পরকালের পথে যাত্রা – পর্ব ০১ – মৃত্যু

আলহামদুলিল্লাহ, ওয়াস সালাতু ওয়াস সালাম আলা সাইয়িদিনা মুহাম্মাদ ওয়া আ’লা আলিহি ওয়া সাহাবিহি ওয়া সাল্লাম

আমরা, মানব জাতি দুনিয়াতে এমন একটা ধারণা নিয়ে বেঁচে থাকি যে, এই দুনিয়াটা আমাদের। এটাই আমাদের থাকার স্থান, ঘরবাড়ি, এখানে আছি, থাকব, যেন এটা আমাদের চির আবাসস্থল। কিন্তু যে বাস্তবতা আমরা জানি না, বা জানতে চাই না, যে, আমরা এক ট্রেনে ভ্রমণ করছি, যে ট্রেনটা একটা একটা করে স্টেশন পার হয়ে সর্বশেষ একটি গন্তব্যের দিকে যাচ্ছে। আর এই দুনিয়ার জীবন হচ্ছে এমনই একটা স্টেশনের শুরু মাত্র। 

কিন্তু আমরা এই দুনিয়ার নই, বা দুনিয়াটাও আমাদের নয়। 
আমাদের হাতে যেন একটি টিকেট আছে, যেটার তিনটি অংশ আছে। আমরা মায়ের গর্ভে নয় মাস অবস্থান করি, তারপর সে টিকেটের একটা অংশ ছিড়ে ফেলা হয়। এরপর আমরা এই দুনিয়ার জীবনে প্রবেশ করি, আমাদের নতুন স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু হয়, আর এরপর যখন আমরা মারা যাই, তখন টিকেটের দ্বিতীয় অংশটুকু ছিড়ে ফেলা হয়। আমাদের হাতে থেকে যায় টিকেটের শেষ অংশটুকু, জান্নাত বা জাহান্নামের প্রবেশ করার সাথে শেষ অংশটুকুও ছিড়ে ফেলা হবে, আর সেটাই হবে আমাদের চূড়ান্ত গন্তব্যস্থল।

আমরা, এই দুনিয়ার চিরস্থায়ী বাসিন্দা না, এই দুনিয়া কেবলই আমাদের দীর্ঘ সফরের একটা ক্ষুদ্র অংশ মাত্র, তাই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, এই দুনিয়াতে এমনভাবে বেঁচে থাক যেন তুমি একজন মুসাফির। 

তিনি দুনিয়ার জীবনের বাস্তবতাকে আরও ভালোভাবে তুলে ধরতে তুলনা করে বলেছেন,যে, ধর, একটা মানুষ মরুভূমির পথ ধরে যাচ্ছে, এবং সে দেখল একটা গাছ, সেটা দেখে তার ছায়ার নিচে বসল, বিশ্রাম নিল এবং আবার তার অসম্পূর্ণ সফর সম্পন্ন করতে পুনরায় চলতে শুরু করল, এটাই হল দুনিয়া।” 

পার্থিব জীবন ঐ পথিকের ন্যায়, যে গ্রীষ্মে রৌদ্রজ্জ্বল তাপদগ্ধ দিনে যাত্রা আরম্ভ করল, অতঃপর দিনের ক্লান্তময় কিছু সময় একটি গাছের নীচে বিশ্রাম নিল, ক্ষণিক পরেই তা ত্যাগ করে পুনরায় যাত্রা আরম্ভ করল।

আমরা গাছটার নিচে অল্প কয়টা মূহূর্ত ব্যয় করছি এবং এরপর আবার আগের যাত্রা। সময়ের এই পথ চলা, আমাদের জীবনের, আমাদের অস্তিত্বের ক্ষয় ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রতিটি সেকেন্ডের সাথে সাথে আমাদের অস্তিত্ব ক্রমেই নিঃশেষ হচ্ছে। এই বাস্তবতা আমাদেরকে বিশ্বাস করতে হবে, যে, আমরা এখানকার কেউ নেই, আর তাই আমাদের প্রস্তুত হতে হবে মৃত্যুর জন্য। 

আর এই বিষয়টি নিয়ে আল্লাহর ইচ্ছায় আমরা শুরু করতে যাচ্ছি আমাদের লেকচার সিরিজ, আলআখিরাহ বা “পরকালের পথে যাত্রা”

কেন আমরা এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলব ? আমাদের অবশ্যই প্রতিটি কাজের পিছনে আমাদের উদ্দেশ্য জানতে হবে।

১ নম্বর হচ্ছে, আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস ঈমানের একটি শাখা। 
এটা বিশ্বাসের একটি স্তম্ভ, আমরা পড়েছি, ”ওয়া তু’মিনুনা বিল ইয়াওমিল আখিরা  আখিরাতের জীবনের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা।

২ নম্বর কারণ নিয়ে বলতে গেলে আমাদের ভাবতে হবে, আমাদের চারপাশে কেন এত এত সমস্যা? কেন একজন মুসলিম মদপান করে ? বা কেন বা ব্যাভিচার করবে ? বা সুদের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করবে? মিথ্যে বলবে? কেন? আমাদের সমস্যাটা কোথায়?

ভাল করে খেয়াল করুন, আয়েশা (রাঃ) এর একটি কথা। উনার একটি কথা, 
এই একটি কথাতেই, আমাদের ব্যাক্তিগত এবং সামাজিক জীবনের পরিবর্তনের একটা ইশতেহার বা প্রোগ্রাম দেয়া আছে। তার এই একটি কথা যদি আমরা মেনে চলি, তাহলে আমরা আমাদের জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন দেখতে পাব।
 সায়্যিদিনা আইশা বলেন, যদি কুরআনে এই আয়াতটা সর্বপ্রথম নাযিল হত, যে, “তোমরা মদ খেও না”, তাহলে লোকে বলত, “আমরা কখনও মদ খাওয়া ছাড়ব না”, যদি সর্বপ্রথম এই আয়াত নাযিল হত যে তোমরা যিনাব্যাভিচারে লিপ্ত হোয়ো না, তাহলে লোকে বলত, “আমরা কখনই যিনাব্যভিচার থেকে বিরত হব না। কিন্তু কুরআনে সবার আগে যে জিনিষটির কথা বলা হয়েছে তা হল জান্নাত এবং জাহান্নাম, আর যতক্ষণ না পর্যন্ত লোকেদের হৃদয় আল্লাহর প্রতি নত হয়েছে, আকৃষ্ট হয়েছে, তার পর এসেছে হালাল এবং হারামের হুকুমগুলো।

খেয়াল করে দেখবেন, আইন-কানুন সংক্রান্ত আয়াত মক্কী জীবনে খুব একটা নাযিল হয় নি, শরীয়াহর বেশিরভাগ আইন নাযিল হয়েছে মাদানী জীবনে। মক্কার জীবনটা ছিল এই শরীয়ার হুকুম-আহকামগুলো মেনে চলার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করার সময়।এই সময়টা ছিল নিজের ঈমান পূর্ণ করার সময়, আর সেটি ছিল বারবার জান্নাত এবং জাহান্নামের কথা স্মরণ করার মধ্যে দিয়ে, আখিরাতের জীবনের কথা স্মরণ করার মাধ্যমে। তাই মক্কী জীবনে বারবার বলা হয়েছে আল-গায়েব বা অদৃশ্যের কথা, যেন মানুষের হৃদয় আল্লাহ সুবহানাতা’আলার প্রতি অনুগত হতে পারে, যেন অজ্ঞানতা আর অন্ধকারের পর্দা আমাদের মন থেকে উন্মোচিত হতে পারে। এরপরই আল্লাহ তা’আলা হালাল এবং হারামের হুকুমগুলো প্রকাশ করলেন।

ইসলাম সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা একটি বড় সমস্যা, 
কিন্তু এটিই যে আমাদের একমাত্র সমস্যা, ব্যাপারটা তা না, কারণ, আপনি দেখবেন, সবাই জানে মদ পান হারাম, কিন্তু তবু মানুষ সেটা খায়।  সবাই জানে সুদ খাওয়া হারাম, তবু কিছু মানুষ সুদের সাথে জড়িত হয়ে পড়ছে।সবাইই জানে জামাতে সালাত আদায় করার গুরুত্বের কথা, … পাচঁ ওয়াক্ত সালাত এবং রমযান মাসে সিয়াম পালনের কথা, কিন্তু তবু অনেক এসবের ব্যাপারে উদাসীন! সবাই জানে, এমনকি একটা শিশুও, যে, হজ্জ হচ্ছে ইসলামের একটি স্তম্ভ, তবু এটা কি করে হতে পারে যে মুসলিমরা হজ্জ পালন করছে না? এখানে একটা বড় সমস্যা হচ্ছে আমাদের বিশ্বাস বা ঈমানের অপর্যাপ্ততা।

আমাদের মনটা পাথরের মত শক্ত হয়ে গেছে 
কি পারে আমাদের এই কঠিন মনটাকে নরম-কোমল করে তুলতে? পারে, আলআখিরাহ বা পরকালের জীবনের প্রতি ভয়, আলগায়েব বা অদৃশ্যের আলোচনা। কারণ রাসূল (সাঃ) বলেছেন, তোমরা যদি জানতে যা আমি জানতাম, তাহলে তোমরা বেশি বেশি কাদঁতে আর অল্পই হাসিঠাট্টা করতে। আখিরাহ এর বাস্তবতা আমাদেরকে খুব কাছ থেকে উপলব্ধি করতে পারা উচিত যেমনটা পারতেন আলী (রাঃ), তিনি বলেছিলেন, আমি যদি চোখের সামনে এখন জান্নাত দেখতে পাই আমি জান্নাতকে ততটাই ভালবাসব যতটা জান্নাতকে নিজের চোখে না দেখে আমি ভালবাসি, কিংবা জাহান্নামকে যদি আমার চোখের সামনে আনা হয় তাহলে আমি ততটাই ভয় পাব যতটা আমি জাহান্নামের আগুন না দেখেও ভয় করি, … অর্থাৎ আলী (রাঃ) জান্নাত এবং জাহান্নামের অর্থ আর বাস্তবতা খুব গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারতেন। তিনি এই দুনিয়ায় এমনভাবে বেঁচে ছিলেন, যেন তিনি চোখের সামনে জান্নাত এবং জাহান্নামকে দেখতেন এবং অনুভব করতেন, এটাই হচ্ছে ঈমান

আমরা ব্যক্তি এবং সমাজ পরিবর্তনের সেই আলোচনায় আবার ফিরে যাই। ১৯৩০ সালে আমেরিকা যুক্তরাষ্টে, কনগ্রেস মদ নিষিদ্ধ করে একটি আইন পাস করল। সুবহানাল্লাহ, মুসলিম-অমুসলিম সকলেই বুঝতে পারে মদ খাওয়া শরীরের জন্য ক্ষতিকর। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে আমেরিকার সরকার এই আইনটি বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নিল। এই ঘটনার পর প্রায় ৫ লক্ষ লোক জেলে গেল, মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ব্যয় হল এই আইন বাস্তবায়নে, খুন হল হাজার হাজার লোক। … মজার ব্যাপার হল, মদ খাওয়ার পরিমাণে কম বেশ হলই না, উপরন্তু লোকজন নিজের ঘরে মদের তৈরি করতে শুরু করল। মদ উৎপাদনের প্রক্রিয়া বেশ অস্বাস্থ্যকর হওয়ায় অসুখ-বিসুখ ছড়িয়ে পড়ল। চার বছরের দুর্বিষহ সময়ের পর আমেরিকার সরকার এই আইন বাতি করল। তথাকথিত পরাক্রমশালী আমেরিকা এই আইন প্রয়োগ করতে পারল না, বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী জাতি মদ নিষিদ্ধ করতে ব্যর্থ হল।

এবার আসুন আমরা ১৪০০ বছর আগে ফিরে যাই। জিবরীল (আঃ) রাসূল (সাঃ) এর কাছে আয়াত নিয়ে হাজির হলেন, 
হে মুমিনগণ,এই যে মদ,জুয়া, প্রতিমা এবং ভাগ্যনির্ধারক শরসমূহ এসব শয়তানের অপবিত্র কাজ ছাড়া আর কিছুই নয় অতএব,এগুলো থেকে বেঁচে থাকযাতে তোমরা কল্যাণপ্রাপ্ত হও।[সূরা মায়িদাঃ ৯০] মদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে এই আয়াতটি আল্লাহর পক্ষে থেকে রাসূল (সাঃ) এর কাছে নাযিল হল। রাসূল (সাঃ) কোন পুলিশবাহিনী, সেনাবাহনী কিংবা ন্যাশনাল গার্ডের সাহায্য ছাড়া সাহাবাদের কাছে এই আয়াতটি পড়ে শুনালেন। সাহাবারা এটা শোনামাত্র রাস্তায় বেড়িয়ে পড়ে ঘোষণা করলেন, মদ খাওয়ার আর কোন বৈধতা ইসলামে নেই।

আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) বলেন, আমি কয়জন সাহাবাকে মদ পরিবেশন করছিলাম এবং আমরা তখন শুনলাম রাস্তায় ঘোষণা দেয়া হচ্ছে মদ খাওয়া এখন থেকে হারাম’, তৎক্ষণাৎ আমি হাত থেকে মদের জগ ছুড়ে ফেললাম এবং সাহাবারা সকলে হাত থেকে মদের গ্লাস ফেলে দিলেন। যাদের মুখে মদ লেগে ছিল, তারা সেটা মুখ থেকে থু থু দিয়ে ফেলে দিলেন। তাদের মধ্যে এমন অনেকে ছিলেন যারা মদ গিলে ফেলেছেন বিধায় বমি করে পেট থেকে মদটুকু উগলে দিতে চেষ্টা করলেন। বলা হয়ে থাকে, মদীনার রাস্তায় মদের বন্যা বয়ে গিয়েছিল। মদ হারাম এই খবর শোনামাত্র সকলের তৎক্ষণাৎভাবে সে আদেশ পালন করল, কোন পুলিশের ভয় ছাড়া, US কংগ্রেস কিংবা ন্যাশনাল গার্ডের হস্তক্ষেপ ছাড়া। প্রয়োজন হল না কোন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা লক্ষ ডলারের। কাউকে জেলে ছোড়ার প্রয়োজনও পড়ল না, বাস্তবায়িত হল আল্লাহর হুকুম, কেন? কিভাবে একই আদেশ মদীনায় কাজ করল কিন্তু আমেরিকায় নয়? পার্থক্যটা ঈমানে, তাক্বওয়ায়। সাহাবারা নিজেদেরকে এভাবেই আল্লাহর দেয়া আদেশগুলো মানতে নিজেদের প্রস্তুত করেছিলেন, আমাদেরকেও তা করতে হবে। আর এটা সম্ভব হবে তখনই যখন আমরা আখিরাতের ব্যাপারে চিন্তা করব, আখিরাত সম্পর্কে জানব এবং কথা বলব।

তো আমাদের পরকালের দিকে মহাযাত্রার এই আলোচনায়, পর্যায়ক্রমে অনেকগুলো বিষয় আসবে। 
আমরা প্রথমে আলক্বিয়ামাহ আসসুগুরা বা গৌণ বিচার দিবস নিয়ে আলোচনা করব। এই আলোচনার আওতায় ১ নম্বরে আছে, মৃত্যু, তার পর হচ্ছে দুই, কবরের জীবন, এরপর থাকবে তিন, আর-রুহ বা মৃত ব্যাক্তির আত্মা। এরপরে আসবে চার, আল ক্বিয়ামাহ এর আলামতগুলো, যেগুলোর মধ্যে ছোট বড় সব আলামত নিয়েই আলোচনা করা হবে। এরপর আসবে বিচার দিবস, যার মধ্যে প্রথমে আসবে, এক, পুনরুত্থান, দুই, দ্বিতীয়ত বিচার দিবসের আতংকিত পরিস্থিতি, তিন, এরপর পর্যায়ক্রমে আসবে জবাবদিহিতা, হিসাব-নিকাশ এবং প্রতিফল প্রদানের বর্ণণা। আর সবশেষে আমাদের সর্বশেষ গন্তব্য, জান্নাত বা জাহান্নাম। এই রুপরেখা মেনেই আমরা আমাদের আখিরাতে দিকের মহাযাত্রার কাহিনী শুনব, এমন এক মহাযাত্রা, যাতে আমাদের সবাইকেই অংশ নিতে হবে।

আখিরাতের শুরু হয় মৃত্যুর মধ্য দিয়ে, যেটাকে বলা হয় ছোট বা গৌণ বিচারদিবস। বুখারীতে বর্ণিত আছে, একদিন রাসূলূল্লাহ (সাঃ) এর কাছে কিছু বেদুইন এসে জানতে চাইল, আসসাআ কখন?”। আস-সা’আ মানে হল বিচারদিবস। তিনি তাদেরকে ভাল করে দেখলেন এবং তাদের মধ্যে সবচেয়ে কমবয়স্ক যে ছিল তার দিকে নির্দেশ করে বললেন, এ বালকটি বৃদ্ধ হবার আগেই, তোমাদের বাকি সকলের বিচারদিবস আরম্ভ হয়ে যাবে। অর্থাৎ, মৃত্যুর পরপরই মানুষের বিচারদিবসের সূচনা হয়। তাই মৃত্যুকে বলা হয় ছোট বিচারদিবস।

মৃত্যু, যেটাকে আসলে পাশ কাটিয়ে যাবার কোন সুযোগ নেই, সবাই মৃত্যুবরণ করবে।

আল্লাহ সুবহানা’তা’আলা বলেন, আল্লাহর সত্তা ব্যতীত সবকিছু ধবংস হবে বিধান তাঁরই এবং তোমরা তাঁরই কাছে প্রত্যাবর্তিত হবে[সূরা আল-ক্বাসাসঃ৮৮]। প্রত্যেকটা কিছুর পরিসমাপ্তি আছে, একমাত্র আল্লাহ তা’আলার কোন শেষ নেই। আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন, প্রত্যেক সত্ত্বাই মৃত্যু আস্বাদনকারী, তারপর আমাদেরই কাছে তোমাদের ফিরিয়ে আনা হবে।”[আলআনকাবূতঃ৫৭] । প্রত্যেককেই, মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে, আর যত যাই কিছু হোক।



আমাদের মৃত্যু কবে হবে তা পূর্বনির্ধারিত 

-আর আল্লাহর হুকুম ছাড়া কেউ মরতে পারে না-সেজন্য একটা সময় নির্ধারিত রয়েছে। (আলে-ইমরানঃ ১৪৫)

প্রত্যেক সম্প্রদায়ের একটি মেয়াদ রয়েছে। যখন তাদের মেয়াদ এসে যাবে, তখন তারা না এক মুহুর্ত পিছে যেতে পারবে, আর না এগিয়ে আসতে পারবে। (আল-আ’রাফঃ ৩৪) 

কিছু লোক যারা মৃত্যু থেকে পলায়ন করার চেষ্টা করছিল,  
“তুমি কি তাদেরকে দেখনি, যারা মৃত্যুর ভয়ে নিজেদের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন? অথচ তারা ছিল হাজার হাজার। তারপর আল্লাহ তাদেরকে বললেন মরে যাও। তারপর তাদেরকে জীবিত করে দিলেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ মানুষের উপর অনুগ্রহকারী। কিন্তু অধিকাংশ লোক শুকরিয়া প্রকাশ করে না”। (বাকারাহঃ ২৪৩)

উম্মে হাবিবা, মুসলিম শরীফের হাদীস, 
হে আল্লাহ! আমার স্বামী রসূল দ্বারা আমাকে উপকৃত করুন তাকে একটি দীর্ঘ জীবন দান করার মাধ্যমে, আমার পিতা আবু সুফিয়ান দ্বারা আমাকে উপকৃত করুন তাকে একটি দীর্ঘ জীবন দান করার মাধ্যমে, এবং আমার ভাই মুয়াবিয়ার দ্বারা আমাকে উপকৃত করুন দ্বারা আমাকে উপকৃত করুন তাকে একটি দীর্ঘ জীবন দান করার মাধ্যমে।
তাই এক ব্যাক্তি যখন আল্লাহর কাছে দু’আ করছিল দীর্ঘজীবন প্রদানের জন্য, তখন রাসূল (সাঃ) তাকে বলছিলেন,তুমি আল্লাহর কাছে এমন এক জিনিষের প্রার্থনা করছ যেটা তিনি আগেই তোমার জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, তিনি তোমাদের দিন নির্ধারিত করে দিয়েছেন এবং রিযিক্ব নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন।তিনি আবার তাকে বললেন, 
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :

তুমি এমন কিছু চাও যা আল্লাহ তোমাদের জন্য পূর্বনির্ধারিত করে দিয়েছেন, তোমাদের দিন গণণা করে রেখেছেন এবং তোমাদের রিযিক্ব যা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে এবং বন্টন করে দেয়া হয়েছে। তুমি যদি আল্লাহর কাছে জাহান্নামের আগুন থেকে এবং কবরের আযাব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করতে তাহলে এটা তোমার জন্য অধিকতর মঙ্গলজনক দুআ হত

আমরা আমাদের জন্য, আমাদের পিতা মাতা ভাইদের জন্য দীর্ঘায়ু কামনা করি,
 বলে থাকি, আল্লাহ তোমাকে হায়াত দান করুন !
 অথচ আমরা কে কয়দিন বাচঁব তা পূর্বনির্ধারিত। এটা কখনই পরিবর্তন হবার নয়। আর মৃত্যুর আগমন হবে কোন ঘোষণা ছাড়াই। মৃত্য হবে সেখানে, যেখানেই আল্লাহ তা’আলা মৃত্যুকে যেখানেই ঠিক করে রেখেছেন।

আমি আপনাদেরকে একটা বাস্তব ঘটনা বলতে যাচ্ছি,
 এটা হয়েছিল রিয়াদে। একটা বিল্ডিং এর ৭ম তলায় কন্সট্রাকশনের কাজ করছিল এক কর্মী। হঠাৎ সে উপর থেকে পড়ে গেল, সেখানে নিরাপত্তামূলক কোন ব্যবস্থা ছিল না, সে সোজা  ফুটপাথের উপর এসে পড়ল। ভেবে দেখুন, ৭ম তলা থেকে একটা মানুষ সোজা এসে পড়েছে শক্ত কনক্রিটের ওপর ! 
পথচারীরা তৎক্ষণাৎ তার দিকে ছুটে গেল, তারা ভাবল সে মারা গেছে, চারদিক থেকে লোকজন দৌড়ে আসল। 
কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে লোকটি দাঁড়িয়ে পড়ল! 

তার কিছুই হয় নি, সে লাফ দিয়ে আনন্দে দাঁড়িয়ে পড়ল, খুশী ! আল্লাহ তা’আলা তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। সবাই অবাক বিস্ময়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকল। লোকটি এতটাই আশ্চর্য আর আনন্দিত হল যে, সে এই স্মরণীয় মূহুর্ত উদযাপন করতে সবাইকে দাওয়াত দিল,  ড্রিংক্সের আমন্ত্রণ জানাল। তো সে, তাই, রাস্তার অপরপাশ থেকে ড্রিংক্স আনতে রাস্তা পার হতে গেল। রাস্তা পার হবার সময় সে কিছুটা অমনযোগী ছিল এবং হঠাৎ একটি গাড়ি এসে তার উপর দিয়ে চলে গেল এবং সে সাথে সাথে মারা গেল।

লোকটি ৭ তলা থেকে পড়েও মরে নি, কেন-কারণ আল্লাহ সুবহানা ওয়া তা’আলা সেখানে সেভাবে তার মৃত্যু চান নি। বরং তিনি তার মৃত্যুর জন্য একটা নির্দিষ্ট স্থান-কাল-পাত্র ঠিক করে রেখেছিলেন, যেখানে তার আত্মাকে শরীর থেকে কেড়ে নেয়া হবে। সে বিল্ডিং থেকে পড়ে গিয়েছিল এই কারণে যে, আল্লাহ তাকে মৃত্যুর জন্য নির্ধারিত স্থানে তাকে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। লোকটি বিল্ডিং থেকে পড়ে বেঁচে গিয়ে, মৃত্যর দিকেই হাটঁতে শুরু করল।

সে যখন অত উচুঁ বিল্ডিং থেকে পড়েও মরল না, সে ভেবেছিল, তাকে বোধহয় অনেক দীর্ঘ জীবন দান করা হয়েছে, আর এই ভাবনাটা সাথে করে নিয়েই তার জীবনের পরিসমাপ্তি হল। সে ব্যাপারটা ভেবেছিল এমন যে, যদি এভাবে তার মৃত্য না-ই ঘটে, তাহলে নিশ্চয়ই,তার সামনে দীর্ঘ জীবন পড়ে আছে। কিন্তু ভাবতেও পারে নি, রাস্তার মাঝেই আজরাইলের সাথে তার এপয়েন্টমেন্ট ঠিক করা ছিল।

এমন আরো একটি ঘটনা আছে, মিসরে কয়েক বছর আগে একটা ভূমিকম্প হয়েছিল, 
বেশিরভাগ মিডিয়াতে খবরটি এসেছিল। সেখানে একটা লোক ধংসস্তুপের নিচে অনেকদিন বেঁচে ছিল, যদিও বা বেঁচে থাকার মত কোন অবস্থাই সেখানে ছিল না। কিন্তু সে বেঁচে ছিল, কারণ তার মৃত্যুর সে সময় আল্লাহ চান নি। তার সাথে ছিল তার মা এবং বোন, দুইজনই মারা গিয়েছিল, কিন্তু তার কিছু হয় নি। মৃত্যু আসবে কোন ধরণের ঘোষণা ছাড়াই, হঠাৎ করে। আমরা হয়তো ভাবছি, আমরা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নেব, কিন্তু এমন হতেই পারে মৃত্যু এমন ভাবে এসেছে যে আপনি বিন্দুমাত্র টেরও পান নি।

আপনি কত তাড়াতাড়ি মৃত্যুর দেখা পেতে পারেন তার সবচেয়ে ভাল উদাহারন দিতে গেলে বলতে হয় কয়েক বছর আগে ভারতে ঘটে যাওয়া দুটো বিমান বিধ্বস্ত হবার ঘটনা, যেখানে দুটো বিমান, একটি সৌদি এবং অপরটি ইউক্রেনিয়ান এয়ারলাইন্সের,তাদের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটে। ভেবে দেখুন, দুটো বিমানের মধ্যে যখন এভাবে সংঘর্ষ হয় তখন তারা প্রায় ১৬০০ মাইল বেগে ধাক্কা খায়, কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই ! রাস্তাঘাটের সাধারণ ঘটে যাওয়া দূর্ঘটনাগুলোতেই লোকজন তাৎক্ষণিক মৃত্যুবরণ করে আর সেখানে ভেবে দেখুন ১৬০০ মাইল বেগে দুটো বিমানের দূর্ঘটনা।

তাহলে আমাদের কতটা কাছে হতে পারে এই মৃত্যু ? হতে পারে বিমানে এমন কেউ ছিলেন যিনি এক টুকরো খাবারের টুকরো মুখে নিয়ে খাচ্ছিলেন আর সেটা মুখে তোলার আগেই তার মৃত্যু হয়েছে ? হতে পারে দু’বন্ধু গল্প করছিল, আর তাদের কারো একজনের মুখের কথা সম্পূর্ণ হবার আগেই দুজনেরই মৃত্যু হয়েছে ? আমাদের বারবার মৃত্যুর কথা স্মরণ করা উচিত। কারণ রাসূল(সাঃ) বলেছেন, তোমরা বেশি বেশি করে মৃত্যুর কথা স্মরণ কর, কারণ মৃত্য হচ্ছে সুখবিনাশী। রাসূল(সাঃ) মৃত্যুকে সুখের বিনষ্টকারী রুপে অভিহিত করেছেন।

রাসূল(সাঃ) বলেছেন, আল মওতু হাক্ব”, অর্থাৎ হচ্ছে মৃত্যু হচ্ছে সত্য, বাস্তবতা। মুসলিম বা অমুসলিম কেই মৃত্যুকে অবিশ্বাস করে না। তবু ইমাম হাসান আল বসরী বলেন, মৃত্যু থেকে নিশ্চিত আর কিছুই নেই, তবুও লোকে এমনভাবে এই নিশ্চিত বাস্তবতার সাথে আচরণ করে যেন এর মধ্যে সন্দেহ আছে, যেন তারা চিরজীবন এই দুনিয়ায় থাকবে”।
 যেমন ভেবে দেখুন, আমরা জানিনা, কালকে আমাদের জন্য কি পরিমাণ রিযিক্ব নির্ধারিত আছে, তবু আমরা অনিশ্চিত পরিমাণ এই রিযিক্ব উপার্জনের জন্য কত প্ল্যান-প্রোগ্রাম করছি। কিন্তু নিশ্চিত মৃত্যুর জন্য আমরা কয়জন প্রস্তুতি নিচ্ছি ?

ব্যাপারটা অবাক করা! মৃত্যুর জন্য কিন্তু আমরা সত্যিকার অর্থে কোনই প্রস্তুতি নিচ্ছি না। যাদেরকে দেখবেন মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা আসলে ঠিক মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে না, বরং তারা মৃত্যু সংক্রান্ত এই দুনিয়াতে যেসব কাজ-কর্ম বা আচার-অনুষ্ঠান রয়েছে সেটার প্রস্তুতি নিচ্ছে, মৃত্যুর পরে কি আছে সেটার প্রস্তুতি নয়। তারা মৃত্যু পরবর্তী অনুষ্ঠান, তারা অন্তোষ্টিক্রিয়া কিংবা গোরস্তান এর পরিচর্যা নিয়ে যতটুকু চিন্তিত, মৃত্যুর পরে কি হবে ততটা নয় !

“মৃত্যুর পরে আপনার কি হবে?”- এই প্রশ্নটা করা হয়েছিল, বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী লেখক আইজ্যাক আসিমভ কে, তার মৃত্যুর কয়েক মাস আগে। তিনি উত্তর দিলেন, কিছুই হবে না, আমি মরে গেলে কোন কিছুই হবে না। আমার লাশ পচে মাটিতে পরিণত হবে। তার এত জ্ঞান, তার লেখা ভুড়ি ভুড়ি বই, তার বুদ্ধিবৃত্তি, তার সম্পদ আর খ্যাতি থাকা সত্ত্বেও,তার সাথে আজ থেকে ১৪০০ বছর আগের আরবের নিরক্ষর, অজ্ঞ কাফিরদের সাথে কার্যত তার কোন পার্থক্য নেই। তার তথাকথিত জ্ঞান কোনই কাজে আসেনি, কারণ আমরা একটা মানুষকে যতই বুদ্ধিমান বা জ্ঞানী মনে করি না কেন, তার বুদ্ধিমত্তা প্রকৃতপক্ষে শূণ্যের কোঠায়, যদি সে আখিরাতে বিশ্বাস না করে। আল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলছেন, তারা আরও বলবেঃ যদি আমরা শুনতাম অথবা বুদ্ধি খাটাতাম,তবে আমরা জাহান্নামবাসীদের মধ্যে থাকতাম না।“ [সূরা মূলকঃ১০] দেখুন তারা বলছে, যদি আমরা বুদ্ধি খাটাতাম, আক্বল খাটাতাম… ”। 

শেষ পর্যন্ত যদি জাহান্নামে আগুনেই পুড়তে হয় তাহলে আমাদের এত এত মেধা, বুদ্ধিমত্তা জ্ঞান-বিজ্ঞানের কি মূল্য থাকল? আল্লাহ তা’আলা বলেছেন কেন আমাদেরকে মেধা দিয়েছেন,তোমাদেরকে দেন কর্ণ, চক্ষু ও অন্তঃকরণ তোমরা সামান্যই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। [আসসাজদাঃ৯] অর্থাৎ, যেন আমরা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারি । আল্লাহ আমাদেরকে চোখ এবং কান দিয়েছেন যেন আমরা সেগুলো দিয়ে দেখি, শুনি, জানি। মন দিয়েছেন যেন আমরা চিন্তা করতে পারি এবং যে কেউ এই তিনটি নিয়ামতের সঠিক ব্যবহার করবে, সে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করবে এবং ঈমান আনবে।

আমরা যখন মৃত্যুর কথা আলোচনা করি, এবং মৃত্যুর নিশ্চয়তা অনুধাবন করি, তখন তা আমাদেরকে অলসতা থেকে দূরে রাখে এবং আমাদেরকে বাস্তবতার মুখোমুখি করে। এবং পার্থিব জীবনের প্রতি আমাদের আসক্তি নষ্ট করে দেয়। দুনিয়ার জীবনের প্রতি আমাদের এ আসক্তির কারণ হল আমরা  আজ একটা পর্দার মধ্যে আবদ্ধ, আমরা সত্যটা দেখতে পাই না। তাই আমাদের মৃত্যুর কথা স্মরণে রাখা উচিত যেন এ জীবনের বাস্তবতা সম্পর্কে আমরা গাফেল না হই এবং আমাদের মন চূড়ান্ত বাস্তবতার কথা খেয়াল রাখতে পারে।

মৃত্যুর আগের সময়টার একটা নাম আছে, এটাকে বলা হয়, আলইহতিদার।
 এটি মৃত্যুর একদম পূর্ব পর্যায়, এ পর্যায়ে মৃত্যুর ফেরেশতা জান কবজ করতে অবতরণ করে। আল্লাহ সুবহানা ওয়া আল-ইহতিদার পর্যায় সম্পর্কে পবিত্র কুর’আনে বলেন, যখন তোমাদের কারও মৃত্যু আসে তখন আমার প্রেরিত ফেরেশতারা তার আত্মা হস্তগত করে নেয়।[সূরা আনআমঃ৬১]

আল-ইহতিদার পর্যায়ে যখন ফেরেশতারা অবতরণ করেন তখন মৃত্যুর দিকে অভিমুখী ব্যাক্তি তাকে দেখতে পায়। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেন, মুমিন ব্যাক্তি যখন দুনিয়া ত্যাগ করে এবং আখিরাতের দিকে যেতে থাকে তখন ফেরেশতারা উজ্জ্বল মুখে আসমান থেকে অবতীর্ণ হয়, তারা জান্নাত থেকে কফিন এবং সুগন্ধি নিয়ে আগমন করে তার পাশে বসে তাকে বলে, “হে পবিত্র আত্মা! আল্লাহর ক্ষমা আর সন্তুষ্টির দিকে ছুটে আস। এরপর মৃত্যু ফেরেশতা খুব কোমলস্বরে আত্মাকে দেহ থেকে বের হয়ে আসতে বলে এবং তার কাছে আল্লাহর ক্ষমা এবং সন্তুষ্টির প্রতিশ্রুতি দেয়।রাসূল (সাঃ) বলেছেন, এইপবিত্র আত্মা খুব সহজে দেহ থেকে বের হয়ে আসবে, যেমনটা করে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে।

আর যারা পাপাচারী ব্যাক্তি এবং অবিশ্বাসী, সে যখন দুনিয়ার জীবন ত্যাগ করে আখিরাতের দিকে যেতে থাকবে, তখন মৃত্যুর অন্ধকার ফেরেশতা খসখসে কফিন নিয়ে আগমন করবে যেটা আমদানি হয়েছে জাহান্নাম থেকে। তার পাশে এসে বসে মৃত্যুর ফেরেশতা বলবেন,হে পাপী আত্মা! আল্লাহ সুবহানু ওয়া তাআলার ক্রোধ এবং রোষের দিকে ছুটে আস।তাকে বলা হবে যে, যে তোমাকে এখনই আসতে হবে এবং তোমার জন্য আল্লাহর ক্রোধ অপেক্ষা করছে।

যখন মৃত্যুর ফেরেশতা এই ঘোষণা করবে, তখন তার আত্মা দেহের মধ্যে ছুটে বেড়াবে আর সে বের হয়ে আসতে চাইবে না। মৃত্যুর ফেরেশতারা তখন তার আত্মাকে খপ করে ধরে টানতে টানতে নিয়ে যাবে, ভেজা পশমের মধ্য থেকে কাটাঁযুক্ত কিছুকে টেনে আনতে যেমন অবস্থা হয় তেমন। ভেবে দেখুন, আপনার কাছে কাটাঁময় কিছু একটা আছে, যেটাকে আপনি ভেজা পশমের মধ্য থেকে টেনে বের করে আনতে চাচ্ছেন ! এটা সবকিছু ছিড়েই ফেলবে। তাই রাসূল (সাঃ) বলছেন, যখন এই আত্মাকে টেনে বের করা হবে তখন যেন এটা মাংস এবং স্নায়ুকে ছিড়ে ফেলবে, কারণ এই আত্মা শরীর থেকে সহজে বের হতে চাইবে না।” কষ্ট আর দূর্ভোগ! এমনই হবে পাপাচারী আত্মার পরিণতি।

এই সময়টাতে মু’মিন ব্যাক্তিরাও চিন্তিত থাকবে। তাই আল্লাহ সুবহানু ওয়া তা’আলা তাদেরকে প্রশান্তি দেবেন এবং তাদের সুসংবাদ দেবেন। আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুর’আনে এই সুসংবাদ দিয়ে বলেন, নিশ্চয় যারা বলে,আমাদের পালনকর্তা আল্লাহ, অতঃপর তাতেই অবিচল থাকে,তাদের কাছে ফেরেশতা অবতীর্ণ হয় এবং বলে, তোমরা ভয় করো না, চিন্তা করো না এবং তোমাদের প্রতিশ্রুত জান্নাতের সুসংবাদ শোন। [সূরা ফুসিলাতঃ৩০]। অর্থাৎ মু’মিনদের আত্মা যখন ইহতিদার পর্যায়ে থাকবে তখনই তাদেরকে মৃত্যুর ফেরেশতারা জান্নাতের সুসংবাদ দেবে। কাদেরকে? আল্লাহ বলছেন, যারা বলেছে আমাদের রব হচ্ছে আল্লাহ, এবং এরপরে যারা এই কথার উপর দৃঢ় ছিল। অর্থাৎ, এরা হল সেই সব লোক,যারা আল্লাহকে রব হিসেবে স্বীকার করেছে, দ্বীনের সরল পথ বাদ দিয়ে বামে-ডানের বক্রপথে চলার অপচেষ্টা করেনি, মসজিদে একদিন আর আর বাইরে ৬ দিন, নাইটক্লাবে একদিন আর ইতি’কাফে পরের দিন, রোযা রেখে একদিন আর বাকি দিন মদ খেয়ে কাটিয়েছে –এমনটি যারা করে নি।

আর যারা ছিল পাপাচারী, আল্লাহ তাদের ব্যাপারে বলেন, আর যদি তুমি দেখ, যখন ফেরেশতারা কাফেরদের জান কবজ করে; প্রহার করে তাদের মুখে এবং তাদের পশ্চাদদেশে আর বলে, জ্বলন্ত আযাবের স্বাদ গ্রহণ করএই হলো সে সবের বিনিময় যা তোমরা তোমাদের পূর্বে পাঠিয়েছ নিজের হাতে বস্তুতঃ এটি এ জন্য যে,আল্লাহ বান্দার উপর যুলুম করেন না। [সূরা আনফাল:৫১] এ আয়াতে বলা হচ্ছে, ফেরেশতারা তাকে প্রহার করতে থাকবে এবং বলতে থাকবে, তুমি জাহান্নামে যাচ্ছ তোমার কাজের প্রতিফল হিসেবে এবং আল্লাহ তোমার উপর কোন অবিচার করেন নি বরং তুমিই নিজের হাতে যা কামিয়েছ তার ফলস্বরুপ তোমার আজ এই অবস্থা।

আতা’বিন রাবা’বলেন, মৃত্যুর কথা স্মরণ করার মাঝে তিনটি উপকার আছে।

১ নাম্বার হচ্ছে, তওবার দিকে মনোনিবেশ করা।

২, অল্পে তুষ্ট থাকা, এবং

৩, দুনিয়ার জন্যে ব্যস্ততা, পেরেশানী কমে যাওয়া।

তওবার দিকে মনোনিবেশ করা, আপনি যদি মৃত্যুর কথা বেশি স্মরণ করেন এবং আখিরাতে কথা ভাবেন তাহলে এর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণে উৎসাহ পাবেন এবং তওবা করার ব্যাপারে বেশি বেশি ছুটে যাবেন।

অল্পে তুষ্ট থাকা, আল্লাহ যা-ই দেন, তা নিয়ে খুশি থাকা এবং তৃপ্ত থাকা।কারণ আপনি জানেন এই দুনিয়া হচ্ছে হচ্ছে অস্থায়ী আবাস, তাই এখানে কি-হচ্ছে না-হচ্ছে তা নিয়ে আপনাকে খুব বেশি সংশ্লিষ্ট হতে হবে না। আল্লাহ আপনাকে যা-ই দেন, তাতেই আলহ্বামদুলিল্লাহ।

মৃত্যর কথা স্মরণের ৩ নাম্বার উপকার হচ্ছে, দুনিয়ার জন্যে ব্যস্ততা, পেরেশানী কমে যাওয়াঃ আপনি এই দুনিয়ার ভোগ-ঐশ্বর্যের জন্য দৌড়াদৌড়ি-মারামারি-কাটাকাটি-প্রতিযোগিতা, এগুলা বন্ধ করে দেবেন। এবং এটা আপনার মনে প্রশান্তির জন্ম দেবে। কারণ, মানুষ যে কারণে উদ্বিগ্ন হয় বা আপত্তিকর কাজে লিপ্ত হয় তার কারণ হল দুনিয়র ভোগ-ঐশ্বর্যের জন্য ছুটাছুটি। দুনিয়াটা ছোট আর আপনার চাহিদা অনেক বড় তাই, কোন কিছুই আপনার মনতে তুষ্ট করতে পারবে না। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেছেন,যদি বনী আদমের কাছে এক পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ থাকত তবু সে আরো এক পাহাড় স্বর্ণের জন্য আবেদন করত এবং কোন কিছুই আদম সন্তানের মন ভরাতে পারত না, ধূলাবালি ছাড়া অন্য কোন কিছুই তাকে থামাতে পারত না।

হ্যাঁ, ধূলা-বালি ছাড়া ছাড়া কোনকিছু আপনার লোভকে সামলাতে সক্ষম নয়। কারণ, মানুষ মরে গিয়ে যখন ধূলাবালিতে পরিণত হয়, তখনই তাদের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব শেষ হয়।

তো, আমরা যা বলছিলাম, যে মানুষ মৃত্যুর ব্যাপারে চিন্তাশীল হবে, সে পার্থিব জীবনের সাময়িক এ সম্পদ-প্রতিপত্তির জন্য মারামারি করবে না, এগুলোর জন্য অস্থির হবে না। সে ভাবতে শুরু করবে, এর সবই অস্থায়ী, এগুলোর জন্য যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেবার কিছু নেই! আপনি দেখবেন, বিভিন্ন দেশ এবং জাতিগুলোর মধ্যে যে যুদ্ধ হয়ে আসছে, তা হচ্ছে সম্পদের তাগিদে। তারা যুদ্ধ করছে তেলের জন্য, ভূমির জন্য, প্রাকৃতিক সম্পদ হস্তগত করার জন্য। ন্যায়ের জন্য ন্যায্য যে যুদ্ধ, একমাত্র ন্যায্য যে যুদ্ধটি আছে তা হল ইসলামিক জিহাদ। কারণ এই এই যুদ্ধ হচ্ছে কেবল মাত্র আল্লাহ তা’আলার জন্য, তার সন্তুষ্টির জন্য। এ ছাড়া আর সবকিছুই হচ্ছে দুনিয়ার জন্য যুদ্ধ।

পশ্চিমারা ইসলামের জিহাদের ধারণার উপর আক্রমণ করে যেন তাদের যুদ্ধগুলো ন্যায্য ! তারা কেন যুদ্ধ করছে? তারা কখনও মুখে মানবাধিকারের মুখোশ পড়ে বলছে, “আমাদের যুদ্ধ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা”। এটা বিশ্বাসযোগ্য কথা নয়, বিক্রিযোগ্য কথা নয়, এটা বিশ্বাস করা সম্ভব নয়, মানবাধিকারের জন্য আসলেই কোথায়ও যুদ্ধ হচ্ছে। এই যুদ্ধগুলো গণমানুষের স্বার্থে নয়, বরং হাতে গোণা কিছু লোকের স্বার্থোদ্ধারের জন্য যুদ্ধ হচ্ছে। কোনভাবেই এগুলো আমার-আপনার অধিকার আদায়ের জন্য নয়, বরং গুটিকয়েক লোক, যারা তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তিকে কাজে লাগিয়ে সুবিধা নিতে সদা তৎপর। যদিও আমরা এখানে কসভো, চেচনিয়া কিংবা কুয়েত যুদ্ধের কারণ আলোচনা করতে বসি নি, কিন্তু আপনি দেখবেন, এই যুদ্ধগুলো হচ্ছে “মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা”র পতাকাতলে, কিন্তু আদতে এগুলোর পেছনের উদ্দেশ্য মোটেও তা নয়।

মানুষ যদি সত্যই মৃত্যুর ব্যাপারে সিরিয়াস হত, তাহলে তারা এই দুনিয়ার পেছনে লেগে থাকত না। বরং তারা আল্লাহ যা দিয়েছেন তার উপর খুশি থাকত। 

আল্লাহ তা’আলা বলছেন মৃত্য যন্ত্রণা বা সাকারাতুল মাউত বা মৃত্যু যন্ত্রণার কথা। সাকারা শব্দটি বোঝায় মাথা-ঘোরানোর মত অবস্থা বোঝায় যখন মানুষ অসচতেন হয়ে পড়ে, যেটা ব্যাথার কারণে হতে পারে। 
আল্লাহ বলছেন, মৃত্যুযন্ত্রণা নিশ্চিতই আসবে এ থেকেই তুমি টালবাহানা করতে। [সূরা ক্বাফঃ১৯] । এর অর্থ হল, “মৃত্যুযন্ত্রণা নিশ্চিতই আসবে। আরে এটাই তুমি এড়িয়ে চলতে চাও !”। এটা আসবেই আমরা যতই পালিয়ে বেড়ানোর চেষ্টা করি না কেন, যতই অব্যাহতি চাই না কেন। সবাইকেই মরতে হবে, মরতে হয়েছিল রাসূলূল্লাহ (সাঃ) কেও। রাসূল (সাঃ) নিজের সাথে এক জগ পানি রাখতেন আর সেখান থেকে হাত ডুবিয়ে তিনি মুখ মুছতেন এবং বলতেন, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, ইন্নালিল মাউতি লা সাকারাত, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, অর্থাৎ, নিশ্চয়ই মৃত্যু যন্ত্রণা বড়ই তীব্র। রাসূল (সাঃ) স্বয়ং মৃত্যুর এই প্রবল যন্ত্রণা এতটাই অনুভব করতেন যে তাকে পানিতে হাত ডুবিয়ে মুখ মুছে নিজেকে শীতল করে নিতে হত। যেখানে রাসূল (সাঃ) এমন ভয় করতেন সেখানে আমার-আপনার কি হবে? যারা কাফির তাদের কি হবে ?

আল্লাহ তা’আলা বলেন, আর তুমি যদি দেখতে পেতে যখন অন্যায়কারীরা মৃত্যু-যন্ত্রণায় থাকবে আর ফিরিশ্‌তারা তাদের হাত বাড়াবে — বের করো তোমাদের অন্তরাত্মা! আর তোমাদের দেয়া হবে লাঞ্ছনাপূর্ণ শাস্তি যেহেতু তোমরা আল্লাহ্র বিরুদ্ধে বলে চলেছিলে সততার সীমা ছাড়িয়ে,আর তোমরা তাঁর আয়াতসমূহে অহংকার পোষণ করতে। [সূরা আনআম:৯৩] সবাইকেই মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে, তবে সেটার সবার জন্য সমান নয়। যারা অবিশ্বাসী বা কাফির, তাদের এই যন্ত্রণা হবে সবচেয়ে বেশি। তবে হ্যা, এমন কিছু মানুষ আছে, যাদের ব্যাপারে বলা হয়েছে যে তাদের কোন প্রকার মৃত্যু যন্ত্রণা বোধ হবে না। তারা কারা ? আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলছেন, আশ-শুহাদা বা শহীদগণ। রাসূলূল্লাহ (সাঃ) বলছেন, শহীদদের মৃত্যু যন্ত্রণা হবে কেবল একটা পিপড়েঁর কামড়ের মত।আল্লাহ সুবহানু ওয়া তা’আলা শহীদদের বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত করেছেন, আর আমরা আজ সে মর্যাদা থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছি।

যখন কোন ব্যাক্তি দুনিয়া ছেড়ে চলে যায়, সে কামনা করে আবার ফিরে আসতে।যে কাফির সে চায় দুনিয়ায় আবার ফিরে এসে মুসলিম হতে। যদি সে পাপাচারী হয় তাহলে সে তওবা করার জন্য ফিরে আসতে চায়। আল্লাহ তা’আলা বলেন,

যখন তাদের কারও কাছে মৃত্যু আসে,তখন সে বলেঃ হে আমার পালণকর্তা! আমাকে পুনরায় (দুনিয়াতে ) প্রেরণ করুনযাতে আমি সৎকর্ম করতে পারি, যা আমি করিনি না! এ তো তার একটি কথার কথা মাত্র আর তার সামনে রয়েছেবরযখসেইদিন পর্যন্ত যখন তাদের পুনরুত্থান করা হবে।”  [সূরা মুমিনূন:৯৯,১০০] তাদেরকে দুনিয়াতে সুযোগ দেয়া হয়েছিল, কিন্তু তারা সে সুযোগ গ্রহণ করেনি, এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তারা ইচ্ছা করবে, দুনিয়ায় ফিরে এসে ভাল কাজ করবে, তওবা করবে এবং মুসলিম হবে। আল্লাহ বলছেন, কাল্লা’, “না”। তারপর আল্লাহ বলছেন, তাদের আর তাদের পিছনে ফিরে যাওয়ার মধ্যে বারযাখ বা পর্দা আছে। এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।

আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আর যেকোনদিন, যেকোন একটা দিন এমন একটা দেয়াল এসে পড়বে আমাদের পিছনে, আমাদের সেদিন আর পেছনে ফেরার পথ খোলা থাকবে না। তওবা করলে তখন আল্লাহ মেনে নেবেন না। আল্লাহ আপনাকে তওবার করার জন্য একটা সুযোগ দিয়েছেন সে সময় পর্যন্ত আপনার জন্য নিজেকে শোধরাবার সুযোগ আছে, এর পরে আর নয়। কারণ আল্লাহ বলছেন, অবশ্যই আল্লাহ তাদের তওবা কবুল করবেন, যারা ভূলবশতঃ মন্দ কাজ করে, অতঃপর অনতিবিলম্বে তওবা করে; এরাই হল সেসব লোক যাদেরকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন আল্লাহ মহাজ্ঞানী, রহস্যবিদ।” [সূরা নিসাঃ১৭]

আল্লাহ বলছেন, “ইয়াতুবুনা মিন কারিব”বা ‘অনতিবিলম্বে’। ইবনে কাসির এই শব্দটির ব্যাখ্যা দিয়েছেন, কত তাড়াতাড়ি তওবা করলে সেটা কবুল হবে? ইবনে কাসির বলছেন, ‘আল-ঘারঘারাহ’, এর আগ পর্যন্ত তওবার দরজা খোলা আছে। আল ঘারঘারাহ কি ? আল-ঘারঘারাহ হচ্ছে সেই সীমা বা সেই মূহুর্ত যখন আত্মা দেহ ত্যাগের প্রস্তুতি নেয়। সেই মূহুর্ত পর্যন্তই কেবল কারো তওবা কবুল হতে পারে, এটাকো আল্লাহ বলছেন “يَتُوبُونَ مِن قَرِيبٍ”বা “অনতিবিলম্বে তওবা করে;”। তাই আল্লাহ তা’আলা বলছেন,আর এমন লোকদের জন্য কোন ক্ষমা নেই, যারা মন্দ কাজ করতেই থাকে, এমন কি যখন তাদের কারো মাথার উপর মৃত্যু উপস্থিত হয়, তখন বলতে থাকেঃ আমি এখন তওবা করছি আর তওবা নেই তাদের জন্য, যারা কুফরী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে আমি তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি।” [সূরা নিসা:১৮]

অর্থাৎ, মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসলে যে তওবা করা হয় তার কোন দাম নেই। যেমনটা হয়েছিল ফির’আউনের ক্ষেত্রে, সে মৃত্যুর ঠিক আগ মূহুর্তে, যখন সে পানিতে ডুবে যাচ্ছিল বলেছিল, এবার আমি বিশ্বাস করে নিচ্ছি যে, কোন মাবুদ নেই তাঁকে ছাড়া যাঁর উপর ঈমান এনেছে বনীইসরাঈলরা বস্তুতঃ আমিও তাঁরই অনুগতদের অন্তর্ভুক্ত।” [সূরা ইউনুস:৯০] আল্লাহ তার এ কথার জবাবে বলছেন, এখন একথা বলছ! অথচ তুমি ইতিপূর্বে নাফরমানী করছিলে এবং পথভ্রষ্টদেরই অন্তর্ভুক্ত ছিলে।” আল্লাহ তা’আলা তার এই তওবা গ্রহণ করেন নি, কারণ আত্মার দেহত্যাগের আগে এটা করা হয় নি।

আমরা দেখেছি যে মৃত্যু কোনরুপ ঘোষণা ছাড়াই আসে। কোনপ্রকার আল্টিমেটাম দেয়া হয় না, মৃত্যুর ফেরেশতা এপয়েন্টমেন্টের পূর্ব প্রেরিত নোটিশ ছাড়াই হাজির হবে। আর এটাকে বাতিল করার বিন্দুমাত্র সুযোগ আপনার হাতে নেই। আপনি যতই চেষ্টা করুন না কেন, যেভাবেই চেষ্টা করুন না কেন, এটাকে ফেরাবার কোনই সুযোগ নেই। যদি মৃত্যু কোনধরণের আগাম বার্তা না দিয়েই আমাদের কাছে হাজির হয় তাহলে আমাদের তওবা করার সময়টা ঠিক কখন ?

যারা মুমিন, তাদের জন্যে কি আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য অবর্তীর্ণ হয়েছে, তার কারণে হৃদয় বিগলিত হওয়ার সময় আসেনি? তারা তাদের মত যেন না হয়, যাদেরকে পূর্বে কিতাব দেয়া হয়েছিল তাদের উপর সুদীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হয়েছে, অতঃপর তাদের অন্তঃকরণ কঠিন হয়ে গেছে তাদের অধিকাংশই পাপাচারী হাদীদ ১৬ 

এখনই ! এই এখনই ! মু’মিনদের জন্য এখনই তওবা করার জন্য সঠিক সময়, কারণ, বলা হয়েছে, “يَأْنِ ইয়া’নি”, এর মানে হচ্ছে ঠিক এখনই, বুড়ো হয়ে তারপর নয়।

আপনি যদি কুর’আন পড়েন তাহলে দেখবেন, যেসব আয়াতে ক্বিয়ামাহ এর দিনে লোকেদের আর্তচিৎকারের কথা এসেছে তার পেছনের কারণটা হচ্ছে তাসউইস, তাসউইস মানে গড়িমসি বা কালক্ষেপণ করা।
 ক্বিয়ামাহ এর দিনে মানুষগুলো বলতে থাকবে, হে আল্লাহ আমাদেরকে দুনিয়াতে ফেরত পাঠান যেন আমি ভাল কাজে খরচ করতে পারি, তারা বলবে আমাকে ফিরিয়ে নিন যেন সৎ কাজ করতে পারি। – এর সবই হচ্ছে সময়-সুযোগ থাকার পরেও গড়িমসি করে সেগুলো নষ্ট করার জন্য সৃষ্ট আফসোস।

 রাসূল (সাঃ) বলেছেন, যে ব্যাক্তি আল্লাহর সাক্ষাৎ কামনা করে, আল্লাহ তার সাথে সাক্ষাৎ করতে ভালবাসেন এবং যে ব্যাক্তি আল্লাহর সাথে দেখা করতে অপছন্দ করবে, আল্লাহও তার সাথে দেখা করতে অপছন্দ করবেন

 আইশা (রাঃ) যখন এই কথা শুনলেন, তখন তিনি বললেন,“আমরা কেউই তো মৃত্যুকে পছন্দ করি না”, অর্থাৎ তিনি বুঝাতে চাইলেন, যে, কেউ যখন মৃত্যুকে ভালবাসেই না তার মানে কেউই তো আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করতে চাইবে না। আমরা মৃত্যুকে অপছন্দ করি, এর মানে কি এই যে আমরা আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎকেও অপছন্দ করি? ”আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তাকে শুধরে দিয়ে বললেন, “আমি তো এটা বুঝাই নি। মু’মিন ব্যাক্তি যখন মৃত্যুর সন্নিকটে পৌছে যাবে, তখন তার কাছে এই খবরটা পৌছে দেয়া হবে যে আল্লাহ তার উপর সন্তুষ্ট এবং আল্লাহ তাকে সম্মানিত করবেন। এটা শুনে তার কাছে সবচেয়ে প্রিয় হবে এই যে সে সামনের দিকে অর্থাৎ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবে এবং আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎকে সে ভালবাসবে এবং আল্লাহও তার সাথে সাক্ষাৎকে ভালবাসবেন।

কিন্তু যখন কাফিররা মৃত্যুর কাছাকাছি এসে উপস্থিত হবে, তখন তাকে বলা হবে আল্লাহ তোমার উপর রাগান্বিত এবং আল্লাহ তাকে শাস্তি দেবেন। এটা শোনার পর তার মরতে ইচ্ছা করবে না এবং আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎকে সে ভয় পেতে শুরু করবে এবং অপছন্দ করবে। আর তাই আল্লাহ তা’আলা ও তার সাথে দেখা করতে চাইবেন না।

এমনকি মৃত্যুর পরেও, জানাযার নামাযের পর যখন কাধে করে লাশ নিয়ে যাওয়া হবে তখন মু’মিন ব্যাক্তি বলবে, আমাকে যত দ্রুত সম্ভব নিয়ে যাও। আর পাপাচারী ব্যাক্তি বলবে, তোমরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?? আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলছেন, মানুষ ছাড়া প্রত্যেকে এই কথাগুলো শুনবে এবং মানুষ যদি এই কথাগুলো শুনতে পেত তাহলে তারা ভয়েই মরে যেত।

আস-সা’আত, বা সে মৃত্যু যা প্রচন্ড ধাক্কা বা ভয়ের কারণে হয়, এটাই হতে পারত আমাদের বাস্তবতা, যা আমরা জানিনা। এই শব্দ এতটাই ভয়ংকর যে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)বলছেন,“আমি আল্লাহর কাছে আবেদন করতাম যেন তোমরা কবরবাসীর আওয়াজ শুনতে পাও। কিন্তু আমি ভয় করি, সে আওয়াজ শুনলে তোমরা আর কেউই মৃত ব্যাক্তিকে কবর দিতে সাহস করতে না”।

সাল্লাল্লাহু আলা সাইয়িদিনা মুহাম্মাদ ওয়া আলা আলিহি , ওয়া সাহবিহী ওয়া সাল্লাম তাসলীমান কাসীরাহ।