পরকালের পথে যাত্রা – পর্ব ১৫ – কিয়ামতের পরিচয়

কিয়ামত দিবসের নামসমূহ

কিয়ামত দিবসকে অনেক নাম দেওয়া হয়েছে কারণ এটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আরবি ভাষায়, অথবা পৃথিবীর যেকোন ভাষাতে তাৎপর্যপূর্ণ, গুরুত্বপূর্ণ  কোনো কিছুকে অনেকগুলো নাম দেওয়া হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, আরবিতে ঘোড়াকে অনেক নাম দেওয়া হয়, শুধুমাত্র ঘোড়া শব্দটির অনেকগুলো প্রতিশব্দ আছে, এছাড়াও প্রজাতি, রঙ ইত্যাদি বিবেচনা করে আরও নাম দেয়া হয়েছে। একইভাবে, ইংরেজিতে মদ এর অনেক নাম আছে। কেন? কারণ, এটা তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। প্রাক-ইসলামিক যুগে মদের ৮০ টি নাম দেওয়া হয়েছিল কারণ এটা সে সময় তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

কিয়ামত দিবস আমাদের মুসলিমদের নিকট এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে ঠিক একইভাবে এটিকেও অনেকগুলো নাম দেওয়া হয়েছে। এই নামগুলো কিয়ামত দিবসে কি ঘটবে তা বর্ণনা করে। আমরা কিয়ামত দিবসের কয়েকটি নাম নিয়ে আলোচনা করব।

১। আল-ক্বিয়ামাহ

এটি সবচেয়ে পরিচিত নাম। এই নামটি এসেছে “কিয়াম” হতে। “কিয়াম” অর্থ দাঁড়ানো। সুতরাং কিয়ামত দিবস হচ্ছে একটি দিবস যেদিন সকল মানুষ দাঁড়িয়ে থাকবে। “ 

“যেদিন মানুষ দাঁড়াবে বিশ্ব পালনকর্তার সামনে।” (আল-কুরআন, ৮৩:৬)”। 

আপনি বসতে বা শুতে পারবেন না, আপনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে ৫০০০০ বছর !!!

আল্লাহ আরও বলেন, “ ‘আল্লাহ ব্যতীত আর কোনোই উপাস্য নেই। অবশ্যই তিনি তোমাদেরকে সমবেত করবেন কেয়ামতের দিন, এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তাছাড়া আল্লাহর চাইতে বেশী সত্য কথা আর কার হবে!”

(আল-কুরআন, ৪:৮৭)

২। আল ইয়াওম আল-আখিরাহ

এটিও অত্যন্ত পরিচিত একটি নাম। আল-ইয়াওম আল-আখির অর্থ হল শেষ দিবস। এর পরে আর কোনো দিবস নাই। এটিই হবে পৃথিবীর শেষ দিবস। 

আল্লাহ বলেন, “সৎকর্ম শুধু এই নয় যে, পূর্ব কিংবা পশ্চিমদিকে মুখ করবে, বরং বড় সৎকাজ হল এই যে, ঈমান আনবে আল্লাহর উপর শেষ দিবসের (আল-ইয়াওম আল-আখির) উপর, ফেরেশতাদের উপর এবং সমস্ত নবী-রসূলগণের উপর” (২:১৭৭)

আল ইয়াওম অথবা আল আখিরাহ, যার অর্থ শেষ দিন, পরিসমাপ্তি এই দুনিয়ার শেষ, আখের।

 

৩। আস-সা’’আহ

এর অর্থ “সেই মুহুর্তটি”। ইহাই সেই মুহুর্ত, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহুর্ত।

আল-কুরতুবী বলেছেন, “আরবিতে, আস-সা’আ অর্থ অনির্ধারিত সময়। এটির অর্থ হতে পারে এক ঘণ্টা, দিনের ২৪ ভাগের ১ ভাগ। সুতরাং এটিকে “সেই ঘণ্টা” বলা যেতে পারে। আস-সা’আ এর সাথে “আল” যুক্ত থাকলে এটিকে বলা যেতে পারে “এই মুহুর্ত”। তিনি বলতে চাচ্ছেন যে, কিয়ামত কে এই নামকরণ করা হয়েছে কারণ এই মুহুর্তটি অতি নিকটবর্তী !!

২য় ব্যখ্যাটি হচ্ছে,এটিকে “সেই মুহুর্ত” বলা হয় কারণ এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহুর্ত, যখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী সংঘটিত হবে। অথবা, এটিকে “সেই মুহুর্ত” বলা যেতে পারে কারণ মুহুর্তটি হঠাৎ করে চলে আসবে।

এই তিনটি ব্যখ্যা আল-কুরতুবি কর্তৃক প্রদত্ত। আল্লাহ বলেছেন, হে লোক সকল! তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর। নিশ্চয় কেয়ামতের প্রকম্পন একটি ভয়ংকর ব্যাপার।(২২:১)

৪। ইয়াওম আল বা

ইয়াওম আল বা’থ এর অর্থ হচ্ছে পুনরুত্থান দিবস। এইরুপ নামকরণের কারন এই দিবসে আমাদের নতুন জীবন দেওয়া হবে এবং আমাদের আমাদের দেহ পুনরায় সৃষ্টি করা হবে। এটি হবে আমাদের ২য় সৃষ্টি।

আল্লাহ বলছেন,“হে লোকসকল! যদি তোমরা পুনরুত্থানের ব্যাপারে সন্দিগ্ধ হও,তবে (ভেবে দেখ) আমি তোমাদেরকে মৃত্তিকা থেকে সৃষ্টি করেছি।…” (২২:৫)

৫। ইয়াওম আল-খুরুজ

আল-খুরুজ অর্থ উত্থিত/আবির্ভুত হওয়া। কিয়ামত কে উত্থান দিবস/ আবির্ভাবের দিবস বলা হয় কারণ এই দিবসে আমরা সকলেই আমাদের কবর থেকে উত্থিত হব/বের হয়ে আসব।

আল্লাহ বলছেন,“যেদিন মানুষ নিশ্চিত সেই ভয়াবহ আওয়াজ শুনতে পাবে, সেদিনই পুনরত্থান দিবস।” (৫০:৪২)

৬। আল-ক্বারিয়াহ

একে বলা যায় “দুর্যোগ”। এটি এমন কিছু যা অন্তরে আঘাত করে।

আল্লাহ বলেন, “করাঘাতকারী (আল-ক্বারিয়াহ), করাঘাতকারী কি, করাঘাতকারী সম্পর্কে আপনি কি জানেন?” (১০১: ১-৩)

৭। ইয়াওম আল-ফাসল

ইয়াওম আল-ফাসল অর্থ ফয়সালা করার দিন। “আল-ফাসল” অর্থ যখন সকল বিবাদের মিমাংসা হয়ে যাবে। অর্থাৎ যখন আল্লাহ মানুষের বিচার করবেন- যা সে করেছে অথবা বলেছে।

আল্লাহ বলছেন, “এটা বিচার দিবস,আমি তোমাদেরকে এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে একত্রিত করেছি।” (৭৭:৩৮)

 

৮। ইয়াওম আল-হাসরা

ইয়াওম আল-হাসরা অর্থ অনুশোচনার দিবস। বিচার দিবসে অনেক অনুশোচনা হবে। কাফেররা অনুশোচনা করবে কারণ তারা মুসলিম হয়ে মৃত্যুবরণ করেনি। অন্যদিকে মুসলিমরা অনুশোচনা করবে যে তারা আল্লাহর আদেশ নিষেধ মেনে চলেনি,সৎকর্ম করেনি।

আল্লাহ্‌ বলেন, “জালেম সেদিন আপন হস্তদ্বয় দংশন করতে করতে বলবে,হায় আফসোস! আমি যদি রসূলের সাথে পথ অবলম্বন করতাম।”(২৫:২৭)- কাফেরদের অনুশোচনা এত তীব্র হবে যে সেদিন তারা নিজেদের নখ নয় বরং হাত কামড়াবে ।

আল্লাহ্‌ আরও বলেন, “
আপনি তাদেরকে পরিতাপের দিবস (ইয়াওম আল হাসরা) সম্পর্কে হুশিয়ার করে দিন যখন সব ব্যাপারের মীমাংসা হয়ে যাবে। এখন তারা অনবধানতায় আছে এবং তারা বিশ্বাস স্থাপন করছে না। ” (১৯:৩৯)

৯। ইয়াওম আল-হিসাব

ইয়াওম এল হিসাব অর্থ হিসাব গ্রহণের দিন।

আল্লাহ্‌ বলছেন, “মূসা বলল,যারা হিসাব দিবসে বিশ্বাস করে না এমন প্রত্যেক অহংকারী থেকে আমি আমার ও তোমাদের পালনকর্তার আশ্রয় নিয়ে নিয়েছি।” (৪০:২৭)

১০। আল- ওয়াক্বিয়াহ

আল-ওয়াক্বিয়াহ অর্থ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।

১১। আল-হাক্কাহ

আল-হাক্ব অর্থ অনিবার্য সত্য অথবা বাস্তব।

আল্লাহ্‌ বলেন, “সুনিশ্চিত বিষয়। সুনিশ্চিত বিষয় কি? আপনি কি জানেন সেই সুনিশ্চিত বিষয় কি?”

(৬৯:১-৩)

১২। ইয়াওম আল-তালাক্ব

ইয়াওম আল-তালাক্ব অর্থ সাক্ষাৎ দিবস।

আল্লাহ্‌ বলেন, “তিনিই সুউচ্চ মর্যাদার অধিকারী,আরশের মালিক,তাঁর বান্দাদের মধ্যে যার প্রতি ইচ্ছা তত্ত্বপূর্ণ বিষয়াদি নাযিল করেন,যাতে সে সাক্ষাতের দিন সম্পর্কে সকলকে সতর্ক করে।” (৪০:১৫)

ইবনে কাথির বলেছেন, ইবনে আব্বাস বলেনঃ এটিকে সাক্ষাৎ দিবস বলা হয় কারণ এই দিবসে আদম তার সর্বশেষ সন্তানের সাথে সাক্ষাৎ করবে। আদমের সকল সন্তান সেদিন সাক্ষাৎ করবে একে অপরের সাথে।

আল-ক্বাতাদাহ এবং আস-সুদ্দি বলেনঃ এই দিবসে দুনিয়ার সৃষ্টি সাক্ষাৎ করবে জান্নাতের সৃষ্টির সাথে এবং সৃষ্টিকর্তা সাক্ষাৎ করবেন তাঁর সৃষ্টির সাথে।

এবং মায়মুন ইবনে মাহরাম বলেছেনঃ এই দিবসে জুলুমকারী সাক্ষাৎ করবে মজলুম এর সাথে।

১৩। ইয়াওম আল-তানাদ

ইয়াওম আল-তানাদ অর্থ আহবান দিবস। আল্লাহ্‌ বলেন, “হে আমার কওম,আমি তোমাদের জন্যে প্রচন্ড হাঁক-ডাকের দিনের আশংকা করি।” (৪০:৩২)

এটিকে এইরুপ নামকরণ করা হয়েছে কারণ এই দিনে অসংখ্য আহবান করা হবে- প্রথমে সকলকে ডাকা হবে সমবেত হওয়ার জন্য, মজলুমরা ডাকবে জুলুমকারীদের এবং পুজারীরা ডাকবে তাদেরকে যাদের তারা পুজা করত।

 

কিয়ামত দিবসের একটি অন্যতম গুরুত্বপুর্ন ব্যপার হচ্ছে হিসাব। সেদিন বেশ কয়েকটি পর্যায় থাকবে। শুরুতেই, মহাবিশ্বের পরিবর্তন হবে, অতঃপর সকল মানুষের সমাবেশ, অতঃপর হাশর এবং তারপর হবে প্রার্থনা,অনুনয়-বিনয়। অতঃপর হবে হিসাব, যেটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং কিয়ামত দিবসের প্রধান অংশ। সে জন্যই কিয়ামত দিবস হবে যাতে মানুষের কৃতকর্মের হিসাবনিকাশ হয় এবং জান্নাত কিংবা জাহান্নামের অধিবাসীদের পৃথক করা যায়।

আল্লাহ্‌ বলেন, “তারা আপনার পালনকর্তার সামনে পেশ হবে সারিবদ্ধ ভাবে এবং বলা হবেঃ তোমরা আমার কাছে এসে গেছ; যেমন তোমাদেরকে প্রথম বার সৃষ্টি করেছিলাম। না,তোমরা তো বলতে যে,আমি তোমাদের জন্যে কোন প্রতিশ্রুত সময় নির্দিষ্ট করব না।” (১৮:৪৮)

বিচার দিবসের কিছু নিয়ম কানুন, মূলনীতি  

আলদলন্যয়পরায়নতা

বিচার দিবস এমন একটি দিন যেদিন সকল ন্যয়বিচার হবে এবং আল্লাহর অনেকগুলো নামের একটি হচ্ছে আল-আদল (ন্যয়পরায়ন)। আল্লাহ্‌ কারও প্রতি অবিচার করবেন না। তিনি প্রত্যেককে তার পাওনা দিবেন।

আল্লাহ্‌ বলেন, “ঐ দিনকে ভয় কর,যে দিন তোমরা আল্লাহর কাছে প্রত্যাবর্তিত হবে। অতঃপর প্রত্যেকেই তার কর্মের ফল পুরোপুরি পাবে এবং তাদের প্রতি কোন রূপ অবিচার করা হবে না।” (২:২৮১)

বিচারের মাপকাঠি অতি সূক্ষ্ণ। আল্লাহ্‌ আপনাকে তা ই দেবেন যা আপনার প্রাপ্য, এমনকি তা যদি শস্যদানা পরিমাণও হয়। 

আল্লাহ্‌ বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ কারো প্রাপ্য হক বিন্দু-বিসর্গও রাখেন না; আর যদি তা সৎকর্ম হয়, তবে তাকে দ্বিগুণ করে দেন এবং নিজের পক্ষ থেকে বিপুল সওয়াব দান করেন।” (৪:৪০)

লুকমান (আঃ) তাঁর পুত্রকে উপদেশ দেবার সময় বলেছেন, “হে বৎস,কোন বস্তু যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয় অতঃপর তা যদি থাকে প্রস্তর গর্ভে অথবা আকাশে অথবা ভূ-গর্ভে,তবে আল্লাহ তাও উপস্থিত করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ গোপন ভেদ জানেন, সবকিছুর খবর রাখেন।” (৩১:১৬)

আল্লাহ্‌ বলছেন, “অতঃপর কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তা দেখতে পাবে। এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে তাও দেখতে পাবে।” (৯৯:৭-৮) 

লুকমান (আঃ) এর তার পুত্রের প্রতি প্রথম উপদেশ ছিল “লা-তুশ্রিক বিল্লাহ” অর্থাৎ আল্লাহ্‌র সাথে কারও শরীক করোনা। অতঃপর দ্বিতীয় উপদেশ ছিল- পিতামাতার প্রতি দয়াশীল হও। 
মিসিংএরপরের উপদেশ, সালাহর পূর্বে 
তিনি চেয়েছিলেন তাঁর সন্তানের মধ্যে আল্লাহর মুরাকাবাহ সম্পর্কে বুঝ আসার জন্য- অর্থাৎ এই বুঝ যে আল্লাহ্‌ তা’আলা সর্বদা তাকে লক্ষ্য করছেন।

এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, আমাদের উচিৎ আমাদের ও আমাদের সন্তানদের হৃদয়ে এই বিশ্বাস ধীরে ধীরে জাগিয়ে দেওয়া যে আল্লাহ্‌ সর্বদা আমাদের দেখছেন। অভিভাবক হিসাবে আমাদের চেষ্টা করা উচিৎ আমাদের সন্তানদের গতিবিধি লক্ষ্ণ করা- অর্থাৎ তারা কোথায় যাচ্ছে এবং কি করছে ইত্যাদি। আপনি যতই চেষ্টা করেন না কেন, আপনি সবকিছু জানতে পারবেন না কারণ আমাদের সবকিছুই সীমিত। তাদের জন্য সর্বোত্তম উপায় যা খারাপ কাজ হতে দূরে রাখে তা হল আল্লাহ্‌র ভয়। যদি তাদের এই গুণটি থাকে তাহলে আপনি তাদের আশেপাশে না থাকলেও তারা আল্লাহকে ভয় করবে।

সন্তানরা আমাদের ভয় করবে এমন মনোভাব গড়ে তোলা সঠিক উপায় নয়। কারণ যখন আমরা তাদের আশেপাশে থাকবনা, তখন কেন তারা আমাদের ভয় করবে? আমরা যদি তাদের মধ্যে আল্লাহর ভয় জাগিয়ে দিতে পারি, সেটা সবচেয়ে শক্তিশালী। তারা জানবে যে তারা যেখানেই থাকুক না কেন, আল্লাহ্‌ তাদের দেখছেন।

লুকমান (আঃ) এর একটি বক্তব্য আছে, লুকমান (আঃ) তাঁর পুত্রকে বলেছিলেন, “ও আমার পুত্র, তুমি যদি পাপ কাজ করতে চাও, এগিয়ে যাও এবং কর সেটি, কিন্তু কাজটি এমন কোথাও করবে যেখানে আল্লাহ্‌ তোমাকে দেখতে পাবেন না।” 

সুতরাং, আল্লাহ্‌ আমাদের সকল কাজকর্ম দেখছেন- এই বিশ্বাস নিজেদের মধ্যে গড়ে তুলা পাপ কাজের বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার।

‘ইহসান হল, আল্লাহর ইবাদত কর এমনভাবে যাতে তুমি উনাকে দেখছ। তুমি যদি তাঁকে নাও দেখ, তিনি তোমাকে দেখছেন।’

নিজস্ব জবাবদিহিতা

আপনি দুনিয়াতে যা করেছেন তাঁর জন্য আপনিই দায়ী। অন্য কেউ কি করল তাঁর জন্য আপনি দায়ী নন। আপনাকে প্রশ্ন করা হবে শুধু আপনি দুনিয়াতে যা করেছেন তাঁর হিসাব দেওয়ার জন্য, অন্য কেউ কি করল তাঁর জন্য আপনাকে জবাবদিহিতা করতে হবে না।

খ্রিষ্টান ধর্মে আছে, একটি প্রাচীন পাপ অরিজিনাল সিন ছিল যা অন্য কেউ করেছিল, তারা এটাকে আদমের উপর আরোপ করেছে। খ্রিষ্টধর্ম মতে, আদম হাজার হাজার বছর আগে যা করেছে তাঁর জন্য আমাদের জবাবদিহিতা করতে হবে। গুনাহটি আমাদের দ্বারা হয়নি, বরং আদমের দ্বারা হয়েছিল এবং খ্রীস্টানরা বলে যে, আমাদের এটার জন্য জবাবদিহিতা করতে হবে! কে এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবে? আমরা নই, বরং ঈসা (আঃ)- আমাদের হয়ে এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবেন- খ্রিস্টানদের এরূপই বিশ্বাস। এটি সাধারন বিবেকের পরিপন্থী। কেন নিষ্পাপ (ঈসা (আঃ)) কে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে যেসব পাপ আমরা সাধারন মানুষেরা করি? এটি ন্যয়বিচারের পরিপন্থী।

আল্লাহ্‌ আমাদের দায়ী করবেন আমাদের নিজেদের কৃতকর্মের জন্য। আল্লাহ্‌ বলছেন, “যে কেউ সৎপথে চলে,তারা নিজের মঙ্গলের জন্যেই সৎ পথে চলে। আর যে পথভ্রষ্ট হয়,তারা নিজের অমঙ্গলের জন্যেই পথ ভ্রষ্ট হয়। কেউ অপরের বোঝা বহন করবে না। কোন রাসূল না পাঠানো পর্যন্ত আমি কাউকেই শাস্তি দান করি না।” (১৭:১৫) 

আপনি মুসলিম হওয়ার দরুন কাউকে অনুগ্রহ করছেন না। বরং, যে হেদায়াতপ্রাপ্ত হয়েছে, সে নিজের কৃত ভাল কর্মের জন্যই হেদায়াতপ্রাপ্ত হয়েছে। আপনি কাউকে অনুগ্রহ করে মসজিদে সালাত আদায় করতে যাচ্ছেন না। আপনি আল্লাহকে অনুগ্রহ করে তাঁর ইবাদত করছেন না, এটি করছেন আপনার নিজের ভালোর জন্যই। একইভাবে, আপনি যদি পথভ্রষ্ট হন, এটা আপনার জন্যই ক্ষতিকর।

নিজের কৃতকর্মের দায়বদ্ধতা নিজের- এই বার্তা রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কর্তৃক আনিত নতুন কোন বার্তা নয়, বরং এই বার্তা ছিল পুর্বের সকল নবী-রাসুলদের- ঈসা(আঃ), ইবরাহিম (আঃ), নুহ (আঃ), আদম (আঃ) সকলের। 

আল্লাহ্‌ বলছেন, “তাকে কি জানানো হয়নি যা আছে মূসার কিতাবে,এবং ইব্রাহীমের কিতাবে,যে তার দায়িত্ব পালন করেছিল? কিতাবে এই আছে যে,কোন ব্যক্তি কারও গোনাহ নিজে বহন করবে না। এবং মানুষ তাই পায়,যা সে করে,তার কর্ম শীঘ্রই দেখা হবে। অতঃপর তাকে পূর্ণ প্রতিদান দেয়া হবে।” (৫৩:৩৬-৪১)

অসঙ্গতিপূর্ন?

আপনি যখন কুরআনের কিছু আয়াত পড়বেন, কিছুক্ষেত্রে অসঙ্গতি মনে হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ,
আল্লাহ্‌ বলছেন, “তারা নিজেদের পাপভার এবং তার সাথে আরও কিছু পাপভার বহন করবে। …” (২৯:১৩) 

এই আয়াতে যা বলা হয়েছে তা এই মতের বিরোধী মনে হতে পারে যে- প্রত্যেকে তাঁর নিজের পাপের বোঝা বহন করবে। আমরা এই অসঙ্গতির উত্তর একই আয়াতেই পাইঃ “… অবশ্য তারা যে সব মিথ্যা কথা উদ্ভাবন করে,সে সম্পর্কে কেয়ামতের দিন জিজ্ঞাসিত হবে।” (২৯:১৩) 

তারা মিথ্যা প্রচার করত এবং অন্যান্য লোকেরা তাদের মিথ্যা সংবাদ কেই অনুসরণ করত। সুতরাং, তারা ঐ সকল লোকদের পাপের বোঝা বহন করবে যারা তাদের মিথ্যা কথাগুলি অনুসরণ করত। এটা সত্য যে আপনি কেবল আপনার নিজের পাপের বোঝাই বহন করবেন, কিন্তু আপনার কারণে অন্যের করা পাপের জন্যও আপনিই দায়ী। এর মানে এই নয় যে, ঐ সকল মানুষ তাদের পাপের বোঝা বহন করা থেকে মুক্ত, তারাও তাদের পাপের বোঝা বহন করবে। আপনি যদি অন্য মানুষের করা ৫ টি পাপের কারণ হয়ে থাকেন, তাহলে যারা ঐ পাপ কাজগুলি করেছে তারা নিজেরা ঐ পাপ কাজগুলির জন্য দায়ী হবে এবং পাপের বোঝা করবে, এবং তাদের সাথে আপনিও ঐ পাপ কাজগুলির বোঝা বহন করবেন, কারণ আপনার জন্যই লোকেরা ঐ পাপ কাজগুলি করেছিল।

আগেই বলা হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, যে কেউ একটি ভাল কাজ (সুন্নাহ) এর প্রচলন  করবে লোকদের মাঝে, কিয়ামত পর্যন্ত সে তাদের সকলের পুরষ্কার এর সমান পুরষ্কার পাবে যারা ঐ সুন্নত অনুসরণ করবে। এবং যে কেউ একটি খারাপ কাজ এর প্রচলন করবে লোকদের মাঝে, কিয়ামত পর্যন্ত সে তাদের সকলের পাপ এর সমান পাপ কামাই করবে যারা ঐ পাপ কাজ করবে। 

সুতরাং, আলেমরা বলেছেন, একজন লোকের জন্য ইহাই যথেষ্ট যে, একজন লোক একটি খারাপ কাজ গোপনে না করে জনসমক্ষে করে যাতে লোকেরা তা অনুসরণ করে। এটা আমরা আগেই আলোচনা করেছি।

রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “ কিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষকে অন্যায়ভাবে খুন করা হবে, সকল খুনের পাপের একটা অংশ বহন করবে সে, যে সর্বপ্রথম  পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে মানুষকে হত্যা করার প্রচলন করেছে (বলা হয়ে থাকে এটি ছিল ক্বাবিল)” (বুখারিঃ ৯/৮৩/৬, বুখারি ৯/৯২/৪২৩, মুসলিম ১৬,৪১৫৬)

কৃতকর্মের উপস্থাপন

বিচার দিবসে, আপনার সকল কৃতকর্ম আপনার সামনে উপস্থাপন করা হবে। আপনি যা করেছিলেন, আপনি সবকিছু দেখতে পাবেন। 

আল্লাহ্‌ বলেন, “cutতোমাদের সবাইকে আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে হবে। তখন তিনি তোমাদেরকে বলে দেবেন,যা কিছু তোমরা করতে।” (৫:১০৫)

কৃতকর্ম সমূহ একটি বই আকারে উপস্থাপন করা হবে । আল্লাহ বলেন, “ আমি প্রত্যেক মানুষের কর্মকে তার গ্রীবালগ্ন করে রেখেছি। কেয়ামতের দিন বের করে দেখাব তাকে একটি কিতাব, যা খোলা অবস্থায় পাবে।পাঠ কর তুমি তোমার কিতাব। আজ তোমার হিসাব গ্রহণের জন্যে তুমিই যথেষ্ট।” (১৭:১৩) 

সকল কর্মের বিস্তারিত বিবরণ সেখানে উল্লেখ করা থাকবে, কিছুই বাদ পড়বে না। আপনার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হবে – বিচার দিবস দীর্ঘায়িত হওয়ার ক্ষেত্রে এটা একটি কারণ হতে পারে।

আল্লাহ বলেন “আর আমলনামা সামনে রাখা হবে। তাতে যা আছে; তার কারণে আপনি অপরাধীদেরকে ভীত-সন্ত্রস্ত দেখবেন। তারা বলবেঃ হায় আফসোস, এ কেমন আমলনামা। এ যে ছোট বড় কোন কিছুই বাদ দেয়নি-সবই এতে রয়েছে। তারা তাদের কৃতকর্মকে সামনে উপস্থিত পাবে। আপনার পালনকর্তা কারও প্রতি জুলুম করবেন না।” (১৮:৪৯) 

গুনাহগার বান্দারা তাদের পাপে পরিপূর্ণ এ বিশাল বই দেখে বেপরোয়া হয়ে পড়বে।

 

আল্লাহ আমাদের প্রতি দয়া এবং ক্ষমা সরূপ আমাদের গুনাহ সমূহকে বৃদ্ধি করবেন না। কিন্তু আমাদের নেক আমল সমূহকে ১০ গুন বৃদ্ধি করে দিবেন। আল্লাহ বলেন, “যে একটি সৎকর্ম করবে, সে তার দশগুণ পাবে এবং যে, একটি মন্দ কাজ করবে, সে তার সমান শাস্তিই পাবে। বস্তুতঃ তাদের প্রতি জুলুম করা হবে না।” (৬:১৬০) 

এই আয়াতে আল্লাহ বলেছেন তিনি নেক আমল সমূহগুলো ১০ গুন বৃদ্ধি করে দিবেন, আর এটা হচ্ছে সর্বনিম্ন। সুবহানাল্লাহ ।

 

যে সকল আমল ১০ গুন বৃদ্ধি করা হবে

এমনকি ১০ গুণের চেয়েও বেশি বাড়িয়ে দেওয়া হয় এমন কিছু নেক আমল আছে। যেমন, কুরআন এর প্রতিটি অক্ষরের জন্য ১০ নেকী। তিরমিযী শরীফে বর্ণিত এক হাদিসে, ইবন মাসুদ (রা) বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “ আলিফ-লাম-মীম একটি অক্ষর নয়, বরং আলিফ একটি অক্ষর, লাম একটি অক্ষর এবং মীম একটি অক্ষর। ”

 

আব্দুল্লাহ ইব্‌ন আমর থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: দুটি স্বভাব যে কোন মুসলিম আয়ত্ব করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে, যা খুবই সহজ কিন্তু তার উপর আমলকারীর সংখ্যা খুব কম। 
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, প্রত্যেক সালাতের পর ১০বার তাসবিহ, ১০বার তাহমিদ ও ১০বার তাকবির বলবে। এভাবে মুখে ১৫০বার উচ্চারণ করা হবে, কিন্তু মিজানে তার ওজন হবে ১৫০০ বলার। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হাত দিয়ে গুনতে দেখি। যখন তোমাদের কেউ শুতে বিছানায় যাবে ৩৩বার তাসবিহ পড়বে, ৩৩বার তাহমিদ পড়বে ও ৩৪বার তাকবির পড়বে, এভাবে মুখে ১০০বার হলেও মিজানে তার ওজন হবে ১০০০বার।  তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: তোমাদের এমন কে আছে, যে দিনে দুই হাজার পাঁচ শত পাপ করে? তাকে বলা হল: আমরা তাহলে এগুলো কেন পড়ব না? তিনি বললেন: তোমাদের কেউ যখন সালাতে থাকে, তখন শয়তান আগমন করে বলে: এটা স্মরণ কর, ওটা স্মরণ কর, এবং ঘুমের সময় আসে অতঃপর তাকে ঘুম পারিয়ে দেয়। ইব্‌ন মাজার শব্দ এরূপ: শয়তান তাকে ঘুম পারানো চেষ্টা করে, অবশেষে সে ঘুমিয়ে যায়। নাসায়ি: (১৩৪৮), ইব্‌ন মাজাহ: (৯২৬), আবু দাউদ: (৫০৬৫), তিরমিযি: (৩৪১০), আহমদ: (২/৫০২), সহিহ সুনানে নাসায়ি: (১/২৯০), সহিহ ইব্‌ন মাজাহ: (১/১৫২), হাকেম হাদিসটি সহিহ বলেছেন, ইমাম জাহাবি তার সমর্থন করেছেন, হাকেম: (১/২৫৫)

অপর একটি হাদিস, যা আত তিরমিযী এবং আন নাসাই এ বর্ণিত, আবদুল্লাহ ইবন আমর ইবন আল আস বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন,“ দুইটি আমল এর উপর যদি তোমরা অটল থাকতে পার, জান্নাত হবে তোমাদের পুরস্কার। আমল সমূহ সহজ কিন্তু এর উপর আমলকারীর সংখ্যা কম। প্রত্যেক সালাতের শেষে ১০ বার সুবহানাল্লাহ, ১০ বার আলহামদুলিল্লাহ এবং ১০ বার আল্লাহু আকবার বলবে ( অপর একটা হাদিসে ৩৩ বার করে বলার কথা উল্লেখ আছে )।” আবদুল্লাহ বলেছেন, “ আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)  কে নিজ হাতে গুনতে দেখেছি, যা উনার বক্তব্যে ১৫০ বার” আবদুল্লাহ ১৫০ বার কিভাবে পেল ? প্রতি সালাত শেষে ৩০ বার করে। এরপর আবদুল্লাহ বলেন, “ কিন্তু বিচার দিবসে তা ১৫০০ হিসেবে ধার্য হবে।”  এভাবেই একটি নেক আমলের জন্য ১০ গুন পুরস্কার। দ্বিতীয় বিষয় হল “ যখন তুমি ঘুমাতে যাবে, তাসবীহ,তাহমীদ এবং তাকবীর দ্বারা ১০০ বার পূর্ণ করবে” তাই আপনাদের ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ এবং ৩৪ বার আল্লাহু আকবার দ্বারা ১০০ বার পূর্ণ করতে হবে। আর ইহা বিচার দিবসে ১০০০ বার হিসেবে ধার্য হবে। এরপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)   জিজ্ঞেস করলেন,“ তোমাদের মাঝে কে প্রতিদিন ২৫০০ গুনাহ করে ? ’’  রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এ বিষয়টিকে আমাদের জন্য একটি সুযোগ হিসেবে গণ্য করেছেন কারণ আমরা প্রচুর পরিমানে নেকী অর্জন করছি এবং আমরা হয়তবা ঐ পরিমানের গুনাহ করছি না। এরপর সাহাবী বললেন, “ আমরা কেন এই আমল গুলো করবা না ? ( যা আমাদের নিকট সহজ ) ” রাসূলুল্লাহ (সাঃ)   বললেন, “ শয়তান তোমার সালাতের সময় এসে, তোমাকে তোমার কোন কাজের কথা স্মরণ করিয়ে দিবে যার কারনে তুমি সালাত শেষ করে জিকির না করেই চলে যাবে। এবং শয়তান তোমার ঘুমের সময় আসবে এবং তোমাকে জিকিরের আগেই তন্দ্রাছন্ন করে দিবে।”

আজ মসজিদে এ বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়। ইমামের সালাতের শেষে খুব কম লোকই জিকির করে। এছাড়া আরও কিছু জিকির আছে যেমন আয়াতুল কুরসি, কুলস (শেষ চার সূরা ) আর কিছু সালাতের শেষে নির্দিষ্ট কিছু জিকির রয়েছে।

 

সালাত শেষে এ জিকির সমূহ বেশ সহজ এবং আর সহজ বলেই আমরা তুচ্ছ জ্ঞান করি, অবহেলা করি। কিন্তু এ আমল সমূহ তুচ্ছ নয়, এই সহজ জিকির গুলোর দ্বারা আমাদের পক্ষে দিনে ২৫০০ নেকী অর্জন সম্ভব। 

নেকী বৃদ্ধির আরেকটি উদাহারন হচ্ছে সালাত। মুলত আমাদের উপর ৫০ ওয়াক্ত সালাত ফরয হয়েছিল। মুসা (আ), রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে এই সালাতের বিধান কমিয়ে আনতে অনুরোধ করেন এবং তা কমে ৫ ওয়াক্ত হয়। আল্লাহ, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে বলেন তোমাদের ৫ ওয়াক্ত সালাত আদায় করতে হবে কিন্তু তা ৫০ ওয়াক্ত হিসেবে ধার্য হবে। এটি বুখারির একটি হাদিস।

যে সকল আমল আরও বেশি বৃদ্ধি হবে

আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দান করা

আল্লাহ বলেন, “যারা আল্লাহর রাস্তায় স্বীয় ধন সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উদাহরণ একটি বীজের মত, যা থেকে সাতটি শীষ জন্মায়। প্রত্যেকটি শীষে একশ করে দানা থাকে। আল্লাহ অতি দানশীল, সর্বজ্ঞ।” (২:২৬১) সর্বমোট পুরস্কার হল ৭০০। আল্লাহ বলেছেন যে, তিনি যাকে ইচ্ছা তার পুরস্কার বৃদ্ধি করে দিতে পারেন – তাই সে ক্ষেত্রে আরও বেশী পুরস্কার রয়েছে।

ইবন আব্বাস বলেছেন হজ্জ কিংবা জিহাদে ১ দিরহাম খরচ করা হলে তা ৭০০ গুন করে দেওয়া হবে। এটা সম্পদের উপর প্রায় ৭০,০০০ % বৃদ্ধি। পৃথিবীর কোনো বিনিয়োগ কি এমন মুনাফা দিতে পারে ? কোন ক্ষেত্রেই না। এবং এই পুরস্কার শেয়ার বাজারের মত নয় যে উঠা নামা করবে, এর পূর্ণ নিশ্চয়তা রয়েছে। অর্থনৈতিক মন্দা কিংবা চাঙ্গা যাি হোক না কেন এ বিনিয়োগে তার কোনো প্রভাব নেই, এর নিশ্চয়তা দানকারী স্বয়ং আল্লাহ।

হজ্জের সময় যদি কেউ ৩০০০ ডলার খরচ করে তা ৭০০ গুন বৃদ্ধি পেয়ে হবে ২,১০০,০০০। এই হল প্রাপ্তি, ২ মিলিয়ন ডলারের চেয়ে কিছু বেশী। এ হল আল্লাহর বদান্যতা।

 


সাবর (ধৈর্য) এবং সিয়াম (রোজা)

আল্লাহ বলেন, “বলুন, হে আমার বিশ্বাসী বান্দাগণ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর। যারা এ দুনিয়াতে সৎকাজ করে, তাদের জন্যে রয়েছে পুণ্য। আল্লাহর পৃথিবী প্রশস্ত। যারা সবরকারী, তারাই তাদের পুরস্কার পায় অগণিত।” (৩৯:১০) এক্ষেত্রে পুরস্কার সীমাহীন।

ধৈর্যধারণের ক্ষেত্রেও পুরস্কার রয়েছে। আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)   বলেছেন, “ আদম সন্তানের প্রতিটা নেক আমলকে বৃদ্ধি করে দেওয়া হবে, একটি নেক আমল ১০ গুন থেকে ৭০০ গুন বৃদ্ধি করা হবে। মহিমাম্বিত এবং ঐশ্বর্যশালী আল্লাহ বলেছেন, “ রোজা আমার জন্য, আমার জন্য তারা ক্ষুধার্ত এবং ধৈর্যশীল ছিল এবং আমি নিজে তার প্রতিদান দেব। .. ”। (মুসলিম, ৬/২৫৬৭)

এই হাদিসে আল্লাহর বদান্যতা প্রকাশিত হয়েছে।  রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “ আল্লাহ, ভাল ও খারাপ আমল লিপিবদ্ধ করে রাখার জন্য ফেরেশতাদের নিযুক্ত করেছেন এবং তাদের শিখিয়েছেন কিভাবে লিপিবদ্ধ করতে হবে। কোন বান্দা যদি ভাল কোন কাজের নিয়ত করে এবং যদি সে তা করতে না পারে, আল্লাহ তাকে ভাল কাজের প্রতিদান দেবেন। যদি সে ভাল কাজের নিয়ত করে এবং সে তা করে তবে তা ১০ গুন থেকে ৭০০ গুন কিংবা তার চেয়ে বেশী হিসেবে লিপিবদ্ধ করে রাখা হবে। আর যদি কোন বান্দা খারাপ কাজ করার নিয়ত করে এবং সে যদি তা থেকে বিরত থাকে তবে তার জন্য একটি নেকী লিপিবদ্ধ করা হবে। যদি সে খারাপ কাজের নিয়ত করে এবং তা করে ফেলে তাহলে তার জন্য একটি গুন্নাহ লিপিবদ্ধ করা হবে। ” ( বুখারি )

 


তওবা

আল্লাহর মহানুভবতা ও দাক্ষিণ্যের আরেকটি উদাহারন হচ্ছে, আল্লাহ তাওবাকারীদের পুরস্কৃত করবেন। আল্লাহ বলেন, “এবং যারা আল্লাহর সাথে অন্য উপাস্যের এবাদত করে না, আল্লাহ যার হত্যা অবৈধ করেছেন, সঙ্গত কারণ ব্যতীত তাকে হত্যা করে না এবং ব্যভিচার করে না। যারা একাজ করে, তারা শাস্তির সম্মুখীন হবে।কেয়ামতের দিন তাদের শাস্তি দ্বিগুন হবে এবং তথায় লাঞ্ছিত অবস্থায় চিরকাল বসবাস করবে।” (২৫:৬৮,৬৯) 

আল্লাহ এই আয়াতে তিনটি বড় গুনাহের কথা বলেছেন এবং উল্লেখ করেছেন তাদের জন্য নির্ধারিত নির্মম শাস্তির কথা, তবে তওবাকারীরা বাদে। “কিন্তু যারা তওবা করে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদের গোনাহকে পুন্য দ্বারা পরিবর্তত করে এবং দেবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” (২৫:৭০) যদি কোন গুনাহগার বান্দা তওবা করে তবে আল্লাহ কেবল তার গুনাহ সমূহ মুছে দিবেন না, বরং তাদের নেক আমলে রূপান্তরিত করে দিবেন।  আল্লাহ সুবহানহু ওয়া তায়ালা গাফুরুর রাহিম, ক্ষমাশীল করুনাময়, সুবহানাল্লাহ!

আবু যার (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)   বলেছেন, “ জান্নাতে প্রবেশকারী সর্বশেষ ব্যক্তি এবং জাহান্নাম থেকে বের হয়ে আসা সর্বশেষ ব্যক্তি সম্পর্কে আমি জানি। কিয়ামতের দ্বীন তাকে ( আল্লাহর সম্মুখে ) উপস্থিত করা হবে। বলা হবে, এ ব্যক্তির সমস্ত ছোট ছোট গুনাহগুলো তার সামনে উপস্থিত কর। আর বড় বড় গুনাহ তুলে নাও ( গোপন রাখ )। আতঃপর ছোট ছোট গুনাহগুলো তার সামনে উপস্থিত করা হবে । তাকে জিজ্ঞেস করা হবে, তুমি কি অমুক দিন এই এই এবং অমুক দিন এই এই (গুনাহের) কাজ করেছিলে ? সে বলবে হ্যাঁ। তার অস্বীকার করার কোন উপায় থাকবে না। বরং তার বড় বড় গুনাহগুলো উপস্থাপন করা হয় না কি সেজন্য ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে। আতঃপর তাকে বলা হবে, যাও, তোমার প্রত্যেকটি গুনাহের স্থলে তোমাকে নেকী দেয়া হল। (এ ব্যাপার দেখে তার অন্তরে বিরাট আশার সঞ্চার হবে) তখন সে বলবে, হে পরোয়ারদিগার, আমি তো আরো কিছু কাজ করেছিলাম সেগুল তো আজ এখানে উপস্থিত দেখছিনা। আবু যার (রা) বলেন, এ সময় আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)  কে এমনভাবে হাসতে দেখেছি যে তার মাড়ির দাঁত পর্যন্ত প্রকাশ হয়ে পড়েছিল। (মুসলিম ১/৩৬৫) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হাসছিলেন কারণ ঐ ব্যক্তি আল্লাহর বদান্যতা দেখে নিজের গুনাহ এর কথা প্রকাশ করছিল।

 


৪. সাক্ষী উপস্থাপন

আল্লাহ ব্যক্তিপর্যায়ে এবং জাতীয়পর্যায়ে সাক্ষী জড় করবেন। আল্লাহর সামনে এই উম্মাহকে অন্যদের জন্য সাক্ষী হিসেবে সাব্যস্ত হবে। আমরা ইতিমধ্যে আলোচনা করেছি কিভাবে আল্লাহ আমাদের জন্য সাক্ষী জড়ো করবেন – আমাদের হাত, পা, জিহ্বা আমাদের কৃতকর্মের সাক্ষী দিবে। প্রথমে নিজদের বিরুদ্ধে সাক্ষী উপস্থাপন করা হবে এবং এরপর প্রতিটি জাতির জন্য সাক্ষী হাজির করা হবে,

নুহ (আ) তাঁর জাতির জন্য সাক্ষী দিবেন। তিনি বলবেন, তিনি তাঁর জাতিকে সত্য জানিয়েছিলেন কিন্তু তারা তা প্রত্যাখ্যান করে। আবু সাদ থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)   বলেছেন, “নুহ (আ) এবং তাঁর জাতি বিচার দিবসে উপস্থিত হবে এবং আল্লাহ নুহ (আ) কে জিজ্ঞেস করবেন, “ তুমি কি তাদের সত্য পৌঁছে দিয়েছিলে ? ” তিনি বলবেন, “হ্যাঁ, আমার রব ” এরপর আল্লাহ নুহ (আ) এর জাতিকে জিজ্ঞেস করবেন, “ নুহ কি তোমাদের সত্য পৌঁছে দিয়েছিল ?” তারা বলবে, “ না, আমাদের নিকট কোন নাবী আসেনি” এরপর আল্লাহ নুহ (আ) কে জিজ্ঞেস করবেন, “ তোমার কর্মের সাক্ষী কে হবে?” উনি জবাবে বলবেন, “ মুহাম্মাদ এবং তাঁর উম্মাত।” তাই আমি এবং আমার উম্মাত তাঁর জন্য সাক্ষী দিবে।” এটাই হল আল্লাহর বানীর ব্যাখ্যা যেখানে আল্লাহ বলেছেন “এমনিভাবে আমি তোমাদেরকে মধ্যপন্থী সম্প্রদায় করেছি যাতে করে তোমরা সাক্ষ্যদাতা হও মানবমন্ডলীর জন্যে …………” (২:১৪৩)” ( বুখারি ৪/৫৫/৫৫৫) নুহ (আ) এর জাতি এই মুসলিম উম্মাহকে জিজ্ঞেস করবে, “ তোমরা কিভাবে জান ? তোমরা ত তখন ছিলে না ’’ তখন মুসলিমরা বলবে, “ আল্লাহ আমাদের জন্য একটি কিতাব নাজিল করেছিলেন (আল কুরআন ) ”

এরপর আল্লাহর নির্দেশে, মুহাম্মদ (সা) আমাদের জন্য সাক্ষীদাতা হবেন। “এমনিভাবে আমি তোমাদেরকে মধ্যপন্থী সম্প্রদায় করেছি যাতে করে তোমরা সাক্ষ্যদাতা হও মানবমন্ডলীর জন্যে এবং যাতে রসূল সাক্ষ্যদাতা হন তোমাদের জন্য …………” (২:১৪৩)

 


আস সাওয়াল (জিজ্ঞাসাবাদ)

বিচার দিবসে সকলে জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হবে – কিছু বান্দাকে বিস্তারিত জিজ্ঞেস করা হবে এবং কিছু বান্দাদের মোটেও জিজ্ঞেস করা হবে না। যাদের মোটেও জিজ্ঞেস করা হবে না তারা ঈমানের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছেন। তারা জিজ্ঞাসাবাদ ব্যতিত জান্নাতে প্রবেশ করবে। তাদেরকে তাদের আমলনামা হাতে দেয়া হবে কিন্ত জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে না। এই উম্মাহর ৭০,০০০ বিনা জিজ্ঞাসাবাদে জান্নাতে প্রবেশ করবে।

এরপর, যত বেশী প্রশ্ন করা হবে হিসাব তত বেশী ভয়ংকর ও কঠিন হবে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)   বলেছেন, “ যাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে তারা শাস্তিপ্রাপ্ত হবে ” যদি আপনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, তাঁর মানে কিছু সমস্যা আছে।  সব কিছুর ব্যাপারে প্রশ্ন করা হবে কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট বিষয় রয়েছে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে কুফর নিয়ে। আল্লাহ বলেন, “তাদেরকে বলা হবেঃ তারা কোথায়, তোমরা যাদের ইবাদত করতে।আল্লাহর পরিবর্তে? তারা কি তোমাদের সাহায্য করতে পারে, অথবা তারা প্রতিশোধ নিতে পারে?অতঃপর তাদেরকে এবং পথভ্রষ্টদেরকে আধোমুখি করে নিক্ষেপ করা হবে জাহান্নামে।এবং ইবলীস বাহিনীর সকলকে।” (২৬:৯২-৯৫)

 




পাঁচটি প্রশ্ন

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ থেকে বর্ণিত যে নবী কারীম, সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: পাঁচটি প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ার আগে কোন মানব সন্তান কেয়ামতের দিন পা নাড়াতে পারবে না। তাকে প্রশ্ন করা হবে 
(১)জীবন সম্পর্কে; সে কি কাজে আয়ু শেষ করেছে? প্রশ্ন করা হবে তার 
(২)যৌবন সম্পর্কে ; কি কাজে সে তাকে বার্ধক্যে পৌছে দিয়েছে? প্রশ্ন করা হবে তার 
(৩)ধন-সম্পদ সম্পর্কে; কিভাবে সে তা আয় করেছে আর 
(৪)কি কাজে তা ব্যয় করেছে? আর প্রশ্ন করা হবে সে যা 
(৫)জ্ঞান অর্জন করেছে সে মোতাবেক কাজ করেছে কি না? (বর্ণনায়: তিরিমিজী, আলবানী রহ. হাদীসটিকে হাসান বলেছেন, দেখুন সহীহ আল জামে)

 

পাঁচটি প্রশ্ন প্রত্যেককে জিজ্ঞেস করা হবে।

আত তিরমিযীতে বর্ণিত এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, কিয়ামতের দিন আদম সন্তানের দুই পা কোনো দিকে নড়াতে পারবে না, যতক্ষণ না তাকে পাঁচটি বিষয়ে প্রশ্ন করা হবে। 

প্রথমটি হল;  কিভাবে আপনি আপনার জীবন কাল অতিবাহিত করেছেন ? এটা হল জীবনে সময়ের মূল্য। সময় ধনসম্পত্তির চেয়েও মূল্যবান, জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত, আমাদেরকে ব্যাখ্যা করে যাচ্ছে।

 

দ্বিতীয় প্রশ্ন হবেঃ কিভাবে আপনার যৌবন কাটিয়েছেন ? আল্লাহ আপনাকে সামর্থ্য দিয়েছেন। আপনি নিজে এ শক্তির উৎস নন। আপনার দেহ আপনার কাছে আমানত স্বরূপ। আপনি কিভাবে এই দেহের ব্যবহার করেছেন, আপনি কি আল্লাহর রাস্তায় আপনার শক্তি সামর্থ্য ব্যয় করেছেন  ? আপনার এ দেহ একটি নিয়ামত, আল্লাহর তরফ থেকে আপনার জন্য রহমত এবং আপনি কিভাবে তা ব্যবহার করেছেন তা আপনাকে জিজ্ঞেস করা হবে।

তৃতীয়, চতুর্থ প্রশ্নটি হবে আপনার অর্থসম্পদ নিয়ে। সম্পদ নিয়ে আপনাকে দুটি প্রশ্ন করা হবে; আপনি কিভাবে উপার্জন করেছেন এবং কিভাবে তা খরচ করেছেন ? আপনাকে প্রশ্ন করা হবে আপনার উপার্জিত প্রতিটি টাকার জন্য এবং আপনার খরচকৃত প্রতিটি টাকার জন্য। সেইজন্য, সারা জীবনে দরিদ্রতার পীড়া,  বিচার দিবসে একটি টাকার জন্য ভোগান্তির চেয়ে উত্তম। প্রশ্ন করা মানে হল আপনি শাস্তির সম্মুখীন হবেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “ যাদেরকে কৃতকর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে তারা অবশ্যই শাস্তি প্রাপ্ত হবে। ” (বুখারি ৮/৭৭/৫৪৩)

 

এটি একটি অন্যতম কারণ যার জন্য ধনীদের তুলনায় গরীবরা জান্নাতে বেশী প্রবেশ করবে। যদিও এমন অনেক ধনী ব্যক্তি থাকবে যারা গরীবদের তুলনায় উচ্চস্তরের জান্নাতে থাকবে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)   বলেছেন, “ গরিব মুহাজীরিনগন ধনীদের ৫০০ বছর পূর্বে জান্নাতে প্রবেশ করবে। ” এই হাদিসে বর্ণিত আছে যে তারা যখন জান্নাতের প্রবেশ মুখে আসবে তখন ফেরেশতারা তাদের জিজ্ঞেস করবে, তোমরা এইখানে কিভাবে আসলে ? তোমরা কি কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নও ? ঐসকল গরীবরা জবাব দিবে, কিসের ব্যাপারে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য হব? আমাদের কোন সম্পদ নেই এবং আমরা তো আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তলোয়ার বহন করেছি। তবে এর পাশাপাশি অনেক ধনী ব্যক্তি থাকবে যারা গরীবদের তুলনায় উচ্চস্তরের জান্নাতে থাকবে যেমন আব্দুর রাহমান ইবন আউফ (রা)।

 

সম্পদ বেশ ভয়ংকর একটি বিষয়। এটা আমাদের জান্নাতের দ্বার খুলে দিতে পারে এবং তা আমাদের জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরেও নিয়ে যেতে পারে। সম্পদের ক্ষেত্রে আমাদের উপযুক্ত মনোনিবেশ করতে হবেঃ কিভাবে তা উপার্জন করব এবং কিভাবে ত ব্যয় করব।

 

পঞ্চম প্রশ্ন; আপনার ইলম কিভাবে ব্যাবহার করেছেন ? আপনকি ইলম বাস্তবে চর্চা করেছেন নাকি কেবল শেখার উদ্দেশ্য শিখলেন এবং তা দ্বারা কেবল লোকপ্রদর্শন করেছেন ? যদি ইলম এর ব্যবহার না করা হয় তবে তা আমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে।আমাদের অর্জিত ইলম এর ব্যবহার না করা একটি বড় গুনাহ। আল্লাহ বলেছেন, “মুমিনগণ! তোমরা যা কর না, তা কেন বল?তোমরা যা কর না, তা বলা আল্লাহর কাছে খুবই অসন্তোষজনক। ” (৬১:২,৩) তাই আমরা যা বলে থাকি তা আমাদের চর্চা করতে হবে।

 

৩ নং প্রশ্ন বিলাসবহুল জীবন

আল্লাহ বলেন, এরপর অবশ্যই সেদিন তোমরা নেয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।” (১০২:৮) এই আয়াতের বিভিন্ন ব্যাখ্যা রয়েছে। মুজাহিদের মতে, আপনি যা কিছু ভোগ করেছেন তাঁর সবকিছু সম্পর্কে আপনাকে জিজ্ঞেস করা হবে। ইবন আব্বাসের মতে যা কিছু আপনার সম্পদ এবং 

দেহ নিয়ে সংশ্লিষ্ট তা নিয়ে জিজ্ঞেস করা হবে।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ)   বলেছেন, দুটি রহমত আছে যার ব্যাপারে অনেক মানুষ ক্ষতির মধ্যে আছে; তা হল সুস্বাস্থ্য এবং ভাল কাজ করার জন্য অবসর সময় (বুখারি ৮/৭৬/৪২১) এ দুটি রহমত আমাদের, আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করা উচিৎ না হয় হিতে বিপরীত হবে

 

৪ নং প্রশ্ন প্রতিশ্রুতি এবং প্রতিজ্ঞা

সবচেয়ে বড় প্রতিজ্ঞা হল ঈমানের প্রতিজ্ঞা এটি আল্লাহর সাথে আমাদের প্রতিজ্ঞাআমরা কি আল্লাহর সাথে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ? হ্যাঁ, আমরা যখন দাবী করি আমরা মুসলিম, তখন আমরা আল্লাহর সাথে চুক্তি সাক্ষর করছিযখনই আমরা নিজেদের মুসলিম কিংবা মুমিন হিসেবে দাবী করছি, তখনই আমরা নির্দিষ্ট কিছু বিধানের ব্যাপারে নিজের সম্মতি জ্ঞাপন করছিআমাদের এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবেআল্লাহ বলেন, ………… এবং অঙ্গীকার পূর্ন কর। নিশ্চয় অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।” (১৭:৩৪)

 

৫ নং প্রশ্ন দৃষ্টিশক্তি, শ্রবনশক্তি এবং চিন্তাশক্তি

তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় – দৃষ্টিশক্তি, শ্রবনশক্তি এবং চিন্তাশক্তি। দৃষ্টিশক্তি এবং শ্রবনশক্তির মাধ্যমে আমরা আমাদের চিন্তাশক্তির জন্য সকল তথ্যের যোগান দিয়ে থাকি। অন্তর, যা কিনা চিন্তাশক্তির আধার, এ অন্তরকে যদি আমাদের দেহের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ধরে নেয়া হয় তবে তার তথ্যের যোগানদাতা কারা ? দৃষ্টিশক্তি এবং শ্রবনশক্তি। তাই আল্লাহ সুনির্দিষ্ট করে এসকল বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন।

আপনার চোখ দ্বারা কি আপনি কুরআন তিলাওয়াত করেছেন নাকি হারাম ক্ষেত্রে দৃষ্টিপাত করেছেন ? আপনার কান দিয়ে কি আল্লাহর জিকির শুনেছেন নাকি হারাম কিছু শুনেছেন ? আপনার চিন্তাশক্তিকে কিভাবে ব্যাবহার করেছেন ?  তা কি আপনি আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করেছেন নাকি আখিরাতকে ভুলে নিজেকে এই দুনিয়ার ভোগসুখের জোয়ারে ভাসিয়ে দিতে ব্যবহার করেছেন ? এই চিন্তাশক্তিই কিন্তু আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে। আমাদের 

চিন্তাশক্তি অনুযায়ী আমাদের কাজ পরিচালিত হয়ে থাকে যার জন্য আমরা কৈফিয়ত দিতে বাধ্য। আমাদের এই তিনটি বিষয় দ্বারা সর্বদা আল্লাহ সন্তুষ্টিই কামনা করা উচিৎ।

আল্লাহ বলেন, “তিনি তোমাদেরকে কর্ণ, চক্ষু ও অন্তর দিয়েছেন, যাতে তোমরা অনুগ্রহ স্বীকার কর।” (১৬:৭৮)

আল্লাহ বলেন, “………  নিশ্চয় কান, চক্ষু ও অন্তঃকরণ এদের প্রত্যেকটিই জিজ্ঞাসিত হবে।” (১৭:৩৬)

পরিশেষে, যারা বিশ্বাসী তাদের সালাত এর ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আন নাসাই এ বর্ণিত এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন- বান্দার কাছ থেকে কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যে বিষয়ের হিসেব গ্রহণ করা হবে তা হল তার সালাত। সে যদি তা পুরোপুরিভাবে আদায় করে থাকে তবে তা পুরো লেখা হবে। আর সে যদি তা পুরোপুরি আদায় না করে থাকে, তবে মহান ও পরাক্রান্ত আল্লাহ ফেরেশতাদেরকে বলবেন –দেখ, আমার বান্দার কোন নফল সালাত আছে কিনা, যার দ্বারা তোমরা তার ফরজ পুরো করে নিতে পার। এটাই হচ্ছে নফল এবং সুন্নাত সালাতের ফযিলাত। 

পাঁচ ওয়াক্ত সালাত পুরোপুরিভাবে আদায় করতে হবে। অবশ্যই আমাদের কিছু ঘাটতি রয়ে যাবেই কিন্তু সেগুলো কিভাবে পূরণ করা সম্ভব ? নফল এবং সুন্নাত সালাত দ্বারা। আতঃপর,  রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন সমুদয় আমলের হিসাব অনুরূপভাবে নেয়া হবে। আল্লাহ নির্দেশ দিবেন তার ফরয রোজার হিসেব নিতে। যদি তাতে কোন ঘাটতি থাকে তবে নফল রোজার দিকে দৃষ্টিপাত করা হবে।