পরকালের পথে যাত্রা – পর্ব ২০ – ঘুরে আসি জান্নাত থেকে

আলহামদুলিল্লাহ ওয়াসসালাতু ওয়াসসালাম ‘আলা রাসুলিল্লাহ

 

আমরা ফিরে যাচ্ছি আমাদের ভ্রমণে। আমরা কল্পনা করছি যে, কেউ একজন আমাদেরকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে জান্নাত দেখাচ্ছে। আমি চাই আপনি কল্পনা করুন যে আপনিই সেই ব্যক্তি, আপনি সেখানে আছেন এবং জান্নাত ঘুরে দেখছেন। আপনি জান্নাতের দরজা দিয়ে প্রবেশ করেছেন এবং এখন আপনি আপনার নিজের বাড়িতে যাবেন। 
জান্নাতের বাড়ি
রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন, “জান্নাতে একজন তাঁর বাড়িকে তাঁর দুনিয়ার বাড়ির চেয়েও ভালো ভাবে চিনবে।” 
আপনি অন্তর থেকেই তা অনুভব করবেন। জান্নাতে প্রবেশ করার পর কোন কোন রাস্তা ধরে আপনার বাড়িতে পৌছতে হবে তা আপনার অন্তর আপনাকে বলে দিবে। যাত্রা পথে, পথের দু ধারে  আপনি অনেক সুন্দর দৃশ্য দেখবেন কিন্তু আপনার মন আকুল থাকবে আপনার বাড়ি দেখার জন্য, আপনি দেখতে চাইবেন আল্লাহ সুবহানা ওয়া তা’আলা আপনার জন্য কি সারপ্রাইজ প্রস্তুত করে রেখেছেন। নিজের বাড়িতে না পৌঁছানো পর্যন্ত আপনি হোমসিক ফিল করছেন।

 যাত্রা শেষ এখন আপনি আপনার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আপনি দেখতে পাচ্ছেন, আপনার জন্য আল্লাহ সুবহানা ওয়া তা’আলা সুবিশাল প্রাসাদ তৈরি করে রেখেছেন। সাধারণ বাড়ি নয়, রাজপ্রাসাদ ! সে এক অসাধারণ স্থাপত্য, যার ইট পর্যন্ত স্বর্ণ ও রৌপ্য নির্মিত। মন ভুলানো সব রং, সুবিশাল আকৃতি, স্থাপত্যকর্মের এক শৈল্পিক প্রদর্শনী ! এতই অসাধারণ যা আমরা এই পৃথিবীতে কল্পনাও করতে পারি না। দুনিয়ার স্থাপত্যশিল্পের মধ্যে শ্রেষ্ঠ নিদর্শনকে আপনারা কল্পনা করতে পারেন, অনেকে তাজমহলের সৌন্দর্য্যে অভিভূত, কিন্তু জান্নাতের সাথে কোন কিছুরই তুলনা হতে পারে না। 

কারণ দুনিয়াতে সবকিছুরই কিছু না কিছু সীমাবদ্ধতা বা ত্রুটি থাকে, কিন্তু জান্নাতে এই পৃথিবীর মত বাধা বা সীমাবদ্ধতা থাকবে না। সেখানে মাধ্যাকর্ষণ থাকবে না, সেখানে কনক্রিট থাকবে না। আর তাই থাকবে না এসব জিনিসের সীমাবদ্ধতা বা দুর্বল দিকগুলো। তাই জান্নাত হবে স্থাপত্যকর্মে অতুলনীয়! স্বর্ণ ও রৌপ্য নির্মিত প্রাসাদসমুহ। 

কিন্তু আপনার জন্য আরও সারপ্রাইজ আছে, আপনি আপনার রাজপ্রাসাদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, আর প্রাসাদের খুব কাছে যেতেই এমন কিছু দেখবেন যা আপনাকে স্তম্ভিত করে ফেলবে, সেই অপরুপ সৌন্দর্য দর্শনে আপনি আনন্দে হাঁটার শক্তি হারিয়ে ফেলবেন। আপনি যেন নিজের পায়ে ভর করে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না ! আপনি আপনার জান্নাতী স্ত্রীর সামনে দাঁড়িয়ে, আপনি যেন কিছু হার্টবিট মিস করলেন, তিনি আপনার দিকে তাকিয়ে হাসছেন, …ভাবুন একবার !

আপনার স্ত্রীদের ব্যাপারে কথা বলার আগে চলুন আপনার প্রাসাদ নিয়ে কিছু আলোচনা করি। আল্লাহ সুবহানা ওয়া তা’আলা বলেন, যারা তাঁদের মালিককে ভয় করে তাঁদের জন্য থাকবে প্রাসাদের উপর প্রাসাদ, যার পাদদেশে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত থাকবে, (এটা হচ্ছে) আল্লাহ তাআলার ওয়াদা, আর আল্লাহ তাঁর ওয়াদার বরখেলাপ করেন না।” – সূরা ঝুমার (আয়াত ২০)

 

আমরা বলেছি, জান্নাতে পৃথিবীর মত সীমাবদ্ধতা থাকবে না, দুনিয়ার সবকিছুই সীমাবদ্ধ, কোন কিছুই ত্রুটিমুক্ত নয়। কিন্তু, জান্নাহ ভিন্ন, এখানে জান্নাতের প্রাসাদ শুধু একদিকেই বড় হবে না, তা বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে থাকবে, একটার উপর আরেকটা। 
غُرَفٌ مِّن فَوْقِهَا غُرَفٌ-গুরাফুন মিন ফাওক্বিহা গুরাফুন
প্রাসাদের উপর প্রাসাদ, কাজেই আল্লাহ সুবহানা ওয়া তা’আলাই ভালো জানেন যে, জান্নাতে মাত্রা কি শুধু ৩ টা দিকে সীমাবদ্ধ কি না! দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এ উচ্চতা ! হয়তোবা জান্নাতে দিকের সংখ্যা আরো বেশি, এটা যদিও আমার কল্পনা, কিন্তু জান্নাতে তা সম্ভব, কারণ জান্নাত ভিন্ন রকম। এই পৃথিবীর সীমাবদ্ধতা সেখানে নেই। সেই সব প্রাসাদের নিচ দিয়ে প্রবাহিত হবে নদী, জান্নাতের নদী প্রাসাদের পাশ দিয়ে নয়, নিচ দিয়ে প্রবাহিত হবে। আর এসব হচ্ছে আল্লাহ সুবহানা ওয়া তা’আলার ওয়াদা। 

কিছু জিনিস আছে যেগুলো পৃথিবীতেও আছে আবার আখিরাতেও তা থাকবে, কিন্তু সেগুলো দুনিয়ার মত হবে না। 
যেমন পৃথিবীতে আগুন আছে কিন্তু জাহান্নামের আগুন তার তুলনায় ৭০ গুণ বেশি প্রখর। রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন যে জাহান্নামের আগুনকে ১০০০ বছর পোড়ানোর পর তা লাল হয়, তারপর আরও ১০০০ বছর পোড়ানোর পর তা কালো হয়ে যায়। কল্পনা করুন… কালো আগুন!

 

একইভাবে জান্নাতে পানি থাকবে, দুধ থাকবে, মধু থাকবে। কিন্তু পৃথিবীর পানি,দুধ,মধুর সাথে জান্নাতের পানি,দুধ,মধুর শুধু নামেই মিল থাকবে, পরিমান ও গুনগত মানের দিক থেকে তা হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন। জান্নাতের এমন প্রাসাদ থাকবে যা হবে মুক্তার মত, যার ভেতর থাকবে না কোন শব্দ দূষণ, থাকবে না কোন ক্লান্তি, শুধু প্রশান্তি আর প্রশান্তি আপনি দুনিয়াতে আপনার শ্রেষ্ঠ বিশ্রামের স্থানটিকে চিন্তা করতে পারেন, কোলাহলমুক্ত, শান্তিপূর্ণ স্থান। জান্নাত হবে তার থেকেও বেশি।

হাদিস থেকে আমরা জানতে পাই যে জিবরীল (আ) রাসুলুল্লাহ (সা)-এর কাছে এসে বলেন, ‘আপনার স্ত্রী খাদিজা এখন আপনার কাছে আসবেন, তিনি আসলে তাঁকে বলবেন যে আল্লাহ তাঁকে সালাম দিয়েছেন আর আমি(জিবরীল) তাঁকে সালাম দিয়েছি। আর সেই সাথে তাঁকে জান্নাতে একটি প্রাসাদের সুসংবাদ দিন যা হবে মুক্তার মত, যার ভেতর থাকবে না কোন শব্দ দূষণ, থাকবে না কোন ক্লান্তি

 

জান্নাতে এমন সব ঘর থাকবে যার ভেতর থেকে বাহির দেখা যাবে আর বাহির থেকে দেখা যাবে ভেতর। এটা কিভাবে সম্ভব, আল্লাহই ভালো জানেন। কিন্তু জান্নাতের স্থাপত্য এরকমই হবে, যা আমরা কল্পনাও করতে পারি না। 

এক বেদুইন রাসুলুল্লাহ (সা) –কে জিজ্ঞেস করলো, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ, এই প্রাসাদ কাদের জন্য?’ (যখন দুনিয়াতে কোথাও আপনি একটি আলীশান বাড়ি দেখেন, আপনার মনে হয়, এত সুন্দর বাড়িতে কে থাকে ! এই বেদুঈন, তিনি যেন জান্নাতের বাড়ির সামনে নিজেকে দেখতে পাচ্ছিলেন, কাজেই তার মনে প্রশ্ন জেগে উঠল, এই জান্নাতের প্রাসাদে কে থাকে?)  কাজেই বেদুঈন প্রশ্ন করলেন, এই প্রাসাদ কাদের জন্য?
রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন, যারা সুন্দর কথা বলে, যারা গরিবদের খাবার দেয়, যারা রোজা রাখে আর যারা রাতের এমন সময় নামায পড়ে যখন সবাই ঘুমায়।’ রাসুলুল্লাহ (সা) আরও বলেন, ‘জান্নাতে মুক্তার মত প্রাসাদ থাকবে যার উচ্চতা হবে ৩০ মাইল, এবং তাঁর প্রত্যেক কিনারে জান্নাতির একটি পরিবার থাকবে যা অন্যরা দেখতে পাবে না।’

 

পৃথিবীতে একটি বাসা তৈরি করতে একজন মানুষকে বছরের পর বছর কষ্ট করতে হয়, কিন্তু এই বাড়ির কোন নিশ্চয়তা নেই, হয়ত বাড়ি ভেঙ্গে যেতে পারে, কিংবা লোকটি নিজেই মারা যেতে পারে, কিন্তু জান্নাতের বাড়ি আপনার স্থায়ী ঠিকানা। কাজেই, আপনি অনেক বেশি চাইবেন, এখন কিভাবে আমরা জান্নাতে নিজের সম্পত্তির পরিমাণ বৃদ্ধি করতে পারি? আছে কি কোন উপায়?
উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ! 

প্রথমত, আপনি যদি আল্লাহকে খুশি করার জন্য একটি মসজিদ নির্মাণ করেন, আল্লাহ আপনার জন্য জান্নাতে একটি প্রাসাদ তৈরি করবেন। দ্বিতীয়ত, রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন, কেউ যদি দৈনিক ১২ রাকাত সুন্নত নামায আদায় করে, আল্লাহ তাঁর জন্য জান্নাতে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করবেন। সেই সুন্নাতগুলো হলো ফজরের আগে ২ রাকাত, যোহরের আগে ৪ ও পরে ২ রাকাত, মাগরিবের পরে ২ রাকাত আর ইশার পরে ২ রাকাত। তো আপনি চাইলে প্রতিদিন এভাবে জান্নাতে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করতে পারেন। 

পার্থক্যটা দেখুন দুনিয়াতে একটি বাড়ি তৈরি করতে আপনাকে বছরের পর বছর কষ্ট করতে হয়, আর জান্নাতে আপনি তা পারছেন শুধুমাত্র ১২ রাকাত সুন্নাত নামায আদায় করে। আমাদের উচিৎ এই লোভনীয় অফার গ্রহণ করা। আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন আমাদেরকে জান্নাতবাসিদের অন্তর্ভুক্ত করেন।

 

এবার চলুন জান্নাতিদের স্ত্রী- প্রসঙ্গে আসি। আপনি যখন জান্নাতে আপনার রাজপ্রাসাদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, হঠাত করে একটি দৃশ্য আপনার হার্টবিট বাড়িয়ে দিল, আপনার জান্নাতী স্ত্রী আপনার সামনে দাঁড়িয়ে, তিনি আপনার দিকে তাকিয়ে হাসছেন, আপনার পা যেন জান্নাতের যমীনে আটকে গেল, আপনি তাঁর রুপে মুগ্ধ হয়ে থেমে গেছেন। সে আপনার জান্নাতের স্ত্রী হউন কিংবা পৃথিবীর স্ত্রী হউন না কেন, উভয় ক্ষেত্রেই তাঁরা অপরুপ সুন্দরি হবেন। আপনি বসে থাকবেন তাঁর রুপে মুগ্ধ হয়ে, এমন রুপ যা পৃথিবীর কোন কিছুর সাথে তুলনা করা যায় না।

আল্লাহ সুবহানা ওয়া তা’আলা বলেন, আমি তাঁদের (হুরদের) বানিয়েছি বানানোর মত করেই, আমি তাঁদের চির কুমারি করে রেখেছি, তাঁরা হবে সম বয়সের প্রেম সোহাগিনী।” – সূরা ওয়াকিয়া (আয়াত ৩৫৩৭)

 

জান্নাত সম্পর্কে লিখতে গিয়ে একজন আলেম বলেন, একজন মানুষ তাঁর স্ত্রীর রুপে মুগ্ধ হয়ে ৪০ বছর তাঁর দিকে অপলক তাকিয়ে থাকবে। আর এই সুন্দরীরা সুন্দর এই কারণে নয়, যে পৃথিবীর কিছু মানুষ তাদেরকে কোন প্রতিযোগিতায় বিজয়ী ঘোষণা করেছে, বরং আল্লাহ সুবহানা ওয়া তা’আলাতাদেরকে সুন্দর বলেছেন আর এটাই আমাদের জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ সুবহানা ওয়া তা’আলাবলেন, সেখানে থাকবে সৎ সভাবের অনিন্দ্য সুন্দরী রমনিরা” – সূরা রাহমান (আয়াত ৭০)

সুতরাং, তারা শুধুমাত্র সুন্দরীই নন, বরং সৎ স্বভাবেরও এবং আল্লাহ সুবহানা ওয়া তা’আলা যখন তাদেরকে সুন্দরী বলেছেন তখন বুঝতেই পারছেন, তাঁদের সৌন্দর্য নিয়ে আর কোন সন্দেহ থাকতে পারে না। এই সৌন্দর্য আমাদের পক্ষে কল্পনা করাও সম্ভব নয়।

রাসুলুল্লাহ (সা) আমাদেরকে বুঝানোর জন্য উদাহরণ পেশ করে, সহজ করে বলেন, ‘জান্নাতের একজন নারী যদি পৃথিবীতে আসতো, তাহলে আসমান-জমিন আলোয় ভরে যেত, তাঁর মধ্যবর্তী অংশ সুগন্ধে ভরে যেত আর সেই নারীর মাথার দোপাট্টা এই পৃথিবী আর তার উপর যা কিছু আছে সব কিছুর চাইতেও উত্তম হত। 

’দেখুন সূর্য আমাদের থেকে অনেক দূরে থাকা সত্ত্বেও তা এই পৃথিবীকে আলোকিত করে, কিন্তু আমরা যদি এই সৌরজগতের বাইরে যাই তাহলে দেখব যে সূর্যের আলো সেখানে নেই। কিন্তু জান্নাতের একজন নারী তাঁর আলো দিয়ে আসমান-জমিন আলোকিত করে ফেলবে, নূর! কল্পনা করুন তাঁর সৌন্দর্য। তাঁর মাথার এক টুকরো কাপড় এই পৃথিবীর সবকিছুর চাইতে উত্তম।

 

একবার রাসুলুল্লাহ (সা) একটি কাপড় উপহার হিসেবে পান, সেই কাপড় দেখে সাহাবারা তা বারবার ছুঁয়ে দেখছিলেন। তাঁদের দেখে রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন, ‘জান্নাতে সা’দ বিন মুয়াজের রুমালও এর চাইতে উত্তম।’ 

মুল কথা হচ্ছে জান্নাতের সবকিছু, সবকিছুই পৃথিবীর থেকে উত্তম। 

জান্নাতের নারীরা যেমন বিশেষভাবে তৈরি তেমনি জান্নাতে পুরুষরাও হবে বিশেষভাবে তৈরি। বর্ণিত আছে যে, জান্নাতে আমাদের উচ্চতা আদম (আ)-এর সমান, আমরা হবো ইউসুফ (আ)-এর মত সুন্দর আর আমাদের বয়স হবে ইসা (আ)-এর সমান অর্থাৎ ৩৩ বছর। আর জান্নাতে পুরুষদের শক্তি সামর্থ্যও হবে অনেক বেশি। 

তিরমিযির বর্ণনায় রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন, ‘জান্নাতে একজন পুরুষের শক্তি হবে পৃথিবীর ১০০ জন পুরুষের সমান।’ সুতরাং জান্নাতে সবকিছুই হবে বেশি বেশি, তা পরিমানের দিক থেকে হোক আর গুনগত মানের দিক থেকেই হোক। হুরদের সৌন্দর্য বর্ণনা করতে আল্লাহ সুবহানা ওয়া তা’আলাবলেন, এরা যেন এক একটি প্রবাল ও পদ্মরাগ” – সূরা রাহমান (আয়াত ৫৮)

রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন, জান্নাতের নারীদের অস্থিমজ্জা তাঁদের কাপড়ের ভেতর দিয়ে দেখা যাবে।’ আমি যখন বিষয়টা নিয়ে ভাবি তখন মনে হয়, এটা কিভাবে সম্ভব! আর তা সৌন্দর্যেরই বা কি কারণ। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে যে রাসুলুল্লাহ (সা) তা দেখেছেন আর তিনি আমাদের কাছে তা পৌছে দিয়েছেন, কিন্তু যেহেতু আমরা এটা কল্পনা করতে পারছি না, তার মানে এই নয় এটা সুন্দর নয়। জান্নাত একটি ভিন্ন জগত।

তো…! আপনি অনেক বছর কাটিয়ে দিয়েছেন আপনার স্ত্রীকে দেখে। এখন আপনি আপনার প্রাসাদে প্রবেশ করেছেন আপনি যা দেখছেন সবই আপনার কাছে নতুন মনে হচ্ছে। সব কিছুই এক একটা অভিজ্ঞতা। একটা শিশুর ক্ষেত্রে কি ঘটে? তার কাছে সবকিছুই নতুন, তাই সে যা দেখে তাতেই মজা পায়, এবং তাকিয়ে থাকে। একইভাবে আপনিও, জান্নাতের প্রাসাদের আসবাবপত্র দেখে অভিভূত হয়ে যাবেন, এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যাবেন আর বলবেন আলহামদুলিল্লাহ ! 

আল্লাহ সুবহানা ওয়া তা’আলাবলেন, তাতে থাকবে (সুসজ্জিত) উঁচু উঁচু আসন, (সাজানো থাকবে) নানান ধরনের পানপাত্র, (আরামআয়েশের জন্য থাকবে) সারি সারি গালিচা ও রেশমের বালিশ।”  – সূরা গাশিয়াহ (আয়াত ১৩১৫)

 

জান্নাতে আসবাবপত্র সাজানোর ব্যবস্থাও হবে অসাধারণ। ফার্নিচারগুলো যেভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে সেটাই একটা সৌন্দর্য। কল্পনা করুন একজন ফেরেশতা থাকবেন যিনি হবেন আসবাবপত্র সাজানোর ব্যাপারে পারদর্শী। এই অসাধারণ জিনিসগুলো কেনার জন্য আপনাকে অথবা আপনার স্ত্রীকে মার্কেটে যাওয়ার প্রয়োজন হয়নি। এসব কিছুই আপনার জন্য তৈরি করে রাখা আছে। আপনার সাথে আপনার স্ত্রীও সেই সব আসবাবপত্রের বিন্যাস দেখে অভিভূত হয়ে পড়বেন। তাঁর মনে পড়বে পৃথিবীতে তাঁর সাজানো ঘরের কথা আর সেই ঘরের সাথে জান্নাতের তুলনা করতে গিয়ে তিনি বুঝতে পারবেন; জান্নাত অতুলনীয়। আল্লাহ সুবহানা ওয়া তা’আলা আরওবলেন, তাঁরা এবং তাঁদের সঙ্গিনীরা সুশীতল ছায়ায় সুসজ্জিত আসনের উপর হেলান দিয়ে বসে থাকবে” – সূরা ইয়াসিন (আয়াত ৫৬)

 

সেই গালিচার উপর বসে আপনি এক অন্যরকম অনুভূতি পাবেন। আপনার জন্য সেখানে বসে থাকাও হবে আনন্দের কারণ। আপনি কয়েক মাস সেখানে বসেই কাটিয়ে দিবেন। আর আমি যখন বলছি যে আপনি মাসের পর মাস কাটিয়ে দিবেন, তা কিন্তু মোটেও অতিরঞ্জিত বর্ণনা নয়, কারণ জান্নাতে আপনার কোন তাড়াহুড়ো থাকবে না, আপনার কোন মিটিং থাকবে না, কোন কাজের চাপ থাকবে না, সময়ের কোন চিন্তা থাকবে না। আপনার সময় অফুরন্ত। আপনি যা যতক্ষণ করতে মন চায় করতে পারেন। এমনও হবে যে আপনি আপনার প্রাসাদ থেকে বের হলেন এবং একটি সুন্দর গোলাপ দেখতে পেলেন। আপনি সেটার সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য সেখানে এক বছর বসে থাকবেন। আপনার তো কোন কাজ করতে হবে না, আপনার কোন তাড়া থাকবে না। জান্নাতে আপনার কাছে অফুরন্ত সময় থাকবে আপনার যা ইচ্ছা হয় তা করার জন্য। তো আপনি আপনার স্ত্রী সেই গালিচার উপর কয়েক মাস কাটাবেন, আপনারা কথা বলবেন কবরের সময় নিয়ে, কিয়ামত দিবসের সময় নিয়ে। 
তারপর আপনার স্ত্রী বলবেন, ‘চলো, আমাদের অন্যান্য সম্পত্তি দেখে আসি।’ আপনি বলবেন, ‘না, আমি এত সুন্দর গালিচা থেকে এখন উঠতে চাই না।’ 
আপনার স্ত্রী বলবেন, ‘তুমি পৃথিবীতে আমাকে বাইরে যেতে দাও নি। 
চলো এখন যাই আমরা আল্লাহ আমাদেরকে যা দিয়েছেন তা দেখে আসি।’ সেই কথা শুনে আপনারা দুজন বের হয়ে যাবেন আপনাদের বাগানসমূহ দেখার জন্য। … 

কত বড় হবে সেই বাগানগুলো? জান্নাতের সর্বনিম্ন স্তরে যে ব্যাক্তি থাকবে তাঁকে এই পৃথিবীর ১০ গুণ পরিমান জায়গা দেয়া হবে। আর আমরা যদি উচ্চস্তরের কথা বলি, তাহলে মনে হয় আলোকবর্ষে হিসাব করতে হবে। জান্নাতের এক স্তরের সাথে অন্য স্তরের পার্থক্য হবে বিশাল। আপনারা দুজন এখন বেড়াতে যাচ্ছেন, তার আগে আপনার ইচ্ছা হল কিছু খেয়ে নিবেন, কিছু পান করবেন। যখন আপনার মনে ইচ্ছা হল, তখনই আপনি দেখলেন যে চারপাশে অনেক কিশোর আপনাদের জন্য বিভিন্ন খাবার নিয়ে ঘুরছে। তাঁরা সকলেই সুন্দর কাপড় পরিধান করে আছে, অসাধারণ সব জিনিস তাঁরা পরিবেশন করছে। সেইসব কিশোরদের দেখে, তাঁদের হাসি দেখে, তাঁদের ব্যবহার, আপ্যায়নে আপনি মুগ্ধ । (একটি উদাহরণ, আপনারা দেখেছেন দুনিয়াতেও বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় খেলোয়াড়দের সাথে কিশোর বাচ্চারা আসেন, তাদেরকে মাঠে নিয়ে আসেন) 

ইবনে কাসির (র) বলেন, ‘জান্নাতিদের খাবার পরিবেশন করবে কিশোরেরা, তাঁরা চিরকাল থাকবে, তাঁদের বয়স বাড়বে না। 

আপনি দেখলেন তাঁদের সংখ্যা অনেক, আপনার সেবায় নিয়োজিত, আরো দেখলেন তাঁরা কতটা উৎসাহী ! আপনাকে সাহায্য করার জন্য, আর তাঁদের চেহারার সৌন্দর্য, তাঁদের চেহারার ঔজ্জ্বল্য, তাঁরা সব সময় হাসতে থাকবে, আর তাঁদের পরনের কাপড়ের রং আর অলংকার…সবকিছু দেখে আপনার মনে হবে তাঁরা যেন ছড়ানো-ছিটানো মুক্তা।’ আল্লাহ সুবহানা ওয়া তা’আলা বলেন, ‘“তাঁদের চারপাশে ঘুরাঘুরি করবে একদল কিশোর বালক, যারা চিরকাল কিশোর থাকবে, যখন তুমি এদের দিকে তাকাবে মনে হবে এরা বুঝি কতিপয় ছড়ানোছিটানো মুক্তা।”  সূরা ইনসান (আয়াত ১৯)

 

আপনার নিজের কোন কাজ করতে হবে না, আপনার স্ত্রীর কোন কাজ করতে হবে না, তাঁকে রান্নাঘর পরিস্কার করতে হবে না। আপনারা শুধু উপভোগ করতেই থাকবেন, করতেই থাকবেন। এবং আপনারা সেখানে কিছু খেয়ে, কিছু পান করে নিয়ে বের হয়ে পরবেন ভ্রমণে।
হতে পারে, আপনারা সাথে একজন গাইড রাখবেন আপনার বিশাল বাগানগুলো ঘুরে দেখানোর জন্য। আপনি আপনার প্রাসাদ থেকে বের হতে না হতেই আপনার নাকে একটা সুগন্ধ আসবে যা আপনাকে পাগল করে দিবে। আপনি ভাববেন এই সুগন্ধ কোত্থেকে আসছে? আপনি সেই সুগন্ধের উৎস খুজতে গিয়ে বুঝবেন যে জান্নাতের মাটি থেকে সেই সুগন্ধ আসছে।

আপনি সেই মাটি হাতে নিবেন, সেই মাটি হবে বিশুদ্ধ সাদা মিশক

আপনার তখন মনে হবে এই মাটি মনে হয় আল্লাহ শুধু আপনাকেই দিয়েছেন কিন্তু বাইরে গিয়ে আপনি বুঝবেন যে পুরো জান্নাতেই এই মিশকের মাটি থাকবে। বুখারির বর্ণনায় রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন, এবং তাঁর মাটি হবে মিশক 

তারপর আপনি পানির আওয়াজ পাবেন। আপনি আপনার গাইডকে জিজ্ঞেস করবেন, ‘এটা কিসের আওয়াজ?’ সে বলবে এটা আপনার নদী, আর তা আপনার প্রাসাদের নিচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। আপনি সেই সচ্ছ পানির নদী থেকে পানি পান করবেন আর উপলব্ধি করবেন যে এই পানি পৃথিবীর পানি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। আর তাই আপনি সেখানে বসে কাপের পর কাপ পানি পান করতেই থাকবেন। আপনি জান্নাতে তৃষ্ণা মেটানোর জন্য পানি পান করবেন না, কারণ একজন জান্নাতবাসি আগেই এমন এক পানি পান করবে যার পর তাঁর আর কোনদিন তৃষ্ণা পাবে না। সেটা হলো আল-হাউজ আল-কাউসারের পানি। 

কিয়ামতের দিন আল-কাউসারের একাংশ হাশরের ময়দানে নিয়ে আসা হবে জান্নাত থেকে। সেটার পাশে কে দাঁড়িয়ে থাকবেন ? রাসুলুল্লাহ (সা)। তিনি তাঁর অনুসারীদের জন্য পানি ঢেলে দিবেন। আর তিনি তাঁর নিজের হাতে তা পরিবেশন করবেন। ভাবতে পারেন? রা সা) নিজের হাতে আপনাকে পানি পান করানোর জন্য অপেক্ষা করছেন ! 

আপনি যদি মুসলিম হোন আর আপনার জন্য রাসুলুল্লাহ (সা) শাফায়াতের প্রার্থনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা) আপনাকে ডেকে নিয়ে আল-কাউসার থেকে পানি পান করাবেন। এসো, পান কর !

আর সেই এক কাপ পানি অনন্তকালের জন্য আপনার তৃষ্ণা মিটিয়ে দিবে, তারপর আপনি আর কোনদিন পিপাসার্ত হবেন না। 
তাহলে জান্নাতের লোকেরা খাচ্ছে কেন, তাঁরা পান করছে কেন ? 

জান্নাতিরা খাওয়া-দাওয়া করবে শুধুমাত্র আনন্দের জন্য। তাঁদের খাবারের প্রয়োজন হবে না, তাঁদের তৃষ্ণাও পাবে না, তাঁরা খাবে আর পান করবে শুধুমাত্র উপভোগ করার জন্য। আপনি এত পানি পান করবেন কিন্তু তা আপনার দেহে থাকবে না। তা ঘাম হিসেবে বের হয়ে যাবে যদিও তাঁর গন্ধ হবে মিশকের। আপনি যখন আপনার নদী থেকে কাপের পর কাপ পান করছেন আপনার গাইড আপনাকে বলবে যে আপনার আরও নদী আছে যা এটার চেয়েও উত্তম। আপনি তখন সেই নদীর কাছে যেতে চাইবেন। আপনি আপনার স্ত্রী আর গাইড হাজার হাজার মাইল দূরত্ব অতিক্রম করবেন সেই নদীর কাছে পৌছার জন্য। দুনিয়াতে মানুষ বিভিন্ন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার জন্য হাজার হাজার মাইল পাড়ি দেয়, কেউ যায় নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখতে, কিংবা কেউ যায় গ্রাণ্ড কানিয়নে, এবারে জান্নাতে আপনি এবং আপনার স্ত্রী যাচ্ছেন, সেরকমই একটি অসাধারণ নদী দেখতে ! 

আর জান্নাতের যোগাযোগ ব্যবস্থা যে অসাধারণ হবে তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। আপনার ইচ্ছা হলে আপনি ধীর গতির যানে যাবেন, আশেপাশের দৃশ্য দেখে দেখে যাবেন, ইচ্ছা হলে দ্রুতগতির যানে যাবেন। আপনি সেখানে পৌঁছে দেখবেন যে সেটা হচ্ছে দুধের নদী। আর আপনি তা পান করেই বুঝবেন যে তা এই পৃথিবীর দুধের মত না। আপনি আর আপনার স্ত্রী যখন পান করতেই থাকবেন, তখন আপনার গাইড বলবে যে আপনার আরও একটি নদী রয়েছে যা এটার চাইতেও উত্তম। আপনারা কল্পনা করতে পারেন সমুদ্র দেখার অনুভূতির সাথে, সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে কেমন অনুভূতি হয়, কিংবা নদী, পাল তোলা নৌকা ঢেউ ইত্যাদি, এমনকি দুনিয়ার এই দৃশ্যগুলোই আমাদের নয়ন জুড়িয়ে দেয়, তাহলে চিন্তা করুন, যখন আপনি দাঁড়িয়ে আছেন সেরকমই জান্নাতের বহমান একটি নদীর সামনে, কত চমতকারই  না হবে সে দৃশ্য !

সেই নদীর কাছে গিয়ে আপনি দেখবেন যে তা হচ্ছে মধুর নদী আপনি সেই মধুও পান করবেন। আর তাঁর পর আপনি শেষ নদীটির কাছে যাবেন। আর সেটা হবে সুধার নদী, সুধা মানে মদ…কিন্তু মদ শব্দটা শুনতে খারাপ শোনায়, কাজেই আমরা বলেছি সুধার নদী, কিন্তু এই মদের নদী হবে ভিন্নরকম, এখানে আপনি মদের ক্ষতিকর দিকগুলো থেকে মুক্ত, এটা কেবল আপনাকে আনন্দ দেবে, মাদকতা, ঝিমঝিমভাব, মাথা ব্যথা ইত্যাদি থেকে মুক্ত হবে, কারণ জান্নাতি সুধা দুনিয়ার মদের মত নাপাক বা ক্ষতিকর হবে না, এটা হবে পিউর । আপনি সেখানে কিছুক্ষণ থাকবেন সেই নদী থেকে পান করার জন্য যা আপনাকে আল্লাহ সুবহানা ওয়া তা’আলা দিয়েছেন। তারপর আপনি জান্নাতের ঝরনাসমুহ দেখতে বের হবেন। আল্লাহ সুবহানা ওয়া তা’আলা বলেন, আল্লাহ তাআলাকে যারা ভয় করে তাঁদের যে জান্নাতের ওয়াদা করা হয়েছে; সেখানে নির্মল পানির ফোয়ারা রয়েছে, রয়েছে দুধের এমন কিছু ঝর্ণাধারা যার স্বাদ কখনও পরিবর্তিত হয় না, রয়েছে পানকারীদের জন্য সুধার নহরসমুহ, রয়েছে বিশুদ্ধ মধুর ঝর্ণাধারা।”– সূরা মুহাম্মাদ (আয়াত ১৫)

 

আপনার গাইড আপনাকে জিজ্ঞেস করছে, আপনি সেই ঝরনাসমুহ দেখতে চান কি না? আপনি বলবেন ‘হ্যা’। কিন্তু সে বলবে তাঁর চেয়েও ভালো কিছু রয়েছে। চলুন রাসুলুল্লাহ (সা)-কে যে নদীটি দেয়া হয়েছে তা দেখে আসি’ আর সেটাই হলো আল-কাউসার নামক নদী। আপনি জিজ্ঞেস করবেন, ‘আমি কি সেখানে যেতে পারবো?’ উত্তরে বলা হবে ‘হ্যা’। আপনি যদি মুহাম্মাদ (সা)-এর উম্মত হোন তাহলে আপনি তাঁর নদীতে যেতে পারবেন আর সেখান থেকে পানও করতে পারবেন। 
আর এটা হচ্ছে জান্নাতের সর্বশ্রেষ্ঠ নদী আর তাঁর উৎপত্তিস্থল হচ্ছে আল্লাহর আরশ। 

সহিহ মুসলিমের বর্ণনায় রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন, “মিরাজের রাতে আমাকে যখন জান্নাতে নিয়ে যাওয়া হয় আমি দেখতে পাই একটি নদী যার পাশে রয়েছে ফাঁপা মুক্তার তাবু। আমি জিবরীলকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এটা কি?’ জিবরীল বললেন, ‘এটা হলো আল-কাউসার যা আপনার প্রভু আপনাকে দিয়েছেন। দেখুন এর মাটি হচ্ছে মিশকের তৈরি !’ ” 

একটি বিষয়-আপনারা যখন শুনছেন যে আপনার একজন গাইড থাকবে আপনারা হয়তো ভাববেন আমি এসব বানিয়ে বলছি! কিন্তু রাসুলুল্লাহ (সা) যখন জান্নাতে গিয়েছিলেন তখন তাঁর একজন গাইড ছিলেন, তাঁর গাইড ছিলেন জিবরীল (আ)। তো জান্নাতে আপনার গাইড থাকাতে আসলে কোন সমস্যাই নেই। 

জান্নাতে আপনাকে সবসময় খেদমত করা হবে। ঘরের ভিতরে ঘরের বাইরে, সব জায়গায় আপনার খেদমতে থাকবে বিভিন্ন জন। আপনি আপনার গাইডের সাথে আল-কাউসারে গেলেন, সেখান থেকে পান করলেন। 

আপনার এই পুরো ভ্রমনটা অসাধারণ কাটছে। আপনার কোন টাকা খরচ হচ্ছে না। এই সব কিছুই পুরো ফ্রি। 
আর এই ভ্রমন শেষ করতে আপনার বেশ কয়েক বছর লেগে গিয়েছে।

আর এখন আপনি পরিকল্পনা করছেন জান্নাতের ঝর্ণাসমূহ দেখার জন্য। আপনি জান্নাতের বিভিন্ন ঝর্ণা পরিদর্শন করছেন এবং এই ঝর্ণাগুলোর নাম আপনি দুনিয়া থেকেই জানেন কারণ আপনি কুরআন পড়তেন। যেমন একটির নাম সালসাবিল, আরেকটি হচ্ছে ‘কাফুরের’ ঝর্ণা। আপনি সেই সব ঝর্ণা দেখতে চাইবেন। আল্লাহ সুবহা না ওয়া’ তা’আলা বলেন, “নিঃসন্দেহে যারা সৎকর্মশীল তাঁরা জান্নাতে এমন সুরা পান করবে যার সাথে (সুগন্ধযুক্ত) কাফুর (কর্পূর) মেশানো থাকবে। এ (কর্পূর মেশানো) পানি হবে প্রবাহমান (এক) ঝর্ণা, যার (প্রবাহ) থেকে আল্লাহর নেক বান্দারা সদা পানীয় গ্রহণ করবে, তাঁরা (যেদিকে যখন ইচ্ছা) এ (ঝর্ণাধারা)-টা প্রবাহিত করে নেবে।” সুরা ইনসান (আয়াত ৫-৬)

 

আপনি সেখানে গিয়ে দেখবেন যে অন্যান্য মুমিনরা সেখান থেকে পান করছে। 
আপনি তাঁদের কাছে যাবেন, তাঁদের সাথে কিছুক্ষণ গল্প করবেন, সুরা পান করবেন। তারপর আপনি আপনার নতুন গন্তব্যের দিকে রওয়ানা হবেন। আল্লাহ সুবহা না ওয়া’ তা’আলা বলেন, “নিঃসন্দেহে নেককার লোকেরা মহা নেয়ামতে থাকবে, এরা সুসজ্জিত আসনে বসে সব অবলোকন করবে, এদের চেহারায় নেয়ামতের সজীবতা তুমি চিনতে পারবে। ছিপি আঁটা (বোতল) থেকে এদের সেদিন বিসুদ্ধতম পানীয় পান করানো হবে, কস্তূরীর সুগন্ধি দিয়ে যার মুখ বন্ধ করা। এতে (বিজয়ী হবার জন্য) প্রতিটি প্রতিযোগীই প্রতিযোগিতা করুক।” – সূরা মুতাফফিফীন (আয়াত ২২-২৫)

আল্লাহ সুবহা না ওয়া’ তা’আলা আরও বলেন, “সেখানে তাঁদের এমন এক সুরা পান করানো হবে, যার সাথে মেশানো হবে যানযাবীল, তাতে রয়েছে এক অমিয় ঝর্ণা, যার নাম হচ্ছে সালসাবীল।” – সূরা ইনসান (আয়াত ১৭-১৮)

 

আপনি একের পর এক ঝর্ণা দেখতে থাকবেন, বছরের পর বছর অতিবাহিত হতে থাকবে, আপনি খেয়াল করবেন যে জান্নাতে কোন চন্দ্র অথবা সূর্য নেই, রাত নেই, দিনও নেই নেই গ্রীষ্ম, নেই শীত, নেই বসন্ত আপনি চিন্তা করবেন জান্নাতে একটি দিন কত বড়? এখানে কি আদৌ রাত হবে? এবং আপনি বুঝতে পারবেন যে জান্নাতে কোন ঘুম নেই, সেখানে সবসময় আলো থাকবে। আর দিন আর রাতের পার্থক্য বুঝতে পারবেন আল্লাহর আরশের নিচে থেকে আসা আলোক রশ্মি থেকে। জান্নাত সবসময় আলোকিত থাকবে।

আল-কুরতুবি বলেন, “জান্নাতে কোন রাত অথবা দিন নেই, সেখানে সবসময় আলো থাকবে।”

ইবনে তাইমিয়াহ বলেন, “জান্নাতে সূর্য নেই, চন্দ্রও নেই, রাত নেই, দিন নেই। 
সকাল থেকে দুপুর আলাদা করা যাবে আরশের নিচে থেকে আসা আলোক রশ্মি দেখে।”

 

তো আপনি এখনও আপনার গাইডের অনুসরণ করছেন, হঠাৎ আপনি এক মস্ত বড় গাছ দেখতে পেলেন। আপনি জানতে পারবেন এটাই হচ্ছে রাসুলুল্লাহ (সা) –এর বলা সেই গাছ, যার বর্ণনা আমরা হাদিস থেকে পাই। রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন, “জান্নাতে এমন এক গাছ থাকবে যা এত বিশাল হবে যে একজন সওয়ারী সেই গাছের ছায়ায় একশ বছর যাত্রা করতে পারবে।” 

তারপর আপনি যেখানেই যান না কেন আপনি নতুন নতুন গাছ দেখতে পাবেন, প্রতিটা গাছ ভিন্ন। আপনি অবাক হবেন আর আপনার গাইডকে জিজ্ঞেস করলে সে বলবে, ‘এখানে এমন গাছ রয়েছে যার সব ডাল স্বর্ণ, আরও গাছ রয়েছে যার ডাল রৌপ্য নির্মিত, এমন গাছ রয়েছে যা কাপড় উৎপন্ন করে, রয়েছে ফল প্রদানকারী গাছ।’ আপনার গাইড আপনাকে বিশেষ কিছু গাছ দেখাতে নিয়ে যাবে, যেমন ‘সিদ্রাতুল মুন্তাহা’। রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন, “আমাকে যখন সিদ্রাতুল মুন্তাহায় নিয়ে যাওয়া হয়, আমি দেখতে পাই তার পাতাগুলো হাতির কানের মত, আর তার ফলগুলো বড় মাটির পাত্রের মত।”

 

একদা রাসুলুল্লাহ (সা) জান্নাত নিয়ে কথা বলছিলেন, একজন লোক তাকে প্রশ্ন করলো, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ, জান্নাতের কাপড় কি তৈরি থাকবে, নাকি তা হাতে বোনা হবে?’ এই প্রশ্ন শুনে সাহাবারা হেসে উঠলেন। তাঁদের মনে হল এই প্রশ্নটা অবান্তর। রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন, “তোমরা হাসছ কেন? একটা অজ্ঞ মানুষ  একজন বিজ্ঞ মানুষকে প্রশ্ন করছে বলে?” রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন যে কোন প্রশ্নই অবান্তর হতে পারে না, একজন মানুষ না জানলে সে প্রশ্ন করতেই পারে। তারপর রাসুলুল্লাহ (সা) সেই মানুষটির প্রশ্নের উত্তরে বলেন, “জান্নাতের পোশাক জান্নাতের গাছ থেকে উৎপন্ন হবে।” আপনি আর আপনার স্ত্রী কোন গাছের নিচে যাবেন, গিয়ে আপনি একটি ফলের দিকে নির্দেশ করতেই তা আপনার জন্য নতুন কাপড় বের করে দিবে। আপনি কাপড় সংগ্রহ করবেন, আপনার স্ত্রী সেখানে দাঁড়িয়ে কাপড় নিবে, স্বাভাবিকভাবেই সে অনেক কাপড় নিবে। 

তো আপনি সে সব কাপড় নিয়ে আবার চলতে শুরু করবেন, আপনার কাপড় নিয়ে যাওয়ার জন্য আরেকজন খাদেম থাকবে। আপনি আরেকটি গাছের কাছে আসবেন, দেখবেন সেটা কমলালেবুর গাছ, আপনি কিছুদিন আগেই কমলালেবু খেয়েছেন। আপনার গাইড জিজ্ঞেস করবে আপনি সেই ফল খেতে চান কি না। আপনি বলবেন, ‘না, এটা তো আমই আগেই খেয়েছি’। আপনার গাইড আপনাকে একটি কমলালেবু দিবে, আপনি সেটা খেয়ে দেখবেন যে তা আগেরটার চেয়ে ভিন্ন। এই কমলালেবু বেশি সুস্বাদু। আপনার খাওয়া প্রতিটা কমলালেবু তার আগেরটার চেয়ে ভাল হবে।

আল্লাহ সুবহা না ওয়া’ তা’আলা বলেন, “…যখনি তাঁদের (জান্নাতের) কোন একটি ফল দেয়া হবে তখনি তাঁরা বলে, ‘এ ধরনের (ফল) তো ইতিপূর্বেও আমাদেরকে দেয়া হয়েছিল’, তাঁদের (মূলত) এ ধরনের জিনিসই সেখানে দেয়া হবে।”          – সূরা বাকারা (আয়াত ২৫)

জান্নাতের বাসিন্দারা অভিযোগ করবে যে তাদেরকে আগেও এই একই ফল দেয়া হয়েছিলো, কিন্তু তাঁরা বুঝতে পারবে যে এই ফলের স্বাদ আগের চেয়ে ভিন্ন এবং উত্তম। দেখুন জান্নাতবাসীদের রুচি কতটা উন্নত, তাঁরা এক ফল দুইবার খেতে চাইবে না। যতবার তাঁরা একই ফল খাবে, ততবার সেই ফলের স্বাদ বৃদ্ধি পাবে।

 

তিরমিযির বর্ণনায় রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন, ‘জান্নাতের গাছের কাণ্ড ও ডালপালা হবে স্বর্ণ নির্মিত।’

এখন চলুন আমরা দেখি কিভাবে একজন জান্নাতে তাঁর গাছের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে পারে। রাসুলুল্লাহ (সা) আল-ইসরা ওয়াল মি’রাজে ইব্রাহিম (আঃ) এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। ইব্রাহিম (আঃ) হলেন এই উম্মতের পিতা, তিনি আমাদের পিতা। আর তাই তিনি আমাদের জন্য সবচেয়ে ভাল জিনিসটা কামনা করেন। যদিও ইব্রাহিম (আঃ) আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন, তারপরও তিনি আমাদেরকে সাহায্য করতে চান। আর যেহেতু তিনি এখন জান্নাতে রয়েছেন, তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে তিনি মুহাম্মাদ (সা) –কে সাহায্য করেছেন। তিনি বলেন, ‘ইয়া মুহাম্মাদ, তোমার উম্মতকে আমার সালাম দিও। তাদেরকে বলে দিও যে জান্নাত অনেক সুন্দর, জান্নাতের পানি বিশুদ্ধ, তাঁর মাটি পরিস্কার, আর টা হচ্ছে বিশালায়তন। আর জান্নাতের গাছ হচ্ছে, ‘সুবহানাল্লাহ, ওয়ালহামদুলিল্লাহ, ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, ওয়াল্লাহু আকবার।’ ’ আপনি যদি নিজের জন্য জান্নাতে একটি গাছ চান, আপনাকে শুধু এই কথাগুলোই বলতে হবে। ‘সুবহানাল্লাহ, ওয়ালহামদুলিল্লাহ, ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, ওয়াল্লাহু আকবার।’

ভাই ও বোনেরা আপনারা দুনিয়ায় বসে জান্নাতে বৃক্ষ রোপণ করুন। সেখানে প্রাসাদ তৈরি করুন। জান্নাতে যাওয়ার আগেই প্রস্তুতি গ্রহণ করুন। আর আপনি যদি জান্নাতে অনেক মুল্যবান সম্পদ চান, তাহলে ‘লা হাওলা ওয়ালা কুও্বাতা ইল্লা বিল্লাহ’ পড়ুন।

 

জান্নাতের পশু-পাখীরা কেমন হবে? রাসুলুল্লাহ (সা)–কে যখন কাউসার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়, তিনি বলেন, ‘এটা একটি নদী যা আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন, তাঁর পানি দুধের চেয়েও সাদা আর মধুর চেয়েও মিষ্টি। আর সেই নদী থেকে পানি পান করে এমন সব পাখি যাদের গলা হচ্ছে উটের গলার মতো।’ মস্ত বড় পাখি এবং তা পুরোপুরি প্রাকৃতিক। এখানে কোন হরমোনের ব্যাপার নেই। আমরা সাধারণত বড় আকারের সাথে হরমোনের বিষয়টা টেনে আনি। কিন্তু জান্নাতের পাখি হবে সম্পূর্ণ ভেজাল মুক্ত।

উমার বিন আল-খাত্তাব (রা) সেখানে উপস্তিত ছিলেন, তিনি বললেন, ‘সুবহানাল্লাহ, এই পাখিরা তো আনন্দে আছে।’ রাসুলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘হে উমার, যারা সেই পাখিগুলো খাবে তাঁরা আরও বেশি আনন্দে থাকবে।’ 

আপনি একটি পাখি উড়তে দেখে যদি তা আপনার পছন্দ হয়, আপনি শুধু তার দিকে নির্দেশ করতেই তা আপনার জন্য প্রস্তুত অবস্থায় আপনার সামনে পরিবেশন করা হবে। চুলা গরম হওয়ার জন্য কোন অপেক্ষা করতে হবে না, রান্না হওয়ার জন্য কোন সময় লাগবে না। যখন চাইবেন তখনই পেয়ে যাবেন।

 

তো আপনি আর আপনার স্ত্রী ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন খাবার চেখে দেখছেন, আল্লাহ আপনাকে যা যা দিয়েছেন তা দেখছেন আর আপনি বুঝতে পারছেন যে আল্লাহর দেয়া পুরস্কার শেষ হচ্ছে না। তাই এবার আপনি ঘরে ফিরে যাবেন বিশ্রাম নিতে এবং নিজেকে উপভোগ করতে। একবার চিন্তা করুন, যদি জান্নাতের সর্বনিম্ন স্তর হয় দুনিয়ার দশ গুণ, তাহলে একটা মানুষের তার নিজের সম্পত্তি দেখতে কত বছর লাগতে পারে ভাবুন। আপনি যে দেশে বাস করেন, সেই দেশের আপনি কতটুকু দেখেছেন? আমই নিশ্চিত করে বলতে পারি যে আপনি সে দেশের ২৫ ভাগও দেখেননি। আপনি হয়তোবা ৪-৫ টা শহর ঘুরে দেখেছেন, যাত্রার সময় দু-পাশের দৃশ্য দেখেছেন। কিন্তু তা পুরো দেশের তুলনায় তুচ্ছ। আর আপনি যে দেশে থাকেন, সেটাও তো কত ছোট। এই পৃথিবীর চার-পঞ্চমাংস হচ্ছে পানি, তার মধ্যে ছোট্ট একটি দেশ আমরা দেখে শেষ করতে পারি না, ভাবুন, আল্লাহ আপনাকে জান্নাতে যে সম্পত্তি দিবেন তা দেখে শেষ করতে আপনার শত শত বৎসর লেগে যাবে।

 

আপনি যখন আপনার বাসায় ফিরে যাবেন, সেখানে আপনাকে পানীয় পরিবেশন করা হবে। আল্লাহ সুবহা না ওয়া’ তা’আলা বলেন,

“ঘুরে ঘুরে বিশুদ্ধ সুরা তাঁদের পরিবেশন করা হবে। শুভ্র ও সমুজ্জল, যা হবে পানকারীদের জন্য সুস্বাদু। তাতে কোন রকম মাথা ঘুরানির মত ক্ষতিকর কিছু থাকবে না এবং তার কারণে তাঁরা মাতালও হবে না।” – সূরা সাফফাত (আয়াত ৪৫-৪৮)

 

ইবন কাছির বলেন, এই পানীয় তাঁদের মাথা ব্যাথার কারণ হবে না, এটা তাঁদের মাতালও করবে না।

ইবনে আব্বাস(রা) বলেন, ‘মদের চারটি খারাপ দিক রয়েছে। প্রথমটি হলো মাদকতা। দ্বিতীয়ত, মাথা ব্যাথা। তৃতীয়ত, মুত্রের মাত্রা বেড়ে যাওয়া এবং শেষটি হলো বমি হওয়া। আল্লাহ সুবহা না ওয়া’ তা’আলা জান্নাতের মদকে এই চারটি খারাপ দিক থেকে পবিত্র করেছেন।’

 

জান্নাতের বাসিন্দারা কখনও মাতাল হবে না। তাঁরা অনেক মদ পান করবে কিন্তু তাঁরা মাতাল হবে না। এটা তাদেরকে খুশি করবে, তাঁরা আনন্দিত হবে। দুনিয়াতে যা কিছু রয়েছে, সবকিছু, সবই হলো ভাল আর মন্দের মিশ্রণ। এখানে সম্পূর্ণ পবিত্র কিছুই নেই, পুরোপুরি ভাল যেমন নেই, পুরোপুরি খারাপও নেই। এজন্যই আল্লাহ এই পৃথিবীকে জান্নাত অথবা জাহান্নাম বানান নি। জান্নাত হওয়ার জন্য যথেষ্ট ভাল যেমন এই পৃথিবী নয়, তা জাহান্নাম হওয়ার জন্য যথেষ্ট খারাপও নয়। তাই মানুষ পৃথিবীতে যে মদ পান করে তা থেকে তারা কিছু আনন্দ পায় ঠিক, কিন্তু এর খারাপ দিকগুলো থেকেও তারা বাচতে পারে না। আর এ জন্যই মদকে হারাম করা হয়েছে। আল্লাহ সুবহা না ওয়া’ তা’আলা কুরআনে বলেছেন যে মদের ভাল দিক রয়েছে, কিন্তু এর খারাপ দিক ভালোর চেয়ে বেশি। জান্নাতের মদ হবে সব খারাপ দিক হতে পবিত্র।

এখন কথা হচ্ছে, জান্নাতের বাসিন্দারা খাওয়াদাওয়া করবে কেন? আল-কুরতুবি বলেন, ‘জান্নাতের মানুষ তাঁদের ক্ষুধা নিবারণের জন্য খাবে না, তাঁরা তৃষ্ণা মেটানোর জন্য পান করবে না, তাঁরা দুর্গন্ধ দূর করার জন্য সুগন্ধি মাখবে না, তাঁরা এই সব করবে উপভোগ করার জন্য, এসব হবে তাঁদের বিলাসিতা। একজন মানুষ পৃথিবীতে যা যা ভালোবাসতো তার সব কিছুই সে জান্নাতে পাবে। উপরন্তু, আল্লাহ তাঁর জন্য এমন সব জিনিস লুকিয়ে রেখেছেন যা সে জানেই না।’

 

একটা প্রশ্ন আসে যে কোন বোন যদি তালাকপ্রাপ্ত হোন, জান্নাতে তিনি কার সাথে থাকবেন? যদি স্বামী-স্ত্রী দুজনেই জান্নাতে যায়, তাঁরা একসাথে থাকবে। তাঁদের মধ্যে যদি পার্থক্য থাকে, তাহলে নিচে যে থাকবে তাকে উপরের স্তরে নিয়ে যাওয়া হবে। আল্লাহ সুবহা না ওয়া’ তা’আলা কাউকে নিচে নামিয়ে আনবেন না। তিনি তাঁর রহমত দিয়ে মানুষকে উপরের স্তরে উন্নিত করবেন।

আল্লাহ সুবহা না ওয়া’ তা’আলাবলেন,

“(সে তো হচ্ছে) এক চিরস্থায়ী জান্নাত, সেখানে তাঁরা নিজেরা (যেমনি) প্রবেশ করবে, (তেমনি) তাঁদের পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান সন্ততিদের মধ্যে যারা নেক কাজ করেছে তারাও (প্রবেশ করবে), জান্নাতের প্রতিটি দরজা দিয়ে ফেরেশতারাও তাঁদের সাথে প্রবেশ করবে।” – সূরা রাদ (আয়াত ২৩)

আল্লাহ সুবহা না ওয়া’ তা’আলা আরও বলেন,

“তাঁরা এবং তাঁদের সঙ্গিনীরা সুশীতল ছায়ায় সুসজ্জিত আসনের উপর হেলান দিয়ে বসে থাকবে” – সূরা ইয়াসিন (আয়াত ৫৬)

তো তাঁদের সবাইকে, পুরুষ ও নারী, উভয়কেই জান্নাতে অভ্যর্থনা জানানো হবে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যদি কোন স্বামী বিপত্নীক হোন আর তিনি আবার বিয়ে করেন, তখন কি হবে?  তিনি জান্নাতে গেলে তাঁর দুই স্ত্রীর সাথেই তিনি একত্রিত হবেন। কিন্তু যদি কোন মহিলা বেঁচে থাকেন আর তাঁর স্বামী মারা যান, এই মহিলা জান্নাতে কার সাথে থাকবেন? একটি দুর্বল বর্ণনায় আমরা জানতে পারি যে, আবু দারদা (রা) মারা যাওয়ার পর মুয়াওিয়া (রা) উম্মে দারদাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু উম্মে দারদা বলেন যে তিনি তাঁর স্বামীকে বলতে শুনেছেন যে রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘একজন নারী তাঁর সর্বশেষ স্বামীর সাথে জান্নাতে একত্রিত হবে।’ এই বর্ণনাটি দুর্বল। কিন্তু আরও দুটি বর্ণনায় এটি শক্তিশালী হয়ে যায়।

 

প্রথমত, আসমা বিনতে আবি বাকর (রা), আবু বাকর আস সিদ্দিকের (রা) মেয়ে, তিনি ছিলেন আয-যুবাইর ইবন আল-আও্বাম (রা), সেই দশ জনের একজন, যাদেরকে জান্নাতের সুসংবাদ দেয়া হয়েছিলো। আসমা (রা) একদা তাঁর পিতার নিকট অভিযোগ করলেন তাঁর স্বামীর ব্যাপারে যে তাঁর স্বামী খুব কঠোর লোক। 

আয-যুবাইর ইবন আল-আও্বাম (রা) খুব শক্তিশালী একজন মানুষ ছিলেন। সাহাবাদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালীদের অন্যতম। এক যুদ্ধে আয-যুবাইর ইবন আল-আও্বাম (রা) এক শত্রুর মাথায় তাঁর তলোয়ার দিয়ে আঘাত করেন। সেই তলোয়ার শত্রুর পুরো দেহ ছেদ করে তাঁর ঘোড়ার পিঠের জিনকে দু টুকরো করে ফেলে। এটা দেখে সাহাবারা বললেন, আপনার তলোয়ার তো অনেক শক্তিশালী! আয-যুবাইর ইবন আল-আও্বাম (রা) বলেন, ‘এটা তলোয়ারের শক্তি নয়, এটি আমার বাহুর শক্তি।’ অপর এক যুদ্ধে, তাঁর সামনে যে শত্রু সেনা ছিল, তার পুরো দেহ বরমে ঢাকা ছিল, শুধুমাত্র চোখের কিছু অংশ বাদে। আয-যুবাইর ইবন আল-আও্বাম (রা) সেই ছোট ছিদ্র দিয়ে তাঁর বর্শাটা ধুকিয়ে দিলেন। কিন্তু বর্শার ফলা যেহেতু মোটা, তাই সেটা ধুক্তে পারছিল না, আয-যুবাইর ইবন আল-আও্বাম (রা) বর্শাটাকে এত জোড়ে চাপ দিলেন যে বর্শার ফলা বেঁকে গেল। আবু বাকর আস সিদ্দিক (রা) সেই বর্শাটি নিজের সাথে রেখে দেয়ার অনুরোধ করলেন এবং তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এটা তাঁর কাছেই রাখলেন। আবু বাকর মারা যাওয়ার পর উমার বিন আল খাত্তাব (রা )সেটি পাওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন এবং আমৃত্যু টা সাথে রাখলেন। তাঁর মৃত্যুর পর সেটা উসমান ইবনে আফফান (রা) সেটি নিলেন। আর তাঁরও মৃত্যুর পর সেটি আব্দুল্লাহ ইবনে আয-যুবাইর ইবন আল-আও্বাম (রা) সেটি নিয়ে যান। তো এই শক্তিশালী মানুষটি তাঁর স্ত্রীর সাথে আচরণেও একটু কঠোর ছিলেন। 

তাই আসমা (রা) তাঁর পিতার কাছে অভিযোগ করলেন। তাঁর অভিযোগ শুনে আবু বাকর আস সিদ্দিক এই কথাগুলো বলেন, ‘হে আমার মেয়ে, ধৈর্য ধারন করো, কেননা কোন নারীর যদি একজন সৎ স্বামী থাকে আর তাঁর মৃত্যুর পর সে আর কাউকে বিয়ে না করে, আল্লাহ তাদের দুইজনকে জান্নাতে একত্রিত করবেন।’ আবু বাকর আস সিদ্দিক (রা) জানতেন যে তাঁর মেয়ের কষ্ট হচ্ছিল আয-যুবাইর ইবন আল-আও্বাম (রা) এর আচরণে। কিন্তু তিনি এও জানতেন যে আয-যুবাইর ইবন আল-আও্বাম (রা) জান্নাতে সবচেয়ে উচ্চস্থানের অধিকারীদের একজন হবেন। আর তিনি চাইতেন তাঁর মেয়েও যেন সেই উচ্চাসন লাভ করতে পারে, তাই তিনি তাঁর মেয়েকে ধৈর্য ধারন করতে বলেন। 

এই দুনিয়াটাই তো সব না, আখিরাতটাই আসল জীবন। আমই আমার প্রিয় ভাই ও বোনদের বলতে চাই যে, আপনি যদি আপনার স্বামী অথবা স্ত্রীর কোন বিষয় অপছন্দ করেন কিন্তু আপনার স্বামী/স্ত্রী যদি আল্লাহর নেক বান্দা হোন, তাহলে ধৈর্য ধরুন। 

একদা উমার বিন আল খাত্তাবের (রা) কাছে এক মহিলা এসে বলল, ‘হে আমির আল মুমিনিন, আমই আমার স্বামীকে চাই না।’ উমার বিন আল খাত্তাব (রা) বলেন, ‘সব বিয়ে প্রেমের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়, এটা হচ্ছে একটা দায়িত্ব’, একটা মুসলমান পরিবার গড়ার দায়িত্ব, মুসলমান পরিবেশে বাচ্চাদের বেড়ে উঠার সুযোগ দেয়ার দায়িত্ব। তবুও স্বামী স্ত্রীর মাঝে একটা ভাল সম্পর্ক থাকা জরুরি, রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন, ‘তোমাদের স্বামী-স্ত্রীদের সাথে খারাপ ব্যাবহার করো না, কেননা তোমরা যদি তাঁদের কোন বিষয় অপছন্দ করো, তাঁদের এমন অনেক দিক আছে যা তোমরা ভালোবাসো।’

 

আর দ্বিতীয় বর্ণনাটি হচ্ছে, হুযাইফা (রা) তাঁর মৃত্যুর পূর্বে তাঁর স্ত্রীকে বলেন, ‘তুমি যদি পরকালে আমার স্ত্রী হতে চাও, তাহলে আমার পরে কাউকে বিয়ে করো না, কারণ আমি রাসুলুল্লাহ (সা)-কে বলতে শুনেছি যে একজন নারী পরকালে তাঁর শেষ স্বামীর সাথে থাকবে।’

 

আরেকটি বিষয়ে আমি বলতে চাই, এটি অনেকের মনে প্রশ্ন হয়ে আছে, হুর আল-‘ইন এর ব্যাপারে। অনেক বোনের মনে এই প্রশ্ন আসে যে জান্নাতে তাঁদের কি হবে? পুরুষদের জন্য হুর থাকবে কিন্তু তাঁদের কি হবে? কোন বোনের মনে হতে পারে যে জান্নাতে আমার স্বামীর এতগুলো স্ত্রী থাকবে, দুনিয়াতে তো আমি একা ছিলাম তাঁর সাথে।

প্রিয় বোনেরা আমার, শুরুতেই বলে নেই যে জান্নাতে কারো মন খারাপ করার মতো কোন বিষয় থাকবে না। কারো কখনও সেখানে মন খারাপ হবে না। আল্লাহ সুবহা না ওয়া’ তা’আলা আরও বলেন, ‘সেখানে তাঁদের মন থেকে সব খারাপ লাগা দূর করে দেয়া হবে।’ তাই সেখানে কোন হিংসা থাকবেন না, কোন মন্দ লাগা থাকবে না, কোন ধরনের খারাপ অনুভুতির স্থান জান্নাতে থাকবে না।

 

দ্বিতীয়ত, আল্লাহ তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে অবগত আছেন, তিনি জানেন পুরুষরা কি চায়, নারীরা কি চায়। তাঁদের অন্তর যা চায় আল্লাহ তাদেরকে তার সবকিছু দেবেন। আল্লাহ সুবহা না ওয়া’ তা’আলা জানেন যে পুরুষরা অনেক স্ত্রী চায়, এবং এটাই বাস্তবতা, কেউ যদি টা অস্বীকার করতে চায় সেটা ভুল হবে। আর আল্লাহ সুবহা না ওয়া’ তা’আলা তাদেরকে তা দিয়ে দিবেন। জান্নাতে সব পুরুষই কমপক্ষে দুইজন স্ত্রী পাবে। এবং নারীদেরও এমন অনেক বাসনা আছে। আল্লাহ সুবহা না ওয়া’ তা’আলা তাঁদের সব বাসনা পুরন করবেন আর এমন অনেক জিনিস দিবেন যা তাঁরা কল্পনাও করতে পারে না। তাই মন খারাপ করার কোন কারণ নেই। আর নারীরাও একের অধিক স্বামী চায় না, এটা তাঁদের প্রকৃতি। মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকেও পুরুষ আর মহিলারা আলাদা। আল্লাহ সুবহা না ওয়া’ তা’আলা আমাদের সৃষ্টিকর্তা, তিনি জানেন আমরা কি চাই, আর জান্নাতে তিনি তা পুরন করবেন। 

ইবনে কায়্যিম বলেন, ‘আলেমদের আমাদের দুনিয়াতে দরকার, আখিরাতেও দরকার। দুনিয়াতে দরকার আমাদের সঠিক পথ দেখানোর জন্য, আর জান্নাতে দরকার আল্লাহর কাছে কি চাইতে হবে তা জানার জন্য।’ আমরা কি চাই সেটাই আমরা জানি না। জান্নাতে হয়তোবা আমাদের আলেমদেরকে জিজ্ঞেস করতে হবে, ‘আমরা আল্লাহর কাছে কি চাইতে পারি?’। কিন্তু আল্লাহ জানেন আমরা কি চাই। আর আল্লাহ আপনাকে তা দিবেন। তাই হতাশ হবেন না। আল্লাহ আপনার মনের আশা পুরন করবেন।

 

সাল্লাল্লাহু ‘আলা নাবিয়্যিনা মুহাম্মাদ।