ওলীমা, আকীকা ও খতনা – মুফতী মনসূরুল হক (দা.বা)

শরীআতের দৃষ্টিতে ওলীমা, আকীকা ও খতনা

ওলীমা প্রসঙ্গ

ওলীমার শাব্দিক অর্থ খানা খাওয়ানো। শরী‘আতের পরিভাষায় বিবাহের পর ছেলে বা তার পরিবারের পক্ষ থেকে যে খানার দাওয়াত দেওয়া হয় তাকে ওলীমা বলে।

ওলীমার হুকুম

ওলীমা করা সুন্নাত । হাদীস শরীফে এসেছে, হযরত আনাস রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রাযি. এর শরীর বা কাপড়ে হলুদ রঙের চিন্হ দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কী ? জবাবে তিনি বললেন, আমি একটি খেজুর দানার পরিমাণ সোনা দিয়ে একটি মেয়েকে বিবাহ করেছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেন, আল্লাহ তোমার বিবাহে বরকত দিন। আর তুমি ওলীমা করো যদিও একটি বকরি দ্বারা হোক না কেনো। বুখারী ১/৭৭৭, মুসলিম ১/৪৬১

ওলীমার সময়

বিবাহের তিন দিনের মধ্যে যেকোনো সময় ওলীমার আয়োজন করা যেতে পারে। তবে কনের রুখসতির পর তথা বর-কনের বাসর হওয়ার পর  ওলীমা করা উত্তম। এতে বিবাহের পরিপূর্ণ এ‘লান ও প্রচার প্রসার হয়ে যায়। ফাতহুল মুলহিম ৬/৪০৮

ওলীমার দাওয়াত গ্রহণ করার হুকুম

ওলীমার দাওয়াত গ্রহণ করা সুন্নাত। হাদীস শরীফে এসেছে, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যখন তোমাদের কাউকে ওলীমার দাওয়াত দেওয়া হয় তখন সে যেন তাতে উপস্থিত হয়। বুখারী ১/৭৭৭, মুসলিম ১/৪৬১

যদি ওলীমার সভায় শরীয়ত বিরোধী কোনো কিছু হওয়ার আশংকা থাকে আর দাওয়াতি মেহমানের উক্ত কাজ বন্ধ করার ক্ষমতা থাকে, তাহলে মজলিসে অংশগ্রহণ করে তা বন্ধ করে দিবে। কিন্তু বন্ধ করার ক্ষমতা না থাকলে সেখানে অংশগ্রহণ করবে না। আর যদি উপস্থিত হওয়ার পর শরীয়ত বিরোধী কার্যকলাপ দেখা যায়, তাহলে সমাজের দ্বীনদার ও ইমাম, মুয়ায্যিন এবং মুবাল্লিগ ভায়েরা তা বন্ধ করার ব্যবস্থা করবেন, আর বন্ধ না করতে পারলে আহার না করেই চলে আসবেন। ফাতাওয়ায়ে আলমগিরি খণ্ড-৫ কারাহিয়া অধ্যায়

কয়েকটি বর্জনীয় কাজ

১. ছেলে নিজের সামর্থ্যের বাহিরে ওলীমার ব্যবস্থা করবে না এবং এর জন্য ধার-কর্জ করারও প্রয়োজন নেই। যদি কোনো কিছুর সামর্থ্য না থাকে তবে শুধু মিষ্টিমুখ করিয়ে দিবে। ওলীমাতে পেট ভরে খাওয়ানো জরুরী নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর এক স্ত্রীর ( উম্মে সালামা রাযি.) ওলীমা করেছিলেন মাত্র দুই মুদ যব দ্বারা। বুখারী ১/৭৭৭

২. ওলীমার দাওয়াতে শুধু ধনী ও সমাজের মান্য গণ্য ব্যক্তিবর্গকে দাওয়াত করবে না। বরং গরীব শ্রেণীকেও দাওয়াত করবে। হাদীসে এসেছে, হযরত আবূ হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, সর্বাপেক্ষা মন্দ খানা হচ্ছে সেই খানা, যাতে কেবল ধনীদের দাওয়াত দেওয়া হয়, আর গরীবদের বাদ দেওয়া হয়। বুখারী ১/৭৭৭, মুসলিম ১/৪৬১

৩. আমাদের সমাজে বরযাত্রার নামে যে ধূমধাম করা হয় এটা এবং বর পক্ষের এই শর্ত করা যে, আমাদের এই পরিমাণ লোককে খাওয়াতে হবে এসব শরীয়তে অনুমোদিত নয়। এ ধরণের দাওয়াতে শরীক হবেন না। মুহিউস সুন্নাহ হযরত মাওলানা শাহ আবরারুল হক রহ. বলতেন, এটা হচ্ছে ডাকাতির খানা। হাদীসে এধরণের দাওয়াতে অংশগ্রহণকারীদের ব্যাপারে এসেছে যে, তারা চোর হয়ে প্রবেশ করলো আর ডাকাত হয়ে বের হলো। সুতরাং এধরণের খানা থেকে দূরে থাকা চাই। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের তাওফীক দান করুন।

৪. শরী‘আতের দৃষ্টিতে বিয়েতে মাত্র দুই ধরনের খরচ থাকে মহর ও ওলীমা। আর এই উভয় খরচ স্বামীর যিম্মায়। সুতরাং মেয়ের বাপের উপর দাওয়াত, যৌতুক ইত্যাদি কোনো কিছুর বোঝা চাপানো জায়িয নেই।

আকীকা প্রসঙ্গ

আকীকা করা মুস্তাহাব এবং এর দাওয়াত কবুল করা জায়িয। ফাতাওয়া রহীমিয়্যাহ ২/৯১

ছেলে বা মেয়ের জন্মের পর সপ্তম দিবসে আকীকা করা উত্তম। সপ্তম দিনে না করতে পারলে পরে যেকোনো দিন করতে পারবে। তবে সপ্তম দিন যে বার ছিল সেই বারে করা ভালো। হযরত ইবনে উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, সন্তান জন্মের সপ্তম দিনে তার আকীকা করো এবং তার জন্য সুন্দর নাম রাখো। তাবারানী আউসাত হা.১৯৮১

ছোট বয়সে যদি আকীকা করা না হয়, তাহলে যেকোনো বয়সে নিজের আকীকা নিজে করতে পারবে। হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবী হওয়ার পর নিজের জন্য আকীকা করেছেন। তাবারানী আউসাত হা. ৯৯৪

কয়েকটি জরুরী মাসআলা

১.আকীকার মধ্যে ছেলে সন্তানের জন্য দুইটি বকরি আর মেয়ে সন্তানের জন্য একটি বকরি জবাই করা উত্তম।  ছেলের জন্য দুইটি বকরি সম্ভব না হলে একটিই যথেষ্ট । রদ্দুল মুহতার- ৫/২১৩

২. কেউ যদি কুরবানীর গরুর মধ্যে আকীকা করতে চায়, তাহলে সে ছেলের জন্য দুই অংশ আর মেয়ের জন্য এক অংশ বরাদ্দ করবে। ছেলের জন্য দুই অংশ সম্ভব না হলে এক অংশ বরাদ্দ করতে পারে। রদ্দুল মুহতার ৫/২১৩

৩. গরু ও উট দ্বারা একাধিক বাচ্চার আকীকা করা জায়িয আছে । ফাতাওয়া মাহমুদিয়া ২/৯১

৪. আকীকা করা মুস্তাহাব । কেউ যদি আকীকা না করে তাহলে সে গুনাহগার হবে না। ফাতাওয়া রহীমিয়া ২/৯১

৫. যে পশু দ্বারা কুরবানী করা বৈধ সেই পশু দ্বারা আকীকা করতে হয়। যেমনঃ ছাগল, ভেড়া এক বছরের হতে হবে। আর গরু ও মহিষ দুই বছরের হতে হবে। রদ্দুল মুহতার ৫/২১৩

৬. আকীকার গোস্ত কাঁচা বণ্টন করা বা রান্না করে বণ্টন করা অথবা দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানো কিংবা কাউকে না খাওয়ানো সবই জায়িয আছে। আর আকীকার গোস্ত ধনী-গরীব সবাই খেতে পারবে। রদ্দুল মুহতার ৫/২১৩

৭. আকীকার চামড়ার মূল্য কুরবানীর চামড়ার ন্যায় সদকা করে দিতে হবে ।

আকীকার ফযীলতঃ আকীকার দ্বারা বিভিন্ন বিপদাপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। বুখারী ২/৮২২

জন্মের সপ্তম দিবসে কয়েকটি করণীয় কাজ

১. আকীকা করা। তাবারানী আউসাত হা.১৯৮১

২. শিশুর সুন্দর নাম রাখা। প্রাগুক্ত

৩. পশু জবাইয়ের আগে বা পরে বাচ্চার মাথার চুল মুন্ডানো। তুহফাতুল মাওদূদ বি আহকামিল মাওলূদ পৃ.৮৮

৪. সম্ভব হলে চুলের ওজন সমপরিমাণ সোনা বা রুপা দান করা। প্রাগুক্ত

৫. আকীকার গোস্ত দাওয়াত করে খাওয়ানো। প্রাগুক্ত পৃ. ৭৩

খতনা প্রসঙ্গ

খতনা করা সুন্নাত। এটা ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিয়ার বা নিদর্শন। জন্মের পর থেকে বালেগ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত যেকোনো সময় খতনা করা যায়। তবে সাত বছরের আগে করানো উত্তম ও মুস্তাহাব। ফাতাওয়া আলেম গীরী ৫/৪৩৬

যদি বালেগ হওয়ার পূর্বে কারো খতনা না হয়ে থাকে বা কোনো অমুসলিম বালেগ হওয়ার পর মুসলমান হয়, তাহলে বালেগ হওয়ার পর খতনা করার হুকুম বাকী থাকবে এবং তাকে খতনা করানো হবে যদি তার মধ্যে খতনার কষ্ট সহ্য করার মতো ক্ষমতা থাকে। ইমদাদুল ফাতাওয়া ৪/২৩৮

খতনার পরিমাণ

পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগে যে চামড়া রয়েছে তার অর্ধেকের চেয়ে বেশি কাটা হলে তাকে খতনা বলা হবে। আর অর্ধেক বা তার চেয়ে কম কাটা হলে তাকে খতনা বলা হবে না। সুতরাং যদি কাউকে খতনা করানোর পর তার অগ্রভাগের চামড়া লম্বা হয়ে পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগকে প্রায় ঢেকে নেয়, তাহলে তাকে পুনরায় খতনা করাতে হবে। রদ্দুল মুহতার ১০/৫১৫

প্রচলিত একটি ভুল

অনেক জায়গায় খতনা উপলক্ষে আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশীর জন্য বিরাট আকারে খানা পিনার আয়োজন করা হয় এবং সেখানে ছেলেদের জন্য কাপড়-চোপড় ও হাদিয়া-তোহফা নিয়ে আসা হয়, এসব সুন্নাত পরিপন্থী ও পরিত্যাজ্য । বিখ্যাত তাবেয়ী হযরত হাসান বসরী রহ. বলেন, হযরত উসমান ইবনে আবিল আস রাযি. কে কোনো এক খতনার অনুষ্ঠানে দাওয়াত করা হলো, তখন তিনি তা গ্রহণ করলেন না। পরে যখন তাকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করা হলো তখন তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগে আমরা খাতনার দাওয়াতে যেতাম না এবং আমাদেরকে এর জন্য দাওয়াতও দেওয়া হত না। মুসনাদে আহমাদ হা.১৭৯০৮, তাবারানী কাবীর হা.৮৩৮১, মাজমাউজ জাওয়ায়েদ হা. ৬২০৮

আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে করণীয় কাজগুলি করার এবং বর্জনীয় কাজগুলি বর্জন করার তাওফীক দান করুন। আমীন।