মানযিকার্টের যুদ্ধ

আজ শুক্রবার। পবিত্র জুমআর দিন। জুম্মার সালাত শেষ করে কেউ ঘরের উদ্দেশ্যে পথ ধরেছে, কেউ দুনিয়াবি কাজকর্ম একপাশে রেখে এই নির্মল সময়ে নিজের সমস্ত প্রয়োজন আল্লাহর দরবারে চেয়ে নিচ্ছে। হাজার বছর আগের এমন এক শুক্রবার। 

জিলক্বদ মাস, ১০৭১ সাল (হিজরি ৪৬৩)। মানযিকার্টের ময়দানে জুমআর নামাজ শেষ করে তপ্ত দুপুরে ১৫ হাজার সৈন্যের এক ক্ষুদ্র বাহিনী আল্লাহর দরবারে হাত উত্তোলন করে দোয়া করছে। সেনাপ্রধান কান্নাকাটি করছে, সঙ্গে সকল সৈন্যও। সৈন্যদের ক্রন্দনের গুঞ্জনে মুখরিত মানযিকার্টের আকাশ-বাতাস। একটাই চাওয়া, আল্লাহর শত্রুদের বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করা। সেনাপ্রধানের নাম মুহাম্মাদ বিন চাগরি বেগ। ইতিহাসে যিনি আল্প আরসালান নামেই অধিক পরিচিত। তিনি ছিলেন সালজুক সালতানাতের তৃতীয় সুলতান। যাকে ঐতিহাসিকরা সালজুকের শ্রেষ্ঠ শাসক হিসেবে অবহিত করেন। (১)

মানযিকার্ট ছিল আর্মেনিয়া, রোম (বর্তমান তুরস্ক) ও আলজাযীরা সীমান্তে অবস্থিত। পূর্বে ১০৪৮ সনে এই অঞ্চল বাইজেন্টাইনদের হাত থেকে বিজয় করেছিলেন সালজুক সাম্রাজ্যের মূল রূপকার তুগরীল বেগ। তিনি ঐ সময় বাইজেন্টাইনদের থেকে আজারবাইজান, আর্মেনিয়া ও আনাতোলিয়ার বিশাল অংশ জয় করেন। তুগরীল বেগের মৃত্যুর পর তার ভ্রাতুষ্পুত্র আল্প আরসালান কিছু অঞ্চল বিজয় করেন। অব্যাহত এসব পরাজয় রোমানদের চোখ খুলে দেয়।

বাইজেন্টাইন সম্রাট ধেয়ে আসা এই ঝড়ের ব্যপারে নিশ্চিন্ত আর বসে থাকতে পারছিল না। কখন হয়তো সালজুকরা সরাসরি কনস্টান্টিনোপলে আঘাত হানে! সেই ভয়ে চিরকালের জন্য তাদেরকে দুনিয়া থেকে উচ্ছেদ করার জন্য স্বয়ং বাইজেন্টাইন সম্রাট রোমানস ডিয়োজেনেস প্রায় তিন লক্ষ সৈন্যের বিশাল এক সেনাবহর নিয়ে আনাতোলিয়া তছনছ করে আর্মেনিয়ার ভন লেকের উত্তরে মুরাট নদীর তীরবর্তী মানযিকার্ট এসে উপনীত হয়। (২) তার সেনাবাহিনীতে ছিল ফ্রান্স, নরমান ও কুমান সেনাদল।

আল্প আরসালান তখন হালবের (আলেপ্পো) ফাতেমি শাসক মাহমুদ ইবনে সালেহ থেকে হালব বিজয় করে আজারবাইজানের খুবী শহরে প্রত্যাবর্তন করেন। এমন সময় শত্রু ঘাড়ের উপর এসে আকস্মিক হামলার কথা শুনে সুলতান অল্পক্ষণের জন্য কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যান। কিন্তু তিনি কিছু সময় পরেই বীরত্বের আবেগে উদ্দীপিত হয়ে উঠলেন। হাতে তখন বেশি সৈন্য ছিল না। যদি বৃহৎ সৈন্য ও যুদ্ধ সামগ্রী আসার অপেক্ষায় বসে থাকা হয় তাহলে শত্রুর সাফল্যলাভের সাম্ভবনা অধিক বৃদ্ধি পাবে। তাই তিনি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিলেন এবং সৈন্যদেরকে প্রস্তুতি নিতে বললেন। সুলতান আসার পূর্বে আমীর-উমারাদের অসিয়ত করলেন, যদি আমি বিজয় লাভ করি তাহলে আল্লাহর মেহেরবানী আর যদি মৃত্যু বরণ করি তাহলে আমার পুত্র মালিক শাহ আমার স্থলাভিষিক্ত হবে।

অত:পর সুলতান হাতে থাকা পনের হাজার সৈন্য নিয়ে ১০৭১ খ্রীস্টাব্দের জিলক্বদ মাসের শেষ দশকের বৃহস্পতিবার মানযিকার্টের প্রান্তরে এসে উপস্থিত হন। বাইজেন্টাইন বাহিনীর অবস্থান থেকে দুই ক্রোশ দূরে তাবু স্থাপন করেন। সুলতান প্রথমে বাইজেন্টাইন সম্রাটের কাছে সন্ধির প্রস্তাব পাঠান। কিন্তু সম্রাট অহংকারের বশবর্তী হয়ে সুলতানকে জবান দেন-
“যদি সেই বন্য পশু সন্ধির জন্য লালায়িত হয়ে থাকে, তাহলে সততার প্রমাণস্বরূপ নিজের শহর রায় ও নিজের রাজপ্রাসাদ আমাদের হাতে তুলে দিক।” (৩)

ফলে এ জবাবের পর যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠে। তৎক্ষনাৎ সুলতান যুদ্ধের জন্য নিজ তাবু থেকে বেরিয়ে আসেন। বাহিনীকে প্রস্তুতি নিতে বলেন। সুলতানের সাথে ছিলেন প্রসিদ্ধ ফকিহ আবু নাসর মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল মালেক বুখারী হানাফি। তিনি পরামর্শ দেন, আজ যুদ্ধ মুলতবি রাখুন, আগামীকাল জুমআর দিন সেসময় সারা দুনিয়ায় মুসলমান নামাজ শেষ করে আপনার সাহায্যের জন্য দোয়া করবে, যাতে আল্লাহর বান্দাদের দোয়া মুজাহিদদের তরবারির সহযোগী হয়। সুলতান এই পরামর্শ গ্রহণ করলেন এবং জুমআর জন্য যুদ্ধ স্থগিত রাখলেন।

দোয়া শেষে সালজুক মুজাহিদ বাহিনী যুদ্ধের জন্য মূর্তির মতো সারিবদ্ধ হয়। অপরদিকে বিশাল সেনাবহর নিয়ে বাইজেন্টাইনরা। আর তখনই সালজুকের সাহসী সুলতান সুসজ্জিত কালো ঘোড়ায় বজ্রের গতিতে ছুটিয়ে বাহিনীর সম্মুখ এসে দাড়ালেন। সেনাদের উদ্দেশ্যে উচ্চস্বরে বললেন- যারা শাহাদাৎ কামনা করে তারা থেকে যাক আর যারা ফিরে যেতে চায় তারা ফিরে যাক। কারণ এখান আর এখানে কেউ সুলতান বা বাদশাহ নয়। আজ অবধি সুলতানের সেই ছোট ভাষন ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখিত আছে। সুলতান খাপমুক্ত করে হাতে তলোয়ার নিলেন, নিজ হাতে ঘোড়ার লেজ বাঁধলেন, ধবধবে সাদা পোশাক পরে সুগন্ধি মেখে বললেন, আমি যদি শহীদ হয়ে যাই, তাহলে এটি হবে আমার কাফন। তার এই উক্তিতে সমস্ত সৈনিকের অন্তরে বীরত্বের আবেগ ও শাহাদাতের আকাঙ্ক্ষায় উদ্দীপ্ত হয়ে উঠে।

শত্রু বাহিনীর মুখোমুখি হওয়ার সময় সুলতান আল্লাহকে স্বরণ করলেন, যার উপর ভরসা করে তিনি তার চেয়ে দশগুণ সৈন্যের মোকাবিলা করতে এসেছেন। সুলতান বাহিনীকে আক্রমণ করার নির্দেশ দিবেন তখনই যুদ্ধের বাতাসের দিক পরিবর্তন হয়ে যায়। বাইজেন্টাইন বাহিনীর কুমান সৈন্যদল যারা মূলত ভাড়াটে সৈনিক ছিল তারা দলত্যাগ করে সালজুক বাহিনীতে যোগ দেয়। বাইজেন্টাইনদের এমন বিক্ষিপ্ত অবস্থার সুযোগে সুলতান বিদ্যুৎ গতিতে হামলা করলেন। এমন সময় ফান্স ও নর্মান সৈন্যরাও পালিয়ে যায়। প্রথম আক্রমণেই রোমান জেনারেল বাসিলাসিয়ান পরাজিত হয়ে পশ্চাদপসরণ করে। তার পাশেই ছিল মালদাভিয়া উজি অশ্বারোহী বাহিনী। সুলতানের বাহিনীর তুমুল আক্রমণে গোটা ব্যুহই তছনছ হয়ে গেলো।

বাকি সৈন্যরা যুদ্ধক্ষেত্রে সালজুক বাহিনীর হাতে কচুকাটা হলো। ময়দানে ঘোড়ার হ্রেষা ধ্বনি আর সৈনিকদের টুকরো টুকরো লাশ ব্যতীত কিছুই ছিল না। সম্রাট রোমানোস বন্দি হলো। তাকে সুলতানের সামনে অবনতমস্তকে নিয়ে আসা হলে আল্প আরসালান প্রশ্ন করেন, যদি আমাকে বন্দি করা হতো তাহলে আপনি কি করতেন? রোমানোস বললো, হয়তো আমি আপনাকে হত্যা করতাম কিংবা কনস্টান্টিনোপলের রাস্তায় ঘুরিয়ে প্রদর্শন করাতাম। সুলতান বললেন, এখনতো আমি তোমার খারাপ উদ্দেশ্য জেনে নিলাম, তাই আমার উচিৎ তোমার সাথে এরূপ আচরণ করা। রোমানোস বললো, আমার বদনিয়তের পরিনতি দেখতেই পাচ্ছেন। অতঃপর সুলতান সন্ধির মাধ্যমে তাকে ক্ষমা করে দেয়। (৪) তার এই মহানুভবতার কথা ওরিয়েন্টালিস্টরা আজও স্বীকার করতে বাধ্য হয়।

এ যুদ্ধে সালজুক সালতানাতের সীমানা সম্প্রসারিত হয়নি তবে এদিকটি ছাড়া অন্য বহুবিধ কল্যাণ লাভ ও সুযোগ সুবিধা অর্জিত হয়েছে। গনিমতের যে মাল হস্তগত হয় তার বিপুলতার অনুমান এথেকেই করা যেতে পারে, পরিবহনের গাড়িই ছিল তিন হাজার। এ সব বস্তুগত লাভ ছাড়াও ইসলামী দুনিয়ায় সালতানাতের যে সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয় ও চিরকালের জন্য বাইজেন্টাইনদের ভিত নড়বড়ে করে দেয় এবং আনাতোলিয়ার তুর্কিদের পশ্চিমে অগ্রযাত্রায় সহজ হয় তার মূল্য অপরিসীম।


তথ্যসূত্রঃ
১. যুবদাতুন নুসরা ১/৪৩, ইবনে খালেদ (মৃত্যু: ৫১৯ হিজরি) লাইডেন।
২. আল মুখতাসার ২/১৮৫, আবুল ফিদা (মৃত্যু: ৭৩২ হিজরি)
৩. আল কামিল ফিত তারীখ ১০/২৮, হাফেজ ইবনে আসির (মৃত্যু: ৬৩০ হিজরি)
৪. প্রাগুক্ত ১০/৪৪ পৃষ্ঠা।


আহমাদ উসমান