উপার্জনে নৈতিকতার প্রেরণা – ড. মুহাম্মাদ জুনাইদ নদভী

অর্থনীতির প্রধান উপলক্ষ উপার্জন। সেই উপার্জনের নীতিতে ইসলামের দিকনির্দেশনা অনেক স্পষ্ট ও পরিষ্কার। দিয়ানতদারি ও সততা হচ্ছে বৈধ উপার্জনের বড় অনুষঙ্গ। ব্যবসা বা উপার্জনের ক্ষেত্রে এই সততা ও নৈতিকতা অবলম্বন মানব-জীবনে উজ্জ্বলতা নিয়ে আসতে পারে। ব্যবসা ও উপার্জন বিষয়ক কয়েকটি হাদীসের ভাষ্যের প্রতি দৃষ্টি দিলে বিষয়টি অনুধাবন করা আমাদের জন্য সহজ হতে পারে।

হযরত রাফে ইবনে খাদীজ রা. বলেন, কোনো এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলো, হে আল্লাহর রাসূল উপার্জনের মাধ্যমগুলোর মাঝে কোন মাধ্যমটি সবচেয়ে উত্তম এবং পবিত্র? নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিলেন, ‘নিজের হাতের কাজ এবং বিশ্বস্ততাপূর্ণ ব্যবসা।’  -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৭২৬৫

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্য করে ইরশাদ করেছেন, ব্যবসায় অধিক কসম করা থেকে বিরত থাক। এটি সাময়িক সময়ের জন্য ব্যবসার প্রসার ঘটালেও বরকত নষ্ট করে দেয়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৬০৭

হযরত কায়েস রা. বলেন, আমাদের ব্যবসায়ীদের বলা হত দালাল। একদিন আমাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তখন তিনি আমাদেরকে এর চেয়েও সুন্দর একটি নাম দেন। তিনি এরশাদ করেন, হে ব্যবসায়ীরা! পণ্য বিক্রি করতে গিয়ে অনেক অহেতুক কথা বলা এবং মিথ্যা শপথ করার পরিবেশ তৈরি হয়। এজন্য তোমরা সদকা কর, যেন তোমাদের ত্রুটি-বিচ্যুতির কাফফারা হয়ে যায়। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৩২৬; জামে তিরমিযী, হাদীস ১২৫০

নবীজী আরও এরশাদ করেন, কোনো ব্যবসায়ীর জন্য উচিত নয় কোনো জিনিস বিক্রি করা এবং তার ভেতরের দোষত্রুটির কথা বর্ণনা না করা। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৭৪৫১; মুজামে কাবীর, তবারানী ১৭/৩১৭

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার একজন শস্যব্যবসায়ীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। সে সময় তিনি তার শস্যের স্ত‚পের ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিলেন। তখন ভেতরের শস্যগুলোতে তিনি কিছু কিছু আর্দ্রতা অনুভব করলেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কী? সেই ব্যবসায়ী উত্তর দিলেন, বৃষ্টিতে ভিজে গিয়েছিল। ‘নবীজী তখন বললেন, ভেজা অংশটা উপরে রাখলে না কেন?’ তারপর নবীজী আরো বললেন, যারা আমাদেরকে ধোঁকা দেয় তারা আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।  -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০২

উপরে বর্ণিত হাদীসগুলোতে ব্যবসার ক্ষেত্রে বিভিন্ন নৈতিকতার প্রেরণা পাওয়া যায়। একইসঙ্গে দেখা যায়, ওই যুগের সম্ভাব্য ব্যবসায়িক ধোঁকা বা প্রতারণার বিষয়ে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে। সেসব অমোঘ সতর্কবাণীকে নীতি হিসেবে গ্রহণ করলে স্পষ্টত বোঝা যায় আজকের সিংহভাগ ব্যবসায়ী সমাজের প্রতারণা ও ক্ষতিকর পদক্ষেপ সম্পর্কে হাদীসের ভাষ্য কতো কঠোর হতো। কারণ, আগের যুগে প্রতারণার ক্ষেত্রগুলোতে ক্রেতাকে ঠকিয়ে শুধু কিছু অবৈধ লাভের চিন্তা করা হতো। পক্ষান্তরে বর্তমানে ক্রেতাকে ঠকিয়ে লাভ হাতানোর জন্য পণ্যের সঙ্গে ফরমালিনসহ নানা ধরনের প্রাণঘাতী বিষেরও সংমিশ্রণ ঘটানো হয়। এভাবে অর্থ ও জীবন দুইয়েরই ক্ষতি সাধন করা হয়। মুসলিম জীবনের সঙ্গে এই ভয়ংকর প্রতারণার কোনো মিল নেই।

দুই. আরবীতে ‘ইহতিকার’ কথার বাংলা অর্থ হচ্ছে গুদামজাত করা। ব্যবসায়িক পরিভাষায় বলা হয় নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্য আটকে রেখে স্ত‚প করা, বাজারে না ছাড়া। এভাবে মূল্যবৃদ্ধির অপেক্ষা করা। এরপর মূল্য বেড়ে গেলে পরে আটকে রাখা পণ্য বাজারে ছাড়া এবং অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এজাতীয় প্রবণতার প্রতি তীব্র অসন্তোষ ব্যক্ত করেছেন। এমন মানসিকতার প্রতি আঘাত করেছেন। মূলত এমন মানসিকতা ও প্রবণতা হৃদয়বান মানুষকে পাথরদিলের বে-রহম প্রাণীতে পরিণত করে দেয়। এটি ইসলামের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন। কারণ ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে মানুষের প্রতি সহৃদয়তা ও সহানুভ‚তির প্রেরণা জোগানো। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যবসায়ী পণ্য আবদ্ধ ও স্ত‚প করে সে গোনাহগার। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৬০৫

অপরদিকে নবীজীর এরশাদ রয়েছে, যে ব্যবসায়ী নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আবদ্ধ করে না, বরং সময়মতো বাজারে পণ্য নিয়ে আসে, সে আল্লাহর রহমত পাওয়ার অধিকারী; তাকে আল্লাহ রিযিক দেবেন। আর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আবদ্ধকারী হচ্ছে অভিশপ্ত।  (সে আল্লাহর রহমত থেকে মাহরূম হবে। কারণ, সে মন্দকাজ করেছে।) -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ২১৫৩

হযরত মুআয রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আবদ্ধকারী ব্যক্তি কতই না মন্দ! যদি পণ্যদ্রব্যের মূল্য কমে যায় তাহলে সে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয় আর যদি মূল্য বেড়ে যায় তাহলে সে আনন্দিত হয়।  -শুআবুল ঈমান, বায়হাকী ৭/৫২৫

উপরের হাদীসগুলো দ্বারা বোঝা গেল গুদামজাত করা বা স্ত‚প করাসহ ভোক্তা-সাধারণকে বিপদে ফেলে পণ্যের দাম বাড়ানো একটি অত্যন্ত বাজে কাজ। একইভাবে পরিকল্পনা করে জোটবদ্ধ হয়ে পণ্যের দাম অযৌক্তিক উপায়ে বাড়িয়ে দেওয়াও মারাত্মক অন্যায়। অথচ বিভিন্ন মৌসুমে এজাতীয় স্ত‚পিকৃত করা কিংবা পরিকল্পিত জোটবদ্ধতার ভিত্তিতে মূল্যবৃদ্ধি ঘটানোর পরিস্থিতি প্রায়ই আমাদের চোখে পড়ে। বলা বাহুল্য, এজাতীয় প্রবণতার সঙ্গে ইসলামের সহৃদয়তা ও সহানুভ‚তিশীল ব্যবসা-নীতির কোনো সম্পর্ক নেই।

তিন. হযরত আবু হুরায়রা রা. রেওয়ায়েত করেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, উত্তম উপার্জন হচ্ছে মজদুরের উপার্জন, যদি সে তার মালিকের কাজ হীতাকাক্সক্ষা ও নিষ্ঠার সঙ্গে করে। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৮৪১২

বিদায় হজ্বের সময় নবীজী দুস্থদের মাঝে সম্পদ বণ্টন করছিলেন। এ সময় দুজন ব্যক্তি এসে কাতারে শামিল হয়ে গেল। নবীজী তাদেরকে দেখলেন।

তাঁর চোখে তাদেরকে মনে হলো সুস্থ ও সচ্ছল। তখন নবীজী বললেন, যদি তোমরা চাও তবে এ সম্পদ থেকে আমি তোমাদের দিতে পারি। কিন্তু ধনী, সুস্থ ও কাজকর্মে সক্ষম মানুষের জন্য এ সম্পদে কোনো অংশ নেই। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৬৩৩

একবার এক ব্যক্তি নবীজীর পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেন। সাহাবায়ে কেরাম দেখলেন জীবিকা অর্জনে সে ব্যক্তি খুবই তৎপর ও মনোযোগী। তখন উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম (ওই ব্যক্তিকে ইঙ্গিত করে) নবীজীর সামনে আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! যদি ওই ব্যক্তির এই দৌড়ঝাঁপ ও মনোযোগ আল্লাহর পথে নিবেদিত হতো তাহলে কত উত্তম হতো! তখন নবীজী এরশাদ করলেন, যদি সে নিজের সন্তান-সন্তুতির লালন-পালনের জন্য এই দৌড়ঝাঁপ করে থাকে তাহলে সেটাই আল্লাহর পথে দৌড়ঝাঁপের মধ্যে গণ্য হয়ে যাবে। আর যদি সে নিজের জন্য চেষ্টা-শ্রম ব্যয় করে থাকে আর তার উদ্দেশ্য থাকে মানুষের সামনে নিজের হাত পাতা থেকে বেঁচে থাকা তাহলে এই চেষ্টাও আল্লাহর পথের চেষ্টা হিসেবে গণ্য হবে। -আল মুজামুল আওসাত, তবারানী, হাদীস ৪২২৬; আল মুজামুল কাবীর, তবারানী, ১৯/১২৯

মূলত সৎ ব্যবসায় নিয়োজিত থাকা, অসৎ ব্যবসা থেকে বিরত থাকা এবং কায়িক শ্রম দিয়ে উপার্জন ইসলামের অন্যতম উপার্জননীতি। অসততা, অলসতা এবং সক্ষম সচ্ছল হওয়া সত্তে¡ও অন্যের দুয়ারে হাত পাতা ইসলামের দৃষ্টিতে নিন্দনীয়। ইসলামের এই সৌন্দর্যমণ্ডিত উপার্জননীতি অনুসরণ করে চললে নিঃসন্দেহে যে কোনো মুসলমান দুনিয়া ও আখেরাতে কামিয়াব হতে পারবে। একই সঙ্গে মুসলমানদের সমাজে নেমে আসবে সহৃদয়তা ও সাচ্ছন্দ। অপর জাতি-গোষ্ঠির সামনে তাদের নৈতিক চরিত্রের উজ্জ্বল চেহারা প্রশংসিত ও আকর্ষণীয় হবে এবং এ আচরণ দ্বীনী দাওয়াতের ক্ষেত্রে বড় ভ‚মিকা রাখবে।

[উর্দূ একটি পত্রিকা থেকে অনুবাদ ও অবলম্বন : শরীফ মুহাম্মদ]


জুমাদাল উলা ১৪৩৭ – ফেব্রুয়ারি ২০১৬
মাসিক আলকাউসার