লাহোর প্রস্তাব : যেভাবে উত্থাপিত হয় ভারতবর্ষে মুসলমানদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের দাবি

আজ ২৩ মার্চ। ১৯৪০ সালের এ দিনে লাহোরে মুসলিম লীগের একটি অধিবেশনে উত্থাপিত হয়েছিল ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব। লাহোর প্রস্তাব অখণ্ড ভারতের বিভক্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আনুষ্ঠানিকভাবে এ দিনই সর্বপ্রথম আলোচনায় আসে ভারতবর্ষে মুসলমানদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি।

ভারত বিভক্তির আগে ব্রিটিশ শাসনামলে উপমহাদেশীয় রাজনীতিতে মুসলমানরা সব সময়ই কোনঠাসা ছিলেন। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি ব্রিটিশ রাজের একটা আনুকূল্য পেত সবসময়ই। পক্ষান্তরে মুসলমানরা ব্রিটিশদের হাতে যেমন নিগৃহীত হতেন, তেম্নি হিন্দুত্ববাদীদেরও অসহযোগিতা ছিল তাদের প্রতি। ১৭৫৭ পলাশী ট্রাজেডি ও বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজুদ্দৌলার নির্মম পরিণতি ছিল ইংরেজ ও তাদের এদেশীয় এজেন্টদের মুসলিম-বিরোধী ষড়যন্ত্রেরই ফসল। বিষয়টি আরও দিবালোকের মতো ষ্পষ্ট হয়ে ওঠে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে। মূলত বঙ্গভঙ্গ বাংলার ইতিহাসে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

বাংলার প্রশাসনিক কাজে সুবিধার জন্য ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর ভারতের ভাইসরয় লর্ড কার্জনের আদেশে ১ম বঙ্গভঙ্গ সম্পন্ন হয়। বাংলা বিভক্ত করে ফেলার ধারণাটি অবশ্য কার্জন থেকে শুরু হয়নি। ১৭৬৫ সালের পর থেকেই বিহার ও উড়িষ্যা বাংলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ফলে সরকারি প্রশাসনিক এলাকা হিসেবে বাংলা অতিরিক্ত বড় হয়ে যায় এবং বৃটিশ সরকারের পক্ষে এটির সুষ্ঠু শাসনক্রিয়া দুরূহ হয়ে পড়ে। বঙ্গভঙ্গের সূত্রপাত এখান থেকেই। কিন্তু বাংলার এই বিভক্তির ফলে পূর্ববঙ্গের মুসলমান কিছুটা হলেও আনুকুল্য পায়। তারা শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও গণযোগাযোগের ক্ষেত্রে এগিয়ে যায় অনেক ক্ষেত্রেই।

মূলত প্রশাসনিক কাজে সুবিধার জন্য ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ ঘটনা ঘটলেও তা পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের জন্য সাপেবর হিসেবে দেখা দেয়। ফলে নতুন প্রদেশের শিক্ষা, কর্মসংস্থান ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাদের সুযোগ বেড়ে যায়। কিন্তু পশ্চিম বঙ্গের জনগণ এই বিভক্তি মেনে নিতে পারে নি। কারণ, হিন্দুরা মুসলমানদেরকে তাদের অধিনস্ত প্রজা ভাবতেই বেশি পছন্দ করত। তাই বঙ্গভঙ্গের কারণে পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা কিছুটা হলেও যে সুবিধা অর্জন করেছিল তা তাদের পছন্দ হয়নি। ফলে তারা বঙ্গভঙ্গ রদের জন্য আন্দোলন শুরু করে।

তারা এই বিভাজনের বিরুদ্ধে হিন্দুদের ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজ লাগাতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। তারা বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদন ঘটেছে বলে ব্যাপক প্রচার চালায় এবং প্রচুর পরিমাণে জাতীয়তাবাদী লেখা এই সময় প্রকাশিত হয়। ফলে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি হয়। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য যে, ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের সময় আবারও বাংলা বিভক্ত হলেও এ সময় অবিভক্ত বাংলার ধ্বজাধারীরা কোনো টুশব্দও করেনি।

১৯০৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গভঙ্গ রদ করার প্রস্তাবকদের জন্য এক মর্মস্পর্শী গান ‘আমার সোনার বাংলা’ লেখেন, যা অনেক পরে, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতে পরিণত হয়। মূলত পশ্চিম বাংলার জনগণ বঙ্গবঙ্গের কারণে পূর্ববাংলার মুসলমানরা যে আনুকুল্য পেয়েছিল তা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি। তাই তারা বঙ্গভঙ্গ রদের জন্য তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে এবং ফলশ্রুতি ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়।

ভাষাতাত্ত্বিক এক নতুন বিভক্তির মাধ্যমে হিন্দি, ওড়িয়া এবং অসমীয়া অঞ্চলগুলো বঙ্গ হতে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা প্রশাসনিক কাঠামোর আওতায় আনা হয়। এরই সাথে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে নয়া দিল্লিতে স্থানান্তর করা হয়। ফলে ঔপনিবেশিক শাসন পরবর্তী অবিভক্ত ভারতের ধারণাটি অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়। আর এজন্য মুসলমানরা দায়ি ছিলেন না বরং হিন্দুদের সাম্প্রদায়িক মনোভাবই এজন্য প্রধানত দায়ী।

মূলত ভারতীয় রাজনীতিকদের এমন সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তির কারণেই ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের পর ভারতকে অখণ্ড রাখা সম্ভব হয়নি। আর সে জন্যই মুসলিম নেতৃবৃন্দের বড় একটি অংশ ভারত থেকে বের হয়ে এসে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলো নিয়ে স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রের ধারণা উপস্থাপন করেছিলেন ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবে। কারণ, ভারতীয় রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতার উপস্থিতির কারণে অখণ্ড ভারতে যোগ দেয়া তারা সমীচীন মনে করছিলেন না।

তাই মুসলিম লীগের কর্মীদের একটি ক্ষুদ্র দল নিয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৪০ সালের ১৯ মার্চ লাহোরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। অধিবেশনে যোগদানের জন্য বাংলার মুসলিম লীগ দলের নেতৃত্ব দেন শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক এবং তাঁরা ২২ মার্চ লাহোরে পৌঁছেন। বাংলার প্রতিনিধি দলকে উষ্ণ অভ্যর্থনার মাধ্যমে বরণ করে নেওয়া হয়।

পরদিন বসে মুসলিম লীগের সাধারণ অধিবেশন। অধিবেশনে মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ দীর্ঘ বক্তব্য রাখেন। এবং এ বক্তব্যেই তিনি দ্বি-জাতি তত্ত্বের প্রয়োজনীয়তা এবং হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার মোকাবেলায় মুসলমানদের স্বতন্ত্র ভূমি কতটা জরুরি তা আলোচনা করেন।

অধিবেশনে স্বতন্ত্র আবাস ভূমির প্রস্তাবনা উত্থাপন করেন শেরে বাংলা একে ফজলুল হক।

প্রস্তাবনাটির প্রারম্ভিক খসড়া তৈরি করেছিলেন পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী সিকান্দার হায়াদ খান। পরে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সাবজেক্ট কমিটি এতে আমূল সংশোধন আনয়ন করে। এবং ২৩ মার্চ সাধারণ অধিবেশনে তা উত্থাপনের জন্য একে ফজলুল হককে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

একে ফজলুল হক প্রস্তাবনাটি উত্থাপন করলে চৌধুরী খালিকুজ্জামান ও অন্যান্য মুসলিম নেতৃবৃন্দ তা সমর্থন করেন। প্রস্তাবটি উপস্থাপনের সময় ফজলুল হক বক্তব্য রাখেন।

প্রস্তাবের মূলকথা ছিল, ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্ব এলাকাসমূহের মতো যে সকল অঞ্চলে মুসলমানগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ, সে সব অঞ্চলে ‘স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ’ গঠন করতে হবে যার মধ্যে গঠনকারী এককগুলি হবে স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম। আর এদের একটি কেন্দ্র থাকবে।

২৪ মার্চ প্রবল উৎসাহের মধ্য দিয়ে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়।

বাংলার মুসলমানগণ, যারা উনিশ ও বিশ শতকের প্রথম দিকে নিজেদের আত্মপরিচয় খুঁজে ফিরছিল, পরিশেষে লাহোর প্রস্তাবের মধ্যে তার সন্ধান পায়। লাহোর প্রস্তাব তাদেরকে একটি জাতীয় চেতনা প্রদান করে। তখন থেকে মুসলিম রাজনীতির প্রধান ধ্যানধারণা হিন্দুদের অবিচারের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানোর পরিবর্তে স্বতন্ত্র রাজনৈতিক অস্তিত্ব অর্জনের দাবির রূপ পরিগ্রহ করে।

কিন্তু হিন্দু সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রসমূহ লাহোর প্রস্তাবকে ক্যামব্রিজে বসবাসরত দেশত্যাগী ভারতীয় মুসলমান রহমত আলী কর্তৃক উদ্ভাবিত নকশা অনুযায়ী ‘পাকিস্তানের জন্য দাবি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। অথচ প্রস্তাবের কোথাও একক রাষ্ট্র বা পাকিস্তানের উল্লেখ ছিল না তখন পর্যন্ত, বরং প্রস্তাবের মূলকথা ছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে আলাদা আলাদা একেকটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করা। এবং এগুলোর সমন্বয়ের জন্য তাদের মধ্য থেকে একটি কেন্দ্র রাষ্ট্র গঠন করা। হিন্দু সংবাদপত্রসমূহের এ প্রোপাগাণ্ডা ও প্রচারণার কারণেই মূলত মুসলিম লীগের নেতৃত্ব এবং সাধারণ সমাজে একক পাকিস্তানের একটা ধারণা তৈরি হয়। এবং এরই পরিপ্রেক্ষিতে ৪৭ সালে একক পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়।

লাহোর প্রস্তাবে স্বায়ত্বশাসিত আলাদা আলাদা মুসলিম রাষ্ট্রগঠন এবং এর একটি কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র থাকার কথা উল্লেখ থাকলেও কেন্দ্রটি কোথায় হবে, স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলগুলো কতটা স্বাধীনতা পাবে, এসবের কোনোকিছুই স্পষ্ট ছিল না। এই অস্পষ্টতার দরুণই মুসলিম রাজনীতিবিদদের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ক্ষমতার অপব্যবহার করে, স্বায়ত্তশাসিত পূর্ববাংলায় নানা ধরনের বঞ্চনা ও সংকটের সৃষ্টি করে এবং এরই পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয় ঘটে।


মুসান্না মেহবুব
মূলঃ fateh24