায়েবের মধ্য থেকে একজনের নাম দুশ খান – যে চেঙ্গিস খানের ফুফুকে বিয়ে করেছিলো। দুশ খান মারা যাওয়ার পর চেঙ্গিশ খান কিশলু খানকে নিয়ে তার ফুফুকে দেখতে যায়। তার ফুফু কিশলু খানকে জানায়, দুশ খানের কোন সন্তান নেই। এজন্য চেঙ্গিস খান তখতে আরোহণ করুক। ফলে সে মসনদে উপবেশন করে আর তার জয়কৃত জনপদগুলো এর সাথে একীভূত করে ফেলে। এরপর বিশাল উপহার সামগ্রীসহ কয়েকজন দূত কর্তৃক সে ইলকানে আকবরকে বিষয়টি অবহতি করে।

এ সংবাদ পেয়ে ইলকানে আকবর গর্জন করে উঠলো। তার অনুমোদন ছাড়া চেঙ্গিশ খানের তখত গ্রহণের বিষয়টি তাকে ক্ষিপ্ত করে তোলে। উপঢৌকন হিসেবে পাঠানো চেঙ্গিশ খানের ঘোড়াগুলো আর দূতদের সে হত্যা করে। খবর পেয়ে চেঙ্গিস খান আর কিশলু খান ইলকানে আকবরের বিরুদ্ধে শপথ করে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়। সকল তাতারি তাদের পতাকা তলে এসে সমবেত হয়। তাদের শক্তিমত্তা ও সৈন্য সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ইলকানে আকবর তাদের দুর্দমনীয় প্রতাপ দেখে বিচলিত হয়ে উঠে। লোক পাঠিয়ে সে তাদের শাসিয়ে দেয়। কিন্তু কোন কাজ হল না।

অবশেষে উভয়ে মুখোমুখি দাঁড়ায়। প্রচণ্ড তীব্রতার সাথে শুরু হয় মরণপণ লড়াই। অনেক প্রাণহানি ও রক্তপাতের পর ইলকানে আকবর পরাজিত হয়। চেঙ্গিস খান আর কিশলু খান তার গোটা সাম্রাজ্য পদানত করে নেয়। তাদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি বেড়ে যায়। চেঙ্গিস খান ও কিশলু খান উভয়ে সাম্রাজ্য পরিচালনা করতে থাকে। এরপর তারা চীনের শাকু শহর অস্ত্রের মুখে দখল করে নেয়। এরই মধ্যে কিশলু খান মারা গেলে তার ছেলে তার স্থানে আসে। প্রথমে কৌশলে তারা শক্তি দুর্বল করার পর হামলা চালিয়ে তাকে হত্যা করে আর চেঙ্গিস খান একচ্ছত্র অধিপতিতে পরিণত হয়। তাতারিরা প্রথম থেকেই তাকে নিবিড় সঙ্গ দিয়ে আসছিলো। তারা চেঙ্গিস খানের ভীষণ আনুগত্যশীল ছিল। তারা তাকে আল্লাহ ভাবতে বসে। তারা আনুগত্যের সীমানা পেরিয়ে তার তাবেদারি করতে থাকে।

৬০৬ হিজরিতে চেঙ্গিস খান সর্বপ্রথম নিজ রাজ্য থেকে মামালিকে তরক, ফারগানা আর খুরাসানের শাসনকর্তা খাওয়ারিজম শাহ মুহাম্মাদ বিন তশ এর উপর হামলা চালায়, যার বিবরণ পূর্বে বিধৃত হয়েছে। খাওারিজম শাহ অনেক বড় বাদশাহ’র সাথে লড়াই করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলো। কিন্তু তাতারিদের তার রাজ্যের দিকে আসতে দেখে সমরকন্দ পালিয়ে যায়।

৬১৫ হিজরিতে তাতারিরা বিভিন্ন জনপদে ব্যাপক লুটতরাজ করে। এরপর চেঙ্গিস খান বিপুল উপঢৌকন সম্ভারসহ খাওারিজম শাহ এর কাছে দূত পাঠায়। দূত গিয়ে খাওারিজম শাহকে বললো, ইলকানে আযম (চেঙ্গিস খান) আপনাকে সালাম জানিয়েছে আর বলেছে – আপনি আমার শান-শওকত, প্রভাব-প্রতিপত্তি ও মর্যাদা সম্পর্কে জানেন। আমাদের মাঝে আপোষকামিতার কল্যাণ আমি দেখতে পাচ্ছি। তাই আমাদের মধ্যে পুনঃমিলনের সন্ধি হওয়া প্রয়োজন। আপনি আমার কাছে আমার আওলাদ অপেক্ষা প্রিয়। আপনি সব বিষয়ে চিন্তামুক্ত থাকতে পারেন। আপনি জানেন আমি গোটা চীন দখল করে নিয়েছি। সেখানে সিপাহী আর ঘোড়ার কোন ঘাটতি নেই। সেখানে রয়েছে স্বর্ণ ও রৌপ্যের খনি। সকল জিনিসের মালিক হওয়ার কারণে চীনা লোকেরা অন্য দেশের সাথে দোস্তি পাতে না। যদি ভালো মনে করেন, তবে বন্ধুত্বের শপথ গ্রহণ করুন আর পদানত রাজ্যগুলোতে ব্যবসায়ীদের অবাধে যাতায়াতের অনুমতি দিন।

খাওারিযম শাহ তার প্রস্তাব গ্রহণ করায় চেঙ্গিস খান আনন্দিত হয়। সন্ধিপত্রের ক্ষমতাবলে ব্যবসায়ীদের স্বাধীনতা এসে যায়। এ মিত্রতা অনেক দিন পর্যন্ত অটুট ছিল।

খাওারিযম শাহ এর মামা মাওরান নাহার, যার বিশ হাজার অশ্বারোহী ছিল, তার জনপদে অবস্থানরত চীনা ব্যবসায়ীদের মতগতি নিরক্ষন করে খাওারিযম শাহকে এ মর্মে পত্র লিখলো যে, চেঙ্গিস খানের দেশ থেকে আমার শহরের আগত লোকেরা পোশাক-আশাকে ব্যবসায়ী, কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য গুপ্তচরবৃত্তি। তোমার অনুমতি পেলে তাদেরকে চোখে চোখে রাখবো।

খাওারিযম শাহ তাকে সাবধানতা অবলম্বনের পরামর্শ দেয়। কিন্তু সে তাদেরকে বন্দী করে আর তাদের সম্পদ ছিনিয়ে নেয়। চেঙ্গিস খান সংবাদ পেয়ে সাথে সাথে দূত পাঠিয়ে খাওারিযম শাহকে জানিয়ে দিলো – আপনি প্রথমে ব্যবসায়ীদের স্বাধীনতা দিয়েছিলেন, এরপর এ ব্যাপারে কৌশলের ফাঁদ পাতলেন। প্রতিটি অবস্থায় কৌশল ভালো নয়, আর যখন তা হবে মুসলিম বাদশাহ কর্তৃক, তখন সেটা হবে খুবই লজাজনক। আপনার মামা যা করেছে সে সম্পর্কে আপনি না জানোলে আর যদি সে আপনার অনুমতি ছাড়া এ কাজ করে থাকে, তবে তাকে আমার হাতে ছেড়ে দিন। নাহলে আমার তলোয়ার আপনাকে যা দেখাবে তা আপনার অজানা নয়।

এ কথা শুনে খাওারিজম শাহ এর চৈতন্য লোপ পায় আর দারুন বিচলিত হয়ে পরে। সে তড়িঘড়ি করে চেঙ্গিস খানের দূতদের হত্যা করে, এর ফলাফল হয় ভয়ংকর। দুতের এক ফোঁটা রক্তের পরিবর্তে বইয়ে দেওয়া হয় মুসলমানদের এক সাগর রক্ত। চেঙ্গিস খান সসৈন্যে ধেয়ে আসে। তারা খুনের নেশায় পাগল হয়ে জীহুন সাগর পারি দিয়ে হামদান শহরে পৌঁছে। তাতারিদের ভয়ে সে হামদানের বুরুজে আশ্রয় নেয়। তাতারিরা তাকে ঘেরাও করে ফেলে আর একে একে তার সব সাথীদের হত্যা করে। খাওারিজম শাহ একা কোন রকম জীবন নিয়ে সাগর পাড়ি দিয়ে দ্বীপে পালিয়ে যায়। সেখানে সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। নির্জন দ্বীপে সাহায্যকারীর অভাবে সে মারা যায়। তার সাথে পরনের যা কাপড় ছিল, সেগুলোই হয় রার কাফন আর এগুলো পড়িয়েই তাকে ৬১৭ হিজরিতে সেখানেই দাফন করা হয়। তার সকল রাজ্য তাতারিরা দখল করে নেয়।

সিলবত ইবনে জাওযী বলেছেনঃ ৬১৫ হিজরিতে তাতারিরা সর্বপ্রথম মাওরাউন নাহার শহরে আত্মপ্রকাশ করে আর বুখারা ও সমরকন্দ দখল করে নেয়। এর অধিবাসীদের হত্যা করে, এরপর খাওারিযম শাহকে অবরুদ্ধ করে ফেলে। এরপর সাগর পার হয়ে চেঙ্গিস খান খুরাসান লুট করে আর সেখানে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়।

ইবনে আসির স্বরচিত আল কামিল ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন, এই রক্তপাগল তাতারদের নারকীয় পৈচাশিকতার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে অদ্বিতীয়। দুনিয়ার কোনো সৃষ্টির সামনে এমন মুসীবত আর কখনোই আসে নি, বিশেষত মুসলমানদের সামনে তো নয়-ই। যদি কেউ এ কথা বলে – আবহমানকাল থেকে আজ পর্যন্ত এতো মুসীবত আর কখনোই আসেনি, তবে তা হবে সম্পূর্ণ সঠিক। ঐতিহাসিকগণ তাদের দৃষ্টান্ত পেশ করতে অক্ষম।

ঐতিহাসিকগণ বাইতুল মুকাদ্দিসে বখত নসর কর্তৃক বনি ইসরাইলের উপর নির্যাতনকে অধিক বর্বর হিসেবে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। কিন্তু এই অভিশপ্ত চেঙ্গিস খান কর্তৃক মুসলমানগণ অত্যাচারিত হওয়ার মাত্রা বখত নসরের জুলুমের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। বখত নসর কর্তৃক বাইতুল মুকাদ্দিসের ঘটনা আর চেঙ্গিস খানের হাতে মুসলমানদের নির্যাতন অভিন্ন ছিল না। মুসলমানরা তাদের দেশেই এই অভিশপ্ত লোকটির দ্বারা অত্যাচারিত হয় আর তার হাতে যতো মুসলমান নিহত হয়, বখত নসরের হাতে ততো বনি ইসরাইল নিহত হয়নি। এ দুর্ভাগ্যটি একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ, যা বৃদ্ধি পেতেই থাকে আর টর্নেডোতে রূপ নেয়। তাতারিরা ছিল এমন এক ঝড়ো হাওয়া, যা খুবই ক্ষিপ্রতার সাথে বইয়ে বেড়াতো। তারা চীন থেকে বেরিয়ে তুর্কীস্তানের কাশআর, শাগরীক ইত্যাদি শহর ধ্বংস করে বুখারা ও সমরকন্দ এসে পৌঁছে। তারা সেখানে লুটতরাজ করে। এরপর তাদের মধ্য থেকে কিছু সংখ্যক খুরাসানে গিয়ে সেখানেও তারা ধংস্প ও হত্যার সফল স্বাক্ষর রেখে যায় আর হামদান শহরে গিয়ে লুট, ধ্বংস ও হত্যার রাজ্য কায়েম করে। এরপর ইরাক সীমান্তে হানা দিয়ে আযারবাইজানে যাত্রা করে। এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে তারা নিদারুন নিষ্ঠুরতার চিহ্ন রেখে যায়। একই বছরে তারা বর্ণিত সকল রাজ্য মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়। ইতিহাসে যার দৃষ্টান্ত অনেক কম।

তাতারিরা আযারবাইজানো থেকে দর বনদ, শিরাওয়া, লান, লিকয, কিফজানো, গজনী, সিজিস্তান, কারমান প্রভৃতি শহর একের পর এক ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। যার নজির ইতিহাসের পাতায় খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাদশাহ ইস্কিন্দার দুনিয়ার অধিকাংশ ভূখণ্ড শাসন করতো। সেও তাতারিদের ক্ষিপ্রতার তুলনায় ছিল অতি নগণ্য। বাদশাহ ইস্কিন্দারের দখলকৃত রাজ্যগুলোতে প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার সময় লেগেছিল কমপক্ষে দশ বছর। আর বাদশাহ ইস্কিন্দার রাজ্য জয় করতে গিয়ে শুধু হত্যা ও ধ্বংসের পথকেই বেছে নেয়নি, শক্তি প্রদর্শন ছাড়াও সে বহু রাজ্য জয় করেছেন। অনেক জনপদে তার তলোয়ার বনি আদমের খুনে রঞ্জিত হয়নি। পক্ষান্তরে, চেঙ্গিস খান এক বছরেই রক্তের সাগর বইয়ে দিয়ে সকল রাজ্য জয় করে আর রাজ্যগুলোতে ভীতির সঞ্চার ঘটায়। যুদ্ধজয়ের ক্ষেত্রে তাদের কোন সাহায্য ও রসদের প্রয়োজন ছিল না। সকালে উদিত সূর্যকে তারা সিজদাহ করতো, এটা ছিল তাদের ধর্মীয় রীতিনীতি। তাদের কাছে কোন জিনিস হারাম ছিল না। সকল প্রাণী, এমনকি মানুষের গোশত ও তারা খেতো। তাদের মধ্যে কোন বিয়ের ব্যবস্থা ছিল না। একজন নারী কয়েকজন পুরুষকে সন্তুষ্ট রাখতো।

৬৫৬ হিজরিতে হালাকু খান দুই লাখ সৈন্য নিয়ে বাগদাদ আক্রমণ করে। খলীফার সৈন্যরা তার মোকাবিলায় ব্যর্থ হওয়ায় লুটেরার দল ১০ই মুহাররমে বাগদাদে প্রবেশ করে। খলীফা মুসতাসিমের অভিশপ্ত উযির খলীফাকে তাতারিদের সাথে সন্ধি করার পরামর্শ দিয়ে বললো, “আপনার সিপাহসালাররা তাতারিদের সাথে গিয়ে মিলিত হয়েছে। আমি তাদের সাথে লোক মাধ্যমে সন্ধির আলোচনা করছি।” এ কথা বলে বিশ্বাসঘাতক উযির নিজেই তাদের কাছে গিয়ে নিজের নিরাপত্তা লাভের বিষয়টি নিশ্চিত করে খলীফার কাছে ফিরে এসে বললো, “তাতারদের বাদশাহ নিজের মেয়েকে আপনার ছেলে আমীর আবু বকরের সাথে বিয়ে দিতে চায়। তার ইচ্ছা, আপনি খিলাফতে অধিষ্ঠিত থাকুন। সালজুকদের মতো নায়েবে সালতানাতের পদ নিয়ে তারা ফিরে যেতে চায়। তাদেরকে সন্তুষ্ট করাই মঙ্গলজনক। এছাড়া মুসলমানদের রক্তপাত এড়ানোর আর কোনোই পথ ও পন্থা নেই। এরপরেও আপনার ইখতিয়ার আছে, আপনি যা ইচ্ছা করতে পারেন। তবে হালাকু খানের কাছে যাওয়ার এটাই সুবর্ণ সুযোগ।” এ কথা শুনে খলীফা গোটা সভাসদবর্গ নিয়ে হালাকু খানের কাছে গিয়ে একটি তাবুর মধ্যে সকলের সাথে বসেন।

এদিকে খলীফার উযির আগেই পৌঁছেছিলো। সে সন্ধিপত্র প্রস্তুত করার জন্য সর্বপ্রথম ওলামা ও ফুকাহাদের আহবান জানায়। তারা সেখানে পৌঁছামাত্র তাদের গর্দান উড়িয়ে দেওয়া হয়। এরপর মুসলিম উম্মাহ’র একটি প্রতিনিধি দলকে অভিন্ন কৌশলে ডেকে এনে তাদেরকেও হত্যা করা হয়। এভাবে যখন সকল ওলামা, উমারা আর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাবৃন্দকে শেষ করার পর রাস্তা পরিস্কার হয়ে যায়, নরপিচাশ তাতারিদের তরবারিগুলো খাপমুক্ত হয়ে ঝলসে উঠে, সৃষ্টি হয় রক্তের সাগর। লাগাতার চল্লিশ দ্বীন তাদের তলোয়ারগুলো খাপবদ্ধ হয়নি। লক্ষ লক্ষ আদম সন্তানের জীবন প্রদীপ নিভে যায়, যারা কুপ বা অজ্ঞাত স্থানে লুকিয়ে ছিল, একমাত্র তারাই প্রাণে রক্ষা পায়। আর ভাগ্য বিড়ম্বিত অসহায় খলীফা ধাক্কা ও লাথি খেতে খেতেই ইন্তেকাল করেন।

যাহাবি বলেছেন, আমার মতে বেচারা মসু তাসিমের ভাগ্যে দাফন জোটেনি। তার সাথে তার অনেক আওলাদ আর আত্মীয়-পরিজন নিহত হয়। আবার কাউকে কাউকে তারা বন্দী করে নিয়ে যায়। এর আগে এমন ফ্যাসাদ মুসলমানদের ভাগ্যে আর কখনো আসেনি। বিশ্বাসঘাতক উযির চক্রান্ত করে সফল হয়নি। সে তাতারিদের হাতে লাঞ্চিত হয়। এ ঘটনার কিছু দিন পরেই মৃত্যু এসে উযিরকে নিয়ে যায়। কবিগণ বাগদাদ সম্পর্কে অনেক শোকগাথা রচনা করেছেন।

বাগদাদে পঠিত সর্বশেষ খুতবাটি খতীব সাহেব এভাবে শুরু করেছিলেন – সকল প্রশংসা সেই প্রতিপালকের, যিনি মজবুত ইমারত ধ্বংস করে দিয়েছেন, যিনি শহরবাসীর মূলোৎপাটনের ফরমান জারি করেছেন আর আজ পর্যন্ত যিনি তলোয়ার খাপবদ্ধ করেননি।

হালাকু খান বাগদাদে হত্যাযজ্ঞ চালানোর পর ইরাকে তার নায়েব মনোনীত করে। আলী (রাঃ) এর পরিবার থেকে কাউকে খলীফা মনোনয়ন নিয়ে দিতে ইবনে আলকামী ব্যর্থ হয়। তাতারিরা তাকে কুকুরের মতো ধমক দিয়ে থামিয়ে দেয়। আদনা গোলামের মতো সে তাদের সাথে মিলে থাকা অবস্থায় মারা যায়। আল্লাহ যেন এ কমবখতের উপর রহম না করেন আর এ নিমকহারামের গুনাহ যেন ক্ষমা না করেন।

এরপর হালাকু খান দামেশকের শাসনকর্তা নাসিরের কাছে পরপর তিনটি চিঠি পাঠিয়ে তার আনুগত্য করার নির্দেশ দেয়।

৬৫৭ হিজরির প্রারম্ভে পৃথিবী খলীফার শাসনমুক্ত ছিল। সে সময় তাতাররা আমিদ শহরের দিকে ধাবিত হয়। তখন মিসরের শাসনকর্তা আল মানসুর আলী বিন মাআয বয়সে অনেক ছোট। তাকে পরিচালিত করতো তার বাবার গোলাম আমীর সাইফুদ্দিন কতনুল মাআযী, সুলতান কামালুদ্দীন আদিমী তাতারিদের প্রতিহত করার জন্য  আমীর সাইফুদ্দিনের সাহায্য চাইলে সে সকল উমারা আর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সমবেত করে। সেখানে শায়খ আযুদ্দীন বিন আব্দুস সালামও উপস্থিত ছিলেন। তার কাছে ফতোয়া চাওয়া হলে তিনি বললেন, “দুশমন আক্রমণ করলে তা প্রতিহত করা পৃথিবীর সবার জন্য ওয়াজিব। এ ক্ষেত্রে জনসাধারণের রণপ্রস্তুতির জন্য বাইতুল মাল শূন্য করে দেওয়াও বৈধ। এ জন্য উন্নত মানের ঘোড়া, অস্ত্রসহ সমরসামগ্রী কেনা যেতে পারে। এক্ষেত্রে তোমরা আর জনসাধারণ একই বরাবর। ফৌজদের কাছে কোন রসদ না থাকায় তা জনসাধারণের কাছ থেকে সম্পদ গ্রহণ করায় কোন ক্ষতি নেই।”

এর কয়েকদিন পর আমীর সাইফুদ্দিন ওলামাদের কাছে বললো, “এ মুহূর্তে বাদশাহ তো শিশু হয়ে আছেন। তাছাড়া তিনি খুবই লজ্জাশীলও। ফলে এখন একজন সাহসী ও নির্ভীক বাদশাহ’র তখতে আরোহণ করা প্রয়োজন, যিনি জিহাদ করবেন।” আমীর সাইফুদ্দীনই অবশেষে বাদশাহ মনোনীত হয়। সে আল মুলকুল মুযাফফর উপাধি ধারণ করে।

৬৫৮ হিজরির শুরু দিকে কোন খলীফা নির্ধারিত হয়নি। তাতাররা ফোরাত নদী পাড়ি দিয়ে হলব শহরে এসে ব্যাপক গণহত্যা চালায়। এরপর তারা দামেশকে যায়। এদিকে তাতারিদের মোকাবিলা করার জন্য শাবান মাসে মিসরী সৈন্যরা এগিয়ে গেলে আল মূলকুল মুযাফফরও সসৈন্যে এগিয়ে যায়। তার সিপাহ সালারের নাম রুকনদ্দীন বিবরস। সে সময় তাতারিরা জালুত নদীর উপর ছিল। ৬৫৮ হিজরির রমযান মাসের পনেরো তারিখ শুক্রবারে উভয় বাহিনীতে তুমুল লড়াই হয়। এতে তাতারিরা পরাজিত আর মুসলমানগণ বিজিত হয়। এ যুদ্ধে অনেক তাতার সৈন্য নিহত হয়। আর বাকিরা পালিয়ে গিয়ে জীবন রক্ষা করে। আল মুযাফফর দামেশকে অবস্থান করছিলেন। তার কাছে এ বিজয় সংবাদ পৌঁছানো হয়, জনতার দল আনন্দে নেচে উঠে। লোকেরা মুযাফফরের জন্য দুয়া করে আর তাকে ভালবাসতে থাকে। সিপাহসালার রুকনুদ্দিন বিবরস তাতারিদের পসচাদ্ধাবন করে। তাদেরকে হলব ইত্যাদি শহর থেকে বের করে না দেওয়া পর্যন্ত মুসলিম সিপাহসালার তাদের ধাওয়া করতেই থাকে।

সুলতান মুযাফফর রুকনুদ্দিন বিবরসকে এ বিজয় ছিনিয়ে আনার জন্য হলব শহর প্রদানের ওয়াদা করেছিলো, কিন্তু কার্যসিদ্ধির পর নিয়্যত পরিবর্তন হয়। এ খবর বিবরস জানার পর তার ব্যথিত হওয়ার বিষয়টি অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাতারিদের অবশিষ্টাংশ উৎখাত করার জন্য মুযাফফর হলবে যায়। সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের ফলে বিবরসের বিষণ্ণতা আর তার বিরুদ্ধাচরণের কথা জানোতে পেরে সে পথ পরিবর্তন করে মিসরে চলে যায় আর খুবই গোপনভাবে বিবরসের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে লাগে। এদিকে বিবরসও মিসরে আসে। উভয়ে নিজ নিজ হিতাকাঙ্ক্ষীদের সাথে পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে থাকে।

অবশেষে ৬৫৮ হিজরির যিলকদ মাসের ষোলো তারিখে আমীর উমারাদের সমর্থন নিয়ে বিবরস মুযাফফরকে হত্যা করে। সে আল মুলকুল কাহির উপাধি ধারণ করে তখতে আরোহণ করে। মুযাফফর তার শাসনামলে যে অত্যাচার করেছে, সে তার অবসান ঘটায়। সে যীনুল মিল্লাত ওয়া দ্বীন ইবনে যুবাইরকে উযির মনোনীত করে। সুযোগ বুঝে উযির একদিন বিবরসকে বললো, “আল কাহির উপাধি ধারণকারী কোন বাদশাহ সফলকাম হয়নি, তাই এ উপাধি পরিবর্তন করাই শ্রেয়। দেখুন, আল কাহির বিন আল মুতাযদ এ উপাধি ধারণ করেছিলো। কিছুদিন পর তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে তার চোখ দুটো উপড়ে ফেলা হয়। মৌসুলের শাসনকর্তাও আল কাহির উপাধি ধারণ করেছিলো, তাকেও বিষ খাওয়ানো হয়।” এ কথা শুনে সে কাহির উপাধির পরিবর্তে যাহির উপাধি ধারণ করে।

বর্ষপরিক্রমায় ৬৫৯ হিজরি আসে। পৃথিবীতে তখনো কোন খলীফা ছিল না। রযব মাস পর্যন্ত দুনিয়ায় খলীফার শাসন মুক্ত ছিল। অবশেষে সাড়ে তিন বছর পর খিলাফত ব্যবস্থা শূন্য থাকার পর মিসরে মুসতানসিরের খিলাফত কায়েম হয়। এর বিবরণ আমরা সামনে পেশ করবো।

খলীফা মুসতাসিমের শাসনামলে যেসকল ওলামায়ে কেরামগণ ইন্তেকাল করেন তারা হলেন – হাফেজ তাকিউদ্দিন সারিফীনী, হাফেজ আবুল কাসিম বিন আল তায়লিসান, হানাফি মাযহাবের সম্মানিত ব্যক্তিত্ব শামসুল আইম্মা আল কুর্দি, শায়খ তকিউদ্দিন বিন সালাহ, ভাশাবিদ ও ঐতিহাসিক হাফেজ মুহিবুদ্দিন বিন বুখার, মুনতাখিবুদ্দীন, নাহুদিব ইবনে ইআইশ, দানশীল আবুল হুজ্জাজ আল আকসারী, নাহুবি আবু আলী সারবিনী, ইবনে বায়তার, ইমাম আল্লামা জালালুদ্দীন আল হাজিব, আবুল হাসান বিন দিবাহ, তারিখুল নুহাত গ্রন্থকার কাফীতী, আফযালুদ্দীন, হাফেজ ইউসুফ বিন খলীল, বাহার বিনতুল হুমায়রী, জামাল বিন উমরাওয়ান, গ্রন্থকার রেজা, মাআনী, বয়ান, ইযাযুল কুরআন প্রভৃতি গ্রন্থের লেখক কামাল আবদুল ওহেদ যিমলেকারী, মজদ বিন তাইমিয়া, মারাতুস যামান বইয়ের লেখক ইউসুফ সবত ইবনে জাওযী ইবনে বাতিশ শাফী, সাহেবে তাফসীর আবুল ফজল আল মরসী প্রমুখ।

খিলাফত শূন্য সময়ের মধ্যে যারা ইন্তেকাল করেন তারা হলেন – যাকী আবদুল আযীম আল মুনসারী, শায়খ আবুল হাসান শাযলী, শায়খ তয়েফা, শুবাতুল মাকরী, আশ শাতিবা গ্রন্থের ব্যাখ্যাকার ফাসী, কবি সাদুদ্দীন, কবি সরসরী, স্পেনের ঐতিহাসিক ইবনুল আবার প্রমুখ।