আল হাকিম বি আমরিল্লাহ আবুল আব্বাস

আল হাকিম বি আমরিল্লাহ আবুল আব্বাস আহমাদ বিন আবু আলী হোসেন আবকী বিন আলী বিন আবু বকর বিন খলীফা মুসতারশিদ বিল্লাহ বিন মুসতাযহার বিল্লাহ।

বাগদাদে হত্যাযজ্ঞের সময় আত্মগোপনের কারণে তিনি প্রানে রক্ষা পান। তিনি এক দল লোক নিয়ে বাগদাদ থেকে বনু খিফাজা গোত্রের আমীর হুসাইন বিন ফালাহ’র কাছে চলে যান। তার কাছে কিছুদিন থেকে আরবীদের সাথে দামেশকে আমীর ঈসা বিন মাহনার কাছে যান। দামেশকের শাসনকর্তা আন নাসর তাকে ডেকে পাঠায়। তিনি তখনো যাননি। এরই মধ্যে তাতাররা আক্রমণ করে। আল মুলকুল মুযাফফর দামেশকে তাতারিদের সাথে লড়াই শেষে আমীর ফালাজ বাগদাদীর হাতে আবার তাকে দামেশকে ডেকে পাঠায়। জনসাধারণ তার হাতে বাইয়াত প্রদান করে। আরবের এক দল উমারা তাকে সমর্থন জানায়। তিনি তাদের সহচরত্বে ঘানা, হাদীসা, হাইবত, আনবার প্রভৃতি শহর দখল করেন। এরপর তাতারিদের সাথে লড়াই করে বিজয় ছিনিয়ে আনেন।

এরপর মূলকুয জাহেরের আহবান সম্বলিত দামেশকের নায়েব আলাউদ্দিন তোবায়রিসের চিঠি তার কাছে পৌঁছে। অবশেষে সফর মাসে তিনি দামেশকে পৌঁছলে দামেশকের নায়েব আলাউদ্দিন তাকে সুলতান আল মূলকুয যাহিরের কাছে পাঠিয়ে দেয়। তিনি কায়রোতে পৌঁছার তিনদিন পূর্বেই সেখানে মুসতানসিরের বাইয়াত সম্পন্ন হয়। এজন্য তিনি বন্দী হওয়ার আশংকায় হলবে ফিরে যান। হলবে সেখানকার শাসনকর্তা আর সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ তাকে বাইয়াত দেন। বাইয়াতকারীদের মধ্যে ছিলেন আবদুল হালিম বিন তাইমিয়া। বাইয়াতকারীদের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে।

তিনি ঘানায় যান। মুসতানসির ঘানায় গেলে তিনি তার আনুগত্য গ্রহণ করেন। মুসতানসির তাতারিদের সাথে যুদ্ধে নিখোঁজ হওয়ায় রুহবার প্রশাসক ঈসা বিন মাহনার কাছে যান। সেখান থেকে আল মূলকুয যাহির বিবরস তাকে ডেকে পাঠায়। তিনি নিজ সন্তানদের সাথে একদলসহ কায়রোতে পৌঁছান। যাহির তাকে খুবই সমাদর করে আর তার কাছে খিলাফতের বাইয়াত করে। যাহির দুর্গের শিখরে আরোহণ করে। তিনি সেখানে কয়েকবার খুৎবা দেন।

শায়খ কুতুবুদ্দিন বলেন, ৬৬১ হিজরির মুহাররম মাসের আট তারিখ বৃহস্পতিবারে সুলতান একটি আম মজলিশের ইন্তেজাম করে। হামিক বি আমরিল্লাহ কিলআতুল জাবালের বড় প্রাসাদে গিয়ে সুলতানের সাথে উপবেশন করেন। সুলতান তার সম্মানে যমীন চুম্বন করে আর বাইয়াত করে। খলীফা সুলতানকে খিলাআত প্রদান করায় তার লোকেরা একের পর এক বাইয়াত করতে থাকে। পরের দিন জুমায় তিনি খুৎবা পাঠ করেন। হামদ আর সালাতের পর জিহাদ ও ইমামতের গুরুত্ব তুলে ধরে খিলাফতের বেইজ্জতির কথা মনে করিয়ে দেন। তিনি খুৎবায় এভাবে আল্লাহ’র প্রশংসা করেন – “সেই প্রতিপালকের প্রশংসা, যিনি বনু আব্বাসের সাহায্যকারী।” খুৎবা শেষে তার বাইয়াতের ঘোষণা দেওয়া হয়।

৬৬১ হিজরিতে এ ঘটনার পর তাতারিরা ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। আশ্রয়কারী হয়ে তারা মুসলিম সাম্রাজ্যে নীরবতার সাথে বসবাস করতে থাকে। তাদের জন্য ভাতা নির্ধারণ করা হয়। এভাবে তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি কমতে থাকে।

৬৬২ হিজরিতে কাসরিয়ীন শহরে মাদরাসা যাহিরিয়া নির্মিত হয়। শাফী মাযহাবের ফিকাহশাস্ত্র শিক্ষাদানের জন্য তাকী বিন যারির আর হাদিসের শিক্ষক হিসেবে শরফ দিময়াতীকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ বছর মিসরে শক্ত ভুমিকম্প হয়।

৬৬৩ হিজরিতে স্পেনের বাদশাহ সুলতানুল মুসলিমীন আবু আবদুল্লাহ বিন আল আহমর ফিরিঙ্গীদের পরাজিত করে বাতিস শহর ছিনিয়ে নেন। এ বছর কায়রো শহরের বিভিন্ন ভবনে অগ্নিসংযোগ হয়। এ বছর সুলতান উমারাদের সাথে নিয়ে আশমুন সাগর খনন কাজে স্বশরীরে অংশগ্রহণ করেন। এ বছর তাতারিদের সর্দার হালাকু খান মারা যায়। তার স্থানে তার ছেলে আবগা বাদশাহ হয়। এ বছর সুলতান তার চার বছরের পুত্র সন্তান মূলক আল সাইদকে উত্তরাধিকার মনোনীত করে। এ বছর মিসরে প্রত্যেক মাযহাবের চার বিচারক নিয়োগ করা হয়। এ বছর রমযান মাসে সুলতান খলীফাকে পর্দার আড়ালে রাখে।

৬৫৫ হিজরিতে হাসিনাহ শহরে সুলতান একটি জামে মসজিদ নির্মাণের নির্দেশ দেন। ৬৬৭ হিজরিতে নির্মাণ কাজ শেষ হয়। এ মসজিদে হানাফী মাযহাবের খতীব নিয়োগ পান।

৬৭৪ হিজরিতে সুলতান নূবা এবং দানকিলা যুদ্ধের মাধ্যমে জয় করে নূবার বাদশাহকে যাহিরের সামনে হাজির করা হয়, আর দানকিলার অধিবাসীদের উপর যিজিয়া কর আরোপ করা হয়।

যাহাবি বলেছেনঃ ৩৩ হিজরিতে সর্বপ্রথম আবদুল্লাহ বিন আবু সুরাহ পাঁচ হাজার ঘোড় সওয়ার নিয়ে নূবা আক্রমণ করেও বিজয় ছিনিয়ে আনতে না পেরে সন্ধি করেন। এরপর হিশামের যুগেও হামলা চালানো হয়, কিন্তু বিজয় আসেনি। এরপর যথাক্রমে মানসুর, নাসিরুদ্দৌলা বিন হামদান আর সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ুবির ভাই তুরান শাহ ৫৬৮ হিজরিতে লড়াই করেও বিজয়মাল্য পড়তে পারেনি। আর তা এ বছর বিজিত হয়। এ বিজয়কে নিয়ে ইবনে আব্দুয যাহির একটি কবিতা লিখেছেন যার অর্থ হল – “এটা এমন এক বিজয়, যা কখনো শুনিনি, দেখিনি আর লোকেরাও এর বিবরণ দেয়নি।”

৬৭৬ হিজরির মুহাররম মাসে সুলতান মুলকুয যাহির ইন্তেকাল করে। তার স্থানে ১৮ বছর বয়সে তার ছেলে সাইদ মুহাম্মাদ উপবেশন করে। এ বছর তাকি বিন রাযি মিসর আর কায়রো উভয় শহরের বিচারপতি মনোনীত হোন। এর আগে শহর দুটোতে পৃথক পৃথক বিচারপতি ছিলেন।

৬৭৮ হিজরিতে সাইদ মুহাম্মাদকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় আর সে এ বছর বজ্রপাতে মারা যায়। তার স্থানে তার ভাই বদরুদ্দিন শালামাশ সুলতান হয়ে মিসরে সাত বছর দায়িত্ব পালন করে। তার উপাধি ছিল মূলকুল আদেল। আমীর সাইফুদ্দীন কালাদুন (কালদুয) তার অভিভাবকত্বের দায়ভার গ্রহণ করে। দুদিকে দুজনের নাম খোদিত মুদ্রা চালু হয়। খুৎবায় দুজনের নাম পাঠ করা হয়। রযব মাসে শালামাশকে সরিয়ে কালাদুন আর মুলকুন মানসুর উপাধি নিয়ে একচ্ছত্র বাদশাহ হয়ে যায়।

৬৭৯ হিজরিতে আরাফার দিন শিলা ও বজ্রপাত হয়।

৬৮০ হিজরিতে তাতারিরা সিরিয়ায় এসে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করলে সুলতান তাদের সাথে যুদ্ধ করলে মুসলমানরা বিজিত হয়।

মুয়াবিয়া (রাঃ) এর শাসনামলে তারাবালাস শহর বিজিত হয়। ৫০৩ হিজরিতে খ্রিস্টানরা তা ছিনিয়ে নেয়। ৬৮৮ হিজরিতে তা আবার পুনঃদখল হয়।

৬৮৯ হিজরির যিলকদ মাসে সুলতান কালাদুনের ইন্তেকাল হয়। তার স্থানে তার ছেলে আল মুলকুল আশরাফ সালাহুদ্দীন খলীল সুলতান হয়।

৬৯১ হিজরিতে সুলতান রোমের দুর্গ অবরোধ করে।

৬৯৩ হিজরিতে সুলতান নিহত হয়। তার ভাই মুহাম্মাদ বিন মানসুর নয় বছর বয়সে আল মূলকুন নাসর উপাধি নিয়ে ক্ষমতায় আরোহণ করে।

৬৯৪ হিজরিতে মুহাররম মাসে তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে কিতবাগা আল মানসুর মুলকুল আদেল লকব ধারণ করে তখতে উপবেশন করে। এ বছর তাতারিদের বাদশাহ ফাযান বিন আওগুন বিন আব-না বিন হালাকু খান ইসলাম গ্রহণ করায় মুসলমানরা খুশী হয় আর তার সৈন্যদের মাঝে ইসলাম ছড়িয়ে পড়ে।

৬৯২ হিজরিতে সুলতান মুলকুল আদেল দামেশক গেলে সফর মাসে লাজীন জবরদস্তীমূলক আমীর-উমারাদের থেকে আনুগত্যের শপথ আদায় করে। খলীফা তাকে খিলআত প্রদান করেন। মুলকুন আদেল সরহদে পালিয়ে যায়।

অবশেষে ৬৯৮ হিজরিতে লাজীন নিহত হয়। এরপর ক্ষমতাচ্যুত মুলকুন নাসর মুহাম্মাদ বিন মানসুর কালাদুন আবার সুলতান হয়। খলীফা তাকেও খিলআত প্রদান করেন। আর আল মুলকুল আদেল নায়েবে সালতানাত হয়ে হাম্মাত শহরে যান। সে মৃত্যু অবধি ৭০২ হিজরি পর্যন্ত সেখানেই ছিল।

৭০১ হিজরির জামাদিউল আউয়াল মাসের ১৮ তারিখ জুমআর রাতে খলীফা হাকিম বি আমরিল্লাহ ইন্তেকাল করেন। আল্লাহ তার উপর রহম করুন। আসরের সময় দুর্গের নিচে সওকে খায়েল এ তার জানাযার নামায পড়ানো হয়। খলীফার আত্মীয় স্বজন আর সাম্রাজ্যের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাবৃন্দ রক্ষী-প্রহরীসহ জানাযার নামাযে শরীক হোন। তাকে সাইয়েদাহ নাফীসার কাছে সমাহিত করা হয়। তিনি প্রথম খলীফা, যাকে সর্বপ্রথম এখানে দাফন করা হয়েছিলো। তখন থেকে আজ পর্যন্ত তার বংশধরকে এখানেই দাফন করা হয়।

খলীফা হাকিম তার শাসনামলে নিজের পুত্র আবু রবিয়া সুলায়মানকে উত্তরাধিকার মনোনীত করেছিলেন।

তার যুগে যেসব ওলামাগণ ইন্তেকাল করেন তারা হলেন – শায়খ আযুদ্দীন বিন আব্দুস সালাম, দানশীল আবু কাসিম কুবারী, যীন খালিদ নাবলুসী, হাফেজ আবু বকর বিন সুদ্দী, ইমাম আবু শামা, তাজ বিন বিনতুল আ-আয, আবুল হাসান বিন আদলান, মজদ্দীন বিন দাকিকুল ঈদ, নাহুবিদ আবুল হাসান বিন আসফুর, আব্দুর রহীম বিন ইউনুস, বিখ্যাত মুফাসসীর (সাহেবে তাফসীর) আল্লামা কুরতুবি, শায়খ জালালুদ্দীন বিন মালিক, তার ছেলে বদরুদ্দীন, দর্শন জগতের সম্রাট তাসির তুসী, শায়খ মহিউদ্দিন নূরী, হানাফী ইমাম সুলায়মান, বুরহান বিন জামাআত, ঐতিহাসিক তাজ বিন মায়াসসার, মুফাসসির কাওয়াশী, নাহুবিদ ইবনে ইয়াদ আবদুল হালিম বিন তাইমিয়া, ইবনে জাওয়ান, নাসিরুদ্দিন ইন মুনির, ইলমুল কালাম (অলংকার শাস্ত্রের) রূপকার নজম বিন বারযী বুরহানুল নফসী, রেযা শাতবী, জামাল শুয়াইশী, কবি আফীফ, তাজ বিন ফুররাহ, যায়েদ বিন মুরহিল, মুহিব তবরী, রেযা কাসতানতিনী প্রমুখ।